অর্ধেক মানবী – ৯

সারারাত ঘুম এল না কিছুতেই।

শুধু চোখের সামনে নীলাকে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এ রক্তমাংসের জীবন্ত নীলা নয়, আমার ঘরে সে কখনো আসেনি। অন্ধকারের মধ্যে ভেসে উঠেছে তার ছবি, সে হাসছে, কথা বলছে, মিলিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ।

কে ঐ নীল শাড়ি পরা মেয়েটি? যখন সে সত্যি সত্যি আসে, তাকে স্পর্শ করি, তখন বেশি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে না, মনে হয়, তার উপস্থিতি খুব স্বাভাবিক, সে শুধু আমারই জন্য আসে। তাকে অন্য লোকরাও দেখতে পায়, একবালপুরের গুণ্ডা দুটো বলেছিল, মেয়েটা কোথায় গেল?

মাথার মধ্যে যখন চিড়িক চিড়িক ব্যথাটা বেশ বেড়ে যায়, তখনই নীলা আসে। কিন্তু এই ব্যথাটা কখন কোথায় শুরু হবে, তার ঠিক নেই। ব্যথাটা আমি সৃষ্টি করতে পারি না। তাই ইচ্ছেমতন যে-কোনো সময় তাকে ডাকা যায় না।

নীলা বার বার বলে, আমাকে যেতে দিও না, আমাকে পরিপূর্ণ করো! এর মানে বুঝতে পারি না। আমিই কি তাকে নির্মাণ করছি? তাকে পুরোপুরি নির্মাণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি একটু উচ্ছল হয়ে উঠলেই ও আর থাকতে পারে না।

কতখানি তীব্র একাগ্রতায় এমন একজন নারীকে সম্পূর্ণভাবে ধরে রাখা যায়?

দু’দিন ধরে আমার আর কিছু ভালো লাগছে না।

নীলার মতন একটি মেয়ে আমার কাছে স্বেচ্ছায় আসে, আমার দুঃখের সে ভাগ নিতে চায়, অপমানের সময় সে সান্ত্বনা দেয়, এরকম সৌভাগ্য কজনের হয়? আবার সে কোথায় থাকে তা জানি না, ইচ্ছে করলেও আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারি না, এও যে চরম কষ্টকর!

নীলা যে বলল, সে দিকশূন্যপুরে থাকে, কাছাকাছি দিকশূন্যপুর তৈরি হয়েছে, তা কি ইয়ার্কি? আমি অনেকদিন দিকশূন্যপুরে যাইনি। সে জায়গাটার জন্য আমার মন কেমন করে!

জানলার বাইরে একটা চিলের ডাক শোনা গেল। প্রত্যেকদিন ঐ চিলটার ডাকে আমার ভোর সূচিত হয়, ছাদের কার্নিসে এসে বসে।

এখন আর ঘুমোবার চেষ্টা করারও কোনো মানে হয় না।

রাস্তায় খবরের কাগজের হকাররা সাইকেলের বেল বাজিয়ে ছুটছে। ঠিকে—`ঝি দরজায় ধাক্কা দিতে আমিই গিয়ে খুলে দিলুম।

মা কিংবা দাদা-বৌদি এখনো জাগেনি। ভোরের নরম আলো গায়ে মাখবার জন্য আমি দাঁড়ালুম গিয়ে বারান্দায়। হাফপ্যান্ট আর কেডস পরে অনেক প্রৌঢ় মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছে, কোমরের বেড় কমাবার জন্য কেউ কেউ ছুটছে।

এ দৃশ্য আমার ভালো লাগে না। ছাদটা বরং আকর্ষণীয়। মা অনেকগুলো ফুলগাছের টব বসিয়েছেন। টবের গাছ আমার তেমন পছন্দ নয়, কিন্তু মধুর অভাবে গুড়। গাছের পাতায় যে ভোরের শিশির লেগে থাকে, সেগুলো আঙুলে তুলে ঠোটে লাগালে বেশ একটা প্রকৃতিকে চুমু খাওয়ার স্বাদ পাওয়া যায়। অবশ্য শিশির পড়ে শীতকালে। এখন পাতাগুলো ভেজেনি।

ছাদের দরজাটা বন্ধ করে দিলুম। এখানে আমি সম্পূর্ণ একা। এখন নীলা আসতে পারে না? সেই এক বৃষ্টির রাতে যেমন এসেছিল?

আমি গুনগুন করে বলতে লাগলুম, নীলা, এসো, নীলা, এসো…।

ফুরফুরে হাওয়ায় এত আরাম লাগছে, মাথার মধ্যে একটুও ব্যথা নেই!

আমি সারা ছাদ ঘুরে ঘুরে ডাকতে লাগলুম নীলা, এসো, নীলা, একবার এসো, একটুক্ষণের জন্য।

কোনো সাড়া নেই। কোথায় নীলা? কোনো পাত্তা নেই।

রোদ্দুর চড়া হবার পর নেমে এলুম ছাদ থেকে।

চা তৈরি হয়ে গেছে। আমার দিকে এক কাপ এগিয়ে দিয়ে বৌদি জিজ্ঞেস করল, তুমি বুঝি ছাদে গান গাইতে যাও?

আমি বললুম, না, ধ্যান করি।

বৌদি এমন একটা চোখের ভঙ্গি করল, যেন এরকম অসম্ভব কথা সে কখনো শোনেনি! অথচ আমি খাঁটি সত্যি কথাই বলেছি, সত্যের কি হেনস্থা!

বৌদি আবার জিজ্ঞেস করল, আজ তো তোমার ছুটি। তোমার দাদা বলছিল, আজ তুমি বাজার করে আনবে, না ও যাবে?

আমাকে এখন সকাল আটটার মধ্যে অফিসে বেরুতে হয় বলে বাজার করার দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি। বাড়ির অন্যান্য কাজের জন্যও এখন আর যখন তখন কেউ আমাকে হুকুম করে না। ঠিকে-ঝির মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সে সকালের দুধ নিয়ে আসে। কেরোসিন কিংবা চিনি সে যোগাড় করে। বাড়ির চাকরগিরি করার বদলে আমি এখন এক ওষুধ কোম্পানির চাকর হয়েছি, তাই বাড়িতে খাতির বেড়ে গেছে। যদিও এখনো এক মাসের মাইনেও পাইনি, তবু সেই সম্ভাবনাতেই বৌদি টাকা ধার দেয়।

দাদা একদিন জিজ্ঞেস করছিল, হ্যাঁরে নীলু, তোরা অফিস থেকে বিনা পয়সায় ওষুধ পাস না? তোদের কোম্পানি ভালো আয়রন টনিক বানায়। আমার পেটের গোলমালটা কিছুতে যাচ্ছে না, মাসে তিরিশ-পঁয়তিরিশ টাকার ওষুধ কিনতে হয়!

আমি বলেছিলুম, না, কারুক্কে কিছু নিতে দেয় না।

দাদা বলেছিল, কমিশনে তো অন্তত পেতে পারিস? খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, নিশ্চয়ই অনেকেই নেয়।

বৌদি বলেছিল, নীলু মুখ ফুটে কারুকে কিছু বলতেই পারবে না। ও যা মুখচোরা!

পঁয়তিরিশ টাকার ওষুধের কত কমিশন হতে পারে? আমি যদি বলতুম, একগোছা টাকা আমি খামসুদ্ধ জলে ফেলে দিয়েছি, তা হলে দাদা-বৌদির মুখের চেহারা কীরকম হতো?

অফিসের পার্টিতে দাদা ড্রিংক করে, মাঝেমধ্যে বাড়িতেও হুইস্কির বোতল কিনে আনে। শস্তা বোতলের দামও আশি-নব্বই টাকা। বিনা পয়সায় স্কচ পাবার সম্ভাবনা দেখলে কি দাদা ছাড়ত?

দাদা নিউজ এজেন্সিতে কাজ করে। সে অফিসে ঘুষ পাবার কোনোরকম সুযোগই নেই। দাদা তাই ঘুষের বিরুদ্ধে প্রায়ই বক্তৃতা দেয়।

অনেকটা দয়া করার ভঙ্গিতে বৌদিকে বললুম, ঠিক আছে, দাও আমিই আজ বাজার করে দিচ্ছি!

মায়ের জন্য নিমপাতা আর চালতা, বৌদির জন্য মোচা, আর দাদার জন্য চিংড়িমাছের মুড়ো, এই তিনটে জিনিস আনতেই হবে। আমাদের মতন পরিবারে গলদা চিংড়ি খাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না, তবে শুধু মুড়ো এক একদিন বেশ শস্তায় পাওয়া যায়। মাছগুলো চলে যায় সাহেবদের দেশে। ভাগ্যিস বোকা সাহেবগুলো এখনো গলদা চিংড়ির মুড়োভাজা খেতে শেখেনি!

বাজার করতে আমার খারাপ লাগে না, কিন্তু আজ কোনো উৎসাহ পাচ্ছি না। কয়েকদিন বৃষ্টি হয়নি, তবু বাজারের মধ্যে জল প্যাচপ্যাচ করছে, মাছের বাজারটার মুখে নোংরা জলের মধ্যে মধ্যে ইঁট পেতে রেখেছে। কেউ কোনো আপত্তি বা প্রতিবাদ করে না। একটা লোক আমাকে ধাক্কা দিতেই নোংরার মধ্যে পা পড়ে গেল!

লোকটা ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল টপ করে। সুযোগও দিল না প্ৰতিশোধ নেবার। শুধু চটি না, প্যান্টেও কাদা লেগেছে।

সব কিছুর আজ আগুন দাম। ট্যাংরা মাছ ষাট টাকা, কুচো চিংড়ি পঁয়তিরিশ। পার্শে মাছ পঞ্চাশ, গলদার মুড়ো আসেনি। এইসব দিনে অ্যামেরিকান পোনা ছাড়া গতি নেই, যদিও দাদা এই পেটমোটা মাছ দু’চক্ষে দেখতে পারে না।

ছুটির দিনে বাজারের বাজেট পঁচিশ, অন্যদিন কুড়ি। এখনো বলতে গেলে একা দাদার উপার্জনেই সংসার চলছে, বৌদির মাইনে সামান্য। এর বেশি খরচ করার উপায় নেই। কিন্তু এই টাকাতে কিছুই প্রায় কেনা যায় না। মাত্র কয়েক বছর আগে বাবা দশ টাকাতে কত কী কিনে আনতেন!

ছোট সাইজের অ্যামেরিকান পোনা কুড়ি টাকা কিলো, একটার ওজন হলো পাঁচশো। মাছটা থলিতে নেবার পর আমি মাছওয়ালার দিকে কুড়ি টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলুম।

সে লোকটা একটা চটের নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে, কী ভেবে আবার বার করে আনল। সেটা চোখের সামনে তুলে ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সে বলল, দাদা, এটা তো চলবে না। এটা জাল!

আমি চমকে গিয়ে বললুম, জাল?

মাছওয়ালা বলল, এই দেখুন না। জলছাপ নেই। মাঝখানটায় জোড়া।

নোটটা নিজের হাতে নিয়ে দেখলুম, সত্যিই সেটাতে জলছাপ নেই, মাঝখানটায় আঠা দিয়ে জোড়া হয়েছে। একটা অতি বাজে ধরনের জালি নোট।

আমি বললুম, যাঃ!

ঐ যাঃ বলাটাই আমার কাল হলো। আমার কাছে আর মাত্র পাঁচ টাকা আছে, বাজার করা হবে না, আবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে, এইসব দ্রুত চিন্তায় আমার মুখ দিয়ে ঐ অসাবধান উক্তি বেরিয়ে এল।

কেননা পরের মুহূর্তেই বুঝলুম, কোথাও কিছু একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। এই নোটটা আমি দিইনি। আমার টাকাটা ছিল অপেক্ষাকৃত নতুন, সেটা দু ভাঁজ ছিল, এটা চার ভাঁজ। সব টাকাই এক এক টুকরো কাগজ, তবু হাতে নিলে দুটো নোটের তফাৎ বোঝা যায়।

মাছওয়ালা বলল, কেউ আপনাকে গছিয়ে দিয়েছে! একদম দু’নম্বরি!

আমি বললুম, এটা তো আমার নোট নয়। আমি এটা দিইনি ভাই তোমাকে।

—বাঃ, এই মাত্তর দিলেন!

–না, না, অন্য নোট দিয়েছি। তুমি তোমার ওখানটায় দ্যাখ।

—এই দেখুন, আমার এখানে আর কুড়ি টাকার নোটই নেই। আমি দেখে শুনে এইরকম নোট নেবো? আর একখানা দিন।

—আর একখানা নেই আমার কাছে। আমি বলছি, আমি ভালো নোট দিয়েছি!

সে লোকটি পাশের এক মাছউলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি দ্যাখনি, এই বাবু একটা কুড়ি টাকার নোট দিলেন! আমার কাছে এই একখানাই মাত্তর কুড়ি টাকা। অথচ উনি বলছেন, উনি দ্যাননি!

মাছউলি ভালোমানুষের মতন মুখ করে বলল, হ্যাঁ, দেখলাম তো!

আমি এবার ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলুম, দেখবে মানে, কী দেখবে? আমি একটা নতুন কুড়ি টাকার নোট দিয়েছি!

–না, আপনি দ্যান নি।

—হ্যাঁ দিয়েছি।

অন্য পাশ থেকে আর একজন মাছওয়ালা নোটটি দেখে আমার দিকে আবার বাড়িয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, এ কী চালাতে এসেছেন, দাদা? এই ভূষিমাল কখনো চলে?

রাগে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছে। এরা আমাকে ভেবেছেটা কি? আমি গোছা গোছা পঞ্চাশ টাকার নোট কচুরিপানা ভর্তি জলে ফেলে দিয়েছি, সেই আমাকে মাত্র কুড়ি টাকার জন্য অবিশ্বাস? পৃথিবীটা কী হয়ে যাচ্ছে দিন দিন!

মাছওয়ালা হাত বাড়িয়ে আমার থলে থেকে মাছটা তুলে নেবার চেষ্টা করতেই আমি গর্জন করে বললুম, খবর্দার, হাত দেবে না!

লোকটি গলা তুলে বলল, আপনাকে মিনিমাগনায় মাছ দেব নাকি?

চ্যাঁচামেচিতে খানিক ভিড় জমে গেছে। কিন্তু আমি কিছুতেই ছাড়তে রাজি নই। কেউ একজন বিদ্রূপ করে বলে উঠল, ভ্যাজাল নোট চালাতে গেলে জেল হয়ে যায়!

আমি মুখ ফিরিয়ে তাকে কিছু বলতে যেতেই দেখি পাশে দাঁড়িয়ে আছে নীলা!

আমার সমস্ত রাগ উবে গেল এক মুহূর্তে। আমি স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম। আমার মাথায় তো কোনো যন্ত্রণা হয়নি, তবু নীলা এসেছে?

নীলা মৃদু গলায় বলল, চল।

আমি কাতরভাবে বললুম, দ্যাখ, এরা আমাকে ঠকাচ্ছে!

মাছওয়ালা নীলাকে বলল, দেখুন তো দিদি, আমার কী দোষ! উনি কোথা থেকে একটা জালি টাকা নিয়ে এসেছেন!

নীলা বলল, ঠিক আছে। কোনো একজনের ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই। আপনার কিংবা ওর।

আমি বললুম, আমার ভুল হয়নি।

নীলা আমার বাহু ছুঁয়ে বলল, মাছ কিনতে হবে না, চলো।

আমি থলি উপুড় করে ঢেলে দিলুম মাছটা। নোটটা ছুঁড়ে দিলুম লোকটার দিকে। তারপর নীলার সঙ্গে বেরিয়ে এলুম সেই ভিড় থেকে।

নীলা সলজ্জ ভৎসনার সুরে বলল, তুমি বাজারের লোকজনদের সঙ্গে মারামারি করতে যাচ্ছিলে, নীললোহিত? এ কি তোমাকে মানায়?

সঙ্গে সঙ্গে দোষ স্বীকার করে নিয়ে আমি বললুম, না, আমার ভুল হয়েছে। ওদের সঙ্গে তর্কে আমি পারতুম না। কিন্তু আমাকে এমনভাবে ঠকাবে কেন? বলো?

নীলা বলল, ওকে নিশ্চয়ই অন্য কেউ ঠকিয়েছে।

—তুমি কী করে ওই বাজারের ভিড়ের মধ্যে আমাকে খুঁজে পেলে, নীলা?

—আমার তবু একটু দেরি হয়ে গেল। আমি সকাল থেকেই তোমার কাছে আসতে চাইছিলুম।

—তোমার কাছে টাকা আছে, নীলা? আমাকে ধার দেবে? আমার কাছে মাছ কেনার আর টাকা নেই। পকেটে আর মোটে পাঁচ টাকা।

—আমার কাছেও টাকা নেই। তোমার পাঁচ টাকায় কিছু পাওয়া যাবে না?

—হ্যাঁ, নিমপাতা, চালতা, মোচা কোনোরকমে হয়ে যেতে পারে। আলু-পেঁয়াজের দোকান আমার চেনা, ওখানে ধারে পেতে পারি। নিরামিষ বাজার হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে বাজারে ঘুরবে? তোমার কষ্ট হবে। এই নোংরা, জল-কাদার মধ্যে!

—যাঃ, কষ্ট আবার কিসের? অন্য মেয়েরা বুঝি বাজারে আসে না? ঐ তো, আরও দু’-একজনকে দেখছি!

—কিন্তু তুমি যে অন্য সকলের চেয়ে আলাদা।

—কিচ্ছু আলাদা নই। চলো, তুমি কী রকম বাজার করো, দেখব। তুমি দরদাম করতে পার?

—নিমপাতা আর চালতা মোচা কেনার জন্য দরদাম লাগে না।

বাজারের অনেক লোক ঘুরে ঘুরে নীলাকে দেখছে। কেউ নীলার গায়ে ধাক্কা দেবার চেষ্টা করলে আমি তাকে হাত দিয়ে ঘিরে রাখছি। প্রায় সর্বক্ষণই নীলার শরীরের সামান্য ছোঁয়া লাগছে আমার শরীরে।

মোচা কেনার সময় আমি একটা ফুল ছিঁড়ে তার গোড়াটা দাঁতে কাটতেই নীলা জিজ্ঞেস করল, ও কি করছ? খাঁচা খাচ্ছ?

আমি বললুম, তুমি জান না বুঝি? কোনো কোনো মোচা তেতো হয়। সেইজন্য খেয়ে দেখতে হয়।

নীলা বলল, দেখি দেখি! আমিও একটু খেয়ে দেখি!

মোচাওয়ালি মেয়েটি বলল, দেখুন দিদি, আপনিও দেখুন। আমি তেতো মোচা বেচি না।

মাছওয়ালা, মোচাওয়ালি এরা সবাই নীলার সঙ্গে কথা বলছে। নীলা অলীক নয়। এই উপলব্ধি একটা অদ্ভুত আনন্দে যেন আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছে।

আলুওয়ালা ধার দিতে রাজি হয়ে গেল এক কথায়। এক কিলো আলু সে ওজন করে দিচ্ছে, তার থেকে একটা আমি তুলে নিয়ে বদলে দিলুম।

নীলা জিজ্ঞেস করল, ঐ একটা আলু তুমি শুধু সরিয়ে দিলে কেন?

আমি বললুম, ঐ আলুটার গা খানিকটা নীল রঙের। মেয়েদের নীল রঙের শাড়িতে মানায়। কিন্তু নীল রঙের আলু ভালো হয় না। যারা ধারে কেনে, আলুওয়ালা তাদের নীল রঙের আলু দেয়।

আলুওয়ালাটি হেসে বলল, না, না। আমি দেখতে পাইনি।

আমি বললুম, পেঁয়াজও ধারে দিতে হবে। কিন্তু থ্যাৎলানো পেঁয়াজ তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে চলবে না।

নীলা খুব মজা পাচ্ছে। সে তার চম্পকবর্ণ হাতটি মুখে চাপা দিয়ে হাসছে নিঃশব্দে।

নিমপাতা কেনার পর আর মোটে দশটি পয়সা বাকি রইল। আর একটা দরকারি জিনিস বাদ পড়ে গেছে। কাঁচা লঙ্কা।

বাজারের বাইরের রাস্তায় এক বুড়িকে বললুম, ওগো, দশ পয়সার কাঁচা লঙ্কা দাও তো?

বুড়ি মুখঝামটা দিয়ে বলল, দশ পয়সায় হবে না! কাঁচালঙ্কার এখন অনেক দাম!

কাঁচালঙ্কার এখন যে কত দাম, তা কি আমি জানি না! মাত্র একশো গ্রামের দাম এক টাকা। কিন্তু আমার কাছে যে দশ পয়সার বেশি আর নেই।

আমি বললুম, দাও না যে কটা হয়।

পয়সাটা তার কোলের ওপর ফেলে দিতে সে আর আপত্তি করতে পারল না। এই বুড়ির যৌবনে দশ পয়সার কত মূল্য ছিল, তা ভুলে যায়নি নিশ্চয়ই। গজগজ করতে করতে বলল, জিনিসপত্রের দাম এত বাড়ছে, সে কি আমাদের দোষ?

গোটা সাতেক লঙ্কা তুলে দিল সে। তাও খুব কৃপার সঙ্গে।

কয়েক পা হেঁটে যাবার পর আমি নীলাকে জিজ্ঞেস করলুম, বাজারে এত লোক থাকতে ঐ মাছওয়ালাটা আমাকেই ঠকাবার জন্য বেছে নিল কেন?

নীলা বলল, তুমি কুড়ি টাকার শোক ভুলতে পারনি?

আমি বললুম, শুধু টাকার জন্য নয়। লোকটা আমাকে মিথ্যেবাদী, জোচ্চোর প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছিল। ও আমাকে….

হঠাৎ থেমে গিয়ে আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলুম। এতক্ষণ অন্য দিকটা আমি খেয়াল করিনি। মাছওয়ালাটি আজ আমার দারুণ উপকার করেছে।

আমি বললুম, না, না, না, ও ঠিক করেছে। ভাগ্যিস জাল টাকাটা চালাবার জন্য আমাকেই বেছে নিয়েছিল! ও ওরকমভাবে অপমান না করলে তুমি বাজারে আসতে না, নীলা!

নীলা বলল, আমি ওর কথা শুনিনি। তুমি আমাকে ডাকছিলে…

এও আর একটা বিস্ময়। ভোরবেলা ছাদে ঘুরতে ঘুরতে কতবার আকূলভাবে ডেকেছি, তবু নীলা আসেনি। বাজারে আমি নীলাকে ডাকব কেন? তার কথা তখন মনেও পড়েনি। অথচ নীলা আমার ডাক শুনতে পেয়েছে বলছে। গভীরভাবে ডাকারও একটা রহস্য আছে। আমি কখন ডাকি আমি নিজেই তা জানি না।

আমি ওর হাত ছুঁয়ে বললুম, সেদিন তুমি আকাশ দেখিয়েছিলে। তুমি কি সত্যিই মহাকাশ থেকে আসো?

মুচকি হেসে নীলা বলল, হতেও পারে। নাও হতে পারে।

—তুমি কি কল্প-বিজ্ঞানের নায়িকা? কিন্তু তাদের তো পাহাড়ের উপত্যকায় কিংবা খুব নির্জন কোনো জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। বাজারের ভিড়ে, এরকম নোংরা জল-কাদার মধ্যে তো তাদের দেখা পাওয়ার কথা কখনো শোনা যায়নি!

—আমাকে বিশ্বাস করো, নীললোহিত, আমি যখন তোমার কাছে আসি, তখন পেছনের কোনো কথাই আমার মনে পড়ে না। তখন আমি শুধু তোমাকেই চিনি। অন্য কোনো প্রশ্নও আমার মনে জাগে না।

—ঠিক বলেছ। আমিও প্রশ্ন করতে চাই না। তুমি যে আসো, দেখা দাও, সেটাই তো দারুণ ব্যাপার। আমার মহাভাগ্য। তুমি এলেই আমার মনটা আতর জলে ধোওয়া হয়ে যায়। তুমি আছ, এটাই যথেষ্ট। ‘তুমি যে তুমিই ওগো, সেই তব ঋণ’! তবু মানুষ তো সব সময় যুক্তি খোঁজে। তাই আমিও জানতে চাই, তুমি আমার কাছেই আসো কেন? আমি তো সেরকম কেউ না। কোনো দিক থেকেই আমার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। আমার মতন কত ছেলে এই শহরে ফ্যা—ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমাকে পাবার মতন আমার যে কোনো যোগ্যতাই নেই, নীলা! দেখছ না, আমি কত ব্যাপারে হেরে যাই! আমাকে লোকে ভয় দেখায়, ঠকায়, আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে পারি না। আমি সব সময় পালাবার সুযোগ খুঁজি। তোমার মতন মেয়েকে সাধারণত সার্থক পুরুষরাই পায়।

–আমি তো আর কোনো সার্থক পুরুষকে চিনি না, নীললোহিত।

—এই কলকাতা শহরের এত পুরুষমানুষের মধ্যে তুমি আর কারুকেই চেন না?

—না, এখনো চিনি না। চেনা উচিত বুঝি?

–না, না, সে কথা বলছি না। তুমি শুধু আমাকে চেন। এজন্য গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছে। আমার হুর-রে বলে চিৎকার করা উচিত। এই রাস্তার মধ্যে আমার নাচতে, ডিগবাজি খেতে ইচ্ছে করছে!

—নীললোহিত, এবার আমাকে চলে যেতে হবে। আমার শরীর কাঁপছে।

—না, এখন যেও না। এত তাড়াতাড়ি…তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। যেও না!

—এই দ্যাখ, আমার শরীরটা কাচের মতন হয়ে যাচ্ছে!

সত্যিই তো তাই। নীলার হাত দুখানা কাচের মতন স্বচ্ছ হয়ে আসছে। তার মুখখানা প্রিজম-এর মতন, রোদ্দুর পড়ে এমন ঝলসাচ্ছে যে তাকানো যাচ্ছে না! আমি বাজারের থলেটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সেই প্রকাশ্য রাস্তায় তার কাঁধ চেপে ধরে বললুম, তোমাকে এখন আমি কিছুতেই যেতে দেব না!

নীলা ফিসফিস করে বলল, যেতে দিও না, আমাকে জোর করে ধরে রাখ!

আমি বললুম, তোমার কাচের মতন শরীর ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে না তো?

নীলা বলল, আমাকে তোমার বুকের মধ্যে মিশিয়ে নাও।

একটা গাড়ি আমাদের পেছনে এসে হর্ন দিচ্ছে। আমি বললুম, সরব না, কছুতেই সরব না। ছেড়ে দিলেই নীলা এখান থেকে চলে যাবে।

নীলা বলল, এই দ্যাখ, হাতদুটো আবার ঠিক হয়ে গেছে। চল, ফুটপাথে উঠি।

বেলা প্রায় সাড়ে আটটা। এখন রাস্তা-ভর্তি মানুষ। অনেকে অবাক হয়ে দেখছে আমাদের। কিন্তু নাগরিক সভ্যতায় কেউ কোনো মন্তব্য করে না।

ট্রাম রাস্তার কাছে এসে রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়িয়ে আমি বললুম, নীলা, তুমি কাচের মতন স্বচ্ছ হয়ে মিলিয়ে যেতে চাইছিলে, তখন আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, সে কষ্ট কারুকে বোঝাতে পারব না।

নীলা বলল, ঠিক আমারও অতখানিই কষ্ট হয়।

—তুমি সেদিন দিকশূন্যপুরের কথা বলছিলে! দিকশূন্যপুরের কথা তুমি কী করে জানলে? খুব কম লোকেই সে জায়গাটা চেনে।

—আমি তো দিকশূন্যপুরেই ফিরে যাই।

–তুমি বললে, এখন কাছাকাছি দিকশূন্যপুর তৈরি হয়েছে! এটা আমার ও জানা ছিল না।

–তুমি যাবে সেখানে, নীললোহিত?

–বাঃ যাব না? তুমি আমাকে নিয়ে যাবে বলেছিলে। আজই চলো।

–ঠিক আছে, তুমি বাজারের থলেটা রেখে এসো।

–তুমি এর মধ্যে আবার হারিয়ে যাবে না তো? নীলা, তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়ি পর্যন্ত এসো। আমি এক দৌড়ে ওপরে রেখে আসব।

কলকাতা শহরের ছেলেমেয়েরা হাত-ধরাধরি করে যায় না। কিন্তু গেলেই বা ক্ষতি কি? আমি নীলার হাত ধরে হাঁটতে লাগলুম।

নীলাকে ওপরেও নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তা হলে অনেক নীরব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আমার একজন বান্ধবী এলে মা কিংবা বৌদি ভুরু তুলবে না, কিন্তু নীরব প্রশ্নগুলো গায়ে বিধবে ঠিকই। তাতে নীলা যদি আবার কাচের শরীর হয়ে যায়!

বাড়ির সামনে এসে বললুম, তুমি এখানে একটু দাঁড়াবে? দু মিনিট!

নীলা ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।

আমি নীলার একটা হাত তুলে নিয়ে কড়ে আঙুলের ডগাটা সামান্য কামড়ে দিলুম।

নীলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এটার মানে কি?

আমি বললুম, তোমাকে একটা গণ্ডি দিয়ে রেখে যাচ্ছি। কেউ তোমার ওপর নজর দিতে পারবে না।

দু’তিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে এলুম ওপরে। দরজাটা হাট করে খোলা। একটা ধপধপে সাদা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের ফ্ল্যাটের মধ্যে।

বৌদিদের ঘরের দরজা বন্ধ। সেখান থেকে বৌদি জিজ্ঞেস করল, কে, নীলু? দ্যাখো, কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! একটা কুকুর ঢুকে পড়েছে!

আমি হাসতে হাসতে বললুম, এত সুন্দর একটা স্পিৎজ, এটা দেখে ভয় পাচ্ছ! এ কুকুর কামড়ায় না। এটা কোত্থেকে এল?

বৌদি বলল, জানি না। তুমি ওটাকে তাড়িয়ে দাও প্লিজ। না হলে আমি ঘর থেকে বেরুতে পারব না। সদর দরজা খোলা রেখে গেছে, অমনি এই কুকুরটা ঢুকে পড়েছে!

—দাদা কোথায়?

—তোমার দাদা এইমাত্র বেরুল। মা বাথরুমে। আমাকে একা পেয়ে কুকুরটা কামড়ে দিতে এসেছিল।

–বৌদি, তুমি আর লোক হাসিও না। এইটুকু কুকুরকেও কেউ ভয় পায়! ওরা কামড়ায় না, আদর খেতে ভালোবাসে।

—তুমি ওকে বার করে দরজা বন্ধ করে দাও আগে!

কুকুরটা আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।

আমি নীচু হয়ে ওটাকে ধরতে যেতেই ও ভুক ভুক করে দুবার ডেকে দৌড়ে ঢুকে গেল আমার শোবার ঘরে।

আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে—কিন্তু কুকুরটা না তাড়ালে সত্যিই বৌদি বেরুতে পারবে না। দোতলায় ভাড়াটেরা কুকুর পুষছে নাকি?

আমি আয়, আয়, আয় বলে একটু একটু করে এগোতে লাগলুম ওটার দিকে, সেটাও একটু একটু করে পিছিয়ে ঢুকে গেল খাটের তলায়। যত ডাকি, কিছুতেই আসে না। এইটুকু কুকুরের তেজ আছে, এক একবার দাঁত বার করে ভয় দেখাতে আসে!

খাটের তলা থেকে কুকুর বার করা সোজা কথা নয়। অন্য ঘর থেকে বৌদি চ্যাঁচাচ্ছে, গ্যাছে? গ্যাছে?

আমি বললুম, দাঁড়াও, বার করছি, আর একটা লাঠি যদি পাওয়া যেত!

আজকাল কেউ বাড়িতে লাঠি রাখে না। হাতপাখাও থাকে না। খবরের কাগজ পাকিয়ে ভয় দেখাই, সেটা তবু এক কোণ থেকে অন্য কোণে সরে যায়। এ তো মহা মুশকিল দেখছি!

এবার কুকুরটার ওপর দারুণ রাগ হচ্ছে। ওকে আর মোটেই সুন্দর বলে মনে হচ্ছে না। কিছু জিনিস দিয়ে খোঁচাখুঁচি করলে স্পিৎজ কুকুরও রেগে যায়। দাঁত আছে, মরীয়া হয়ে কামড়ে দেওয়া আশ্চর্য কিছু না।

পুরো খাটটাকেই টেনে সরিয়ে আনলুম। এবার আর কুকুরটার কোনো দেয়ালের দিকে গা দেওয়ার উপায় রইল না। উল্টো দিকে গিয়ে তাড়া দিতেই সে এবার ছুটে বেরিয়ে ঢুকল মায়ের ঘরে।

মায়ের চৌকিটা নীচু। সেটার তলায় সে ঢুকতে পারল না বটে, চতুর্দিকে কয়েক পাক ঘুরে সে একটা বিশ্রী কাণ্ড করল। ঘরের এককোণে মায়ের ছোটখাটো ঠাকুর দেবতার জায়গা, কয়েকটা ছবি ও একটা পেতলের সিংহাসন রয়েছে। কুকুরটা লণ্ডভণ্ড করে দিল সেই জায়গাটা।

এবার আমি তাকে খবরের কাগজ দিয়ে খুব পেটালুম, সে বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে। কিন্তু মায়ের ঠাকুরের ছবিটবিতে কুকুর পা দিয়েছে, এটা মাকে জানান উচিত নয়। দ্রুত হাতে গুছিয়ে দিতে লাগলুম সেগুলো। একটা কমণ্ডলু থেকে গঙ্গাজল উল্টে পড়ে গেছে, সে আর কিছু করা যাবে না।

সব কোনোরকমে সামলে বৌদিকে বললুম, এবার ঠিক আছে। বেরিয়ে সদর বন্ধ করে যাও। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হতে পারে।

হুড়হুড় করে বন্যার জলের মতন সিঁড়ি দিয়ে প্রায় গড়িয়ে নেমে এলাম নীচে। দরজা থেকে এক লাফে রাস্তায়।

নীলা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে জায়গাটা শূন্য। নীলা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *