অর্ধেক মানবী – ১

সিঙ্গাপুর থেকে হঠাৎ মেজমামা এসে আমার মহা সর্বনাশ করে দিলেন।

এই মেজমামাটি দু’তিন বছর অন্তর অন্তর একবার করে দেশে আসেন, আমাদের বাড়িতে কখনো এক রাতের বেশি থাকেন না, তারপরেই চলে যান মুর্শিদাবাদের কান্দীতে ওঁর শ্বশুরবাড়িতে। সেখান থেকে আবার বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বিভিন্ন গ্রামে। সিঙ্গাপুর নাকি খটখটে, ঝকঝকে, খুব যান্ত্রিক শহর, তাই দেশে ছুটি কাটাতে এসে মেজমামার কোনো শহরে থাকতে ভালো লাগে না। উনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান, মেঠো রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটেন, এঁদো পুকুরে সাঁতার কাটেন। মুড়ি-চিঁড়ে-খই আর নারকোল নাড়ু ওঁর প্রিয় জলখাবার।

মেজমামা এলে আমরা কিছু বিদেশী চকলেট আর নানারকমের ডটপেন উপহার পাই। একবার উনি আমার জন্য একটা চক্রাবক্রা জামাও এনেছিলেন, তাতে ড্রাগন আঁকা। মা সে জামাটা আমায় কিছুতেই পরতে দেননি, সেটি আমাদের বাড়ির জমাদারকে পুজোর জামার বদলে গছানো হয়েছে। একবার মেজমামা আমাকে একটা ক্যামেরাও দিতে চেয়েছিলেন, সেটা অবশ্য আমি নিইনি। মেজমামার শালা ভন্তুর ওপর কোনো কারণে আমার রাগ ছিল, তাই আমি মিষ্টি হেসে বলেছিলুম, মেজমামা, তুমি ঐ ভালো জিনিসটা ভন্তুকেই দাও! ঐ ক্যামেরার জন্য ভন্তুর এখন প্রতি মাসে অন্তত দুশো টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে একবার ওটা সারাতেও হয়েছে।

এবারে মেজমামার মাথায় কী এক দুষ্টুবুদ্ধি চাপল, উনি এক বর্ষার সন্ধেবেলা দমদম এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে মাকে বললেন, ছোড়দি, তোমার এখানে আমি দিন সাতেক থেকে যাব!

ক’দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব, অনেক রাস্তায় জল জমে আছে। চারদিকে ছুটি ছুটি ভাব, আমরা প্রত্যেক দুপুরে খিচুড়ি খাচ্ছি। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোতে মেজমামাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। মওকা পেয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার দেড়শো টাকা চেয়েছিল, তাও বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে ট্রিভোলি কোর্টের কাছে ইঞ্জিন থেমে গেল। তখন সেই রাস্তার কোমরজলে নেমে গাড়ি ঠেলতে হয়েছে মেজমামাকে। তার ওপরে আবার একটা ড্রেনের মধ্যে পা ঢুকে গিয়েছিল। মেজমামার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে পা-টা ফ্র্যাকচার হয়নি, শুধু গোড়ালির কাছে একটু মচকেছে।

এতেও অবশ্য মেজমামার মেজাজ খারাপ হয়নি। তিনি সদা হাস্যময় ধরনের মানুষ। রাস্তায় গাড়ি ঠেলতে হয়েছে বলে তিনি ট্যাক্সিওয়ালাকে হিসেব করে দেড়শো টাকা থেকে আঠারো টাকা কম দিলেন। কী হিসেব তা কে জানে, ট্যাক্সিওয়ালাও আপত্তি করল না। মচকানো পা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উৎফুল্ল গলায় মেজমামা বললেন, আরে, প্রত্যেকবার আমি এসেই গ্রামে যাবার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠি কেন? কলকাতাটাও যে এখনো গ্রাম হয়ে আছে, সেটা খেয়ালই করিনি। আসবার পথে কী দেখলুম জানিস? ল্যান্সডাউন আর সার্কুলার রোডের ক্রসিং-এর কাছে কী একটা পার্ক আছে, সেই পার্কের পুকুরটা উপচে রাস্তার জলের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। পুকুরের মাছও ভেসে যাচ্ছে, একদল ছেলে গামছা দিয়ে সেই মাছ ধরছে! সার্কুলার রোডে মাছ ধরা! আর এক জায়গায় দেখি, খাটাল থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটো মোষ, তারা গাঁক গাঁক করে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে মাঝরাস্তা দিয়ে, আর রাস্তার লোকজন ভয়ে এদিক ওদিক দৌড়ে পালাচ্ছে, রানিং হেলটার স্কেলটার যাকে বলে! আজকাল গ্রামেও চট করে এরকম দৃশ্য দেখা যায় না।

মেজমামার সুটকেস আর ব্যাগ-ট্যাগ আমি বয়ে আনলুম ওপরে।

মাকে প্রণাম করে মেজমামা বললেন, তুমি বেশ রোগা হয়ে গেছ, ছোড়দি। ছেলেরা তোমাকে ভালো করে খেতে দেয় না বুঝি?

মা হেসে বললেন, এসেই কী সব অলক্ষুণে কথা শুরু করলি! খেতে দেবে না কেন? মোটেই আমি রোগা হইনি, তুই-ই বরং…। তুই এবার অনেকদিন পর এলি, পিন্টু! অন্যান্যবার শীতকালে আসিস, এবার এই বর্ষার মধ্যে…

মেজমামা বললেন, ভালোই তো হলো, এবার বর্ষাটা দেখা যাবে। অনেক বছর দেশের বর্ষা দেখিনি।

—ঊষা আর ছেলেমেয়েরা এল না?

—নাঃ! মেয়েটার সামনেই পরীক্ষা। ঊষার ধারণা, সে কাছে না থাকলে মেয়েটা ফেল করবে! এদিকে ঊষার নিজের বিদ্যের দৌড় কতখানি তা তো তুমি জানই! ইংলিশ অনার্সে গাড্ডু মেরেছিল।

—বাজে কথা বলিস না। তুই তো ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর দিকে কোনো নজরই দিস না। ঊষাই সব দেখাশুনো করে শুনেছি।

–আমার বাবা-মা কি পরীক্ষার আগে আমার পড়া দেখিয়ে দিত? আমরা নিজে নিজে পড়ে পাশ করিনি? ঊষার যত সব আদিখ্যেতা। বললুম, ছেলেমেয়েদের রেখে আমার সঙ্গে চলে আসতে। তোমাকে এই বলে রাখলুম ছোড়দি, মিলিয়ে দেখো, অতিরিক্ত আদর পেয়ে পেয়ে আমার ছেলেমেয়েগুলো উচ্ছন্নে যাবে। কিস্যু হবে না ওদের। আমার ছোট ছেলেটা ডিমসেদ্ধ খেতে চাইত না, বুঝলে, নিয়ে নষ্ট করত। আমার কত কষ্টের রোজগার করা পয়সা। একদিন ওর মা বাড়ি ছিল না। আমি ছোট ছেলেটার চুলের মুঠি ধরে বললুম, হারামজাদা, শুয়ারকা বাচ্চা, ডিম নষ্ট করবি তো এইসান একখানা রদ্দা কষাবো যে ঘাড় ভেঙে যাবে। মায়ের কাছে নালিশ করলে জিভ কেটে দেব! ব্যাস, তারপর থেকে সব ঠিক হয়ে গেছে, এখন ডিম চেয়ে খায়। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খায়!

আমরা হাসতে লাগলুম। মেজমামার কথাবার্তার মধ্যে সত্যি মিথ্যে ধরা শক্ত। তবে মেজমামা এলেই বাড়িটা সরগরম হয়ে ওঠে।

বাড়িতে কোনো অতিথি এলেই আমার ভালো লাগে। যেন এক ঝলক নতুন গন্ধবহ বাতাস। অতিথির সামনে আমরাও একটু বদলে যাই। অন্য সুরে কথা বলি। মেজমামা ছ’ফুটের বেশি লম্বা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দশাসই শরীর। দেখলেই মনে হয় অফুরন্ত তাঁর প্রাণশক্তি। মিলিটারিদের মতন কাঁধের দু’পাশে ফ্ল্যাপ দেওয়া শার্ট পরেন। তাঁর হাসির শব্দ দেয়াল ফাটাবার মতন।

চা-জলখাবার খেতে খেতে মেজমামা গল্পের বন্যা বইয়ে দিলেন।

মেজমামা ভন্তুকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদে যান। ভন্তু থাকে শ্যামবাজারে। নর্থ ক্যালকাটায় নাকি এবার অসম্ভব জল জমেছে। ট্রাম-বাস কিচ্ছু যাচ্ছে না, দু: তিনদিনের মধ্যে অবস্থা স্বাভাবিক হবার আশা নেই, বৃষ্টি পড়েই চলেছে।

একসময় গল্প থামিয়ে মেজমামা বললেন, তা হলে ভন্তুকে একটা টেলিফোন করে দিই। এবার দু’চারদিন পরেই গ্রামে যাব। ফোনটা কোথায়? ওকি, ফোনটাকে টেবিলের নীচে রেখেছিস কেন?

আমি বললুম, এক মাস ধরে ফোনটা কোনো শব্দ করে না!

মেজমামা সবিস্ময়ে এ-ক-মা-স বলতেই আমি আবার জানালুম, অত অবাক হচ্ছ কেন? অনেকের ফোন তিনমাস ছ’মাসও খারাপ থাকে, আমাদের তো মোটে এক মাস হয়েছে।

মেজমামা বললেন, রাস্তায় কোমরজল, সাউথ থেকে নর্থ ক্যালকাটায় যাবার কোনো উপায় নেই। টেলিফোনেও খবর দেওয়া যাবে না। বাঃ, চমৎকার ব্যবস্থা। লোকে অফিস-টফিসও যাচ্ছে না বোধহয়? কী রে, নীলু, তুই আজ অফিস গেলি? নাকি ইস্কুলের মতন রেইনি ডে?

মা বললেন, নীলুর আবার অফিস কোথায়?

মেজমামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর অফিস নেই…মানে, তুই চাকরি-টাকরি করিস না এখনো?

আমি হাসিমুখে দু’দিকে ঘাড় নাড়লুম।

মেজমামা আমার পিঠে একখানা বিরাট চাপড় মেরে বললেন, বা-বা-বা-বা—বা! এ তো অতি দিব্য ব্যাপার! নীলু, তুই তা হলে খাসা আছিস বল! আগের জন্মে যারা চরম পাপ করেছে, তারাই তো এ জন্মে চাকরি করে! তুই তো মহাপুরুষ!

আমার পিঠে চাপড়ের শব্দটা শুনে টেবিলের উল্টো দিকে দাঁড়ানো বৌদি চমকে উঠে বলল, উফ্! মেজমামা, আপনার আদরটাও তো সাঙ্ঘাতিক!

মেজমামা বললেন, সাড়ে তিন বছর পরে দেশে ফিরলুম। এখানে প্রাণখুলে কথা বলা যায়। তোমরা বেশ মজায় আছ। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায়, টেলিফোন কাজ করে না, বাড়িতে একটা দামড়া ছেলে বেকার বসে থাকে, তবু তো সব ঠিকঠাক চলছে! কোনো অসুবিধে নেই। আর আমাদের ওখানে পান থেকে চুন খসার উপায়টি নেই, সারা সপ্তাহ খাটতে খাটতে জিভ বেরিয়ে যায়, কেউ একটু হাসি-ঠাট্টা করারও সময় পায় না। এমনভাবে রোজগার করেই বা কী লাভ!

মা বললেন, পিন্টু, তোর পা মচকে গেছে, একটু চুন-হলুদ লাগিয়ে দি? নাকি আয়োডেক্স-ফায়োডেক্স কিছু মাখবি?

মেজমামা বললেন, দাঁড়াও ছোড়দি, আগে চানটা করে আসি। রাস্তার নোংরা জলে নেমে গাড়ি ঠেলতে হয়েছে তো, গা-টা এখন কিটকিট করছে। ওষুধ-ফষুধ কিচ্ছু লাগবে না।

—তা হলে গরম জল করে দিক!

—আরে নাঃ। দেশে ফিরে আমি কক্ষনো গরম জলে স্নান করি না। তোমার গামছা আছে? তোয়ালে দিয়ে গা মুছে মুছে অভক্তি জন্মে গেছে। গামছার মতন মোলায়েম জিনিস আর হয় না।

মেজমামা বাথরুমে ঢুকে যাবার পর মা আমার দিকে তাকিয়ে একটা চোখের ইঙ্গিত করলেন।

দাদা অফিসের কাজে পাটনা গেছে। বাড়িতে মা, বৌদি আর আমি এই তিনটি প্রাণী। বাদলার মধ্যে আজ আর বাজারে যাওয়ার ঝামেলা করিনি। দুপুরে খিচুড়ি—আলুসেদ্ধ’ওমলেট খাওয়া হয়েছে, রাত্তিরেও ডিমের ঝোল দিয়ে চালিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু মেজমামাকে কিছু স্পেশাল খাতির দেখানো দরকার।

যতই বৃষ্টি হোক, গড়িয়াহাটের বাজার সন্ধের পরেও খোলা থাকে। এবারের বর্ষায় বেশ ভালো ইলিশ উঠেছে। মেজমামা এখানকার মাছ খেতে খুব ভালোবাসেন। সিঙ্গাপুরে শুধু সামুদ্রিক মাছ, সেসব তাঁর পছন্দ নয়। ভন্তুর কাছে গল্প শুনেছি, কান্দীতে একবার পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হচ্ছিল, একটা প্রায় তিন কিলো ওজনের রুইমাছ উঠল, পাড়ে ফেলার পরও সেটা লাফাচ্ছে। মেজমামা সেই মাছটা জড়িয়ে ধরে আনন্দের চোটে প্রায় কেঁদে ফেলে বলেছিলেন, ওরে, সিঙ্গাপুরে এক লাখ টাকা দিলেও এমন টাটকা পুকুরের মাছ পাওয়া যাবে না!

বিদেশে মেজমামার প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর কেটে গেল, তবু তাঁর দিশি রুচি এখনো বদলায়নি।

মাসের শেষ, তবু বৌদি কী করে যেন ম্যাজিকের মতন একটা একশো টাকার নোট বার করে দিল। মা বললেন, একটু ভালো দেখে চালও আনিস, আর কাঁচা লঙ্কা, আর গোটাছয়েক সন্দেশ, সাইজটা যেন একটু বড় হয় …

প্যান্ট গুটিয়ে, ছাতা আর থলে হাতে নিয়ে আমি বাজারে যাবার জন্য সিঁড়িতে পা দিয়েছি, এমন সময় বাথরুম থেকে মেজমামা চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে কী হলো! ভুল করে কে আলো নিভিয়ে দিল রে? আমি যে ভেতরে আছি!

আমি বললুম, লোডশেডিং!

মা বললেন, এই রে, অন্ধকারের মধ্যে ছেলেটা আবার ঠোক্কর খাবে। তুই চুপ করে একটু দাঁড়িয়ে থাক পিন্টু, মোমবাতি জ্বেলে দিচ্ছি। অলকা, তাড়াতাড়ি একটা মোমবাতি!

বৌদি বলল, যাঃ, মোম যে ফুরিয়ে গেছে। নীলু, তুমি আগে চট করে মোম কিনে দিয়ে যাও তো! ততক্ষণ একটা টর্চ দেব?

মেজমামা বললেন, লাগবে না, লাগবে না! এ যে চমৎকার ব্যাপার! গ্রামে তবু কাছাকাছি হ্যারিকেন বা লণ্ঠনের আলো-টালো দেখা যায়। এমন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার বহুকাল দেখিনি! বা-বা-বা-বা-বা-বা-বা! হে-হে-হে-হে-হে-হে-হে!

আমার মনে হলো আনন্দের চোটে বাথরুমের মধ্যে পিন্টুমামা নাচতে শুরু করেছেন। দেশে ফিরে সব কিছুতেই মজা পাচ্ছেন উনি। এইসব সময়ে বোঝা যায়, আনন্দ বা দুঃখ, বিরক্তি বা মজা, এইসব ব্যাপারগুলিও কত আপেক্ষিক। আলো-ঝলমল দেশগুলো থেকে যারা আসে, তাদের কিছুটা অন্যরকম স্বাদ দেবার জন্যই কলকাতায় এরকম অন্ধকারের ব্যবস্থা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *