অর্ধেক মানবী – ১০

১০

খুনীরা নাকি অকুস্থলে একবার না একবার ঠিক ফিরে যায়। নির্যাতিতরাও কি যায় না? একবালপুর-খিদিরপুরের মাঝামাঝি একটা নির্জন জায়গায়, পুকুরধারে দুটি সাইকেল আরোহী গুণ্ডা আমাকে মেরেছিল। সেখানেই হাঁটতে হাঁটতে চলে এলুম সন্ধেবেলা। এবার আর পথ ভুল করে নয়, পথ চিনে।

আমার কাছে আজ ঘড়ি নেই, একশো টাকা নেই, কিছুই নেই। গুণ্ডারা আমার কী করবে? ওদের কথা আমি চিন্তাও করছি না। মনটা খারাপ হয়ে আছে নানা কারণে।

মানুষ মানুষকে কেন এত ভুল বোঝে?

বিকেলে হঠাৎ দীনেন বসুর যমজ বাচ্চাদুটোর কথা মনে পড়ছিল বারবার। কেন মনে পড়ছিল কে জানে! মনের ওপর তো শাসন চলে না!

দুটি ফুটফুটে যমজ শিশু, এক বছর কয়েক মাস মাত্র বয়েস, এখন বাবা—মায়ের কাছ থেকে কত আদর পাবার কথা। কিন্তু বাবাটি সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে, মা যখন তখন কাঁদে। বাবাটি স্ত্রী-পুত্রদের ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। সামান্য একটা চাকরিকে উপলক্ষ করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা বিষিয়ে গেছে।

মানুষের জীবনে চাকরি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কবে থেকে? এ কী ধরনের সমাজ গড়ে তুলেছি আমরা?

দীনেন বোস চাকরিটা ফিরে পেয়েছে কিনা, সেটা জানার দারুণ কৌতূহল হচ্ছিল। ঐ অফিসে আর জীবনে কখনো পা দেব না প্রতিজ্ঞা করেছি, কিন্তু দীনেন বোসের বাড়িতে যাওয়ার তো কোনো বাধা নেই। মানুষ কি মানুষের বাড়িতে সৌজন্য বিনিময় করতে যায় না?

ঝোঁকের মাথায় একবালপুরের সেই গলিঘুঁজির মধ্যে দীনেন বোসের বাড়ি খুঁজে উপস্থিত হয়েছিলুম সাড়ে পাঁচটার সময়। ট্যাক্সি নিয়ে যাবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে।

দোতলায় উঠে সেই দরজাটায় টক টক করতে আগের দিনের মতনই খুলে দিল সেই বিষণ্ণ রমণী। প্রথমে আমাকে চিনতেই পারল না।

আমি নমস্কার করে বললুম, আমার নাম নীললোহিত, আমি একদিন এসেছিলুম ব্যানার্জিবাবুদের সঙ্গে। একবার দীনেনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারি?

দরজার অন্য পাল্লাটা খুলে মহিলাটি বলল, দীনেন এখন নেই। বেরিয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, আমি কি অপেক্ষা করব, না চলে যাব?

—আপনার বিশেষ কিছু দরকার ছিল?

–না, সেরকম কিছু না। আপনার কাছ থেকেই জেনে নিতে পারি। দীনেনবাবু আবার চাকরিতে জয়েন করেছেন?

-ভেতরে আসুন।

তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে কেউ একজন নামতে নামতে থেমে গিয়ে হাঁ করে আমাদের দেখছে, সেইজন্যই বোধহয় মহিলাটি আমায় ভেতরে ডাকলেন। লোকটির মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের দৃষ্টি সুবিধের না।

মহিলাটি দরজা বন্ধ করে দিল। ঘরের ভেতরটা আগের দিনের মতন ততটা অগোছালো মনে হলো না। বোধ হয় এদের অবস্থা ফিরেছে। তবে তো খুব ভালো কথা।

পাশের’ ঘর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে যমজের মধ্যে একটি। আমি কোনো কিছু না ভেবেই তাকে কোলে তুলে নিলুম। খুব ভদ্র বাচ্চা। মুখের কাছে আঙুল নিলেই খটখটিয়ে হাসে। চেনা-অচেনা নেই। এক একটা বাচ্চা অচেনা কারুর কোলে গেলেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে, সে বড় বিশ্রী ব্যাপার হয়!

দীনেনের স্ত্রীর নাম মণিকা। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমি হাসলুম। কিন্তু ওঁর মুখে হাসি নেই। খানিকটা ধারালো গলায় বলল, আপনি তো আরও ভালো পোস্ট পেয়েছেন?

আমি খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়ে বললুম, হ্যাঁ, মানে, খুব ভালো বলা যায় না। তবে আমাকে আর একটা জায়গায় বসান হয়েছে। দীনেনবাবু কি অফিস থেকে এখনো ফেরেননি?

মণিকা বলল, ও অফিস যাচ্ছে কে বলল আপনাকে? ওকে তো অফিস থেকে ডাকেনি!

—সে কি। এখনো ডাকেনি?

—আপনার গিল্টি ফিল করার কোনো দরকার নেই। আপনি তো এখন ওর চেয়ারে আর বসছেন না!

—না, সেজন্য নয়। দীনেনবাবুকে এখনো ডাকেনি কেন?

—এখন শোনা যাচ্ছে, চিঠি দুটো আসলে দীনেন হারায়নি। সব চিঠিই দীনেনের রিসিভ করার কথা, কিন্তু সেই সময় দীনেন সীটে ছিল না। চিঠি দুটো রিসিভ করেছিল পরিতোষ, দীনেনের নাম করে রেখেছিল। তারপর পরিতোষ সে চিঠি দুটোর কথা ভুলে যায়। কিংবা ইচ্ছে করে কোনো কারণে চেপে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন জেনে ফেললেও কেউ আর এখন পরিতোষের নাম ডিসক্লোজ করতে চায় না। তাহলে পরিতোষকে সাসপেণ্ড করা হবে। দীনেনও সেটা চায় না। ইউনিয়ানও চায় না। একজনের বদলে আরেকজনকে সাসপেণ্ড করিয়ে লাভ কী? দীনেনের তুলনায় পরিতোষ অনেক বেশি অ্যাকটিভ।

আমি বাচ্চাটিকে কোল থেকে নামিয়ে খাটের ওপর বসিয়ে দিয়ে বললুম, কী সাঙ্ঘাতিক কথা! দীনেনবাবু কোনো অন্যায় করেননি, তবু তিনি চাকরি খোয়াবেন?

মণিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, যারা চাকরি করছে, তারা বুঝি সবসময় ন্যায়—নীতি মেনে চলে?

আগের দিন মনে হয়েছিল, আমার প্রতি মণিকার খানিকটা সহানুভূতি আছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমাকে সে আঘাত করতে চায়। দীনেনের চেয়ারে আমি বসছি না বটে, কিন্তু আমার অন্য চাকরি পাওয়াটাও যেন খুব দোষের!

চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ লাখ বেকারের মধ্যে হঠাৎ একজন-দুজনের চাকরি পেয়ে যাওয়াটাও বোধহয় খুব ভালগার ব্যাপার। যেন একদল অভুক্ত মানুষের সামনে দেখিয়ে দেখিয়ে কারুর সন্দেশ-রসগোল্লা খাওয়া!

মণিকা দেওয়ালের দিকে ফিরে বলল, দীনেন আজ সকালে বেরিয়েছে আমার সঙ্গে ঝগড়া করে। দুপুরে খেতেও আসেনি। সে আর ফিরবে কি না কে জানে!

—সে কি? কোনো খোঁজ করেননি? ব্যানার্জিদের কোনো খবর দেননি? ঠিকানা পেলে আমি ওঁদের কারুকে বলে আসতে পারি।

—আপনি আমার ছেলেটাকে হঠাৎ কোলে তুলে আদর করলেন কেন?

–কেন? একটা বাচ্চাকে আদর করার মধ্যে কি এরকম প্রশ্ন আসে? আমার ঠিক জানা ছিল না!

—আপনি ভালো চাকরি পেয়েছেন। তারপর দেখতে এসেছেন আমরা কী অবস্থায় আছি! দয়া? দয়া করতে চান আমাদের?

–না, না, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।

দেয়ালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মণিকা আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকাল। চুলগুলো খোলা, আঁচলটা লুটোচ্ছে মাটিতে, তাকে দেখাচ্ছে উন্মাদিনীর মতন।

সে বলল, সেদিন আমার ভাই বলেছিল, আপনি চাকরি পেয়েছেন….দীনেন যদি কোথাও চলে যায়, তাহলে আপনাকে ভার নিতে আমাদের ছেলেদের, আমার, এই সংসার! বলেনি? আপনি সেইজন্য এসেছেন?

—না, না।

-তবে কেন এসেছেন? বলুন! বলুন! উত্তর দিন! চুপ করে রইলেন কেন, বলুন?

আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে এসেছি।

সত্যিই তো। আমি কেন গিয়েছিলুম ওদের বাড়িতে, তা বুঝিয়ে বলা খুব শক্ত। যা ভাষায় বুঝিয়ে বলা যায় না, তাও কি কেউ বুঝবে না?

রাগে-দুঃখে-অভিমানে মাথার ঠিক নেই মণিকার। তাকে কোনো সান্ত্বনা দেবার ভাষাও আমার জানা নেই। আমি সান্ত্বনা দেবার কে!

ট্রামে-বাসে, রাস্তায় কত বেকার ছেলে দেখি, তাদের গায়ে শক্তি আছে, দু-একটা ডিগ্রিও আছে, কিন্তু কোনো কাজ নেই। তাদের অনেকেরই যোগ্যতা নিশ্চিত আমার চেয়ে বেশি। তারা যদি জানতে পারে, আমি দৈবাৎ আমার মামার জোরে একটা চাকরি পেয়ে গেছি, তা হলে তারা পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে!

সেই বাড়ি থেকে আমি আজ রাস্তা চিনে ট্রাম লাইনে ফিরে যেতে পারতুম। কিন্তু আগের দিনের ভুল করে হারিয়ে যাওয়া রাস্তাটাও এখন আমার জানা হয়ে গেছে।

সেই নির্জন জায়গা, দূরে দূরে ছাড়া ছাড়া বাড়ি, একদিকে একটা মস্ত বড় পুকুর কিংবা খাল, আজও সেখানে একটা নৌকো বাঁধা আছে।

এইখানেই নীলা প্রথম আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। আমি তাকে ছুঁয়ে দেখেছিলুম যে সে রক্তমাংসের নারী, তার শরীরে উত্তাপ আছে।

দিকশূন্যপুর কি এই নির্জন জায়গার কাছাকাছি? এই সব অঞ্চল ভালো চিনি না, এখানে কোনো বিরাট শূন্যতা থাকতে পারে। নীলা এখানে খুব সাবলীলভাবে মিলিয়ে গিয়েছিল অন্ধকারে।

সেই পুকুরের ঘাটলাটায় গিয়ে বসলুম।

কে আসবে—গুণ্ডারা, না নীলা?

আজ আর মাথা নয়, আমার গলার কাছে ব্যথা-ব্যথা করছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার বুঝি অভিমান হতে পারে না?

এটা দীঘি কিংবা খাল যাই-ই হোক, অন্ধকারে ওপরের দিকটা অস্পষ্ট। দু’ পাশে জন্মে গেছে অনেক আগাছা। জলের রঙ কালো। মাঝে মাঝে ঘাই মারছে মাছ। আজ একজনও মানুষ দেখা যাচ্ছে না।

একটু বাদে দেখতে পেলুম, পুকুরের ডান ধার দিয়ে এদিকের রাস্তার দিকে হেঁটে আসছে একটি মেয়ে। যারা জানে না, তারা ভয় পেতে পারত। এরকম সন্ধেবেলা, এত নির্জন, গুণ্ডা-অধ্যুষিত জায়গায় কোনো একা মেয়ে কি আসে? অপার্থিব কেউ হতেও পারে।

কিন্তু নীলা সত্যিই তো অপার্থিব। আমি বুঝে গেছি, সে এই পৃথিবীর কেউ নয়। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, সে শুধু আমার জন্য আসে। আমার এই সাতাশ বছর বয়সের মধ্যে এমন পুরস্কার তো আমি আগে কখনো পাইনি!

এজন্য আমার কিছু ত্যাগ করা উচিত। শুধু পাওয়া ভালো নয়। সঙ্গে সঙ্গে কিছু ছেড়ে দিতেও হয়। এই মুহূর্তে আমার কাছে আর তো কিছু নেই, তাই চটি জুতোজোড়া ঠেলে ফেলে দিলুম জলের মধ্যে।

আগের দিনে গুণ্ডারা আমার হাতের ঘড়ি আর একশো টাকার নোট নিয়ে ঠিক কাজই করেছিল। সেও তো ত্যাগ।

ও কি নীলা, না কেউ? হয়তো কোনো বাড়ির কাজের মেয়ে বাড়ি ফিরছে। কাজের মেয়েদের বিশেষ ভয়-ডর থাকে না। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না শাড়ির রঙ।

মেয়েটি আমার কাছে এসে বসল। একটা গন্ধ পেয়েই বুঝলুম, এ নির্ঘাৎ নীলা। নীলার নিজস্ব একটা সৌরভ আছে, যা কোনো পারফিউম নয়।

নীলা বসেছে আমার পিছন দিকে। তবু আমি ঘাড় ঘোরালুম না, দেখলুম না তাকে, কথা বললুম না তার সঙ্গে।

এ কি বিচিত্র ব্যাপার! নীলার প্রতীক্ষাতেই এখানে এসে বসে থাকা, অথচ আমি তাকে এত কাছে পেয়েও দেখছি না। আমার গলার মধ্যে বাষ্প আটকে গেছে।

কয়েক মুহূর্ত বাদে নীলা আরও সরে এসে আমার পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে, নীললোহিত? তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন? আমি দু’তিনটে বড় বড় ঢোক গিলে পরিষ্কার করে নিলুম গলা। তারপর বললুম, নীলা, আমার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, মাথায় নয় বুকে নয় গলায় নয়। ঠিক জানি না কোথায়, কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে।

নীলা বলল, কেন তোমার এত কষ্ট হচ্ছে, নীললোহিত?

আমি বললুম, কেন যেন মনে হচ্ছে, তুমি আমায় ভালোবাসো না।

নীলা বলল, আমি তো ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই জানি না, নীললোহিত।

-তবে কেন সকালবেলা, তোমাকে দাঁড়াতে বললুম, তবু তুমি চলে গেলে?

-অনেকক্ষণ ধরে যে কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছিলুম, তাই আমার শরীর কেঁপে উঠল।

—কুকুরের ডাক! তুমিও বুঝি কুকুরে ভয় পাও?

-না তো! কিন্তু তোমার মনের মধ্যে একসময় কুকুর ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমি ছিলুম না। তাই আমি আর থাকতে পারলুম না। আমাকে চলে যেতে হলো।

-মনের মধ্যে কুকুর! দা সারকামসাইজড ডগ! তাহলে কি প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা কুকুর আছে? আমাদের ফ্ল্যাটে তখন সত্যিকারের কোনো কুকুর ঢোকেনি, ওটা মনের কুকুর? আই টুক বাই দা থ্রোট দা সারকামসাইজড ডগ…

—তুমি কী বলছ, বুঝতে পারছি না!

—ও কিছু না। বোধহয় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই আমি হঠাৎ এই উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

—এখানে শুধু শুধু বসে ছিলে কেন? এই জায়গাটা ভালো না। আগেরদিন দুটো লোক তোমাকে বিশ্রীভাবে মেরেছিল। কেন আবার এলে!

–আমি আগে দীনেন বোসের বাড়িতে গিয়েছিলুম। তুমি ওকে চেন না।

—প্রথমদিন চাকরিতে যার চেয়ারে তুমি না জেনে বসেছিলে, সেটা তো তোমার দোষ হতে পারে না!

—তুমি এখবরও জান? কিন্তু নীলা, আমি যে না জেনে দীনেনের চেয়ারে বসেছিলুম এটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। সবাই কেন আমাকে এতটা স্বার্থপর ভাবে! আমার খুব কষ্ট হয়।

—তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও। তুমি কষ্ট পেয়ে আমাকেও কষ্ট দিও না আর।

—নীলা, তুমি না এলে আমি আজ এখানে সারারাত বসে থাকতুম।

—তুমি যদি চাও, আমাকে ধরে রাখ, তাহলে আমিও সারারাত বসে থাকতে পারি এখানে।

–তুমি আমাকে দিকশূন্যপুরে নিয়ে যাবে বলেছিলে!

-এখন যাবে?

—এখান থেকে যাওয়া যায়?

—যে কোনো জায়গা থেকেই তো যাওয়া যায়।

—চলো, চলো। এক্ষুনি চলো। কিসে যাব? হেঁটে, না কোনো গাড়ি ভাড়া করতে হবে?

—হেঁটে যেতে পারি। ইচ্ছে করলে এই নৌকোটাতেও যাওয়া যায়।

—নৌকোয় যাব? এটা তো একটা পুকুর?

–না, পুকুর নয়। এটার শেষ নেই। তুমি নৌকো চালাতে জান, নীললোহিত?

—আমি এরোপ্লেন ছাড়া সব চালাতে জানি। সাইকেল জানি, নৌকো জানি, একবার হাজারিবাগে গিয়ে ট্যাক্সি-ড্রাইভার হব ঠিক করে গাড়ি চালাতেও শিখেছিলুম। রিকশাও টেনেছি কয়েকদিন। শুধু প্লেন আর মহাশূন্যের রকেট জানি না। অবশ্য শুনেছি, রকেট চালাবার জন্য বিশেষ কিছু শিখতে হয় না, তলা থেকেই সবকিছু কন্ট্রোল করে।

–এসো, আমরা নৌকোটায় উঠি।

—এটা কার নৌকো? কেউ কিছু বলবে না?

—এখনো তোমার এত প্রশ্ন! দিকশূন্যপুর যাবার জন্য তো প্রশ্ন লাগে না। এটা বারোয়ারি খেয়ার নৌকো। এর কোনো মালিক নেই।

—তবে চলো, নৌকোতে যাই। আমি নৌকো উল্টে দেব না। তবু, তুমি সাঁতার জান তো নীলা?

–তুমি জানলেই তো হবে।

আমরা দুজনে চড়ে বসলুম নৌকোয়। দুটো বৈঠা রাখা আছে, কোনো অসুবিধে নেই। অনেক দিনের অনভ্যেস, প্রথমে একটু টালমাটাল হলো। বাচ্চা মেয়ের মতন জলের মধ্যে হাত দিয়ে খেলা করতে লাগল নীলা।

তারপর নৌকোটা বেশ সহজ ভাবে চলা শুরু করল, যেন একটা চোরা স্রোত আছে এই জলে। একটু বাদেই কোথা থেকে কুয়াশা ঘিরে ফেলল আমাদের। তার মধ্যেও নৌকো চলে এল তরতর করে।

এক সময় নীলা বলল, এবার বাঁধো।

আমি খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে বললুম, এত কাছে?

নীলা বলল, এ আমার নিজস্ব দিকশূন্যপুর। এর কোনো জায়গা লাগে না। যেখানে ইচ্ছে বানিয়ে নেওয়া যায়।

পাড় বা ঘাট দেখা যাচ্ছে না, তবু নৌকোটা ঠেকল কোনো শক্ত জায়গায়। বৈঠা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আমি নীলার দিকে হাত বাড়িয়ে বললুম, এসো।

নীলা বলল, এখানে তুমি কিছু চিনবে না। আমিই তোমাকে নিয়ে যাব।

আমি বললুম, কুয়াশায় যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গরম কালের রাতে এমন কুয়াশা এল কোথা থেকে? নাকি ধোঁয়া?

নীলা বলল, ফুঁ দাও, একটু একটু করে সরে যাবে।

ওপরটা বেশ পিছল। ঠিক কাদা নেই, তবু যেন পায়ের তলা সড়সড় করে। আমার খালি পা। আমি শক্ত করে ধরে রইলুম নীলাকে।

যেন আমরা শিশু হয়ে গেছি, পৌঁছেছি এক রূপকথার জগতে। সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছি না, ফুঁ দিয়ে সরাচ্ছি কুয়াশা।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, এখানে আর কেউ আসে না?

নীলা বলল, এই তো তুমিই এলে প্রথম!

—আমি আর ফিরে যাব না। চাকরিটাকরি কিছু আর ভালো লাগে না আমার তোমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও অন্য কোথাও থাকতে চাই না।

–আমিও তোমাকে ছেড়ে আর থাকতে পারি না, নীললোহিত। বার বার কাচের টুকরোর মতন ভেঙে ভেঙে যেতে আমার ভালো লাগে না।

-এখানে বাড়ি আছে? কোনো গাছপালা আছে?

—আমার একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। সেখানে নিয়ে গিয়ে তোমাকে খুব মজার একটা জিনিস দেখাব। তুমি নির্ঘাৎ চমকে যাবে।

—কী দেখাবে নীলা? কী দেখাবে?

—আগে পৌঁছোই! হ্যাঁ, এখানে গাছও আছে। পাশেই তো একটা, তোমার হাতটা বাড়াও!

কুয়াশায় দেখা যাচ্ছে না, তবু হাত দিয়ে আমি ছুঁতে পারলুম একটা গাছ বেশ বড়। গুঁড়িটা টের পাচ্ছি, পাতা খুঁজে পাচ্ছি না।

—এটা কী গাছ?

—এটা একটা চাঁপা ফুলের গাছ। ঊর্বশী চাঁপা। বারোমাস ফুল হয়। ভারি সুন্দর গন্ধ।

—চাঁপা ফুল আমার খুব প্রিয়। ফুল পাড়া যাবে না?

—অনেক উঁচুতে ফুল। কুয়াশা সরে যাক, তারপর চেষ্টা করো।

আমি নীলার হাতটা আমার মুখের কাছে এনে তার আঙুলগুলোতে চুমু খেলাম। আমার শরীর কাঁপছে। আমার অন্তরাত্মা কাঁপছে। বিকেল ও সন্ধের মধ্যে এত তফাৎ!

গাছতলায় একটুক্ষণের জন্য দাঁড়ালুম আমরা।

বিকেলবেলার দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ফিরে এল। ফুঁ দিয়ে কুয়াশা সরানো যায় কিন্তু সেই মনের ছবিটা সরান যায় না। অপমানিত হয়ে আমি মাথা নীচু করে বেরিয়ে আসছি একটা বাড়ি থেকে

আমি বললুম, দীনেন বসুর স্ত্রী মণিকা আমাকে বড্ড কষ্ট দিয়েছে আজ। আমার উদ্দেশ্যটাকে কেন অবিশ্বাস করল! একটা শিশুকেও আদর করা দোষের! চাকরি পেয়েছি বলে আমি যেন একটা দুর্বৃত্ত। আমার নোংরা হাতে একটা শিশুকেও স্পর্শ করা যায় না।

নীলা বলল, ও কথা আর মনে রেখো না!

আমি বললুম, ভুলতে পারছি না যে! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!

নীলা বলল, আমি আদর করে তোমার কষ্ট ভুলিয়ে দেব!

আমি বললুম, দাও আদর দাও। এ পর্যন্ত আমি তোমার কাছে কিছু চাই নি। শুধু একবার…..আমি কি বোকা, বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে তোমার কাছে কুড়ি টাকা চেয়েছিলুম!

খিলখিল করে হেসে নীলা বলল, আহা রে, সেই কুড়ি টাকার শোক! দিকশূন্যপুরে এসে টাকার কথা বলতে নেই, তা জান না?

আমি অসহায়ভাবে বললুম, মনটা কিছুতেই পরিষ্কার হতে চায় না। এইসব ছোটখাটো কথা ঘুরে ফিরে আসে। তুমি আদর দিয়ে ভুলিয়ে দাও।

নীলা আমার সামনে চলে এল।

কুয়াশায় আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু অকূল সমুদ্রে লাইটহাউসের মতন দেখতে পাচ্ছি তার উজ্জ্বল মুখ। এখন সেই মুখখানি দারুণ চেনা মনে হচ্ছে। তার চিবুকের ডৌল, তার কানের লতি, তার উড়ন্ত ভুরু, সবই খুব চেনা।

আমার ঠোটে ঠোঁট রাখল নীলা। তার মুখের মধ্যে চাঁপা ফুলের গন্ধ।

চুম্বনটি অসমাপ্ত রেখেই সে ছিটকে সরে গিয়ে উৎকণ্ঠিতভাবে বলল, একী, তুমি কাঁপছ, নীললোহিত? তোমার জ্বর হয়েছে নাকি?

আমি বিপন্ন গলায় বললুম, কাঁপছি? না, না, আমার জ্বর হয়নি। মনে হচ্ছে যেন ঝড় উঠেছে।

নীলা বলল, তা হলে সত্যি ঝড় উঠেছে। আমার হাত ধরে থাকো। তুমি চলে যেও না। তুমি চলে যেও না।

আমি বললুম, আমি যেতে চাই না। আমায় ধরে থাকো

কিন্তু হাত বাড়িয়েও ‘আমি নীলাকে আর ধরতে পারলুম না। একটা সত্যিকারের প্রবল ঝড় আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে গাছপালার। নীলাকে আর দেখতে পাচ্ছি না।

আমি বলতে লাগলুম, নীলা, আমাকে যেতে দিও না, আমি যেতে চাই না! অনেক দূর থেকে নীলার গলা শোনা গেল, নীললোহিত, চলে যেও না, চলে যেও না!…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *