উত্তম পুরুষ – ২৩

তেইশ

সেদিন ঘরে আর কেউ ছিল না। আমি চলে আসছিলাম, সেলিনা বাধা দিল।

–যেও না। দাঁড়াও।

—আমার কাজ আছে।

—তর্ক করো না। মনে আছে সেদিন কি কথা দিয়েছিলে?

—কি কাজ বলো, করে দেব; কিন্তু বসতে পারব না।

—তোমাকে বসতে বলেছি আপাতত এইটেই তোমার কাজ। আমি গা ধুয়ে এখুনি আসছি।

ভয়ানক গরম পড়েছে। গায়ে কাপড় রাখা যায় না। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে, তবু ছটফট করতে লাগলাম। কখন যে তন্দ্রায় চোখ বন্ধ হয়ে গেছে টেরও পাই নি।

বাইরে কতগুলো কুকুর প্রাণপণে চেঁচামেচি আর কামড়াকামড়ি করছে, তারই বিকট শব্দে তন্দ্রা কেটে গেল।

চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলাম।

সামনে সেলিনার ঘরের দরজা খোলা, একটা শুধু পাতলা পর্দা ঝুলছে। এক সময় পর্দাটা হাওয়ায় সরে গেল। সেলিনা প্রকাণ্ড দেয়াল আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রসাধন করছে, আমার দিকে পিঠ। তখনো তার সাজসজ্জা অসম্পূর্ণ। হঠাৎ আয়নাতেই আমার চোখের ওপর তার চোখ পড়ল। কাঁধের ওপর আঁচলটা ভালো করে টেনে নিয়ে সে ঝট করে সেখান থেকে সরে গেল। অল্প পরেই খট করে দরজা বন্ধ করবার শব্দ হলো।

আমি সেখানেই বসে বসে ঘামতে লাগলাম। উৎকট গরম পড়েছে এবার কলকাতায়। পাখাটা পুরো দমে ছেড়েছিলাম; কিন্তু তাও কি গরম কমে!

মিনিট পনের পর সেলিনা বেরিয়ে এলো। ফিরোজা রঙের শাড়ি গায়ে, মুখে যৎসামান্য প্রসাধনের চিহ্ন; কিন্তু সেই অল্প বয়সেও, অথবা হয়তো বয়স অল্প বলেই মনে হলো, এত রূপ বুঝি আর কোথাও দেখি নি, কোথাও কখনো দেখব না।

আমি তবু তেমনি বসেই থাকলাম।

—অমনভাবে বজ্রাহতের মতো বসে আছ কেন? কেউ দেখলে ভাববে ভূত দেখেছ!

বলে সেলিনা একটুখানি হাসল।

—কোথায় যেতে হবে?

—আমি যেখানে যাব।

—সে জাহান্নামটি কোথায়?

সেলিনা হাসল। আশ্চর্য সে হাসি।

—সত্যিই জাহান্নাম। আমি অস্বীকার করব না; কিন্তু তোমাকে আমার সাথে আসতে হবে। আমি যন্ত্রচালিতের মতো উঠলাম।

ট্রাম এসে এসপ্ল্যানেড পৌঁছল। সেলিনা বললো : আমরা যাব খিদিরপুর। কিন্তু তার আগে চলো কে-সি-দের দোকানে বসে কিছু স্পঞ্জ রসগোল্লা খেয়ে নি। কি বলো?

মনে মনে বললাম : আমি তো দোজখে যাবার জন্যই বেরিয়েছি, রসগোল্লা খাব সে আর এমনকি বড় কথা।

তখন যুদ্ধ চলছে। মার্কিন সৈনিকদের আনাগোনায় এসপ্ল্যানেড চৌরঙ্গী ফুটপাত, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্রাম-বাস, পথঘাট সবই জনাকীর্ণ। বোমা পড়ার ভয়ে কলকাতার অধিকাংশ গৃহই তখন গৃহীহীন, এমনকি আমরাও শিগগিরই কলকাতা ত্যাগ করব সেই রকম কথা চলছে। তবে গৃহের বাইরে তেমনি ভিড়।

সেলিনা আমার হাত ধরে এগিয়ে এসেছিল। কে-সি-দের দোকানেও অসম্ভব ভিড়। কোথাও একটা চেয়ারও খালি নেই, অনেকে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এটা-ওটা-সেটা কিনছেন, খাচ্ছেন। একটি কোণে একটি অনভ্যস্ত দৃশ্য চোখে পড়ল; অনভ্যস্তই-বা বলি কেন, এই রকম দৃশ্য একটু একটু করে অভ্যস্ত হয়ে আসছিল। এক বিদুষী বাঙালি-কন্যা এক শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের সঙ্গে বসে একাকী চা পান করছেন। এই দৃশ্যটি আরো একটি কারণে মনে আছে। কচুরি-রসগোল্লা-তরমুজা প্রভৃতি খাদ্যের প্রতি সমুদ্রপারের এই আগন্তুকদের রুচি কেবলমাত্র তখনই দৃষ্টিগোচর হতে শুরু হয়েছে।

সেলিনা বললো : চলো। আমাদের আর খাওয়া হলো না।

তারপর চলতে চলতে বললো : মেয়েটি কে জান? আমার সঙ্গে পড়ত। গোল্লায় গেছে।

—গোল্লায় কি কেবল সে একাই গেছে?

এক পাশে চৌরঙ্গী আর এক পাশে সবুজ মাঠ। ট্রাম হু-হু করে ছুটে চলল। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। এতক্ষণে সেলিনা আমার প্রশ্নের জবাব দিল।

—না। সে একাই নয়। আমিও গেছি।

বলে সে আবার অধোবদন হয়ে বসে থাকল।

আবার সে-ই বললো : তার গলার আওয়াজ সত্যকার অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত হয়ে এলো।

—আমি জানি, আমি যা করছি তা মন্দ, তা অত্যন্ত মন্দ আর গর্হিত। কিন্তু কি যেন হয়, আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারি না। বারবার তার কাছে ছুটে যাই।

—যার কাছে যাও, আর এখনো যাচ্ছ, তাকে আমি একবারই দেখেছি। সে তোমার অযোগ্য।

—তা-ও মানি।

—তবে?

—সে তুমি বুঝবে না।

—আজ তার কাছে না গেলেই নয়?

—আজ তার আম্মা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

—তাঁকে আগে কখনো দেখেছ?

—না। তাঁর আম্মা আছেন কি না, আর কে কে আছেন কিছুই জানি না।

একবালপুর রোডের কাছে এসে আমরা ট্রাম থেকে নেবে পড়লাম। এ-গলি ও-গলি পেরিয়ে আমরা ছোট্ট একটা প্রিন্টিং প্রেসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এমন এক অঞ্চলে সেলিনার কি কাজ থাকতে পারে আমি কিছুমাত্র অনুমান করতে পারলাম না। কড়া নাড়তেই সেলিনার বন্ধু—সেই হাফ শার্ট পরা বন্ধু—দরজা খুলে দিল। সামনে প্রেস—পাশে দুইটি ঘর।

—তুমি এখানেই থাকো না কি?

–হ্যাঁ।

—তোমার আম্মা কোথায়?

—আছেন ভিতরে।

সেলিনা মুহূর্তকাল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। হঠাৎ তার চোখে কিসের যেন সন্দেহের ছায়া নেবে এলো।

আরো দুই দীর্ঘ মুহূর্ত ইতস্তত করে বললো : আচ্ছা চলো।

কিন্তু এ বাড়িতে কোনো স্ত্রীলোক থাকে বলে মনে হলো না। অথচ সেই সেলিনা সেই ছেলেটির আম্মার সঙ্গে দেখা করতে ভিতরে চলে গেল। আমি একটা টুলের ওপর বসে মশা তাড়াতে লাগলাম, তাই সময়টা কেটে গেল।

কতটা সময় যে কেটে গেল জানতেও পারলাম না। অন্ধকার ভয়ানক গাঢ় হয়ে এলো। কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। এক সময় মনে হলো কোথায় যেন একটা আর্ত চিৎকার শুনলাম “না না না”। মনে হলো বহুদিন আগে এক দুঃস্বপ্নে শোনা দূরাগত শব্দ— অথচ অন্ধকারের বুকে এই শব্দটি যেন হাতুড়ি মারতে লাগল।

কিছুটা সময় কেটে গেল। বেশি না। কিন্তু আমার বয়স এক নিমেষে এক যুগ করে বাড়তে লাগল। একটু পরেই সেলিনা বেরিয়ে এলো।

—চলো আমরা যাই।

তার গলার আওয়াজ বাদলের মতো সিক্ত। পিছনের ঘরটিতে একটি হারিকেন জ্বলছিল। খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে যতটা আলো আসে তারই সাহায্যে দেখলাম, সেই ছেলটিও পিছনে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটির পিছনেই বিকট অন্ধকার, তাই তাকে ভালো দেখা যায় না। শুধু সেই অপ্রচুর আলোতে তার মুখের যে ছায়া দেয়ালে প্রতিফলিত দেখলাম তা অত্যন্ত বিকৃত মনে হলো।

আমাদের পিছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।

আমার পা টলছিল, কেন জানি না। এক অজ্ঞাত আশঙ্কায় সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপছিল; এক অনুপলব্ধ বেদনায় চোখের অশ্রু অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল। গলার কাছে এক প্রকার অবর্ণনীয় ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম—গলায় সুপারি আটকে গেলে যেমন করতে থাকে।

সেলিনা নীরবে হাঁটছিল। এক সময় তার দুটি হাত ঝড়ের বুকে ঝরাপাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে আমার দুটি হাত চেপে ধরল। তার পা দুটি এমন ভয়ানক কাঁপছিল যেন ভেঙে পড়ে যাবে।

—ধরো। আমাকে শক্ত করে ধরো। আমি পড়ে যাব। আমার শরীর ভয়ানক খারাপ লাগছে। মাথা ঘুরছে।

—কি হয়েছে?

আমি প্রশ্ন করলাম।

সেলিনা নিঃস্বের মতো উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমারই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি করল : কি হয়েছে।

তারপর দুই হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেই রাস্তার মাঝখানেই হু-হু করে কাঁদতে শুরু করে দিল। কেবল পাগলের মতো বলে যেতে লাগল : বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও, সারা জীবন তোমার কেনা হয়ে থাকব।

সেলিনার অন্যান্য বহু আচরণের মতো তার এ কথারও সঠিক অর্থ বুঝলাম না।

রাস্তার লোক চলাচল কম বটে; কিন্তু তবু মাঝে মাঝে দু’-একটি পথিক বিস্মিত চোখ একবার এদিকে তুলে আবার নিজ নিজ গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু এক মাঝবয়সী লোক এগিয়ে এলেন। তিনি কিছু বলবার আগেই আমি বললাম : আমার বোন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

ভদ্রলোক চলে গেলেন; কিন্তু তবু দু’-একবার ফিরে ফিরে আমাদের দেখতে লাগলেন। আমি তাড়াতাড়ি সেলিনার হাত-ব্যাগ হাতড়ে দেখে নিলাম। হ্যাঁ আছে; ট্যাক্সি ভাড়া আছে।

সারাটা পথ কারো মুখে কোনো কথা নেই। সেলিনা এক পাশে মাথা কাত করে চোখ বন্ধ করে পড়েছিল। মাঝে মাঝে তার গলার ভিতর দিয়ে “ওঃ; ওঃ; ওঃ”—এই রকম এক কাতরোক্তি বেরিয়ে আসছিল।

কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে নিজেকে অনেকটা সামলে নিল।

সেলিনার আম্মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন দেখলেন।

—তোরা এতক্ষণ ছিলি কোথায়?

—সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।

সেলিনা জবাব দিল।

আমি বললাম : মিথ্যে কথা। খিদিরপুরে একটি ছেলের বাসায় গিয়েছিলাম।

সেলিনা ঘুরে দাঁড়াল। তার দুই চোখভরা ভয় আর মিনতি।

আমার দৃষ্টিও কঠোর হয়ে এলো কিন্তু আর একটি কথাও না বলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে চলে এলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *