অর্ধেক মানবী – ১২

১২

গেটের দু’পাশে দু’জন দারোয়ান বেশ কর্তব্যপরায়ণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

এদের মধ্যে যে আসল দারোয়ান নয়, সেই ছদ্মবেশী সহদেব পালের ব্যবহারই বেশি বেশি দারোয়ানের মতন। সে আমাকে দেখে একটা স্যালুট দিল জুতো ঠুকে। আগের দিন দেখেছি, সে খৈনী খাওয়াও রপ্ত করেছে।

এক নম্বর গোডাউন থেকে বেরিয়ে দু’ নম্বরের দিকে যেতে গিয়ে মিথিলাবাবু থমকে দাঁড়াল। চেয়ে রইল আমার দিকে, কিন্তু কোনো কথা বলল না। আমার সঙ্গে সে আজকাল প্রায় কথাই বলে না। আমার ঘরে তাকে রোজ দু’বার করে অন্তত আসতেই হয়, বিশেষ এক ধরনের কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুঁ-হাঁ করে কাজ সারে।

এই অফিসের কারুর সঙ্গেই আমার এ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠতা হলো না। তার জন্য আমার একা-চোরা স্বভাবটাই দায়ী! আমি যেচে কারুর সঙ্গে আলাপ করতে পারি না। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গও তুলতে পারি না চট করে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলুম দোতলায়। বারান্দাটা যেন বড় বেশি ফাঁকা। সেদিনের পর আর একবারও নীলা এসে এখানে দাঁড়ায়নি। জলাটায় আজও অনেক বক এসেছে। দুটো খুব সুন্দর মাছরাঙা উড়ে গেল পাশাপাশি। খানিকটা দূরে কয়েকজন লোক জলে নেমে কচুরিপানা সাফ করছে। কচুরিপানা নদী-নালা-পুকুরের অনেক ক্ষতি করে ঠিকই, কিন্তু এই বেওয়ারিশ ধরনের জলাটায় যেন কচুরিপানাই মানায়

আমি না এলে এ ঘরটার তালা খোলা হয় না। আজ আমার পনেরো মিনিট লেট। এই প্রথম। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু লজ্জিতভাবে সিগারেট ধরালুম। ঘরের চাবি দারোয়ানদের জিম্মাতেই থাকে। সহদেব নয়, অন্য একজন পুরোনো দারোয়ান চাবি নিয়ে এল। তার পেছনে ছুটতে ছুটতে এল পল্টু। সে রীতিমতন হাঁপাচ্ছে।

দরজা খোলার পর পল্টু বলল, ট্রেন আটকে গেছিল, ওঃ, কী কষ্ট করেই যে আজ এসেছি!

আমি হাজিরা খাতা খোলার পর পল্টু বলল, আপনিও এইমাত্র এসেছেন, আমি দূর থেকে ঢুকতে দেখলুম আপনাকে! আমায় লেট মার্ক করলে আপনার নিজেরটাও করতে হবে!

পল্টু ক্লাস ফোর হলেও আমায় বেশ ধমকে ধমকে কথা বলে।

আমি নিজের নামের পাশে একটা লাল পেন্সিলের দাগ দিয়ে বললুম, তোমায় লেট মার্ক করছি না।

পল্টু তাতেও খুশি হলো না। সে বলল, আজ আমায় স্যার যেতেও হবে একটু তাড়াতাড়ি। আমার মায়ের শরীর ভালো নেই। বড্ড বাড়াবাড়ি।

এখানকার অনেকেই জেনে গেছে যে পল্টু সারা বছর ধরেই বাবা কিংবা মায়ের অসুখের অজুহাত দেয়। এক সপ্তাহ অন্তর এক একজনের। কেউ কেউ বলে, পল্টুর বাবা কিংবা মা কেউ আসলে বেঁচেই নেই।

পল্টু তার হাতের চটের ঝোলা থেকে দুটি বেশ বড় হরলিকসের ভর্তি শিশি বার করে বলল, এ দুটো আমি বাইরে থেকে কিনে এনেছি। নিজের পয়সায়। আপনার এখানে রেখে যাব?

আমি ভুরু কুঁচকে বললুম, এখানে রেখে যাবে কেন?

পল্টু নাকি-নাকি গলায় অভিযোগের সুরে বলল, আমায় বেরোবার সময় তো দারোয়ানরা ধরবে। বলবে, এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার কাছে রাখুন, আপনি তখন টিকিটে লিখে দেবেন।

পল্টুর মতন একজন লোকের দু’খানা হরলিকসের শিশি একসঙ্গে কেনার কোনো যুক্তি আছে কি? বিশেষত এখন মাসের শেষ! এমন কথা শোনা গেছে যে পল্টু এখানকার সাপ্লায়ারদের কিংবা বড় বড় ক্রেতাদের অফিসে বা দোকানে গিয়ে বিভিন্ন জিনিস চায়, বখশিশও দাবি করে। তা সে অফিসের বাইরে যা ইচ্ছে করুক। আমার দেখার দরকার নেই।

আমি কড়া গলায় বললুম, না, ওসব এখানে রাখা চলবে না। দারোয়ানদের দেখিয়ে, যদি ওদের কাছে রেখে দিতে পার তো সেই চেষ্টা করো।

পল্টু গজগজ করতে করতে চলে গেল।

দারোয়ানদের কাছে রাখার কী অসুবিধে, তাও অনুমান করা শক্ত নয়। দারোয়ানরা নির্ঘাৎ শিশি দুটোর উৎস বুঝতে পেরে একটা নিজেরা রেখে দেবে।

আমার আগে অন্য যারা পৌঁছেছে, তারা একে একে নাম সই করতে এল। প্রত্যেকে পাতা উল্টে দেখে গেল, আমি আমার নামের পাশে লাল ঢ্যাঁড়া মেরেছি কিনা।

আজ আমি বিভূতিভূষণের আরণ্যক এনেছি। যতবার ইচ্ছে পড়া যায়, পড়লে মন ভালো হয়ে যায়। আমার এই চাকরিতে বই পড়া নিষিদ্ধ নয়। মাঝে মাঝে একেবারে বসে থাকতে হয় চুপচাপ।

একটু পড়তে গিয়েই মন জুড়ে এল নীলার মুখ। এই নীলা আসল নীলা নয়। কেন যেন মনে হচ্ছে, সেই নীল শাড়ি পড়া মেয়েটি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। আর দেখা পাব না তার। সামান্য একটা ঝড় সহ্য করতে পারিনি আমি।

গতকাল সন্ধেবেলাতেও একবালপুর-খিদিরপুরের সেই খালের ধারে বসেছিলুম অনেকক্ষণ। সেখানে নৌকোটা ছিল না। এক সময় আমার মাথা ব্যথা করছিল খুব। তবু নীলা আসেনি।

হঠাৎ হঠাৎ চমকে জানলার দিকে তাকাই। না, কেউ নেই। জলাভূমির ওপরের আকাশ আজ পরিষ্কার নীল।

দুপুরের দিকে সিঁড়িতে জুতোর ধুপধাপ শব্দ তুলে এসে সহদেব পাল ঢুকল আমার ঘরে। প্রথমে স্যালুট দিয়ে, খুব দুর্বোধ্য হিন্দীতে বেশ জোর গলায় কিছু একটা বলল।

তারপর দরজাটায় ছিটকিনি দিয়ে, জানলার পর্দাগুলো টেনে খুলে ফেলল মাথার চুল, গোঁফ।

একটা চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে বলল, উফ, এই রোদ্দুরে আর পারা যায় না! আজ একেবারে ডাকাতের মতন রোদ উঠেছে। আর কয়েকটা দিন কেটে গেলে বাঁচি।

আমি বললুম, আপনি কবে ট্রান্সফার হচ্ছেন আবার?

সহদেব পাল বলল, দারোয়ান সেজে থাকা কি পোষায়! আর চারদিন পরেই ছুটিতে যাচ্ছি কালিম্পং। সেখান থেকে একেবারে ফ্রেস হয়ে এসে সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে জয়েন করব কলকাতার অফিসে।

–বাঃ, কালিম্পং খুব ভালো জায়গা। ওখান থেকে লাভা ঘুরে আসবেন। লুলেগাঁও-তে ভালো বাংলো আছে।

—আরে ধুর মশাই! আমি অত বেড়াবার লাইনে নেই। কালিম্পং-এ কোম্পানির রেস্ট হাউস আছে, সেখানে গিয়ে বডি ফেলব আর শুধু ঘুমোবো। বেস্পতিবার আগুনটা ঠিকমতন লাগাতে পারলেই কোম্পানি আমাকে কালিম্পং ট্রিপটা রিওয়ার্ড দেবে।

—আগুন লাগাতেই হবে?

–সে নিয়ে আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। গোডাউনের তিনজনকে কনফিডেন্সে নিতেই হয়েছে। এতগুলো ডেট এক্সপায়ার হয়ে যাওয়া ওষুধ, তার একটা হিল্লে করতে হবে না? ইনসিওরেন্স থেকে যারা ইন্সপেকশানে আসবে, তাদেরও ম্যানেজ করে ফেলেছি। তবু আগুনটা কনভিনসিং হওয়া দরকার। যাতে খবরের কাগজে ওঠে।

—আপনি তো খুব করিৎকর্মা লোক!

–কোম্পানি কি আর এমনি এমনি রেখেছে! শুনুন মশাই, যেজন্য আপনার কাছে এলুম। আমি সব খবর রাখি তো, এখানকার সব স্টাফ যে আপনার ওপর খুব খাপচুরিয়াস হয়ে আছে!

—কেন? আমি কী দোষ করেছি? কারুর ব্যবহারেও তো বোঝা যায় না।

—ব্যবহারে বুঝতে দেবে কেন? আপনার নামে সবাই মিলে পিটিশন করবে শোনা যাচ্ছে। আপনি নাকি কয়েকজনের নামে চুকলি কেটেছেন বড় সাহেবদের কাছে!

–সে আবার কি? চুকলি কাটব কেন?

–ঐ যে গ্যাডগিল, সে আপনার এখানে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে গেল সেদিন, আপনার সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করেছে, আসল ইন্‌সপেকশান তো প্ৰায় কিছুই করল না। কিন্তু সে আজ গোডাউন স্টাফদের মধ্য থেকে তিনজনকে ডেকে পাঠিয়েছে তার হোটেলে। অটোমেটিক্যালি আপনার ওপর সন্দেহ পড়বেই। আপনি তাদের নামে কিছু কমপ্লেইন করেছেন, তাই গ্যাডগিল ডেকেছে। নইলে গ্যাডগিলের তো ঐসব স্টাফদের নাম জানারই কথা নয়!

—আমি কমপ্লেইন করলেই বা গ্যাডগিল শুনবেন কেন? আমি তো একটা চুনোপুঁটি!

—আপনি গ্যাডগিলের মেয়েকে বিয়ে করছেন। গ্যাডগিল আপনার মতনই একজন ওয়াচম্যান ছিলেন, তাঁকে দেখে কোম্পানির মালিকের পছন্দ হয়ে গিয়েছিল, মালিকের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়াতেই গ্যাডগিলের এখন এত রবরবা।

—এ গল্প আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো তখন এ ঘরে ছিলেন না!

—এসব কথা হাওয়াতে ভেসে বেড়ায়—বুঝলেন, হাওয়াতে ভাসে! স্টোরের লোকরা এখন এই আলোচনাই করছে।

—আপনি স্টোরের লোকদের গিয়ে বলুন, ওরা যেন আগে গ্যাডগিলের আর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করে!

একটু থমকে গিয়ে, পরে হেসে ফেলে সহদেব বলল, ও, এই ব্যাপার! গ্যাডগিলের মেয়ে নেই? সে যাই হোক, আপনার ওপর সবাই কিন্তু খাপ্পা হয়ে আছে বেশ!

—আমি কী দোষ করেছি জানি না। আপনি বলছেন সবাই খাপ্পা, তার মানে কি আপনিও, সহদেববাবু?

-তা খানিকটা বলতে পারেন। আপনি আমার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করলেন না। আর মাত্র চারদিন আছে, আমি খালি হাতে চলে যাব?

—আপনি যে বললেন, কোম্পানি আপনাকে রিওয়ার্ড দেবে?

—সে কোম্পানি যা দেবার দেবে। কিন্তু এখান থেকে কিছু পাব না! এ জায়গা যে মশাই সোনার খনি! শুনুন, নীললোহিতবাবু, আপনি আর আমি কোম্পানির কলকাতার মেইন অফিসের লোক। আমাদের রাখা হয়েছে করাপশান চেক করবার জন্য। ঠিক তো? বেশ, আমরা কোম্পানির স্বার্থ নিশ্চয়ই দেখব। বাট, আপটু অ্যান এক্সটেণ্ট! তা বলে কি আমরা নিজেদের স্বার্থ একেবারেই দেখব না?

—নিজেদের স্বার্থ? শুধু স্বার্থ বললেই বোধহয় চলে!

—আর ধুর মশাই! আপনি আবার এর মধ্যে ব্যাকরণ-ফ্যাকরণ টেনে আনছেন কেন? বলি, বাইরের সাপ্লায়াররা নানা রকম গিফ্‌ট নিয়ে আসে। তাড়াতাড়ি কাজ আদায় করতে গেলে এগুলো করতে হয়। সারা দেশেই চলে। কার্টন কার্টন ফরেন সিগারেট, হুইস্কি, লাইফ সেভিং ড্রাগ, হরলিক্স, এটা, সেটা! এগুলো যদি তারা দিতে চায়, লোকে নেবে না? জলে ফেলে দেবে?

আমি চমকে উঠে বললুম, না, না, জলে ফেলে দেবে কেন? এরকম সব দামি জিনিস?

সহদেব চকচকে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সব খবর রাখি। দ্যাট ইজ মাই ডিউটি! আপনি ফেলে দিয়েছেন। আপনি ফেলে দিলে অন্যরাও খোলা মনে কিছু নিতে পারে না।

–কেন, আমি তো কারুকে বাধা দিই না! নিক না, যার যা খুশি!

—আপনি যদি কিছু না নেন, তা হলেই আপনি সাসপেক্ট। আপনি চুকলিখোর। আমিও কিছু নিতে পারছি না। আমরা এক পালকের পাখি। আপনি যদি সাধু সেজে থাকেন, তা হলে আমিও ফাঁক পড়ে যাই। আমি তো আর দারোয়ানদের কাছে ভাগ বসাতে পারি না। দ্যাট ইজ বিনিথ মাই ডিগনিটি!

আমি সহদেব পালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম। আর কোনো কথা আমার মুখে এল না।

সহদেব আমার চোখের সামনে শাসানির আঙুল তুলে বলল, আর একটা কথা। আজকাল শুধু মাসমাইনের টাকায় ক’জনের সংসার চলে? কিছু উপরি দরকার সকলেরই। এমনকি রাজীব গান্ধীরও। শুধু শুধু এখানকার গরিব বেচারাদের ওপর চোখ রাঙিয়ে কী হবে? আমরা কোম্পানির স্বার্থ দেখছি ঠিকই, কিন্তু বাইরের সাপ্লায়াররা শুধু যদি তাড়াতাড়ি কাজ আদায় করার জন্য দু’ হাজার পাঁচ হাজার দিতে রাজি থাকে, তাহলে সেটা নিতে আপত্তি কিসের? কোম্পানির টাকা নয়, কোম্পানির কোনো ক্ষতিও হচ্ছে না, দিচ্ছে বাইরের পার্টি! সেটা সবাই ভাগ করে নিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? কী, উত্তর দিচ্ছেন না যে? বলুন বলুন, চুপ করে রইলেন কেন? আমি মশাই খোলাখুলি কথা বলি। আপনার কি জবাব আছে বলুন।

আমি আস্তে আস্তে উত্তর দিলুম, মহাভারত শুদ্ধ রাখার দায়িত্ব আসলে তো কেউ দেয়নি!

—তবে? আপনি এত আলগা আলগা ভাব করে থাকছেন কেন? আপনি একটা শেয়ার নিন, তা হলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। অফিসে কাজ করতে গেলে সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। অন্য সবাই এক রকম আর আপনি আলাদা সাধু সেজে থাকবেন, এ কখনো হয়? একবার চুঁচড়োর একটা ফ্যাক্টরিতে কী হয়েছিল জানেন? সেখানে আপনার মতন …

সহদেব পালের কথা শেষ হলো না। গেটের কাছে একটা ট্রাক ঢোকার আওয়াজ পাওয়া গেল। সহদেব উঠে গিয়ে ওদিককার জানলার পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে বলল, বাইরের একটা পার্টি ডেলিভারি নিতে এসেছে। বড় পার্টি। আমাকে তো তা হলে যেতে হচ্ছে এখন!

দরজার ছিটকিনি খুলে সহদেব বাইরে পা বাড়াতেই আমি তাকে ডেকে বললুম, ও সহদেববাবু, আপনি আপনার চুল আর গোঁফ ফেলে যাচ্ছেন যে!

সহদেব চমকে ঘুরে দাঁড়াল। তার মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এত স্মার্ট মানুষটা বিহ্বলভাবে বলল, অ্যাঁ! চুল আর গোঁফ…সর্বনাশ হয়ে যেত, ধরা পড়ে যেতুম। সব প্ল্যান বানচাল হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে।

টেবিল থেকে নকল জিনিস দুটো তুলে সে খুব সাবধানে পরে নিল। তারপর আমার দিকে একটা বিচিত্র দৃষ্টি দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে লাগলুম।

মিঃ গ্যাডগিল আমার পিঠ চাপড়ে গিয়ে আমার দারুণ ক্ষতি করে গেছেন। কেন, অন্য আরও কত লোকেরই তো পিঠ আছে, তিনি সেগুলো চাপড়াতে পারতেন না? উনি একসময় ওয়াচম্যানের কাজ করতেন বলে এই ঘরে এসে ওঁর স্মৃতি উথলে উঠেছিল, সেটা কি আমার দোষ?

আমাকে বলে কিনা চুকলিখোর! এরকম খারাপ কথা একজন মানুষ সম্পর্কে অন্য কেউ এমন অবলীলাক্রমে বলতে পারে? গ্যাডগিল এখানে ঘুরে যাবার পর কয়েকদিনের জন্য শিলং গিয়েছিলেন, আবার ফিরে এসে গ্র্যাণ্ড হোটেলে উঠেছেন। এইটুকু আমি শুনেছি মাত্র। আর তাঁকে চোখে দেখিনি। তিনি যদি এখানকার কয়েকজনকে ডেকে পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই সেদিন হাজিরাখাতা উল্টেপাল্টে দেখে নিজেই কিছু সন্দেহ করেছেন।

আমি এই ক’দিন আর কারুর টিকিটে দাগ দিইনি। আসা-যাওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করি না, তবু আমার ওপরে রাগ কেন এদের? আমি জিনিসপত্র কিছু নিই না ঠিকই। আমি নির্লোভ, সাধুপুরুষ নই। কিন্তু যখনই এখানকার কেউ কেউ আমাকে এটা-সেটা দিতে আসে, তখনই মনে হয়, এরা আমাকে একটা ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। আমি যে আসলে ভীতু, সেটা এরা বোঝে না।

যে-সব পার্টি এখান থেকে ওষুধ ডেলিভারি নিতে আসে, তারা নানারকম উপহারদ্রব্য নিয়ে আসে, এটা আমি দেখেছি। টাকাপয়সা কত লেনদেন হয় তা আমি জানি না। পার্টিগুলোর এখানকার কর্মচারিদের খাতির করার কারণটা অতি সরল। অতি প্রয়োজনীয় কোনো ওষুধ কেউ নিতে এল, এখানকার মিথিলাবাবুর মতন কোনো স্টোর-ইনচার্জ অম্লান বদনে বলে দেবে, ঐ জিনিস তো স্টকে নেই। আজ পাবেন না, পরশু আসবেন। দু’ দিন দেরিতে অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তখন হুইস্কির বোতল, বিলিতি সিগারেট আরও নানান জিনিস দিলেই দেখা যায় স্টকে আছে যথেষ্টই। এটাই রেওয়াজ হয়ে গেছে। সবসময় স্টকে নেই বলতেও হয় না, আগে উপহার, তারপর ডেলিভারি। অনেক কোম্পানি অফিসিয়াল গিফট হিসেবেই ঘড়ি, রেডিও, লাইটার ইত্যাদি দেয়।

বিনা পয়সায় এসব জিনিস পেতে সবাই ভালোবাসে। উপহার পেতে কার না লোভ হয়! এই যে মেজমামার আনা উপহার তা নিয়ে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, আমার বৌদি, মা, সবাই লোভ করেনি? আমিও শুধু লাইটার পেয়ে নিরাশ হইনি? মনে মনে আমার ইচ্ছে ছিল না আরও কিছু পাওয়ার?

এই গুদামে আগে কোনো ওয়াচম্যান ছিল না। নিজেরাই কাজ চালাত। তাতে তো কোম্পানি ফেল পড়েনি, সব কিছুই তো ঠিকঠাক চলছিল। আমাকে এখানে এনে বসানোটা এখানকার কেউ পছন্দ করছে না! আমি যেন একটা ফোঁপরদালাল!

লাখ লাখ বেকারের মধ্যে একজন কেউ চাকরি পেয়ে গেলে অন্য বেকাররা ক্ষুব্ধ হতে পারে। আবার দেখা যাচ্ছে, যারা চাকরি করতে করতে ঝানু হয়ে গেছে, তারাও নতুন কেউ চাকরিতে জয়েন করলে তাকে সহজে মেনে নিতে চায় না। এরা আমার পোস্টটাকেই অপ্রয়োজনীয় মনে করছে।

নিজের মামার কাছ থেকে কিছু জিনিস নেওয়া আর অচেনা কোনো পার্টির কাছ থেকে জিনিষপত্র নেওয়া কি এক? নিজের পয়সা দিয়ে রোজ সিগারেট কিনতে হয়, এখানে ফাইভ ফিফটি ফাইভের ছড়াছড়ি, এক এক সময় কি আমার ইচ্ছে হয় না দু’-এক প্যাকেট নিই?

কিন্তু ভয় হয়। সিগারেট নিলেই মদ, ঘড়ি, রেডিও নিতে হবে। হরলিক্স, ওষুধ, কেক-পেস্ট্রি। তারপর টাকা। সেটাই বা অস্বীকার করব কী করে? এইসব নিলেই ওদের দলে ভিড়ে যেতে হবে। চাকরির দড়ি আমাকে বেঁধে ফেলবে আষ্টেপৃষ্ঠে। আমাকে আর পালাতে দেবে না।

নীলার সঙ্গে আর কোনোদিন যেতে পারব না দিকশূন্যপুরে? খুঁজে পাব না সেই পথ?

খানিক বাদে সহদেব পাল আবার ফিরে এল।

এবার আর গোঁফ-চুল খুলল না, আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। অস্বস্তিকর নীরবতা।

তারপর গম্ভীরভাবে বলল, নীললোহিতবাবু, তখন আপনি আমার চুল আর গোঁফের কথা মনে করিয়ে দিয়ে অশেষ উপকার করেছেন। এমন একটা পার্টি এসেছিল, যারা আমার আসল চেহারাটা চেনে, যদি দেখত আমি দারোয়ানের পোশাকে আছি, তাহলে…। আপনি তো এটা না করলেও পারতেন!

আমি চুপ করে রইলুম। আমি কি এসব ভেবেছি নাকি? চোখে পড়েছে, তাই বলেছি!

সহদেব বলল, এজন্য আপনারও একটা উপকার আমার করা উচিত। বেশি সময় নেই, আপনাকে একটা খবর জানিয়ে যাচ্ছি শুধু। মিথিলাবাবু আর কয়েকজন মিলে ঠিক করেছে, আপনাকে একটু রগড়াবে। আপনি মিথিলাকে ওর দ্বিতীয় বউয়ের সঙ্গে দুপুরবেলা দেখা করতে যেতে দেন না, সেইজন্য ওর খুব রাগ।

-আমি যেতে দেব না কেন? গেলেই পারেন!

—আপনি খাতায় রেকর্ড করেছেন!

—উনি তো আমায় আগে কিছু বলেননি। রগড়াবে মানে কী? মারবে? মেরে ফেলবে?

—খুন? না, না, খুনটুন করবে না। আপনাকে মারলে সেটা তো আর পলিটিক্যাল মার্ডার বলে চালানো যাবে না! বউ খুন ছাড়া আজকাল আর কেউ নন-পলিটিক্যাল মার্ডারের ঝঞ্ঝাটে যেতে চায় না। যতদূর মনে হচ্ছে, যেদিন আগুন লাগান হবে, সেদিন আপনাকে একটু ঝলসে দেবে!

—একটু?

–একটু না বেশি, সেটা ঠিক বলা যায় না এখন

—আমি একটুও আগুনের ছ্যাকা সহ্য করতে পারি না। আমার ভীষণ লাগে!

—আগুনের ছ্যাঁকায় সবারই লাগে। একবার চুঁচড়োর এক কারখানায় আপনারই মতন একজনকে একটুখানি রগড়াতে গিয়ে বেশি হয়ে গিয়েছিল। সে লোকটার একটা চোখই কানা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে, এই ঘরের খাতাপত্তর সব পোড়াবে, সেই সঙ্গে আপনাকেও…আপনি সাবধানে থাকবেন…আমি চেষ্টা করব আপনাকে বাঁচাবার, তবু বলা তো যায় না, দৈবের কথা কে বলতে পারে? আমি যদি এখন…।

আমি টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে চোখ বুজলুম। এরা কি আমাকে পয়লা তারিখ পর্যন্তও কাজ করতে দেবে না? অন্তত এক মাসের মাইনেটাও পাব না? মা, বৌদি কত আশা করে আছে, মাসের প্রথমে আমি তাদের হাতে তিন হাজার টাকা তুলে দেব! মেজমামা লোকজন খাওয়াবার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন…।

এরা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তারপর ভেতরে পেট্রোল ছুঁড়ে আগুন লাগাবে এই ঘরে। চিকেন রোস্টের মতন ঝলসাবে আমাকে, আমি আর্তনাদ করব, দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা মারব জ্বলন্ত শরীরে, বাইরে থেকে মিথিলা বলবে, আর একটু, আর একটু পুড়ুক, এখন দরজা খুলো না, পল্টু…।

আমি নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলুম, মাত্র এক মাসের জন্য কষ্ট করো, নীললোহিত। এক মাস কষ্ট করে মা-দাদা-বৌদি-মেজমামাকে খুশি করো। তারপরেই দেশান্তরী হব। কিন্তু সেই এক মাসও আমাকে সহ্য করতে পারল না এই লোকগুলো? বৌদির কাছে ধার, সিগারেট-দোকানদারের কাছে ধার, বাজারে আলুওয়ালার কাছে ধার, সেসব কিছুই শোধ করা যাবে না!

আমার পিঠে কার হাতের ছোঁয়া লাগতেই আমি কেঁপে উঠলাম। মুখ ফিরিয়ে দেখি, নীলা।

নীলা বলল, শিগগির ওঠ, দ্যাখো, ঝড় আসছে!

আমি বললুম, ঝড়?

নীলা বলল, দ্যাখো, আকাশ দ্যাখো!

আমি বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সকালবেলা আকাশ নীল ছিল, এখন সত্যিই কালো হয়ে এসেছে। ব্যস্তভাবে ওড়াউড়ি করছে একঝাঁক চিল।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, তুমি আমাকে ত্যাগ করেছিলে?

নীলা বলল, আমি তোমার কাছে কিছুতেই আসতে পারছিলুম না। বার বার বাধা পড়ছিল।

-কিসের বাধা?

—জানি না। আমার শরীর কাচ হয়ে যাচ্ছিল। তুমি আমাকে সেদিন ছেড়ে চলে গেলে!

—ঝড়ের জন্য ধরে রাখতে পারিনি। আর কি আমি কোনোদিন তোমার দিকশূন্যপুরে যেতে পারব না?

–সেই জন্যই তো আমি এসেছি। এক্ষুনি চলো।

—আবার ঝড় উঠছে। তোমাকে দেখতে পাব না।

—ঝড়ের আগেই পৌঁছে যেতে হবে। আজ আমার হাত কিছুতেই ছেড়ো না তুমি!

উঠে দাঁড়িয়ে নীলার হাত চেপে ধরে বললুম, ছাড়ব না। চলো।

সিঁড়িতে পা দিয়ে আবার বললুম, গেট দিয়ে বেরুতে গেলে তোমাকে সবাই দেখবে। দেখুক। আমি গ্রাহ্য করি না।

নীলা বলল, এই পাঁচিলের গায়ে একটা ছোট্ট দরজা আছে, জলার দিকে।—তাই নাকি? আমি তো আগে দেখিনি!

–আমি তো সেই দরজা দিয়েই এলুম। খোলা রেখে এসেছি।

তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে আমরা দেয়াল ঘেঁষে ছুটতে লাগলুম। সত্যিই একটা ছোট দরজা রয়েছে। সেটা দিয়ে বাইরে বেরুতেই জলাভূমি। বড় বড় ঘাস, প্যাচপেচে কাদা। আসন্ন বৃষ্টির সম্ভাবনায় ব্যাঙ ডাকতে শুরু করেছে। দূরে যে লোকগুলো কচুরিপানা সাফ করছিল, তারা এখন নেই।

—নীলা, তোমার পায়ে কাদা লাগছে। এখানে সাপখোপ থাকতে পারে।

–তুমি শুধু আমার হাত ধরে থাকো।

—এখান দিয়ে আমরা যাব কী করে? এখানে তো নৌকো নেই!

—আছে, নৌকো আছে, আর একটু চলো।

—কিন্তু এই দমদম থেকে আমরা দিকশূন্যপুরে যাব কী করে? অনেক দূর না?

—যে-কোনো জায়গা দিয়েই দিকশূন্যপুর পৌঁছনো যায়। দিকশূন্যপুরকে কাছেও আনা যায়, তাই না?

—এটা আমি জানতুম না।

জলের পাশ দিয়ে দিয়ে, বড় বড় বিন্নি ঘাস আর নলখাগড়ার ঝোপ ভেদ করে যেতে যেতে এক জায়গায় দেখলুম, একটা লোক জলে ছিপ ফেলে চুপ করে বসে আছে। আমাদের দেখে সে চমকে উঠল।

নীলা তাকে জিজ্ঞেস করল, ভাই, এখানে একটা নৌকো ছিল না? লোকটি বলল, হ্যাঁ, দিদি, ছিল তো। ঐ যে দেখুন, ভেসে গিয়ে একটা দামে আটকে গেছে।

নীলা আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি জলে নেমে নৌকোটা নিয়ে আসতে পারবে?

আমি বললুম, নিশ্চয়ই।

লোকটি বলল, আপনি জলে নামছেন কেন? আমার গা ভিজে। আমি এনে দিচ্ছি।

সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে গেল, নিয়ে এল নৌকোটা আমাদের কাছে। নীলা বলল, আপনি খুব ভালো লোক। দ্যাখো নীললোহিত, পৃথিবীতে এখনও কত ভালো মানুষ আছে। এমনি এমনি অন্যের জন্য নৌকো এনে দেয়।

লোকটি লজ্জা পেয়ে বলল, আপনারা যাবেন তো উঠে পড়ুন। ঝড় এসে যাবে।

আমি সাবধানে নীলাকে বসালুম নৌকোর মাঝখানে। একটা বৈঠা তুলে নিয়ে লোকটিকে বললুম, তুমি আমাদের উপকার করলে, তোমার সব কিছু ভালো হোক।

খানিকটা যেতে না যেতেই ঝড় উঠল।

আমার দু’ হাতে বৈঠা। আমি বললুম, নীলা, তুমি আরও কাছে সরে এসো, আমার হাঁটু চেপে ধরে থাকো। নৌকো উল্টোলেও ভয় নেই।

নীলা আমার বুকের ওপর এসে, দু’ হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে এবার কিছুতেই ছাড়ব না।

আমি পেছন ফিরে একবার আমাদের গোডাউনটার দিকে তাকালুম।

ঝড়ের জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। মনে হলো, ওখানে আসলে কোনো গুদাম ছিল না। ওটা অলীক। আমার চাকরিটাও অলীক। এই কচুরিপানায় ভর্তি জলা, এই নৌকো, এই ঝড়, আমার বুকের ওপর নীলা, এই কয়েকটি শুধু বাস্তব।

ঝড়ের ধাক্কায় নৌকোটা দুলছে। কিন্তু নৌকো চালানো সম্পর্কে আমার প্রবল আত্মবিশ্বাস আছে। আমি সুন্দরবনের দুর্দান্ত নদীতেও ঝড়ের মধ্যে নৌকো চালিয়েছি।

বাতাসও এখন কালো। কোনোদিকেই কিছু দেখা যায় না। সেদিনের কুয়াশার মতন। তাহলে এবার দিকশূন্যপুরে ঠিকই পৌঁছনো যাবে।

আমার বুকের ওপর মাথা রেখে যেন নীলা সেই কথাটা শুনতে পেল। মুখ তুলে বলল, এই তো আমরা এসে গেছি।

একবার বিদ্যুৎচমকে চোখে পড়ল, কাছেই একটা বেশ তকতকে ঘটি বাঁধানো। নৌকোটা ভেড়ালুম সেখানে।

নীলা উঠে দাঁড়াতেই নৌকোটা দুলে উঠল, আমি বললুম, সাবধান!

আমি আগে লাফিয়ে নেমে পড়লুম মাটিতে। পাকা মাঝিদের মতন নৌকোটা টেনে পাড়ের ওপর খানিকটা তুলে এনে তারপর নীলার হাত ধরে নিয়ে এলুম ওপরে।

ঝড় কমেছে, এবার বৃষ্টি।

বৃষ্টির মধ্যে তবু কিছু কিছু দেখা যায়। গালিচার মতন সবুজ ঘাস, ছোট ছোট অচেনা গাছ। পায়ে চলা রাস্তায় নুড়ি ছড়ান। নীলা ভিজে একেবারে শপশপে হয়ে গেছে। আমি নিজের ভেজা শরীর দেখতে পাচ্ছি না, নীলাকেই দেখছি। মোটেই হেমেন মজুমদারের ছবির মতন নয় সে, তার নীল শাড়ি ভেদ করে শরীর ফুটে ওঠেনি, মনে হচ্ছে তার কোনো শাড়িই নেই, তার অস্তিত্বটাই নীল। প্রাচীন গ্রীস ভাস্করদের বানানো একটা নীল মূর্তি।

একটা বড় গাছের দিকে হাত দেখিয়ে নীলা বলল, এটা চিনতে পার?

আমি গাছটার গায়ে হাত রেখে কোনো চেনা সাড়া পেলুম না।

নীলা বলল, এটা সেদিনের সেই চাঁপা গাছটা। উর্বশী চাঁপা। এখান থেকে তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে।

আমি নীলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললুম, তোমাকে আর এক মিনিটের জন্যও আমি ছেড়ে থাকতে পারব না।

নীলা বলল, তোমাকে ছেড়ে থাকলে আমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাই। আমার বড় কষ্ট হয়। তুমি আর ফিরে যেও না, নীললোহিত।

আমি বললুম, কোথায় যাব? আর সব কিছুই মিথ্যে হয়ে গেছে। কলকাতা শহরটাই তো অবাস্তব। আমাকে এখানে তোমার কাছে থাকতে দেবে?

নীলা বলল, তুমি আমার কাছে থাক। আমি তোমাকে রান্না করে খাওয়াব। আমরা খুব ভালোবাসব। এই গাছটা ধরে ঝাঁকাও তো। যদি দু’-একটা ফুল পড়ে, ঘরে নিয়ে গিয়ে সাজাব।

—আমার গাছের ফুল দরকার নেই। সেদিন তোমার মুখে আমি চাঁপা ফুলের গন্ধ পেয়েছিলাম। নীলা, সত্যি তুমি আকাশ থেকে শুধু আমারই জন্য এসেছ এই পৃথিবীতে? গ্রহ-গ্রহান্তর পেরিয়ে, মহাশূন্যের কোনো এক বিন্দু থেকে ….

–তুমিই আমাকে এনেছ। অন্য কেউ তো আমায় আনেনি।

—আমার চিন্তার তরঙ্গ অতদূর পৌঁছয়? সেই জন্যই আমার মাথায় চিড়িক চিড়িক করে ব্যথা হতো। অন্য কোনো তরঙ্গের সাড়া পেতুম? কিন্তু তোমার এই রূপ, এটা তোমারই তো নিজস্ব? আমি তো এ রূপ কল্পনা করিনি!

—আমার কোনো রূপই নেই, নীললোহিত!

আমি নীলার চিবুকে, বুকে হাত বুলিয়ে বললুম, এই যে তোমার শরীর?

নীলা বলল, এই সবই তোমার!

আমি বললুম, নীলা, কী করে আমার এত সৌভাগ্য হলো? কী এমন ভালো কাজ করেছি জীবনে?

নীলা বলল, এটা আমারই সৌভাগ্য। তুমি আমার উপহার। চলো, আর বৃষ্টিতে ভেজা যাচ্ছে না। আমার ঘরে গিয়ে বসি।

-এখানে তোমার ঘর আছে?

–বাঃ, ঘর থাকবে না? তোমার সেই দিকশূন্যপুরে বন্দনাদি, কৃষ্ণা, ওদের নিজস্ব ঘর ছিল না? কতরকম ফুল দিয়ে আমার ঘর সাজাই। সেদিন তোমাকে একটা মজার জিনিস দেখাব বলেছিলুম। এবার সেটা দেখবে আমার ঘরে।

দুই লঘু বালক-বালিকার মতন হাত ধরে ছুটতে লাগলুম আমরা।

বৃষ্টির জন্য অন্য বাড়িঘর কিছু চোখে পড়ছে না। কিন্তু সরু পথটা আমাদের নিয়ে এল জলের ধারে একটি বাড়ির কাছে। একটিই মাত্র ঘর, পাথরের দেওয়াল, ওপরে খড়ের ছাউনি। সামনে একচিলতে বারান্দা।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টির ছাঁটে পায়ের কাদা ধুয়ে নিলুম আগে। নীলা একটা তোয়ালে এনে বলল, ভালো করে মাথা মুছে নাও। এখন আমরা চা খাব।

ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়েই বুকে যেন বিশাল একটা হাতুড়ির ঘা লাগল।

দূরের দেওয়ালের দিকে, একটা বেতের চেয়ারে, আমার দিকে পেছন ফিরে বসে আছে একজন পুরুষ।

এক লহমার জন্য সেই নিথর মানুষটিকে মনে হয়েছিল একটা পাথরের মূর্তি, তারপরই বোঝা গেল, না, মানুষ। পেছন ফিরে আছে বলে মুখের একটা পাশ শুধু দেখতে পাচ্ছি, মনে হয়, আমারই কাছাকাছি বয়েসের কোনো যুবক, প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট পরা, পায়ে চটি, এক হাতের ওপর চিবুকটা রাখা।

নীলা তা হলে একা থাকে না? তার একজন পুরুষ সঙ্গী আছে? শুধু আমারই জন্য সে শূন্য থেকে নেমে এসেছে বলেছিল, তা আসলে সত্যি নয়? এই ছোকরাটি ওর বডিগার্ড? এর সঙ্গে একঘরে থাকে? আমার প্রতি যে এত ভালোবাসা, তা আসলে ছলনা? কিংবা অন্য কোনো জগৎ থেকে এসে এই মেয়েটি আমার ওপর কোনো এক্সপেরিমেন্ট করছে?

ঈর্ষায়, রাগে বুকটা ফেটে যেতে চাইছে। আর সব কিছুই আমি ছাড়তে পারতুম, কিন্তু নীলাকেও ছাড়তে হবে? তা হলে যে আমার কিছুই রইল না।

নীলা আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে খেলা করবার জন্য?

এই যুবকের হাতে নীলাকে সঁপে দেবার বদলে নীলাকে ধ্বংস করে দেওয়াও ভালো?

নীলা জিজ্ঞেস করল, ওকে চিনতে পারছ?

আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না। নীলা আমাকে একটা মজার জিনিস দেখাবে বলেছিল। একি নিষ্ঠুর কৌতুক ওর

নীলা বেতের চেয়ারটির কাছে গিয়ে যুবকটির কাঁধে হাত দিয়ে খুব আদর করা গলায় বলল, এই, মুখ ফেরাও! দ্যাখ, কে এসেছে!

আমার ইচ্ছে হলো ছুটে চলে যেতে। কিন্তু দুঃখের চেয়ে রাগটা প্রবল হয়ে উঠছে, সব কিছু ভেঙে না দিয়ে আমি যেতে পারব না।

যুবকটি মুখ ফিরিয়ে বলল, ও, আপনি? নমস্কার!

আমি তার প্রতি উল্টে নমস্কার জানালুম না।

নীলা জিজ্ঞেস করল, তুমি এখনও চিনতে পারছ না একে?

আমি উত্তর দিলুম না তবু। চিনতে পারিনি, ওকে আমি চিনতে চাই—ও না!

নীলা বলল, তুমি আশ্চর্য মানুষ তো! তুমি একে চিনতে পারছ না, আমার রূপ কেমন হবে তা তুমি জানতে না, তুমি বড্ড ভুলো-মনা, নীললোহিত!

দেওয়াল থেকে একটা আয়না খুলে এনে আমার মুখের সামনে ধরে বলল, এবার নিজেকে দ্যাখো, তারপর ওকে দ্যাখো!

এবার আমি ভূত দেখার মতন কেঁপে উঠলুম। যুবকটিকে হুবহু আমার মতন দেখতে। জামাটা অন্য রকম, চুল আঁচড়ানোটা আলাদা, তা ছাড়া আর কোনো তফাত নেই! ঠিক যেন আমার যমজ ভাই। এ পৃথিবীতে আমার যমজ কেউ নেই, তা আমি খুব ভালোই জানি। অন্য কোথাও ছিল?

নীলা বলল, ওকে আমি তৈরি করেছি। তুমি যখন কাছে থাক না, তোমাকে যখন পাই না, তখন আমার খুব কষ্ট হয়। তাই একটু একটু করে বানিয়েছি ওকে। তুমি যেমন আমাকে তৈরি করেছ, তেমনি আমিও তৈরি করেছি তোমাকে!

এতক্ষণ পরে আমি বললুম, সত্যি? নীলা, তুমি যা বললে, তা সত্যি?

নীলা বলল, কেন সত্যি হবে না! ঠিক তোমার মতন হয়নি? এই তিনদিন দেখা পাইনি তোমার, এই তিনদিনে ওকে সম্পূর্ণ করেছি। আজই ও হাঁটতে শিখেছে। দেখবে? এই, তুমি উঠে একটু হাঁটো তো!

দ্বিতীয় নীললোহিত উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটল কয়েক পা। প্রথমে বাচ্চাদের মতন একটু টলে গেলেও সামলে নিয়ে হেসে বলল, ঠিক পেরে যাব!

ওর গলার আওয়াজ অবিকল আমার মতন!

নীলা বলল, ও কিন্তু ভুলো-মনা নয়। ওকে যা শেখাই সব মনে রাখে।

আমি অভিভূতের মতন জিজ্ঞেস করলুম, আমরা দুজনে এখানে থাকব?

নীলা বলল, না, তা কি হয়! তুমি এসে গেছ, তুমি আর ফিরে যাবে না তো?

আমি বললুম, না, নীলা, আমি ফিরে যাব না। আমি তোমার কাছে থাকতেই এসেছি। কিন্তু ও রাগ করবে না তো?

নীলা আর দ্বিতীয় নীললোহিত একসঙ্গে হাসল।

নীলা বলল, ও রাগ করবে কেন? ও তোমার জায়গায় ফিরে যাবে। ও সব জানে। ওকে কেউ বাজারে ঠকাতে পারবে না। ওকে কেউ অফিসে অপমান করতে পারবে না। কেউ ওকে আগুনে ঝলসে মারতে পারবে না। ও অপরাজেয়।

দ্বিতীয় নীললোহিত একটা হাত তুলে, ভুরু নাচিয়ে হেসে বলল, আমি সব জানি। আমি সব পারব। এখন যাব?

আমি তবু অবিশ্বাসের সুরে বললুম, ও রাস্তা চিনে যেতে পারবে?

দ্বিতীয় নীললোহিত বলল, রাস্তা চেনা তো খুব সহজ। ঝড় থেমে গেছে, বৃষ্টিও নেই।

নীলা তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, যাও, তাহলে এগিয়ে পড়, আমি মাঝে মাঝে গিয়ে তোমাকে দেখে আসব।

দ্বিতীয় নীললোহিত নেমে পড়ল রাস্তায়, আমি আর নীলা এসে দাঁড়ালুম সরু বারান্দায়।

সে বেশ সাবলীলভাবে হেঁটে যাচ্ছে। একবার মুখ ফিরিয়ে আমাদের দিকে হাত তুলল। তারপর গতি বাড়িয়ে দিল।

অলীক শহর, অলীক চাকরি, অলীক সংসারের দিকে যাচ্ছে একজন অলীক মানুষ। আমার মতন চেহারা হলেও ও আমার মতন নয়, ও সব কিছু সামলাতে পারবে।

আমি আর নীলা বারান্দায় হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রইলুম চিরকালের বাস্তব সত্য হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *