৬
ট্যাক্সিটা ময়দান ছাড়িয়ে চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে একবালপুরের দিকে ঢুকে গেল। এই দিককার রাস্তাঘাট আমার ভালো চেনা নেই। কিছু কিছু বস্তি, আবার কিছু কিছু দারুণ হালফ্যাশানের বাড়ি।
অনেক গলিঘুঁজি ঘুরে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামান হলো। ব্যানার্জি নিজে আগে নেমে গিয়ে বলল, আসুন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলুম ওপরে। একটা দরজায় ধাক্কা দেবার আগেই সেটা খুলে গেল, মনে হয় ট্যাক্সি থামবার আওয়াজ পেয়ে কেউ জানলা থেকে উঁকি মেরে দেখে ছিল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা, বছর তিরিশেক বয়েস।
তার দৃষ্টি দেখেই মনে হলো, বাকি তিনজনকে সে চেনে, আমার দিকে অস্বস্তিকর ভাবে কয়েক মূহূর্ত তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, ব্যানার্জিদা?
ব্যানার্জি আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, এই যে, এ তোমার স্বামীর কাউন্টার পার্ট। তোমাদের সঙ্গে আলাপ করবার জন্য নিয়ে এলাম।
মহিলা বলল, এই, যাঃ কী করেছেন, ব্যানার্জিদা, না, না, ছি, ছি, ছি। এ রকম কেন করলেন?
ব্যানার্জি বলল, আরে আমাদের ভেতরে বসতে দাও! দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকবে?
অন্য দু’জনের একজন বলল, তোমরা বসো, আমি ট্যাক্সিটা ছেড়ে আসছি।
দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা ছোট ঘর, একটা সরু চৌকির ওপর সতরঞ্চি পাতা, আর কয়েকটা মোড়া রয়েছে ছড়ানো, চেয়ার টেয়ার কিছু নেই। একটা। দেয়ালে একখানা শেতলপাটি সেঁটে সাজাবার চেষ্টা করা হয়েছে, খুব সম্ভবত ওই দেয়ালের প্লাস্টার খসে গেছে, পাটি দিয়ে ঢাকা হয়েছে সেই জায়গাটা।
মহিলাটি আমার দিকে বার বার কুণ্ঠিতভাবে চাইতে চাইতে ব্যানার্জিকে বলল, এটা মোটেই আপনার উচিত হয়নি। শুধু শুধু ওঁকে টেনে আনলেন কেন?
ব্যানার্জি চৌকির ওপর বসে পড়ে বলল, বসুন, ভাই বসুন। আগে আলাপ পরিচয়টা সেরে নিই। আমার নাম পল্লব ব্যানার্জি, আমি আছি পার্সোনেল ডিপার্টমেন্টে। স্টাফ ইউনিয়ানের আমি সেক্রেটারি।
পাশের লোকটাকে দেখিয়ে বলল, এ হচ্ছে পরিতোষ সান্যাল, অ্যাকাউন্টসে আছে, আর যে নীচে গেল, এক্ষুনি আসছে, সে হচ্ছে অরিন্দম দাস, সে ইউনিয়ানের একজন কমিটি মেম্বার আর এই মেয়েটি মণিকা দত্ত।
মেয়েটি লজ্জিত মুখে হাত জোড় করে নমস্কার করল, আমিও তাকে প্রতি নমস্কার জানালুম।
পল্লব ব্যানার্জি বলল, মণিকা, তোমার পতিদেবতাটি কোথায়?
মণিকা বলল, ঘুমোচ্ছে। সারাদিন ঘুমোয়। না ঘুমোলেও বিছানায় শুয়ে থাকে।
পল্লব ব্যানার্জি বলল, ভালো, ভালো, ঘুমোনো ভালো। এখন একবার ডাকো। এই ভদ্দরলোকের সঙ্গে আলাপ করুন।
মণিকা পাশের দরজা দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। পল্লব ব্যানার্জি একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার দিকে অপলক ভাবে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে আচমকা জিজ্ঞেস করল, আপনি বিয়ে করেছেন?
আমার বলতে ইচ্ছে হলো, আপনার ঘটকালির ব্যাবসা আছে নাকি? কিন্তু মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়লুম দু’ দিকে।
—আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
—আমাকে এরকম ভাবে জেরা করছেন কেন বলুন তো?
পল্লব ব্যানার্জি আপন মনে হাসল।
মণিকা ফিরে এসে কুণ্ঠিত গলায় বলল, ও কিছুতেই উঠতে চাইছে না।
—জেগে আছে?
—হ্যাঁ, জেগে আছে, কিন্তু আসতে চাইছে না এ ঘরে।
—ঠিক আছে, তা হলে আমরাই যাচ্ছি ওই ঘরে?
পল্লব ব্যানার্জি উঠে দাঁড়িয়ে খুব নরম গলায় আমাকে বলল, একবার একটু চলুন পাশের ঘরে। আসুন, আসুন, লজ্জা করবার কিছু নেই।
পাশের ঘরটি অত্যন্ত অগোছালো। এখানে সেখানে জামাকাপড় আর এঁটো কাপ ছড়ানো। বড় একটা খাটের ওপর কোঁচকানো চাদর আর ওয়াড়হীন কয়েকটা বালিশের মধ্যে শুয়ে আছে একজন বেশ লম্বা মতন লোক, মুখে পাঁচ-সাত দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। খালি গা, বেশ লোমশ বুক, শুধু পাজামা পরা।
ঘরে ঢুকেই অবশ্য প্রথম দৃষ্টি পড়ে একটা দোলনার ওপর। অন্য সব কিছুর তুলনায় সেই দোলনাটি অনেক দামি, তাতে শুয়ে আছে দুটি ফুটফুটে শিশু। তাদের বয়েস বছর খানেক হবে, হুবহু একরকম দেখতে। এমনই সুন্দর যে মনে হয়, দুটি যমজ জাপানী পুতুল। আদর করতে ইচ্ছে করে।
বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটি বেশ ক্ষোভের সঙ্গে বলল, পল্লবদা, কেন আপনি আমাদের লজ্জায় ফেলছেন বলুন তো? ভদ্দরলোককে কেন এখানে টেনে এনেছেন? …
সে কথা গ্রাহ্য না করে পল্লব ব্যানার্জি আমাকে বলল, এই হচ্ছে দীনেন বোস। আপনি আজ সারাদিন এর চেয়ারে বসেছিলেন। দীনেনকে চাকরি থেকে সাসপেণ্ড করা হয়েছে। .
আমার সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল দুটো কথা। মেজমামার বন্ধু নির্মল পত্রনবীশ প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ফিসফিস করে বলেছিলেন, সব চাকরি শেষ। এ জেনারেশনের আর কেউ নতুন চাকরি পাবে না!
শিবরাম চক্রবর্তীর একটা গল্পে পড়েছিলাম, একটা চলন্ত দারুণ ভিড়ে ভর্তি বাসের সামনের দরজা দিয়ে একজন লোক জোর করে ঠেলেঠুলে উঠল, আর অমনি পেছনের দরজা দিয়ে একজন টুপ করে খসে পড়ে গেল।
আমি এই দীনেন বোসকে ঠেলে ফেলে দিয়েছি!
পল্লব ব্যানার্জি বলল, দীনেন ওর কাজে দু’-একটা ভুল করেছিল। তিনখানা জরুরি চিঠি মিসপ্লেসড হয়েছে, এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভুল কি মানুষের হয় না? সকলেরই ভুল হতে পারে।
দীনেন বলল, আঃ ওসব কথা থাক না। যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
দোলনায় বাচ্চা দুটো কেঁদে উঠল একসঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে মণিকা ছুটে এসে তাদের কোলে তুলে নিল। দুজনকেই। কোনো মায়ের বক্ষে একসঙ্গে দু’ দিকে দুটি সন্তান, এই দৃশ্য আমি আগে কখনো দেখিনি।
বাচ্চা দুটো তাদের মায়ের রূপ পেয়েছে।
ওদের বাবার চেহারাও খারাপ নয়, তবে গায়ের রং আমারই মতন কালো।
অরিন্দম নামে যে লোকটি ট্যাক্সির ভাড়া মেটাতে গিয়েছিল, সে ফিরে এল এক ঠোঙা সিঙ্গাড়া নিয়ে, সঙ্গে একটি বাচ্চা ছেলে, তার হাতে কেলি ভর্তি চা আর কয়েকটা মাটির ভাঁড়।
মণিকা বলল, এ কী, আমি বুঝি চা করে দিতে পারতুম না?
অরিন্দম বলল, কেন শুধু শুধু ঝঞ্ঝাট করবি! এই তো পাশেই দোকান। আমরা সবাই এখানেই বসে আলোচনাটা সেরে নিই।
দীনেন বিরক্ত ভাবে বলল, আলোচনার কী আছে? আমার যা বলার, তা তো বলেই দিয়েছি।
অরিন্দম বলল, না, তোমার কথা শোনা হবে না। সবাই মিলে কথা বলে একটা ডিসিশান নিতে হবে। কী বলুন, ব্যানার্জিদা।
পল্লব ব্যানার্জি বলল, নিশ্চয়ই, সেইজন্যই তো এসেছি!
ভাঁড়ে চা ঢেলে প্রথমটাই আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে অরিন্দম বলল, নিন। সিঙ্গাড়া তুলে নিন, গরম আছে। আপনাকে জোর করে ধরে এনেছি, সে জন্য কিছু মাইণ্ড করেননি তো? ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস!
আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা সরছে না।
খাটের পাশেই বসে পড়ল অন্যরা। আমার জন্য একটা মোড়া এনে দিল ব্যানার্জি। অচেনা কারুর বিছানায় বাইরের লোক এসে বসে না। পরিতোষ নামের লোকটি একটি কথাও বলছে না। দীনেন বিছানাতে আধ শোওয়া হয়েই রইল। তার মুখখানিতে বিরক্তি মাখান।
অরিন্দম বলল, মিঃ নীললোহিত, এই মণিকা আমার মাসতুতো বোন। একেবারে আপন নয়, তবে ছোটবেলা থেকেই খুব ক্লোজ। দীনেন ওকে বিয়ে করেছে দু’ বছর আগে। বিয়েটা আমার মাসি আর মেসো কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। ওঁরা বড্ড জেদি। সে যাই হোক, ওরা এখানে আলাদা সংসার পেতেছে, কী সুন্দর যমজ বাচ্চা হয়েছে, দেখছেন তো! মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ এই কাণ্ড। দু’ মাস ধরে দীনেনকে সাসপেণ্ড করা হয়েছে।
পল্লব ব্যানার্জি বলল, আমরা এই নিয়ে আন্দোলন করব ঠিক করেছিলাম। পেন ডাউন স্ট্রাইকের কথা ঘোষণাও করা হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই দীনেনকে নিয়ে। ও কিছুতেই আন্দোলন করতে রাজি নয়। ওর ধারণা, ও দোষ করেছে, তাই শাস্তি পেয়েছে। আবার সে জন্য ক্ষমাও চাইবে না। দেখুন তো, কী পাগলামি!
আমার এক হাতে সিঙ্গাড়া, আর এক হাতে চায়ের ভাঁড়, কোনোটাই মুখে দিতে পারছি না। সকলের চোখ আমার দিকে, আমি যেন আসামী!
অরিন্দম বলল, এর মধ্যে দীনেন আর একটা কাণ্ড করেছিল। একদিন বউ—বাচ্চাদের ফেলে উধাও হয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। সন্ন্যাসী হয়ে যাবার তালে ছিল। এই পরিতোষ থাকে চন্দননগরে, ও ভাগ্যিস দীনেনকে দেখতে পেয়ে গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনে।
এতক্ষণের নীরবতা ভেঙে. পরিতোষ বলল, সেদিন দীনেন একেবারে উল্টোপাল্টা কথা বলছিল। ঠিক পাগলের মতন।
দীনেন বলে উঠল, তোমরা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেন এত মাথা গলাচ্ছ?
অরিন্দম ধমক দিয়ে বলল, চোপ! ব্যক্তিগত ব্যাপার মানে, মণিকা আর বাচ্চা দুটোকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে!
দীনেন বলল, আমি সরে গেলেই মণিকাকে ওর বাবা-মা ফেরৎ নিয়ে নেবে। রাগ তো শুধু আমার ওপর!
অরিন্দম বলল, কাওয়ার্ডের মতন কথা বলো না। তুমি প্রেম করে বিয়ে করেছ, এখন তুমি বউয়ের দায়িত্ব নেবে না?
মণিকা বলল, আমি মরে গেলেও বাপের বাড়িতে কোনোদিন ফিরে যাব না। আমি একটা স্কুলের চাকরির চেষ্টা করছি!
পল্লব বলল, ইউনিয়ান থেকে কোম্পানিকে আমরা বলে দিয়েছি, দীনেনকে একটা ওয়ার্নিং দিয়ে ফেরৎ নিতে হবে। ওর জায়গায় কোনো নতুন লোককে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলে আমরা বরদাস্ত করব না। তবু আমাদের কিছু না জানিয়ে আপনাকে চাকরি দিয়ে দিল? ঐ সুরঞ্জন দত্তরায় শালা একটা ঝানু বদমাস কোম্পানির যত বে-আইনী কাজে ও মদত দেয়।
অরিন্দম বলল, ওটা কত বড় হারামজাদা, আজ আপনাকে জয়েন করতে বলে নিজে ডুব মেরেছে, অফিসেই আসেনি। আমরা যে ওকে প্রটেস্ট জানাতে যাব, তারও উপায় নেই। আপনি চিঠি দেখিয়ে জয়েন করতে চাইলে বড়বাবু টেকনিক্যালি আপত্তি করতে পারেন না।
পল্লব বলল, আপনি খাতায় সই করলেন, তাতে আপনার রাইট এসটাব্লিসড হয়ে গেল!
অরিন্দম বলল, এরপর আপনাকে সরাতে চাইলে আপনি মামলা করতে পারেন।
দীনেন আবার তেড়ে উঠে বলল, এ ভদ্রলোকের কী দোষ? ইনি চাকরি পেলে নেবেন না কেন? এই বাজারে চাকরি’ পেলে কেউ ছাড়ে?
আমার মাথার মধ্যে চিড়িক চিড়িক ব্যথাটা হঠাৎ শুরু হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে।
মণিকা বাচ্চা দুটিকে আবার নামিয়ে দিয়েছে দোলনায়। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না। আমরা কিন্তু আপনাকে এভাবে নিয়ে আসতে বলিনি এখানে!
অরিন্দম দীনেনকে বলল, একটা বদনাম নিয়ে চাকরি হারালে তুমি জীবনে আর কখনো চাকরি পাবে?
দীনেন বলল, আমি এ ভাবে আর জীবন কাটাতে পারছি না। আমি কাওয়ার্ড! আমি অপদার্থ! আমি মণিকাকে মুক্তি দিয়ে চলে যাব!
মণিকাকে বেশ ব্যক্তিত্বময়ী মনে হয়েছিল। এবার সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। স্বামীর মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনলে যে-কোনো মেয়ে অপমানিত বোধ করবেই।
একটুক্ষণ সবাই চুপ করে থেকে মণিকাকে সামলে নেবার সুযোগ দিল।
তারপর পল্লব বলল, আপনি সব জেনেশুনেও এ চাকরি করতে পারবেন? দীনেন একটু আলাভোলা ধরনের হলেও সরল, ভালো মানুষ। অফিসের সবাই ওকে পছন্দ করে। আপনার ওখানে কাজ করতে খুবই অসুবিধে হবে। আপনি এখনো বিয়ে করেননি। আপনার দায়িত্ব কম, কিন্তু দীনেন বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার পেতে বসেছে।
অরিন্দম বলল, আপনি যদি চাকরিটা আঁকড়ে থাকতে চান, আর দীনেন আবার বাড়ি ছেড়ে পালায়, তা হলে মণিকা, তার দুটি বাচ্চা, এই ফ্ল্যাটের ভাড়া, এই সব কিছুর দায়িত্ব মরালি আপনারই নেওয়া উচিত।
মণিকা মুখ ফিরিয়ে দীপ্ত কণ্ঠে বলল, ছিঃ! কী সব বলছ তুমি? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
অরিন্দম বলল, আমি বলছি, মরাল দায়িত্ব।
ব্যথায় আমার মাথাটা ভারি হয়ে গেছে, নুয়ে পড়তে চাইছে। কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে আমি বললুম, আপনাদের ঐ অফিসে আমি জীবনে আর কোনোদিন পা দেব না। এবার আমি যেতে পারি?
অরিন্দম সোল্লাসে বলে উঠল, জানতুম। ভদ্রলোকের মুখ দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল…
পল্লব বলল, এই প্রবলেমটা যে বুঝবে না, সে তো অতি হার্টলেস। উনি নিজের চোখে দেখলেন বলেই ঠিক বুঝলেন। প্ল্যানটা কী রকম করেছিলুম বলো।
দীনেন কিছু বলার চেষ্টা করলেও তাকে থামিয়ে দিল ওরা দুজন।
মাঝখানের দরজাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মণিকা। তাকে পাশ কাটিয়ে বেরুতে গিয়েও সামান্য ছোঁয়া লেগে গেল তার বাহুর সঙ্গে। তার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছি না।
অরিন্দম বলল, দাঁড়ান না, আপনাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দেব। আমি সিঙ্গাড়াটা খেয়ে নিই।
সে কথায় কান না দিয়ে আমি দৌড় লাগালুম সিঁড়ি দিয়ে। মাথার মধ্যে অনবরত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এবার কোনো ডাক্তারকে দেখাতেই হবে।
.
আমি যেন অন্ধের মতন হাঁটছি। এ গলি ও গলি দিয়ে ঘোরাঘুরি করেও বড় রাস্তা খুঁজে পেলুম না। সন্ধে হয়ে গেছে, কিন্তু রাস্তার আলো জ্বলেনি। এক সময় এসে পড়লুম একটা ফাঁকা জায়গায়, এক পাশে একটা এবড়োখেবড়ো ধরনের বেশ বড় পুকুর, সেই পুকুরের ঘাটে একটা নৌকো বাঁধা রয়েছে। কলকাতারই মধ্যে নৌকো সমেত পুকুর!
এদিকটায় মানুষজনও আর দেখতে পাচ্ছি না যে জিজ্ঞেস করব, বড় রাস্তা কোন্ দিকে। এরপর বোধ হয় ক্রমশ গ্রাম এসে যাবে। উলটো দিকে ফিরে যাওয়াই ভালো।
পেছন ফিরতেই দেখি, একটু দূরে একটি নারীমূর্তি।
প্রথমে মনে হলো, মণিকা। সে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিতে এসেছে। কিংবা সে আমাকে নিভৃতে আরও কিছু জানাতে চায়।
আর এক পা এগোতেই বোঝা গেল, মণিকা নয়। অন্য কেউ। তা হলেও তার সমস্ত শরীরময় উপস্থিতিটা খানিকটা বেশ চেনা লাগছে।
তারপর আমি কেঁপে উঠলুম রীতিমতন। ভয়ে, না বিস্ময়ে? একটি যুবতীকে দেখে ভয় পেতে যাব কেন?
মায়া কিংবা কল্পনা কিংবা চোখের ভুল, তা আজ পরখ করে দেখতেই হবে। এই মেয়েটিকেই আমি দেখেছি, রাত্তিরে বৃষ্টির মধ্যে আমাদের বাড়ির ছাদের আলসের কাছে। রথীন তালুকদারের পার্টি অফিসের বাইরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে এই মেয়েটিই দাঁড়িয়ে ছিল। এখন সে একবালপুর কিংবা খিদিরপুরের কোনো জায়গায় এক জলার ধারে এসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিদ্যুৎচমকে দেখেছি এই মুখ, দুপুরের রোদ পড়েছিল এই মুখে, এখন সন্ধের আলো-আঁধারিতে সেই একই মুখ।
আর একটু কাছে যেতেই মেয়েটি সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, রাস্তা চিনতে পারছ না?
আমার শরীরে আবার একটা শিহরণ হলো।
এত পরিষ্কার, ঝংকারময় তার কণ্ঠ, কিছুতেই কোনো অবাস্তব নারীর হতে পারে না। একটি সত্যিকারের মেয়ে, সে নির্জন জায়গায় একা দাঁড়িয়ে আছে কেন?
আমি অভিভূতের মতন বললুম, না। রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছি।
মেয়েটি বলল, এসো আমার সঙ্গে।
আমি বললুম, আপনি…আপনি আমাকে চেনেন?
সে বলল, ওমা, চিনব না কেন? তুমি নীললোহিত! কেন, তুমি বুঝি আমাকে চিনতে পারছ না?
মিথ্যে কথা বলার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি দু’ দিকে মাথা নেড়ে বললুম, না।
সে কুলকুল করে হেসে বলল, আশ্চর্য! আশ্চর্য! মানুষের এমন ভুল হয় বুঝি?
আমি একেবারে কাছাকাছি এসে নির্লজ্জের মতন তাকে দেখলাম ভালো করে। আজও সে নীল শাড়ি পরেছে, লাল ব্লাউজ, লাল চটি, কানে দুটি লাল পাথরের দুল। উচ্চতায় আমার চেয়ে সামান্য একটু কম, মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা।
আমি খানিকটা দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করলুম, তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখব!
সে অসংকোচে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল তার একটা হাত।
তার ওপর আমার হাত রাখলুম। রক্তমাংসের নারীর উষ্ণ স্পর্শ! এবং সেই স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, সত্যিই তো, একে আমি চিনি। আর প্রশ্ন করার কোনো মানেই হয় না।
দুটি সাইকেল আসছে এদিকে। পুকুরটার জলে একটা বড় মাছ ঘাই মারল। একটু দূরের একটা বাড়ির তিনতলার বারান্দা থেকে কেউ সশব্দে এক ঝুড়ি ময়লা ফেলল নীচে।
এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। হাত ছেড়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম পাশাপাশি। আমি তার শরীরের একটা সুগন্ধ পাচ্ছি। আমার মাথার ব্যথাটা মিলিয়ে গেছে।
একটুখানি যাবার পর সে বলল, তোমার খুব মন খারাপ, তাই না নীললোহিত?
—তুমি কি করে জানলে?
—তুমি যখন আমায় ছুঁলে, তখনই টের পেলাম। তোমার আঙুলের ডগায় দুঃখ লেগে আছে।
—আঙুলের ডগায় তো রাগ থাকে, দুঃখও বোঝা যায় বুঝি?
—আমি রাগটা ঠিক চিনি না।
—রাগ চেন না? ভালোই তো। তা হলে আর চিনতে হবে না। তুমি যে এমন নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলে, তোমার ভয় করছিল?
–না, ওতে কোনো ভয় নেই। তবে আমার সব সময় একটা অন্যরকম ভয়, করে।
সাইকেল আরোহী দুজন ফিরে আসছে। গতি মন্থর করছে আমাদের কাছে এসে। এসব পাড়া ভালো নয়। নানা রকম হাঙ্গামা হয় প্রায়ই, কাগজে পড়ি। কোনো যুবতীর সঙ্গে এখানে বেড়ায় না কেউ।
সে বলল, আমি এবার যাই! তুমি আর একটু গেলেই বড় রাস্তা পেয়ে যাবে।
—না, যেও না। ওরা কি করবে? আমরা তাকাব না ওদের দিকে।
—না, নীললোহিত, আমি যাই!
একজন গুণ্ডা সাইকেলটা ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপরে। অন্য লোকটা বলল, মেয়েটা কোথায় গেল? একটা মেয়ে ছিল সঙ্গে!
আমার গালে ঠাস করে এক চড় মেরে বলল, এই, তোর সঙ্গে যে মেয়েটা ছিল সে কোথায় গেল?
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলুম। সে নেই। এই লোক দু’জনও তাকে দেখেছে।
অন্য একজন একটা ছুরি বার করে বলল, চ্যাঁচালে খোপরি উড়িয়ে দেব!
আমি পকেট থেকে একশো টাকার নোটটা বার করে এগিয়ে দিলুম ওদের দিকে। অন্য গালে আর একটা চড় কষিয়ে একজন বলল, ঘড়িটা খোল, শালা।
আমার কাছে কোনোদিন মানি ব্যাগ থাকে না। আর আছে বুক পকেটে মাত্র তিনটি টাকা। ওরা ঘড়ি আর একশো টাকার নোটটা নিয়ে অকারণে আমার মুখে কয়েকটা ঘুষি মেরে হাতের সুখ করে নিল, তারপর এক ধাক্কা মেরে ফেলে দিল মাটিতে।
আমি একটা কথাও উচ্চারণ করিনি। সবাই জানে, গুণ্ডাদের সঙ্গে তর্ক করতে গেলেই পেটে ছুরি খেতে হয়। ওরা কথা সহ্য করতে পারে না। দু’জন সশস্ত্র দুর্বৃত্তের সঙ্গে একা খালি হাতে লড়ে যেতে পারে শুধু গল্পের বইয়ের নায়করা। আমি ছুরি-টুরি খাওয়া একদম পছন্দ করি না।
খুব বেশি মারেনি, নাক দিয়ে একটু রক্ত বেরিয়েছে শুধু। এ তো কিছুই না। ভুরিভোজের বদলে সামান্য জলখাবারের মতন।
বেশি আহত হবার ভঙ্গিতে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে রইলুম খানিকক্ষণ! তারপর শুনতে পেলুম,
সে বলছে, নীললোহিত, ওঠো।
আমি উঠে বসতেই সে আমার হাত ধরে টেনে তুলল।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুমি কোথায় লুকোলে?
সে বলল, ঐ যে, ঐ অন্ধকারের মধ্যে। এরা এত খারাপ লোক কেন? তুমি
টাকা আর ঘড়ি দিয়ে দিলে, তবু ওরা তোমাকে মারল!
আমি বললুম, এর চেয়ে অনেক সামান্য কারণে খুন হয়। প্রকৃতি এখন জনসংখ্যা কমাবার দায়িত্ব দিয়েছে কিছু কিছু মানুষেরই ওপরে।
–তোমার কোনো কিছু ভাঙেনি তো?
—নাঃ! নীলা, তুমি আবার এলে, তোমাকে দেখলে…
—নীলা! আমার নাম বুঝি নীলা?
–তোমাকে প্রত্যেকবারই নীল শাড়ি পরা দেখছি, তাই এই নামটা মনে এল! তোমাকে দেখতে পেলে ওরা আবার ফিরে আসতে পারে। আর কোনোদিন এরকম নির্জন জায়গায় এসো না।
—চলো, আমরা দৌড়ে বড় রাস্তার দিকে চলে যাই। তুমি দৌড়োতে পারবে, নীললোহিত!
—হ্যাঁ পারব!
—তাহলে তুমি আমার হাত ধরে থাকো। শক্ত করে ধরো।
কিন্তু এর মধ্যেই বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি ওর হাতটা খুঁজে পেলুম না। ওকে দেখতে পাচ্ছি না ভালো করে।
আবার সাইকেলের বেলের শব্দ। আমি প্রাণপণে ছুট দিলুম সামনের দিকে। নীলা একটু দূরত্ব রেখে আমার পাশে পাশে ছুটছে। অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওকে, ক্রমশ ও মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে।