উত্তম পুরুষ – ২৭

সাতাশ

পরীক্ষা এসে পড়ল বলে। এ সময়টা একটু পড়াশোনা না করলে অলৌকিক প্রভাবেও পাশ করতে পারব না। তাই বই-পত্রগুলো এইবার একটু নাড়াচাড়া করতে লাগলাম, ক্লাসে ও নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করলাম। আমাদের ক্লাসেই ছাত্রের সংখ্যা এত বেশি যে ভালো করে পড়া শোনাই যেত না। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র শেখরই কলেজে আমার সহপাঠী। সে ছাত্র ভালো—তার পড়াশোনা করবার কথা আরো বেশি। অথচ বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি, পড়াশোনায় তার মন তো নেই-ই, সে অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বস্তুত কোনো জিনিসেই তার মন নেই। কলেজে আসে-যায়, কিন্তু কি যে পড়ানো হচ্ছে, কবে যে পরীক্ষা এ সমস্ত বিষয়ে তার হুঁশ আছে বলেই মনে হয় না। তার মাথার চুল একটু একটু করে বড় হয়ে একেবারে ঝাঁকড়া হয়ে গেছে। মুখও মলিন; সবসময়ই কেমন নিরুৎসাহ ক্লান্ত

একদিন তাকে জিগ্যেস করলাম—

—কিরে তোর হয়েছে কি বলত?

–কেন? –কিছুই না।

—কিছু না বললেই আমি শুনলাম আর কি। তোকে বলতেই হবে কি হয়েছে।

অনেক পীড়াপীড়ি করবার পর শেখর বললো—

—আমার বাবার চাকরি গেছে।

শেখরের বাবা কি চাকরি করতেন কোথায় থাকতেন সে-সব আমি কিছুই জানতাম না।

তাঁকে কোনোদিন আমি চোখেও দেখি নি; কিন্তু তাই বলে এই ‘চাকরি চলে গেছে কথাগুলোর অর্থ বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় নি।

–তোদের এখন চলছে কি করে?

—চলছে আর কোথায়? একটি একটি করে মা-র যৎসামান্য গহনা যা ছিল তাও শেষ হয়েছে।

—বলিস কিরে। খাওয়া-পরা চলছে কিভাবে?

—চলছে না!

—দাঁড়া। যাচ্ছিস কোথায়?

এবার শেখরের চোখে চোখ রেখে আবার প্রশ্ন করি :

—একটি সত্য কথা বলবি? আজ তোর খাওয়া হয় নি, তাই না?

—না। চন্দ্ৰা, মা আমি কেউ খাই নি।

শেখরকে আর কিছুতেই ধরে রাখা গেল না।

আমি হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকলাম। বস্তুত আমাদের নিজের অবস্থা যে এর চাইতে বিশেষ কিছু ভালো তা নয়। তবু বাড়িতে এখনও হাঁড়ি চড়ে। আব্বার চাকরিও বজায় আছে। বন্ধুর জন্য কষ্ট হচ্ছিল খুব। কিন্তু আমি কতটুকুই করতে পারি, কিইবা করতে পারি। বারবার চন্দ্রার মুখ মনে পড়ছিল। সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটির ওপর অনাহারের মালিন্য কল্পনা করে যারপরনাই ক্লেশ বোধ করছিলাম। তার সেই চওড়া লাল পেড়ে শাড়িটা কেমন করে যেন আগুনের মতো চোখের সামনে ভাসছিল। চন্দ্রার সঙ্গে সামান্য পরিচয়; কিন্তু স্থির জানতাম, এ মেয়েটি মুখ ফুটে কিছুই চাইবে না। এমনি করে ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরবে, তবু চাইবে না কিছু। হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার চোখের কোণের উজ্জ্বল হাসিটুকু তেমনি অপরিম্লান থাকবে।

চন্দ্রা বলেছিল সে তার বিপদের দিনে আমাকে ডাকবে। কিন্তু সে এখনো আমাকে ডাকে নি। ডাকলেই-বা আমি কি করতে পারি। একটি ক্লাস শেষ হলো, ঘণ্টা পড়ল। বাড়ি ফিরে এলাম। মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল।

পরদিন কলেজে এসে দেখি শেখর তার নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসে আছে। তার মাথার চুল বেশ পরিপাটি করে সিঁথি করা। এমনকি গায়েও নতুন জামা-কাপড়। যা সবচাইতে আশ্চর্যের কথা, তার মুখে হাসি।

আমিও একটু হেসেই বললাম :

—কি হে শেখর কুমার। তোমাকে যে আজ চিনতেই পারছি না। ব্যাপারস্যাপার কি?

—তামাসা রাখ। কাল বাবা ফিরে এসেছেন।

—ফিরে এসেছেন। এতদিন ছিলেন না বুঝি?

—না। চাকরি যাবার পর যে ক’টা দিন হাতে টাকা-কড়ি ছিল, তিনি বাসাতেই থাকতেন। যেদিন মা-র হাত খালি হয়ে গেল, বাবাও নিরুদ্দেশ হলেন। কাল ফিরে এসেছেন। সলিল ধরে নিয়ে এসেছে।

—সলিল! সে আবার কোথা থেকে এলো।

—বাঃ সে-ই তো বাবাকে ধরে নিয়ে এলো। ছেলেটি সত্যিই দেবতুল্য। আমাদের জন্য অনেক করেছে।

আমি শেখরের উচ্ছ্বাসে বাধা দিলাম না। জানি সে নিজেই বলে যাবে।

শেখর বলে গেল :

—গতকাল সলিল কোথা থেকে এসে উপস্থিত। সঙ্গে বাবা। তারপর বাড়িঘরদোরের অবস্থা দেখে সলিল একেবারে ক্ষেপে গেল। রান্নাঘরটি পর্যন্ত তন্নতন্ন করে দেখে এলো। তারপর হঠাৎ উধাও। ঘণ্টাখানেক বাদে একটা ট্রাকে করে দু’মন চাল, চিনি, ময়দা, ডাল, কয়লা আরো টুকিটাকি কত জিনিস যে নিয়ে এলো। মা, চন্দ্রা আর আমার জন্য পরনের কাপড়টা পর্যন্ত ভুলে যায় নি। তাছাড়া বিছানার চাদর-গেলাফ কত কি। যাবার আগে মা-র হাতে একশ’ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলে গেল : আপনাদের ভার আমার। আমি মাঝে মাঝে আসব, খোঁজ-খবর নেব। যখন যা দরকার চাইতে লজ্জা করবেন না।

তাছাড়া বাবার জন্য সে একটা চাকরিও ঠিক করে দেবে বলেছে। বলে কি না, যুদ্ধের বাজারে চাকরির অভাব!

দু’তিনদিন পর শেখরের মুখ আরও উজ্জ্বল দেখলাম। পাশে বসতেই আমার হাত ধরে বললো :

—এতদিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। বাবার একটা চাকরি হয়েছে। তিনশ’ টাকা মাইনে। সলিলদেরই ফার্মের কাজ। তবে বাবাকে সবসময়ই বেহালায় থাকতে হবে! সলিল এমনিতে খুব ভালো; কিন্তু কাজের বেলায় বড্ড কড়া লোক। বাবাকে কাজের কথা জানিয়ে বললো : কাকাবাবু কাজ তো হলো। কিন্তু কলকাতা থেকে যাতায়াত করলে তদারক করতে পারবেন না। আপনাকে বেহালাতেই থাকতে হবে। আপনি বরঞ্চ শনিবার রোববার বাড়ি আসবেন। এ কথাটা আপনাকে বলতেই হলো : ওয়ার্ক ইজ্ ওয়ার্ক!

বাবা শুনে বললেন :

এই তো চাই বাবা। এই রকম কর্তব্যনিষ্ঠা সকলের থাকে না বলেই বাঙালিরা ব্যবসা করতে শিখল না। বেশ তাই হবে, আমি বেহালাতেই থাকব। শেখরের সব কথা আমার কানে যাচ্ছিল না। মোটের ওপর তাদের অবস্থা ফিরেছে এইটুকু অবশ্য বুঝলাম। আমার ডান কানটা কদিন ধরেই ব্যথায় টনটন করছিল, হয়তো পেকেই গেছে। তাই একটু অন্যমনস্ক হয়েই জিগ্যেস করলাম :

—চন্দ্ৰা কেমন আছে?

—চন্দ্ৰা ভালোই আছে! একজোড়া নতুন শাড়ি পেয়ে তার আনন্দ আর ধরে না। সে এখন সারাদিন ধরে সলিলের জন্য উলের সোয়েটার বোনে। সেদিন সলিল এক পাউন্ড উল নিয়ে এসে উপস্থিত। মা-কে গিয়ে বললো : মাসিমা, আবার বড় সাধ হয় চন্দ্রা আমার জন্য একটা সোয়েটার বুনে দিক। মা বললেন : বেশ তো বাবা। সে আর অমন বড় কথা কি!

সেদিন থেকেই চন্দ্ৰা দিন নেই রাত নেই কেবল সোয়েটার বুনছে।

আমার কানের ব্যথাটা বড়ই অসহ্য ঠেকছিল। আমি শেখরকে বাধা দিয়ে বললাম :

—আমার শরীরটা ভালো নেইরে। এই পিরিয়ডটা শেষ হলেই বাড়ি যাব।

ক’দিন কানের ব্যথায় খুব ভুগলাম। কিছুদিন কামাই করবার পর যেদিন কলেজে এলাম, সেদিন আবার যথাস্থানে শেখরকে বসে থাকতে দেখলাম। আজ আবার শেখরকে কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছিল। সে বললো :

—ক’দিন আসিস নি কেন? কানের ব্যথা বেড়েছিল।

—হ্যাঁ। তোরা সব ভালো?

—না ভাই। পরশু রাতে একটা বিশ্রী কাণ্ড ঘটে গেছে। আমাদের বাসার পাশেই এক ভদ্রলোক থাকেন, ইছাপুরে কাজ করেন… ভালো কথা। তুই তো তাঁকে চিনিস। আমি কালীবাবুর কথা বলছি। পরশু রাতে কি হয়েছে জানিস। রাত তখন এগারোটা হবে বোধ করি। মা বাড়ি ছিলেন একেবারে একা। বাবা বেহালায় থাকেন, সেতো তুই জানিস। কালীবাবু করেছেন কি, রাত এগারোটায় মদ খেয়ে এসে মা’র ঘরের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করে দিলেন। ভাগ্যিস, মা ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। সে কি ধাক্কা। দরজার অবস্থাটা একবার দেখলে তুইও অনুমান করতে পারবি। মনে হয় বাঘ যেন তার থাবা দিয়ে আঁচড় কেটেছে। চেঁচামেচিতে পাড়াসুদ্ধ লোক উঠে এলো। আর তুই শুনে অবাক হবি কালীবাবুকে কেউ বিশেষ কিছু বলল না। পাড়ার সব লোকই তার কাছে কোনো না কোনোভাবে ঋণী; এমন ছোটলোকদের পাড়া…। আমরা ভাবছি অন্য কোথাও উঠে যাব।

আমি সেসব কথার কোনো জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলাম—

–তোর মা একা কেন। তুই আর চন্দ্রা ছিলি কোথায়?

—আমরা সলিলের সঙ্গে ন’টার শো-এ ‘চিত্রায়’ সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। কিছুতেই ছাড়ল না।

—ওঃ তাই বল।

—ভারি বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটে গেল তাই না?

–হ্যাঁ তাতো বটেই। তোরা কেন বেহালায় তোর বাবার কাছে গিয়ে থাকিস্ না।

—হ্যাঁ তাই থাকব। কিন্তু বাড়ি পাওয়া যায় না। তাছাড়া বাবা প্রায়ই থাকেন না। তাঁকে মফস্বলে ঘুরে বেড়াতে হয় কি না।

—চন্দ্রার সোয়েটার বোনা হলো?

—হ্যাঁ প্রায় শেষ করে এনেছে। এটা হয়ে গেলেই তোর জন্য একটা ধরবে। সেদিন বলছিল।

—আমি গরিব মানুষ। এক পাউন্ড উল পাব কোথা থেকে।

—দূর বোকা তোকে দিতে হবে না। চন্দ্রার হাতে অনেক টাকা।

—চন্দ্রার হাতে অনেক টাকা! সে টাকা পেল কোথায়?

—আর বলিস নে! ঐ সলিলটাই জবরদস্তি দিয়ে যায়। মার হাতেও জোর করে যখন-তখন টাকা গুঁজে দিয়ে যায়। বলে কি না, চন্দ্রা আমার খাজাঞ্চি!

—সে তো সলিলের গচ্ছিত টাকা। সে টাকা দিয়ে আমার জন্য উল কিনবে কি করে?

—সব কেন সলিলের টাকা হতে যাবে। চন্দ্রার টাকাও আছে।

অনেকক্ষণ দুইজনেই চুপচাপ বসে থাকি। বিপদের দিনে শেখররা সত্যকার দরদী বন্ধু পেয়েছে, এটা সৌভাগ্যের কথা। শেখরের প্রতিটি কথায় কৃতজ্ঞতার পরিচয় তো থাকবেই। না থাকলেই বরং অত্যন্ত অন্যায় হতো। এক সময় জিগ্যেস করলাম-

চন্দ্রা সারাদিন কি করে?

—তুই চন্দ্রাকে খুব ভালোবাসিস্। তাই না? চন্দ্রাও যে তোকে কি চোখেই দেখেছে। সারাটা দিন কেবল তোর কথা। তোকে নিয়ে সলিলের সঙ্গে যে তার কতবার কথা কাটাকাটি হয়েছে- এমনকি রাগারাগি পর্যন্ত হয়েছে। সলিল কতদিন রাগ করে চলে গেছে।

আমি একটু হেসেই জবাব দিলাম—

—ছেলে মানুষ কি না।

ঠিক বলেছিস। তাই কথার মাত্রা রাখতে পারে না।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতে জিগ্যেস করলাম :

—সলিলের সঙ্গে চন্দ্রার বিয়ে হলে কিন্তু বেশ হয়, তাই না!

শেখর গম্ভীর হয়ে গেল। বললো :

বিয়ের কথা থাক। চন্দ্রার কতই-বা বয়স। এখুনি বিয়ে কিসের। তাছাড়া সলিলরা বামুন আর আমরা… শেখর কথা শেষ করল না।

বস্তুত হিন্দুদের জাতিপ্রথা সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা অপরিসীম। তাছাড়া শেখরের হাবভাব দেখে মনে হলো চন্দ্রার বিবাহ প্রসঙ্গটা তার তেমন মনঃপূত নয়। তাই কথাটা শেষ করে দেয়ার জন্য বললাম

—না এমনিই বলেছিলাম। কথাটা হঠাৎ মনে পড়ল তাই।

—তা বুঝেছি। কিন্তু এই দুনিয়ায় কি সবই হয়। এই মনে কর, তোর সঙ্গেই কি চন্দ্রার বিয়ে হতে পারে।

—কি যে বলিস তার কোনো ঠিক নেই। তা কি করে হয়। বাঃ তা কি করে হয়…এ প্রশ্নই উঠতে পারে না।

—আমিও তো তাই বলি। তা কি করে হয়।

এই বলে শেখর হনহন করে চলে গেল।

যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আমি সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।

সেদিন কলেজের ছুটির পর ভারি ইচ্ছে করতে লাগল, একবার গিয়ে চন্দ্রাকে দেখে আসি কিন্তু সলিলের ঐশ্বর্যের পাশে আমাকে কেমন ম্লান দেখাবে, সেই কথা মনে করে আর গেলাম না।

বেশ ক’দিন কেটে গেছে। একদিন শেখর কলেজে আসে নি। তার কোনো অসুখ হলো কি না, অথবা বাড়িতেই কোনো বিপদ-আপদ হলো কি না এইসব কথা ভেবে বেশ চিন্তিতই ছিলাম। একবার এনটালিতে গিয়ে খোঁজ করব কি না সে কথাও ভেবে দেখেছি। কিন্তু সলিলের সঙ্গে তুলনায় আমি হেরে যাব, এই কথা মনে করে কিছুতেই সেদিকে পা উঠছিল না।

অথচ সেদিন কলেজের পর এই সলিলের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল। সলিল বেশ গম্ভীর, যা তার স্বভাববিরুদ্ধ। আমার হাত ধরে টেনে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সে যে ওয়েটারকে ডেকে কি আনতে বললো তা পর্যন্ত কানে গেল না।

একবার শুধু বললো :

—হ্যারিসন রোডের এই ‘মর্নিং বেল’ রেস্টুরেন্টে মাটন কারিটা কিন্তু বেড় করে। তারপর আবার গম্ভীর হয়ে গেল। বললো :

–শেখরের বাবার খবর শুনেছিস?

আমি কিছুই শুনি নি। অজ্ঞাত আশঙ্কায় মুখ শুকিয়ে গেল। মুখ দিয়ে সবচাইতে অশুভ কথাটাই সবচাইতে আগে বেরিয়ে এলো। জিগ্যেস করলাম :

—মারা গেছেন?

আমার কথা শুনে সলিল হো-হো করে হেসে উঠল। তার হাসি কিছুতেই থামতে চায় না। আমার আশঙ্কা দূর হলো। আর যাই হোক, শেখরের বাবা মরেন নি। মরলে সলিল ওভাবে হাসতে পারত না।

—না। ব্যাটা মরে নি। সে অত সহজে মরবার পাত্র নয়।

আমি চুপ করে বসে থাকলাম। না হয় সলিল চাকরি দিয়ে ভদ্রলোকের উপকারই করেছে। তাই বলে তাঁর সম্পর্কে এই অসৌজন্যমূলক সম্ভাষণ ভালো লাগল না।

সলিল আবার বললো

—মাসে তিনশ’ করে মাইনে পায়, কিন্তু বাড়িতে এক পয়সাও দেবে না। বাড়িতে একবার আসেও না। সারারাত মদ খেয়ে পড়ে থাকবে। ব্যাটাকে দিতাম তাড়িয়ে। কিন্তু কাজটা ভালো করে। মাথা আছে। সেদিন গভীর রাত্রে বেহালার একটা মেয়েমানুষ নিয়ে এসে সে কি বেলেল্লাপনা, আমরা পর্যন্ত হার মেনে যাই। তবে হ্যাঁ, মানতেই হবে। লোকটার রুচি আছে। মাগী ম্যাথরানী বটে; কিন্তু শরীর কি! একেবারে পেটা লোহার মতো

—তুই কার সম্বন্ধে কি বলছিস।

সলিল আবার হো-হো করে হেসে উঠল।

—কার সম্বন্ধে আবার। আমাদের পরম পূজনীয় শেখর-জনক সম্বন্ধেই বলছি। লোকটা এমন ইতর তা জানতাম না।

বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে আর কথা সরে না। কেবল যে শেখরের বাবা বলেই অবাক হয়েছি তাই নয়, অবাক হওয়ার আরও কারণ ছিল। আমি শেখরের মা-কে দেখেছি।

তাঁর মতো সুন্দরী স্ত্রীলোক খুব কমই চোখে পড়ে। আর শেখরের বাবা কি না… সলিলও সেই কথাই বললো। কিন্তু একটু অন্যভাবে বললো।

—আরে বাবা, যার বাড়িতে এমন লক্কা পায়রার মতো স্ত্রী, সে কেন অন্যদিকে নজর দেয়।

–সলিল তুই এত ইতর হয়ে গেছিস। যা মুখে আসে তাই বলিস।

—আরে থো তোর নীতি কথা। ঢের ঢের দেখা আছে। বাপ তো এই, ইদিকে মেয়ের সতিপনা দেখে বাঁচি না। সেদিন কলতলা থেকে গা ধুয়ে এসেছে। ভিজে কাপড়েই ঘরে ঢুকছিল। বুক তো নয়, সমুদ্রের ঢেউ যেন। সে যাই হোক, চন্দ্রা সেই যে আমার চোখের সুমুখ দিয়ে চলে গেল, আর সামনেই এলো না মাইরি। আমিও সলিল চাটুয্যে, দেখে নেব।

রাগে আমার শরীর কাঁপছিল। কিন্তু অসহায় ক্রোধে নিরুপায় হয়ে বসে থাকলাম। একবার ভাবলাম উঠে চলে যাই। কিন্তু কে যেন শিকল দিয়ে আমার হাত-পা বেঁধে রেখে দিয়েছে, কিছুতেই নড়তে পারলাম না। সলিল বলেই চললো।

–বেহালায় সেদিন রাত্রে শেখরের বাবা বলে কি জানিস। তোমাকে আর লজ্জা কি সলিল। ও দুটো জিনিস না হলেই নয়। আমিও বললাম : কাকাবাবু কারুর ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করবার পক্ষপাতী নই। এবার উঠি। দুপুরে মদের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। তবে একটা কথা ঠিক জানবি। ও বুড়ো শালা কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না আর। আমিও আর কাঁহাতক ওদের দেখব। মরুক, সংসারসুদ্ধ সবাই শুকিয়ে মরুক। আমার কি!

এরই কিছুদিন পর খবর পেলাম শেখরের বাবা অফিসের ক্যাশ বাক্স ভেঙে পালিয়েছেন। সলিলও প্রতিজ্ঞা করেছে নেমকহারামটাকে জেলে না দিয়ে সে অন্য কাজে হাত দেবে না। চাকা বড় দ্রুত ঘুরতে লাগল।

কিছুদিন পরপর শেখর কলেজে আসে। আবার সেই আগেকার মতোই চিন্তিত মলিন শুষ্ক মুখে চুপচাপ বসে থাকে।

—তোর বাবার কোনো খোঁজখবর পেলি?

শেখর একটু বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো। বললো :

—বারবার একই কথা জিগ্যেস করিস কেন? এলে খবর পাবি।

আজকাল প্রায়ই এইভাবে শেখরের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। হবারই কথা। তাদের ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে, তা মাথা ঠাণ্ডা করে না। তাই তার কথায় আমি কিছু মনে করি না। তবু তাদের পরিবার সম্বন্ধে কৌতূহল কিছুতেই দমন করতে পারি না। ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করি :

—তোদের চলছে কিভাবে, ভাই?

—সলিলই চালাচ্ছে কোনোমতে। আর একট কথাও না। পড়া শোন! এইভাবে আরো দু’মাস কেটে গেল। এর মধ্যে একবারও শেখরদের বাড়ি যাই নি।

সেদিন রাত্রের কথা পরিষ্কার মনে আছে। যাকে বলে পুলকিত জ্যোৎস্না, মানুষের মাথা দালান-কোঠা, গাছপালা, সবকিছুর ওপর তারই বন্যা নেবে এসেছে। যুদ্ধের বাজার, তাই রাস্তার আলোগুলো ‘লাইটিং রেশট্রিকশন’ অনুসারে অর্ধ অবগুণ্ঠিত করা হয়েছে। তাই পূর্ণ চন্দ্রের সম্পূর্ণ রূপটাই আজ এভাবে চোখে ধরা পড়ল। পথে লোকজন চলাফেরা করছে, গাড়ি- ঘোড়াও নেহাৎ কম নয়, গাছপালাগুলোও কেমন যেন সলজ্জ সঙ্কোচে এক পাশে সরে দাঁড়িয়েছে। এসব কিছুই আমার চোখে স্বপ্নে দেখা দৃশ্যগুলোর মতোই অপার্থিব মনে হচ্ছিল। পৃথিবীতে যে এত শান্তি থাকতে পারে তা কল্পনাতীত। চতুর্দিকে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছে কিন্তু তাও যেন কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছিল।

হঠাৎ কি মনে হলো, শেখরদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম। এ পথে কতদিন আসি নি, অথচ পথঘাট এতই চেনা যে মনে হচ্ছিল যেন প্রত্যহই এই পথে আনাগোনা করেছি। শেখরদের বাড়ির লাউগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালেই চন্দ্রা এখুনি দোরগোড়ায় স্থির হয়ে অভিমানভরা দুটি চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। মনে মনে চন্দ্রার সঙ্গে এই ধরনের একটা সংলাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম।

—এতদিন আস নি যে।

আমি একটু হেসেই জবাব দিলাম।

—বাঃ, তুমি না আসতে বারণ করে দিয়েছিলে।

—বারণ করলেই তা শুনতে হবে বুঝি! মুখের একটা বারণ, সেটাই বড় হলো!

–বড় যে কি তা কি করে জানব বলো। আমি এসে গৃহবিবাদ লাগাতে চাই নি বলেই আসি নি।

—বেশ তো, গৃহবিবাদের যদি এতই আশঙ্কা তাহলে আজই-বা কি মনে করে এলে শুনি?

-–আজ আমি ইচ্ছে করে আসি নি। কে যেন জোর করে আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে। বোধ হয় ভূত।

—হ্যাঁ আমিই সেই ভূত। আমিই জোর করে তোমাকে টেনে নিয়ে এসেছি।

এই বলে চন্দ্রা হাসি গোপন করবে। তারপর একটু এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলবে :

ইস্। কি রোগাটাই হয়েছ। শরীরের একটু যত্নও বুঝি করতে নেই।

—যত্ন করব পরে। এখন আমার একটি বড় কাজ বাকি আছে।

—কি তোমার বড় কাজ একবার শুনি।

—তোমার জন্য বর দেখা।

—আমার বর!—সহাস্য কৌতুকে চন্দ্রা আমারই কথার প্রতিধ্বনি করবে। পর মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে দড়াম করে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে যাবে। কখন যে সেই লাউগাছের তলাতেই এসে দাঁড়িয়েছি খেয়ালও করি নি। চারদিক কেবল আলো আর আলো- জ্যোৎস্নার আলো। শুধু শোবার ঘরটার এক কোণে একটা হারিকেন জ্বলছে। দোরগোড়ায় একটা চকচকে পেটেন্ট লেদারের পাম্প সু। দেখেই চিনলাম, এটি সলিলের। ভীত চকিত দৃষ্টি অত্যন্ত ধীরে ধীরে ঘোরতর অনিচ্ছায় শোবার ঘরে পৌঁছল। খাটের ওপর চন্দ্রা শায়িত। একটি হাত দিয়ে সে দুই চোখ ঢেকে পড়ে আছে। অন্য হাতটি সলিলের হাতে। সলিলের অপর হাতে একটি গেলাস। বোধ করি তার মধ্যে হুইস্কি।

এইবার রান্নাঘর চোখে পড়ল। শেখরের মা চা তৈরি করছেন। সামনে তিনটি পেয়ালা রাখা আছে। এক মুহূর্ত দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কি ভাবলেন। আবার চা তৈরি করতে লাগলেন।

লাউগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আমার হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। তবু কোনোমতে যেমন নিঃশব্দে এসেছিলাম, তেমনি নীরবেই বিদায় নিলাম।

দু’দিন কেবল সেই দৃশ্যটাই চোখের সামনে ভাসতে লাগল। কেমন করে বারবার মনে হচ্ছিল, এ দুটি চোখ যা দেখেছে তা ভুল, আমি যা কিছু বুঝেছি তাও ভুল। সবকিছুরই একটা সন্তোষজনক কৈফিয়ত আছে—চন্দ্রার সঙ্গে একবার কথা হলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আরো একটা কথা বারবার মনে পড়তে লাগল। চন্দ্রা বলেছিল, আমার বিপদের দিনে ডাকলে আসবে তো? তার সেই বিপদের দিন তো সত্যিই এলো। এমনভাবে এমন দিক দিয়ে এলো যা আমাদের উভয়েরই অতি বড় দুঃস্বপ্নেরও অগোচর ছিল। কিন্তু কৈ, চন্দ্রা তো আমাকে একবারও ডাকল না। তাহলে কি চন্দ্রা স্বেচ্ছায় এই জীবনই বেছে নিয়েছে? এই জীবনই তার মনোনীত আর মনঃপূত? চন্দ্রার? অসম্ভব।

এর সবটাই একটা দুঃস্বপ্ন। চন্দ্রার সাথে একবার দেখা হওয়া দরকার। সবকিছুরই একটা শোভন ব্যাখ্যা আছে নিশ্চয়ই। সেই ব্যাখ্যাটা কি চন্দ্রার সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই জানতে পারব না। আর না জানা অবধি এতটুকু শান্তি নেই। চোখ যে পুড়ে গেল। বুক যে জ্বলে গেল। সবরকম বিশ্বাসের বুনিয়াদই যে ধসে গেল।

আজও জ্যোৎস্নার আলো আছে। আজও চারপাশ নিজঝুম। আজও শোবার ঘরে হারিকেন জ্বলছে। আজও দোরগোড়ায় পাম্প-সু রাখা আছে। তবে পেটেন্ট লেদারের নয়। আধ ময়লা আধ ছেঁড়া মোটা চামড়ার পাম্প-সু।

আজও লাউগাছের তলায় দাঁড়িয়ে দৃষ্টি দোর অতিক্রম করে শোবার ঘরের খাট পর্যন্ত

অগ্রসর হলো। আর দেখল—

চন্দ্রার মা খাটে শুয়ে আছেন। তাঁরও একহাত দিয়ে দুই চোখ ঢাকা। কালীবাবুর কোলে তাঁর মাথা। শেখরের শিশু-ভ্রাতা এক কোণে একটা ছোট্ট খাটে শুয়ে আছে।

কখন যে আপনা থেকেই চোখ দুটো রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এসেছে জানি না। সেখানে চন্দ্রা হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে। সামনে চায়ের পেয়ালা—দুধ-চিনি। কিন্তু সে যেন শান্ত সাগরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। অতল চিন্তার ভারে তার মাথা নত! উনুনের পাশে একটা পিদিম জ্বলছে, উনুনের ওপর হাঁড়ি। চন্দ্রার পরনে সেই লাল পেড়ে শাড়ি। সন্ধ্যাকাশে একটিমাত্র নক্ষত্রের মতো নিঃসঙ্গ একাকীত্বে বসে আছে—এক বিন্দু অশ্রুর মতো।

ভেবেছিলাম আজও নিঃশব্দে বেরিয়ে যাব। কিন্তু সেই মুহূর্তেই চন্দ্রা চোখ তুলে তাকালো। এ কি চন্দ্রার চোখ? দু’চোখ ছাপিয়ে কি দুঃসহ ক্লান্তি। চোখাচোখি হতেই সাগরের বুকে যেন এক খণ্ড ক্ষুদ্র প্রস্তর পড়ল। নিমেষের জন্য চন্দ্রার সর্বশরীর একবার কেঁপে উঠল; কিন্তু নিমেষের জন্যই। তারপর তার অচেতন দেহ সেখানেই লুটিয়ে পড়ল। আমিও বেরিয়ে চলে এলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *