৩০
যতই থাকুক দুর্গাপুজো আর রথের মেলা, আমাদের ছেলেবেলার সবচেয়ে বড়ো উৎসব ছিল ঝুলন। কেননা, এই একটা উৎসবে আমরা আর শুধু দর্শক না থেকে হয়ে উঠতাম কর্মী। সবচেয়ে ছোট খোকা খুকুরাও পেয়ে যেত কাঠগুঁড়োয় রং ধরানোর গুরুদায়িত্ব। একটু বড়ো যারা, তারা সেই কাঠগুঁড়ো ব্যাগে ভরে বয়ে আনত গোলা থেকে; রঙিন গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হত পথঘাট, পার্ক আর পুকুর। ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিত লিলিপুট, বাঘ বা ঘোড়া। থাকতই থাকত একটা যুদ্ধক্ষেত্র— তাতে সার দিয়ে দাঁড়াত সৈনিক-পুতুলেরা। একমাত্র আমার চেয়ে আট বছরের বড়ো দাদাই জানত— কেমন করে পুরোনো কাপড়ে কাদামাটি লাগিয়ে, তাকে পাটকাঠির উপর চড়িয়ে বানানো যায় পাহাড়। সে রহস্যকথা দাদা ফাঁস করত না কখনো। অনেকগুলো খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইবোন মিলে আমরা ওই ক-দিন পড়া ফেলে দেখভাল করতাম ঝুলনের; বন্ধুরা দেখতে এসে হাঁ হয়ে যেত।
আমি তখন পড়তাম একটা নার্সারি স্কুলে। মিস মার্গারেট ছিলেন তার প্রিন্সিপ্যাল। নিষ্ঠাবতী খ্রিস্টান রমণী, কথায় কথায় বুকের উপর ক্রস আঁকতেন; দেখাদেখি আমিও। একদিন হঠাৎ তিনি আমায় উপহার দিলেন যিশুর একটা ছবি। গদগদ হয়ে বাড়িতে নিয়ে এলাম সেটা। ঝুলনের সময় দেওয়ালে টাঙানো হত রাধাকৃষ্ণের ফটো। এবার আমি জেদ ধরলাম— আমার আনা যিশুর ছবিও টাঙানো হোক! স্বভাবতই অন্যরা সে দাবি নাকচ করে দিল; ফলে আমিও নিয়মমতো উঠোনে শুয়ে পড়ে ‘ও ঠাকুমা’— বলে কেঁদে উঠলাম চিৎকার করে।
সাদা থান পরা, ছোট করে চুল ছাঁটা ঠাকুমাকে বেরোতেই হল। তারপর সব শুনে, আমায় তুলে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল— ‘এয়া নিয়া এত ঝামেলা করার আছেডা কী! রাধাকৃষ্ণ আমাগো ঠাকুর, যিশু অইন্য কারোর। ঠাকুর তো দুয়োডাই। দে না বাবা টাঙাইয়া, কইসে যহন। দ্যাখ দেহি— কানতেয়াসে! না দাদা…’
এর উপরে তো আর কথা নেই, তাই আমি ভেজা চোখে দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম। রাধাকৃষ্ণের পাশেই ঝুলতে লাগলেন যিশুও। একটু পরে দেখি— উবু হয়ে বসে সৈনিক-পুতুলগুলো সাবধানে তুলে নিচ্ছে দাদা। কী ব্যাপার? জিগ্যেস করতে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল ছবিটা। এবার চোখে পড়ল— তাতে লেখা আছে —‘Love Thy Neighbour.’
ইতিহাসের ভুল শুধরে নিচ্ছিল এক কিশোর আর এক নিরক্ষর বৃদ্ধা।
৩১
দু-হাজার চোদ্দ সালের আষাঢ়স্য কি-যেন দিবসে রোটারি সদনে প্রথম গাইলাম মেঘদূত। নিজেই সুর দিলাম কালিদাসের অমর কাব্যে, অনুবাদও করলাম নিজেই। গুরু ও গুরুজনেরা সস্নেহে সাহায্য করলেন; সতীর্থ ও বন্ধুরা উৎসাহ দিলেন। হই হই করে সফল হল অনুষ্ঠান।
মাস কয়েক পরে জীবনানন্দ সভাঘরে আবার হল মেঘদূত। অনুষ্ঠানের শেষে অনেক অটোগ্রাফ দিয়ে আর পাশে দাঁড়িয়ে ফটোগ্রাফ তুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি; বেশ একটা কেউকেটা গোছের ঠেকছে নিজেকে। একটু দূরে তিনজন বছর চল্লিশের ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। আমার ঠিক আগেই হল থেকে বেরিয়েছেন তাঁরাও, খেয়াল করেছি। আমায় দেখে তাঁরা সোৎসাহে এগিয়ে এলেন। আমিও খানিক প্রশংসা শুনে হেঁ হেঁ করার জন্য তৈরি হলাম।
অগ্রবর্তী ভদ্রলোক নমস্কার করে বললেন— তিনি রোটারি সদনে মেঘদূত শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আজ তাই ধরে এনেছেন দুই বন্ধুকেও। বলে, বাঁ-পাশের বন্ধুটির পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বললেন— ‘এ ব্যাটা তো কিছুতেই আসবে না। একেবারে বাড়ি গিয়ে জোর করে তুলে আনলাম। কীরে শালা, এবার বল কেমন লাগল!’
মৃদু হেসে তিনি বললেন— ‘অসামান্য অভিজ্ঞতা।’ তারপর আমার দেঁতো হাসি উড়িয়ে দিয়ে আত্মগত কণ্ঠে বলে চললেন— ‘চারদিন আগে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ল, জানেন। লাস্ট স্টেজ। বাড়িতে শুধু বুড়ি মা, বিয়েও করি নি। তা ডাক্তার আমাকেই ডেকে বললেন— আমার আয়ু আর বড়জোর ছ-মাস। খুব বেশি হলে।’ আমার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি যোগ করলেন— ‘খুব ভয় পেয়ে গেলাম, বুঝলেন। মরে যাব! এই বয়েসে! মা-র কী হবে! এইসব ভাবতে লাগলাম ঘরে বসে। অফিসে যাওয়াও বন্ধ। কোত্থেকে খবর পেয়ে আজ এই দুই হতভাগা গিয়ে উপস্থিত। বলে কিনা— ‘ধুর ব্যাটা! সে তো সবাই মরবে আজ নয় কাল! চল দেখি— মরবিই যদি, মেঘদূতটা শুনেই মর। ভাবুন দেখি! কোনো সিমপ্যাথি নেই! তা কী আর করব। এলাম। শুনলাম।’
আমি দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর বন্ধুরাও। তিনি একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার বললেন— ‘খুব ভয় খেয়ে গিয়েছিলাম, জানেন। আজ… আপনার গান, মানে মেঘদূত শুনে…কেটে গেল ভয়টা। কেন কে জানে, এখন আর অতটা— ইনফ্যাক্ট একটুও— ভয় করছে না।…ভাল থাকবেন।’
এই বলে, একগাল হেসে, দুই বন্ধুর হাত ধরে তিনি এগিয়ে গেলেন বাংলা অকাদেমির গেটের দিকে।
এই আমার স্বদেশ। বন্ধুত্ব কাকে বলে, কাকে বলে ‘মৃত্যুঞ্জয়’— আমাদের শেখাতে আসবেন না মশাই!
৩২
আমার প্রথম বিদেশ-ভ্রমণ ছিল নেপাল। সে এমনই বিদেশ যে, বিনা পাসপোর্টেই আমি সীমান্ত পার হলাম; তাও আবার টাঙায় চড়ে। কাঠমান্ডুর দরবার স্কোয়ার দেখে হাঁ হয়ে গেলাম আমরা সবাই; মনে হল— হ্যাঁ, বিদেশ বটে!
পরদিন বিকেলে আমরা পৌঁছলাম নাগরকোট নামের একটা পাহাড়চূড়োয়। জানা গেল— আকাশ পরিষ্কার আর কপাল ভালো থাকলে এখান থেকে সূর্যাস্ত যেমনটি দেখা যায়, তা নাকি অবিশ্বাস্য। গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল একটা গোল চত্বরে— চারিদিকে তার চা আর টুকিটাকি খাবারের দোকান। প্রায় একই সঙ্গে ঢুকেছে বেশ ক-টা টুরিস্ট গাড়ি, জমে উঠেছে ভীড়, চলছে বেচাকেনা। এর বাঁ-দিক দিয়ে একটা পাথুরে সিঁড়ি উঠে গেছে চূড়োর দিকে। পর্যটকেরা একে একে সেই পথ ধরলেন। ফের নামল নির্জনতা।
এমন সময় একটা দোকানের সামনে বেজে উঠল গিটার। গান ধরেছে এক নেপালী কিশোর, শুনছে জনাকয়েক সমবয়স ছেলে। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তাদের কাছে, শুনতে লাগলাম। হঠাৎ তাদের একজন হিন্দিতে বলল— ‘মনে হচ্ছে আপনিও গান করেন। শোনান না কিছু।’ অপ্রত্যাশিত অনুরোধে ঘাবড়ে গেলাম আমি; কিন্তু একটু পরে শুরু হল সংক্রামক গুনগুনানি। একসময় গলা ছেড়েই গাইতে লাগলাম ‘বড়ি দূর সে আয়ে হ্যাঁয়’ গানটা। মনে হলো, বিদেশ থেকে এসেিছ— সেই কথাটাও বোঝানো যাবে এই গানে।
এরা কিশোরমাত্র। এত পুরোনো গান শোনার কথা না। একটু পরে তাই উসখুস করে উঠল একজন— ‘তো ইয়ে ইন্ডিয়া-কা গানা হ্যায়?’
‘ইন্ডিয়াকা গানা !’ ভারতের গান ! হেসে বললাম— ‘ভারতে তো কত ভাষা, কত রকম সুর ! ‘ভারতের গান’ বলে তাই কিছু হয় না।’ —‘তো আপ যাহাঁকে রহনেওয়ালে হ্যাঁয়, ওয়াহাঁ কা গানা সুনাইয়ে এক!’—বলল একজন। আর আমি, প্রায় কিছু না-ভেবেই গান ধরলাম— ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা…’
ক্রমে থেমে এল গিটারের শব্দ। পাইনের ছায়া পড়ছিল লম্বা হয়ে। ছেলেগুলো, এমনকী আমার সঙ্গীরাও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল— এই প্রথম যেন শুনছিল ‘ভারতের গান’। ভারতে নয়, অন্য এক দেশের পাহাড়চূড়োয় দাঁড়িয়ে। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়ছিল সেই গান— ‘তোমার ওই শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা….।’ আর আমি ভাবছিলাম, শিশু তো শুধু একজোড়া মায়াময় চোখ আর একটা সিঁদুরের টিপ-কেই ‘মা’ বলে জানে। মাকে সম্পূর্ণ দেখতে হলে মায়ের কোল থেকে নামতে হয়।
এই প্রথমবার, ভারতের গান গাইছিলাম আমি।
৩৩
আমরা যেবার প্রথম সিলারি গাঁও বেড়াতে যাই, তখনও খুব বেশি মানুষ তার নাম জানতেন না। ফলে ভিড় ছিল না পর্যটকেরও। দিলীপ তামাং-এর বাড়িতে উঠেছিলাম আমরা। এই প্রথম কোন পাহাড়ি গ্রামে পাহাড়ি মানুষদের সাথে মিলেমিশে থাকার সুযোগ হল। এক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য; কাঞ্চনজঙ্ঘা আর তিস্তার প্রহরে প্রহরে রঙ বদলের খেলা… আর নৈঃশব্দ— এ কোন্ স্বর্গপুর! পথচলতি মানুষ কাঁধে মস্ত কাঠের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলে যায়; রান্নাঘরে কাঠের আগুন ওঠে লকলকিয়ে; আর তাকে ঘিরে গল্প করে ভাবী, আমার গিন্নি, গাঁয়ের আর পাঁচটা মেয়ে। কাজ সেরে দিলীপ এসে বসে বারান্দায়, গল্প চলে রাত পর্যন্ত, আর পূর্ণিমার আলোয় দেখা যায় স্বপ্নময় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
প্রায় প্রত্যেক দু’বছরে একবার করে গিয়েছি তারপর থেকে এই গ্রামে। চোখের সামনেই রূপ পাল্টাচ্ছিল তার— ভিড় বাড়ল, ঘর বাড়ল, কারেন্ট এল, দোকান বসল— ক্রমে জমজমাট হয়ে উঠল নির্জন সিলারি। আর হাসি ফুটল গরীব মানুষগুলোর মুখে। আবার উলটোদিকে, মুছে গেল সেই রহস্যকথা, সেই চিতার রোমশ ঘ্রাণ, পাইনবনের সেই সবুজ অন্ধকার। খুশি হব, না বিমর্ষ, বুঝতে পারছিলাম না।
শেষবার গিয়ে দেখি— লোকে লোকারণ্য। সার সার ঘরে ঠাসা ট্যুরিস্ট। সপরিবারে হিমসিম খাচ্ছে দিলীপ। ভাবী— দিলীপের স্ত্রী— চিনতেই পারলেন না আমাদের। স্বাভাবিক, এত মানুষ আসছেন প্রতিদিন। রাতে চারিদিকে জমে উঠল পার্টি, বারবিকিউ, মদ, লাউডস্পিকার, হানি সিং…। নিজের রুমের সামনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, ভাবী হঠাৎ এসে বললেন— ‘আপনি সেই একেবারে প্রথম দিকে এসেছিলেন না? গৌতমজি-কা ভাঞ্জা! ‘মাথা নাড়তে চলে গেলেন। একটু পরে আবার এলেন— ‘আপনি সেই অনেক রাত অবধি বারান্দায় বসে গান গাইতেন না— ঠান্ডি হাওয়া ইয়ে চাঁদনি সুহানি!’ ভুলে-যাওয়া মানুষটাকে ক্রমে মনে পড়ছিল তাঁর। আমি হাসছিলাম।
ন-টা নাগাদ এক কিশোরী এসে বলল— ‘আপকো বুলা রহি হ্যায়।’ কে ডাকে! নিয়ে গেল নতুন ডাইনিং হলে, সেখানে খেতে বসেছেন পর্যটকেরা। তার পিছনে রান্নাঘর। মস্ত মাটির উনুনে কাঠের আগুন… আরাম… মাটিতে পিঁড়ি পাতা। আমাদের তাতে বসিয়ে হাতে মাংস-রুটির থালা তুলে দিয়ে ভাবী বললেন— ‘খেয়ে নিন। রাত হল।’
বাইরে যতই পালটাই আমরা, ভেতরটা— বুঝলেন, অনেক হাজার বছরের পুরোনো। ও অত সহজে পালটাবে না।
৩৪
গতকাল আমার ভোটের ডিউটি ছিল টালিগঞ্জের কোনো একটা বুথে। প্রথম তিন ঘন্টায় ভোট পড়ল প্রায় আড়াইশো, চোখে ধোঁয়া দেখছিলাম। তারপর ক্রমে রোদ চড়তে লাগল, ভোটারের প্লাবন কমতে লাগল, বারোটার পর বুথ মোটের ওপর সুনসান হয়ে গেল। আমরাও একটু নিশ্বাস ফেললাম, আমি এবার কাগজপত্রে মন দিলাম।
হঠাৎ একটা কম্পিত কণ্ঠস্বর কানে এল— ‘দ্যাখেন তো, সুবলচন্দ্র সাহা নামডা আছে নাকি?’
চোখ তুলে দেখি, একেবারে থুত্থুরে বুড়ো এক ভদ্রলোক ফার্স্ট পোলিং অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনের পায়জামা আর ফতুয়াটা এককালে সাদা ছিল, এখন তার কোনো রং আর অবশিষ্ট নেই। গালে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, সামান্য কিছু পাকা চুল এখনো আছে মাথায়। চোখে মোটা ঘোলাটে চশমা,তার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে দুটো কৌতুহলী চোখ। ঝুঁকে পড়েছেন ভোটারদের লিস্টটার উপরে।
সিরিয়াল নম্বর না বলতে পারলে নাম খুঁজে বের করা মুশকিল। তবু ভদ্রলোকের বয়েস দেখে ফার্স্ট পোলিং অফিসার মুনিরদা বললেন— ‘এভাবে তো মুশকিল দাদু… ঠিকানাটা বলুন দেখি, ওঁরা যদি বলতে পারেন’— বলে পোলিং এজেন্টদের দিকে তাকালেন। দেখি, তাঁদের মুখে চাপা হাসি। একজন বললেন— ‘না কাকু, এবারও নেই আপনার নাম… বললাম তো— পাড়ায় যখন ভোটের ক্যাম্প হবে তখন যেতে হবে… আপনি তো গেলেন না…’
বুড়ো তেরিয়া হয়ে বললেন— ‘আর এই বয়সে কই যামু কও দেহি!’ —বলে সোজা এলেন আমার সামনে। জিগ্যেস করলেন— ‘আপনেই প্রিজাইডিং অফিসার?’ মাথা নাড়তে বললেন—‘কন দেহি সার, যেইখানেই যাই, কয় লাইফ সার্টিফিকেট দাও! চল্লিশ বচ্ছর ধইরা গভর্নমেন্টরে যে সার্ভিস দেলাম, হ্যার কোনো মূইল্য নাই? আইজ তিরিশ বচ্ছর ধইরা পেনশন পাইতাছি আমি। নিজেই প্রিজাইডিং আছিলাম সাতবার— অ্যারা আমারে ভোট দ্যাহায়! গতবারও এই কইরা নাম ওঠে নাই আমার, আইস্যা ফিরা গেছি। বউ আইজ তিন বছর বিছনায়, ভাবি নামডা কাটাইয়া দেই। আর আমি তো অহনতরি হাঁটি-চলি, কয় নাম নাই। পোলায় কয়— অরা ভাবছে— তুমি মইরা গেছো। কন দেহি— এইয়া কুনো কথা!’
এই বলে তিনি তাঁর বলিরেখাঙ্কিত কাঁপা হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে— ‘দ্যাহেন তো সার, আমি কী সইত্যই মইরা গেছি, না বাঁইচ্যা রইছি? না না, হাত না, নাড়িটা চলে কিনা দ্যাহেন তো একবার?’
বাধ্য হয়ে হাত রাখলাম সেই কাঁপা নবতিপর হাতের উপর, আর অমনি টের পেলাম সেই স্পন্দন— যা ঘোষণা করে— আমি বেঁচে আছি। বললাম— ‘খুব বেঁচে আছেন। দিব্যি সুস্থ আছেন আপনি!’
যেন কোন্ মন্ত্রবলে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন নু্ব্জ মানুষটি। বললেন— ‘কন দেহি তাই! আর সক্কলে কয়…তাইলে নেক্স্ট্ টাইম যহন পাড়ায় ক্যাম্প হইবো, তহন গিয়া কই— এই দ্যাখেন, বাইচ্যাই আছি অহনতরি! মরি নাই। কি কন? যাই?’
ও আমার স্বদেশ ! একবার আবার দাঁড়াও দেখি সোজা হয়ে, মেরুদণ্ড টান করে ! সবার সব সংশয় ঘুচিয়ে একবার বলো দেখি জোরগলায়—‘বেঁচে আছি এখনো। এই দ্যাখো— পৃথিবী, এখনো আমিই ‘সকল দেশের রানী!’
পা টেনে টেনে চড়া রোদ্দুর মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন একজন প্রত্যাখ্যাত, কিন্তু অপরাহত মানুুষ।
৩৫
ছোটোবেলায় আমাদের মস্ত পরিবারে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পগুলোর মধ্যে পড়ত ‘পুলিশি-হানার’ গল্প। মোড়ের মাথায় কালভার্টে বসে থাকত আমার দিদিভাই— আমাদের সবচেয়ে বড়ো দিদি। দূর থেকে পুলিশের গাড়ি দেখা গেলেই সে ছুট্টে এসে বাড়িতে খবর দিত। আর অমনি আমার বামপন্থী বাপ-জ্যাঠারা রান্নাঘরের ছোট্ট জানলা গলে পালিয়ে যেতেন। পুলিশি অত্যাচারের ভয়ানক সব গল্প— পালাতে বলে পিছন থেকে গুলি করে মারার গল্প— তখন হাওয়ায় উড়ত; সেই সত্তর দশকের শেষ দিকে। কাজেই পুলিশ মানেই আমার কাছে একটা অবিমিশ্র ভিলেনের প্রতিমূর্তি।
চাকরির চিঠি পাওয়ার দিনটা— আরও অনেকের মতোই আমার কাছেও— জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। এক শনিবারে এল সেই সরকারি ছাপ-মারা চিঠি। কিন্তু সেই চিঠিতে যে ঠিকানা দেওয়া ছিল, তা আমার ছোট্ট কলকাতা জ্ঞানের চৌহদ্দির বাইরে। জে.এম.এভিন্যু আবার কোথায়! এক আত্মীয় জানালেন, গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনে নেমে যেতে হবে সেখানে। গেলাম সেখানে; চাকরিতে জয়েন করব— বুক ফুলে আছে। গিরিশ পার্ক থেকে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন অবধি হেঁটে চলে গেলাম। এমন একটা বাড়িও চোখে পড়ল না, যাকে স্কুল বলে সন্দেহ হয়। আবার ফিরলাম পুরো পথটা। নাঃ। পাচ্ছি না। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও আমি তখন ঘামছি। উঁকি দিচ্ছে কূট সন্দেহ, চিঠিটা ভুয়ো নয় তো! ঠিকানাটা ভুল নেই তো? পথে দাঁড়ানো স্বল্পবেশী মেয়েরা চোখের ইশারায় ডাকছে। কান্না পাচ্ছিল সব মিলিয়ে।
শেষ উপায় হিসেবে বিবেকানন্দ রোডের মুখে দাঁড়ানো পুলিশটিকেই ধরলাম গিয়ে। এক ঝলক ঠিকানাটা দেখে তিনি বললেন— ‘কোত্থেকে আসছেন?’ বললাম। মাথা নাড়তে নাড়তে তিনি বললেন— ‘তাহলে আর দোষ কি? সে বাড়িতে কি আর ঠিকানা লেখা আছে যে আপনি খুঁজে পাবেন?’— এই বলে, আর একজনকে নিজের জায়গায় দাঁড় করিয়ে তিনি বললেন—‘আসুন আমার সঙ্গে।’ হাঁটতে হাঁটতেই তিনি বললেন— ‘একটু সাবধানে থাকবেন এখানে। একে পাড়াটা ভালো নয়, তায় আপনি এসেছেন মফস্সল থেকে।’
একটু পরেই রাস্তার বাঁ-পাশের একটা প্রকাণ্ড পোড়ো বাড়ির বন্ধ কোলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন— ‘নিন, আপনার চাকুরিস্থল এসে গেছে।’ হ্যাঁ, ইসকুলই বটে! বাচ্চারা খেলা করছে খোলা উঠোনটায়। ফিরে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ দিতে যাব, তিনি মৃদু কণ্ঠে বললেন— ‘বড্ড গরিব বাচ্চাগুলো। একটু দেখবেন।’
এই বলে, একটু অপ্রতিভ হেসে, দ্রুত পা চালিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল একটা ভয়ংকর পুলিশের লোক। ধন্যবাদ দেওয়া হয় নি তখনও।
৩৬
তখনও স্ট্রিট-লাইট ছিল না আমাদের পাড়ায়। বাড়ির সামনের চেনা মাঠটা তাই সন্ধ্যের পর হয়ে উঠত রহস্যময়; মাঠের ওপারের পোড়ো কারখানাটার পিছন থেকে রাজার মতো উঠে আসত চাঁদ, জামরুল গাছে জ্বলত নিভত জোনাকির ঝাঁক। পূর্ণিমারাত্রির ভরাট যুবতী জ্যোৎস্নায় হঠাৎ ডেকে উঠত কাক। সেই অন্যরকম সন্ধ্যা আর রাতের পাতা-ঝরা পথ দিয়ে হেঁটে চলছিল আমার প্রথম যৌবনের উন্মুখর দিনগুলো। পড়াশোনা শেষ করে অনেকক্ষণ পায়চারি করতাম খোলা ছাতে, বা আমার চিলেকোঠার ঘরে। আর অবধারিত ভাবেই শুনতে পেতাম— লাস্ট ট্রেন চলে যাওয়ার মিনিট কুড়ি পরে ভ্যান চালিয়ে বাড়ি ফিরছে বাসুকাকা। কোনোদিন ভ্যানে প্যাসেঞ্জার আছে, কোনোদিন বা নেই; কিন্তু গলায় গান আছেই আছে। দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে-পড়া পাড়ায় হঠাৎ শোনা যেত মন-কেমন গলা— ‘দয়াল কাঙাল জানিয়া পার করো…’ কিংবা ‘হায় রে, পথের পরিচয়; মনে রেখ এ সংসারে কেহ কারো নয়…।’ বাবা বলেছিল— এটা বাসুকাকার গলা। আমি কিন্তু সেই মধ্যরাতের গানওলাকে দেখি নি কখনও।
এক রাতে তাই সব্বাই ঘুমিয়ে পড়ার পর দাঁড়িয়ে রইলাম গেটের সামনে। চাঁদ ছিল না। তারার আলোয় যথারীতি যথাসময়ে দেখা দিল একটা ফাঁকা ভ্যান, শোনা গেল গান। হাত দেখাতে খুব অবাক হল, কিন্তু দাঁড়াল। আলাপ হল। বলল— বাবাকে খুব চেনে, মাকে অনেকবার দিয়ে এসেছে ইশকুলে। বিড়ি ধরিয়ে মাঠে বসল হরিকাকা; আমি শুনতে লাগলাম তার গান নয়, কথা। একাত্তরে ‘দ্যাশ’ ছেড়ে পলায়ন, এখানে পি.এল.ক্যাম্পে ঘর বাঁধা। সাতখানা বোন ছিল বাসুকাকার; তখন তাদের বড়জনের বয়েস সাতাশ, ছোটজনের তেরো। দুটো পালিয়ে গেল, একটার মৃগি ছিল— মরে গেল একদিন। বাকিগুলোর বিয়ে দিল। বাপ-মা মরল। একটা বোন ফিরে এল বরের সাথে ঝগড়া করে দুটো ছেলে নিয়ে। ‘দ্যাশে’ থাকতে গানের জন্য সুনাম ছিল খুব, অনুষ্ঠান করত রীতিমত। এখানে এসেও চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দাঁড়ানোর জন্য যে সময়টুকু দরকার ছিল— সেটা পেল না। ফলে প্রথমে রিক্সা, তারপর ভ্যান। এভাবেই চলে গেল দিন— যেমন অনেকেরই যায়। এখন তেপ্পান্ন। ‘আর গান হইব না, বোঝলা। কিন্তু গলাও দেহি খারাপ হয় না। তা নিজেরেই শুনাই। আর ক্যান জানি মনে হয়— কে জানি আর একজন— বোঝলা— শোনে খুব মন দিয়া।’
এই বলে তারা-ভরা আকাশের দিকে তাকাল হরিকাকা। তারপর নিবে যাওয়া বিড়িটা ফেলে দিয়ে ভ্যান টানতে টানতে রওনা দিল বাড়ির দিকে। ফাঁকা রাস্তা শুনতে লাগল এক হেরে-যাওয়া মানুষের গান— ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে…’
আমার মনে হচ্ছিল— যেন ওই তারায় ভরা আকাশ, প্রতিটি ধূলিকনা, প্রতিটি গাছের পাতা, আমার দেশ আর হরিকাকার ‘দ্যাশ’— সবাই— সব্বাই উৎকর্ণ হয়ে শুনছে সেই গান।
৩৭
সেবার উত্তরভারতের অনেকগুলো জায়গা ঘুরে দেখব বলে বেরিয়েছিলাম আমরা— শ্বশুরকুল আর পিতৃকুল সব্বাই মিলে সাতজন। প্রথমেই হরিদ্বার। এক অভিজ্ঞ আত্মীয়র কথামতো একটা চিঠি লিখে দেওয়া হয়েছিল ভোলাগিরি আশ্রমের ঠিকানায়। গিয়ে দেখা গেল, আমাদের মতো বেশ কয়েকটি পরিবার বাইরে বাক্স-প্যাটরা নিয়ে প্রতীক্ষারত। বেশ কিছুক্ষণের অপেক্ষার পর একটিমাত্র অপরিসর ঘর পাওয়া গেল। কোনক্রমে ঠাসাঠাসি করে কাটিয়ে দেওয়া গেল একটা রাত; কিন্তু বোঝা গেল— এভাবে হবে না।
পরদিন সকালে এই নিয়েই কথা হচ্ছিল, এমন সময় ঘরে এলেন আশ্রমের কেয়ারটেকার গোছের ভদ্রলোক। বললেন— আমাদের মধ্যে যদি কেউ গান জানেন— তাহলে স্বয়ং ভোলাগিরিকে গান শোনাবার সৌভাগ্য অর্জন করা যেতে পারে। কট্টর বামপন্থী বাড়িতে জন্মেছি আমি, দেবদ্বিজে ভক্তি নেই মোটে। কিন্তু ‘বাবা’কে সন্তুষ্ট করলে একটা ঘর মিলতে পারে— এই ধান্দায় লাফ দিয়ে উঠে বললাম— তাঁকে গান শোনানোর সৌভাগ্য আমি কোনক্রমেই হারাতে চাই না।
নিয়ে যাওয়া হল আমায় তাঁর কাছে। মন্দিরের সামনে বারান্দায় বসে আছেন জনা-কয় ভক্ত, মেঝেতে মাদুরের উপর। শুধু একটি নিতান্ত বাচ্চা মেয়ে বসেছে ইজিচেয়ারে আসীন প্রবীণ সন্ন্যাসীর কাছে। আমি বসে তাঁকে একটি দায়সারা প্রণাম করলাম, তিনি গভীর তীক্ষ্ণ চোখে আমায় একটু দেখে বললেন— ‘গাও বাবা।’ আমিও অমনি রবি ঠাকুরের পূজা পর্যায়ের গান ধরলাম— ‘প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর…।’ ধ্যানস্থ হয়ে শুনলেন তিনি, আরও দু-একটা রবীন্দ্রসংগীত আর কালী-কীর্তন শুনলেন ফরমাশ করে। তারপর হঠাৎ যেন আমায় ভুলে গিয়ে বাচ্চাটিকে বললেন — ‘কি গো, কবিতা শুনবে নাকি?’
বিগলিত হয়ে মাথা নাড়ল সে; আমি ভাবলাম— এইবার নির্ঘাত শুনতে হবে ঠাকুর-দেবতার শ্লোক-জাতীয় কিছু। আর তিনি, শিশুটির মাথায় হাত রেখে আশ্চর্য ভরাট অথচ মধুর গলায় আবৃত্তি করতে লাগলেন— ‘ছোট্ট আমার মেয়ে/ সঙ্গিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে…।’ তারপর, কী আশ্চর্য— পরপর ‘শিশু’ থেকে কবিতা। সব মুখস্থ! শেষে আমার দিকে একটা অদ্ভুত দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে তিনি বললেন— ‘ভারি মিষ্টি গলা তোমার, বাবা।’
ঘরে ফেরার একটু পরেই খবর এল, আমাদের জন্য দোতলায় আরও দুটো ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে। ছুট্টে গিয়ে দখল নেওয়া গেল। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখলাম— মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমার দিকে তাকিয়ে সেই দুষ্টু হাসি নিয়ে হাত তুলে শুধোলেন—‘এবার ঠিক আছে ?’
এতক্ষণে বুঝলাম— আমায় তিনি পড়ে ফেলেছিলেন খোলা বইয়ের মতো। বুঝে নিয়েছিলেন আমার অবিশ্বাস, আমার উদ্দেশ্য, আমার ধান্দাবাজি— সব। সন্ন্যাসীর দৃষ্টিতে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল স্বার্থপর গৃহীর মন, যে ঈশ্বরের গৃহে বসেও নিজেরটাই ভাবে। শিশু ভাবে না, তাই তিনি কবিতা শুনিয়েছিলেন তাকে। আমাকে না।
আর আমি ভাবছিলাম— কেমন সুন্দর গান গেয়েই বাগিয়ে ফেললাম দু-খানা ঘর!
৩৮
বেশিরভাগ বাচ্চারই চোখের দোষ ধরা পড়ে স্কুলে— আমাদের কাছে— যখন সে বোর্ডের লেখা দেখতে পায় না। নির্মলের ‘দূরদর্শিতা’র অভাবও ওইভাবেই ধরা পড়ল একদিন। পাশের ছেলের খাতা দেখে লিখছিল। নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে, জানা গেল— মাইনাস ২:৫ পাওয়ার হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। চশমা নয় হল— কিন্তু এত্ত পাওয়ার কেন? ক্লাসে কথাটা উঠতে একটা বাচ্চা বলল— ‘ও তো স্যার সন্ধ্যে অবধি ছাতে বসে পড়ে, আবার ভোর রাত থেকেও ছাতে। ওই জন্যই তো…।’ মানে! ছাতে গিয়ে পড়ে কেন? জানা গেল— ওদের প্রকাণ্ড এজমালি বাড়িতে একমাত্র ওদের ঘরেই ইলেক্ট্রিসিটির কানেকশন নেই। পয়সা নেই বিল দেওয়ার। জ্ঞাতিরাও কেউ তাঁদের আলোকিত ঘরে ওকে ঢুকতে দেন না। ফলে ওর ছাতই ভরসা।
ইলেক্ট্রিকের বিল তো আর দিয়ে দেওয়া যায় না। তাই ওকে পরদিন একটা রিচার্জেবল্ লাইট কিনে দিলাম। প্রাণপণে না না করে নিল সেটা। সেদিন পড়াচ্ছিলাম মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বেড়া’। ‘ঝাল ঝাল বেড়ালের মাংস’ খাওয়ার কথায় সবাই ওয়াক তুলছে দেখে ওদের বললাম নানারকম খাদ্যাভ্যাসের কথা। আকালের সময় লোকে যে গেঁড়ি-গুগলি খেত— সে কথাও উঠল। নির্মল বলে উঠল— ‘আমরা তো খাই স্যার এখনও। আপনি খেতে পারবেন না।’ আমার ‘বটে!’ শুনে আর কিছু বলল না; পরদিন টিফিনের সময় একটা এনামেলের টিফিন ক্যারিয়ার ভরে দিয়ে গেল ঝাল ঝাল গেঁড়ি-গুগলি। আর কেউ খেল না— আমি তো তোফা খেলাম। বুঝলাম— এ ছেলে ঋণ রাখতে চায় না।
সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করে আর্টস নিল নির্মল। আমার অফ পিরিয়ডে চলে আসত, স্টাফ রুমে বসে পড়তাম দুজনে। বাংলা ইংরেজি বাদে অন্যগুলো যা পারতাম, পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দিতাম— সেগুলো আমিই বা বুঝি কতটুকু! ওই কোনমতে উচ্চ মাধ্যমিকটাও হল। বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়ে গেল অখ্যাত একটা কলেজে। এবার আর অসুবিধে নেই। অফ পিরিয়ড, টিফিন পিরিয়ড— এঁটো হাতে ছন্দ অলংকারের ক্লাস চলল দিব্যি। অন্য শিক্ষকেরা যার যা সাধ্য— পড়াতে লাগলেন। দিব্যি পাশ করে গেল নির্মল। টিউশন করত খুব। পড়ার ক্ষতি হলেও এটা বারণ করা যেত না। এস.এস.সি. দিয়েই একটা ছোট্ট কম্পানিতে জয়েন করে গেল। আগের মতো রোজ দেখা হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। ফোন করত মাঝে মাঝে।
একদিন ক্লাস টেনে ক্লাস নিচ্ছি, এসে হাজির। প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে এল স্টাফ রুমে। কি ব্যাপার! দেখি, আমার বসার জায়গাটার সামনে রাখা একটা বাক্স। খুলতে বেরিয়ে এল একটা রিচার্জেবল্ লাইট। নতুন। একটা প্রণাম করে, সামান্য ধরা গলায় বলল— ‘এস.এস.সি.র রেজাল্ট বেরিয়েছে স্যার। পাশ করেছি। তাই ভাবলাম— একটা লাইট কিনে রেখে যাই স্কুলে। যদি আমার মতো আর কারোর লাগে, মানে দরকার হয় আবার— এটা দিয়ে দেবেন স্যার। আগেরটা আমার কাছে রইল। অবিশ্যি কারেন্ট এসে গেছে ঘরে…তবু…যদি ভুলে যাই… দিয়েছিলেন একদিন…. লেগেছিল একদিন… তাই… ওটা থাক স্যার আমার কাছে।’
এই বলে, আর একটা প্রণাম করে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল আমার ছাত্র, আমার শিক্ষক— নির্মল রায়; শত দুঃখেও যার চোখে কখনও জল দেখে নি কেউ।
‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান…’
৩৯
ইশকুলে ক্লাস নিচ্ছি, এমন সময় জানলা দিয়ে দেখলাম— একটা লাল বাতি লাগানো গাড়ি এসে দাঁড়াল গেটের সামনে। একটু পরেই দারোয়ান ছুটে এসে খবর দিল— আমাকে খুঁজতে এসেছেন মস্ত এক ‘আফসার‘ (বীরেনদা বিহারের আরা জেলার মানুষ)। আমায়! কেন বাপু! ‘আমি তো কিছু করি নি’— এইরকম একটা কাঁচুমাচু মুখ করে নিচে গেলাম ভয়ে ভয়ে।
তা গিয়ে জানা গেল— ব্যাপারটা অত ভয়ানক কিছু নয়। সরকারি উদ্যোগে একটা নাট্যোৎসব হবে মিনার্ভাতে। পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলার ইশকুলের বাচ্চারা তাতে নাটক করবে। আমার কাজ হল শো-এর আগে একটা করে ছোট্ট ভাষণ দেওয়া— যাতে দর্শকদের বিষয়টা বুঝতে সুবিধে হয়— তারাও সব ইশকুল-পড়ুয়া কিনা। তা নয় হল— কিন্তু আমিই কেন? ভারপ্রাপ্ত ‘আফসার’ দত্ত-সাহেব (হ্যাঁ, ঠিক এইভাবেই পরিচয় দিয়েছিলেন সঙ্গে আসা ভদ্রলোক) ঘোর বিষন্ন মুখে জানালেন— নাট্যজগতের এক মস্ত মানুষ আমার নাম ‘রেকমেন্ড’ করেছেন, নইলে এক বিখ্যাত অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়ে গিয়েছিল। মুখভঙ্গি থেকে পষ্ট বোঝা গেল— এক ‘মাস্টারমশাই’-কে দায়িত্ব দিতে হচ্ছে— এতে তিনি যথেষ্ট হতাশ।
যাক গে। অনুষ্টান ভাল ভাবেই হয়ে গেল। তিনটে দিন অন্য ইশকুলের বাচ্চাদের সাথে যথেচ্ছ হই হই করা গেল। দত্তসাহেব বিরস মুখে আমায় ব্যাজ পরালেন, বিস্তর আক্ষেপ-সহ। আমি লাফালাফির আনন্দে ও সব গায়ে মাখলাম না।
মাস-তিনেক পরে আবার এলেন সাহেব। আরও করুণ মুখে। অরুণাচলের একটি স্কুলের দল আসছে এবার। দুটি নাটক করবে তারা। কি কাণ্ড— তার একটি হল ‘গোপি গায়েন বাঘা বায়েন!’ আমার হাসি-ভরা মুখের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বললেন—‘এবার কিন্তু ফুল ইন্ট্রুডাকশান ইংলিশে দিতে হবে!’ আমি তখন বেজায় আহ্লাদিত, ভাবুন একবার— অরুনাচলেও কিনা আমাদের সেই গুপি-বাঘা এমন বিখ্যাত! খেয়াল না করেই বললাম— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বটেই তো, নিশ্চই, আলবাৎ!’
নির্দিষ্ট দিনে হল-এ পৌঁছতে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বললেন— ‘একটা সমস্যা হয়েছে। ওরা যে ব্রোশিওরটা দিয়েছে, সেটা হিন্দিতে।’ এতে সমস্যার কি আছে— বুঝলাম না। সেটাই তো স্বাভাবিক। পড়ে দেখলাম— একটু পাল্টান হয়েছে গল্পটা— তা সেটুকু পরিষ্কার লেখাই আছে। স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে ফেললাম সেটুকু; তারপর এমন ভাবেই বললাম— যাতে বাচ্চারাও বোঝে। তারপর হাঁ করে দেখলাম— কোন সুদূরের একটা স্কুলের বাচ্চারা কি সুন্দর করে অভিনয় করল আমাদের চিরচেনা গল্পটা।
অনুষ্ঠানের শেষে খুব হাততালি দিয়ে গদগদ মুখে বেরোচ্ছি— দত্তসাহেবের সাথে দেখা। এককোণে টেনে নিয়ে গিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলেন তিনি। বারবার বলতে লাগলেন— এরকম ভাষণ তিনি আশাই করেন নি। অসাধারণ বলা হয়েছে আজ, তিনি মুগ্ধ। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি বলেই চললেন— এরকম উচ্চারণ খুব কম শোনা যায়, একেই বলে খাঁটি অক্সফোর্ড অ্যাকসেন্ট। আর আমি ভাবতে লাগলাম— সে আবার কি বস্তু!
হঠাৎ মনে পড়ল— আজ আমি ইংরেজি বলেছি বটে! তাতেই এত মুগ্ধতা। স্বাধীনতার পর ছ-টা দশক কেটে গেছে— তাতে কি— আজও ইংরেজি বলতে পারাই শিক্ষার প্রধান লক্ষণ। আর মনে পড়ল— অনেক কাল আগে এক কবি লিখেছিলেন বটে—
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে, অবোধ আমি, অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ,
পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি….
(আর ইংরেজিটা তিনি আমার চেয়ে ‘সামান্য‘বেশিই জানতেন !!)
ও আমার বর্ণমালা! ও আমার মাতৃভাষা! আর কতদিন পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি করব গো আমরা!