অর্ধেক মানবী – ৫

আজ সকাল থেকেই আকাশ একেবারে পরিষ্কার, ঝকঝকে রোদ উঠেছে। জল নেমে গেছে অনেক রাস্তা থেকে। প্রচুর লোক বেরিয়ে পড়েছে বাড়ি থেকে। কলকাতায় আবার স্বাভাবিক, অর্থাৎ অস্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হয়ে গেছে। আজ সারা বাড়ি আমাকে অফিস পাঠাবার জন্য ব্যস্ত। মেজমামা গলা সাধা বন্ধ রেখে আমাকে অফিসের আদবকায়দা শেখাচ্ছেন। সহকর্মীদের সঙ্গে কীভাবে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হয়, সে সম্পর্কে তিনি এত কথা বলতে লাগলেন যে আমার মনে হলো, ডেল কার্নেগির বইটা ওঁর মুখস্থ। বৌদি আমার জন্য আজ স্কুলেই গেল না। মুখখানা বেশ হাসি হাসি। আমাকে হাঁড়িকাঠে পাঠাবার জন্য ভেতরে ভেতরে তা হলে ওর খুবই ইচ্ছে ছিল। মা বলে ফেললেন, আর তো কিছু না, আত্মীয়-স্বজন সবাই বলত, নীলুটা কিছু করে না, জীবনটা নষ্ট করছে, এই কথাগুলোই আমার বুকে বাজত। এখন সবার কাছে মাথা উঁচু করে বলতে পারব, নীলু এক কথায় তিন হাজার টাকা মাইনের কাজ পেয়েছে। ওর যোগ্যতা আছে বলেই তো পেয়েছে!

আমি জীবনে কোনোদিন এত সকালে ভাত খেতে পারি না। কিন্তু মা খাওয়াবেনই। প্রথম দিন নাকি আমি ক্যান্টিন খুঁজে পাব না। সিট ছেড়ে রাস্তায় গিয়ে খাবার খাওয়াও উচিত না। মেজমামাও বললেন, খেয়ে নে। মুখের গেরাশ ফেলে যেতে নেই। ভাত খেলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে।

বৌদি দাদার একটা পুরনো ঘড়ি পরিয়ে দিল আমার হাতে।

আটটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে উঠে পড়লুম একটা মিনি বাসে।

সুরঞ্জন দত্তরায় বলে দিয়েছিলেন, আমাকে প্রথম দিন জয়েনিং রিপোর্ট দিতে হবে অফিস সুপারিনটেণ্ডেণ্ট প্রিয়নাথ মল্লিকের কাছে। দোতলায় একটা বড় হলঘর আছে, তিনি সেখানে বসেন।

কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছবার আগেই সুইং ডোরের সামনে একজন আর্দালি আমাকে আটকাল। বেশ বুড়ো মতন চেহারা হলেও চোখ দুটি তীক্ষ্ণ। হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?

আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা বাড়িয়ে দিলুম তার দিকে।

সে তিন লাইনের সংক্ষিপ্ত চিঠিখানা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ল দেড় মিনিট ধরে। তার পর বলল হুঁ, আজই জয়েনিং! এত ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এসেছেন কেন? ওবেলা এলেও পারতেন।

আমি ঘড়ি দেখে বললুম, আমাকে যে ঠিক সাড়ে আটটার মধ্যেই আসতে বলা হয়েছে। এখন ঠিক সাড়ে আটটা।

সেই বৃদ্ধটি নিজের ঘড়ি দেখে বলল, এখনো দু’ মিনিট বাকি আছে। আপনার ঘড়ি ফাস্ট। তা হলে দু’ মিনিট অপেক্ষা করুন!

দু’ মিনিট আগেও ভেতরে ঢোকা যাবে না, এখানে এত কড়াকড়ি? দাঁড়িয়ে রইলুম দেয়াল ঘেঁষে।

অন্যান্য পুরুষ ও মহিলারা গট গট করে আমার সামনে দিয়ে হলঘরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে দরজা ঠেলে, আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। আর্দালিটি নিজের টুলে বসে একটা ব্লেড দিয়ে নখ কেটে চলেছে মন দিয়ে। দু’ মিনিটের জায়গায় পাঁচ মিনিট কেটে গেল, তবু সে ভ্রূক্ষেপ করছে না।

এ তো মহা মুশকিলের ব্যাপার। প্রথম দিনেই অফিস লেট? অথচ আমার কোনো দোষ নেই। আর্দালিটির বেশ ব্যক্তিত্ব আছে, তাকে আর ঘাঁটাতে সাহস হয় না।

প্রায় মিনিট পনেরো ধরে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবার পর সে ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল। তারপর জিজ্ঞেস করল, যাবেন?

অদ্ভুত প্রশ্ন। আমি এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি কি এই বুড়োটার মুখ দেখবার জন্য? কিন্তু মাথা গরম করলে চলবে না।

আর্দালিটি আমাকে নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এল।

খবরের কাগজে-টাগজে লেখে যে বেশির ভাগ অফিসেই নাকি কর্মচারিরা ঠিক সময় আসে না, এক ঘণ্টা দু’ ঘণ্টা পরে তারা হেলতে-দুলতে ঢোকে। কিন্তু সেই বর্ণনার সঙ্গে তো এখানকার দৃশ্য মিলছে না। হলঘরটার মধ্যে প্রায় গোটা চল্লিশেক টেবিল, প্রায় প্রত্যেকটাতেই দু’জন-তিনজন করে লোক বসে আছে। অনেকেই এর মধ্যে মন দিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে।

ঢুকেই ডান পাশের বড় টেবিলটা সুপারিনটেনডেন্ট বা বড়বাবুর। তিনি হাজিরার খাতাটার পাতা ওল্টাচ্ছেন নিবিষ্টভাবে।

প্রিয়নাথ মল্লিকের নামের সঙ্গে কিংবা তাঁর পদের সঙ্গে চেহারাটা একেবারেই মেলে না। সাফারি সুট পরা এক বিশাল বলশালী পুরুষ, জামা ভেদ করে ফুটে উঠেছে তার দু’ বাহুর মাস্ল আর চওড়া বুক। গত শতাব্দীতে জলদস্যুদের সর্দার হলে এঁকে মানাত, এ যুগেও পর্বত অভিযাত্রী কিংবা বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন, তার বদলে নিছক একটা অফিসের বড়বাবু হয়েছেন। কেরানিদের বড়বাবু হতে গেলে এত বড় চেহারার কী দরকার? হিন্দি সিনেমার ভিলেন হলেও রোজগার করতে পারতেন অনেক বেশি টাকা।

আর্দালিটি বলল, বড়বাবু, এই যে এসে গেছে!

বড়বাবু আমার নিয়োগপত্র বিষয়ে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করলেন না, চিঠিখানা একবার দেখেই সরিয়ে রাখলেন পাশে। তারপর আমার মুখের দিকে খানিকটা যেন বিরক্তির দৃষ্টি দিয়ে বললেন, আজই জয়েন করতে চান, না কাল আসবেন?

আমি শুকনো গলায় বললুম, আমাকে তো আজই আসতে বলা হয়েছে। তিনি একবার নিজের হাতঘড়ি, তারপর অফিসের দেয়ালঘড়ি, তারপর আমার হাতের দিকে চেয়ে রইলেন। আপনমনে বললেন, আজই জয়েন করতে চান? ঠিক আছে। আপনি একটু দাঁড়ান।

বড়বাবু উঠে গিয়ে অন্য তিন-চারজন লোককে ডাকলেন। তারপর নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কী সব যেন আলোচনা করতে লাগলেন কয়েক মিনিট ধরে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন আমার দিকে।

আমি কি তারিখ ভুল করলাম? নাঃ, আজ তো পয়লা তারিখ ঠিকই। চিঠিতে সেই তারিখই লেখা আছে। অথচ আজ এসে পড়ে যেন কোনো অন্যায় করে ফেলেছি!

একটু পরে বড়বাবু ফিরে এসে বললেন, ঠিক আছে। জয়েন করুন। আসুন আমার সঙ্গে।

বাঁ দিকে একেবারে কোণের একটা টেবিলের কাছে এসে তিনি বললেন, বসুন এখানে। ঐ পুরোনো গেলাশে জল খাবেন না, একটা নতুন গেলাশ দিচ্ছে। পিন, জেমস ক্লীপ যা দরকার হবে, চেয়ে নেবেন।

তারপর তিনি চলে যেতে যেতে হাঁক দিলেন, এই বৈকুণ্ঠ, এখানে একটা গেলাশ দিয়ে যাও!

টেবিলটা ছোট, একদিকে প্রচুর চিঠিপত্র, তার ওপরে তিন-চারখানা পেপার ওয়েট। আর কোনো জিনিস নেই।

আমি সন্তর্পণে চেয়ারটায় বসলুম।

দু’পাশের টেবিলে কয়েকজন খুব মন দিয়ে কাজ করছেন। একবার তাকালেনও না আমার দিকে। কাছাকাছি সব টেবিলের কর্মীরাই কাজে খুব মগ্ন। দু’জন মহিলাও রয়েছেন, কেউ একটা শব্দও উচ্চারণ করছেন না।

এ কোথায় এলুম রে বাবা!

আমার ধারণা ছিল, নতুন কেউ কাজে যোগ দিতে এলে সবাই তাকে ঘিরে ধরে। আলাপ পরিচয় করে, কাজ বুঝিয়ে দেয়। কেউ কেউ হয়তো বলতেও পারে, চাকরি পেয়েছেন, প্রথম দিন খাওয়ান আমাদের। সেই জন্য মেজমামা আমাকে একটা একশো টাকার নোটও গুঁজে দিয়েছেন পকেটে। কিন্তু কেউ কোনো কথাই বলছে না এখানে!

গোমড়ামুখো বড়বাবুটি আমাকে কোনো কাজের কথাও বুঝিয়ে দিলেন না। প্রথম দিন একটু সাহায্য না করলে কেউ কাজ শুরু করতে পারে? আমি কি বসে বসে শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকব?

টেবিলটার দু’পাশে চারখানা ড্রয়ার। একটা ড্রয়ার টেনে খুললুম। তার মধ্যে দুটো দেশলাই, একটা নস্যির কৌটো, কোনো ব্যাঙ্কের পাশবই, কিছু খুচরো পয়সা, এইসব রয়েছে। এই রে, অন্য কারুর জিনিস!

ঝট করে বন্ধ করে দিলুম ড্রয়ারটা। অন্যগুলো খুলতে সাহস হলো না।

এই টেবিলে, এই চেয়ারে অন্য একজন বসত, সে হয়তো প্রমোশন পেয়ে কিংবা অন্য চাকরিতে চলে গেছে। নিজের ব্যক্তিগত জিনিসগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি কেন? যে-কোনো সময় লোকটা হয়তো আসবে, এলে বলবে, অ্যাই, আমার ড্রয়ারে হাত দিয়েছ কেন?

ডেল কার্নেগির এক নম্বর উপদেশই হচ্ছে, প্রথম দিন অফিসে গিয়ে সব সহকর্মীদের দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকাবে। কেউ যেন তোমাকে গোমড়া কিংবা চালিয়াৎ বলে মনে না করে। (আমি ডেল কার্নেগির বই পড়া দূরে থাক, কখনো সে বই চোখেও দেখিনি। মেজমামা উবাচ।)

কিন্তু যাদের দিকেই তাকাই, কেউ আমার চোখে চোখ ফেলে না পর্যন্ত, চট করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এমনকি মহিলারাও! আমার চেহারা কি এতই কুৎসিত? কিংবা কোনো রেপ কেসের আসামীর সঙ্গে আমার মুখের মিল আছে?

একজন ছোকরামতন বেয়ারা আমার টেবিলে একটা জলভর্তি গেলাশ রেখে বলল, এই নিন! আর কিছু লাগলে বলবেন।

ছোকরাটির মুখের রেখায় ও চোখের ভঙ্গিতে যেন সূক্ষ্ম বিদ্রূপের হাসির ইঙ্গিত। আমার কিছু লাগবে কিনা তা না শুনেই সে পেছন ফিরল।

র‍্যাগিং? ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারি কলেজগুলোতে প্রথম বছরের ছাত্রদের ওপর যে-রকম র‍্যাগিং করা হয়, এই কমার্শিয়াল ফার্মগুলোতেও সেরকম প্রথা আছে নাকি? তা ছাড়া এদের এরকম অদ্ভুত ব্যবহারের আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে!

একজন মধ্যবয়স্ক লোক অন্যান্য টেবিল কাটিয়ে আমারটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে, একগাদা বন্ধ খাম ও খোলা চিঠি হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, এই নাও ভাই, এগুলো ফ্রান্স, কানাডা আর দুর্গাপুরে যাবে। আর বাকিগুলো যাবে আমাদের বম্বে অফিসে। দীনেন, চিঠিগুলো ফেলে রেখ না, আজই পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করো!

হঠাৎ তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে গিয়ে বললেন, আরে এ কে? এ তো দীনেন নয়?

আমি খুবই বিনীতভাবে বললুম, আজ্ঞে, আমি আজ থেকে জয়েন করেছি। নতুন।

ভদ্রলোক কেমন যেন উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে গেলেন। ডান দিকে বাঁ দিকে তাকাতেই অন্য কয়েকটি টেবিল থেকে কয়েকজন হা-হা করে হেসে উঠল। কেউ কেউ আরও বেশি মজা করবার জন্য চাপড় মারতে লাগল টেবিলে।

মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি টেবিলের ওপর থেকে সব কটা চিঠি খামচে তুলে নিয়ে দ্রুত ফিরে গেলেন। বাক্যব্যয় করলেন না আর একটিও!

অন্যদের হাসিতে যোগদান করার জন্য আমি মাথা ফেরাতেই আবার সবার মুখে কুলুপ, সবারই কাজের প্রতি খুব মনোযোগ!

একটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে লাঞ্চ আওয়ারে ফাঁকা হয়ে গেল অফিস।

আমি সকালে ভাত খেয়ে এসেছি, এখন খিদে পাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া আমার চাকরির শর্তই হচ্ছে সর্বক্ষণ চেয়ারে বসে থাকা। প্রথম এক বেলা আমি কোনো কাজই করিনি বলে আমার অস্বস্তি লাগছে। কিছু কাজ না করেও কি মাইনে নেওয়া উচিত?

অবশ্য কাজে ফাঁকি সবাই দেয়। ফাঁকি না দিলে ওভারটাইম হবে কী করে? কাজের ভান করেও অনেক সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমাকে তো কোনো কাজই দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে থেকে কয়েকজন পিওন চিঠিপত্র নিয়ে এসেছে, আমি দেখেছি, কিন্তু তাকে আমার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছতেই দেওয়া হয়নি, অন্য কেউ না কেউ তাকে ডেকে তার সব চিঠিপত্র নিয়ে নিচ্ছে

এ-রকম র‍্যাগিং ক’দিন চলে?

লাঞ্চের পর কিন্তু সকলে ফিরল না। সুরঞ্জনবাবু বলেছিলেন, দুপুরবেলা রাস্তায় টো টো করে ঘুরে বেড়ানো তাঁর অধিকাংশ কর্মচারির বাতিক। টেবিলগুলো ফাঁকা ফাঁকা দেখাচ্ছে। সকালে যারা কাজে মনোযোগী ছিল, এখন তারা মেতে উঠল গল্পে। এর মধ্যে একজন কেউ আমার নাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না।

একেবারে চুপ করে কতক্ষণ বসে থাকা যায়?

মানুষের দু’ চোখের মাঝখানে একটা নাক থাকে, কিন্তু এত কাছের জিনিসটাকেও মানুষ অধিকাংশ সময়েই দেখতে পায় না। এখন আমি শুধু নাকটাকেই দেখতে পাচ্ছি!

টেবিলের এক পাশে যে সব পুরনো চিঠিপত্র ছিল, সেগুলোই পড়তে শুরু করে দিলাম। খুব যে একটা পাঠযোগ্য জিনিস তা বলা যায় না, সব চিঠিই প্রায় একরকম, মালপত্র সাপ্লাই, স্পেয়ার পার্টস, র মেটেরিয়ালস, টেণ্ডার, হ্যানো—ত্যানো। তবু যেমনভাবে আমি চিঠিগুলো পড়ে যেতে লাগলুম, তেমন তন্ময়ভাবে ইস্কুলে লেখাপড়া করলে আমি প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হতুম।

হঠাৎ আমার ঠোটে একটা দুঃখ-দুঃখ স্বাদ এসে গেল। পেটের ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে উঠছে অভিমান। আমি তো কারুর কোনো ক্ষতি করিনি, তবু এই লোকগুলো আমাকে এমন অবহেলা করছে কেন? মানুষ মানুষকে অকারণে কেন আঘাত দেয়! সবাইকে দেখে ভদ্র, সভ্য, শিক্ষিত মনে হয়, ওরা কি বুঝতে পারছে না, একজন নতুন লোককে এভাবে অগ্রাহ্য করলে তার মনে কতখানি লাগে? এরকম র‍্যাগিং যদি দু’-তিনদিনও চলে, তা হলে আমি এ চাকরি রাখতে পারব না! আমার ব্যবহারে কি কোনো ত্রুটি হয়েছে? নতুন যে আসে, তারই কি ডেকে ডেকে সবার সঙ্গে আলাপ করা উচিত? আমি নিজের থেকে কিছু বলিনি বলেই কেউ আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করছে না?

ঠিক আছে, একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক।

মেয়েরা যেমনভাবে লিপস্টিক মাখে, সেইরকম ভাবে আমি ঠোটে আঙুল ঘষে ঘষে দুঃখ মুছে ফেলে হাসি আঁকলুম।

আমার পাশের টেবিলটা ফাঁকা হয়ে গেছে। তার পরের টেবিলে বসে আছেন একজন মাঝারি বয়েসের, রোগা চেহারার মানুষ। মুখটা অন্য দিকে ফেরানো।

আমি বেশ জোরে বললুম, নমস্কার! আমি নতুন এসেছি, আমাকে একটু কাজ বুঝিয়ে দেবেন? যদি দয়া করে একটুখানি…

ভদ্রলোকটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সাড়ম্বরে অন্য একজনকে বলল, ব্যানার্জি, আমি এখন চললুম, আমাকে আজ একবার দমদম যেতে হবে!

আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তিনি চলে গেলেন টেবিল ছেড়ে।

ব্যানার্জি নামে উক্ত ভদ্রলোকটি বললেন, কাজের আঠা! নতুন নতুন যারা আসে, তারা খুব কাজের ক্যারদানি দেখাতে চায়, বুঝলেন দাদা!

আমার মনে হলো, ওরা আমার গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারছে।

দুপুরটা যারা বাইরে কাটাতে গিয়েছিল, তারা কেউ কেউ ফিরে এল বিকেলের দিকে। এসেই টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে তারা আবার বেরিয়ে যেতে লাগল। এ অফিস ছুটি হয় সাড়ে চারটেয়।

দেয়ালঘড়িতে ঠিক সাড়ে চারটে বাজতে দেখে আমিও টেবিল ত্যাগ করলুম। কিছুই কাজ করিনি, তবু সারা শরীর অবসন্ন হয়ে গেছে। এমনভাবে আমি কখনো হেরে যাইনি।

চাকরি এই জিনিস? আজই এই চাকরির মাথায় পদাঘাত করা উচিত আমার। কিন্তু বাড়িতে সিংহের মত ওঁৎ পেতে বসে আছেন সিঙ্গাপুরের মেজমামা। আমি বেকার থাকলে আত্মীয়-স্বজনের কাছে মায়ের সম্মান নষ্ট হয়। বৌদি অন্য সময় আমার সবরকম খামখেয়ালিপনায় তোল্লা দিলেও মনে মনে তার ইচ্ছে, সংসারে আরও কিছু টাকা আসুক। দাদা ফিরে এসে যদি শোনে আমি তিন হাজার টাকার একটা চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিয়েছি, তা হলে নির্ঘাৎ বলবে, এখন থেকে মল্লিকবাড়ির লঙ্গরখানায় ভিখিরিদের সঙ্গে বসে খাবি।

বড়বাবুর টেবিলের পাশ দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ মনে হলো, আমি তো কোনো হাজিরা খাতায় সই করিনি? অফিসে কাজ করতে গেলে এরকম একটা নিয়ম থাকে না?

মল্লবীরের মতন চেহারার বড়বাবু একটা ফাইলে ঘ্যাস ঘ্যাস করে কী যেন লিখে যাচ্ছেন। একবার মুখ তুলতেই আমি বললুম, আমাকে কোনো জায়গায় সই-টই করতে হবে না?

তিনি ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু আপনি তো জয়েনিং রিপোর্ট দেননি?

—জয়েনিং রিপোর্ট?

—আজ থেকে যে জয়েন করলেন, সেটা চিঠি দিয়ে জানাতে হবে না? অদ্ভুত ব্যাপার! আমি কি আগে সাত ঘাটের জল খেয়ে এসেছি যে এসব ব্যাপার জানব? প্রথমেই কি ওঁর বলে দেওয়া উচিত ছিল না? আমি কি ওঁর শত্রু? আমাকে কোনো কাজ দেওয়া হয়নি, খাতাতেও সই করলুম না, অর্থাৎ আমি যে আজ এসেছি, তার কোনো প্রমাণই রইল না।

জেদ চেপে গেল। খানিকটা কড়া গলায় বললুম, আপনি কিছু বলেননি। এখন লিখে দিচ্ছি!

—লিখুন!

—একটা সাদা কাগজ পেতে পারি?

—খুঁজে নিন।

ওঁর টেবিলেই একটা সাদা কাগজের প্যাড রয়েছে। সেটা তুলে নিয়েই লিখে দিলুম তিন লাইনের চিঠি। তারপর জিজ্ঞেস করলুম, খাতা?

তিনি একটা ড্রয়ার খুলে অত্যন্ত বিতৃষ্ণার সঙ্গে বার করলেন একটা লম্বা খাতা। একটা পাতায় আমার নাম লিখলেন, তারপর ধমকের সুরে বললেন, নিন!

মানুষকে বেশি অপমান করতে নেই, তা এরা জানে না। কোণঠাসা বেড়াল এক সময় হিংস্র হয়ে কামড়ে দিতে আসে। আমারও বুক থেকে দুঃখ-অপমান মুছে গিয়ে জ্বলে উঠেছে রাগ। কাল এসে এই লোকটাকে বলব, কাজ দিন আমাকে। ভেবেছেন কি?

সুরঞ্জন দত্তরায় বলে দিয়েছিলেন, আমাকে না ডাকলে আমি যেন তাঁর ঘরে না যাই। প্রথম দিন যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ না করি। মালিকপক্ষের সঙ্গে বেশি ভাব দেখালে অন্য সহকর্মীরা হিংসে করে, পেছনে লাগে। ঠিক আছে, আমি সুরঞ্জনবাবুর কাছে নালিশ জানাব না, কাল থেকে নিজের দাবি আদায় করে নেব। চাকরি যখন পেয়েইছি, তখন অন্তত এক মাসের মাইনে না নিয়ে ছাড়ছি না। অফিসের বাইরের বাতাসটাই অন্যরকম। চমৎকার মুক্তির স্বাদ। বেশ স্বাধীন মানুষের মতন একটা সিগারেট ধরালুম। দাঁতে দাঁত চেপে তিরিশটা দিন পার করতেই হবে। তারপর দেখা যাবে।

একটা ছোট গলি দিয়ে খানিকটা গিয়ে বড় রাস্তায় পড়া যায়। সেখানে পৌঁছবার আগেই একটা ট্যাক্সি থামল আমার গা ঘেঁষে। হুট করে দরজা খুলে নেমে এল দু’জন লোক। আমাকে দু’ দিক থেকে চেপে ধরে বলল, গাড়িতে উঠুন! আমি কিছু বলার চেষ্টা করতেই একজন আমার মুখে হাত-চাপা দিয়ে বলল, গোলমাল করবেন না। উঠুন, উঠুন!

ওরা আমাকে ঠেলতে লাগল ট্যাক্সির দরজার দিকে।

রাস্তাটা ছোট হলেও কিছু লোকজন চলাফেরা করছে। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একজন বাদামওয়ালা। কেউ এই দৃশ্যটি নিয়ে মাথা ঘামাল না।

ভয় পাবার বদলে আমার একটু মজাই লাগল। আমাকে গুম করছে? এরা কারা? আমি কি একটা মূল্যবান জিনিস? আমি কোনো সুন্দরী মেয়েও নই, কোনো ধনী ব্যবসায়ীর আদরের ছোট ছেলেও নই। আমাকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করেছে? দেখতে হচ্ছে, ব্যাপারটা কোন দিকে গড়ায়! সারা দিন এক চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকার পর এরকম একটা রোমাঞ্চকর ঘটনা মন্দ কি!

ট্যাক্সির মধ্যে আর একটি লোক বসে আছে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে। ট্যাক্সিটা বড় রাস্তায় পড়ে বেশ স্পিড নিতে সেই লোকটি আমার দিকে চেয়ে বলল, ভয়ের কিছু নেই। আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।

লোকটিকে চিনতে অসুবিধে হলো না। আমার নবলব্ধ চাকরির একজন সহকর্মী। একজন একে ব্যানার্জিদা বলে ডেকেছিল। এই লোকটি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল একটি বিদ্রূপ বাক্য। ·

আমি বললুম, আলাপ করার কায়দাটা একটু নতুন, তাই না?

লোকটি বলল, বললাম তো, ভয়ের কিছু নেই। আপনি চুপচাপ বসে থাকুন। চ্যাঁচামেচি করে রাস্তার লোক ডাকার চেষ্টা করবেন না!

অন্য দু’জন বসেছে ট্যাক্সি ড্রাইভারের পাশে। কারুর হাতেই পিস্তল কিংবা ছুরি-টুরি কিছু নেই। খামোখা এদের ভয় পেতে যাব কেন? আমি চ্যাঁচামেচি করলেও রাস্তার লোক নিশ্চয়ই আমাকে পাগল ভাববে। এরকম একটা দামড়া লোককে কেউ ফটফটে দিনের আলোয় ধরে নিয়ে যায়?

সারাদিন ধরে আমার প্রতি যেরকম অপমানজনক ব্যবহার করেছে, তার শোধ নেবার এই তো প্রকৃষ্ট সময়।

আমি বললুম, এই অফিসে তো ভালোই মাইনে দেয় শুনেছি। আপনি বুঝি তার পরেও পার্ট টাইম গুণ্ডামি করেন?

ব্যানার্জি নামের সেই ভদ্রলোক বললেন, একটু পরেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন!

সামনের সিট থেকে একজন বলল, সিগারেটটা আপনার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল, আপনি ইচ্ছে করলে আর একটা ধরাতে পারেন। এই নিন।

আমি লোকটির প্যাকেট সুদ্ধু বাড়ানো হাতটি ঠিলে দিয়ে বললুম, থ্যাঙ্ক ইউ! আপনারা কোন্ দিকে যাচ্ছেন? আমি কিন্তু হাজরা মোড়ে নামব!

সেই লোকটি বলল, আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য একটা অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে।

—এটাও বুঝি র‍্যাগিং-এর অঙ্গ?

—র‍্যাগিং?

–সারা দিন কেউ আমার সঙ্গে একটাও কথা বলল না, হঠাৎ এখন জোর করে আলাপ করাবার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এর মানে কি? আমি আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে ইন্টারেস্টেড নই!

–আপনি হাজিরা খাতায় জোর করে সই করলেন কেন? তা না হলে আমাদের এই স্টেপ নিতে হতো না।

—জোর করে সই করলুম মানে? অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেলেও খাতায় সই করার অধিকার জন্মায় না বুঝি?

–আমরা যেখানে যাচ্ছি, আগে সেখানে পৌঁছই, তারপর সব কথা হবে। সব কটা জানলার কাঁচ তোলা। ট্যাক্সির ড্রাইভারটিও নিশ্চয়ই এদের চেনা, সে ঘাড় ফিরিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

সামনের সিট থেকে আর একজন বলল, আপনি মশাই সর্বক্ষণ চেয়ারে সেঁটে বসে রইলেন, একবারও উঠলেন না, বাথরুমে পর্যন্ত গেলেন না?

অন্য দু’জন হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে উঠল!

আমি বললুম, কেন, বাথরুমটাই বুঝি আপনাদের আলাপ করার জায়গা?

এবার ওরা সবাই মিলে, ট্যাক্সি ড্রাইভার সমেত একসঙ্গে হেসে উঠল। এটা কী এমন হাসির কথা যে এদের হাসি থামতেই চায় না!

1 Comment
Collapse Comments

বাহ কি অনবদ্য লেখনী। মুগ্ধ হয়ে শুধু পড়েই যাচ্ছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *