অর্ধেক মানবী – ৪

পার্টি অফিসটায় নতুন রং করা হয়েছে। কাছে গেলেই গন্ধ পাওয়া যায়। কলকাতার অন্যান্য বাড়ির সঙ্গে এই বাড়িটার একটা বিশেষ তফাৎ এই যে, এর দেয়ালে কোনো পার্টির শ্লোগান লেখা নেই।

সামনে দু’-তিনটি গাড়ি ও অনেকগুলি স্কুটার-সাইকেল। বেশ লোকজনের যাওয়া-আসার ব্যস্ততা।

আমার মাথার মধ্যে চিড়িক চিড়িক করে ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল।

এই রে, ব্যথাটা হঠাৎ খুব বেড়ে যাবে নাকি? ব্যথাটা আরম্ভ হলেই পা-দুটো দুর্বল লাগে, শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। এখন এলেবেলে কথা শুনতে হবে কতক্ষণ তা কে জানে।

মূল দরজাটার ঠিক পাশেই দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরা, মাথার চুল খোলা, একটু আগেই বৃষ্টিতে ভিজেছে বোধ হয়, মুখে কয়েক ফোঁটা জলের বিন্দু।

মেয়েটি সোজা চেয়ে আছে আমার দিকে। দিন-দুপুরে আমার বুকটা কেঁপে উঠল।

কাল রাত্তিরে ছাদে এই মেয়েটিকেই দেখেছিলুম না? তখন বৃষ্টি ও অন্ধকার ছিল, বিদ্যুৎচমকে একবার মাত্র দেখা গিয়েছিল। আমার দিকে চেয়ে হাসছিল সে। না, ছাদে সত্যিকারের কোনো মেয়ে ছিল না। ওটা আমার চোখের ভুল। দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎচমকে আর তাকে দেখা যায়নি। এমন চোখের ভুল আমার আগে কখনো হয়নি, আমি কোনোদিন ভূত বা পেত্নী দেখিনি।

কিন্তু কাল রাত্তিরে ছাদে অবিকল রক্তমাংসের মানবীর মতন একজনকে দেখেছিলাম, এটাও যেমন ঠিক, আবার একটু পরেই সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, এটাও ঠিক। আমি ছিলুম সিঁড়ির দরজার দিকে, সুতরাং সেখান দিয়ে কোনো মেয়ের চট করে নেমে যাওয়ারও সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং কাল্পনিক নারী হতে বাধ্য। যদিও বৃষ্টির মধ্যে ছাদের পাঁচিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো একটি মেয়েকে আমি খামোখা কল্পনা করতে যাব কেন, তাই-ই বা কে জানে!

সেই কাল্পনিক মেয়েটির সঙ্গে এই নীল শাড়ি পরা মেয়েটির মুখের আশ্চর্য মিল। এ মেয়েটি তো আর অবাস্তব হতে পারে না। এখন পৌনে বারোটা বাজে, সদ্য বৃষ্টি থেমে এক ঝলক রোদ উঠেছে। সেই রোদ পড়েছে মেয়েটির মুখে। ওর ব্লাউজের রং লাল, চটির রং লাল, তার কানেও দুটি লাল পাথরের দুল, এগুলো কি কল্পনা হতে পারে নাকি?

মেয়েটি সোজাসুজি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ও কি আমাকে চেনে? হাসি হাসি মুখ করে আছে। আমি চট করে মাথা ঘুরিয়ে একবার পেছনটা দেখে নিলুম, হয়তো অন্য কারুর দিকে চেয়ে ও হাসছে। কিন্তু আমার ঠিক পেছনে কেউ নেই।

পৃথিবীতে কত মেয়েকে দেখলে মনের ভেতরটা আকুলি-বিকুলি করে, ব্রাউনিং-এর কবিতার মতন বলতে ইচ্ছে করে, তোমার সমগ্র জীবন থেকে আমাকে একটিমাত্র মুহূর্ত দাও! বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বলা হয় না। অচেনা কোনো মেয়ের সঙ্গে আলাপ করার বিন্দুমাত্র প্রতিভা নেই আমার।

মেজমামা ভেতরে ঢুকে গিয়েও মাথা ঘুরিয়ে বললেন, এই নীলু, কী হলো, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন, কেটে পড়বার মতলবে আছিস নাকি?

মেজমামা ফিরে এসে হাত ধরে টানাটানি করবেন, এই ভয়ে আমাকেও ভেতরে ঢুকে পড়তে হলো। মেয়েটি একটু যেন কৌতুকের হাসি দিল সেজন্য।

মেজমামা একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, রথীন তালুকদারকে কোথায় পাব? লোকটি বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলল, রথীনদা? চলে যান, দোতলায় উঠে ডান দিকের বারান্দায় প্রথম দু’খানা ঘর ছেড়ে…।

দোতলায় উঠে দেখা গেল একটা টানা বারান্দা। অনেকগুলো ঘর। আর একটি লোককে জিজ্ঞেস করতে সেও একই রকম ভাবে বলল, রথীনদা? ঐ যে দরজাটা এক পাল্লা খোলা দেখছেন…।

সেই ঘরের মধ্যে অনেক লোকজন, নানারকম গুঞ্জন। দরজার কাছে পাহারাদারের ভঙ্গিতে একজন যুবক দাঁড়িয়ে। রথীন তালুকদারের নাম শুনে বলল, চলে যান ভেতরে, ঐ যে মাঝখানে বসে আছেন!

নির্মল পত্রনবীশের ঘরে লোকজন বিশেষ ছিল না, তবু আমাদের আটকান হচ্ছিল। এখানে কেউ কোনোরকম বাধা দেয় না।

ঘরের মধ্যে চেয়ার-টেবিল নেই, একটা নীচু চৌকির ওপর ফরাস পাতা। একজন মাঝবয়েসী, মাঝারি স্বাস্থ্যের লোককে ঘিরে বসে আছে দশ-বারোটি নারী—পুরুষ। ভদ্রলোকের দু’ পাশে দুটি লাল ও নীল টেলিফোন, তিনি অনেকের সঙ্গেই পর্যায়ক্রমে কথা বলছেন, আবার মাঝে মাঝে টেলিফোন তুলছেন।

চৌকিটার কাছে গিয়ে এখন দাঁড়ালেও তিনি আমাদের দিকে তাকালেন না। মেজমামা দু’বার গলা খাঁকারি দিলেন, তাতেও কোনো কাজ হলো না।

অসহিষ্ণুভাবে মেজমামা বললেন, রথীন, কেমন আছিস? তাকিয়ে দ্যাখ কে এসেছে!

ভদ্রলোক এবারেও মেজমামার দিকে না তাকিয়ে বললেন, হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে!

মেজমামা আবার বললেন, রথীন তালুকদার, মস্ত বড় লিডার, একবার মুখখানা তোলো বাপ!

ভদ্রলোক বললেন, লিডার আবার কি! জনগণই সব শক্তির উৎস!

ধৈর্য হারিয়ে মেজমামা হেঁকে বললেন, অ্যাই রথীন! তোদের নামে আমি মামলা করব। ব্যাটা গভর্নমেন্ট চালাচ্ছিস তোরা, আর রাস্তায় ইয়া বড় বড় গর্ত নর্দমা, হাইড্র্যান্টের ঢাকনা নেই, কত লোকের পা ভাঙছে, আমারই তো পা মচকে গেছে, এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

ঘরের অন্য সকলে এক নিমেষে চুপ করে গেছে। রথীন তালুকদার মুখ তুলে প্রশ্রয়ের হাসি দিলেন একটা। তারপর ভাবগম্ভীর স্বরে বললেন, সমাজ—দেহের সারা জায়গায় এত ক্ষত, আর আপনি সামান্য রাস্তার গর্ত নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন? আগে আসুন, আমরা সবাই মিলে সমাজটাকে বদলাই, সুস্থতা ফিরিয়ে আনি, তারপর রাস্তা সারাবার কথা ভাবা যাবে।

কথাগুলো তিনি বললেন আবৃত্তির সুরে। আগে থেকে তৈরি করা এবং অনেকবার বলতে হয়, তা শুনলেই বোঝা যায়।

বলা শেষ করেই তিনি অন্য একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ। ঐ বস্তিতে কত ভোটার বললে? সাড়ে তিন শো। কতজন মেল, কতজন ফিমেল? মেজমামা এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, অ্যাই রথীন, একবার তাকিয়ে দ্যাখ ভালো করে কে এসেছে। আমি পিন্টু। চিনতে পারছিস না নাকি? আমার তো নির্মলের মতন চেহারা পাল্টায় নি।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনতে পারব না কেন? বসুন, বসুন। আপনার বাবা কেমন আছেন?

—বাবা? আমার বাবা তো কেটে পড়েছেন চোদ্দ বছর আগে। আমার বাবার শ্রাদ্ধে তুই নেমন্তন্ন খেয়েছিলি মনে নেই?

—আপনাদের ওখানকার পার্টি অফিসটা বড় করতে হবে। একটা ঘর না বাড়ালেই নয়।

—অ্যাঁ, পার্টি অফিস? আমাদের ওখানে কোনো পার্টিই নেই।

—আপনারা কত চাঁদা তুলতে পারবেন?

—চাঁদা? সিঙ্গাপুরে কেউ চাঁদা তুলতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে জেলে ভরে দেবে। এবার আমি লক্ষ্য করলুম, রথীন তালুকদার সামান্য লক্ষ্মী ট্যারা। উনি মেজমামার দিকে তাকিয়ে থাকলেও কথা বলছেন পাশের লোকটির সঙ্গে। মেজমামা একরকম উত্তর দিচ্ছেন, পাশের লোকটিও অন্যরকম উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

রথীন তালুকদার আবার মেজমামার দিকে চেয়ে থেকেই বললেন, বুর্জোয়া শোষণ ব্যবস্থা আর সাম্প্রদায়িকতা, এই দুটোর বিরুদ্ধে আমাদের সব সময় লড়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, পার্টি মেম্বার মানেই প্রত্যেকে এক একজন অতন্দ্র প্রহরী!

মেজমামা এবার খুব রেগে গিয়ে প্রবল গলা চড়িয়ে বললেন, তখন থেকে আমার ওপর বড় বড় বুকনি ঝাড়ছিস যে বড়। আমি পিন্টু, আমাকে তুই চিনিস না? শালা, আমাকে না-চেনার ভান করছিস? চ্যালা-চামুণ্ডা নিয়ে বসে আছিস বলে এতক্ষণ কিছু বলিনি। এবার মারব এক থাবড়া? খুব বড় নেতা হয়েছিস, না?

মেজমামা সত্যি সত্যি মারার জন্য হাত তুললেন। আমি প্রমাদ গনলুম। চ্যালাদের কাছে ছুরি কিংবা বোমা থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আজকাল যে—কোনো পার্টির চ্যালাদেরই প্রথম যোগ্যতা ছুরি কিংবা বোমা চালাতে জানা। মেজমামা একা শুধু গায়ের জোরে কী করবেন?

অন্য নারী-পুরুষরা একসঙ্গে গুনগুন করে কী যেন বলে উঠল। দু’জন উঠে দাঁড়াল। রথীন তালুকদার বাঁ হাত তুলে তাদের নিবৃত্ত করে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন মেজমামার দিকে। তারপর তিনিও হঠাৎ হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, পিনাকপানি! পিনাকপানি! তাই বল। তখন থেকে পিন্টু পিন্টু করছিস কেন? পিনাকের মতন গলাটা চড়ালি বলেই তো চিনতে পারলুম। রোজ এখানে অন্তত পাঁচজন করে পিন্টু আসে। খুব কমন নাম। পিন্টু, হেবো, বঙ্কা, গুল্লু এইসব নামেই আজকাল এরা অনেকে নিজেদের পরিচয় দেয়, ভালো নাম-টাম কেউ বলে না। তারপর পিনাক, তোর কী খবর বল? তুই এখন দুর্গাপুরেই আছিস? মেজমামা আবার ভুরু কুঁচকে বললেন, দুর্গাপুরে? আমি আবার সেখানে ছিলুম কবে, আমি তো থাকি সিঙ্গাপুর।

রথীন তালুকদার বললেন, ও হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা দাঁড়া এক মিনিট

তিনি অন্য একজনের দিকে ফিরে বললেন, এই তোদের পাড়ার দেওয়ালগুলো অন্য পার্টি ক্যাপচার করল কী করে? দেয়াল একদম ছাড়া চলবে না। দেয়াল দখলটাই আসল লড়াই। দেয়াল আমাদের চাই।

আর একজনকে বললেন, গুল্লু, তোদের ওখানে আরো হকার বসা। রাস্তার দুধারে মোটে পঁচিশ-তিরিশটা হকার দেখলুম সেদিন। অন্তত দেড়শোজন হকার না হলে স্ট্রং ইউনিয়ন হবে না। আরও হকার ডেকে এনে পুরো ফুটপাথ ঢেকে দে!

আর একজনকে বললেন, তোমাদের ওখানে খালের ওপর একটা ব্রীজ চাই? হ্যাঁ, ছোটখাটো একটা কাঠের ব্রীজ আপাতত দরকার, সেটা আমিও দেখে এসে বুঝেছি। মিউনিসিপ্যালিটিকে বলে এক্ষুনি একটা ব্রীজ বানিয়ে দিতে পারি। পি ডবলু ডি-র ফাণ্ড থেকেও দেওয়া যেতে পারে কিছু টাকা। কিন্তু ব্রীজের ওপারটায় কারা থাকে? সব অন্য পার্টির সাপোর্টার। গতবার আমাদের এগেইনস্টে ভোট দিয়েছে। দেয়নি? ঐসব হারামজাদা, নিমকহারামদের জন্য গভর্নমেন্টের পয়সা খর্চা করে ব্রীজ বানান হবে? আমরা ব্রীজ বানাব, ওরা মজা লুটবে? ওসব চলবে না! আমাদের ক্যাডাররা গিয়ে বলুক, ওরা যদি পরের বার আমাদের ভোট দেয়, তবেই ব্রীজ পাবে।

আবার তিনি মেজমামার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ, আপনার কী চাই বলুন!

মেজমামা তড়পে উঠে বললেন, ফের ন্যাকামি হচ্ছে? আমার সঙ্গে আপনি আপনি?

রথীন তালুকদার বললেন, ওঃ হো! পিনাকপানি! বড্ড ভুলে যাইরে আজকাল। এতে কাজ, এত লোকজন আসে, কোন দিকটা সামলাব!

মেজমামা বললেন, তোর বড্ড ভুলো মন বরাবরই। ইউনিভারসিটিতে পড়ার সময় তোকে পাঁচশো টাকা ধার দিয়েছিলুম, সেটাও ভুলে মেরে দিয়েছিস! কোনোদিন ফেরৎ দিসনি।

–না, না। সেটা ভুলব কেন? তোর কাছে বেশি টাকা ছিল তুই দিয়েছিস! আমার অভাব ছিল, আমি নিয়েছি। এটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই না? এর মধ্যে আবার ফেরৎ দেবার কোশ্চেন আসছে কোথা থেকে?

—আমার বেশি টাকা ছিল? তুই পরীক্ষার ফি জোটাতে পারিসনি বলে আমি আমার মেডেল বিক্রি করে দিইনি? সে থাকগে, টাকা চাইতে আসিনি আমি, ভয় নেই। সেই টাকার চিন্তাতেই তুই আমাকে না চেনার ভান করছিলি?

–আরে না, না, তোকে চিনব না কেন?

—আমার বাবা ছোটবেলা থেকে তোকে পড়িয়েছেন। আমাকে একটা জামা কিনে দিলে তোকেও একটা জামা দিতেন। বাবা মারা যাবার সময় তুই হাউ হাউ করে কেঁদেছিলি! শ্রাদ্ধের দিন কত খাটাখাটনি করলি। সেই তুই আজ আমায় ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করছিস, বাবা কেমন আছে? বড় নেতা হলে বুঝি এইসব কথা ভুলে যেতে হয়?

রথীন তালুকদার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সব এবার যাও। আমার এক পুরোনো বন্ধু এসেছে, এর সঙ্গে প্রাইভেট কথা আছে।

সঙ্গে সঙ্গে সবাই হুড়মুড় করে উঠে গেল।

একটু পরেই একজন এসে বড় ভাঁড়ে চা দিয়ে গেল।

মেজমামা আর রথীন তালুকদার মেতে উঠলেন পুরোনো কালের গল্পে। আমি আর কান দিলুম না সেদিকে।

বাইরে দেয়াল-ঘেঁষে দাঁড়ান মেয়েটি আমার দিকে চেনা-চেনা চোখে তাকিয়েছিল। ওকে কি আমি আগে কোথাও দেখেছি? কোথাও পরিচয় হয়েছিল? একটি সুশ্রী তরুণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হলে তাকে আমি ভুলে যাব, এও কি সম্ভব?

মেয়েটি কি এখনো দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে?

বাথরুমে যাবার নাম করে একবার দেখে এলে হয় না? এরা দুই বন্ধু তো এখন গল্পে মত্ত। আমার মাথার ব্যথাটা কমে গেছে কখন যেন। চায়ের পরে সিগারেটেও দু’-একটান দিয়ে আসা দরকার।

উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় মেজমামা বললেন, শোন রথীন, এবার একটা কাজের কথা বলে নিই। তোর কাছে এসেছি একটা চাকরির জন্য।

রথীন তালুকদার বলেন, সে কি, তুই এখনো চাকরি করিস না? এত বয়েস পর্যন্ত বেকার? এতদিন আমাকে কোনো খবর দিসনি কেন?

মেজমামা চোখ পাকিয়ে বললেন, আমার জন্য বলছি না, ইডিয়েট। সিঙ্গাপুরে কি আমি ভ্যারেণ্ডা ভাজি? আমার এই ভাগ্নেটার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তোদের হাতে তো এখন অনেক ক্ষমতা।

রথীন তালুকদার এই প্রথম আমাকে দেখলেন। এতক্ষণ যে তাঁর বাল্যবন্ধুর পাশে আর একজন মানুষও বসে আছে, তা তিনি লক্ষ্যই করেননি।

মেজমামা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, এই হচ্ছে আমার ভাগ্নে, নীলু। পড়াশুনোয় খুব একটা ভালো ছিল না। স্বভাবটাও বাউণ্ডুলে টাইপের। তবে মাঝারি চাকরির জন্য তো বেশি কিছু কোয়ালিফিকেশান লাগে না। বসিয়ে দে কোনো একটা পোস্টে।

রথীন তালুকদার জিজ্ঞেস করলেন, বয়েস কত?

মেজমামা বললেন, চব্বিশ-পঁচিশ হবে, তাই না রে নীলু?

আমি শুকনো গলায় বললুম, সাতাশ।

রথীন তালুকদার জিজ্ঞেস করলেন, কোন পার্টিতে আছে?

মেজমামা আমার দিকে ফিরে বললেন, তুই কোনো পার্টি-ফার্টি করিস নাকি! আমি দু’দিকে মাথা নাড়লুম।

রথীন তালুকদার একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে তো ভাই আমি কিছু করতে পারব না। আমাদের পার্টি ওয়ার্কার ছাড়া তো কারুকে চাকরি দেওয়া যাবে না।

মেজমামা বললেন, সে কি রে? সোজাসুজি এই কথা বললি? সরকারি চাকরি তা শুধু তোদের পার্টির ওয়ার্কাররা পাবে কেন? সরকার আর পার্টি কি এক?

রথীন তালুকদার বললেন, এতে অবাক হবার কী আছে রে, পিন্টু? দেশে যখন আলাদা আলাদা পার্টি আছে, তখন যে-পার্টি যখন ক্ষমতায় আসবে, সেই পার্টি তখন নিজের পাতে যত বেশি পারে ঝোল টানবে, চাকরি-বাকরিগুলো নিজেদের ওয়ার্কার দিয়ে ভরাবার চেষ্টা করবে, এটাই তো স্বাভাবিক, সব দেশেই এরকম হয়।

—তুই কটা দেশের খবর রাখিস রে? ইংল্যাণ্ডে রুলিং পার্টি এরকম ফেভারিটিজম দেখাবার চেষ্টা করলে গভর্নমেন্ট ফল করে যায়। ফ্রান্সে একবার…—ঠিক আছে, অন্য দেশের কথা বাদ দে। আমাদের দেশে এরকমই সিসটেম। ইণ্ডিয়ার অন্য স্টেটগুলোতে দ্যাখ না! এমনকি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টেও কি আমাদের পার্টির কেউ চাকরি পাবে? পুলিস এনকোয়ারি করে নাকচ করে দেবে। ওরা ওদের পার্টির লোকদের চান্স দেয়, আমরাও আমাদের পার্টির ওয়ার্কারদের চান্স দেব। সোজা কথা।

—তা হলে যে-সব ছেলেমেয়ে এ পার্টিতেও নেই, ও পার্টিতেও নেই, তারা কোথায় যাবে?

—তারা ফরেনে চলে যাবে। তারা ইংল্যাণ্ড-আমেরিকায় চাকরি করতে চলে যায়।

—এ কী সর্বনেশে কথা রে! সব ছেলেমেয়েকেই পার্টি পলিটিক্স করতে হবে? তা হলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, শিল্পী, গায়ক এসব হবে কারা? চীন—রাশিয়াতেও তো সব ছেলেমেয়ে পার্টি মেম্বার হয় না।

–আমরাও হতে বলছি না।

—তা হলে যে চাকরি পাবে না বলছিস!

—শোন, পিন্টু, রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে না, ‘ঘরেও নাহি, পারে নাহি, যে-জন আছে মাঝখানে, সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে লয় তারে…।’ কে ডাকে বল তো? কেউ ডাকে না। সে নিজের চেষ্টায় যা পারে করবে। আমি তোর ভাগ্নের জন্য কিছু করতে পারব না।

মেজমামা এক মিনিট থুতনি চুলকোতে চুলকোতে চিন্তা করলেন।

তারপর আমার ঘাড়ে আর একখানা চাপড় মেরে বললেন, কুছ পরোয়া নেই। নীলু, তুই রথীনদের পার্টির ওয়ার্কার হয়ে যা। তা হলে প্রবলেম সল্ভড় হয়ে যায়। কী রে, রথীন, ও এখন ওয়ার্কার হতে পারে না?

–তা হতে পারে। কোনো অসুবিধে নেই।

—কী কী করতে হবে? কোনো খাতায় নাম লেখাতে হয়?

—সেসব আমি ব্যবস্থা করে দেব।

—নীলু, তুই তা হলে আজ থেকেই লেগে যা।

আমি ডান হাতটা তুলে বললুম, আমি কি…আমি তো বোমা বাঁধতে জানি না। কালীপুজোর সময় তুবড়ি বানিয়েছিলুম একবার।

রথীন তালুকদার ধমক দিয়ে বললেন, বোমা-টোমা আবার কি! ওসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। বোমা বানাবার অনেক লোক আছে। আমাদের চাই আদর্শ কর্মী। ডেডিকেটেড ওয়ার্কার। বইটই পড়ে নিতে হবে। তোমাদের পাড়ার লোকাল কমিটিকে আমি জানিয়ে দেব, ওরাই যোগাযোগ করবে তোমার সঙ্গে।

মেজমামা উল্লাসের সঙ্গে বললেন, দ্যাট সেটলস ইট। গুড, ভেরি গুড। থ্যাঙ্ক ইউ, রথীন, বড্ড উপকার করলি! তা হলে আমার ভাগ্নেটাকে কী চাকরি দিচ্ছিস?

-চাকরি? চাকরি এক্ষুনি কি?

—এই যে বললি পার্টি ওয়ার্কার হলেই চাকরি পাবে?

—সঙ্গে সঙ্গে? এ কি মামাবাড়ির আবদার নাকি রে? তা হলে তো চাকরি পাবার লোভে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ছুটে এসে বলবে, পার্টি ওয়ার্কার হব! এতই সোজা? দেশে লক্ষ লক্ষ বেকার। সবাইকে কি চাকরি দিতে পারব? যারা আমাদের পার্টির সত্যি সত্যি সিনসিয়ার ওয়ার্কার হবে, সেটা প্রুভ করবে, তাদেরই জন্য চাকরির ব্যবস্থা করব।

—সেটা প্রুভ করতে কতদিন লাগবে? ততদিন এই বেকারগুলো খাবে কি? নীলুকে তুই কতদিন পরে চান্স দিবি?

–ওকে লাইনে থাকতে হবে। যারা আগে এসেছে, তারা আগে চান্স পাবে। ওর নম্বর হবে পাঁচ হাজার সাতশো তিরাশি।

—তুই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস, রথীন! অতগুলো লোকের পর চা পেতে পেতে তো আমার ভাগ্নেটা বুড়ো হয়ে যাবে। কিংবা ওর টার্ন আসবার আগে মরেই যাবে হয়তো।

—আর একটা উপায় হচ্ছে, পাঁচ হাজার সাতশো তিরাশি টাকা চাঁদা যদি দিতে পারে।

-ঘুষ? চাকরির জন্য ঘুষ?

—ঘুষ নয়, চাঁদা। পার্টি ফাণ্ডে।

—দ্যাখ রোথো, আমার সহ্যের একটা সীমা আছে। তুই আমার ভাগ্নের একটা চাকরির জন্য আমার কাছে ঘুষ চাইছিস?

—ঘুষ নয় ভাই, পার্টি ফাণ্ডে চাঁদা! কোন্ পার্টি এভাবে চাঁদা তোলে না বল তো? সবাই তোলে।

—যে-পার্টিই তুলুক। স্বেচ্ছায় দিলে তাকে বলা যায় চাঁদা। প্রেসার দিয়ে আদায় করলে তাকেই বলে ঘুষ! হারামজাদা, তুই কতদিন আমাদের বাড়িতে খেয়েছিস, থেকেছিস, ঘুমিয়েছিস, এখন তুই আমার ভাগ্নের একটা চাকরির বদলে ঘুষ চাইছিস

—তুই শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করছিস পিন্টু। পার্টির নীতি কিংবা নির্দেশ আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না। এখানে আমি ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব কিংবা আত্মীয়তাকেও প্রশ্রয় দিই না। তুই সিঙ্গাপুরে বড় চাকরি করিস, এই কটা টাকা দিতে তোর এমন কি অসুবিধে হবে?

—এক পয়সাও দেব না। অন প্রিন্সিপাল দেব না! চল নীলু, তুই সারাজীবন বেকার থাকবি তাও সই, তবু খবর্দার মাথা নোয়াবি না! পলিটিক্সের নিকুচি করেছে! চোখের চামড়া পর্যন্ত নেই, আমার কাছে এই রোথোটা ঘুষ চাইল!

–কেন বারবার ঘুষ ঘুষ বলছিস পিন্টু? আমি নিজের জন্য চেয়েছি? বলছি না পার্টি ফাণ্ডে চাঁদা।

—তোর ডিক্সনারিতে যেটা চাঁদা, আমার ডিক্সনারিতে সেটাই ঘুষ! পাঁচ হাজার সাতশো তিরাশি! একেবারে অঙ্কের হিসেবের মতন।

—রাউণ্ড ফিগার কেন বলা হয় না জানিস? সেটা বড্ড মারোয়াড়ি মারোয়াড়ি শোনায়।

হঠাৎ লজ্জা পেয়ে, জিভ কেটে রথীন তালুকদার বললেন, সরি, সরি! অফ দা রেকর্ড। মারোয়াড়ি কথাটা আমি উচ্চারণ করতে চাইনি। শিল্প অফ টাং। কোনো বিশেষ কমিউনিটির বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলতে চাই না। মারোয়াড়িদের বিরুদ্ধেও আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। আমি বলতে চাইছিলাম, পাঁচ হাজার দশ হাজার এইরকম ডোনেশন বড় বড় ব্যবসায়ীরা যখন তখন দিতে পারে। কিন্তু পাঁচ হাজার সাতশো তিরাশি, এরকম ফিগার শুনলেই মনে হয়, একজন মেহনতী মানুষ অনেক কষ্ট করে টাকাটা জোগাড় করেছে, শেষ সম্বলটাও পার্টিকে দিয়েছে।

মেজমামা মুখ ভেংচে বললেন, শুনলে এরকম মনে হয়? আর একজন বেকার এই টাকাটা জোগাড় করবে কী করে?

—কষ্ট করতে হবে! পার্টির জন্য দিচ্ছে। পার্টিকে ষ্ট্রং করতে হবে। তুই আমার ওপর রাগ করে চলে যাচ্ছিস পিন্টু, এক সময় তুই আমার অনেক উপকার করেছিস, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত স্বার্থে কোনো কিছু করতে পারি না। পার্টির স্বার্থ আমাকে সব সময় দেখতেই হবে!

—তুই কোনো চাকরি-বাকরি করিস, রথীন? না তুইও বেকার?

–বেকার মানে? আমি সারাক্ষণই এই কাজ করি। আমি পার্টির হোল—টাইমার!

—ভাবের ঘরে আর কতদিন চুরি করবি, শালা! পার্টির স্বার্থ মানেই তোর ব্যক্তিগত স্বার্থ। চাঁদার টাকায় এরকম বড় বড় বাড়ি হবে। তোর মতন নেতারা দু’ পাশে দু’খানা টেলিফোন নিয়ে অন্যদের লেকচার মেরে যাবে। মাথার ওপর পাখা, যখন তখন চা। তোর খাওয়া পরার খরচও পার্টি দেয়। পার্টি তোকে গাড়ি দেয়নি? আরও চাঁদা তোল, গাড়ি পাবি।

—তুই বুঝতে পারছিস না, পিন্টু। সব পার্টিতেই হোল টাইমার থাকে, আমি যদি…

—আমার আর বোঝার দরকার নেই! গুড বাই! এককালের ছাত্র বিপ্লবী এখন চাঁদা তোলার যন্ত্র।

.

মেজমামা গটমট করে বীর দর্পে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও তাঁর মুখখানা অপমানে ও ক্ষোভে কালচে হয়ে গেছে।

আমি সিঁড়ি দিয়ে প্রায় নাচতে নাচতে নামতে লাগলুম। মেজমামার এই পরাজয় দেখার আনন্দ আমি আর চেপে রাখতে পারছি না। বাড়ি ফিরে বৌদিকে সব রসিয়ে বলতে হবে। তারপর দু’জনে মিলে মেজমামাকে যা নাস্তানাবুদ করব আজ বিকেলে!

বাইরে এসেই বাঁ দিকে তাকালুম। না, সে মেয়েটি নেই। এতক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবেই বা কেন সে? মেয়েটি কি এখানে কারুর জন্য প্রতীক্ষা করছিল?

মেজমামা বিরস মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে জিপটা খুঁজতে লাগলেন।

আমি বললুম, আর কি কোথাও যাবার দরকার আছে? এবার বাড়ি ফিরলে হয় না?

মেজমামা বললেন, সত্যি রে নীলু, চাকরির বাজার যে এমন টাইট, ভাবতেই পারিনি। রথীনটার ওপর খুব ভরসা করেছিলুম, কিন্তু ও এমন বদলে গেছে! বন্ধুত্ব—টন্ধুত্বর কোনো দাম নেই, সবই এখন পার্টি!

-মেজমামা, উনি তো দোষের কিছু বলেননি! সব পার্টিই এইরকম কথা বলে।

–সব পার্টিরই আমি গুষ্ঠির পিণ্ডি চটকাই! পার্টির বাইরে কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না, সবাইকেই জো-হুজুর হতে হবে! এখন দেখতে পাচ্ছি, তোর কথাটাই ঠিক। এরকম অপমানজনকভাবে চাকরি জোগাড় করার চেয়ে বেকার থাকা ঢের ভালো। যাদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না, কাচ্চা-বাচ্চারা না খেয়ে থাকে, তাদের তো একটা কিছু করতেই হবে। তোর তো সে ঝামেলা নেই, তুই বেশ আছিস, বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। যতদিন তোর দাদা-বৌদি তোকে খাওয়াবে, তুই এরকমই চালিয়ে যা।

—শুধু শুধু এই বাদলার দিনে তুমি এতটা সময় নষ্ট করলে মেজমামা!—পুরোনো বন্ধুরা যে এমন পাল্টে যায়, কী করে জানব? এই রথীন যখন আমাদের বাড়িতে এসে থাকত, আমরা এক বালিশে মাথা দিয়ে শুয়েছি। আজ সে তোকে চাকরি দিতে পারুক বা না পারুক, একটাও পার্সোনাল কথা বলল না! শুধু বড় বড় লেকচার!

—আকাশ আবার কালো হয়ে এসেছে। চল, বাড়ি যাই!

—হুঁ! তোর মার কাছে বড় গলা করে বলেছিলুম, তোর একটা চাকরি আমি জোগাড় করে দেবই! এখন ছোড়দি ঠাট্টা করবে। খালি হাতে ফিরলেই বলবে, দেখলুম পিন্টু তোর মুরোদ!

—আমি আর বৌদিও তোমাকে ক্ষ্যাপাব! সিঙ্গাপুরে থাক, এ দেশের কিছুই খবর রাখ না।

—তোরাও আমায় ক্ষ্যাপাবি?

—নিশ্চয়ই! তুমি আমার কতটা সময় নষ্ট করলে! তোমার সঙ্গে এসে আমাকেও ফালতু অপমান সহ্য করতে হলো!

—তা হলে তো দেখছি আজই শ্বশুরবাড়ি পালাতে হবে ভন্তুর সঙ্গে। চল, একবার সুরঞ্জনের অফিসটা ঘুরে যাই!

—আবার? দু’খানা বন্ধুর স্যাম্পেল তো দেখলে মেজমামা। সবাই এই রকমই হবে। কেন সাধ করে নিজের মান খোওয়াতে যাবে।

—সুরঞ্জনের অফিসটা কাছেই। শুধু একবার দেখা করে যাব। ঠিক আছে, চাকরির কথা উচ্চারণও করব না। তুই ভালো করে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে ফ্যাল। তোর মুখ দেখলেই যাতে বোঝা যায়, তুই চাকরি-ফাকরি কিচ্ছু গ্রাহ্য করিস না।

আবার জিপটায় উঠে বসার পর মেজমামা আবার বলল, এই যে সুরঞ্জন দত্তরায়ের কাছে যাচ্ছি, ওর সঙ্গে আমি স্কুলে পড়েছি। আমার সঙ্গে খুব যে ভাব ছিল তা নয়, বরং রেষারেষি ছিল। ও একবার ফার্স্ট হতো, আমি পরের বার ফার্স্ট হতাম। হ্যাঁ, তুই বিশ্বাস করছিস না, আমি সত্যি সত্যি ফার্স্ট হয়েছি অনেকবার। তা সুরঞ্জন এখন সাকসেসফুল হয়েছে, প্রাইভেট ফার্মে বড় চাকরি করে। কিন্তু ও ঘন ঘন চাকরি বদলায়। এর মধ্যে আট-দশ জায়গায় বদলেছে। একটা ছাড়ে, আবার একটা পেয়েও যায় সঙ্গে সঙ্গে।

আমি বললুম, ওপরের দিকের লোকদের চাকরির অভাব নেই। খবরের কাগজে বড় বড় বিজ্ঞাপন থাকে। দশ বছর, পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা চায়। যত ঝঞ্ঝাট আমার বয়েসীদের, যাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আচ্ছা বলো তো, কোনো চাকরি না পেলে অভিজ্ঞতা হবে কী করে? তোমার ঐ প্রথম বন্ধু নির্মলবাবু বললেন না, তোমাদের জেনারেশানের পরে আর কেউ চাকরিও পাবে না!

মেজমামা বললেন, এই সুরঞ্জনের সঙ্গে দেখা হলেই বাঙালিদের নিন্দে করে। নিজে যে বাঙালি সেটা পর্যন্ত অস্বীকার করতে চায়। ও বলে, বাঙালিরা কোনো কর্মের না, ফাঁকি মারে, ইউনিয়ানবাজি করে, কথায় কথায় স্ট্রাইক ডাকে, কিন্তু কাজের বেলায় চুঁ হুঁ! এমনকি বাঙালি কেরানিরা নাকি ভালো করে ঘুষ নিতেও জানে না। পঞ্চাশ-একশো টাকা ঘুষ নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকে। আর নর্থ ইণ্ডিয়ার অফিসগুলোতে যে-কোনো কাজের জন্য যাও, স্ট্রেট দশ পাশেন্ট ঘুষ চাইবে, কাজটাও নিখুঁত করে দেবে! ঘুষের ব্যাপারে তারা অনেস্ট।

—ঘুষেরও অনেস্টি!

–হে-হে-হে-হে! যে বিয়ের যে মন্তর! সুরঞ্জনের কাছে যাচ্ছি তার কারণ ও আমাকে একটা চিঠি লিখেছে, আসবার ঠিক দু’ দিন আগেই পেয়েছি। উত্তর দেওয়া হয়নি।

—দশ মিনিটের বেশি বসব না কিন্তু। তোমরা দেখা হলেই স্কুল-কলেজের বন্ধুদের কথা বলতে শুরু করে দাও, আমার বোরিং লাগে।

—ঠিক আছে, ঠিক আছে।

থিয়েটার রোডে গিয়ে আবার একটা সরু রাস্তায় ঢুকে সুরঞ্জন দত্তরায়ের অফিস। এখানকার এক একটা বাড়িতেই অনেকগুলো অফিস থাকে। এদের কোম্পানিটা দোতলা তিনতলা মিলিয়ে।

সুরঞ্জন দত্তরায়ের ঘরের সামনে একজন বেয়ারা বসে আছে, সে যথারীতি জানাল যে সাহেব এখন ব্যস্ত আছেন।

তার কথা অবিশ্বাস করা গেল না, কারণ ঠিক তক্ষুনি সেই ঘরের দরজা ঠেলে একজন লোক বেরুল, দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল যে ঘরের মধ্যে এক ঝাঁক মানুষ

দু’ জায়গায় ঘা খেয়ে মেজমামা অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছেন।

তিনি আর চ্যাঁচামেচি করলেন না, বেয়ারার কাছ থেকে শিল্প নিয়ে তাতে নিজের নাম লিখে পাঠিয়ে দিলেন।

চ্যাঁচামেচির চেয়ে অনেক বেশি কাজ হলো। প্রায় ম্যাজিকের মতন। সঙ্গে সঙ্গে নীল সুট পরা একজন সুপুরুষ বেরিয়ে এসে প্রবল উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললেন, পিনাকপানি? পিন্টু! কী আশ্চর্য ব্যাপার! এ যে মেঘ না চাইতেই জল। আজ সকাল থেকে তোর কথাই ভাবছি! কেমন আছিস?

তারপরেই আর্দালির দিকে ফিরে তিনি বললেন, সুখরাম, পাশের কামরাটা খুলে দাও! এ সি চালাও।

মেজমামার হাত ধরে বললেন, আয় পিন্টু, আমরা এখানে বসি।

মেজমামা বললেন, তুই কাজে ব্যস্ত ছিলি, ঘরে অত লোক দেখলাম।

সুরঞ্জন দত্তরায় বললেন, থাক না, ওরা কাজ করুক। তুই এসেছিস এতদিন পর। তুই আমার এই অফিসের ঠিকানা জানলি কী করে? এখানে এসেছি মাত্র দেড় বছর!

–তোর চিঠি পেলাম যে!

—পেয়েছিস? উত্তর দিলি না কেন?

—এই তো উত্তর দিতে সশরীরে এসেছি। চিঠি পেলাম মাত্র দু’দিন আগে। পাশের ঘরটি ছোট, কিন্তু খুব সাজানো। অনেকগুলো কালো রঙের গদিমোড়া চেয়ার, টেবিলের ওপর একটা ফ্লাওয়ার ভাসে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। কোনো ফাইল বা একটুকরো কাগজও নেই সেখানে, অফিস বলে মনেই হয় না।

সেখানে বসার পর সুরঞ্জন দত্তরায় আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটিকে তো চিনতে পারলাম না।

মেজমামা বললেন, এ আমার ভাগ্নে। তুই আগে দেখিস নি।

সুরঞ্জন দত্তরায় বললেন, খুব ভালো ছেলে মনে হচ্ছে। এই বয়েসী কোনো ছেলে তার মামার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ তো আজকাল দেখাই যায় না। আমার ছেলে আমার সঙ্গে দার্জিলিং-এ যেতেই রাজি হলো না। তোমার নাম কি ভাই?

আমি আমার নাম জানালুম।

সুরঞ্জন দত্তরায় বললেন, পিন্টু, এই ছেলেটিকে দেখে আমার লোভ হচ্ছে। একে আমায় দিবি?

মেজমামা অবাক হয়ে বললেন, তোকে দেব মানে? তুই ওকে তোর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাস নাকি? অ্যাঁ?

—ওকে আমার জামাই করতে পারলে খুশিই হতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার মেয়ের বিয়ে হবে না। অসুবিধা আছে। ওকে আমার অফিসে একটা চাকরি দিতে চাই। আসলে ব্যাপার কী হয়েছে জানিস, পিন্টু। আজই আমার এখানে একটা পোস্ট খালি হয়েছে। আমি ঠিক করে রেখেছিলুম, প্রথম যে ছেলেটিকে দেখে আমার পছন্দ হবে, তাকেই কাজটা দেব।

মেজমামা স্তম্ভিতভাবে প্রায় এক মিনিট তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর পাগলের মতন হাসতে লাগলেন হাত-পা ছুঁড়ে।

মেজমামার হাসি বন্ধ করার জন্য গম্ভীরভাবে বললুম, আমার তো চাকরির দরকার নেই। আমি অলরেডি এক জায়গায় কাজ করি।

সুরঞ্জন দত্তরায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তাতে কী হয়েছে। সেটা ছেড়ে দাও। চাকরি পাল্টাও। চাকরি না পাল্টালে জীবনে উন্নতি করতে পারবে না। এক জায়গায় একঘেয়ে চাকরিতে কত কিছু দেখা বাকি থেকে যায়।

মেজমামা হাসতে হাসতেই বলে যেতে লাগলেন, বাজে কথা! বাজে কথা! ও কোথাও চাকরি করে না। একেবারে কাঠ বেকার! দে, দে, ওকে একটা চাকরি দে, রুণু। আমার প্রেস্টিজ বাঁচা!

—চাকরি তো হয়েই গেল। এক্ষুনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু করে দিচ্ছি। এখন কী খাবি বল। চা-কফি-কোল্ড ড্রিংকস? বীয়ার?

–সত্যি রুণু, তুই ওকে চাকরি দিচ্ছিস? এ যে রূপকথা রে!

—দ্যাট ইজ সেটল্ড! কাল থেকে জয়েন করবে। কত মাইনে চাই?

—তুই ওর ইন্টারভিউ নিলি না, কোয়ালিফিকেশান জিজ্ঞেস করলি না। এমনি এমনি চাকরি হয়ে গেল?

—মুখ দেখেই সব বোঝা যায়। ওয়েল বিহেভড় ছেলে। স্বাস্থ্যও খারাপ না। আচ্ছা, আমি ওকে দু’-একটা কথাও জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি।

সুরঞ্জন দত্তরায় আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দৃষ্টি বোলালেন। উল্টোভাবে আর একবার।

তারপর বেশ নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ইংরিজিতে কিছু কিছু চিঠি ড্রাফ্ট করতে পারবে? শক্ত কিছু নয়, পয়েন্টগুলো আমরা বলে দেব!

আমি দারুণ জোরে মাথা নেড়ে বললুম, আজ্ঞে না। আমি ইংরিজিতে খুব কাঁচা, গ্রামার ঠিক থাকে না, প্রচুর বানান ভুল হয়।

—ঠিক আছে। তুমি অঙ্কে কী রকম? অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে সিম্পল কিছু হিসেবের কাজ। ওয়ার্কারদের মাইনের বিল বানানো।

—অসম্ভব! তাহলে কেউ মাইনেই পাবে না। আমি অঙ্কে বরাবর গাড্ডু পেয়েছি। সাতচল্লিশের সঙ্গে তিপ্পান্ন যোগ করলে কত হয়, সেটাই আমি বলতে পারব না।

মেজমামার চোখ দুটো রসগোল্লার মতন হয়ে গেছে। সুরঞ্জন দত্তরায় মুচকি মুচকি হাসছেন। মেজমামা কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই তিনি হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে আবার আমাকে বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি কিছু ঘোরাঘুরি করতে পারবে? অফিসের কাজে। এই ধরো, দুর্গাপুর, পাটনা, জামশেদপুর এই সব জায়গায় অফিসের কাগজপত্র নিয়ে যেতে হবে, ভালো ট্রাভলিং অ্যালাউয়েন্স পাবে।

আমি কাঁচুমাচু মুখ করে বললুম, দেখুন, আমি একলা কক্ষনো ট্রেনে চাপিনি জীবনে বর্ধমানের চেয়ে বেশি দূর যাইনি। আমার ভয় করে। চারদিকে কত চোর—ডাকাত ঘুরে বেড়ায়। নিজের বাড়িতেই সবাই নিশ্চিন্ত। আর একটা কথা, আমি খুব কাগজপত্র হারিয়ে ফেলি, ব্যাগ হারাই, ছাতা হারাই। আমাকে এই কাজ দেবেন না, প্লিজ, আমি পারব না!

-ঠিক আছে। তোমাকে ট্রেনে করে দূরে কোথাও যেতে হবে না। কলকাতায় ট্রামে-বাসে-ট্যাক্সিতে ঘোরার অভ্যেস নিশ্চয়ই আছে। এই কলকাতাতেই আমাদের তিনটে ব্র্যাঞ্চ, আরও পাঁচ-ছটা অফিসের সঙ্গে আমাদের রোজ কাজকারবার হয়। তোমাকে সেইসব অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। টেলিফোন তো পাওয়া যায় না সবসময়। তুমি অফিসে এসেই সই করে বেরিয়ে পড়বে, সারা দুপুর ঘোরাঘুরি করে আবার ফিরে আসবে বিকেলে।

—দুপুরবেলা? ওরে সর্বনাশ! আমার একদম রোদ্দুর সহ্য হয় না। একটু রোদ মাথায় লাগলেই সাইনোসাইটিশ! আজ বৃষ্টির দিন বলে আমি বেরিয়েছি। অন্যদিন খুব ভোর আর সন্ধের পর ছাড়া আমি বাড়ি থেকেই বেরুতে পারি না। মাপ করবেন, আমায় দুপুরবেলা ঘোরাঘুরি করতে বলবেন না।

সুরঞ্জন দত্তরায় এবার হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, বা-বা-বা-বা! এই তো চাই, এই তো চাই! ঠিক এইরকমই একজনকে চেয়েছিলুম! তুই কাকে এনেছিস রে, পিন্টু! এ যে রত্ন! আমার অফিসের পক্ষে আইডিয়াল!

এবার আমার অবাক হবার পালা!

মেজমামার মুখে আবার হাসি ছড়িয়েছে।

সুরঞ্জন দত্তরায় আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, শোনো, তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিই। আমার অফিসে দশ-বারোটা ইংলিশের এম এ গড়াগড়ি যাচ্ছে। যে—কোনো চিঠি লিখতে বললেই তারা ঝটাঝট লিখে আনে। এমনকি আমার ইংরিজিতে পর্যন্ত ভুল ধরে। তারপর ধরো অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে আছে কুড়ি—পঁচিশটা বি কম, এম কম। তারা সব সময় হিসেব করছে, কী করে বেশি ওভারটাইম পাবে, কী করে ফল্স মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেখিয়ে ছুটির মাইনে পাওয়া যায়, কী ভাবে ইনক্রিমেন্টের জন্য চাপ দিতে হয়, এইসব! কাজেই অ্যাকাউন্টসের লোকও আমার দরকার নেই। অন্য স্টাফদের মধ্যে অনেকেরই ধান্দা, কী করে পাটনা-জামসেদপুরে অফিসের ট্যুর ফেলবে। ট্রাভলিং অ্যালাউন্সের লোভ। সেকেণ্ড ক্লাসে গিয়ে ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া নেয়, শস্তায় হোটেলে থেকে টাকা বাঁচায়। আর একদল আছে, যারা অফিসে এসেই নামটি সই করে অন্য অফিসে কাজের নাম করে বেরিয়ে পড়ে। কাজ না থাকলেও যাবেই। ঐ সময়টা তারা সিনেমা দেখে, না পার্কে শুয়ে শুয়ে প্রেম করে, তা কে জানে। মোট কথা, তাদের অফিসের চেয়ারে বসিয়ে রাখাই একটা সমস্যা। দুপুর হলেই হাওয়া। সেই জন্যই আমি এমন একজন চাইছিলাম, যে সারাক্ষণ অফিসে নিজের জায়গায় বসে থাকবে। আমি যা দেখছি, বাঙালির ছেলেদের মধ্যে একমাত্র তোমারই এই যোগ্যতা আছে। আমাদের অফিস খোলে সাড়ে আটটায়। রোদ চড়া হবার আগেই তুমি চলে আসবে অফিসে। ফিরবে সূর্য অস্ত যাবার পর।

মেজমামা উঠে এসে আমার কাঁধে একটা বিরাট থাবড়া মেরে বললেন, এবার চাঁদু, পালাবে কোথায়? নিজের মুখেই স্বীকার করলি, তুই ঘোরাঘুরি পছন্দ করিস না!

তারপর সুরঞ্জন দত্তরায়ের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললেন, তুই যে কামাল করে দিলি, রুণু! উল্টো প্যাঁচে ছেলেটা একেবারে কুপোকাৎ! ছোড়দির কাছে আমার দারুণ প্রেস্টিজ বেড়ে যাবে। তুই এই ছেলেটাকে কী কাজ দিবি?

—কাজ খুব সহজ। আমাদের ডেসপ্যাচ সেকশানে সারাক্ষণ বসে থাকবে। বাইরের অনেক লোক কত জরুরি চিঠিপত্র নিয়ে আসে, অনেক সময় সীটে লোকই পায় না। এ চিঠিগুলো রিসিভ করবে, আমাদের এদিককার চিঠিগুলো শুধু এন্ট্রি করে দেবে খাতায়, পিওনরা নিয়ে যাবে। আসল কাজ হলো বসে থাকা। অফিসটাকে বাইরের লোকদের কাছে রিপ্রেজেন্ট করা।

–বাঃ, এ তো ভালো কাজ। আমি ভেবেছিলুম, টুল-ফুলে বসতে হবে বোধহয়। এ তো দেখছি চেয়ার পাবে। কত মাইনে দিবি?

—দু হাজার দিলে চলবে?

—অ্যাঁ? এত টাকা? বলিস কি? অ্যাত টাকা নিয়ে এ ছেলেটা কী করবে?

—ঠিক আছে, আড়াই হাজার?

—তুই পাগল নাকি? আমি কমাতে বলছি। বেকার ছেলে, এতদিন বাজার থেকে চুরি করা টু-পাইস ছাড়া আর কোনো রোজগার ছিল না, হঠাৎ হাতে একসঙ্গে এতগুলো টাকা পেলে মাথা ঘুরে যাবে। না, না, অত দরকার নেই।

—তা হলে তিন হাজারই পাবে। আজকাল এর কমে কারুর চলে না। এখন কয়েক মাস তিন হাজারই চলুক, পরে আবার বাড়িয়ে দেওয়া যাবে।

—তুই আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছিস না তো, রুণু? এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।

—ঠাট্টা? উপকারটা তো আমার। একজন ঠিক ঠিক লোক পেলাম।

তার পরেই তিনি ফোন তুললেন, ত্রিপাঠী, একবার এ ঘরে আসুন তো! একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি করতে হবে, আধ ঘণ্টার মধ্যেই চাই।

ফোন রেখে দিয়ে তিনি বললেন, কী আশ্চর্য যোগাযোগ। কাল মাসের পয়লা তারিখ। তুমি কাল থেকেই জয়েন করো। ওয়েলকাম টু আওয়ার অফিস। এবার একটু কফি খাওয়া যাক।

মেজমামা বললেন, তুই কবে সিঙ্গাপুর আসছিস, রুণু?

—আমি পনেরো তারিখ মালয়েশিয়া যাচ্ছি। অফিসের কাজ। ওখান থেকে সিঙ্গাপুরে কয়েকদিন থেকে আসব। আমার বউ যেতেও পারে সঙ্গে। সিঙ্গাপুরে কিছু শপিং-টপিং করবে। সেই জন্যই তোকে চিঠি লিখেছিলাম। ফরেন এক্সচেঞ্জ তো বেশি পাওয়া যাবে না। তোর বাড়িতে কয়েকটা দিন থাকা যাবে?

—আমার ভাগ্নেকে চাকরি না দিলেও তুই থাকতে পারতিস। যখন ইচ্ছে।

—তোর কোনো অসুবিধে হবে না?

—অসুবিধের কোনো প্রশ্নই নেই। গেস্টদের জন্য একখানা আলাদা ঘর রেখেছি। নতুন তোয়ালে, সাবান, টুথপেস্ট সব সাজানো আছে। বাড়িতে যা রান্না হয়, তাই খাবি।

—আমার খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঝামেলাই নেই। ডাল-ভাত আর ডিম সেদ্ধ হলেই আমার চলে যায়।

–তুই রোজ ডিমসেদ্ধ খাস?

-রোজ। দুটো করে।

—হার্ড বয়েলড?

–না, হাফ বয়েলড। ভেতরের কুসুমটা নরম থাকা চাই।

—তাই বল! এই জন্য তুই এত উন্নতি করেছিস! যে-কোনো কাজের ব্যাপারে চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারিস। ভেরি গুড! ডিম খায় না বলেই বাঙালি অফিসার জাতটা অধঃপাতে গেল। নীলু, তুই এখন থেকে প্র্যাকটিস রেখে যা।

বেয়ারা এসে কফি দিয়ে গেল। তাতে চুমুক দিতে যাচ্ছি, সুরঞ্জন দত্তরায় বললেন, থামো, থামো, এক মিনিট! আজ এরকম একটা ভালো যোগাযোগ ঘটে গেল। চলো, সেলিব্রেট করা যাক। এখন প্রায় একটা বাজে, তোমরা চলো, তোমাদের কোনো ভালো জায়গায় লাঞ্চ খাওয়াবো। কফি খেয়ে খিদে নষ্ট করো না। কিরে, পিন্টু, কোনো আপত্তি নেই তো।

মেজমামা জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, কোনো আপত্তি নেই। কোনো আপত্তি নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *