অর্ধেক মানবী – ১১

১১

মেজমামা জঙ্গীপুরের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এলেন একটু তাড়াতাড়ি। ভন্তুর ফ্ল্যাট বানানোর কাজ পড়ে আছে, সে বেশিদিন কলকাতার বাইরে থাকতে পারবে না। ভন্তুকে চলে আসতে হলো বলেই মেজমামা আর সেখানে রইলেন না। কলকাতা ছুঁয়ে তিনি আবার যাবেন পুরুলিয়ায়। সেখানকার এক আদিবাসীদের গ্রামে ওঁর কোনো বন্ধুর সোস্যাল ওয়েলফেয়ার প্রজেক্ট আছে, সেই গ্রামে থাকবেন কয়েকদিন।

সকালবেলা চায়ের টেবিলে মেজমামা বলল, বুঝলে ছোড়দি, এবার একটা টেস্ট কেস করলাম। তোমাদের এখানে সুটকেসটা রেখে শুধু একটা হ্যাণ্ডব্যাগ নিয়ে মুর্শিদাবাদ গেছি বলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব হতাশ!

মা বললেন, কেন, কী হয়েছে?

মেজমামা বললেন, অন্যবার আমার বউ সঙ্গে থাকে। তার কী রকম খরচের হাত তুমি জান না। এত রোজগার করি, তবু আমাকে ফতুর করে দেয়। প্রত্যেকবার দেশে আসবার সময় নিজের গাদা-গুচ্ছের ভাই-বোন, মা-বাবা, পিসি-মাসি, বাড়ির রাঁধুনি, রাখাল এদের জন্য শাড়ি, জামা, ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, পারফিউম, কলম, স্নো-পাউডার এইসব হাবিজাবি জিনিস নিয়ে আসে। আমার শ্বশুর বিরাশি বছরের বুড়ো, চোখে ভালো দেখতে পায় না, চিরকাল হাতের কর গুনে গুনে টাকাপয়সার হিসেব করেছে, গতবার তাকে এনে দিয়েছে একটা ক্যালকুলেটার। বুঝে দ্যাখো! সেই অন্ধ ঐ ক্যালকুলেটার দিয়ে কী করবে?

মা বললেন, তোর কথাবার্তার কি ছিরি রে পিন্টু! শ্বশুর সম্পর্কে কেউ ঐভাবে বলে? তিনি অতি ভালোমানুষ।

মেজমামা বললেন, আহা, ভালোমানুষরা বুঝি বুড়ো হয় না? অন্ধ হতে পারে না? আরও মজার কথা শোনো! আমার টাকার শ্রাদ্ধ করে তোমার বৌমা এত লিপস্টিক আর পারফিউম আর স্নো-পমেটম আনে, যে শেষ পর্যন্ত সেগুলো গড়াগড়ি যায়। ঐ গ্রামদেশে কে লিপস্টিক মাখবে বলো তো? চতুর্দিকে গোবরের গন্ধ, তার মধ্যে ফ্রেঞ্চ পারফিউম মাখারই বা কী দরকার? গোবরের গন্ধই তো অতি চমৎকার!

বৌদি যেন সত্যি সত্যি গোবরের গন্ধ পাচ্ছে, এইভাবে নাকে আঁচল চাপা দিল।

মেজমামা বললেন, গতবারেই একদিন দেখি, ও-বাড়ির বুড়ি রাঁধুনিটা ঠোটে রং মেখে বসে আছে একদিন। আর বাড়ির রাখালটা হেঁটো ধুতি ছেড়ে একটা সুইমিং ট্রাকসুট পরে গরু চরাতে যাচ্ছে। একে কালচারাল পলিউশান বলে না? বাজে জিনিস দিয়ে গ্রামের লোকের স্বভাব নষ্ট করা! তাই এবার কিছু আনিনি। সব ফক্কা।

মা বললেন, কিচ্ছু আনিস নি? শাশুড়ির জন্য অন্তত একখানা শাড়ি?

মেজমামা বললেন, কেন আনব? তুমি আমার নিজের ছোড়দি, তোমার জন্য শাড়ি দেবার কথা মনে থাকে না তোমার বৌমার, আর নিজের মায়ের জন্য, ভাইয়ের বৌ আর বাপের বাড়ির চৌদ্দগুষ্ঠির জন্য গুচ্ছের দেওয়া চাই। সেইজন্য এবার বলেছি, নাথিং ডুয়িং! আমি কিছু নেব না। তুমি নিজে যখন যাবে, তখন যা খুশি নিতে পার, কিন্তু আমি শ্বশুরবাড়ির জন্য মোট বইব না, ব্যাস, অমনি দুনিয়াটা কত পাল্টে গেল! অন্যান্যবার শ্বশুরবাড়িতে কত খাতির পাই, চব্য-চোষ্য—লেহ্য-পেয় কিছুই বন্ধ থাকে না। এবার থার্ড দিন থেকেই দেখি সকালে চায়ের সঙ্গে আর টা দেয় না! খালি পেটে শুধু চা। একখানা বিস্কুট পর্যন্ত না!

একখানা বেশ দম-ফাটানো হাসি দিয়ে মেজমামা আবার বললেন, কয়েকটা দিন ওদের খুব সাসপেন্সে রেখেছিলুম। সবাই ভাবছে, আমি বুঝি মজা করছি। জিনিসগুলো অন্য কোথাও লুকানো আছে। সবাই আমার মুখের দিকে কী পাব, কী পাব বলে তাকায়। কেউ কেউ আবার মনে করিয়ে দেয়, সিঙ্গাপুরের সিল্ক খুব ভালো, ঘড়ি শস্তা। আমার এক শালী তো জিজ্ঞেস করে ফেলল, দিদি কোনো চিঠি দেয়নি? আসলে দিদির জন্য কেউ ব্যস্ত নয়। কিন্তু চিঠি থাকলেই তার মধ্যে জিনিসপত্রের উল্লেখ থাকবে। কার জন্য কোনটা পাঠানো হলো, সব লিখে দেয়। এবারে খুব ঠকিয়েছি।

আমি বললুম, আপনিও তো ঠকেছেন! খাতির কম পেয়েছেন!

মেজমামা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, আরে যা যা। খাতিরের চেয়েও মানুষের ব্যবহার দেখে আমি মজা পাই বেশি। ফরেন জিনিস পায়নি বলেই সবার মুখ ভার হয়ে গেল। অথচ ওদের কিন্তু কোনো জিনিসের অভাব নেই। রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, যার আছে ভুরি ভুরি।

বৌদি জিজ্ঞেস করল, সত্যি কিছু আনেননি এবারে, মেজমামা?

মেজমামা বললেন, কেন, তোমারও লোভ ছিল বুঝি, অলকা?

বৌদি বলল, বাঃ, লোভ থাকবে না! আপনি আমাদেরও কারুকে কিছু দ্যাননি বলে এ বাড়িতেও আপনার খাতির কমে গেছে খানিকটা তা লক্ষ করেননি?

মেজমামা বললেন, হুঁ, লক্ষ করেছি বটে। প্রথম দিন খাওয়ালে ইলিশ মাছ যত খুশি আর সন্দেশ। পরের দিন কাটাপোনা মাত্র দু’ পীস। তার পরের দিন ছোট ট্যাংরা। এবারে কি ময়দানে গিয়ে ফড়িং ধরে ধরে খেতে হবে!

মা বললেন, পিন্টুর যত সব অলক্ষুণে কথা! তুই নিজেই তো বলেছিলি ছোট ট্যাংরা মাছ তুই খুব পছন্দ করিস!

মেজমামা বললেন, যাই বলো, ছোড়দি, অলকার ব্যবহার একটু একটু বদলে গিয়েছিল ঠিকই, অলকা বোধহয় আশা করেছিল সিল্কের শাড়ি পাবে! এবারে চুঁ, ঢুঁ! আর এই নীলুটা, তুইও কিছু আশা করেছিলি নিশ্চয়ই। কী নিমকহারাম রে তুই, তোর একটা চাকরি জুটিয়ে দিলুম, তবু তুই আমাকে একদিনও খাওয়ালি না?

আমি বললুম, এখনো মাইনে পাইনি, মেজমামা! ট্রাম বাস ভাড়া পর্যন্ত ধার করতে হয়!

মেজমামা বললেন, পয়লা তারিখ আসেনি বুঝি? তারিখের হিসেব নেই। ঠিক আছে, পয়লা পর্যন্ত আমি এখানেই থেকে যাব। সেদিন বাড়িতে একটা বিরাট খ্যাটের ব্যবস্থা করতে হবে। বুঝলি! কয়েকজনকে ডাকতে হবে। সুরঞ্জন তো আসবেই। আর নির্মল আর রথীনকেও ডাকব। ও ব্যাটারা বলেছিল না, চাকরি জোটানো এখন অসম্ভব! ওদের দেখিয়ে দিতে হবে।

মা বললেন, হ্যাঁ, নীলু প্রথম মাইনে পেলে কিছু লোকজনকে খাওয়াতে হবে। আর সেদিন একটা পুজো দিয়ে আসতে হবে কালীঘাটে।

মেজমামা বললেন, কালীপুজোও মাইনে পাবার পর! ওটা বুঝি ধারে দেওয়া যেত না! নাকি মা কালীকে আস্ত পাঁঠা খাওয়াবে!

মা ধমকে বললেন, ছিঃ পিন্টু!

আমি বললুম, মেজমামা, আমার ঘরে আপনি যে সুটকেসটা রেখে গেছেন, সেটা অত ভারি কেন?

দড়াম করে চেয়ারটা ঘুরিয়ে মেজমামা বললেন, অ্যাঁ! তুই সেটা খোলার চেষ্টা করেছিলি নাকি? তালা ভেঙেছিস?

আমি হেসে বললুম, সেসব কিছুই করিনি। আমার খাটটা একবার সরাতে হয়েছিল, তাই ওটাকেও সরাতে হয়েছিল। ভেতর থেকে চকলেটের গন্ধ বেরুচ্ছিল।

—চকলেট? চকলেটগুলো এখনো বার করিনি? অনেক কেক-মেকও এনেছিলুম যে, সেইগুলো এই গরমে গলে গেল বোধহয়! যা লোডশেডিং-এর ধাক্কা!

—তুমি এবার কিপ্টের মতন কিছু বার করোনি।

—নিয়ে আয়, নিয়ে আয়, সুটকেসটা শিগগির নিয়ে আয়।

অত বড় সুটকেসটা টেনে এনে টেবিলের ওপর তুলতে আমার ঘাম ছুটে গেল। এই সব ভারি সুটকেস নিয়ে অন্য লোকেরা বিভিন্ন এয়ারপোর্ট দাবড়ে বেড়ায় কী করে? যারা বিদেশে ঘোরাঘুরি করে, তাদের রীতিমত কব্জির জোর দরকার! মেজমামা পাঞ্জাবির পকেট থেকে চাবি বার করে সুটকেসটা খুলতেই যেন চিচিং ফাঁক-এর মতন একটা ব্যাপার হয়ে গেল।

থরে থরে উপহার দ্রব্য সাজান তার মধ্যে। শাড়ি-শার্ট-প্যান্ট-পারফিউম ইত্যাদি। ওপর দিকে চকলেট কেকের কয়েকটা প্যাকেট, সেগুলো গলে চেপ্টে অন্য জিনিসের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে গেছে।

মা বললেন, ইস কী করেছিস, পিন্টু! সুটকেসটা খুলিসনি একবারও!

মেজমামা বললেন, হ্যাণ্ডব্যাগেই জামাকাপড় ছিল, তাতেই কাজ চলে যাচ্ছিল। আরও খুলিনি কেন জান, ছোড়দি? দ্যাখ, আমার বউটা সব জিনিসের ওপর কে কোনটা পাবে নাম লিখে লিখে পিন দিয়ে সেঁটে দিয়েছে। তোমার নামে আর অলকার নামে যদি কিছু না পাঠিয়ে থাকে, তা হলে কি লজ্জার কথা বলো তো!

মা বললেন, আহা, আমাদের জন্য আবার প্রত্যেকবার জিনিস আনতে হবে কেন? আগে দু’-তিনবার তো দিয়েছে। মোটেই আমাদের জন্য আর কিছু আনতে হবে না।

মেজমামা বললেন, এরকম কথা ভদ্রতা করে সবাই বলে। আমি চলে গেলেই তুমি আর অলকা গুজগুজ করে বলতে, পিন্টুটা তো বটেই, ওর বউটাও এমন হাড় কঞ্জুষ হয়েছে! এতদিন এ বাড়িতে থেকে গেল, একটা কিছু জিনিস আনল না আমাদের জন্য! পিন্টুর শ্বশুরবাড়ির লোকরাই সব কিছু পেল!

বৌদি বলল, মা এরকম কিছু না বললেও আমি কিন্তু বলতুম, মেজমামা। অন্তত মনে মনে।

মেজমামা বললেন, এই অলকা সত্যি কথা বলে বলেই তো আমি ওকে পছন্দ করি। তবে এটা বোঝ না, অলকা, আমি আসলে তোমাদের খরচ বাঁচিয়ে দিই। আমার বউ তোমাদের জন্য একটা হাবিজাবি জিনিস পাঠালেই তোমরাও চক্ষুলজ্জায় তার জন্য উল্টে কিছু কিনে দেবে। শুধু শুধু কিছু টাকা গচ্চা!

মা বললেন, জিনিসগুলো ভন্তুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দে।

আমি বললুম, এই চকলেটগুলো আর পাঠানো যাবে না। গলেটলে একেবারে যা-তা হয়ে গেছে। এগুলো আমরা খেয়ে নিতে পারি।

ল্যাতপেতে হয়ে যাওয়া প্যাকেট দুটো সাবধানে তুলে রাখা হলো দুটো প্লেটে। তলাগুলো ছিঁড়ে গলে যাওয়া চকলেট আইসক্রিম মেশামিশি হয়ে লেগে গেছে অনেক জামাকাপড়ে। আমি আঙুল দিয়ে চেঁছে চেঁছে তুলতে লাগলুম সেগুলো।

তারপর ইউরেকা! ইউরেকা! বলে চেঁচিয়ে উঠলুম।

একটা সোনালি রঙের শাড়ির ওপর লেখা রয়েছে ‘অলকার জন্য’।

শাড়িটা তুলে ধরে বললুম, বৌদি, তোমার জিনিস এসে গেছে! তোমার জন্য শাড়ি!

মেজমামা বললেন, এঃ, চকলেট লেগে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এ শাড়ি কি আর কারুকে দেওয়া যায়? ছিঃ!

বৌদি বলল, ও কিছু হবে না, একটু জল দিয়ে ঘষলেই উঠে যাবে। দাগ পড়বে না। রংটা কি ভালো!

মা বললেন, দেখি, দেখি! বাঃ শাড়িটার জমি কত ভালো। ওদেশে এত ভালো শাড়ি পাওয়া যায়? ওখানে মেয়েরা কি শাড়ি পরে?

মেজমামা বললেন, ওখানে সব পাওয়া যায়। ইণ্ডিয়ান কম নাকি? জান ছোড়দি, ওখানে সেরাঙ্গুন নামে একটা রাস্তা আছে, সেখানে গেলে তোমার মনে হবে, তুমি ইণ্ডিয়ার কোনো শহরে ঢুকে পড়েছ। সব ইণ্ডিয়ানদের দোকান, শাড়ি পরা মহিলারা ঘুরছে, দাড়িওয়ালা শিখ শুয়ে আছে রাস্তায় খাটিয়ে পেতে। মার্কেট স্ট্রিট, ট্যাঙ্ক রোড এসব জায়গাতেও অনেক ভারতীয় আছে। থাইল্যাণ্ড, মালয়েশিয়া থেকে ভালো ভালো সিল্কের শাড়ি আসে।

আমি এসব শুনছি না, সুটকেস ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি বৌদির নাম লেখা আর একটা প্যাকেট পেয়ে গেলুম, এটার মধ্যে রয়েছে দামি একটা পারফিউমের শিশি। মেজমামা বললেন, তা হলে অলকা, এবার আর আমাকে আড়ালে গালাগাল দেবে না তো?

বৌদি লজ্জা-খুশি মাখানো মুখে বলল, এই পয়জন পারফিউমটার জন্য আমার অনেক দিনের শখ ছিল। ইস, এত দাম দিয়ে কেন আনলেন?

আমি আবার একটা প্যাকেট তুলে চ্যাঁচালুম, দাদার জন্য শার্ট!

মেজমামা বললেন, তোর জন্য কিছু নেই, নীলু? দ্যাখ দ্যাখ, খুঁজে দ্যাখ! তোর মামী কি তোর কথা ভুলেই গেল?

আমার জন্যও পাওয়া গেল একটা খুবই ছোট প্যাকেট, তাকে প্যাকেট না বলে প্যাকেটিকা বলা উচিত। তার মধ্যে রয়েছে দুটো শস্তার লাইটার। থ্রো অ্যাওয়ে টাইপ

মেজমামা বললেন, যাক, তাহলে সবার জন্যই কিছু না কিছু পাওয়া গেল! তুমি একটু চকলেট খাও, ছোড়দি। নীলুটার জন্য খুব কম খরচে সেরেছে। ঠিক আছে, নীলু, তোকে আমার ঘড়িটা দিয়ে যাব। তোর ঘড়ি সেদিন ছিনতাই হয়ে গেল। তুই এটা পরবি।

—আমার ঘড়ি ছিনতাই হয়নি, সেটা ছিল দাদার ঘড়ি। তুমি দাদাকেই ঘড়িটা দিও।

–তোর দাদার তো আর একটা ঘড়ি আছে দেখেছি। এটাই তোকে দিলুম।

—আমায় দিও না, মেজমামা। আমি ঘড়ি পরি না কক্ষনো।

—কেন ঘড়ি পরিস না?

—ঘড়ি না থাকলে ছিনতাইবাজদের জব্দ করা যায়। তারা ধারে কাছে ঘেঁষে না। আমার লাইটারই খুব পছন্দ। ঘড়ি নিলেই আমি হারাব।

মেজমামা নিজের হাত থেকে রোলেক্স ঘড়িটা খুলতে যাচ্ছিলেন, থেমে গিয়ে বললেন, আচ্ছা, থাক তা হলে।

মা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখের পাতা সামান্য কাঁপছে। মায়ের ইচ্ছে, ঘড়িটা আমি নিয়ে নিই। নিজের ভাইয়ের চেয়ে নিজের ছেলের প্রতি তাঁর টান বেশি। মা বোধহয় এ-ও ভাবছেন, আমার ছোট ছেলেটা বড্ড বোকা!

মায়ের দিকে ফিরে মেজমামা বললেন, একি ছোড়দি, তুমি একটুও চকলেট খেলে না? একটু খেয়ে দ্যাখো, ওদেশের চকলেট দারুণ ভালো!

মা নিরস একটা ছোট্ট হাই তুলে বললেন, নাঃ, আমি ওসব খাব না, তোরা খা। আমি এখন চান করতে যাই।

মা উঠে দাঁড়াতেই মেজমামা আবার মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হা-হা-হা-হা করে হেসে মায়ের একটা হাত চেপে ধরলেন।

তারপর বললেন, ধরা পড়ে গেলে, ছোড়দি, তুমি ধরা পড়ে গেছ!

মা বললেন, আমি আবার কী করলুম?

মেজমামা বললেন, এই একটু আগে বললে, কোনো জিনিস-টিনিস চাই’ না। কেন জিনিস আনবি? এখন যেই দেখলে, অন্যদের জন্য আনা হয়েছে, এমনকি তোমার পুত্রবধূও শাড়ি-টাড়ি পেয়েছে, কিন্তু তোমার জন্য কিছু নেই, অমনি তোমার মুখখানা গোমড়া হয়ে গেল! নীলু, অলকা, তোমরা বলো ঠিক কিনা?

আমি আর বৌদি চোখাচোখি করলুম। মায়ের জন্য কিছু নেই, এই কথাটাই আমাদের দু’জনের মনেও খচখচ করছিল।

মা বললেন, যাঃ আমি বুড়ো হয়েছি, আমি এখন আর জিনিস নিয়ে কী করব! ওদের জন্য এনেছিস, সে-ই তো যথেষ্ট!

মেজমামা বললেন, এটাও অভিমানের কথা। তুমি ভাবছ, বয়েস হয়েছে বলে তোমায় বাতিল করে দেওয়া হয়েছে! তাই একটু চকলেট পর্যন্ত মুখে দিলে না!

সুটকেসের একেবারে তলার দিকে হাত ঢুকিয়ে মেজমামা একটা বড় কাগজের বাক্স তুলে এনে বললেন, দ্যাখো, এটাতে কোনো নাম লেখা নেই। আমি আর কোনো রিস্ক নিইনি। যদি আমার বউটা তোমাকে ফাঁকি দিতে চায়, তাই আমি নিজে এই শাড়িটা তোমার জন্য কিনে এনেছি, ছোড়দি।

বাস্কটা খুলতেই দেখা গেল, তার মধ্যে রয়েছে একটা গরদ-সিল্কের শাড়ি, বেশ দামি তো বটেই।

মা আর খুশির চমক লুকোতে পারলেন না। আমি যে ঘড়ি নিইনি, সেই দুঃখ পর্যন্ত ভুলে গিয়ে বললেন, ইস, দেখেছ, শুধু শুধু আমার জন্য এত টাকার জিনিস…তুই বউয়ের নামে বড্ড বদনাম করিস, পিন্টু! এটা নিশ্চয়ই টুলু নিজে পছন্দ করে কিনেছে! ছেলেরা এরকম কিনতে পারে না!

বৌদি বলল, মায়ের শাড়িটা সবচেয়ে ভালো।

মেজমামা বললেন, হিংসে করো না, হিংসে করো না।

বৌদি বলল, একটু-আধটু হিংসে করা স্বাস্থ্যকর ব্যাপার। মায়েরটা সবচেয়ে ভালো, সে কথা বলতে পারব না? কিন্তু আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ মেজমামা! এগুলো সব বাক্সবন্দী করে রেখেছিলেন এতদিন! পরশুদিন একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলুম, এই শাড়িটা আগে পেলে সেদিন পরে যেতে পারতুম। সবাই দেখত।

মেজমামা এক টুকরো চকলেটে কামড় দিয়ে বললেন, সাসপেন্সে রাখলে চমকটা বেশি হয়। সেই খুশির ভাবটা আমার দেখতে ভালো লাগে। নীলুর জিনিস ‘একটু কম হয়ে গেল, কিন্তু নীলুকে আর একটা কত বড় উপহার আমি এবার দিয়েছি, সেটা বলো? নীলুর চাকরিটা!

মা এবার আন্তরিকভাবে বললেন, তুই এবার কিছু না আনলেও কোনো কিছুই মনে করতুম না রে পিন্টু! কিন্তু তুই এটা যা উপকার করে গেলি…নীলু যে কোনোদিন চাকরি পাবে, সে আশাই তো ছেড়ে দিয়েছিলুম প্রায়!

আমার দিকে খানিকটা গর্ব-মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেজমামা বললেন, এবারে এসে আমিও বড় আনন্দ পেয়ে গেলুম গো! তোমাকে বড় মুখ করে বলেছিলুম, কিন্তু দু’জন অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফিরিয়ে দেবার পর….তোমার ছেলে নিজের মেরিটে চাকরি পেয়েছে, শেষ পর্যন্ত কারুকে ধরাধরি করতে হয়নি, সুরঞ্জনের কাছে গিয়ে আমরা চাকরির কথা উচ্চারণও করিনি। চাকরিটা যেন নীলুর জন্য আকাশ থেকে পড়ল, জাস্ট লাইক ওআইল্ড ফল! মাইনেটাও মোটামুটি মন্দ নয়।

মা বললেন, এখন ভালোয় ভালোয় চাকরিটা পাকা হয়ে গেলেই হয়।

মেজমামা বললেন, তার জন্য কোনো চিন্তা নেই। পাকা হয়েই গেছে ধরে নিতে পার। তোমার ছেলে খুব মন দিয়ে কাজ করছে। সুরঞ্জন খুব প্রশংসা করছিল। ওদের বম্বের হেড অফিস থেকে গ্যাডগিল নামে খুব এক বড় সাহেব এসেছিল, সে পর্যন্ত নীলুর পিঠ চাপড়ে গেছে!

বৌদি বলল, নীলুও মন দিয়ে চাকরি করতে পারে? শুনতে কেমন যেন লাগে! পৃথিবীতে কোনো কিছুই তা হলে অসম্ভব নয়!

আর একখানা চকলেট মুখে পুরে মেজমামা বললেন, পয়লা তারিখ তবে কবে পড়ছে? শনিবার? খুব ভালো দিন। একটা জমপেশ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সেদিন। তোমরা কাকে কাকে ডাকবে লিস্ট করে ফেল। আমার কয়েকজন বন্ধুকে বলতে হবে, সুরঞ্জন তো থাকবেই, নির্মল আর রথীনকে ডেকেও আচ্ছা করে খাওয়াব…চিংড়িমাছ যদি পাওয়া যায়…

মা আর মেজমামা মুখে মুখে নেমন্তন্নের লিস্ট আর খাদ্যতালিকা বানাতে লাগলেন। আমি উঠে পড়লুম সেখান থেকে

চাকরির প্রসঙ্গ আসতেই নীলার কথা দারুণভাবে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে। নীলা কোথায়? তিনদিন তার দেখা পাইনি। একটা আকস্মিক বদখৎ ঝড় আমাদের আলাদা করে দিয়েছে।

আর কি কোনোদিন নীলার দেখা পাব না? এই চাকরির খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকব সারা জীবন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *