উত্তম পুরুষ – ২৪

চব্বিশ

সেদিন কলেজের পর শেখর কিছুতেই ছাড়ল না। তাদের বাড়িতে যেতেই হবে। ক্লাস ছিল মাত্র দুটি। অগত্যা আমরা দু’বন্ধু এনটালীর দিকে হাঁটতে লাগলাম। সামান্য পথ—অন্যমনস্কভাবে গল্প করতে করতে এগুতে লাগলাম। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি আমাদের পাশেই আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল।

আরে সলিল যে।

—তোরা চললি কোথায়?

—বিশেষ কোথাও না। আমাদের বাসায়।

—এই বুঝি তোদের বাড়ি ফেরার সময়? সারা কলকাতা ছুটছে গড়ের মাঠের দিকে, আর তোরা না কি দুটি গাভীর মতো গৃহাভিমুখে! খেলা দেখবি না।

—খেলা আর কি করে দেখব। পকেটও যে গড়ের মাঠ। টিকিট কাটবার পয়সা দেবে কে? –এই বুঝি তোমাদের সমস্যা! কুছ পরোয়া নেই। সলিল চাটুয্যে এখনো বেঁচে আছে। বস্তুত সলিলের ভোলই গেছে বদলে। সে বরাবরই একটু বাবু গোছের ব্যক্তি ছিল; কিন্তু এখন রীতিমতো সাহেব। প্যান্ট-শার্ট পরনে, হাতের কবজিতে দামি ঘড়ি—গায়ে একটু মাংসও হয়েছে। মানিয়েছেও দিব্যি। ঘন-ঘন রুমাল বের করে শুষ্ক নাসিকা রক্তিম করে তুলছে— প্রতিবারই সুন্দর একটা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারছে।

—তুই এখন কি করিস রে!

সলিল এক কথায় জবাব দিল।

—বিজনেস।

—বিজনেস তো বুঝলাম, কিন্তু কিসের বিজনেস?

—আগে ট্যাক্সিতে উঠে পড়, তারপর সব বলব।

সেই যে সলিল স্কুল ছেড়ে চলে গেল, তারপর তার সঙ্গে এই প্রথম দেখা। যুদ্ধ বাধবার পর সে ব্লেড আর পেরেকের কি এক জাতীয় ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা করেছে। যুদ্ধের কাছে সলিল অপরিসীম কৃতজ্ঞ। সে দুই হাত তুলে তার ভগবানকে ধন্যবাদ জানায়। তাছাড়া সে চাল ডাল চিনির র‍্যাশন শপও খুলেছে একটা—সেখান থেকেও পয়সা নেহাৎ মন্দ আসে না। মোটের ওপর আজ সলিল একটা মোটা অঙ্কের মালিক। আমরা দুই ছাত্র যেন আরব্য উপন্যাস শুনছি, এমনই অতৃপ্ত আগ্রহে সলিলের জীবনেতিহাস শুনতে লাগলাম। আমি মুগ্ধ কণ্ঠে বললাম : তুই বলিস কি! এতসব নিজের চেষ্টায় করেছিস!

সলিল একটা সিগারেট ধরালো। তারপর মুখের ভিতর থেকে এক মুখ ধোঁয়া সম্মুখের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে, সে পিছনের গদিতে হেলান দিয়ে আরো একটু আরাম করে বসল। তারপর জবাব দিল :

—নিজের চেষ্টায়? তুই পাগল হয়েছিস! মা কালীর ইচ্ছা না থাকলে কেউ কিছু করতে পারে না।

ট্যাক্সি ততক্ষণে গড়ের মাঠ পৌঁছে গেছে।

মোহামেডান স্পোর্টিং বনাম মোহন বাগানের খেলা। এই খেলাটিতে জিততে পারলেই মোহামেডান স্পোর্টিং চ্যাম্পিয়ন হবে। ট্যাক্সি থেকে নাবতে নাবতে সলিল বললো : আমি কালীর মন্দিরে মানত করেছি, ‘মোহামেডান’ হারলে জোড়া-পাঁঠা বলি দেব।

আমি অল্প একটু বিস্মিত হয়ে, নেহায়েতই যৎসামান্য বিস্মিত হয়ে সলিলের দিকে একবার তাকালাম। সলিলও এক দ্রুত চলমান মুহূর্তের জন্য বিব্রত হয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। তাড়াতাড়ি বললো : চল রে। একটু পা চালিয়ে চল। টিকিট তো পাওয়া যাবেই না। গেটে জামাইবাবু থাকবেন, তিনিই আমাদের মাঠের ভিতর নিয়ে যাবেন। নে চটপট কর।

জামাইবাবু মোহন বাগান ক্লাবের কর্তৃপক্ষস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি গেটের কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। এক সময় সুযোগ বুঝে ইশারা করতেই আমরা তিনজন মাঠের ভিতর চলে এলাম।

যাকে বলে লোকে লোকারণ্য তাই। গ্যালারিগুলোতে তিল ধারণের স্থান নেই। র‍্যামপাটের বাইরে ফোর্ট উইলিয়মের ওপরও জনসমুদ্র। এমনকি মাঠের চারপাশের গাছের ডালপালায় শাখা মৃগের মতো ঝুলতে ঝুলতে খেলা দেখবার মতো উৎসাহী ফুটবলরসিকও অসংখ্য।

খেলা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে মোহামেডান স্পোর্টিং-এর সেন্টার ফরোয়ার্ড পাঁচজন বিপক্ষ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে একক চেষ্টায় এক স্বপ্নতুল্য গোল দিয়ে দিলেন। দলেরর সমর্থকদের গগনবিদারি চিৎকার মিলিয়ে যাবার আগেই আর একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল। রেফারি বললেন : গোল হয় নি! সেন্টার ফরোয়ার্ড, যিনি পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল দিলেন, তিনি না কি অফসাইড ছিলেন। সেই রৌদ্রস্নাত অপরাহ্ণে মেঘ-চিহ্ন-হীন আকাশ থেকে বজ্রপাত হলেও দর্শকরা এতটা বিস্মিত হতেন না। তবু এটা রেফারির ‘ডিসিশন’–এবং ফুটবল খেলা না কি স্পোর্টস, সুতরাং সেই বিচারকের সিদ্ধান্তই শিরোধার্য করে আবার খেলা শুরু হলো। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মোহামেডান স্পোর্টিং দলই জিতল।

সলিল শেখরকে বললো :

—যাই বলিস। এই নেড়েরা কিন্তু খেলা কাকে বলে জানে। আমরা শালা চিংড়ি মাছ খাব, আর বাড়িতে বৌকে ঠ্যাঙাব। আরে বাবা, চিংড়ি খেয়ে ফুটবল মাঠে নাবা যায়।

সলিল একবার আড় চোখে আমাকেও দেখে নিল! তার চোখের কোণের যতটুকু দৃষ্টিগোচর হলো ততটা যে কারণেই হোক রক্তিম। কিন্তু আমার উপস্থিতি সে এতটুকু গ্রাহ্য করল না, তার এতটুকু মর্যাদা দিল না। দ্রুত পদক্ষেপ করতে করতে শেখরকেই উদ্দেশ করে বললো : এবার চলি ভাই। শালার মনটাই খারাপ করে দিল। এখন পেটে একটু ‘হুইস্কি’ না পড়লে কিছুই ভালো লাগবে না। হ্যাঁ ভালো কথা। শেখর, তোর মা কেমন আছেন?

—ভালোই।

—আর চন্দ্রা?

–সেও ভালো।

—আচ্ছা এবার আসি। যাব একদিন তোদের বাড়ি। … ট্যাক্সি, ‘উইণ্ডসর—বার’।

শেখর আমার সঙ্গে চলতে লাগল, তার মাথাটি নত। এক সময় সে অনেকটা অন্যমনস্কের মতো বললো : যাই বলিস। সলিলের মনটা কিন্তু খুব ভালো। এত পয়সা ওদের, কিন্তু এতটুকু দেমাক নেই।

আমি ভালো-মন্দ কিছুই বললাম না।

একটু পর শেখর আবার প্রশ্ন করল :

—কি রে। যাবি না আমাদের বাড়ি?

–না ভাই। আজ থাক। আর একদিন যাব।

আমি এবার চৌরঙ্গী ধরে পার্ক স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। মাঠ-ফেরত লোক বন্যার স্রোতের মতো এগিয়ে চলছে। সবার মুখেই খেলার কথা।

একজন বললো : কিছুতেই ঠেকানো গেল না। শালা রেফারি দ্বিতীয় গোলটাও ডিস-এলাউ করতে পারল না।

দ্বিতীয়জনের জবাব : আর কত করবে বাবা। একটা জলজ্যান্ত গোল নামঞ্জুর করল। তাছাড়া দিব্যি দেখলাম একটা পেনালটি দিল না। আসল কথা—ওদের সঙ্গে পারা অসম্ভব। সে তুমি যতই চাবিকাঠি ঘুরাও না কেন!

ততক্ষণে আমি পার্ক স্ট্রিটে পৌঁছে গেছি।

শ্বেতাঙ্গদের আনাগোনা, উজ্জ্বল বিজলি বাতি, সুন্দর খোলা হাওয়া।

এতক্ষণে বুকভরে নিশ্বাস নিলাম।

সেদিন সকালবেলাই শেখরদের বাড়ি এলাম।

শেখরের বোন তাদের বেড়ায়-ঘেরা বাগানের লাউ গাছগুলো তদারক করছিল। কোমরে তার আঁচল জড়ানো। চওড়া লাল পেড়ে সাদা শাড়িটা আঁটসাঁট করে পরা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। লম্বা একটা ছুরি নিয়ে সে একটা লাউগাছের দিকে এগিয়ে গেল। মাথার এক রাশ চুল খোঁপা করে জড়ানো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও সে লাউগাছের নাগাল পেল না। আমি আস্তে এগিয়ে গিয়ে ডালটা নাবিয়ে দিলাম।

—ওমাঃ আপনি! কখন এলেন?

—তুমি আমাকে চেন?

তার ডাগর দুটি সরল চোখের পূর্ণ দৃষ্টি আমার ওপর এসে পড়ল।

—চিনি না আবার! দাদার এত বড় বন্ধু কেউ নেই। আপনার সাহায্য ছাড়া দাদা পরীক্ষাই দিতে পারত না।

—তোমার নাম কি?

—চন্দ্ৰা।

—তুমিই চন্দ্ৰা?

—হ্যাঁ। আপনি আমার নাম শুনেছেন না কি।

নাম শুনেছি, কিন্তু কোথায় শুনেছি সরাসরি বললাম না। বললাম :

—বাঃ সেদিন যে দেখলাম।

—তা বটে।

—তোমার হাতে-পায়ে ময়লা ভরা। যাও ধুয়ে এসো।

—যাই। অমনি দাদাকেও খবর দিই গে।

—একটু দাঁড়াও। তুমি পেয়ারা খাও?

—পেয়ারা? খাই না আবার!

—খাবে? ভালো ডাঁসা পেয়ারা আছে আমার কাছে!

চন্দ্ৰা সোৎসাহে হাত বাড়িয়ে দিল, পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে হাত সরিয়ে নিল।

—না খাব না। আপনি না মুসলমান। মা রাগ করবে। আপনি হাসছেন যে…

-তোমার কথা শুনে!

—হাসির কথা বলি নি। আমি সত্যিই খাব না।

—খাও, কিচ্ছু হবে না। পেয়ারা খেলে জাত যায় না।

—ঠিক বলছেন?

—ঠিক বলছি।

—আচ্ছা তাহলে দিন। কিন্তু খবরদার মাকে বলবেন না।

—তুমি আগে মুসলমান দেখ নি।

—বেশি না।

—তবু কাদের দেখেছ?

—আমাদের বাড়ির সামনেই যে মাংসের দোকান আছে, সেই দোকানের কসাইকে দেখেছি। আর দেখেছি ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ানকে। তাদের বড্ড ভয় করে। মা সামনে যেতে দেয় না।

—ভয় কেন করে? ওরা কি করেছে।

—কিছুই করে নি। কসাই বেচারা তো আমাকে মা বলে ডাকে। তবু আমার মা এমন করে বলে যে আমি কিছুতেই স্বস্তি পাই না।

—আমিও তো মুসলমান। আমাকে ভয় করে না?

—বাঃ আপনাকে কেন ভয় করবে?

—আমিও যে মুসলমান।

—ধ্যেৎ। আপনাকে একটুও ভয় করে না।

একটা বেঞ্চির ওপর বসে দু’বন্ধু আলাপ করছিলাম। মাটির ভাঁড়ে আমাদের জন্য চা এলো—ঠোঙায় গরম মুড়ি।

চন্দ্রা বলে গেল : খাওয়া হয়ে গেলে, দাদা, ভাঁড় আর ঠোঙা বাইরে ফেলে দিয়ে এসো। মা বারবার করে বলে দিয়েছে।

ছুটির দিন। আমরা যেখানটায় বসেছিলাম তার ঠিক সম্মুখেই রান্নাঘর। সেখানে শেখরের মা রান্না করছিলেন। বেড়া দিয়ে তৈরি রান্নাঘর। আব্রুর বড্ড অভাব। স্থানে স্থানে বেড়া খসে পড়ে গেছে। চট দিয়ে সেই অনাবৃত স্থানগুলো ঢাকবার চেষ্টা করা হয়েছে। রান্নাঘরের পাশেই—একই উঠানের মধ্যে—আর একটি ঘর। সেখানে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক—মিশমিশে কালো গায়ের রঙ—দাঁতন করছিলেন। তাঁর দুটি চোখে অপরিচ্ছন্ন দৃষ্টি, আর চোখ দুটি রান্নাঘরের দিকে স্থির নিবদ্ধ।

শেখরই বললো : কালি বাবু লোকটি ভারি বদ।

—কেন?

শেখর কোনো জবাব দিল না। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম সে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছে। খানিক বাদে সে-ই বললো : ভদ্রলোক ইছাপুরে কাজ করেন। মা রান্নাঘরে এলেই ভদ্রলোক ঐখানটিতে এসে দাঁড়াবেন।

হঠাৎ শেখরের মা-ও কালি বাবুকে দেখতে পেলেন। তাড়াতাড়ি গায়ে কাপড় টেনে নিয়ে বললেন :

–শেখর চটটা ভালো করে টেনে দেতো বাবা।

কালি বাবু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। দাঁতন করা দাঁতের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে থুথু চিবুক পর্যন্ত নেবে আসছে। নোংরা চোখ দুটিতে ভরা পিচুটি। কালো ভুঁড়ির ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম।

আরো একদিনের কথা। চন্দ্রা সেদিনও তেল-মাখানো মুড়ি নিয়ে এলো। কিন্তু সেদিন আর কাগজের ঠোঙায় নয়—কাঁসার বাটিতে।

—শিগগির খেয়ে ফেল। মা দেখতে পেলে আমায় আস্ত রাখবে না।

—কি দেখতে পেলে?

–তোমায় বাটিতে খেতে দিয়েছি।

—তাহলে এমন কাজ করলে কেন? একটা ছোটখাটো বিপ্লব ঘটাতে চাও?

—আমার ইচ্ছা। অত বকবক করতে পারি না।

আমি এক মুঠি মুড়ি তুলে নিয়ে মুখে পুরলাম।

—সামনের দোকানের কসাইকে দেখলে তোমার ভয় করে—কালি বাবুকে ভয় করে না?

—ওমা, কসাই আর কাকাবাবু বুঝি এক হলেন।

—কালি বাবু বুঝি তোমার কাকা?

—তাবলে সত্যিকার কাকা নন। পাশেই থাকেন, তাই কাকা বলি।

—তোমার মা বারণ করেন না?

—কি বারণ করেন না?

—কালি বাবুর সঙ্গে মিশতে।

—ও মা, তুমি কি গো! বারণ করবেন কেন? দাও দাও আমি বাটিটা চট করে মেজে আনি।

চন্দ্রা প্রায় বাটিটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দিল। একটু পরই সে ফিরে এলো। কপালে টিপ, তৈল-মসৃণ কেশ খোঁপা করে বাঁধা, গায়ে ফর্সা শাড়ি। নিঃসন্দেহে এক ফুটফুটে মেয়ে।

—গা ধুয়ে এলাম। তুমি রোজ চান কর না!

–করি।

—কর? তোমরা শুনি রোজ চান কর না!

—এই তোমরাটা কে?

চন্দ্রা কি একটা উত্তর দিতে উদ্যত হয়েও হঠাৎ অন্য কথা বললো :

—আজ কখন করবে?

–করব এক সময়।

—বাড়ি যাবে না?

—কেন? তুমি চাও আমি চলে যাই!

চন্দ্ৰা নত চোখে দাঁড়িয়ে থাকল। আঙুল দিয়ে আঁচল জড়াতে লাগল। ফর্সা মুখের ওপর একটা অন্ধকার ছায়া পড়ল। এইভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল। তারপর চন্দ্রাই বললো : হ্যাঁ। তাই চাই। তুমি আসা-যাওয়া কর, পাড়ায় কথা উঠেছে।

—কথা উঠেছে। কে তুলেছে কথা?

–কালি কাকা!

—বেশ, আর আসব না।

চন্দ্রা মুখ তুলল। তার দুটি চোখ ততক্ষণে সিক্ত হয়ে গেছে। এগিয়ে এসে সে আমার একটি হাত ধরল। বললো :

—সত্যি এসো না। দাদাই তোমাকে মানা করত; কিন্তু পারে নি। মাও চান না তুমি আস। তাই আমিই বলছি। কি হবে এভাবে এসে।

—আচ্ছা তাহলে উঠি এবার।

—একটু দাঁড়াও। জানো আজ রাখী উৎসব। তোমাকে প্রণাম করি।

চন্দ্রা আমার হাতে একটা রাখী বেঁধে দিল। আমি যার বলে একবার উঠে পড়েও আবার বসে পড়লাম। চন্দ্রাকে পাশে বসিয়ে বললাম : তুমি হুমায়ুন বাদশা আর কর্ণবতীর গল্প জানো?

—না! কি গল্প।

—বলি শোনো। কর্ণবতী ছিলেন চিতোরের রানী। বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করতে এগিয়ে এলেন—সঙ্গে হাজার সৈন্য-সামন্ত। কর্ণবতী প্রমাদ গুণলেন। তাঁর এত শক্তি কোথায় দুর্ধর্ষ বাহাদুর শাহকে বাধা দেবেন। তখন অসহায় কর্ণবতী মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের কাছে দূত পাঠালেন। আর তার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন একটা রাখী। হুমায়ুন স্বয়ং সেই মুহূর্তে শের শাহের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু মোগল সম্রাট এক অসহায় নারীর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলেন না। নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কর্ণবতীর পাশে ছুটে এলেন। এই আমার গল্প।

—এ গল্প না সত্যি।

—এ ইতিহাস।

হুমায়ুন কর্ণবতীর পাশে এসে দাঁড়ালেন?

–বীর মোগল সম্রাট আর্ত নারীর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারেন নি।

—আমার বিপদের দিনে যদি আমি ওমনি করে তোমাকে ডাকি, তুমিও আসবে?

–আসব। কিন্তু তোমার তো আর রাজ্য নেই। তোমার আবার বিপদ কিসের? চন্দ্রা সে কথার কোনো জবাব দিল না। অন্যমনস্কের মতো বললো : ডাকলে এসো কিন্তু। কথাগুলো যেন বহুদূর থেকে ভেসে এলো।

.

মুসলমান ছেলেদের জন্য কতগুলো বৃত্তি ধার্য ছিল। বহুদিনের আন্দোলনের পর মুসলমান ছাত্ররা এই সুবিধাটুকু পেয়েছিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার সার্থক পরীক্ষার্থীদের তালিকায় যোগ্যতা অনুসারে আমার স্থান কোন অতলে ছিল জানি না; কিন্তু কেমন করে যেন এই বিশেষ বৃত্তিগুলোর একটি অর্জন করতে পেরেছিলাম। সেদিন তিন চার মাসের বৃত্তি এক সঙ্গে হাতে আসায় অনেকগুলো টাকা পেলাম।

কি খেয়াল হলো একটা রিকশা ভাড়া করে চড়ে বসলাম। বৃদ্ধ রিকশাঅলা, কিন্তু কি সুঠাম শরীর।

—রিকশা টানতে তোমার কষ্ট হয় না।

আমার অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে বৃদ্ধ একটু বিস্মিত হলো; কিন্তু রিকশা টানতে টানতেই বললো : খুব কষ্ট হয় বাবু। কষ্ট আবার হয় না।

—তাহলে কেন রিকশা টান?

–পেটের জন্য।

—আর কিছু করতে পার না?

—সবখানেই ভিড়। গরিব মানুষ লেখাপড়া করি নি, আর কিইবা করব।

—তোমার বয়স কত?

—আমরা জাহেল মানুষ। বয়সের হিসাব রাখি না। তবে বয়স অনেক হবে। তিন কুড়ি তো হবেই।

—সারা দিনে কত আয় কর?

সামনে একটা মোটর আসছিল। বৃদ্ধ সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে বাম দিকের গলিতে ঢুকে পড়ল। তারপর বললো : আয় বাবু সাত টাকা হয়।

—মাসে দু’শ টাকার বেশি রোজগার কর, অবস্থা তোমার ভালোই বলতে হবে।

—আল্লাহর মর্জি আছি এক রকম। সাত টাকার মধ্যে রিকশার মালিককে তিন টাকা দিতে হয়। তাও চলে যায় মন্দ না।

—পয়সা-কড়ি কিছু জমাও নি? একটা রিকশা কিনে নিলেই তো পার

জমাব? বাবু কি যে বলেন। তবে ধারকর্জ করে না হয় কোনোমতে যোগাড় করলাম, কিন্তু গরিব মানুষ আমাদের লাইসেন্স দেবে কে? ওসব বড় লোকরাই পারে।

ছড়ছড় ঠুনঠুন শব্দ করে রিকশা এগিয়ে চলল। পিচের রাস্তা স্থানে স্থানে গরমে গলে গেছে। মাথার ওপর দাউদাউ করে সূর্য জ্বলছে। নির্বিকার বৃদ্ধ রিকশা কাঁধে করে দৌড়ে চলছে।

—বাবু একটু দম নিতে দেবেন। এক গেলাস সরবত খেয়ে নি। আমিও সরবতের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চির ওপর বসে পড়লাম।

—বাড়িতে তোমার কে কে আছে?

—দুই ছেলে, এক মেয়ে আর বিবি। বড় ছেলে হোটেলে কাবাব তৈরি করে। মাসে দেড়শ টাকা রোজগার করে। ছোট ছেলে স্পোর্টিং দলের টেনিস মাঠে বল কুড়ায়। বকশিশ-টকশিশ নিয়ে সেও পঁচাত্তর একশ’ টাকা কামিয়ে নেয়। মেয়ে আমার দেখতে ভালো। আমাদের পাড়ার খলিফার ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছে।

—বাঃ। তোমাদের তো দেখি বেশ সুখের সংসার।

–খোদার শোকর। আছি এক রকম। তবে রিকশা আর টানতে পারি না। বুকে ব্যথা করে। মাঝে মাঝে এত ব্যথা করে রাত্রে শুতে পারি না। আমার ছোট ভাই, সেও রিকশা টানত। মাশাল্লা দেখতেও ছিল ইয়া হাঁট্টা-গোট্টা। হঠাৎ একদিন মুখ থেকে রক্ত উঠল। তিন দিনের মধ্যে সব খতম। ছেলেপুলে হয় নি। ভাইয়ের জেনানা ক’দিন খুব কাঁদল। হালে আবার নিকে করেছে। বলতে গেলে আমিই এক রকম জোর করে নিকে বসিয়ে দিয়েছি। তা আমাকে মুরুব্বির মতো মানেও বটে।

ততক্ষণে বৃদ্ধ আবার কাঁধে রিকশা তুলে নিয়ে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। আমি বললাম : আবার নিকে করেছে। তাতে দোষ কি!

—না। দোষ আবার কি। নিকে করলেই কি আর দোষ হয়। আমার এই রিকশাতেই এত তামাশা হতে দেখেছি যে এখন আবার মাথার পিছনেও দুটি চোখ গজিয়েছে, সব দেখতে পাই।

আউটরাম ঘাটে পৌঁছে গেলাম। পুরো একটি টাকা বের করে বৃদ্ধকে দিয়ে দিলাম।

রিকশাঅলা তার দুটি অভিজ্ঞ চোখ তুলে এই যেন প্রথম আমাকে ভালো করে দেখল।

—আট আনা পয়সা আপনি ফেরত নিন।

—না না। তুমি গোটা টাকাটাই নাও।

—না বাবু। আপনি আট আনা ফেরত নিন।

এবার আমি হেসে ফেললাম।

—তোমরা তো জানি ভাড়া পেয়ে কখনো খুশি হও না। আজ আবার এ কি।

—বাবু আপনি ছেলে মানুষ বেশি কেন দেবেন?

তারপর রিকশাঅলাও হেসে ফেলল। বড় সুন্দর সে হাসি। বললো : বাবু হাঙ্গামা কি আপনারাই কম করেন? তিন মাইল পথ রোদে চরকির মতো ঘুরিয়ে নিয়ে চার আনা পয়সা গুঁজে দেন। সব মানুষ কি আর এক রকম। ভালো-মন্দ সবার মধ্যেই আছে।

হাস্যরত দুটি চোখ দিয়ে বৃদ্ধকে দেখতে লাগলাম।

—সালাম। চলি।

বৃদ্ধ আবার কাঁধে রিকশা তুলে নিল। যতক্ষণ না সে গলির মোড়ে অদৃশ্য হলো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে লাগলাম।

হয়তো এই বৃদ্ধই অন্য কোনো সময় তার ন্যায্য ভাড়ার চাইতে বেশি দাবি করবে। সেই অন্যায় দাবি মেনে না নিলে অশোভন বচসা শুরু করে দেবে। হয়তো আমিই তাকে তার প্রাপ্য ভাড়ার চাইতে কম দিতে চেষ্টা করব। তবু আজকের এই মুহূর্তটি বেশ লাগল।

শিবপুরের টিকিট কেটে বোটানিক্যাল গার্ডেনের জাহাজে উঠে পড়লাম। গার্ডেনে প্রবেশ করবার পর মুহূর্তেই অনেকগুলো পরিচিত মুখ চোখে পড়ল।

—সেলিনা, অনিমা, মুশতাক এবং আর একটি চতুর্থ মুখ যা চেনা ছিল না। অনিমা আর মুশতাক, প্রায় সমস্বরে এবং কলস্বরে চেঁচিয়ে উঠল : শাকের যে!

অনিমা এগিয়ে এলো, তার চোখে-মুখে স্মিতহাসি।

—তোমাকে বহুদিন দেখি নি। রোজই ভাবি খোঁজ করব কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে না। তুমিও তো মাঝে মাঝে খবরটবর নিলে পার।

অপরিচিত ছেলেটি একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। পরনে সাদা ধবধবে ফিনফিনে ধুতি, গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি, চোখে সানগ্লাস, মাথায় এক ঝাঁকড়া চুল নিখুঁতভাবে ব্যাকব্রাশ করা। এবং চোখেমুখে নম্র বিনীত হাসি।

—সুনীল রায়, স্কটিশ চার্চে বি.এ পড়ছেন, ফিলজিতে অনার্স। আমরা এক সঙ্গেই বি.এ দেব। আর এর নাম শাকের। খুবই ব্রিলিয়েন্ট ছেলে। এবার আই.এ দেবে।

—ব্রিলিয়েন্ট ছেলে! কেন আমার দুর্বল ঠ্যাং ধরে টানাটানি করছ।

—ইংরেজি ইডিয়মের বাংলা পরিভাষা তুমি উদ্ভাবন কর মন্দ না।

—পরিভাষার আর প্রয়োজন কি, কোদালকে তো কোদালই বলি।

—হ্যাঁ তা বল বটে, এবং অসুবিধায় পড়লে তোমার বিপদটিকে হাঁসের গায়ের পানির মতোই ঝেড়ে ফেল।

এবার সকলেই হেসে উঠল। এতক্ষণে সুনীল দু’হাত তুলে আমাকে নমস্কার করল। আমি মনে মনে স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলাম, যথারীতি সালাম দেব। কিন্তু অনিমা আর সুনীলের দু’জোড়া চোখের সামনে কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে গেলাম। বিশেষ করে এইমাত্র অনিমা আমার সম্বন্ধে যেসব প্রীতিকর বাক্য উচ্চারণ করল তারপর তার কাছে অপ্রীতিকর হতে পারে এমন কোনো আচরণের কথা ভাবতে পারলেও তা শেষ পর্যন্ত কার্যকরী করতে পারলাম না। অর্থাৎ সত্য কথা বলতে কি, আমারও দুটি হাত যন্ত্রচালিতের মতো নমস্কারের ভঙ্গিতে উঠে এলো।

সেলিনা ফ্লাওয়ার আইল্যান্ডের পাশে তারের ফেনসিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘাটে ভেড়া জাহাজটির চিমনির ওপর তার নজর। চিমনির ঠিক উপরেই একটা ঈগল পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল। অকস্মাৎ জাহাজ ছাড়ার তীব্র সঙ্কেতে চকিত হয়ে অনেক দূরে উড়ে চলে গেল।

আমরা হাঁটতে লাগলাম।

হাঁটতে হাঁটতেই অনিমা আবার বললো : সুনীল, তোমাকে কিন্তু শাকেরের সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া হয় নি। শাকের রীতিমতো ভালো গান করতে পারে—এবং সে মুসলিম লীগের একজন আদর্শ প্রচারক।

সুনীল বললো : তাই না কি। তারপর আমাকে উদ্দেশ করে যোগ করল : আপনার শেষোক্ত পরিচয়টাই কিন্তু ভয়ানক।

—ভয়ানক? ভয়ানক কিসে?

মুশতাক উসখুস করছিল। সে হঠাৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠল—দু’মিনিটও আলাপ হয় নি, এরই মধ্যে রাজনীতি শুরু হয়ে গেল। তার চাইতে চলো আমরা সকলেই কলকাতা ফিরে যাই। একটা ভালো কোনো ছবি দেখলেও হয়।

অনিমাও সোৎসাহে সায় দিল, কিন্তু পরক্ষণেই বললো : কলকাতায় ফিরে যাবে কি করে শুনি? ডানা তো নেই যে উড়ে যাবে। ফিরবার জাহাজ আবার ক’টার সময় পাব কে জানে!

মুশতাক আঙুল তুলে আউটরাম-ঘাট অভিমুখী একটি জাহাজের দিকে আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

—ঐ জাহাজটি দেখেই প্রস্তাবটি আমার মনে এলো। তাড়াতাড়ি কর। জাহাজ এখুনি ঘাটে ভিড়বে।

জাহাজে সবাই স্থির হয়ে ভালো করে বসতে-না-বসতেই আবার মুশতাকের কথায় আমাদের সকলের উৎসাহ কমে এলো।

—চললাম তো দল বেঁধে টিকিট পাব কি না কে জানে। অসহ্য অবস্থা করে তুলেছে এই যুদ্ধ। সিনেমায় যাও টিকিট পাবে না, হাউসফুল। চা খেতে যাও কোথাও বসবার জায়গা পাবে না। ট্রামে ওঠ; পাদানিতে পর্যন্ত ঠ্যাং রাখবার স্থান নেই। এমনকি রাস্তায় চল, ধাক্কা খাবে, ধাক্কা দিয়েছ বলে গলাধাক্কা খাবে। এখন সিনেমায় যাব, টিকিট তো পাবই না, মাঝ থেকে মন-মেজাজই যাবে বিগড়ে।

অনিমা একটুখানি হেসে উঠে চলে গেল। যাবার আগে বললো :

—দাঁড়াও দেখি, তোমার মন-মেজাজের দাওয়াই আনতে পারি কি না—একেবারে অব্যর্থ মহৌষধ।

আবার একটু পরেই ফিরে এলো। তার পিছনে সাত আট বছরের একটি নেপালি ছেলের হাতে একটি ট্রে; ট্রেতে ছোট ছোট গ্লাসে গরম চা, আর লম্বা লম্বা মিঠা বিস্কুট।

–তোমার ও চা-বিস্কুট খেলে আর দেখতে হবে না, এক্ষুণি কলেরা হবে।

মুশতাকের মন্তব্য।

অনিমাও সহাস্যে জবাব দিল, তোমার মাথা হবে।

–তোমাদের আর কোনো কাজ নেই, কেবল খাই খাই। এই বলে মুশতাক গোটা চারেক

বিস্কুট আর গেলাস দুই চা ট্রের ওপর থেকে তুলে নিল।

—এইমাত্র না কলেরার ভয়ে তোমার হাত-পা সব সেঁধিয়ে যাচ্ছিল!

দু’গাল ভরা বিস্কুটের পাহাড়ের পাশ দিয়ে কোনোমতে এই কথাগুলো বেরিয়ে এলো কলেরা যখন হবেই, তখন এক-আধখানা বিস্কুট খেয়ে কেন মরি, পেট পুরেই খেয়ে নি।

এই বলে মুশতাক আরো গোটা চারেক বিস্কুট টেনে নিল।

এতক্ষণে সেলিনা কথা বললো :

—কি করছ মুশতাক, সব কিছুতেই তোমার বাড়াবাড়ি!

মুশতাক কোনো জবাব দিল না। তার লম্বা জিহ্বা বের করে ভগ্নিকে সম্ভাষণ করল। জিহ্বায় পুরু হয়ে বিস্কুটের ভগ্নাবশেষ জমে আছে।

নেপালি বাচ্চাটা জিহ্বার এমন দর্শনীয় ব্যবহার দেখে পুলকে উছলে উঠল। মুশতাক সজোরে ধমকে উঠল। নেপালি সন্তানের হাসি তাতে এতটুকু সংযত হলো না।

মুশতাক হঠাৎ বালকটির হাত ধরে কাছে টেনে নিল। বললো : শোন্ রে। আর কিছু আছে খাবার? দিবি এনে?

ছেলেটি তার বিচিত্র মিশ্র ভাষায় কি বললো ঠিক বোঝা গেল না, কিন্তু দৌড়ে চলে গেল। একটু পরেই একটি থালায় বিভিন্ন প্রকার তেলে-ভাজা এনে হাজির করল।

মুশতাক থালাটি তার কোলের ওপরে টেনে নিয়ে তৎক্ষণাৎ সৎকার্যে মনোনিবেশ করল। বাকি পথটা তার মুখে কোনো কথা ছিল না।

বস্তুত ছোট স্টিমারটির ইঞ্জিনের শব্দ, আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশে নানারকম ছোট-বড় পাখার বিচরণ, নদীর দুই তীরে সবুজ মাঠ, ছোট-বড় গাছ, কলকারখানার চিমনি থেকে উত্থিত ধূম্রকুণ্ডলী এবং সারাদিনের ক্লান্তির সমগ্র প্রভাবে কথা বলতে কারই ভালো লাগছিল না। নদীর পানি কেটে স্টিমার চলেছে, চোখে-মুখে বাতাসের স্পর্শ, এই পরিবেশে নীরবতাই ভালো লাগছিল। পাখির পক্ষ সঞ্চালনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম কিনা জানি না; কিন্তু শুনতে পাচ্ছিলাম কল্পনা করতে বেশ লাগছিল।

এক সময় অনিমা বললো :

—আমার ডান হাতের তালুটা সকাল থেকে চুলকাচ্ছে। ডান হাত চুলকালে কি হয় রে? সেলিনা জবাব দিল :

—শুনেছি অনেক টাকা আসে।

অনিমা তবু সন্দিহান হয়ে আবার প্রশ্ন করে : টাকা আসে। না, বিদেশ যেতে হয়।

—না রে। পা চুলকালে বিদেশ-যাত্রা!

এবার সুনীল বললো :

—আমি তো জানি, ডান হাতই হোক আর বাম হাতই হোক, চুলকালে আরটিকেরিয়া, এগজিমা, পাঁচড়া এইসব হয়।

—তুমি বড্‌ড বেরসিক। দেখ তো আরটিকেরিয়া বা এগজিমার কোনো লক্ষণ দেখতে পাও কি না।

অনিমা উঠে এলো, সুনীলের দিকে দুটি হাতই প্রসারিত করে দিল। সুনীল দুই হাত দিয়ে অনিমার ডান হাতটি চোখের সামনে টেনে আনল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।

সেলিনার চোখে-মুখে হাসি, বললো : সুনীল, লক্ষণগুলো আবিষ্কার করতে সময় বড় বেশি লাগছে না?

অনিমা এক ঝটকায় তার হাত টেনে নিল। আমাদের পিছনে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন। তিনি পর্যন্ত হেসে উঠলেন।

মুশতাক ঠিকই বলেছিল। কোনো সিনেমাতেই টিকিট পাওয়া গেল না।

অগত্যা যে-যার গৃহাভিমুখে প্রস্থানের সিদ্ধান্ত করলাম। একটা ট্যাক্সিতে উঠবার আগে অনিমা বললো : শাকের আগামী সোমবার আমার জন্মদিন, না এলে কিন্তু ভারি রাগ করব।

সেলিনার সঙ্গে একটি কথাও হলো না। এমনকি তারা চলে গেল, তবু একটা বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত না।

.

যখন বাড়ি ফিরে এলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। কিছুই ভালো লাগছিল না। মনে করেছিলাম, শোবার ঘরে গিয়ে চুপচাপ আরাম করব। সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, বাম দিকের অন্ধকার কামরা থেকে মেজ ভাইয়ের ডাক ভেসে এলো : শাকের শুনে যা!

বহুদিন এই ঘরটায় আসি নি। বিছানার চাদর-বালিশ সবকিছুই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে আছে, আর তেমনি নোংরা ঘরের কোণে একটা সোরাই রাখা আছে, তার মুখটা খোলা, এবং তার চারদিক পানিতে ভেজা। কাছেই একটা গেলাসও ভেঙে পড়ে আছে। ঘরে আলো জ্বালানো হয় নি; কিন্তু খোলা জানালার ভিতর দিয়ে স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো ঘরের ভিতরটাও আলোকিত করে দিয়েছে। মেজ ভাইয়ের মুখে এক মুখ দাড়ি, কত দিন যে দাড়ি কামানো হয় নি তার হিসাব নেই।

—তুই সারাদিন কোথায় থাকিস রে!

কোনো জবাব দিলাম না।

—আচ্ছা বোস। এই চেয়ারটায় বসে পড়। না না, ও চেয়ারটায় বসিস না। ওর একটা পা ভাঙা। বিছানার এই কোণটায় বসে পড়

আমিও তাই করলাম। মেজ ভাই সেইভাবেই বহুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকলেন। তাঁর মুখেও কোনো কথা নেই, আমিও নীরব।

তুই ‘জুড দি অবস্কিওর’ পড়েছিস?

—জি না।

এবার মেজ ভাই রেগে উঠলেন, ভয়ানক রেগে উঠলেন।

–তোর মতলব বুঝেছি। তুই আমার কাছে বসতে চাস না। আচ্ছা যা। যা বলছি। এক্ষুণি চলে যা।

আমিও ভয়ে ভয়ে উঠে পড়লাম।

আশ্চর্য, মেজ ভাই তৎক্ষণাৎ আবার শান্ত হয়ে গেলেন।

—যা। কিন্তু আসবি আবার মাঝে মাঝে। বড্ড একা একা থাকি রে।

—একা থাকেন কেন? বাইরে গেলেই তো পারেন।

—বাইরে যাব? কোথায় শুনি? তুই জানিস, আমার এই কামরাটার বাইরে গোটা দুনিয়াটাই পাগলাখানা। তুই ওসব বুঝবি না। যা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *