৯০
বারাসাতে এমন কিছু পাড়া এখনও আছে, যেখানে প’ড়ো প’ড়ো প্রকাণ্ড প্রাচীন অট্টালিকা আর ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট পাশাপাশি দিব্যি থাকে। আমার শ্বশুরবাড়ির পাশে অমনই দু’টো মস্ত জীর্ণ প্রাসাদ ছিল ক’দিন আগেও। মুখোমুখি— মানে রাস্তার দু’পাশে দু’টো। আমার চোখের সামনেই সেগুলো ভেঙে পাঁচতলা বিশাল দু’খানা ফ্ল্যাট উঠল কয়েক বছর আগে। নতুন বাসিন্দারা এলেন, জানলায় ঝুলতে লাগল বাহারি শৌখিন মনিপ্ল্যান্ট।
আমার শ্বশ্রূমাতা এমনই এক মানুষ, যাঁর যত্ন করার ক্ষমতাটা জন্মগত ; অর্থাৎ আমার মতো বেয়াক্কেলে ফাজিল জামাইকেও তিনি এত্তগুলো বছর ধরে যত্নআত্তি করতে পারেন। সেই লোভে আমার গতায়াত এ পাড়ায় কিঞ্চিৎ বেশিই। তা কয়েক বছর আগে একদিন তাঁর ফোন এল অসময়ে, অর্থাৎ দুপুর প্রায় বারোটা নাগাদ— ‘রাজা, একটা দরকার ছিল, একটু আসতে পারবে?’ সাধারণত ওঁর তরফ থেকে এই আবাহনের একটাই মানে হয়— ভাল কিছু রান্না হয়েছে। গরমের ছুটি চলছে তখন; অসহ্য গরমে মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু সে ভয়ে কম্পিত নয় বীরের হৃদয়; বিশেষত ভয়কে জয় করলে যেখানে আশাতীত পুরস্কার আছে— সুখাদ্য। কাজেই আমি ‘জয় মা’ ব’লে ছাতা মাথায় সেই দ্বিপ্রহরে অগ্নিসমুদ্রে ঝাঁপ দিলাম।
যথাস্থানে পৌঁছে বাস থেকে নেমে বুঝলাম— আমার ছাতাটি জবাব দিয়েছে। খুলছে না কোন কারণে। যাক গে, বড়জোর তিন মিনিটের হাঁটাপথ— রওনা দিলাম ছাতা ছাড়াই। মনে পড়ল— সদ্য-ওঠা বাঁ-দিকের ফ্ল্যাটটার নীচেই এক ভদ্রলোক ব’সে ছাতা সারান। যাক, যাওয়ার পথে ছাতাটাও সারিয়ে নেওয়া যাবে। সেখানে পৌঁছে, তাঁর হাতে ছাতা সমর্পণ ক’রে আমি ছায়ায় উঠে দাঁড়ালাম। সামনেই পিচ-গলা রাস্তায় গনগন করছে দুপুরের চণ্ড রোদ।
এমন সময় চোখে পড়ল, উল্টোদিকের ফ্ল্যাটটার গেটের সামনে একটা ঘোর গণ্ডগোল বেঁধেছে। একটি অল্পবয়সী মেয়ে উর্দি-পরে দারোয়ানদের প্রচণ্ড চিৎকার করে বকাবকি করছে। কী ব্যাপার? একটু কান পাততেই কৌতুহল নিরসন হল। আশেপাশের কোনও একটা বাড়িতে আছেন একজন নামকরা প্রাইভেট মাস্টারমশাই। তাঁর কাছে ছেলেমেয়েদের ঢুকিয়ে দিয়ে অভিভাবকেরা গিয়ে দাঁড়ান ওই ফ্ল্যাটটার ছায়াতে। এই অবৈধ প্রবেশ এই মেয়েটির আদৌ পছন্দ নয়। আগেও নাকি তিনি বারণ করেছেন ‘সিকিউরিটি’দের। তৎসত্ত্বেও তারা এই রবাহূত গার্জিয়ানদের আসায় বাধা দেয়নি। আজ মেয়েটির ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। তিনি নেমে এসেছেন এ.সি. ঘর ছেড়ে; এবং যে ভাষায় নিজের অসন্তোষ জ্ঞাপন করছেন— তা প্রখর সূর্যের চেয়েও প্রখরতর।
ঈশ্বরেচ্ছায় গার্জিয়ানদেরও কান আছে। কাজেই গার্ডদের আর কিছু বলতে হল না, অভিভাবকেরা নিজেরাই বেরিয়ে এলেন সেই বিরল ছায়াটুকু ছেড়ে, গ্রীষ্মের দুপুরের খর রোদ্দুরে। মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি— তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন জনাকয়েক মাঝবয়েসি বাপ-মা। প্রতিবাদী তরুণী তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলেন ঘরে; চাকরি বেঁচে গেল পাহারাওলাদের।
আমার ছাতা ততক্ষণে প্রায় সেরে উঠেছে। হেনকালে দেবদূতের মতো দেখা দিলেন এক আইসকিরিম-ওয়ালা। গাড়িটি দেখে ভাবলাম— এই হল সময়; ধারেকাছে চেনা কেউ নেই যে বলবে আমার অমূল্য কণ্ঠটি আইসকিরিম খেলেই খারাপ হয়ে যাবে। পকেটে হাত দেব— হঠাৎ এতক্ষণ নীরবে ছাতা-সারানো মানুষটি মুখ তুলে বললেন— ‘দু’টো আইসক্রিম দে, বাবলু। গরমে পেরান যাওয়ার যোগাড় হইয়েছ!’ আইসকিরিমওয়ালা এসে বসল তাঁর পাশেই। গামছা দিয়ে মুখ মুছে বলল—‘যা কইস দাদা। এর’ম গরম বহুকাল পড়ে নাই। কী খাবা? ভ্যানিলা, না চকলেট?’
‘চকলেটই দে!’— এই ব’লে দুটো আইসক্রিম নিয়ে, একটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন— ‘ভাই, চকলেট খাবা তো? নইলে বলতি পারো— বাবলুর কাছে অন্য সবও আছে কিন্তু…!’
এত অপ্রত্যাশিত এই আমন্ত্রণ— যে আমি ভড়কে গিয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর ভাঙাচোরা মুখটার দিকে। তিনি অবিশ্যি নির্বিকার; বললেন— ‘যেটা পেরানে চায়, খাও। যা গরম…!’ —ব’লে পরম পরিতৃপ্তি-সহ আইসক্রিমে জিভ ছোঁয়ালেন।
এবার এই রোদ্দুরে, পিচ গলে-যাওয়া গরমে আপনি ভারতবর্ষকে কোথায় খুঁজবেন— সেটা অবশ্য আপনার ব্যাপার।
৯১
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যে স্থানটা আমাকে সর্বাধিক আকৃষ্ট করেছিল— তা হল ক্যান্টিন। সরু একটা সুড়ঙ্গপথ দিয়ে সেখানে ঢুকতে হত। দু’পাশে সাজান টেবিল-চেয়ার সর্বদাই ছাত্রছাত্রীদের কলরবে মুখরিত কুঞ্জবনের কথা মনে পড়িয়ে দিত। আবার কেউ কেউ একেবারে পেছনের দিকের টেবিলে বসে খেত মাছ-ভাত। আমি অবিশ্যি বড়জোর একটা চপ আর এক কাপ চা খেতে পারতাম, এর চেয়ে বেশি পয়সা থাকত না আমার কাছে। ভোরে উঠে ছুটতাম ট্যুশন পড়াতে; বাড়ি ফিরে নাকেমুখে দুটো গুঁজে ছুট, দেড়-দু’ঘন্টার চেষ্টায় ইউনিভার্সিটি। ক্লাস সেরে সন্ধ্যে হয়ে যেত ফিরতে। ফের একখানা ট্যুশন সেরে বাড়ি ফিরতে রাত্তির। ওই বয়েসে মায়ের কাছ থেকে টাকা চাইতে লজ্জা করত; এদিকে সেই সময়ে মফস্বলে প্রাইভেট ট্যুশন করে এত পয়সা পাওয়া যেত না— যা দিয়ে কেউ ‘স্বচ্ছল‘হয়ে উঠতে পারে। কাজেই অর্থাভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।
বেশ দেরি করে ক্লাস শুরু করায় বন্ধু জুটতেও দেরি হয়ে গেল আমার। কিন্তু যখন হল— তখন প্রচুর হল। ‘ক্যাম্পাস’ অনুষ্ঠানে— অর্থাৎ নবীনবরণে গান গেয়ে খুব খানিক বাহবা আর মেলাই বন্ধুবান্ধব লাভ হল। গানের সূত্রে আলাপ হওয়ায় তারাও সব গানপাগলের দল। ক্রমে আড্ডা জমে উঠল ক্যান্টিনে; সে আড্ডাও স্বভাবতই সুরে মাখামাখি। লম্বা লম্বা ফাঁক পড়তে লাগল ক্লাসে।
ক্যান্টিনে ঢুকেই ডানদিকে ছিল একটা মস্ত উচ্চাসন। তার সামনে কাউন্টার। বিচারকের তুল্য গাম্ভারি মুখ নিয়ে সেখানে বিরাজ করতেন রাখালদা। কিছুদিনের মধ্যেই অভিজ্ঞ আড্ডাধারীরা আমায় জানিয়ে দিলেন— রাখালদা এই ক্যান্টিনে আছেন আমাদের জন্মেরও বহু আগে থেকে; সিকিউরিটি থেকে ভি.সি. পর্যন্ত সক্কলে তাঁকে এক ডাকে চেনে। শুনে ভারি সমীহ জন্মাল। কড়া এবং কর্কশ কণ্ঠস্বরটিও শ্রদ্ধা জন্মানোর অপর কারণ। একদিন ‘ইয়ে যো মোহব্বত হ্যায়‘গানটা ঈষৎ-উচ্চকিত সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠায় রাম-ধমক খেলাম আমরা সবাই— বিশেষত আমি। এই বাজখাঁই গলা— ওটাই আগে কানে পৌঁছয় কিনা! ফলে দিনকতক আমি সাধ্যমতো মিনমিন করে কথাটথা বললাম। গান একেবারে বন্ধ।
দিন চারেক পরে দুপুরে ক্যান্টিনে ঢুকছি— রাখালদা আমায় দেখে স্বভাবসিদ্ধ কর্কশ গলায় বললেন—‘দাঁড়াও।’ আমি তো কাঠ। আবার কী করলাম? কড়া গলায় বললেন—‘আমি তোমায় গান গাইতে মানা করেছি?‘ ঘটঘট করে মাথা নাড়লাম। বললেন—‘চিৎকার করতে মানা করেছি। গান গাইতে নয়। গাইছ না কেন? নাকি সম্মানে লেগেছে— শুনি!’ আমি জিভ কেটে হেসে ফেললাম। রাখালদা হাসলেন না, গম্ভীর হয়ে বললেন—‘গাইবে। তোমার… ইয়ে… ভালই গলা।’
আমি দাঁত বের করে চাপা গলায় বন্ধুবান্ধবদের খবরটা দিতে তারা ভারি সন্দেহের চোখে আমার পানে আড়ে আড়ে চাইতে লাগল— যেন কেউ আমার গলার প্রশংসা করতেই পারে না। অবিশ্যি এটুকু না-করলে তাকে বন্ধু বলাই উচিত না। তা সেদিন কথা উঠল সলিল চৌধুরিকে নিয়ে। এক বান্ধবী— অসাধারণ তার গলা— ‘কেন যে কাঁদাও’ গেয়ে মাৎ করে দিল। ক্রমে তার থেকে এল সলিলের গণসঙ্গীতের কথা। একজন শুরু করে দিল— ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’। আর পায় কে আমায়! এ আমার ঘরের গান, এই শুনেই বড় হয়েছি। রাখালদার নিষেধাজ্ঞা নিমেষে ভুলে গিয়ে হুংকার দিয়ে উঠলাম আমি— ‘গুরু গুরু গুরু গুরু ডম্বরু পিনাকে বেজেছে বেজেছে বেজেছে/ মায়াবন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ তরণী ভাসানো ঢেউ উঠছে!’ এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল সব কথা— দেরিদা-চমস্কির জ্ঞানগর্ভ আলোচনা নীরব হয়ে গেল, নিস্তব্ধ হল কপোতকপোতির মৃদু কলগুঞ্জন। ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল এক মহাশিল্পীর দ্যুতিময় সৃষ্টির ভৈরব অট্টহাস্য।
গান শেষ হতে সম্বিত ফিরল চারিদিকের নীরবতায়। তাকিয়ে দেখি— গোটা ঘরের সবক’টা চোখ এই টেবিলের দিকেই। অমনি ফের মনে পড়ল রাখালদার নিষেধ। ভয়ে ভয়ে চোখ ফেরালাম সেদিকে। পুরু চশমার আড়াল থেকে সেই দৃষ্টি যে আমাতেই নিবদ্ধ— তা বুঝতে পেরে প্রাণ উড়ে গেল আমার। আজ নির্ঘাত বের করে দেবেন আমায়।
খানিকক্ষণ কঠোর চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন— ‘এদিকে এস!’
আমি উঠে দাঁড়ানোর আগেই সুদীপ বলল— ‘রাখালদা, আসলে হয়েছে কি…’
রাখালদা তার দিকে না-তাকিয়েই বললেন— ‘তোমায় কিছু বলেছি? তুমি— তুমি উঠে এস এখানে।’ এবার তর্জনীর দৃঢ় নিক্ষেপ।
পা টেনে টেনে গিয়ে দাঁড়ালাম বুক-সমান কাউন্টারটার সামনে। সবাই স্তব্ধ। আমার মাথা নীচু। কড়া গলায় বললেন— ‘তোমার বাবার নাম কী?’
এতই অপ্রত্যাশিত এই প্রশ্ন— আমি চমকে তাকালাম এবার। ‘গার্জিয়ান কল’ কী ইউনিভার্সিটি লেভেলেও চলে নাকি! শুকনো গলায় বললাম—‘বাবা… মানে… চলে গেছেন গতবছর।’
ভুরু কুঁচকে গেল রাখালদার। আরও গম্ভীর গলায় বললেন— ‘নাম, নাম জিজ্ঞেস করেছি।’
পিতার মৃত্যুসংবাদ যাকে টলাতে পারে না— সে কেমন মানুষ রে বাবা! মৃদু গলায় বললাম বাবার নামটা।
খুব আস্তে আস্তে চশমাটা খুলে ফেললেন রাখালদা। বজ্রাহত চোখে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন— ‘মারা গেছে! কী করে! কত বয়েস হয়েছিল!’
বললাম সব অতি সংক্ষেপে। মাথা নীচু করে খানিক বসে থেকে রাখালদা বললেন— ‘ক্লাস করার তো সময় ছিল না তার। সারাদিন শুধু পার্টি। ভি.পি. ছিল ইউনিভার্সিটির ইউনিয়নের— জানো? ক’দিন সোজা রাস্তায় বাড়ি ফিরেছে— সন্দেহ আছে। গ্রামের ছেলে, পথঘাট চিনত না; সঙ্গে ছেলে দিয়ে অন্য পথে বের করে দিতে হত ওকে— যাতে প্রাণে বেঁচে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারে। এইখানে বসে গান গাইত সে, গণসঙ্গীত…নিজেও খাসা গান বাঁধতে পারত। তুমি পারো? নাঃ, তোমরা হলে সব ভাল ছেলে, ভাল রেজাল্ট করে বাড়ি যাবে…ভাল চাকরি করবে…পড়াবে ইশকুলে-কলেজে…তোমাদের পেছনে গুণ্ডাও ঘোরে না, পুলিশও না…ভাল ছেলে…’
এই বলে আবার চশমার কাচটা মুছে নিলেন পাঞ্জাবিতে। তারপর ফের সেই কর্কশ গলায় বললেন—‘কিশোর! ওকে এক কাপ চা দে, পয়সা নিবি না। যাও, বসো। আর ইয়ে…বলছিলাম… আর কোনো গণসঙ্গীত জানো? গাও তো… শুনি…’
৯২
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, ভাদ্দরের শেষে যে এমনিধারা দুর্দান্ত গরম পড়তে পারে— তা জন্মেও দেখিনি এ বছরের আগে। বাপ রে বাপ! শনিবার; ইশকুল হাপ-ছুটি হয়ে গেছে। আমি বেরিয়েছি দেড়টা নাগাদ। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি হয়ে, প্রেস ক্লাব হয়ে যখন শিয়ালদায় পৌঁছলাম— তখন প্রায় সাতটা। লেট-খাওয়া একটা বনগাঁ লোকালে উঠলাম ধড়ফড়িয়ে, তালেগোলে একটা সিটও পেয়ে গেলাম— হলই বা হাওয়ার উল্টোবাগে— বসে তো পড়েছি! এই-ই বলে বেশিরভাগ দিন জোটে না!
পঁচিশ বচ্ছর ধরে এই লাইনে নিত্যি নিত্যি যাচ্ছি আসছি। বরাবর দেখে আসছি— বনগাঁ লোকালের শহরের পানে ভারি একটা মায়া আছে। মানে— এই কলকেতা শহরটাকে ছেড়ে যেতে তার মন চায় না। দ্বিধাজড়িত চাকায়, অতি ধীর গতিতে ট্রেন তো রওনা দিল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কপাল থেকে ঘাম নামছে চোখ তাগ করে, আর আমি রুমালটা পর্যন্ত বের করার সুযোগ পাচ্ছিনে— এমনি ভীড়। লোকের চাপে জানলাটা অবধি বন্ধ হয়ে গেছে। হাওয়া নেই। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রীতিমতো। বারাসাত ছাড়লে সচরাচর একটু ঠাণ্ডা হাওয়া আসে অন্যদিন। আজ এল না। ক্রমে নিত্যযাত্রীদের মেজাজ গরম হচ্ছে; দোষও দেওয়া যায় না— এই অবস্থায় যে-কোনো সুস্থ মানুষেরই মাথা গরম হয়ে যাওয়ারই কথা। ঝগড়া হচ্ছে তুচ্ছ কারণে। কিন্তু এরই মধ্যে চলছে সরস আড্ডাও। কে কবে কোথায় কী করেছে— জানতে হলে লোকাল ট্রেনে উঠতে হবে বইকি!
এমন সময় কানে এল এই সংলাপ। কাব্যি না-ক’রে লিখে রাখি— যেমন শুনলাম— তেমনই।
—‘কাল গিয়েছিলাম মেদিনীপুরে— বুঝলে! উফ! জঘন্য জায়গা! এক গ্লাস জল পাওয়া যায় না, একটু ভাত পাওয়া যায় না— এমন জায়গা! শালা! একটা ভাতের হোটেল নেই মাইরি! ভদ্দরলোকে থাকে ওখানে! নেহাত সরকারি কাজ— যেতেই হবে…নইলে…’
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই হল এবার। সাদামাটা কেরানি চেহারার একজন বলছেন এসব— আমার মতোই বৈশিষ্ট্যহীন চেহারা। থাকতে না-পেরে বলেই বসলাম— ‘কী যে বলেন! অত বড় শহরে একটা ভাতের হোটেল নেই! হতেই পারে না!’
‘আরে মশাই— শহরে গিয়েছিলাম নাকি!’ চটেমটে বললেন বক্তা— ‘সে একেবারে হদ্দ গ্রাম! একটা দোকান নেই, একটা ভাতের হোটেল নেই! তিওয়ারিরা তো রুটি-আচার নিয়ে গিয়েছিল। তাই খেল। আমাদের পুরো হরিমটর! সারা দুপুর ঘুরে একটু খাবার পাই না! শেষে একটা বাজার মতো জায়গায় দেখি একটা ঝুপড়ি; একেবারে পড়ো পড়ো অবস্থা— পলিথিন আর পাতা-ছাতা দিয়ে কোনোমতে তৈরি। তার সামনে বসে এক বুড়ি— নির্ঘাত ভিখিরি, নইলে কারুর বাড়িতে কাজ-টাজ করে— ভাত রাঁধছে। তা গিয়ে সোজা বললাম— ‘দু’টো ভাত দেবেন? যা লাগে— দিয়ে দেব! বুড়ি তো দিব্যি একখানা কলাই-করা থালায় আমায় ভাত-ডাল-আলুভাজা দিয়ে খেতে বসিয়ে দিল। খেয়ে-দেয়ে উঠে আঁচিয়ে নিয়ে বললাম— ‘কত দেব?’ ও হরি! বুড়ি বলে কী— ‘এ কী বল বাবা! দু’টো ভাত খেয়েছ— তারও দাম দেবে! কিচ্ছু দিতে হবে না। সাবধানে বাড়ি যাও— রাস্তাঘাটের যা অবস্থা!’ বোঝো মাইরি! শেষে ঋণী ক’রে রেখে দিল! কী জায়গা মাইরি! একটা ভাতের হোটেল অবধি নেই— ভিখিরির কাছে ভিক্ষা করতে হল!’
আমার বেজায় হাসি পাচ্ছিল। সত্যি! এই বুড়ি দেশ আপনার সামনেই আছে— অথচ আপনি তাকে চিনতে পারছেন না তার ভিক্ষুণীর ছদ্মবেশের জন্য— এর চেয়ে হাস্যকর আর কীই বা হতে পারে!
ততক্ষণে অবিশ্যি আমার স্টেশন এসে গেছে। হাসিমুখে নেমে গেলাম আমি। গালমন্দ করতে করতে চলে গেল কয়েকটা লোক— যারা লক্ষ্মীর দেখা পেয়েও, টিকা না-প’রে মুখ ধুতে গিয়েছিল।
৯৩
আমাদের পরিবারটি বঙ্গদেশের সেই অগণিত কমিউনিস্ট বাড়িরই অন্যতম— যারা সাম্যবাদ এবং ব্রাহ্মণত্বে সমান আস্থাপরায়ণ। অর্থাৎ— পার্টির জন্য জেল খাটা যায় অনায়াসে, তাই বলে নিষিদ্ধ মাংসটা খাওয়া যায় না; বিবাহ করিবার পূর্বে একটি ব্রাহ্মণকন্যা খুঁজিয়া বাহির করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জ্যাঠামণিদের মধ্যে অনেকেই জীবনে কুক্কুটমাংস স্পর্শ করেন নি। আবার বিপরীতে, ছেলেপুলে ভাইভাতিজা কেউ খেলে আপত্তিও নেই তাঁদের। এই বিচিত্র বিপরীতধর্মী প্রভাব, স্বভাবতই, আমার মধ্যেও ক্রিয়াশীল। আর— কেন জানি না— জাতপাত আচারবিচারের ব্যাপারে আমার মাথাটা একটু খেলেও কম। ফলে এম.এ. করার সময় যখন প্রথম নিজামে গিয়ে বিফ-কাবাব আর পরোটা খেয়ে ফেললাম— তখন এ হেন ‘জাতিচ্যুত’ হওয়ার ঘটনাটার পূর্ণ তাৎপর্য আমার ভোঁতা মগজে সেঁধলোই না ঠিকমতো। উল্টে সেই হলায়-গলায় বন্ধুটিকে বিস্তর তম্বি করলাম— ‘অ্যাদ্দিন বলতে পার নি চাঁদু? একাই সাঁটাচ্ছিলে— অ্যাঁ?’
বিয়ের তিন হপ্তা আগে নিউমার্কেটে গেছি ভাবী-পত্নীকে নিয়ে। মেলা কেনাকাটি হয়েছে; নিজেকে বেশ মালগাড়ি মালগাড়ি লাগছে। এমন সময় তিনি বললেন— ‘চলো, কিছু খেয়ে নিয়ে বাকিটা করব ‘খন।‘ আমি সটান রাজি— এট্টু হাঁফ ছাড়া যাবে। ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেলাম ফের সেই নিজামে। আমি রণহুংকার দিয়ে কাবাবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি— তিনি দেখি সেই দেবভোগ্য খাবার অলস-আঙুলে নাড়াচাড়া করেই চলেছেন। পীড়াপীড়ি করতে জানালেন— এই দুর্দৈব হতে পারে— তা আন্দাজ করে আমার মাতৃদেবী পূর্বাহ্নেই তাঁকে সাবধান করে দিয়েছেন; সঙ্গে ফ্রি হুমকি— ‘ওসব খেয়ে এলে কিন্তু লক্ষ্মীপুজো করতে দেব না।’ আমি ‘কুসংস্কার ও ভারতীয় নারীসমাজ’ সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ ও তত্ত্ববহুল ভাষণ দিলাম। কিন্তু তিনি দ্বিধাদীর্ণ মুখে অনড় রইলেন। বুঝলাম— ব্যাপার অত সহজ নয়।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার জাত-ধম্মো কিচ্ছু আর রইল না এক মামার পাল্লায় পড়ে। ইনি পেশায় ও নেশায় ট্যুর-অপারেটর। পাহাড় এঁর চারণভূমি। ফলে অভিজ্ঞতা বিপুল, তেমনই অসীম এঁর আমাকে বিপথগামী করার ক্ষমতা। ভুটানে গেছি। থিম্পুর এক খাসা হোটেলে উঠেছি বন্ধুবান্ধবপরিবার মিলে। এ হেন সময়ে সেই মামার ফোন— ‘ওই হোটেলের সেরা খাবার কী বল তো? ডাবল-ফ্রায়েড পর্ক। খেয়ে দ্যাখ ব্যাটা— জীবনে ভুলতে পারবি না স্বাদ!’ ব্যাস! দৌড়ে গিয়ে অর্ডার, সেই স্বর্গীয় খাদ্যের প্লেট-সমারূঢ় হয়ে আগমন, এবং সমবেত ‘আহা উহু‘এবং আঙুল চাটার শব্দ। এ যাত্রায় অবিশ্যি গিন্নিও দু’এক টুকরো মুখে দিয়ে পিত্তরক্ষা করলেন; এবং হাসিমুখে জানালেন— এ সব খাওয়া সাস্থ্যসম্মত না-হলেও ‘খেতে কিন্তু খাসা’। ‘বিদেশে নিয়ম নাস্তি’ ভেবে আমি আর তাঁকে লক্ষ্মীপুজো-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা মনে করিয়ে দিলাম না।
পাহাড়ে যাওয়াটা আমাদের বাৎসরিক কৃত্যের মধ্যেই পড়ে। পরের বছর গেছি সিল্ক রুটে। জুলুক থেকে কুপুপ পর্যন্ত পথের অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে ফিরে এসে পৌঁছলাম পদমচেন নামের একটা গ্রামে। অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখে, সহস্রাব্দ-প্রাচীন রেশমরাস্তা ধরে বনপথে কিঞ্চিৎ হাঁটাহাঁটি করে ফিরেছি হোম-স্টেতে। এমন সময় আবার সেই কালান্তক ফোন—‘হ্যাঁ রে, থাম্বে তোদের স্পেশ্যাল কিছু খাইয়েছে?’ অবাক হয়ে বললাম— ‘কই, না তো! সে তো বাড়িতেই নেই!’ ষড়যন্ত্রকারীর মতো গলায় মামা জানালেন— ‘উফফফ্, ও যা একখানা চিলি-বিফ করে না! সে খেলে আর পুনর্জন্ম হয় না। আমি তো ওর বাড়িতে গেলেই সোজা রান্নাঘরে গিয়ে এইটার জন্য হামলা করি।’
এরপরেও যে সংযত থাকতে পারে, সে মহাপুরুষ। আমি নই। থাম্বে ফিরতেই চেপে ধরলাম। তা সে মিনমিনে গলায় ‘সে জিনিসপত্র কী আছে— কে জানে…. আচ্ছা দেখি…’— এইসব ব’লে পালিয়ে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম— প্রথমদিন এসেই এসব উৎপাত করা ঠিক হল না বোধহয়। ও হরি! ঘন্টা-খানেকের মধ্যেই ফের হাজির; এবার হাতে একটা পাত্র। লেপ-টেপ ফেলে লম্ফ দিয়ে উঠতেই হয় এরপর; এবং হ্যাঁ— এ যাত্রায় ছেলে বা তার মাতৃদেবী— কাউকেই আর নেমন্ত করতে হয় নি। আহা, থাম্বে বড় ভাল ছেলে গো, বড় ভাল রাঁধে।
আর হ্যাঁ, এই ভয়ানক পাপপঙ্কিল খাদ্যাখাদ্যভেদহীন জীবনযাত্রার জন্য— বিশ্বাস করুন— আমার কোনও অনুতাপ নেই। বিন্দুমাত্র না। কেননা— আমি বাঙালি, আমি সাদামাটা একজন ভারতীয় মানুষ। এই বিবিধতার শিক্ষা আমাকে এই দেশই দিয়েছে; আমি শুধু দরজাটা খুলে রেখেছিলাম মাত্র। আমি এইটুকু বুঝেছিলাম— একটা এত বছরের পুরনো ধর্ম শুধু ছোঁয়াছুঁয়ি আর খাদ্যাখাদ্যের বিচার করে টিকে নেই; থাকতেই পারে না! এর জানটা খুঁজে বের করাই আমাদের— আজকের ভারতীয় মানুষের একমাত্র ধর্ম।
কী খেতে নেই— সেটা খুব বড় কথা নয় বোধহয়। সত্যিকারের বড় কথাটা হল— ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া। এটাই প্রাচীনতম, পবিত্রতম ধর্ম। খিদে পাক না একদিন… ঠিক বুঝে যাবেন…
৯৪
আমি মোটে তিন ধরণের বাংলাদেশি চিনি। এক— যাঁদের আমি ব্যক্তিজীবনে চিনি। এঁদের আতিথ্যের আর ভালবাসার সামনে পড়লে সারাজীবন আর ভোলার সাধ্যি থাকে না কারুর। দুই— যাঁরা ‘ফেইসবুক’এ ইন্ডিয়াকে ‘রেন্ডিয়া‘বলেন এবং উদারভাবে সর্ববিষয়ে গালি দেন। তিন— যাঁরা ব্লগারদের খুন-টুন করে ইসলামের মানরক্ষে করেন। এখন, ওই প্রথম শ্রেণিটি ছাড়া আর কারুর সম্পর্কে যেহেতু আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই— তাই তাঁদের কথা থাক। ভারতবর্ষের প্রথম পর্ব থেকে আমি শুধু সেটুকুই লিখেছি— যা আমার অভিজ্ঞতার অংশ। আজ শেষবেলায় না-ই বা তার অন্যথা করলাম।
আমি হদ্দ বাঙাল-বাড়ির ছেলে। ‘দ্যাশের বাড়ি’র গপ্প তাই আমাদের আশৈশব-সঙ্গী। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে যাওয়া ঘটল বুড়ো বয়েসে— মেঘদূত গাইতে। সঙ্গে শুভাশিস আর সোমা— শুভাশিস অহর্নিশের সম্পাদক, খাসা বক্তৃতা দেয়; আর সোমা তো মেঘদূতেরই অংশ। তা যশোরে, বেনজীনদার বাড়িতে পৌঁছে ইস্তক যত্ন-আত্তির যে নমুনা দেখলাম— তাতে চাকরি আর দারা-পুত্র ফেলে না-গেলে ফিরে আসার কোনও কারণই ছিল না। তার বন্ধুরাও সব অমনই; আর বাবলুদা তো সকলের টেক্কা। আর কী কাণ্ড— এই ‘ভারতবর্ষ’-এর দৌলতে সব্বাই চেনেন আমায়! ভালবাসায় মন, আর বই উপহার পেয়ে ব্যাগ ভরে গেল। বুঝলাম— এই প্রথম শ্রেণির মানুষই বাংলাদেশে বেশি— প্রভাবে না-হোক, সংখ্যায়।
যশোরে এসেছি, আর মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভিটে দেখতে যাব না, তাও কি হয়? বেনজীনদাকে বলতেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। গাড়ি এল পরদিন সক্কালবেলায়। সঙ্গে গাইড হিসেবে যে ডাক্তার ছেলেটি চলেছে— সে গাড়িতে উঠে বিস্তর নজ্জা-নজ্জা মুখে একখানা নিজের লেখা কবিতার বই এগিয়ে দিল। দুর্দান্ত সব লেখা। চারদিকে ছড়িয়ে-থাকা ‘দ্যাশ‘ দেখতে দেখতে, আর সেই কবিতা পড়তে পড়তে চলে গেলাম সাগরদাঁড়ি। ঝকঝক করছে সেই দু’শো বছরের পুরনো বাড়ি, বাংলার একমাত্র মহাকবির জন্মস্থল। রক্ষণাবেক্ষণ দেখলে শ্রদ্ধা হয়। পাশেই কপোতাক্ষ নদের অবস্থা দেখে অবিশ্যি চোখে জল এল; পানায় ভরা কাদাঘোলা জলে কপোতের চোখের দেখা পাওয়া অসম্ভব।
যাক। দেখেশুনে ফিরে আসার পথে আমাদের সারথিটি চালিয়ে দিল গান। ড্রাইভারদের চিরসাথী। কিন্তু সে গান হল নতুন বাংলাদেশি সিনেমার গান। এসব গান আমি আগে শুনিনি, শুনে যে খুব ভাল লাগল— এমনও নয়। কাজেই ফের ব্যাগ থেকে সদ্যলব্ধ বইটি বের করে মন দিলাম কাব্যপাঠে। অনেক ভাল।
হেনকালে গাড়ির সাউন্ডসিস্টেমে বেজে উঠল দোতারা আর বাঁশির মেঠো সংগত। আমি গাইয়ে হিসেবে যে মানেরই হই-না-কেন, শ্রোতা হিসেবে দুঁদে। কান খাড়া হয়ে উঠল অমনি— এ তো হালফিলের ফিল্মি গান নয়! আর তারপর, সংক্ষিপ্ত ইন্টারলিউড শেষ হতেই গেয়ে উঠল এক মহাজাগতিক কণ্ঠ— ‘পরের জায়গা, পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই,/আমি তো সেই ঘরের মালিক নই!’
পড়া ছিল বটে, ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো’। বোঝা হল এবার। সে এমনই এক গলা— যার ভাল-মন্দ ভারি-হালকা হয় না; সিধে গিয়ে হানা দেয় বুকের অন্তরতর লোকে। খাঁটি লোকগীতি যাকে বলে। ছোটখাট মুড়কি চলছে বিদ্যুৎবেগে, আওয়াজ লাগছে গিয়ে সুরের এক্কেবারে মাঝখানটায়। আর হ্যাঁ, এই সবকিছুই চলছে একেবারে আয়াসহীন নির্বিকার একটা ভঙ্গীতে— যেন জন্মাবধি এইভাবেই গেয়ে চলেছেন অচেনা মানুষটি। চেনা গান, হাজারবার শোনা গান যেন সহসা উৎক্ষিপ্ত হয়ে গেল সুরের মহাকাশে।
কে এই সিদ্ধপুরুষ!
গান শেষ হতেই হামলে পড়লাম সারথির ঘাড়ে—‘এ কার গলা ভাই? কে গেয়েছেন এ গান?’
সে অত্যন্ত অবাক হয়ে বলল— ‘আপনে আব্দুল আলিমের গলা চিনেন না! নাকি তামাসা করতিসেন?!’
আব্দুল আলিম! না, এ নাম তো শুনিনি! সে হোক— বিপুলা এ পৃথিবীর…ইত্যাদি ব’লে নিজেকে সান্ত্বনা পরেও দেওয়া যাবে। উপস্থিত এই শিল্পীর আরও গান শুনে ফেলাটাই জীবনের প্রধান কাজ। তড়িঘড়ি বললাম— ‘এঁর আরও গান চালাও দেখি ভাই!’
এইবার শুরু হল অনুসন্ধান। গাড়িতে কুল্লে একটিই সি.ডি.আছে। তাতে নানাধরণের প্রায় শ‘দেড়েক গান। ইনলে-কার্ড কিছু নেই। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে ব’সে একটার পর একটা গান এক লাইন ক’রে বাজিয়ে চললাম। সে বেচারা আড়নয়নে চেয়ে ভাবতে লাগল—’এ কোন পাগলকে গাড়িতে তুললাম রে বাবা!’
নেই। একটাও নেই আব্দুল আলিমের গান। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। ওই একটা গানই বার পাঁচেক শুনলাম— যা পাওয়া যায় আরকি। কিন্তু সমুদ্দুর থেকে ঘটি ভরে আনলে কখনো মন ভরে? বেজার মুখে ফিরে এলাম আমি।
রাত্তিরে তো বেজায় ধুমধাম করে হয়ে গেল মেঘদূত। চারিদিকে বিদ্বজ্জনের ভিড়, কেউ এসে অভিনন্দন জানাচ্ছেন; কারো বা প্রশ্ন— ‘প্রথমদিবসে আর প্রশমদিবসে’— এর মধ্যে কোন্ পাঠটি কেন গ্রহনযোগ্য। আমি স্বভাবতই থতমত। ‘মুসলিম’ বাংলাদেশে এত মানুষ এইরকম প্রেমে সংস্কৃত-চর্চা করেন!
এইসময় একটি ছেলে এসে মৃদুস্বরে বলল— বাইরে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বললাম— ‘এখানে আসতে বলুন না!’ জানা গেল— তিনি কোনও কারণে ভিতরে আসতে রাজি নন। তা গেলাম। গেটের কাছে আসতেই বাইরের অন্ধকার থেকে আলোয় বেরিয়ে এল আমাদের সেই সকালবেলার সারথি। কাছে এসে বলল— ‘স্যার, চিনতে পারতিসেন? আমি সেই সকালে…।’ অবাক হয়ে বললাম— ‘আমি এখনো এত ভুলোমন হইনি যে, সকালের পরিচয় রাত্তিরে ভুলে যাব। কিন্তু তুমি বাপু বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
অতিশয় কুণ্ঠার সঙ্গে সে বলল— ‘না স্যার, ঢুকব না কেন… মানে আসলে বড় বড় সবাই এসেছেন… আমি তো সকালে বুঝিনি আপনি যে এত ভাল গান গাইতে… মানে… আপনি ওর’ম মুখ করে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন তো! তাই ভারি খারাপ লাগল। ভাবলেম বিদেশ থেকে এসে মানুষটা এট্টা গান শুনতি চাইল— তাও শুনাতি পারলেম না! দুঃখ পেল! তাই সারাদিন ধরে খুঁজে…এ সি.ডি. তো এখেনে মোটে মেলে না এখন আর… শেষে এক বন্ধুর সি.ডি.র দোকান ছিল— উঠে গেছে এখন— তারে বললাম— তুই দ্যাখ দি’নি তোর ঘরে যদি… তা সে-ই এটা খুঁজেপেতে বার করলে। আমি অনেকক্ষণ এসেছি, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না ভিতরে যাওয়ার। এ বাড়ির মালিক অবশ্য চেনেন আমারে… কিন্তু এত এত সব লোকজন… অগোছালো ভাষায়, অপ্রতিভ ভাবে এইসব বলে, সে পকেট থেকে বের করে দিল এক মহাশিল্পীর গানের সি.ডি.— ভারতে জন্মে যাঁকে চলে যেতে হয়েছিল বাংলাদেশে, সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানে। যে বছর তিনি চলে যান বাংলাদেশে, ঠিক সেই বছর আমার পিতামহ চলে এসেছিলেন ভারতে। এতদিনে দেখা হল দুই উদ্বাস্তুর। একজন তাঁর দেশের নক্ষত্র, অন্যজন তাঁর দীনতম ভক্ত, ব্যাকুল শ্রোতা। সংকুচিত ছেলেটিকে আরেকটু সংকুচিত করে, আমি তাকে বুকে টেনে নিলাম। শুধু এক ‘বিদেশীর‘বিষন্ন মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যে ছেলে সারাদিন কাজ ফেলে দৌড়তে পারে, সে যে আমারই আত্মীয়— তাতে সন্দেহ কী !
যুক্তি, তর্ক, বুদ্ধিমত্তা— খুব ভাল জিনিস— সন্দেহ নেই। কিন্তু মিলন ঘটাতে জানে শুধু সুর। প্রেম। হৃদয়। এই বিবদমান, অবিশ্বাসী এবং দ্বন্দ্বে-দীর্ণ সময়কে যদি কেউ বদলাতে পারে— তাহলে তা গান। সুর। সাহিত্য। ওটাতে বাধা দিতে পারে— এমন কোনও কাঁটাতার আজ অবধি দুনিয়ার কোনও নেতা, কোনও ধর্মগুরু তৈরি করতে পারেননি। পারবেনও না।
ভাল থাকুন। চারিদিকে বড্ড বেসুর বাজে। ভাল থাকতে হলে—তারই মধ্যে— সুরে থাকুন সবাই।
৯৫
বিয়ের পর লোকজন আজকাল কাহাঁ কাহাঁ মুল্লুকে বেড়াতে যায়। আমরা গিয়েছিলাম দীঘা। একে তো টাকা ছিল না, তায় ছুটির অমিল। কিন্তু যেমন আমার, তেমনি আমার গিন্নির— যাকে বলে পায়ের তলায় শর্ষে। কাজেই গরমের ছুটির তিনমাস আগে থেকে আমরা মাথা খাটাতে শুরু করলাম— কোথায় যাওয়া যায়। জ্যাঠতুতো ছোট বোনটা তখন স্বামীর চাকরিসূত্রে থাকত ভাইজাগে। জানা গেল— সেই ভারি সুন্দর শহরটিতে ওই সময়ে— মানে জুন মাসে বেজায় গরম হবে বটে, কিন্তু কাছেই আর একটা জায়গা আছে। নাম তার আরাকু ভ্যালি। সে নাকি অপূর্ব জায়গা, এবং রীতিমতো ঠাণ্ডাও। কাজেই ফোনে কথা হয়ে গেল— একদিন বোনের বাড়িতে থেকে আমরা চলে যাব আরাকুতে। মহা উৎসাহে চেন্নাই মেল এবং কিরন্ডুল প্যাসেঞ্জারের টিকেট কেটে ফেললাম। হোটেলও বুক করা হয়ে গেল।
এখন ফিরে তাকালে দুটো কথা খুব মনে হয়। একে তো তখনও দীপুদার বাইরে কিছু দেখিনি। কাঁচা দৃষ্টি। তারচেয়ে বড় কথা— সেই সতেরো বছর আগের আরাকু ছিল আজকের তুলনায় প্রায় অনাবিষ্কৃত, অনাঘ্রাত। বড় হোটেল বলতে সেই ময়ূরী— যেখানে ওঠার সাধ্য ছিল না আমাদের ; আমরা উঠেছিলাম একেবারে বাজারের মধ্যে অতি ছোট, অতি সাদামাটা একটা হোটেলে। কিন্তু যা ছিল— তাকে বলা চলে ‘প্রাকৃতিক কৌমার্য’। ছিল অনিবার সবুজ মাঠ, নীলাভ অনুচ্চ পাহাড়, ছিল সেই পাহাড়ের সানুদেশ আলিঙ্গন করতে আসা মেঘ— ‘মেঘমাশ্লিষ্ট সানুম্’। ছিল রাঙা টালি দিয়ে ছাওয়া ছোট্ট ইশকুল-বাড়ি, প্রাচীন সব সরলরেখার মতো গাছ; নন্দলালের ছবির মতো আমাদের ছোট নদী সত্যি আঁকাবাঁকা পথে চলত। একপশলা বৃষ্টি হলেই তাতে লাল-টুকটুক জলের স্রোত বইত।
মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা দু’টি প্রাণী। সারাদিন দু’টিতে ঘুরঘুর করে বেড়াতাম আরাকুর বুক চিরে চলে-যাওয়া ঝকঝকে ঢেউ-খেলানো রাস্তাটি ধরে, বসে থাকতাম ছোট্ট নদীর উপরের ক্ষুদে সাঁকোর উপর, ক্কচিৎ নেমে যেতাম ধু ধু মাঠের দিকচিহ্নহীন প্রসারতায়। সন্ধ্যের পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে চাঁদ উঠত; দু’জনে হেঁটে বেড়াতাম জ্যোৎস্না আর ছায়ার কাটাকুটি-খেলা রাস্তা দিয়ে। আর কেবলই বলাবলি করতাম— এ যেন ঈশ্বরের খেলাঘর।
একদিন বিকেলে অমনই এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছি। পথের ডানদিকে অনেক দূরে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রেললাইন দিয়ে চলে যাচ্ছে অনন্ত মালগাড়ি— কালভার্টে বসে দেখছি তাই। এমনসময় চোখে পড়ল— রাস্তার বাঁদিক দিয়ে একটা ছোট্ট পাকদণ্ডি উঠে গেছে দুটো পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে। এমনিই হাঁটা দিলাম দু’জনে সেই কাঁচা রাস্তা ধরে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটা অদ্ভুত দৃশ্য।
বাঁ দিকের পাহাড়টার গায়ে, পথের পাশে একটি আদিবাসী মেয়ে কাজ করছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। পরনে তার খুব মলিন, খুব পুরনো একটা শাড়ি, কুচকুচে কালো শরীরে ঝলসে উঠছে বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুর। অনেক কাঠকুটো আর গাছের ডাল জোগাড় করে সে যা বানাচ্ছে— তা একটা বাড়ি। গাছের ডাল দিয়ে বানানো হয়েছে কাঠামোটা, এখন কাঠকুটো দিয়ে তাকে ভরাট করার কাজ চলছে।
এমন কোনও অভূতপূর্ব দৃশ্য নয় যে, আমরা কত্তা-গিন্নিতে হাঁ করে দাঁড়িয়ে যাব। যেতামও না, যদি না আমাদের চোখে পড়ত— বাড়িটা বানাচ্ছে সে একাই। সম্পূর্ণ একা। আর কেউ নেই সেখানে।
আদিবাসী সমাজ সম্পর্কে আমি বা আমার গৃহিনী ততটুকুই জানি— যতটা জানি থিওরি অফ রিলেটিভিটি সম্পর্কে। কিন্তু দৃশ্যটা, বলা ভাল ওই একাকীত্বটাই টেনে নিল আমাদের। সসংকোচে এগিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম দু’জনে। দুই অনাহূত দর্শকের এই অনাবশ্যক কৌতুহলে সে বেচারি কাজ থামিয়ে তাকাল আমাদের দিকে। তারপর শুরু হল এক আশ্চর্য কথোপকথন। সে যে ভাষা জানে, তার একবিন্দু আমাদের আয়ত্তাধীন নয়। উল্টোদিকে, তার হিন্দি-জ্ঞান অতি-সামান্য। তবু কথা হল। আর সেই কথাটুকুই জমে গেল আমাদের মগজে।
বাপ-মায়ের একমাত্র মেয়ে এ। এই রাস্তা ধরে আরও মাইল-টাক এগোলে এদের বাড়ি ছিল। ছিল— কেননা গত বর্ষায় সেই জীর্ণ বাড়িটি পড়ে গিয়েছে। আপাতত তারা আছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে; কিন্তু সেখানে বেজায় স্থানাভাব। সে তাই ঠিক করেছে— এবার বর্ষা আসার আগেই বাবা-মা-কে সে নিয়ে আসবে তাদের নিজেদের বাড়িতে। সঙ্গীসাথী তেমন কেউ না-থাকায় সে নিজেই কাজটা শুরু করেছে মাস-খানেক আগে। এখন চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ। আশা— বর্ষা আসার আগেই নতুন বাড়িতে সে নিয়ে আসতে পারবে বাপ-মা-কে। সারাদিন তাকে কাজ করতে হয় অন্যত্র, এই বিকেলটুকু সে খাটে নিজের স্বপ্নের পিছনে।
‘বাড়ি’ নামক জিনিসটা মেয়েরাই সৃষ্টি করে এ দেশে। নিজের নিজের বাড়ির দিকে তাকান মশাই— তাহলে আর দ্বিধা থাকবে না এ কথা বলতে— ‘হাসব্যান্ড’স নেম’ বা ‘কেয়ার অফ’— ফর্মের এই জায়গাগুলো দেখলে আসলে আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত!
৯৬
ইশকুল-মাস্টারের চাকরিটি বড্ড মজাদার। লোকজন একদিকে প্রাণপণে নিজের ইশকুল-জীবনের সোনামাখা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন; আবার তারই সঙ্গে অবাক হয়ে শুধোন—‘ওহো— আপনাদের শনিবারে ছুটি থাকে না?’ মস্ত চাকুরে বন্ধুটি— যে আমার নিদেন দশগুণ রোজগার করে— সেও আমি গরমের ছুটি কাটাচ্ছি শুনলে বিস্তর হাহুতাশ করে। ভুলে যায়— ছাত্রাবস্থায় এই গরমের ছুটির জন্য কী আকুল অপেক্ষা করত সে নিজেও। মায় অন্য সরকারি চাকুরেরা অবধি এইসময়টায় ভুলে যান— তাঁরা মাস্টারমশাইদের চেয়ে ঢের বেশি ছুটি এবং সুযোগসুবিধে ভোগ করেন।
তা বাপু, এসব নিয়ে আমার কোনকালেই কোন হিংসেও নেই, গর্বও নেই। কেননা আমি অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টাও করিনি, সে সাধ্যিও আমার ছিল না। ছেলেবেলায় গরমের ছুটি ছিল ভারি আকর্ষণীয় ব্যাপার। ছুটি পড়লে আমি ছুটতাম মামাবাড়িতে। আমার মাতৃকুল ঠিক আমার পিতৃকুলের মতো দরিদ্র টুলো পণ্ডিতের বংশ ছিল না। কিঞ্চিৎ জমিজমা বিষয়-আশয় ছিল তাদের। সেই সম্পত্তির মধ্যে একটি ছিল মস্ত এক আমবাগান— তা থেকে এই সময় ঝুড়িভর্তি আম আসত রকমারি প্রজাতির। আমি বাঙালি-কুলকলঙ্ক; আম্ররসিক নই আদৌ। কিন্তু সেই ঝুড়িভরা আম মেঝেতে ছড়িয়ে গোত্র-অনুযায়ী তাদের আলাদা আলাদা গুছিয়ে রাখাটা এক আশ্চর্য সম্মোহনী খেলা ছিল। সিঁদুরকৌটো বা মধুগুলগুলির মতো নামগুলোও ছিল যাদুভরা।
ছাত্র থেকে মাস্টার হওয়ার পর গরমের ছুটি অন্য মানে নিয়ে উপস্থিত হল। গরমের ছুটি মানেই পাহাড়। আগে থেকে টিকিট কাটা, নতুন নতুন পাহাড়ি গ্রামের নাম, হোম-স্টে, নতুন মানুষ। কিন্তু ছাত্ররা একইভাবে দিন গুনত— কবে পড়বে ছুটি, আর ঠিক কদ্দিন বাকি। আমি পলায়নের ব্যবস্থা ক’রে মজা দেখতাম।
ইতিমধ্যে ইশকুলের পৃথিবীতে একটা মস্ত পরিবর্তন এসেছে। চালু হয়েছে মিড-ডে মিল। আমাদের ছোট স্কুল। রান্না হয় না। দুপুরে এক ভদ্রমহিলা আসেন খাবার নিয়ে। নীচের হলঘরটায় জমে ওঠে খাওয়ার আসর। বাচ্চারা অনেকেই ডিমটা পকেটে ভরে নেয়, সঙ্গে নেয় বন্ধুর ভাগেরটাও— যদি অবিশ্যি সে ডিম না-খায়। রাত্তিরে বাড়িতে ঝোল হবে। রাস্তায় ব’সে আলুকাবলি বিক্রি-করা মানুষটি অদৃশ্য হলেন। কচুরি কেনাও বন্ধ হল।
এই ডিম যোগাড়ের ব্যাপারে সবচেয়ে সফল ছেলেটি হল বরেন। ও সবচেয়ে ভাল জানে— কার পাশে খেতে বসলে পাওয়া যাবে একটা বাড়তি ডিম।বরেন্দ্রনাথ মল্লিকের নামটাই জমকালো। ছেলেটি রোগা-পাতলা, টকটকে রঙ আর বাঁশির মতো নাক শুধু জানান দিত— ও আমাদের মৃতপ্রায় স্কুলটার আরও কয়েকটা ছেলের মতোই পড়তি অভিজাত বাড়ির ছেলে। পরে ওদের প্রকাণ্ড জরাজীর্ণ বাড়িটাও চিনিয়ে দিয়েছিল একদিন। তা এবারের গরমের ছুটির আগের দিন গেছি ক্লাস নিতে। ছেলেপুলে বিশেষ আসেনি; যে ক’জন এসেছে— তাদের পড়ার মুড নেই। গপ্প হচ্ছে জমিয়ে। পাহাড়ের গপ্প। কবে কোথায় কী দেখেছি আমি— তাই ফলাও করে বলছি। ছেলেরাও অনেকেই ‘দেশের বাড়ি‘যাবে ; তারাও বলে চলেছে সোচ্চারে। এহেন সময় বরেন মৃদু কণ্ঠে বলল—‘স্যার, এবার গরমের ছুটি ক’দিন দিয়েছে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম—‘সে কী রে! ছুটির লিস্টি দেখিসনি? একই আছে তো! তিন হপ্তা!’
বরেনের ফর্সা মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল; বলল— ‘মানে একুশ দিন হয়, না স্যার?’
আমি একটু আশ্চর্য হয়ে বললাম— ‘হ্যাঁ। ছুটি পাচ্ছিস, তাতে এত দুঃখ পাওয়ার কী হল রে!’
তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বরেন বলল— ‘না স্যার, দুঃখ পাব কেন! মানে… একুশ দিন…অনেকটা সময়…না স্যার?’
বেজায় সন্দেহজনক আচরণ। কাছে ডেকে জনান্তিকে শুধোলাম— ‘কী হয়েছে রে? কোথাও বেড়াতে যাবি? ডেট অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না? সমস্যা হলে বল্। দেখি, কি করা যায়।’
বরেন একটু চুপ করে থেকে বলল— ‘না স্যার, সত্যি বলছি— কোত্থাও যাব না। তা না…আসলে… মা তো দুপুরে লেকটাউনে একটা বাড়িতে রান্না করে। তাই বাড়িতে রান্না হয় না। বাবা তো অটো চালায়। বাইরেই খেয়ে নেয়। কিন্তু রাত্তিরে এসে যদি দেখে ডিম হয়নি…মারবে স্যার। খুব মারে। নেশা করে আসে তো। মাকেও মারবে, আর আমাকে তো…সেটাই ভাবছি স্যার… আমি তো নিমতলায় ভোলেবাবার পোসাদ খেয়ে নেব, কিন্তু ডিমটা… মানে বাবা ডিম না-পেলে… একুশ দিন বললেন— না স্যার? কবে খুলবে তা’লে? বারো তারিখ, না স্যার?’
কলিকালে যে ‘ছুটি’ শব্দের অর্থ দাঁড়াবে ‘অনাহার’— এটা অবশ্য কোনও শাস্ত্রেই লেখেনি। না বেদে, না কোরানে।
৯৭
বললে বিশ্বাস করবেন না— এককালে আমিও যুবক ছিলাম। সে ছিল এক দিন আমাদের! রাত্তির এগারটার সময় আড্ডা মারতে মারতে ঠিক হয়ে যেত— পরদিন ভোর পাঁচটার বাস ধ’রে আমরা দীঘা যাব। যেতামও! তারপর ষাট টাকার ডাবল-বেড রুমে পাঁচজন মিলে থাকা, রাতভর আড্ডা; আর যা যা হত— সেসব ভদ্রসমাজে বলা যায় না। সে ছিল এক দিন আমাদের…
তে হি নো দিবসা গতা। আমাদের গেছে যে দিন— একেবারেই তা গেছে। সেদিনের সহযাত্রী বন্ধুরা আজ সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠ; আমার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া আজ তাদের সত্যিই মানায় না। আর আমি আজ দীঘা ছাড়িয়ে আন্দামান আর গোয়ার আশ্চর্য বর্ণিল নীল-সবুজ সাগরকিনারে ঘুরে এসেছি। ঘোলা জলের পাঁচিল-ঘেরা দীঘা আজ ব্রাত্য।
তবে কী— প্রথম প্রেম হল প্রথম প্রেম। ঘুমের ভিতরে নিশিডাক দিয়ে যেতে অতুলনীয়। কাজেই এবার যখন নানা কারণে গোটা গরমের ছুটিটা লেখার টেবিলেই কেটে গেল— তখন সহসা ডাক এল পিন্টু ভটচাজের কণ্ঠে— ‘চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায়’। যাদৃশী ভাবনা যস্য…। ব্যাগ গুছিয়ে পরদিনই সেই চিরপরিচিত দীঘা। এখন অবিশ্যি সেই ষাট টাকার ঘরে ওঠা যায় না— সমুদ্রের কাছেই এ.সি. রুম। সে ঘরে বাইরের গরম, সমুদ্দুরের হাওয়া, কিম্বা ধরুন সেই ঢেউয়ের গর্জন— কারোরই ঢোকার জো নেই।
অনেক পাল্টে গিয়েছে দীঘা। ঝলমলে হয়েছে খুব। আবার ঝিনুক নেই; নেই সেই সি-হকের বিচ— যেখানে বাবা আমায় শেখাত সমুদ্রে স্নান করার নিয়মকানুন। কিন্তু দেখলাম— বাজারটা অমনই আছে। আছে সেই পমফ্রেট আর চিংড়িমাছ। কাজেই কিনে ফেলা হল রকমারি মাছ। রাস্তার ধারের এক ঝুপড়িতে সেগুলো রাঁধতে দিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম এ.সি.র নিরাপত্তায়। ব’লে গেলাম— দু’টো নাগাদ খেতে আসব।
খেতে গিয়ে দেখি— আমাদের মতো আরও কিছু পর্যটক একই পথ নিয়েছেন। কেউ মাছ কিনে দিয়ে গেছেন, কেউ বা মাংস। খেতে বসলাম আমরা তিনজনে। রান্নাও চমৎকার! শুধু বড্ড গরম, কপালের ঘাম থালায় পড়ে বুঝি!
এহেন সময়ে গিন্নি নীরবে আঙুল দিয়ে কী একটা দেখালেন আমায়। তখন আমার দেখার অবস্থা নয় মোটেই; পমফ্রেট সেরে চিংড়িতে মন দিয়েছি। তবু— গিন্নির আঙুল। বাইরে তাকিয়ে দেখি— এক মাঝবয়েসী মহিলা— স্পষ্টত মানসিক ভারসাম্যহীন— পরনে ছিন্নবস্ত্র, গায়ে চিটচিটে ময়লা— হেঁটে যাচ্ছেন রোদে-পোড়া রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাথ দিয়ে। প্রত্যেক দোকানের সামনে গিয়ে হাত পাতছেন তিনি প্রার্থনায়। দোকানদাররা শশব্যস্ত ভঙ্গীতে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। পর্যটকরা তাঁকে দেখে বদলে নিচ্ছেন ফুটপাথ।
আমাদের খাওয়া থেমে গেছে তখন। হঠাৎ কানে এল এক বিচিত্র আহ্বান—‘ও দিদি! এদিকে এসো দেখি!’ ফিরে দেখি— সেই ভদ্রলোক— যাঁকে সকালেই বুঝিয়ে গেছি কী কী রান্না করতে হবে— তিনিই ডাকাডাকি জুড়েছেন। আপাতত তিনিও সপরিবারে খেতে বসেছেন একটা ফাঁকা টেবিলে।
রাস্তা পেরিয়ে এলেন সেই মহিলা। ভদ্রলোকের চোখের ইশারায় ঝুপড়ির বাইরের বেঞ্চে পাতা হল আর একটা থার্মোকলের থালা। তাতে পরিবেষণ করা হল ভাত-ডাল-আলুভাজা— যা খাচ্ছিলেন হোটেলমালিক এবং তাঁর পরিবার। মালিক এবার হেঁকে বলল— ‘আর দেরি না-করে খেয়ে নাও দিদি। বসে যাও।’ আর সেই মহিলাও বিনা বাক্যব্যয়ে দিব্যি খেতে ব’সে গেলেন বেঞ্চের উপর বাবু হয়ে।
সামনে চেয়ে দেখি— গিন্নি শক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন আমাদের আয়োজনের দিকে। শেষ মাছটিও ততক্ষণে নেমে এসেছে এঁটো থালায়। বুঝলাম— এই মাছ দিতে পারবেন না তিনি।
খেতেও পারবেন না।
এমনসময় আবার শোনা গেল সেই মালিকের কণ্ঠস্বর— ‘রমেশ— একপিস মাছ দে দিদিকে।’ আর অমনি পাশে বসে খাচ্ছিল যে— বোধহয় ছেলেই হবে তাঁর— ভিতরের রান্নাঘর থেকে হাতায় ক’রে একটা মাছ এনে সযত্নে রাখল সেই ঘরছাড়া পাগলিনীর থালাতে। তিনি নির্বিকার চিত্তে খেতে লাগলেন যথারীতি।
মনে পড়ল— এক ফেসবুক-তুতো বোন (তার নাম বলতে মানা) একবার জানিয়েছিল তার ছোট্ট মেয়ের কাণ্ড। মায়ের হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে সে কুড়িয়ে নিয়েছিল একটা অতিক্ষুদ্র জাতীয় পতাকা— কেননা আর একটু হলেই সেটা পড়ে যাচ্ছিল নর্দমায়।
এটুকু করার জন্য বয়েস লাগে না। অর্থ লাগে না। যোগ্যতা লাগে না। পরিসংখ্যান লাগে না।
লাগে একটা হৃদয়। সোনায়-গড়া মন লাগে একটা। উপরের দিকে গড়ানোর উপায় নেই জলের। কিন্তু আজও নীচের দিকে বয়ে যায় বইকি সেই স্নেহের নির্ঝরিণী!
৯৮
যে পাড়ায় আমি আট বছর বয়েস থেকে আজ অবধি বাস করছি (ফ্ল্যাটে বাস মানে আমার মতে প্রবাস-মাত্র), সেখানে মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের বাস। একে বাড়ির সামনে মাঠ, তায় আমি নিজে ক্রিকেটের পোকা। সেকালে— মানে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে— বাচ্চারা বিকেলে মাঠেই আসত, প্লে-স্টেশনে নয়। ফলে গোটা পাড়ায় হেন বাচ্চা ছিল না, যাকে আমি চিনতাম না। আর বিকাশ দাস ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়দর্শন, সবচেয়ে দরিদ্র। আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট, ধবধবে ফর্সা বিকাশ মাঠের অন্য কালোকোলো বাচ্চাদের থেকে বামানান ছিল একদম, যেখানে আমি বা ভাই দিব্যি মানিয়ে যেতাম। কিন্তু আমার বাবা ছিল কলেজের লাইব্রেরিয়ান, আর ওর বাবা বিড়ি বাঁধত। আমাদের বাড়ির পিছনের রাস্তাটার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে ছিল ওদের মস্ত পরিবারের জমি, তার একপাশে একটা বিশাল দোতলা বাড়িতে ওর জ্ঞাতিকুল বাস করত; আর ওই জমিরই অপরকোণে, গোয়ালের পাশে একটা বেড়ার ঘরে থাকত ওরা। পাড়ার যেকোন কাজে— তা সে মড়া-পোড়ানোই হোক আর ফিস্টের খিচুড়ি রান্না— বিকাশ ছিল সবচেয়ে উৎসাহী সদস্য। কিন্তু অসহনীয় দারিদ্র্য ওকে তিষ্ঠোতে দিত না কিছুতেই।
কোনোমতে হায়ার সেকেন্ডারি পেরিয়েই কাজে নেমে পড়ল বিকাশ। আমি যখন অনার্স শেষ করছি, ততদিনে ও এক জ্ঞাতির ব্যবসায় খাটতে আরম্ভ করে দিয়েছে, মাইনে মাসে হাজার টাকা। বছর পাঁচেক পরে ও জানতে পারল— ওর সঙ্গে যারা কাজ করে, তারা কেউ কেউ ওর দশগুণ টাকা পায়। দাদার ভরসায় ছিল, বোঝেনি৷ এবার ও কাজ নিল সল্টলেকের এক সরকারি ঠিকাদারের আপিসে। ভয়ানক অপমান হজম করত রোজ, আর বাড়ি ফিরে বাপের কাছে শুয়ে কাঁদত নিঃশব্দে। গরীবের ঘরের একমাত্র ছেলে; অনাহারে অভ্যস্ত, অপমানে নয়।
গত বিশ বচ্ছরে ও ছুটি নিয়েছে কুড়ি দিন। বন্ধের দিনগুলোতে অফিসে যাবে বলে ভোর চারটে কুড়ির ট্রেন ধরেছে, পৌঁছে গেছে সাড়ে ছ’টার মধ্যে। ‘মালিক হেব্বি কড়া, বোঝলা রাজাদা। মর্নিং ওয়াকে বাইরাইসে, দ্যাখে আমি সিঁড়িতে বইয়া আসি। কয়— ‘তুমি এত ভোরে এখানে কী কর?’ আমি কই— স্যার, আইজ বন্ধ্, যদি পৌঁছাইতে না পারি… তাই…! তহন মালিক কয়— ‘তুমি তো আমার কাজ বাড়িয়ে দিলে! আমাকেও তো তাহলে আসতে হয়!’ দেখি আইস্যা পড়সে ঠিক সাড়ে দশটায়!’
এইভাবে একটু একটু করে ‘মালিক’-কে জিতে নিয়েছে বিকাশ। আজ সবচেয়ে বড় চেকটা পৌঁছে দেওয়ার ভার ন্যস্ত হয় ওরই ঘাড়ে, মালিকের ছেলের জন্মদিনে নেমন্তন্ন থাকে পুরো অফিসে একমাত্র ওরই।
কাল, দশমীর দুপুরে যাচ্ছিলাম ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে। পাকড়াও করে নিয়ে গেল ভিতরে। দুটো বেডরুম (তাতে অবিশ্যি সেই পুরনো চৌকি দুটোই), ওপেন কিচেন, ঝকঝকে টয়লেট, ছাদে-যাওয়ার সিড়ি, মার্বেলের মেঝে দেখে আমি হাঁ! শতমুখে প্রশংসা করল মালিকের, বারবার বলল, তিনি না থাকলে এসব হতই না! প্ল্যান করে দিয়েছেন, বালি পাঠিয়ে দিয়েছেন, সিমেন্ট যোগাড় করে দিয়েছেন; একজন ইঞ্জিনিয়ারকে বলে রেখেছেন প্রত্যেকদিন এসে তদারকি করে যেতে, কেননা বিকাশ ভালো করে বোঝে না এসব কাজ। বেড়ার ঘর থেকে অতিক্ষুদ্রাকার প্রাসাদ পর্যন্ত একটা রূপকথার জয়যাত্রা দেখে আমি অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি; শুধু বিকাশ ভেজা গলায় বলল— ‘বাবা দেইখ্যা গ্যালে আর একটু ভাল লাগত রাজাদা। যাউকগা, মায় দেইখ্যা গেল— এইয়া কি কম, কও?’ দেখি, বিকাশের মা মড্যুলার কিচেনে দাঁড়িয়ে রান্না করছেন, শুধু পিঠটা আরেকটু বেঁকে গিয়েছে অন্তহীন বাসন-মাজা আর বয়সের ভারে।
ও আমার দেশ! আর কতবার তুমি আমায় শেখাবে— ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন!’ নিজের কাজটুকু নিরভিমানে করাই তো আমাদের দায়িত্ব ছিল! এত বুদ্ধি করে সবাইকে বঞ্চিত করতে শিখলাম কবে আমরা! ফলের আশা কেন আমায় আর আমাদের এমন হীনবৃত্তিপরায়ণ করে তুলল! বিকাশ, আয়, হাত ধর ভাই! সময়মতো ইশকুলে যাই, মন দিয়ে লিখতে শিখি তোর কাছ থেকে!