উত্তম পুরুষ – ১৩

তেরো

পরদিন খুব ভোরে একটা গোলমাল শুনতে পেলাম; ঘুম গেল ভেঙে। এমন সময় সমস্ত বাড়িটাকে প্রকম্পিত করে আব্বার আওয়াজ ভেসে এলো :-র-ম-জা-ন!

এই ডাকটির সঙ্গে রমজান অত্যন্ত পরিচিত। কেয়ামতের দিনে ইসরাফিলের সিঙাকেও বুঝি সে এত ভয় করবে না। বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে সে আব্বার সামনে এসে দাঁড়ালো।

আব্বার ক্ষুদ্র চোখ দুটি তখন জ্বলজ্বল করছে; রাগে পা টলছে; সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে পরিপূর্ণ মুখের অভিব্যক্তি আরো ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। তাঁর সেই মূর্তির সামনে আসতে অতি বড় সাহসীরও বুক কাঁপবে।

—হারামজাদা, মুরগি কোথায়?

—জি আমি তো জানি না।

এই নেতিবাচক জবাব আব্বার পছন্দ হলো না।

—জি আমি তো জানি না! ব্যাটা ন্যাকা।

আব্বার দৃষ্টি রুক্ষ থেকে হয় রুক্ষতর; পেশিগুলো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর। গত রাত্রেই এই মুরগিটি কেনা হয়েছে। বহু কষ্টের সঞ্চিত উদ্বৃত্ত থেকে এই মুরগিটি কেনা হয়েছে। আব্বা এসেছেন, সাদা কোর্মা রান্না করা হবে। সেই মুরগিটিই সকালবেলা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। গোলমাল করে আব্বা বাড়ি মাথায় তুললেন। শেষ পর্যন্ত স্থির করলেন জীবটির অন্তর্ধানের সঙ্গে নিশ্চয়ই রমজানের কোনো যোগাযোগ আছে।

রমজান আমাদের বাড়ির ভৃত্য। যাকে কন্দর্প বলে, হতভাগা দেখতে তেমন কিছু নয়। রমজানের কদম-ছাঁট কেশগুচ্ছ ওপরের দিকে সাঁড়াশির মতো তোলা; কেশ থেকে অনবরত বহুদিনের পচা মাংসের গন্ধ বের হয়; চোখ দুটি কোটরের মধ্যে এত বেশি ঢোকা যে, আছে কি নেই তাও ঠাহর করে দেখতে হয়।

আব্বার জেরার সম্মুখীন হয়ে রমজান ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।

—কোথায় উঁ? কোথায়?

রমজান নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে। আব্বা তাঁর নীরবতাকে অপরাধের স্বীকারোক্তি বলে ধরে নেন।

এবার এক প্রবল চপেটাঘাতে রমজান ঘুরে পড়ল।

আমি বড্ড দমে গেলাম। সুপ্রভাতে দিনটি শুরু হলো বলা চলে না। আব্বা যে কটি দিন কলকাতায় থাকবেন, সে কটি দিন আমাকে বাড়িতেই থাকতে হবে। সারাটা দিন বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে কম বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা নয়। তাছাড়া আব্বার মেজাজ কখন কেমন থাকে, আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। সবচাইতে মুশকিল, কিসে যে তিনি প্রসন্ন হন আর কিসে রুষ্ট, তা পূর্বাহ্ণে অনুমান করা অসাধ্য।

আজকের দিনটি যে খুব সুদিন হবে না সেটা অন্তত অবধারিত। সারাটা দিন যে কিভাবে কাটবে সেই কথা মনে করে আম্মার পিছনে পিছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

চারপাশে শাক-সবজি, আলু, মাছ আর তারই মাঝখানে বসে আম্মা বঁটি দিয়ে পটল কাটছিলেন! আমিও সেখানেই বসে পড়লাম।

—আব্বার রাগ খুব বেশি, তাই না?

আম্মা এবার মুখ তুললেন। আম্মা আজ খুব সকাল সকাল গা ধুয়ে সারাদিনের জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছেন। একটা ধোপার ধোয়া শাড়িও পরেছেন। গত সন্ধ্যায় তাঁর মুখে যে হাসি দেখি, এখনো তা অপরিম্লান আছে। আম্মাকে যেন আজ এক দৃষ্টিতে দেখলাম। এতদিন আমার ধারণা ছিল আম্মা বুঝি দেখতে ভালো নয়। মুশতাকের আম্মা আর নিজের আম্মাকে কল্পনায় পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে একটা তুলনামূলক বিচারও করে নিয়েছি। এই বাজিতেও আমি মনে মনে মুশতাকের জিত মেনে নিয়েছি। সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে আমি বরাবর কেবল এই মোনাজাতই করেছি, মুশতাক বা সেলিনা বা তাদের মা যেন কোনোদিন আমাদের বাড়ি না আসে; আমার আম্মাকে পরীক্ষকের দৃষ্টিতে দেখবার সুযোগ যেন তাদের কোনোদিনই না হয়।

কিন্তু এই মুহূর্তে এক অভাবিত আবিষ্কারে আমার মন যুগপৎ বিস্ময়ে ও আনন্দে ভরে গেল। কে বলে আম্মা দেখতে ভালো নয়। এই মুহূর্তে মুশতাকের আম্মা একবার দেখে গেলে পারতেন।

আম্মা বঁটির ওপর থেকে মুখ তুললেন। তারপর কতকটা যেন আনমনেই বলে গেলেন :

—ওঁর মেজাজ! এখন আছে তো এখন নেই।

—আচ্ছা আম্মা! তুমি রোজ ফর্সা জামা-কাপড় পর না কেন?

আম্মা যেন হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়লেন। তারপর কতকটা সামলে নিয়ে বললেন :

—তুই যখন রোজগার করে এনে দিবি, তখন দেখবি রোজ ফর্সা জামা-কাপড় পরব।

সে কথায় আমি কান দিই না। পুনশ্চ বলি :

—মুশতাকের আম্মা সবসময় কেমন ফিটফাট থাকেন।

আম্মার মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল! সে এক মুহূর্ত মাত্র। তারপর হাঁটুর ওপর চিবুক নাবিয়ে

এনে তিনি তাঁর মুখের হাসি গোপন করতে চেষ্টা করলেন।

—মুশতাকের আম্মা যদি তোর আম্মা হতেন, তাহলে তুই খুব খুশি হতিস—তাই না!

—যাঃ। তাই বই কি। তা নয়। কিন্তু…

আমার মুখে আর কোনো কথা যোগালো না। এক নব আবিষ্কারের বিস্ময়ে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই এক নিদারুণ ধিক্কার বোধে আমি অধোবদন হয়ে গেলাম। বস্তুত এইমাত্র আম্মা যে-কথাটি বললেন, সেই কথাটি ঠিক সেইভাবে কখনোই আমার মনে আসে নি। কিন্তু এখন হঠাৎ কথাটি শুনে আমার মনে হলো, কথাটি যে ঘুণাক্ষরেও মনে আসে নি তা নয়। হঠাৎ এক দুস্তর লজ্জায় মাথাটা আপনা থেকেই নিচু হয়ে গেল।

আম্মা আড় চোখে আমাকে দেখছিলেন। এবার হাসতে হাসতেই বললেন :

—কি রে! মুখে যে কোনো কথা নেই। যা বললাম ঠিক না?

আমি মাথা নিচু করে বসেই থাকলাম। হঠাৎ দু’চোখ প্লাবিত করে অশ্রুর বন্যা নেবে এলো।

আম্মা দু’হাত দিয়ে আমাকে কোলের ওপরে টেনে নিলেন। বললেন :

—আচ্ছা পাগল ছেলে তুই যা হোক।

অনেকক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। এক সময় আমিই বললাম—কিছুতেই কি আর গলা থেকে কথাগুলো বেরুতে চায়। তবু শুরু করলাম :

–সে দিনের সেই দুটি টাকা—

কিছুতেই কথা শেষ করতে পারলাম না।

আম্মা তেমনি হাসতে হাসতেই বললেন :

—তুই থাম তো। বকবক করিসনে। আমার হাতে অনেক কাজ।

বলেই আম্মা উঠে পড়লেন। তক্তার ওপর থেকে একটা মাটির হাঁড়ি নাবিয়ে কি সব নাড়াচাড়া করতে লাগলেন।

টাকার প্রসঙ্গ যে এখানেই শেষ তা বুঝলাম। সিদ্ধান্ত আমার পক্ষেও কিছুমাত্র অরুচিকর মনে হলো না।

এবার আমিও উঠে পড়লাম।

কিন্তু খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে আবার রান্নাঘরেই এসে উপস্থিত হলাম। বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকলে এছাড়া আর উপায়ই-বা কি! আব্বা একটা প্রকাণ্ড ইজি-চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর দুই পাশে দুটি মোড়ার ওপর বড় ভাই আর মেজ ভাই বসে অপেক্ষা করছিলেন।

অপেক্ষা আর কিছুরই নয়।

বহুদিন পর কলকাতা ফিরে এলে আব্বা ছেলেদের কাছে ডেকে এনে তাঁর অবর্তমানকালের যাবতীয় ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনতে চান। ইজি-চেয়ারে শুয়ে কখনো বড় ভাইকে একটি প্রশ্ন করেন, আবার কখনো মেজ ভাইকে একটি প্রশ্ন করেন। তাঁরা যে সময়টায় জবাব দিতে থাকেন সেই অবসরে আব্বা চোখ মুদে হুঁকোর নলে টান দিতে থাকেন এবং তারই মাঝে আরো দু’-একটা অতিরিক্ত প্রশ্ন করে জ্ঞাতব্য তথ্যের মধ্যে কোথাও কোনো রন্ধ্র থাকলে তাও পূর্ণ করে নেন।

আজও দেখলাম আব্বার দুই পাশে দুটি মোড়ায় বসে বড় ভাই আর মেজ ভাই তাঁদের জবানবন্দি দিচ্ছিলেন। প্রশ্নোত্তরের সময় বড় ভাইয়ের আচরণ অনেকটা স্বচ্ছন্দ; কিন্তু বেচারা মেজ ভাইয়ের করুণ মুখভাব দেখে আমার চিত্তও আর্দ্র হয়ে উঠল।

আমি আর ওদিকে ভিড়তে সাহস করলাম না। আমাকে অবশ্য কখনোই এই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় নি; হলে নির্ঘাত ফেল করতাম। কারণ আব্বার সব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকার নয়, আর থাকলেও সে উত্তর আব্বার কাছে কিছুতেই সদুত্তর বলে মনে হতো না। কিন্তু এখন তো আমি বড় হয়েছি। পাছে আমাকে দেখলে তিনি আমাকেও ডাক দেন, সেই ভয়ে আম্মার কাছে নিরাপদ কোণে ফিরে এলাম।

আম্মা জিজ্ঞাসা করেন:

—আবার কি চাস? এখানে ফিরে এলি কেন? যা না তোর আব্বা এসেছেন, তাঁর কাছে গিয়ে একটু বস না। কত খুশি হবেন।

আমি সে কথার কোনো জবাবই দিলাম না। সামনেই একটা মিঠা আলু পড়ে ছিল, তাই নাড়াছাড়া করতে লাগলাম। কিছুকাল নীরবতার পর যখন আমি কথা বললাম, প্রসঙ্গ তখন একেবারেই ভিন্ন।

—আমরা বড় গরিব, তাই না?

ফের সেই কথা। তুই সবসময় গরিব গরিব করিস কেন রে? কিসে গরিব? তোর আব্বা শুনতে পেলে কত কষ্ট পাবেন জানিস?

আমি আমার পূর্ব উক্তিরই সূত্র ধরে আবার বললাম :

—বাড়িতে সাবান দিয়ে কেচে নিয়েও তো তুমি ফর্সা জামা-কাপড় পরতে পার। তাই কেন কর না?

–কেন আবার। ইচ্ছে করে না তাই।

–ইচ্ছে কেন করে না?

—যা যা পালা। বকাস নে। মার খাবি।

আব্বা যে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, একেবারেই টের পাই নি। হঠাৎ খুব কাছে থেকেই সিগার আর জবাকুসুম তেলের গন্ধ ভেসে এলো। এ গন্ধ সুগন্ধই যেমন লোবানের গন্ধও সুগন্ধ; কিন্তু কেমন করে যেন মওতের কথা মনে করিয়ে দেয়। অন্তত আমাকে। আমি কাঠ হয়ে বসে থাকলাম। সকালবেলার রুদ্র মূর্তির কথা মনে পড়ে গেল।

আমি অচৈতন্যের মতো তেমনি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম; গলায় শব্দ নেই, শরীরে এতটুকু কম্পন নেই। যেন পাষাণ হয়ে গেছি।

পিছনের ছায়া তেমনি নীরবে সরে গেল। খড়মের আওয়াজ একটু একটু করে দূরে চলে গেল। এইবার আমি মুখ তুললাম।

—ওঁকে দেখে তোরা অমন কাঠ হয়ে যাস কেনরে?

আম্মার কণ্ঠ অত্যন্ত কঠিন।

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই তিনি উঠে চলে গেলেন।

অপেক্ষা করলেও অবশ্য সেদিন উত্তর দিতে পারতাম না। বাড়ির অভিভাবকের অশেষ স্নেহ শুভেচ্ছা আর কল্যাণ কামনা সত্ত্বেও তাঁকে এড়িয়ে চলার এই যে একটা প্রবণতা, এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সহজ না হলেও, ব্যাখ্যা একটা থাকেই! শৃঙ্খলা বস্তুটি সভ্য জীবনযাত্রার পথে সম্পূর্ণ অপরিহার্য হলেও মানুষের আদিম প্রবৃত্তি বোধ করি বিশৃঙ্খল থাকতেই ভালোবাসে। সকাল হলেই হাতমুখ ধুয়ে নাস্তাপানি খেয়ে পড়তে বসতে হবে এবং রাত ন’টা বাজতেই বিছানায় যেতে হবে এই বাধ্যবাধকতাটুকু মোটেই রুচিকর ঠেকে না। সকাল ন’টা পর্যন্ত ঘুমুতে পারলেই এবং রাত ন’টার পর পড়াশোনা শুরু করতে পারলেই, অন্তত সেই স্বাধীনতাটুকু থাকলেই আমরা যেন খুশি হই। কিন্তু বাড়িতে আব্বা থাকলে সেটি হবার জো নেই। যখন খুশি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব, সারাটি রাত বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়ে আসব, রৌদ্র-দগ্ধ দুপুরে ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে ছাতে উঠব, এসব কিছুই হবার উপায় নেই।

অবশ্য অন্য কারণও ছিল।

আমাদের অভিভাবক অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। এককালে, তাঁর বাপদাদার আমলে, আব্বার সামাজিক মর্যাদা শিখরে ছিল। চতুর্দিক থেকে সকলেই এত সম্মান প্রদর্শন করত যে, সেই অফুরন্ত উপঢৌকনের ফলে সম্মানিত হওয়া তাঁর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এর যে অন্যথা হতে পারে, ব্যতিক্রম ঘটতে পারে সে ছিল তাঁর কাছে অচিন্তনীয়। অথচ একদিন চাকা গেল ঘুরে—দাদার মৃত্যু হলো। আব্বাকে চাকরি নিতে হলো। অপেক্ষা করবার উপায় ছিল না। হাতের কাছে যে চাকরি পাওয়া গেল, হাত পেতে তাই নিতে হলো।

অথচ তাঁর এই পদমর্যাদা তাঁর সামাজিক মর্যাদার সমতুল্য ছিল না। বংশ-পরম্পরায় সঞ্চিত মর্যাদার ভাণ্ডার অপর্যাপ্ত হলেও অফুরন্ত হয় না! একদিন সে ভাণ্ডারও শূন্য হয়। এই পরিবর্তনটুকু কেবল যে মর্মান্তিক তাই নয়, অনেকের পক্ষেই এই পরিবর্তন স্বীকার করে নেয়া সহজও নয় সম্ভবও নয়।

একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে আব্বা তেমন কিছু উচ্চপদস্থ ছিলেন না; কিন্তু তবু একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাঁর হাতে যে ক্ষমতা ছিল তাও তুচ্ছ নয়। তার চোখের ঈষৎ কম্পনে শত শত অপরাধীর হৃৎকম্প হতো, কলমের এক একটি আঁচড়ের ফলে আসামি মুক্তির নিশ্বাস ফেলত বা কয়েদ হতো। তাই আব্বার ব্যক্তিত্বে এক প্রকার হাকিমী—নৈর্ব্যক্তিকতা ছিল যা কাছে টানত না, দূরে সরিয়ে দিত। অবশ্য অনেক সময়ই স্ত্রী-পুত্রের সান্নিধ্যে এই নৈর্ব্যক্তিকতার পর্বত সূর্যের সান্নিধ্যে বরফের মতো গলে যেত। সে দৃশ্য দুর্লভ হলেও এবং দুর্লভ বলেই, আমাদের সকলের চোখই সিক্ত করে দিত।

চাকরি জীবনের শেষের দিকে তিনি একটা মহকুমার শাসন ভার পেয়েছিলেন। কিন্তু যেদিন তিনি শাসনভার একজন ইংরেজ আই-সি-এস কর্মচারীকে বুঝিয়ে দিয়ে অবসর ভোগ করতে কলকাতা চলে এলেন, সেদিন তাঁর চোখে পানি। শ্বাসরুদ্ধকর খাটুনির মাঝে মাঝে খোদার কাছে তিনি বরাবরই এই মোনাজাত করেছেন এমনি শান-শওকতের মধ্যেই যেন তাঁর জীবন শেষ হয়। ট্রেন ছাড়বার প্রাক্কালে উর্দিপরা আরদালি, ইউনিফর্ম-পরা কনস্টেবল এবং অন্যান্য অধীন কর্মচারী প্লাটফর্মের ওপর ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। সকলের মুখেই বিদায়বেলার বেদনার ছায়া। আব্বার মুখে রিক্ততার পাণ্ডুরতা। ট্রেন ছেড়ে দিল। আরদালি বললো : হুজুর সালাম। কনস্টেবল দিল স্যালুট।

আব্বার চোখে পানি। সব শেষ। আরদারি সালাম, কনস্টেবলের স্যালুট, সব শেষ। বাকি জীবনটা কি নিয়ে থাকবেন? আদালত নেই, আসামি নেই, মামলা-মোকদ্দমা কিছুই নেই। জীবনটাই যে নিঃশেষ হয়ে গেল।

অবসরপ্রাপ্ত হাকিমকে কেউ আর ভয় করে না। পথের যে-কোনো লোকের একজনের মতোই সাধারণ লোক বলে মনে করে। যে ব্যক্তি পূর্বে দশ হাত দূরে থেকে সালাম করত, এখন পাশ দিয়ে যাবার সময়, পথের ওপর অত্যন্ত ঘটা করে পানের পিক্ ফেলে একবার জিগ্যেস করে :

—কি, মৌলবী সাহেব কেমন আছেন?

নিয়তির এই নিদারুণ পরিহাসকে হাসিমুখে মেনে নিতে পারে ক’জন। বাইরে বিড়ম্বিত হয়ে, অন্দরে বিড়ম্বনার সৃষ্টি করাই অধিকাংশ লোকের অভ্যাস হয়ে যায়। তাদের শক্তির সমারোহ শুরু হয় বাড়িরই লোকজনের ওপর, নির্ভরশীলদের ওপর। তখন বাড়ির কুকুরটি পর্যন্ত ঘেউ ঘেউ করতে সাহস করে না—টিকটিকিগুলো আওয়াজ করতে ভয় পায়—ঘড়ির টিকটিক শব্দ এক প্রচণ্ড বেয়াদবির মতো মনে হয়।

আব্বা কিন্তু জায়নামাজে বসে খোদাকে ডাকতে থাকেন। এক নীরব নিঃসঙ্গ কোণে নিজের একটি জগৎ সৃষ্টি করে নেন। মাঝে মাঝে সেখানে আম্মাকে ডেকে নিয়ে বিগত দিনের সুখ- দুঃখের কথা আলোচনা করেন।

কিন্তু এ আমি কি করছি।

অনেক পরের কথা অনেক আগেই বলে ফেলছি।

সেদিন বিকেলেই এক কাণ্ড হয়ে গেল।

রমজান এসে খবর দিল :

—ছোটবাবু, আপনার কাছে দোস্ত এসেছে।

–লোক এসেছে? আমার কাছে? বাড়িতে আব্বা থাকতে? কে? কেমন লোক?

—তা জানিনে বাবু। লম্বা পানা দেখতে। দহলিজে বসে সিগ্রেট খাচ্ছে।

সিগ্রেট খাচ্ছে! আমার বন্ধু!

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসি। এসে দেখি সলিল বসে আছে।

—আমার মাসিমা তোদের পাড়াতেই থাকেন। দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভাবলাম একবার তোর এখান থেকেও ঘুরে যাই।

আমার মুখ চুন। গলায় রা নেই।

বেশ কিছুটা সময় বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে এক সময় কোনোমতে বললাম :

—তোর সিগারেটটা ফেলে দে না ভাই। এখুনি হয়তো বাবা এসে পড়বেন।

সলিলের পরনে ফিনফিনে ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি, মাথার মাঝখান থেকে কাটা লম্বা টেরি। হাতে আঙুলের ফাঁকে একটা জ্বলন্ত সিগারেট, যার গন্ধ হয়তো এতক্ষণে অন্দরমহলে আব্বার নাসিকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

সলিলকে আজ এইভাবে এখানে উপস্থিত দেখে আমার কেবলই মনে হতে লাগল, তার সঙ্গে বন্ধুত্বের কোনো সন্তোষজনক কৈফিয়তই আমি আব্বাকে দিতে পারব না।

সলিল একবার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। জানালার ভিতর দিয়ে সিগারেটটাও ছুঁড়ে ফেলে দিল; কিন্তু তারপর পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে দিব্যি গুছিয়ে আরাম করে বসল।

এদিকে আমার হার্ট-প্যালপিটেশন শুরু হয়ে গেছে।

সলিল আর একটিবারও আমার দিকে ভ্রূক্ষেপ করল না। তার দুটি চোখের দৃষ্টি জাহাজের সন্ধানী আলোর মতো কামরাটির চতুর্দিকে কখনো-বা পর্দার ফাঁক দিয়ে অন্দরমহল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে লাগল। পর্দার ফাঁক দিয়ে ভিতরে যতদূর দেখা যায়, বারবার দেখতে লাগল।

এমন সময় আমার নাকে জবাকুসুম তেল আর সিগারের গন্ধ আবার ভেসে এলো। আমার হৃৎপিণ্ড বুকের ভিতর কাটা ছাগলের মতো আছাড় খেতে লাগল।

সলিল হঠাৎ জিগ্যেস করল :

—তোদের বাসায় কে কে আছে রে?

—আমার মা, বাবা আর ভাইরা।

—তোরা ক’ভাইবোন?

—তিন ভাই শুধু।

— বাস্!

হঠাৎ সলিল উঠে পড়ল।

—চলি। অনেক কাজ আছে। আরো দু’একটি বাড়ি যেতে হবে।

বলেই সে হনহন করে বেরিয়ে গেল।

ঠিক সেই মুহূর্তে পর্দা তুলে আব্বা ঘরে ঢুকলেন।

—ছেলেটি কে?

—আমার ক্লাস-ফ্রেন্ড।

—ক্লাস-ফ্রেন্ড! হারামজাদা। ইয়ার আর খুঁজে পাও নি।

বলা বাহুল্য, তারপর আমার যে-অভ্যর্থনাটি হলো সেটিকে ঠিক উত্তম পুরুষের উপযোগী বলা যায় না।

দু’তিন দিন পর।

অন্তর্হিত মুরগিটিকে কলাগাছের তলায় মৃতাবস্থায় পাওয়া গেল।

কলাগাছের বাগানে সাপেরও উপদ্রব ছিল। হয়তো সর্পদংশনই মুরগিটির মৃত্যুর কারণ। তার ওপর কুকুর-বিড়ালের নখের আঁচড়ে মুরগিটির সর্বশরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। রক্ত ও পালকশূন্য মৃত মুরগিটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে।

আব্বা বুঝলেন, এ মানুষের কাজ নয়।

রমজান শয়তান হলেও এতটা শয়তান হতে পারে না।

অত্যন্ত মোলায়েম ও অশ্রু ভারাক্রান্ত কণ্ঠে আব্বা ডাক দিলেন :

—রমজান!

এই আহ্বানও রমজানের সুপরিচিত।

—জি হুজুর, যাই।

আব্বা গভীর কণ্ঠে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন :

—তোকে মিছিমিছি মেরেছিলাম রে!

তৎক্ষণাৎ মুনিবের পায়ের ধুলো মাথায় ঠেকিয়ে একগাল হেসে রমজান জবাব দিল :

—ছিঃ হুজুর। দুঃখ করবেন না। তার বদলে আর একটি থাপ্পড় মারুন। খোদার কাছে

হাজার শুকুর, আপনার মতো মুনিব পেয়েছি।

—নে নে এই দুটো টাকা নে। বায়োস্কোপ দেখবি

দ্রুতপদে রমজান সেখান থেকে পালালো। অবশ্য তার আগে দ্রুততর হস্তে টাকা দুটি পকেটস্থ করতে ভুল করে নি।

সেদিন দুপুরে আব্বা খেতে বসেছেন।

আম্মা দস্তরখানের সামনে বসে হাত পাখা নাড়ছেন। এক সময় আম্মা বললেন :

—রমজান কি বলছিল জানেন?

মুখের মধ্যে এক লুকমা ভাত পুরতে পুরতে আব্বা জিগ্যেস করেন :

—কি বলছিল?

—বলছিল, আপনি যদি রোজ ওকে একবার করে মার দেন তো ও খুশি হয়।

–সে কি! কেন?

—দুটো করে টাকা বকশিশ পাওয়া যাবে।

—বলেছে! হারামজাদা বলেছে। র-ম-জা-ন!

আম্মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি গোপন করলেন।

আজ আব্বা চলে যাচ্ছেন।

বাইরে ফিটন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কোট-প্যান্ট-হ্যাট পরে আব্বা তৈরি হয়ে নিয়েছেন। ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে। বিরাট দেহ, বিশাল ছাতি, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব; কিন্তু এই মুহূর্তে আব্বাকে আমার চাইতেও অসহায় আর দুর্বল মনে হচ্ছিল। আলনার ওপর থেকে ছড়িটা টেনে নিলেন। তারপর আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন :

—রোদে রোদে ঘুরে বেড়ানে বাবা। কত রোগা হয়ে গেছিস্।

আর কিছু বলতে পারলেন না। কেবল আমার দুই গালের ওপর চুমু খেলেন। কান্নার ঢেউ এসে আমার গলার কাছে আছাড় খেতে লাগল। মনে মনে বারবার বলতে লাগলাম : আমি বাইরে যেতে চাই না, বন্ধুদের বাড়ি রাত কাটাতে চাই না, আমি কিছুই চাই না, কেবল চাই আব্বা বরাবর আমাদের সঙ্গে থাকুন।

এক পা এক পা করে আব্বা দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। কিছুতেই তাঁর পা উঠতে চায় না। এইবার আবার আমাদের দিকে ফিরে আম্মাকে উদ্দেশ করে বললেন :

—আব্বাসের মা চলি। খোদা হাফেজ। যাই।

আম্মার গলা থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে :

—খোদা হাফেজ।

ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। জানালার গরাদ ধরে আমি আর আম্মা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, জানালার বাইরে শূন্য দৃষ্টি মেলা। যেন ঘোড়ার ক্ষুরের মিলিয়ে যাওয়া শব্দটুকুর দিকেই তাকিয়ে আছি। সেইটুকুই ধরে রাখতে চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *