উত্তম পুরুষ – ২৯

ঊনত্রিশ

মাদারীপুর বেশি দিন ভালো লাগল না। কলকাতার ছেলে মহকুমা টাউনে এসে অল্প দিনেই হাঁফিয়ে পড়লাম। সময় কাটাবার জন্য নদীর তীর ছিল বটে। নদীটাও সুন্দর : অর্থাৎ নদীর নামটি—আড়িয়াল খাঁ। কিন্তু নদীর তীরে পলাতক বালকের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে থাকতে বেশি দিন ভালো লাগল না। সেই রাত্রের ঘটনা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। গোটা ব্রহ্মাণ্ডের বুনিয়াদটাই যেন ধসে গেছে। কোথায় যেন একটা মস্ত প্রকাণ্ড ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে, সেটিকেই খুঁজে পাচ্ছি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে লাঞ্ছিত হয়েছি, সেটাই যেন বড় কথা নয়। বড় কথা এই : সেলিনার পক্ষে কি করে এই সুপরিকল্পিত প্রবঞ্চনা সম্ভব? সে তো নারী। সে ভুল করতে পারে, সে চঞ্চলমতি হতে পারে, তার স্বভাব তাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে; কিন্তু এই শঠতা, অনুষ্ণ মস্তিষ্কের এই শীতল প্রবঞ্চনা তার দ্বারা কি করে সম্ভব হতে পারে? এই হিসাবটাই আমি কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না।

তবু এ কথাও মনে হচ্ছিল, কোন হিসাবটাই-বা মিলেছে? চন্দ্রার? শুরুর সাথে চন্দ্রার শেষের কোনো মিল আছে? চন্দ্রা-জননীর মাতৃ-মূর্তির সাথে সেই অঙ্ক-শায়িনীর কোনো সাদৃশ্য আছে? সেলিনাই-বা তাহলে পৃথক হবে কি করে!

নারীর পরিচয় কি তাহলে এই? অসম্ভব! জীবনের প্রভাতেই অত্যন্ত স্বল্প অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এত বড় একটা প্রশ্নের উত্তর এত সহজে সেরে ফেলতে মন কিছুতেই রাজি হলো না। তবু দুর্ভাগ্যবশত যে অভিজ্ঞতাটুকু হলো, তারই ওপর নির্ভর করে ঢালাও অভিমত দেওয়া যতই অযৌক্তিক হোক, এই বিক্ষিপ্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাটুকুর কাছে কেতাবে-পড়া নারী মূর্তির ছবি নিতান্তই অবাস্তব মনে হচ্ছিল। মনের তখন এমনই সাংঘাতিক ও বিকারগ্রস্ত অবস্থা যে নারী সম্বন্ধে সলিলের যা বক্তব্য তারও মধ্যে কোথায় যেন যুক্তি আছে মনে হচ্ছিল।

আমার মনের এই অসুস্থ এবং নিতান্তই অশোভন বিকার থেকে মুক্ত হতে আমার সময় লেগেছিল।

যাই হোক একদিন আম্মাকে বলেই ফেললাম : এখানে একটুও ভালো লাগছে না। কলকাতায় ফিরে যেতাম; কিন্তু কোথায় গিয়ে উঠব?

—তুই আজকাল কেমন ধারা হয়ে গেছিস। কি হয়েছে রে!

—হবে আবার কি? কাদামাটি ভরা দেশে কতদিন ভালো লাগতে পারে।

—এই কাদামাটির দেশই সত্যকার দেশ। সে যাই হোক, সোনা দিয়ে মোড়া দেশে যেতে চাস!

—যেতে তো চাই; কিন্তু থাকব কোথায়?

—টালীগঞ্জে তোর এক দূর সম্পর্কের ফুপাত ভাই আছে। ফুপাত ভাই-ও ঠিক নয়। বাপ- মা মরা ছেলে, তোর ফুপু মানুষ করেছিল। সে কাঠের ব্যবসা করে। সেখানে গিয়ে থাকবি? তোর ভাবিও লোক খুব ভালো। দেখবি খুব আদর-যত্ন করবে। যাবি সেখানে?

—নতুন লোকের সঙ্গে থাকব, সে আমি পারব না। কেমন বাধ-বাধ ঠেকবে

—তুই যাতো! মেয়েটিকে আমি কয়েকবার দেখেছি—আমাকে ভক্তিও করে খুব— অমন লক্ষ্মী মেয়ে হয় না। দেখবি মাথায় করে রাখবে। দু’দিনেই আপন করে নেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *