অর্ধেক মানবী – ২

সর্ষেবাটা দিয়ে ঝোলের ইলিশ চারখানা খেয়ে ফেললেন মেজমামা, তার আগে দু’খানা ভাজা।

বৌদি জিজ্ঞেস করল, আর একটা মাছ দিই?

মা বললেন, না, না, আর দিও না! প্রথম দিন এসেই এতগুলো ইলিশ খেয়ে ও হজম করতে পারবে না।

মেজমামা বললেন, আর একখানা ডিমভরা পেটি দাও, অলকা! ব্যাস! চেহারাখানা দেখছ তো ছোড়দি, সব হজম করতে পারি। লোকে ক্যাভিয়ার ক্যাভিয়ার করে! আগুন দাম দিয়ে ঐ মাছের ডিম কেনে। কিন্তু মাছের ডিম না ঘোড়ার ডিম! ঐ ক্যাভিয়ারের তুলনায় ইলিশ মাছের ডিম আমার দশগুণ বেশি ভালো মনে হয়!

মা বললেন, ডিম থাকলে ইলিশের স্বাদ কমে যায়। নীলু মাছটা ঠিক চিনতে পারেনি।

মেজমামা প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বললেন, না, না, খুব ভালো স্বাদ। ইলিশের ডিম হলো উপরি লাভ। ডিম ছাড়া ফাঁকা পেটির মাছ আমার তেমন ভালো লাগে না। খুব ভালো কিনেছিস রে, নীলু! কত করে নিল রে?

—পঞ্চাশ টাকা করে নিল। মাছটা দেড় কিলোর একটু বেশি, আমার সঙ্গে চেনা আছে বলে আমার কাছ থেকে পঁচাত্তর টাকাই নিয়েছে।

—অর্থাৎ?

আমি বুঝতে না পেরে মেজমামার দিকে তাকিয়ে রইলুম।

উনি হেসে বললেন, আসল দামটা কত? এ বিষয়ে সোজা একটা থিয়োরি ছিল আমাদের টাইমে। কোনো বেকার ছেলে যদি বাজার করতে যায়, সে বাড়িতে এসে মাছের দাম বাড়িয়ে বলে। কারণ ওর থেকে তাকে টু পাইস সরাতে হয়। আর কোনো চাকরিওয়ালা লোক যখন নিজের টাকায় বাজার করতে যায়, সে ফিরে এসে সব জিনিসের দাম একটু একটু কমিয়ে বলে। তাতে তার দরাদরির কৃতিত্ব দেখানো হয়। তুই বাজার থেকে কত মেরেছিস সেটা আমি জানতে চাইছি না, এখন ইলিশের আসল দর কী রকম, সেটা জানতে চাই।

—ঠিক দামই বলেছি, মেজমামা। আমার ওরকমভাবে পয়সা মারার দরকার হয় না।

–তা হলে তোর হাতখরচ-টরচ চলে কী করে?

আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই মায়ের দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে মেজমামা আবার বললেন, আর বেশি দিন তোমাকে বেকার থাকতে দেওয়া হবে না হে, নীলুচন্দর! এবার তোমাকে একটা চাকরি করতেই হচ্ছে!

বুঝলুম যে আমার অনুপস্থিতিতে মায়ের সঙ্গে মেজমামার অন্যরকম পাঁচ কথা হয়েছে। উনি মত বদলে ফেলেছেন আমার সম্পর্কে। আমিও মায়ের দিকে কটমট করে তাকালুম।

মেজমামা বললেন, আমি চাকরি করি, তোর দাদা চাকরি করে, ভন্তু চাকরি করে, চেনাশুনো সবাই চাকরি করে, এমন কি অলকাও একটা স্কুলে পড়ায়, শুধু তুই একা বেকার থাকবি কেন? এটা তো স্বার্থপরতা! আমরা খেটে খেটে মুখের রক্ত তুলব, আর তুই দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াবি, তা কেন চলবে? সে সুযোগ তোমাকে দেওয়া হবে না শয়তান! এটা সিরাজউদ্দৌলা নাটকে মহম্মদী বেগের ডায়ালগ না?

মা বললেন, চাকরি করতে চাইলেও তো পাওয়া যায় না। যা দিনকাল পড়েছে!

মেজমামা বললেন, এবার দ্যাখোই না! আমি সাতদিনের মধ্যে নীলুর জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দিচ্ছি!

বৌদি বলল, অতু সহজ নয়, মেজমামা। সারা দেশে কোটি কোটি বেকার। শুধু পশ্চিম বাংলাতেই শিক্ষিত বেকার চল্লিশ না পঁয়তাল্লিশ লাখ। মেজমামা বললেন, তা হোক না চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ লাখ। তারা কেউ আমার ভাগ্নে নয়! বৌদি হেসে বলল, ঐসব বেকার ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই কারুর না কারুর ভাগ্নে-ভাগ্নী!

মেজমামাও হেসে বললেন, কিন্তু তাদের কারুর মামার নাম কি পিনাকপানি ব্যানার্জি? আমি চেষ্টা করলে আমার ভাগ্নের একটা চাকরি হবে না, এটা অসম্ভব! আগে শোনা যাক, নীলু নিজে কী কী চেষ্টা করেছে। কী রে, নীলু, চুপ করে আছিস কেন? এ পর্যন্ত কটা ইন্টারভিউ দিয়ে ফেইল করেছিস?

আমি বললুম, মেজমামা, আমার কেসটা একটু আলাদা। এ দেশে আমি ব্যতিক্রম। আমি চেষ্টা করে চাকরি পাইনি তা নয়। আমি চাকরির জন্য কোনো চেষ্টাই করি না।

-ওরে বাবা, সেটা খুব অহঙ্কারের ব্যাপার নাকি? কেন, চেষ্টা করিসনি কেন?

—কারণ, এই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ লাখ বেকারের ভিড়ের মধ্যে মিশে, অন্যদের সঙ্গে ল্যাং-মারামারি করে কোনোক্রমে একটা চাকরি জোগাড় করা আমার ধাতে পোষাবে না। তার বদলে আমি বেশ আছি।

—এরকম বেশ থাকা কত দিন চলবে, সোনামনি? এখন তো দাদার সংসারে দু’বেলা খ্যাঁট জুটে যাচ্ছে। মা বেঁচে আছে বলে বৌদি মুখঝামটা দিচ্ছে না। ছোড়দি যেদিন চোখ বুজবে, সেদিন এই দাদা-বৌদিই অন্য রূপ ধারণ করবে, বুঝলি? সেদিন দেখবি, তোর ভাতের থালার এক পাশে একটু ছাই দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোকে প্রথম ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, মানে মানে কেটে পড়ো! কী অলকা, আমি ভুল বলছি?

বৌদি বলল, আজকাল গ্যাসে রান্না হয়। ছাই জোগাড় করা খুব শক্ত!

মা বললেন, নীলুকে আমি কতবার বলি…

মাকে বাধা দিয়ে বৌদি বলল, না, সিরিয়াসলি, মেজমামা, পৃথিবীতে সবাইকেই যে চাকরি করতে হবে, এটা আমি মোটেই সাপোর্ট করি না। ফ্যামিলিতে কেউ একজন বাঁশি বাজাবে কিংবা ছবি আঁকবে কিংবা কবিতা লিখবে, কিংবা এসব গুণ না থাকলেও বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়াবে, না হলে পৃথিবীটা কালারফুল থাকবে কী করে? সবাই কেজো, সংসারী, প্র্যাকটিক্যাল হলে পৃথিবীটা ডাল হয়ে যাবে না? নীলু যে টো টো করে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, টাকাপয়সার চিন্তা করে না, ও সেইভাবেই থাক না!

আমি মেজমামার দিকে চেয়ে বললুম, দেখলে, বৌদি আমার কত বড় সাপোর্টার? সেই জন্যই তো আমি এত মজায় আছি!

মেজমামা ঠোঁট উল্টে বললেন, অলকার এত সব রোমান্টিক ধারণা কত দিন টিকবে? এখন ওর নতুন বিয়ে হয়েছে, স্বামী ভালো চাকরি করে, সেই জন্য ফুরফুরে মেজাজে আছে। এর পর যখন ওদের এণ্ডিগেণ্ডি হবে, খরচ বাড়বে, টানাটানি দেখা দেবে সংসারে, তখন এইসব ভালো ভালো চিন্তা কপূরের মতন উবে যাবে। তখন দেখবি, এই অলকাই স্বামীর সঙ্গে ঘরের দরজা বন্ধ করে মুখ—ঝামটা দিয়ে বলবে, তোমার ঐ অপোগণ্ড ভাইটা কত দিন বসে বসে গিলবে? ওকে দিয়ে সংসারের কোনো সাশ্রয় হয় না, বরং জামাকাপড়ের বাবুয়ানি আছে। ওকে বিশ্বাস করে বাজারেও পাঠানো যায় না। এক প্যাকেট মোমবাতি-কিনতে দিলেও তার থেকে পয়সা সরায়। তোমার প্যাকেট থেকে সিগারেট চুরি করে। আরও কত কি চুরি করে কে জানে! ওকে বলো না, বালিগঞ্জ স্টেশনে ভাঁড়ের চা বিক্রি করতে, তাতেও তো দু’ পয়সা আসবে।

মেজমামা বৌদির গলা বেশ ভালোই নকল করে যাচ্ছেন। বৌদি হাসতে হাসতে নুয়ে পড়ল।

মা বললেন, না, না, অলকা কোনোদিনও…আমি না থাকলেও…

মা তাঁর পুত্রবধূর কোনো নিন্দে শুনতে চান না, তবু তাঁর প্রতিবাদটা বেশ দুর্বল শোনাল। কঠোর সংসারের মধ্যগগনে যে মানুষের মন এরকম ভাবে বদলে যায়, সে সত্যটাও মা অস্বীকার করতে পারছেন না।

আমি বললুম, মেজমামা, তুমি বরং আমাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে চলো। বিদেশে একটা চাকরি পেলে আমি কিছুদিন ট্রাই করতে পারি। আর কিছু না হোক বেড়ানো তো হবে!

মেজমামা বললেন, দূর, দূর, সিঙ্গাপুর আবার বিদেশ নাকি? নামের শেষে পুর আছে দেখছিস না? কেষ্টপুর, বিষ্ণুপুরের মতনই আর একটা শহর সিঙ্গাপুর। আগে বোধহয় ওটার নাম সিংহপুর ছিল।

বৌদি বলল, সিঙ্গাপুরে নাকি গেলেই চাকরি পাওয়া যায়? নীলু যদি ওখানে একটা চাকরি পায়, তা হলে আমরাও বেড়াতে যেতে পারি সবাই মিলে।

মেজমামা বললেন, সেসব সুখের দিন আর নেই। এখন ইণ্ডিয়ানদের ধরে ধরে প্যাদাচ্ছে। ইণ্ডিয়ানদের এখন আর কোনো দেশই পছন্দ করে না। রক্তবীজের ঝাড় কিনা! ইণ্ডিয়ানদের আর কেউ চাকরি দেবে না, বরং অনেককে জোর করে প্লেনে তুলে দিয়ে ফেরৎ …

হঠাৎ কথা থামিয়ে বৌদির দিকে কটমট করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন মেজমামা। তারপর প্রচণ্ড ধমকের সুরে বললেন, আমি বিশ-বাইশ বছর ধরে ওখানে আছি, এর মধ্যে তোমরা ওখানে একবারও বেড়াতে যাওনি কেন? কে বারণ করেছিল? ঊষা তোমাদের বার বার যেতে বলেনি? নীলু চাকরি করে তোমাদের জন্য টিকিট পাঠাবে? এর মধ্যেই গলা দিয়ে আসল সুর বেরুচ্ছে?

মা বললেন, যাঃ, অলকা মোটেই সেরকম ভেবে বলেনি। হ্যাঁরে পিন্টু, ইণ্ডিয়ানদের যে ওখান থেকে তাড়াচ্ছে বলছিস, তা হলে তুই…তোর কিছু হবে না তো? ঊষাদের ওখানে রেখে এলি, যদি বার্মার মতন কিছু হয়?

মেজমামা সারা মুখে গর্বের হাসি ছড়িয়ে বললেন, কোনো চিন্তা নেই, আমার কিছু হবে না। যদি ওদেশে মাত্র একজনও ইণ্ডিয়ান থাকে, তা হলে আমি থাকব। আমাকে ছাড়া যে ওদের চলবে না। কেন জানো? আমি ওদের টেলিফোন সিসটেমের এক নম্বর টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার। আমি চলে এলে সিঙ্গাপুরের টেলিফোনও কলকাতার মতন হয়ে যাবে!

আমি বললুম, মেজমামা, তুমি টেলিফোনের এতবড় একজন এক্সপার্ট, তাহলে তুমি কলকাতায় চলে আসছ না কেন? তুমি এসে কলকাতার টেলিফোন ব্যবস্থাটা ঠিকঠাক করে দিতে পার।

—আরে তুই তো মহা উজবুগ দেখছি, নীলু! আমি কলকাতায় ফিরে এসে কী করব? কলকাতায় টেলিফোনে আমার চেয়ে বড় এক্সপার্ট নেই বলতে চাস? নিশ্চয়ই আছে। এদেশে গুণী লোকের অভাব নেই। কিন্তু এরা ইচ্ছে করে টেলিফোনগুলো খারাপ করে রাখে। জনগণের স্বার্থে।

—তার মানে?

—হ্যাঁ, জনগণের স্বার্থে। টেলিফোন খারাপ। তারপর লোডশেডিং। এদেশে যে-কটা পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে, তাতে যথেষ্ট বিদ্যুৎ তৈরি করা যায় না বলতে চাস? আলবাৎ পারে। কিন্তু আদ্ধেকও তৈরি করে না। ইচ্ছে করে বানায় না। জনগণের স্বার্থে। এদেশের জনগণকে তা হলে আর ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতে হয় না। মন মেজাজ ভালো থাকে। রাত্তিরে আলো জ্বলে না, টেলিফোন বাজে না, কল দিয়ে জল পড়ে না, রাস্তা সারাই হয় না, সেইজন্যই লোকে ভাবে, দূর শালা, তাহলে আমরাই বা কাজ করব কেন? চুকে গেল ঝামেলা! কারুর আর কাজ করার দরকার নেই। অন্যান্য দেশে কাজ না করে মাইনে নিতে লোকে লজ্জা পায়, এদেশে সবাই গীতা নামে ঐ গ্যাড়াকলের বইখানা মাথায় নিয়ে বসে আছে।

মা বললেন, দুর্গা দুর্গা! কী তোর কথার ছিরি পিন্টু! গীতা আবার কী দোষ করল?

–ঐ যে গীতায় কী একটা কথা আছে না, কাজ-ফাজ তোমার ইচ্ছেমতন যা খুশি করো, কিন্তু ফলাফল নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না! সবাই সেটাকেই ধরে রেখেছে। একবার কী হলো জানো, ছোড়দি, আমার শ্বশুরমশাই যে-বারে মারা গেলেন, তখন করপোরেশন থেকে একটা ডেথ-সার্টিফিকেট দরকার ছিল। ভন্তু যায় আর ফিরে আসে। করপোরেশনের সেই কেরানি বাবুটির সময়ই হয় না। এদিকে ব্যাঙ্কের টাকা-ফাকা সব আটকে আছে। আমি তখন কলকাতায়। ভক্তকে বললুম, চ তো আমি যাই তোর সঙ্গে! গিয়ে দেখি, একটা অন্ধকার, নোংরা ঘর, তার মধ্যে সেই কেরানিবাবুটি টেবিলে অনেক ফাইলপত্র ছড়িয়ে বসে আছেন। খুব ব্যস্ত-ব্যস্ত ভাব। আমি জিজ্ঞেস করলুম, ও মশাই, সেই ডেথ-সার্টিফিকেটটা? তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, দেখছেন তো কাজ করছি, কাজ না করে কি চুপ করে বসে আছি? আপনাদেরটা এখনো হয়নি কেন তা কী করে জানব? বোঝ ঠ্যালা! উনি কাজ করছেন, কিন্তু ফল কী হচ্ছে, সেজন্য দায়ী নন। সেসব জানে কেষ্টঠাকুর! সাধে কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, কেষ্টা ব্যাটাই চোর!

মা বললেন, হাতে এঁটো শুকিয়ে যাচ্ছে, তুই এবার ওঠ তো!

মেজমামা হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে নীলু, তুই প্রেমট্রেম করিস? কোনো মেয়েকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে ঘোরাচ্ছিস না তো?

বিদেশে বেশিদিন থাকলে কি মানুষের কাণ্ডজ্ঞান একেবারে নষ্ট হয়ে যায়? মায়ের সামনে এরকম প্রশ্ন করার কোনো মানে হয়? আমি মেজমামার দিকে একটা ভর্ৎসনার দৃষ্টি দিলুম, বৌদি হাসতে লাগল, মা জানলার দিকে তাকিয়ে বললেন, বৃষ্টি আবার বাড়ল দেখছি!

মেজমামা তবু বললেন, নিশ্চয়ই কোনো মেয়ে ওকে পাত্তা দেয় না, তাই নীলুর চেহারাটা ন্যাড়া ন্যাড়া দেখাচ্ছে। আজকালকার মেয়েরা সেয়ানা হয়ে গেছে। বেকারদের ধারও ঘেঁষে না। কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেও কোনো মেয়ে জুটবে না। ছোড়দি, শেষ পর্যন্ত তুমি তোমার ছোট ছেলের বিয়েই দিতে পারবে না। আর বেশিদিন বেকার থাকলে ওর গায়ে বিকট গন্ধ হয়ে যাবে।

মা বললেন, আহা, একটা কিছু পেয়ে যাবে ঠিকই। পাপুন বলছিল, নীলু যদি দিল্লি যেতে রাজি থাকে…

ওসব দিল্লি-ফিল্লি ছাড়ো। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আমি সাত দিন থেকে যাচ্ছি এখানেই। এর মধ্যে নীলুর একটা কিছু হিল্লে করতেই হবে। কাল থেকেই বেরুব।

—মেজমামা, তুমি রাস্তায় বেরুলেই টপাস করে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলবে? আজকাল হাতের মোয়াও এত সহজে পাওয়া যায় না।

—চাকরি কী করে জোটাতে হয় তা আমি জানি না ভেবেছিস? ধরাধরি! সব দেশেই এখন ধরাধরির জয়। যোগ্যতা-টোগ্যতা পরের ব্যাপার, আসল কথা হচ্ছে, তুমি ঠিক ঠিক লোককে চেনো কিনা! হাতে হাতে ধরতে নেই, পায়ে ধরলেও কোনো লাভ হয় না, একটা কিছু টোপ ফেলে ধরতে হয়। সিঙ্গাপুরের টোপ অতি উত্তম।

এর পরেই মেজমামা বিকট সুরে একটা গান গেয়ে উঠলেন, ‘ধরি ধরায়ে নমো কৃষ্ণ যাদবায়ে নমো, একে ধরি, তাকে ধরি, ধরাধরি নমো….’

মা বললেন, এই পিন্টু, চুপ কর। খেতে বসে গান গাইতে নেই, তাতে বউ পাগল হয়!

মেজমামা একগাল হেসে বললেন, আমার বউ তো অলরেডি পাগল! ঊষা আর বেশি কি পাগল হবে! আমার সঙ্গে ঝগড়া করার সময় ঊষা ধেই ধেই করে নাচে!

তারপর বৌদির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, গানটা এইমাত্র বানালুম, কেমন হয়েছে, অলকা?

বৌদি বলল, চমৎকার গলা তো আপনার! আপনি টেলিফোনের…ইয়ে… না হয়ে গায়ক হতে পারতেন।

মেজমামা বললেন, ইয়ে মানে তুমি টেলিফোনের মিস্তিরি বলতে যাচ্ছিলে তো! ঠিকই বলেছ। কার নিয়তি যে কাকে কোন্ দিকে নিয়ে যায়! হাজারিবাগে আমার জন্ম, এখন সিঙ্গাপুরে টেলিফোন সারাই!

মা বললেন, এবার মিষ্টি খা, পিন্টু। তুই মিষ্টি ভালোবাসিস সেই ছোটবেলা থেকে।

মেজমামা একটা সন্দেশ টপাস করে মুখের মধ্যে ফেলে দিয়ে বললেন, রথীন!

মা জিজ্ঞেস করলেন, সে আবার কে?

উত্তর না দিয়ে মেজমামা পরপর আরও দুটো সন্দেশ খেতে খেতে বললেন, সুরঞ্জন! নির্মল!

আমি, মা ও বৌদি একবার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম। মেজমামা এক প্রসঙ্গ থেকে কখন যে অন্য প্রসঙ্গে চলে যান, তা বোঝা খুবই শক্ত।

এক গেলাস জল এক চুমুকে শেষ করে একটা উপভোগের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মেজমামা আবার বলে উঠলেন, এক্সেলেন্ট, অনবদ্য, প্রাণ জুড়িয়ে গেল! সত্যি ছোড়দি, যতই লোডশেডিং থাক, টেলিফোন কিংবা রাস্তা খারাপ হোক, দেশের মিষ্টি আর টাটকা মাছের মতন সুখাদ্য সারা পৃথিবীতে আর পাওয়া যাবে না। কে জানে, ঐসব জিনিসগুলো খারাপ আছে বলেই বোধহয় সন্দেশ-রসগোল্লা আর রুই-কাৎলাগুলোর স্বাদ এখনো ভালো আছে। তা হলে নীলু, কাল সকাল দশটা থেকেই আমরা চাকরির অভিযানে বেরুচ্ছি! দশটা, না এগারোটা? বড় বড় বাবুরা কখন অফিসে আসেন?

বৃষ্টি এখনো থামেনি, বরং বেগ আরও বাড়ল। একবার কলকাতায় টানা সাত দিন বৃষ্টি হয়েছিল, এবারও সেরকম কিছু হবে বোধহয়। আসুক, আসুক, আরও বৃষ্টি আসুক, সারা কলকাতা ডুবিয়ে দিক কয়েক দিনের জন্য।

আঁচিয়ে আসার পর আরও কিছুক্ষণ গল্প চলল। এবার সিঙ্গাপুর বিষয়েই বেশি।

আমাদের ফ্ল্যাটে তিনখানা ঘর, দাদা-বৌদির, মায়ের আর আমার। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে আমাকেই বাস্তুচ্যুত হতে হয়, রিফিউজি হতে হয় মায়ের ঘরে। তার মানেই সিগারেট বন্ধ। ঘুমোবার আগে কিছুক্ষণ ছাদে ঘোরাঘুরি করা আমার অভ্যেস, ছাদ আমাকে টানে। আজ বৃষ্টির জন্য যাওয়া যাবে না।

মেজমামা শুয়ে পড়ার পর আমি একবার বৌদির ঘরে এসে বসলুম। এই সময়টায় বৌদি আয়নার সামনে অনেকক্ষণ ধরে চুল আঁচড়ায়।

আমি চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলুম, বৌদি, তুমি বাজার করার জন্য যে ম্যাজিকের মতন একটা একশো টাকার নোট বার করে দিলে, তোমার কাছে ঐরকম নোট আর একখানা আছে নাকি?

বৌদি ভুরু তুলে বলল, কেন বলো তো? এত রাত্তিরে হঠাৎ টাকার কথা?

—থাকলে তোমার কাছ থেকে ধার নিতে চাই। কাল ভোরবেলা কেটে পড়ব।

—ভোরবেলা কেটে পড়বে, তার মানে?

–তোমরা কি আমাকে মেজমামার খপ্পরে ফেলে দিতে চাও? কাল থেকে আমার ঘাড় ধরে বিভিন্ন অফিসে অফিসে ঘুরবে চাকরির জন্য। দৃশ্যটা ভেবে দ্যাখো তো! ঐ দশাসই চেহারার মেজমামা। তার পেছনে পেছনে কাঁচুমাচু চেহারার আমি, অফিসের বেয়ারারাও আমার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাবে। চাকরি তো হবেই না, শুধু শুধু অপমান

—মেজমামার মাথায় যখন একবার এই ব্যাপারটা চেপেছে, সহজে ছাড়বেন না। কী আর করবে, একটু ঘুরে এসো ওঁর সঙ্গে!

—তুমিও বুঝি মায়ের দলে চলে গেছ? জোর-জবরদস্তি করে আমাকে চাকরিতে ঢোকাতে চাও?

–না, না, আমি মোটেই চাই না, তুমি চাকরির কটা টাকার জন্য তোমার স্বাধীনতা বিসর্জন দাও! মেজমামা তোমার চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবেন না। উনি তো জানেন না এখানকার অবস্থা। যদি বা কোনোক্রমে একটা জুটেও যায়, উনি চলে যাবার পরেই সেটা ছেড়ে দিও।

—তুমি আমায় একশো টাকা ধার দেবে না? এর মধ্যেই তুমি এত কঞ্জুষ হয়ে গেলে?

—শোনো নীলু, মিথ্যে কথা বলব না, আর একখানা একশো টাকার নোট আমার কাছে আছে ঠিকই। কিন্তু তুমি কেটে পড়লে, আমি আর মা কি করে মেজমামাকে সামলাব? তাছাড়া, উনি যদি সত্যি সত্যি সাত দিন থেকে যান, তাহলে আরও খরচ আছে না? এ টাকাতেও কুলোবে না। নীচতলা থেকে ধার করতে হবে।

—মেজমামা সাত দিন থাকলে উনি নিজেই বাজার করবেন।

–যাঃ, তা কখনো হয় নাকি? এখন তোমার যাওয়া চলবে না, নীলু। তোমাকেই রোজ বাজার করতে হবে।

—আমাকে রোজ বাজার করতে হবে, র‍্যাশান আনতে হবে, কেরোসিনের জন্য লাইন দিতে হবে, গ্যাসের জন্য তদ্বির করতে হবে, নর্দমার ঝাঁঝরি হারিয়ে গেলে সেটা খুঁজতে হবে…। আমি চাকরি করি না বলে তোমরা আমাকে ভূতের মতন খাটাও!

–তুমি আমার ওপর রাগ করছ, নীলু? এসব কে করবে বলো? তোমার দাদা একদম সময় পায় না। আমি গিয়ে কেরোসিনের জন্য লাইন দিলে সেটা ভালো দেখাবে? মা যেতেই দেবেন না আমাকে। আচ্ছা, তোমার দাদা ফিরুক, এবার বলব একটা বাচ্চা দেখে কাজের ছেলে রাখতে। সত্যিই তো, তুমি এত সব করবে কেন?

–তোমার ছাতাটা কোথায় রাখলে? আর একবার দাও।

—ছাতা? এত রাত্তিরে আবার কোথায় বেরুবে এই বৃষ্টির মধ্যে?

—ছাদে যাব।

বৌদির ঘরে বসে সিগারেট টানা যায় না। আজকাল নিত্য-নতুন থিয়োরি বেরুচ্ছে। এখন খুব শোনা যাচ্ছে প্যাসিভ স্মোকিং-এর কথা। যে সিগারেট খায় না, তার সামনে বসে অন্য একজন সিগারেট টানলেও সেটা তার পক্ষে সমান ক্ষতিকর। বৌদি এই কথাটা প্রায়ই বলে। দাদাকে জোর করে সিগারেট ছাড়িয়েছে, আমাকে এখনো সুবিধে করতে পারেনি।

বৃষ্টি পড়ছে এখন মাঝারি ধারায়। ছাদে এসে মাথার ওপর ছাতাটা ঘোরাতে ঘোরাতে আমি পায়চারি করতে লাগলুম। শহরটা এখন অদ্ভুত শান্ত আর নিস্তব্ধ। কাছে-দূরে কোনো বাড়িতেই আলো জ্বলছে না। বাদলার দিনে কেউ রাত জাগতে চায় না, অথচ রাতটা কী সুন্দর!

মাথাটায় সামান্য সামান্য ব্যথা করছে। কিছুদিন ধরে হচ্ছে এরকম, হঠাৎ হঠাৎ ব্যথাটা আসে। ঠিক মাথাধরা নয়, চিড়িক চিড়িক করতে থাকে মাথার এক দিকটায়। কী এর মানে? কারুকে জানাইনি, কোনো ওষুধ খাইনি। বেশিক্ষণ থাকে না অবশ্য। কারুকে বলতে গেলেই হয়তো শুনব, ধুস, এটা আবার একটা ব্যাপার নাকি? এরকম তো সকলেরই হয়। মাথা থাকলেই মাথার মধ্যে কখনো না কখনো চিড়িক চিড়িক করবেই।

সিগারেটটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে দেখি, ছাদের দক্ষিণ কোণে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি পরা, মাথার চুল খোলা। বৌদি কখন উঠে এল ছাদে? আমাকে ভয় দেখাতে এসেছে?

থমকে দাঁড়িয়ে ভালো করে তাকালুম। না, বৌদি নয়। আমার বৌদির ছোটখাটো চেহারা। বৌদি আমার চেয়ে তিন বছরের বড়, কিন্তু অনেকেই ভাবে ওর বয়েস বাইশ-তেইশের বেশি না। এই মেয়েটি বেশ লম্বা, খুব ছিপছিপে ও নয়, আলো-আঁধারিতে আর কিছু ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না।

একবার আমার বুকটা কেঁপে উঠল।

পরের মুহূর্তেই ভাবলুম, নীচতলায় ভাড়াটেদের কেউ ছাদে উঠে এসেছে? সচরাচর আসে না। ভাড়াটেদের মধ্যে এই রকম তরুণী মেয়ে ছিল একমাত্র দীপা, কিন্তু এই মার্চ মাসে তার বিয়ে হয়ে গেল। আর যে দুটি মেয়ে আছে, তারা ফ্রক পরে। অবশ্য ভাড়াটেদের কাছে বাইরে থেকে কেউ বেড়াতে আসতে পারে। আমাদের বাড়িতে যেমন মেজমামা এসেছে।

মেয়েটি আমারই দিকে চেয়ে আছে। বৃষ্টিতে যে ভিজছে, তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।

আমার ছাতাটা ঐ মেয়েটিকে দেওয়া উচিত। ছাতা দিতে গেলে কথা বলতে হয়। অন্ধকার ছাদে একটি অপরিচিতা নারীর সঙ্গে যেচে আলাপ করতে যাওয়াটা কি শোভন হবে?

মেয়েটি মুখ ফেরাচ্ছে না, শুধু আমাকেই দেখছে কেন?

আমার সর্বাঙ্গে একটা শিহরণ বয়ে গেল।

সিঁড়ির দরজার ছিটকিনি বন্ধ ছিল না? আমিই তো খুললুম। না, না, তা হতে পারে না, তা হলে এই মেয়েটি ছাদে এল কী করে?

নীচ তলার ভাড়াটেদের কাছে যদি কোনো নতুন মেয়ে এসে থাকে, তা হলে সে একা একা এই সময় ছাদে আসবে?

বুঝতে পারছি, আমার ছাতা-ধরা হাতটা একটু একটু কাঁপছে। আমি কি ভয় পেয়েছি? ধারাবর্ষণের রাতে, ফাঁকা ছাদে একটি মেয়েকে দেখে ভয় পাবার কী আছে?

দীপা যদি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে থাকে, তাহলে আমার সঙ্গে সে কথা বলবে না কেন? আমার সঙ্গে তো দীপার কোনো অভিমানের সম্পর্ক ছিল না, বরং ছিল ঠাট্টা-ইয়ার্কির। আমি বেকার বলে দীপা সব সময় আমাকে ক্ষেপাত। দীপা হতে পারে না, দীপাও এত লম্বা নয়। তার ছোটখাটো চেহারা, তাকে ধানী লঙ্কা বলে খুব রাগানো যেত।

অন্ধকারে এই মেয়েটির সিলুয়েট শরীরের গড়ন বেশ নিখুঁত বলে মনে হয়। সঙ্কোচে আমি পুরোপুরি তাকাতে পারছি না, আবার বেশিক্ষণ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখতে পারছি না চোখ।

আমার বুকের ভেতরে শব্দ হচ্ছে, আমার শরীর কাঁপছে!

যদি ভাড়াটেদের কোনো অতিথি হয়, তা হলে ছাদটা তাকেই এখন ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমার এখানে থাকাটা অশোভন। কিন্তু মানুষের কৌতূহল যে রাগ, লোভ কিংবা হিংসের চেয়েও প্রবল।

ফেরার জন্য পা বাড়িয়েও আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে? মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না।

ঠিক এই সময় অনেকখানি আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাল। এবার আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তাকে। তার সুশ্রী মুখখানি কৌতুকের হাসিতে ঝলমল করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *