অখণ্ড ভারতবর্ষ – ২০

২০

আমার সেই মেজদা, যে ভিখারির কাছেই ভিক্ষা চেয়েছিল, এটাও তার গল্প। তখন সে ব্যাংকের কর্মী, মেদিনীপুরের একটা গঞ্জে থাকে। কাছেই কেলেঘাই নদী। এগারো মাসের ছেলেকে নিয়ে আমরা সবাই বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে। ছেলে তখনও হাঁটতে শেখে নি; পায়ে পায়ে ঘোরে হামাগুড়ি দিয়ে,আর মাঝে মাঝেই মুখ তুলে বলে— ‘বাব্বা!’ ওইটেই তার অতি ক্ষুদ্র শব্দভাণ্ডারের একমাত্র শব্দ।

বিকেলে আমরা গেলাম নদী দেখতে। এ নদী এমন নদী, যাতে নামতে হলে উঠতে হয়। মস্ত বাঁধ নদীর পাড়ে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। অনেক নীচে হেমন্তের শীর্ণা স্রোতস্বিনী, শরবনে বিভক্ত। উলটোদিকে ছোটো ছোটো দ্বীপ, তার মাথায় একটা দুটো করে বাড়ি। তারও পিছনে আদিগন্ত ধানখেত। নদীর পাড়ে সারি সারি নৌকো বাঁধা। বোন, জামাই, ভাগ্নি, এমনকী গিন্নী অবধি বায়না ধরল— নৌকাভ্রমণে যাবে। ছেলেকে নিয়ে নৌকোয় ওঠা আমার সাহসে কুলোলো না; দাড়িওয়ালা বুড়ো মাঝি ওদের নিয়ে চলে গেল, আমি ছেলে কোলে ঘুরতে লাগলাম বাঁধের উপরে। তখন হাটুরেরা ঘরে ফিরছে। জমে উঠছে আলোচনা— জমির বা মাছের দাম, চাষবাসের অবস্থা— এইসব নিয়ে। শুনতে লাগলাম।

সন্ধ্যে হয় হয়, এইসময় দেখি— নৌকো ফিরছে। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে ওদের মুগ্ধ উত্তেজিত মুখ। কিন্তু কী যেন একটা আলাদা। কী? তারপর খেয়াল করলাম— মাঝি বসে আছে পিছনে, আর নৌকো বাইছে আমার ব্যাংক-ম্যানেজার মেজদা! তার হাতে বৈঠা, মাঝির হাতে হুঁকো! এ কী কাণ্ড! ওপরে আসতে জিগ্যেস করলাম। নির্বিকার মুখে বলল— ‘এমন কিছু কঠিন না রে। ভালো করে দেখে নিলাম, যখন মনে হল পারব, বললাম— দেবেন একটু? তা দিল। দিব্যি পারলাম। দেখলি তো।’

দেখলাম বইকি। দেখলাম, চেষ্টা করলে নিজের নৌকো নিজেই বাওয়া যায়। আমরা কেবল কর্তব্য এড়াই, অযোগ্য মাঝির হাতে তুলে দিই বৈঠা, আর নালিশ করি। সেই যে মানুষটা, যে নিজেই তুলে নিয়েছিল বৈঠা, নিজেই হাল ধরতে চেয়েছিল— সেও তো কোথায় হারিয়ে গেল। তাইহোকু না সাইবেরিয়া, শৌলমারি না আর কোথাও— তাও জানি না। নিজের তরণী নিজেই পারে লাগাতে গেলে একাই হাল ধরতে হয়— এটুকুই জেনেছি শুধু। আর ভয় পেয়েছি। একা হয়ে যাওয়ার ভয়। খেয়াল করি নি, তাহলে আর মৃত্যুদিন থাকে না।

শুধু জন্মদিন থাকে।

২১

আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণী, তখনো হাফপ্যান্ট। রফিকুল টিফিনের সময় ষড়যন্ত্রকারীর মতো ফিসফিসে গলায় খবর দিল— কলেজের মাঠের খেতের আলুগুলো খাওয়ার যুগ্যি হয়ে গেছে।

আমাদের এলাকার কলেজটার পেছনেই মস্ত চাষের মাঠ। তরবেতর সবজির চাষ হয় তাতে; আবার ধান বা সর্ষেও ফলে। শীতের শেষ সেটা। আলু উঠবে এইবার। চুরির যোগ্য সময়। ঝুঁকি তো আছেই; ওই কলেজটাতেই বাবা সারাদিন থাকে, কী করে কে জানে। নালিশ হতেই পারে। তা হোক! এই সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।

সুতরাং পরের দিনই ইশকুল পালিয়ে মাঠে। অবিশ্যি তার আগে বিস্তর যোগাড়-যন্তর করতে হয় বাপু! বিনু— মানে বিনায়ক চক্রবর্তী আনবে ছুরি। আমি নুন। নিখিল সর্দার (তখনও এস.টি. বুঝি না। তবে বৎসরান্তে নিখিল একটা টাকা পেত— সেটা খুব বুঝতাম; কেননা আমরা তার কিয়দংশ চিটগুড় ও অন্যান্য দেবভোগ্য কিন্তু নিষিদ্ধ খাবারে ব্যয় করতাম।) আনবে আমতেল আর লংকা। রফিক দেশলাই। সব লাগবে কাজে।

পরদিন দুপুরে আলু খেতে পৌঁছনো গেল সদলে। কেউ কোত্থাও নেই। কাজটা কঠিন— খুউব সাবধানে একটা একটা করে গাছ নাড়িয়ে নাড়িয়ে তুলে, সবথেকে বড় আলুটা নিয়ে আবার নিপুণ হাতে গাছটাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া। তা সেটা নির্বিঘ্নেই করা গেল। ছিঁড়ে নেওয়া হল মটরশুঁটি। তারপর কেটে নিতে হবে ধান কেটে-নেওয়ার পর থেকে যাওয়া অংশটা— যাকে বলে নাড়া। এইবার নয়ানজুলি পেরিয়ে, বাঁশঝাড়ের আড়ালে, ঝোপের মাঝখানের নিভৃত ঘাসজমিটায় বসে জ্বালানো হল আগুন। আলু পুড়ল। সেই আলুপোড়া মাখা হল সব সরঞ্জাম— আমতেল-নুন-লংকা ইত্যাদি দিয়ে। কলাপাতার অভাব নেই। তার উপর তৈরি হল একটা মস্ত আলুমাখার স্তূপ। আহা! তেমন সুস্বাদু খাবার কী পৃথিবীতে আর আছে! খেতে লাগলাম চারজনে— আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে পড়ন্ত শীতের দুপুরে ডেকে চলল টুনটুনি আর কুবো, সড়সড়িয়ে চলে গেল গোসাপ। একই কলাপাতা থেকে খেতে লাগল চার বালক— রাজা ভট্টাচার্য, বিনায়ক চক্রবর্তী, নিখিল সর্দার আর রফিকুল ইসলাম।

আর আজ, এই বয়েসে এসে আমি স্বপ্ন দেখছি সেই আলুমাখার। আর ভাবছি, আর একবার— একটিবার যদি ফের বসতে পারতাম সেই ঘাসের কার্পেটে! কলাপাতায় মাখা হত আমতেল আর লংকার গন্ধ মাখা আলুপোড়া। একবার!

এবার তাহলে আর একজনকে ডেকে নিতাম। বলতাম— ‘এই ছেলেটা, আলুপোড়া খাবি সবাই মিলে? একসাথে?’ যারা ওকে ঘেন্না করল, ঘেন্না করতে করতে মেরেই ফেলল; তাদের নিতাম না। ওকেই নিতাম আমাদের অভিযানে। বেঁচে থাকলে আজ— ঠিক আজকের দিনটায়— ওর সাতাশ বছর বয়েস হত। বলতাম— ‘নে, তোর জন্মদিনে মজা করলাম। সবাই কী আর ঘেন্না করে নাকি! ধুর বোকা!’

ওর নাম রোহিত। রোহিত ভেমুলা।

২২

এমএ পড়ি তখন। ক্লাসের চেয়ে বেশি সময় কাটে কফি হাউসের তুমুল আড্ডায়। শেষ লেখা কবিতাও পড়ি সেখানে, সদ্য-শহুরে চোখে হাঁ করে প্রবীণ লেখককেও দেখি সেখানেই।

সেদিনটা ছিল শহরের উষ্ণতম দিন। রোদের দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে গলা শুকিয়ে কাঠ। কোনোক্রমে দুটো ক্লাস করে ছুটলাম কফি হাউসে— সেটা যে কোন্ গুণে ‘শীতল স্থান’ হল— তা অবিশ্যি বোঝা মুশকিল। বয়েসটাই অমন ছিল।

গোটা দুপুরটা ওখানে হইহই করে আড্ডা মেরে বেরোলাম প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ। ট্রেন ধরতে হবে, টিউশন আছে। সে কী রোদ! চাঁদি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। ওই বয়েসে ছাতা ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না। বেরোতেই মনে হল, অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিলাম যেন। কী আর করা! দুই বন্ধু হাঁটা লাগালাম শেয়ালদার দিকে। ওইরকম সদাব্যস্ত জায়গাও বেশ ফাঁকা।

দু-পা হেঁটেছি, এমনসময় দেখি— এক বুড়ো বসে আছে ফুটপাথে। পরনে একটা খুব পুরোনো, কিন্তু পরিষ্কার বুকপকেটওলা পাঞ্জাবি; ময়লাটে ধুতি, পায়ে হাওয়াই চটি, পুরু চশমার ডাঁটিটা নীল সুতো দিয়ে বাঁধা। হাত নেড়ে আমাদেরই ডাকছে। গেলাম কাছে। ভাঙা গলায় কী যেন বলল বুড়ো, শুনতে পেলাম না। বসলাম উবু হয়ে। এবার বোঝা গেল। একটা প্রশ্ন। বুড়ো জিগ্যেস করছে—‘বাবা, হাতিবাগানটা সোজা গিয়ে ডানদিকে না?’ তাই বল। বুড়ো পথ হারাইয়াছে। বললাম—‘সামনের মোড় থেকে একটা বাস ধরে নিন, সোজা গেলেই হাতিবাগান। কন্ডাক্টারকে বলবেন, নামিয়ে দেবে।’

বুড়ো বলল—‘না বাবা। আমি তো হেঁটেই যাব। টিকিটের পয়সা নেই তো। সেই কালীঘাট থেকে হেঁটে আসছি বাবা। ছোট বোনটা থাকে ওখানে। দেখে আসি একবার। অনেক দিন যাই না। কেমন আছে…। বয়েস হয়েছে… রাস্তা গুলিয়ে যায় আজকাল। আচ্ছা, যাই আমি। তোমরা সাবধানে যেয়ো, যা রোদ আজ! ছাতা নাও নি কেন?’

মনে হল, আমার পা দুটো যেন যেন ফুটপাথে জমে গেছে। কোনোমতে পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম। বুড়ো ফোকলা মুখে একটু হেসে মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর বাড়ানো হাতটা সরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল কলেজ স্ট্রিটের দিকে। একটু পরে সে মিশে গেল ভীড়ের মধ্যে।

চোখ ফিরিয়ে দেখি— বন্ধুর চোখে জল। সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আমিও তাকালাম। একটুকরো মেঘ কোত্থেকে উঠে এসেছে। কলেজ স্ট্রিটের উপর এক টুকরো ছায়া।

 মনে হল, মায়ের প্রাণ ছাতা ধরেছে বুড়ো, অবুঝ ছেলের মাথায়। আর সেই বুড়ো ছেলে হেঁটে চলেছে কালীঘাট থেকে সুদূর হাতিবাগানের দিকে। বোনের খবর নিতে।

ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ…

২৩

কোম্পানি বাজার চেনেন? ওই যে বিডন স্ট্রিট আর রবীন্দ্র সরণী যেখানে মিশেছে— তার কোণটায়। খুব পুরোনো বাজার, নামেই বোঝা যাচ্ছে কোম্পানির আমলে তৈরি। ইশকুলে জয়েন করার পর জানলাম, এখান থেকেই সরস্বতী পুজোর বাজার করা হয়। প্রথমবার গিয়েছিলাম পনেরো বছর আগে, সেই থেকে এবার পর্যন্ত প্রত্যেকবার একই দোকান থেকে একই জিনিস কিনে আসছি। সব বাঁধা দোকান আর কি। এই নিয়মেই, ফল কোন দোকান থেকে কেনা হবে— তাও পূর্বনির্ধারিত। আর এখান থেকেই প্রত্যেকবার কিনি টেপারি— সেই ‘বুড়ো আংলা’য় পড়ার পর প্রথম দেখেছিলাম এই দোকানেই। ছাত্ররাও খায়, খানিক বাড়ি নিয়ে যাই ছেলের জন্য।

তা গতকাল ছিল সেই বাজার করার দিন। চার জন শিক্ষক আর কিছু ছাত্র মিলে গেলাম বাজার করতে। ফলের দোকানের ভদ্রলোক এমনিতে বেশ মিশুকে, শিক্ষকদের কিপটেমো আর ছাত্রদের দুষ্টুমি সামলান হাসিমুখেই। এক ধরণের মানুষ থাকে না, যাদের দেখলেই মনে হয়— ‘তোফা আছেন?’ ইনি সেই রকম। নীল-সবুজ চেক লুঙ্গি, ময়লাটে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা দাড়ি, গোঁফ নেই। চোখজোড়া সর্বদাই কেমন যেন হাসিখুশি।

এবার গিয়ে দেখি, তাঁর মেজাজ তিরিক্ষি। ভুরু কুঁচকে গজগজ করছেন খুব— ‘আরে করিস না পুজো! কে মাথার দিব্যি দিয়েছে! পুজোর ফলের থলে পা দিয়ে ঠেলতেছে! কী দিনকাল পড়ল! ইয়া আল্লা!’ হল কী? জিগ্যেস করতে জানা গেল— কোন এক ক্লাবের ছেলেরা এসেছিল পুজোর ফল কিনতে, তারা নাকি পায়ের মাঝে ব্যাগটা রেখে দাম মেটাতে গিয়েছিল। স্বভাবতই ব্যাগটা লেগেছে পায়ে, বুড়ো খেপে লাল। স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক? না তো! এই প্রথমবার ধাঁ করে মনে পড়ল— ইনি তো মুসলমান! কে পুজোর ফলে পা ঠেকাল, তাতে এঁর কী? দেখতে হচ্ছে। জিগ্যেস করে জানা গেল— বুড়োর নাম হান্নান শেখ। বাড়ি জয়নগরের মজিলপুরে। পাঁচ ওক্তো নমাজ পড়েন, ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তবে? সটান জিগ্যেস করলাম— ‘আচ্ছা, এই যে আপনি হান্নান শেখ, আর আমি রাজা ভট্টাচার্য, এসেছি আপনার কাছ থেকে সরস্বতী পুজোর ফল কিনতে— কেমন লাগে আপনার?’

একটুও না ভেবে তিনি বললেন— ‘আমারে এট্টা কথা বলেন। আপনের বেজায় তেষ্টা পেয়েছে। বিরাট মাঠের মইদ্যে এট্টাই বাড়ি। আপনি কী করবেন? আগে শুধোবেন— এ বাড়ি হিন্দুর না মুসলিমের? নাকি আগে পানি চাইবেন, খাবেন ঢকঢক করে— তাপ্পর ভাববেন ও সব! কে কোতায় বসে লড়ায়ে দেল, আমি-আপনি লাফাতি লাগলেম। আরে খিদে তো দু-জনেরই লাগে! খাওয়ায় কে বলেন তো!’

তারপর আমার স্তম্ভিত চোখে চোখ রেখে কেটে কেটে বললেন— ‘ওসব যারা ভাবে, তাদেরই মনে পাপ। বোঝলেন, মনে পাপ!’

একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ এক গাল হেসে বললেন— ‘ভালো কথা, টেপারি নেবেন না এবার ছেলের জন্য? ন্যান যে পেত্যেকবার!’

২৪

বাংলাদেশে এসেছি ‘মেঘদূতম্’ গাইতে। প্রাচ্যসংঘের আমন্ত্রণে। বিশাল কর্মকাণ্ড দেখে তাক লেগে গেছে। অনুষ্ঠানের আগের দিন, সন্ধ্যাবেলা। আড্ডা জমে উঠেছে এ দেশের বুদ্ধিজীবী মানুষদের সঙ্গে; অধিকাংশই অধ্যাপক, ডাক্তার, শিক্ষক। পিতৃপুরুষের ‘দ্যাশে’ ফেরার উত্তেজনা মিশে যাচ্ছে তাত্ত্বিক আলোচনায়।

এমনসময় বাবলুদা এক ভদ্রলোককে নিয়ে এলেন আলাপ করাতে। প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায়, এই অভিজাত পরিমণ্ডলে এঁকে মানায় না। ভাঙাচোরা মুখ, পরনে অত্যন্ত বেমানান শতচ্ছিন্ন একটা কোট, সর্বাঙ্গে দারিদ্র্যের চিহ্ন। বাবলুদা (একটু আগেই আলাপ হয়েছে এই চলচ্চিত্র পরিচালকের সঙ্গে, অসামান্য মানুষ ) আলাপ করিয়ে দিলেন—‘আসুন ডাক্তারসাহেব। এঁরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন।’

ডাক্তার! দেখে তো মনে হয় না! বৃদ্ধ মানুষটি আমার উলটোদিকের চেয়ারে বসলেন। বললেন— ‘কোথা থেকে এইয়েছেন আপনেরা ?’ অশোকনগর শুনেই তাঁর নিষ্প্রভ চোখ জ্বলে উঠল— ‘তালি তো বনগাঁ চেনবেন!’ মাথা নাড়লাম; চিনি বইকি। বললেন— ‘ওই বনগাঁ আমার দ্যাশ!’ এ কী কথা! দেশের বাড়ি তো আমাদের থাকে! তিনি বলতে লাগলেন—‘ওকেনেই থাকতেম তো। টাউনেই। রঞ্জন অপেরায় বিবেকের গান করতাম। শচীনবাবুর সিরাজুদ্দৌলা কল্লাম, লোকের জানি বান ডেকে গেল পালা দেকতি। নজরুলের গান। আহা! তা সে আপনেরা যাই বলেন— আর কেউ গান লিখতি জানে না।’ বলে গান ধরলেন—‘তিমিরবিদারি অলখবিহারি কৃষ্ণমুরারি আগত ওই। — শুনেছেন এ গান?’

মাথা নেড়ে আমিও ধরলাম— ‘টুটিল আগল, নিখিল পাগল…।’ একসাথে গলা মিলিয়ে গাইতে লাগলাম দুজনে, রাজা ভট্টাচার্য আর হোসেন আলি। দুই উদ্বাস্তু। ‘চৌষট্টিতে দাঙ্গা হল, চলে এলাম এপারে। একনও শোনে লোকে এ সব গান ? বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে…বলছি কি… যাবার সময় একটু দেইখে যাবেন তো, আমার বাড়িডা… বনগাঁ টাউনেই, বোঝলেন… ওই যে পোস্টাফিস রোড, ওখেন থেকে… এই আশি বছর বয়সে তো আর যাওয়া হপে না নে… আপনেরা যদি এট্টু…. আসপেন তো আবার? আপনি তো নজরুলের গান জানেন…’

আর আমরা ভাবি, শুধু আমরা— হিন্দুরাই উদ্বাস্তু!

২৫

খুব এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগে। এখনও হচ্ছে টিপটিপ করে। ইশকুল থেকে ফেরার পথে ভিজেছি সামান্য। মেট্রোয় দমদমে এসে তাই বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম চা খাবো বলে। স্টেশনে ঠাসা ভীড়; বৃষ্টি থামায় একবারে এসে পৌঁছেছে অনেক ডেলি-প্যাসেঞ্জার। আমার দুই সহকর্মীও আছে তার মধ্যে।

এমন সময় ভীড়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত চাঞ্চল্য তৈরি হল। প্রায় সবার মাথা ঘুরে গেল একই দিকে। আর আমার তরুণ সহকর্মীটি— যে এতক্ষণ গভীর মনোযোগে ইলেকট্রনিক বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল— হঠাৎ বেজায় উত্তেজিত হয়ে ভিজে ছাতা নাড়িয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগল। কী ব্যাপার?

একটু পরেই অবিশ্যি বোঝা গেল। ‘ব্যাপার’ই বটে। একটি মেয়ে। কেমন দেখতে— তা চোখেই পড়ছে না— কেননা তার পরনে একটা অসম্ভব টাইট হাঁটু-ঝুল প্যান্ট আর গায়ে চেপে-বসা আধো ভিজে গেঞ্জি। সুঠাম যুবতী শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট। আর স্টেশনের তামাম পুরুষ যাত্রীর চোখ সহসা জিভ হয়ে গেছে। যাওয়ারই কথা। ‘কী অসম্ভব নির্লজ্জ হলে এই পোষাক পরে জনারণ্যে এসে দাঁড়ানো যায়’— ভাবতে লাগলাম আমি, নির্লজ্জের মতো তাকে দেখতে দেখতে। সে কিন্তু নির্বিকার; মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত মাথা নীচু করে।

এই সময় ব্যারাকপুর লোকালের খবর হল। সিক্ত নারীদেহের মায়া ত্যাগ করে মুহূর্তেই একটা মস্ত ভীড় ছুটতে শুরু করল সিঁড়ির দিকে। আর তখনই একটা চিৎকার শুনতে পেলাম— ‘ও জগাদা! ও বিশু! গেলি কই তোরা! আরে আমি যে রইয়া গেলাম! লাঠিটা গেল কই, ও বিশু!’ যে তিন ভিখারি একটা লাঠিতে বাঁধা থেকে ভিক্ষে করে সারাদিন এই স্টেশনে— তাদের একজন ভীড়ের ঠেলায় ছিটকে গেছে। খুলে গেছে লাঠির বাঁধন। ‘আমি একা’— এই অসম্ভব চিন্তা তাকে পেড়ে ফেলেছে। একটু দূরেই তার দুই সঙ্গীও চিৎকার করছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে আকুল হাত— একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য। আর মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে উন্মত্ত জনস্রোত— তাদের চোখ আছে।

ঠিক এই সময় মোবাইল থেকে মুখ তুলল মেয়েটা। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই ছুটন্ত মানুষের বন্যার মধ্যে, এগিয়ে-আসা লোভী হাতগুলোকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে। কোনোক্রমে পথ করে এগিয়ে গেল আলাদা হয়ে যাওয়া তিন অন্ধের দিকে, আর একটা বুড়ো, শিরা-ওঠা হাত নিজের হাতে নিয়ে বড় যত্নে, বড় আদরে ধরিয়ে দিল সেই হারিয়ে যাওয়া লাঠিটাতে। বুড়ো যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে বলল— ‘জগা না কি রে ?’ জবাব এল—‘কোথায় গিয়েলে তুমি! উঃ, পেরানডা বেরোয়ে যাচ্ছিল আমাদের!’

নিঃশব্দে পিছিয়ে এল মেয়েটা। দাঁড়াল আমার সামনে এসে। এইবার আমার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে সে হঠাৎ ভারি লজ্জা পেল। খানিকক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে, একটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে, পায়ে পায়ে সে মিশে গেল ভীড়ের মধ্যে। আর আমার মনে পড়ল— যাঃ! একটা নমস্কার করার কথা ছিল যে!

টাইট গেঞ্জির নীচে যে একটা হৃদয়ও ছিল— মাথাতেই আসে নি!

২৬

দমদম জংশন স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের সিড়ি দিয়ে নামতে গেলেই দেখা যায়— একটি মেয়ে বাচ্চা-কোলে ভিক্ষে করছে। প্রতি বছর নতুন একটি শিশু থাকে তার কোলে। সন্দেহ হয়— সবকটিই তার নিজের নয়; প্রতিবেশীর সন্তানরাও থাকে মাঝে মাঝেই। তা বাচ্চা কোলে ভিক্ষে করা ভিখারিণীদের প্রাচীন প্রথা। ওতে বাৎসল্য জাগ্রত হয়— ভিক্ষা মেলে বেশি— সবাই জানে।

গতকাল ইশকুলে যাচ্ছি। নামছি সিঁড়ি দিয়ে। এদিকে আবার ব্যারাকপুর লোকাল দিয়েছে এক নম্বরেই— ফলে অগুন্তি মানুষ ছুটছে উপর পানে। এমন সময়, ওই মেয়েটা সিঁড়ির যে ধাপে বসে থাকে— সেইখানেই দেখলাম একটা বাচ্চাকে। বছর পাঁচেকের মেয়ে, শতচ্ছিন্ন নোংরা একটা ফ্রক তার পরনে, লালচে জটবাঁধা চুল, হাতে একটা প্লাস্টিকের থালা। থালাটা জলে ভরা। খুউব সাবধানে, পা টিপে টিপে, সেই থালাটা নিয়ে সে চলেছে সিঁড়ির ডানদিক থেকে বাঁ দিকে— ভীড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে। অতি ছোটো, অতি তুচ্ছ মেয়েটাকে কেউ দেখছেই না— ব্যস্ত চাকুরের দল দৌড়োচ্ছে ঊর্ধশ্বাসে। আমার সর্বাঙ্গ ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল— এই বুঝি কারোর পায়ের তলায় পিষে গেল বাচ্চাটা। না! ছুটন্ত পায়ের ফাঁক গলে, অতি সন্তর্পণে সিঁড়িটা পার হয়ে, উল্টোদিকের ড্রেনটা পর্যন্ত পৌঁছল সে। তারপর ওই জলটুকু সে ঢেলে দিল ড্রেনে। তারপর চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইল ভীড় কমে যাওয়ার আশায়। আমিও। একটু পরেই ট্রেন চলে গেল। সিঁড়ি ফের জনহীন।

এইবার আমি গিয়ে বসলাম তার সামনে হাঁটু গেড়ে। বললাম— ‘কী রে, কী করছিলি এটা? ওদিকে ফেললেই তো পারতিস জলটুকু!’

সে হাত উলটে বলল— ‘হ্যাঁ, আর কেউ পড়ুক পিছলে! তালে আর দেখতে হবে না। সোজা…’ বলে উপর দিকে দেখিয়ে দিল ছোট্ট তর্জনিটা। তারপর যোগ করল— ‘আর ইস্টিশনটাও তো নুংরা হতো, নাকি!’

তা হয়তো হত। মানে… হতই তো! ভাগ্যিস ও কখনো ইশকুলে যাবে না! পেপার পড়বে না! দেখবে না কোনো ফিল্মস্টারের ফটো— ঝাঁটা হাতে! ও জানেই না— আমরাও এখন এই দেশকে পরিস্কার রাখছি— যাকে বলে ‘স্বচ্ছ ভারত!’

২৭

আমার মায়ের মামাবাড়ি— পাঁচঘাটে আমি শেষবার গিয়েছিলাম দশ বছর বয়েসে। বারো-তেরো বছর পর, এমএ পড়ার সময় যখন মা বলল ওখানে যেতে হবে, আমার গায়ে জ্বর এল। স্বাভাবিক, কেননা সেখানে যেতে হয় মছলন্দপুর স্টেশনে নেমে; তারপর ভ্যানে প্রায় আধঘন্টার পথ পেরিয়ে। দরকারটা জরুরি, কাজেই যেতেই হল অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

জ্যৈষ্ঠের রোদ মাথায় নিয়ে সেই আধঘন্টার মর্মান্তিক ভ্যানযাত্রা শেষ করলাম যখন, আমি প্রায় আধমরা। তারপর একটা মস্ত ফসল-কাটা জমি পেরিয়ে, একটা আমবাগান আর তিনটে বাঁশবন পেরিয়ে সেই তেলেনাপোতা যখন আবিষ্কৃত হল— তখন আমি ধুঁকছি। সান্ত্বনা এইটুকু— সামনে যে তিনটে পথ গেছে— সবকটাই ছায়াঘেরা। কিন্তু এরমধ্যে কোনটায় যাব?

হঠাৎ দেখি, একটা লোক বেরিয়ে এল পাশের আমবাগানটা থেকে। ঘর্মাক্ত কলেবর, কুচকুচে কালো, একগাল পাকা দাড়ি,পরনে লুঙ্গি, মাথায় একটা ঝাঁকা। জিগ্যেস করলাম তাঁকেই— ‘আমি মণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যাব। একটু বলবেন— কোন রাস্তাটা…?’ ভুরু কুঁচকে আমায় একটু পরখ করে তিনি বললেন— ‘মানি কে হয় তোমার?’ মানি! বিরক্ত হলাম, তাতে কী বাড়িটা পালটে যাবে? অনর্থক প্রশ্ন। যাক। বললাম— ‘দাদু। আমার মায়ের মামা।’

মহা বিস্ময়ে চোখ বড়ো করে পরের প্রশ্ন— ‘কী বল দাদা! তুমি কী রিনুর ছেলে?’ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই প্রশ্নের পাহাড় ভেঙে পড়ল— মা কেমন আছে, বাবার মৃত্যুর পর কতটা অসুবিধেয় পড়েছি আমরা, ভাই কোন ক্লাস, আমি কী করছি… ইত্যাদি। ইতিমধ্যে তার হাত আমার কাঁধে উঠেছে। ঝাঁকা থেকে বেরলো জল, তারপর পাকা আম। এইবার ঝাঁকা একটা ঝোপের নীচে ঢুকিয়ে তিনি চললেন আমার সঙ্গে প্রশ্ন করতে করতে।

একটু পরেই জঙ্গল ফুরিয়ে ভেসে উঠল একটা ভারি মিষ্টি বাড়ি। তার বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিলেন মানিদাদু; আমায় দেখেই তার মুখ হাসিতে ভরে গেল। তারপরেই আমার পথদ্রষ্টাকে দেখে মহা বিরক্ত হয়ে বললেন— ‘এটাকে আবার কোথায় পেলি? রোজ এক ঝামেলা!’ এই রে! পাগল না তো! আমি অপ্রস্তুত হয়ে কী একটা বলব— তার আগেই তিনিই বললেন—‘তোর তাতে কী রে? বৌঠান, এক কাপ চা!’ আর আমার পরমাসুন্দরী দিদিমা এসে একগাল হেসে বললেন— ‘এই দিই। বসেন রফিক ভাই।’ মানিদাদু রাগত মুখে বললেন ‘শালা একশো বিঘে জমির মালিক, এক কাপ চা খাবে মাস্টারের বাড়িতে! কিপটের জাসু! ‘আর সেই ‘তিনি’ আমার দিকে চোখ টিপে বললেন— ‘এক ক্লাসেই পড়তাম। সেই থেকেই শত্রুতা! হ্যাঁ, তোমাদের একতলাটা ভাড়া দিয়ে কির’ম পাও?’

কত প্রশ্ন ছিল আমাদের! মহাভারতের বনপর্বে মার্কণ্ডেয় আসছেন শুনে যুধিষ্ঠির তাঁর ভাইদের বলেছিলেন— ‘এবার কর্ণময় হও।’ শুধু শোনো। কত কী জানার ছিল! আর আজ শুধু জানানোর আছে— ‘আমি কে জানো?’ কাউকে কিছু জিগ্যেস করি না, শুধু বলি। শুধু জানাই। জানাই, সে কত অজ্ঞ। আমি কত বিজ্ঞ। আমি সব জানি, তাই আমার কোনো প্রশ্ন নেই আর, শুধু উত্তর আছে। সব প্রশ্নের উত্তর।

ও দেশ! ও আমার জন্মভূমি! এ কোন্ নিরুত্তর প্রশ্নের পথে নিয়ে যাচ্ছো আমায়! কতদিন বন্ধুর পিঠে হাত রেখে জিগ্যেস করিনি—

‘কী রে, কেমন আছিস?’

২৮

স্কুলে জয়েন করার দিনে প্রথম যাঁর সঙ্গে আলাপ হল— তিনি নিতাইবাবু। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা সৌম্য প্রৌঢ় মানুষ, গম্ভীর গলায় স্বাগত জানালেন। বছর দুয়েক চাকরি বাকি আছে আর। বেশ অসুস্থ। পরের দিনই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা পড়লাম তাঁর হাতে, ফিরছিলেন ব্যাঙ্ক থেকে। বললেন— ‘খেতে হলে আমাদের সামনেই খাবেন, ফুটপাথে কদাপি নয়। ভালো নয় পাড়াটা।’

ক্রমে আপনিটা তুমিতে নামল। পড়াশুনোয় যৎকিঞ্চিৎ আগ্রহ আছে জেনে তিনিও খোলস থেকে বেরলেন। তাঁর নিজের লেখা বই দিলেন পড়তে, দিলেন গীনেসবার্গের সই করা বই। প্রচুর পড়াশুনো করা একজন মানুষ, কিন্তু বর্তমানে গমিতমহিমা, সংসারে উপেক্ষিত। ছেলে ডাক্তার। একাই বহন করছেন নিজের ক্লান্ত শরীর। অনেক কথা বলতেন আমার সঙ্গে। একধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠল দু-জন অসমবয়সী মানুষের মধ্যে।

বছর দুয়েক পরের কথা। ততদিনে রিটায়ার করেছেন নিতাইবাবু। মাঝে মধ্যে আসতেন স্কুলে, এমনিই— বা পেনশনের আশায়। কচুরি আনাতেন দারোয়ানকে দিয়ে। বুঝতাম, সংসারে ব্রাত্য হয়ে পড়েছেন। একদিন হঠাৎ জিগ্যেস করলেন— ‘তোমার ঘরে বড়ো আলমারি আছে?’ এ আবার কী প্রশ্ন— ভাবলাম আমি। বললেন— ‘একটা জিনিস দিতে চাই তোমায়। নেবে? মানে… তোমার কাছে আদরে থাকত… এই আর কী।’ বলে আমার হাতে একটা মস্ত প্যাকেট তুলে দিলেন তিনি। বললেন— ‘আমি না বললে খুলো না এটা। রেখে দিয়ো।’

বেশ। মাথায় করে এনে রেখে দিলাম প্যাকেটটা, আলমারির এক কোণে। কিছু লেখাও নেই যে আন্দাজ করব— কী আছে তাতে।

এর ঠিক তিনদিন পর স্কুলে পৌঁছে জানলাম, নিতাইবাবু আত্মহত্যা করেছেন। কারণ জানা যায় নি। ছুটি হয়ে গেল স্কুল। অসময়ে বাড়ি ফিরেই মনে পড়ল— সেই তাঁর দেওয়া প্যাকেটটা যে রয়ে গেল! এখন তাঁর অনুমতি ছাড়া খুলি কী করে! যাক, আর তো অনুমতির প্রশ্ন রইল না। খুললাম সেটা। খয়েরি পিজবোর্ডের বাক্সে সাতটা মোটা বই। প্রভুপাদের নিজের টীকা করা ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত।’ মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ বই— পণ্ডিতরা বলেন। নাম শুনেছি, নোট লিখেছি; পড়ি নি কখনো।

জীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ মৃত্যুর আগে মানুষ হস্তান্তরিত করে যায় উত্তরাধিকারীর হাতে। নিতাইবাবুও তাই করে গেছেন তাহলে! একটি বই! এমন একটি বই— যাতে লেখা আছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী বিপ্লবীর জীবনী, আর সেই পুণ্যশ্লোক জীবনের তাৎপর্য!

মাত্র চারদিন পরে, দোল পূর্ণিমার নিশির নির্মল আকাশ যখন আমাদের উন্মন করে তুলবে, তখন যেন মনে রাখতে পারি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের কথা… উত্তরাধিকারের কথা…

আর নিতাইবাবুর কথা!

২৯

সেদিন, জানি না কোন পুণ্যবলে, সকালের ট্রেনে একটা ভদ্রস্থ দাঁড়ানোর জায়গা পেয়ে গেলাম। ব্যাগটা বাঙ্কে তুলে মোবাইলে নেটটা অন করতেই একটা পার্সোনাল মেসেজ ঢুকল ফেসবুকে। একটি মেয়ে পাঠিয়েছে; এবং তা পড়ে আমি থ হয়ে গেলাম। প্রায় অবিকল তুলে দিই বরং তার বার্তাটুকু—

দু-হাজার এগার সালের ঘটনা। তখন আমি মাস্টার্স করছি। ফিরতাম বিধাননগর হয়ে; ফুটব্রিজটা পেরোতে হত দু-বেলা। একদিন বাস থেকে নেমে দেখি, ব্যাগের চেনটা একটু খোলা। হাত ঢুকিয়ে বুঝলাম— পার্সটা গায়েব, মান্থলিটা নেই— মানে… কিচ্ছু নেই। ফোনটা ছিল অন্য খাপে, তাই সেটাই শুধু রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এখন আমি বাড়ি ফিরব কী করে? বুঝতে পারলাম, আমার হাঁটু কাঁপছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। কী হবে এবার!

কোনোক্রমে ফুটব্রীজটায় উঠে মাকে ফোন করলাম। কথা বলতে বলতেই গলা বুজে এল কান্নায়। ফোনটা রেখেছি সবে, পিছন থেকে একটা অপরিচিত গলা ভেসে এল— ‘অ দিদি, শুনে যাবে একটু?’ ফিরে দেখি— সেই বুড়ো ভিখিরি— যার সামনে দিয়ে দু-বেলা হেঁটে যাই, সে-ই ডাকছে। শুনেছে আমার কথাগুলো; আর এখন তার চিরকাল পেতে-রাখা হাত সে বাড়িয়ে দিয়েছে আমার দিকে। সে হাতে দুটো দশ টাকার নোট। বলল— ‘এতে বাড়ি অবধি যেতে পারবে না?’ মাথা নেড়ে, কাঁপা হাতে টাকাটা নিয়ে বললাম— ‘কালই ফেরত দিয়ে দেব, হ্যাঁ!’ বুড়ো অবাক হয়ে বলল— ‘আমি কী তোমায় ধার দিলাম নাকি! যাও, সাবধানে বাড়ি যাও; মা চিন্তায় সারা হয়ে যাচ্ছেন।’

লেখাটা পড়ে অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে কী একটা লিখতে যাচ্ছি ; মেয়েটি আবার লিখল—‘এই ঘটনাটা কী আপনার ‘ভারতবর্ষে’ স্থান পেতে পারে? ‘আমি হাঁ! আমি তো বরাবর নিজে যা দেখেছি, সেটুকুই লিখেছি! আবার লিখল— ‘আমি তো অমনভাবে লিখতে পারব না, আপনি লিখলেই আমার ভাল লাগবে।’

আমি লিখলাম— ‘বেশ, তোমার নাম দিয়েই লিখছি তাহলে!’

সে লিখল— ‘না। আমার নামটা দেবেন না। কারণ, যার নামটা আসলে উল্লেখ করার কথা ছিল— তার নাম তো আমি জানিই না! জিগ্যেসই করিনি! সেই বুড়ো মানুষটার নাম!’

বলুন দেখি, কাকে স্থান দেই এই ‘ভারতবর্ষে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *