অখণ্ড ভারতবর্ষ – ৪০

৪০

আমাদের বাড়ির চারটে বাড়ি পরেই বাবুদের বাড়ি। এক ক্লাসেই পড়তাম আমরা, এক মাঠেই খেলতাম হাঁটতে শেখার পর থেকে। আমার বাবা ছিলেন কলেজের লাইব্রেরিয়ান, বাড়িতে এমএ আর অনার্স-এর ছাত্রছাত্রীদের বাংলা পড়াতেন। মা পড়াতেন ইশকুলে। আর বাবুর বাবা মারা গিয়েছিলেন আমাদের জ্ঞান হওয়ার আগেই; মা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতেন। তবুও, শৈশবের অমোঘ নিয়মে আমরা ছিলাম গলায় গলায় বন্ধু। ফোর পাশ করেই পড়াশুনো ছাড়তে হল ওকে। কিছুদিন টুকিটাকি কাজ করার পর একটু হাতে-পায়ে জোর হতেই ও ভ্যান চালাতে শুরু করল। আমি এমএ পাশ করার আগেই বাবু বিয়ে করে বসল খুব গরিব ঘরের একটা মেয়েকে। তারপর নিয়ম করে প্রতি বছর একটা করে মেয়ের বাবা হতে লাগল। ছেলে হচ্ছিল না কিনা!

বাবুর বড়ো মেয়েটার নাম ছিল লিলি। এইটে পড়তে একদিন সন্ধ্যেবেলায় আমাদের বাড়িতে এল; খুব সংকোচের সঙ্গে দেখাল একটা খাতা। দেখি— তাতে বেশ কয়েকটা কবিতা। কাঁচা হাতের লেখা, বানান ভুল, ছন্দে মিল-এ গন্ডগোল; কিন্তু কবিতাই বটে। হাঁ করে তাকিয়ে আছি, বলল— ‘একটু শুধরে দেবে, রাজাকাকু? স্কুল ম্যাগাজিনে দেব?’ দিলাম সাধ্যমতো মেরামত করে। ক-দিন পরে আবার এল আর কয়েকটা কবিতা নিয়ে। ক্রমে নিয়ম হয়ে দাঁড়াল এটা; প্রায় নিরক্ষর এক ভ্যানওয়ালার মেয়ের খাতা ভরে উঠছিল কবিতায়।

দ্রুত বড় হয়ে উঠছিল লিলি। দেখার কেউ ছিল না; পাড়ার আর বেপাড়ার উঠতি ছেলেদের সঙ্গে গল্প করত বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আমায় দেখলে ছুটে পালাত ঘরে। যথারীতি পালিয়েই গেল একদিন; জানা গেল— আসানসোল না কোথায় চলে গেছে এক লরি-ড্রাইভার ছোকরার সাথে। বিয়ে করেছে। তা ভালো।

একদিন হঠাৎ ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। নাম অন্য, কিন্তু পালটে-যাওয়া ছবি দেখেও চিনলাম— লিলিই বটে। কুশলজিজ্ঞাসা, ভাই কেমন আছে (আমার ছেলে আর কি) ইত্যাদি সেরে ফোন নম্বর চাইল। দিতেই ফোন। এবার চাইল স্কুলের ঠিকানা। বলল— পরের হপ্তায় কলকাতায় আসবে, তখন দেখা করবে।

সত্যিই পরের সোমবার আমার স্কুলে চলে এল লিলি। পরনে সাধারণ, কিন্তু সুন্দর একটা শাড়ি; স্বাস্থ্য ফিরে গেছে। সঙ্গে বর— সে শশব্যস্ত হয়ে প্রণাম করল, সঙ্গে লিলিও। তারপর হাতে তুলে দিল একটা কাগজের মোড়ক। খুলে দেখি— একটা কবিতার বই। সুন্দর প্রচ্ছদে গোটা গোটা করে লেখা লেখিকার নাম— ‘লিলি দাস’। পাতা ওলটাতেই চোখে পড়ল, উৎসর্গ-পত্রে লেখা— ‘রাজাকাকুকে, একটুও না-বকে অনেক ভুল শুধরে দেওয়ার জন্য!’

কে যে কাকে মনে রাখে, কে যে ভুলে যায়…

৪১

ভাইয়ের বিয়ের বাজার করতে গেছি। না না, শাড়ি-গয়না কী আর আমি কিনতে পারি? ও সবের জন্য গিন্নি আছে, তার উপর মা আছে। আমি গেছি চাল-ডাল-মশলা কিনতে। ফর্দ মিলিয়ে জিনিস বুঝে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। অনেক অনেক জিনিস। একটা রিক্সা চাই এবার, কিম্বা ভ্যান। আর এমনই কপাল— বেরিয়েই পড়লাম হরিদাদুর সামনে। অমনি আবাহন— ‘যাবা নাকি দাদা?’

হরিদাদু আমাদের ছোট্ট মফস্সলি বাজারের সবচেয়ে বুড়ো রিকশাওয়ালা। আমার বাবা তাকে কাকু বলত; সেই সূত্রে আমরা বলি দাদু। সারাদিন বাজারের বাইরেটায় বসে ঝিমোয়, নইলে যাত্রীদের ডাকাডাকি করে— ‘যাবা নাকি ইস্টিশন?’ কেউই উঠতে চায় না হরিদাদুর রিক্সায়— কেননা দাদু বেজায় আস্তে আস্তে চালায়; ট্রেন পাওয়া যায় না ওইভাবে চালালে। তার উপর এই বয়েসের একটা মানুষ রিক্সা চালাবে, আর আমি বসে থাকব— এটাও সহ্য করা মুশকিল। আজ অবিশ্যি অন্য কথা; প্রথমত— আমি উঠছি না, দ্বিতীয়ত— আজ দেরি হলে ক্ষতি নেই। বেশ, আজ হরিদাদুই যাক। এই ভেবে আমি বললাম—‘চল দাদু, আমাদের বাড়িতে।’

মালপত্র তুলে রওনা দেওয়া গেল। অতি ধীর গতিতে, একটু ডান দিকে ঝুঁকে পড়ে চালাতে লাগল দাদু; আর আমি বাইক চালিয়ে ওই গতিতেই পাশে পাশে। বাজার ছাড়িয়ে একটু এগোতেই রাস্তা একেবারে ফাঁকা। মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে, দাদু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ভয়ও করছে। কাজেই কথা বলে উঠছি— ‘ও হরিদাদু, ঠিক আছো তো?’ দু-একবার এমন হতেই মুখ খুলে গেল তার। বলতে লাগল— ‘বোঝলা দাদু, আমি এই এলাকায় পেত্থম রিকশাওয়ালা, একান্নয় আইসি। তহন ইস্টিশন থিক্যা বাজার ভাড়া আছিল আট আনা। হেয়াই কেউ দেতে পারত না। দুইজন মিল্যা ভাড়া করত, চাইর আনা কইরা পড়ত। সেই থিক্যা আইজ তামাইত (পর্যন্ত) এই রিক্সা টানতেয়াছি। অহন বয়স হইসে আশি— জ্বরও হয় নাই এক দিনের লাইগ্যা। পোলায় অহন চাকরি করে বিকাশ ভবনে, সরকারি চাকরি। কয়— আমি রিক্সা টানলে নাকি হ্যার (তার) অসন্মান হয়। মাইয়া তো নার্স, নিজে পসন্দ কইরা বিয়া করসে এক মাশটাররে। হ্যারও মত নাই। কয়— ঘরে বইসা টিভি দেহো। আমি কই— আরে হারামজাদা, এই রিক্সা টাইন্যাই তো বড় কল্লাম তগো, খাওয়াইলাম, ইশকুলে পড়াইলাম। তহন লজ্জা করে নাই? আইজ সব বাবু হইয়া গেছে! কও দেহি— নিজের পরিশ্রমের পয়সায় খাই— এইয়ার মইধ্যে লজ্জার আছেডা কী? তুমিও তো শুনি মাস্টর হইসো। খাটো, খাও। লজ্জা করে নাকি কইতে— খাইট্যা খাই? কী কও, দাদুভাই?’

সেই প্রায়ান্ধকার রাস্তায় বাইক চালাতে চালাতে মাথা ঝুঁকে পড়ল আমার— ঠিক বুড়ো হরিদাদুর মতো। সত্যিই কী খাটি আমি? খেটে খাই? যতটা খাটা উচিত ছিল ছেলেগুলোর পিছনে— ততটা খাটি কি আমি? ততটা খাঁটি কী আমি? এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে ধমকাতে পারব ছেলেকে— যখন আমি বুড়ো হব? নিজের কাজকে এতটা সম্মান করি আমি?

তাকিয়ে দেখি— মাথা উঁচু করে, শিরদাঁড়া সোজা করে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে এক অহংকারী অশ্বারোহী, তার পাকা চুল উড়ছে সম্মানিত হাওয়ায়। তার পিছনে ছুটছে এক অলীক অন্ধ শব্দ।

‘আত্মসম্মান!’

৪২

বইমেলা ২০০৭। অহর্নিশের স্টলে চুপটি করে বসে বই পড়ছি— এমন সময় প্রায় দৌড়পায়ে একটি তরুণ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে শুধলো— ‘রাজা ভট্টাচার্য?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঘাড় নাড়তেই অচেনা ছেলেটি আমার সামনের টেবিলে একটা অতি ছোট্ট বই রেখে—‘এটা আপনার জন্য’— বলেই দ্রুত পায়ে ভীড়ে মিশে গেল আবার। হাতে নিয়ে দেখি— গীতা প্রেসের বের করা একটা গীতা। লাল রঙা, দেশলাই বাক্সের চেয়ে একটু বড়ো আকার। শুধু সংস্কৃত শ্লোক গুলো আছে তাতে। কে যে দিয়ে গেল, আমাকেই বা কেন— কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু তারপর থেকে বইটা আমার ব্যাগে স্থায়ী আসন নিল। ট্রেনে বাসে অবসর পেলে দু-চারটে শ্লোক পড়ে ফেলা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেল।

একদিন মেট্রোয় বসে ওই বইটাই পড়ছি মন দিয়ে। হঠাৎ চোখ তুলতেই দেখি— উলটোদিকের সিটে বসা ছেলেটি— বয়েস তার বোধ হয় কুড়ির কোঠায় পৌঁছয় নি— গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে আমায়। এরকম স্থির চোখে কেউ চেয়ে থাকলে পড়ায় মন বসে না। দু-একবার চেষ্টা করে বই বন্ধ করতে হল। দমদমে নেমে বারাসাত লোকালে উঠে বসেছি। সব্বনাশ! সেই ছেলেটি এবার একেবারে আমার পাশের সিটে। দুর ছাই, পাত্তা দেব না আর— ভেবে মরিয়া হয়ে ফের বের করলাম বইটা। বুঝতে পারছি— অমনি করেই সে ছেলে দেখছে আমাকে এখনও। শেষে আর থাকতে না পেরে ঘুরে বসে বলেই ফেললাম—‘কিছু বলবে?’ থতমত খেয়ে ছেলেটা হাসল। আলাপ হল এবার। সদ্য হায়ার-সেকেন্ডারি পাশ করে শিলিগুড়ি থেকে এসে মধ্যমগ্রামের এক বেসরকারি কলেজে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বলল—‘আপনি রোজ পড়েন গীতা?’ ঘাড় নাড়তে আবার প্রশ্ন— ‘আর কী পড়েন?’ প্রথমে ঠাট্টা করে বললাম— ‘কেন, সুকুমার রায়!’ তারপর তার গম্ভীর চাউনি দেখে অগোছালো ভাবে বললাম কিছু ধর্মগ্রন্থের কথা— বেদ, উপনিষদ, বাইবেল, ক্কুর-আন-শরীফ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদু গলায় বলল— ‘এর সবকটা আমিও পড়েছি।’ আমি তো থ। এইটুকু ছেলে এসব বই পড়ে কেন! তাও আবার এঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র !

চুপ করে এইসব ভাবছি— এমন সময় সে খুব মৃদু কণ্ঠে, প্রায় কানে কানে আমায় জিজ্ঞেস করল— ‘কিছু পেলেন?’

আমার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠল এই ছোট্ট প্রশ্নে। মনে পড়ল বহুদিন আগেকার সিমলে পাড়ার এক প্রশ্নাতুর যুবকের এক আশ্চর্য প্রশ্ন; আর হুগলি থেকে কলকাতায় পুজোয় দাদাকে সাহায্য করতে আসা এক আশ্চর্য মানুষের অমোঘ উত্তরের কথা। তাকিয়ে দেখি— দুই নবীন চোখে সুতীব্র আর্তি ভরে সে চোখ রেখেছে আমার চোখে— যেন বহুদিনের জমে-থাকা তীক্ষ্ণধার প্রশ্নটার উত্তরের উপর তার সমস্ত অস্তিত্ব নির্ভর করে আছে। কী পাব! কীই বা পেতে পারি আমি আমার এই দীনতম বিদ্যায়!

হঠাৎ যেন কোত্থেকে বুকের মধ্যে একটা বল— একটা শক্তি খুঁজে পেলাম। তার হাঁটুর উপর হাত রেখে বললাম— ‘নাঃ। পাই নি। কিচ্ছু না। কিন্তু তুমি পাবে। শুধু জিজ্ঞেস করে চলো। নিজেকে। অন্যকে। পাবে, ঠিক পাবে একদিন।’

এতগুলো সহস্রাব্দ আমরা— এই এত্তবড় দেশের লোকগুলো— শুধু খুঁজে চলেছি। খুঁজতে শিখেছি যখন— একদিন উত্তরও পেয়ে যাব ঠিক।

দেখবেন!

৪৩

গত বছরের প্রায় এই সময়ের একটা দিন। আগে থেকেই ঠিক ছিল, স্কুল থেকে একটু আগে বেরিয়ে শিয়ালদা যাব। বেশ কিছু লেখা জমা দেওয়ার আছে। সেকেন্ড পিরিয়ড থেকে আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি। অমন বৃষ্টি সচরাচর হয় না। ক্লাস চলছিল— অত খেয়াল করি নি। প্রায় দু’ঘন্টা টানা তুমুল বৃষ্টি হয়ে— ও মা— দিব্যি রোদ উঠে গেল। তিনটে নাগাদ যখন বেরোলাম— বুড়ি কোলকাতার ভাঙাচোরা মুখ নববধূর মতো ঝলমল করছে।

বাসে উঠে অভ্যেস-মতো বই খুলে বসলাম। ছেড়েও দিল। গিরিশ পার্ক পেরিয়ে হঠাৎ কী হল— বাস আর নড়ে না। পড়ার নেশায় প্রথম মিনিট দশেক খেয়াল করি নি। তারপর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা দেখলাম— চোখ কপালে উঠে গেল। যতদূর দেখা যায়— শুধু গাড়ি আর গাড়ি। কী হল রে বাবা! সব এর’ম স্তব্ধ কেন? খতিয়ে দেখব বলে রাস্তায় নামলাম— অমনি বুঝলাম— আমার পা পড়ল প্রায় দেড়ফুট জলের মধ্যে।

এইবার বুঝলাম— পুরো এলাকাটাই তলিয়ে গেছে জলে। বাস আর যাবে না। সর্বনাশ! লেখাগুলোর কী হবে? বড্ড জরুরি যে ! ফোন করলাম— উত্তর এল— ‘চলে আয় রে, আমি তো বসে আছি তোর জন্য।’ এরপর আর ফেরা চলে না। বাঙালের গোঁ; হেঁটেই রওনা দিলাম। দেখা যাক কী হয়। মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড়ে পৌঁছে বাস ধরে নেব।

এগোচ্ছি। জল বাড়ছে। প্যান্ট গোটাচ্ছি। নোংরা কালো জল। গা ঘিনঘিন। রেলিং-এর উপরে চড়ে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে বাচ্চারা। ওদের ঘেন্না করে না। ওদের বাড়িতেও এখন জল। আমার বাড়িতে জল ওঠে না।

এগোচ্ছি। জল বাড়ছে। প্যান্ট উঠছে। নোংরা জল ভেঙে হেঁটে গেল প্রেমিকযুগল। হাতে হাত দৃঢ়ভাবে ধরা। মুখে বিরক্তির লেশমাত্র নেই। রাস্তার মাঝখানে অটো দাঁড় করিয়ে ভাড়া মেটাচ্ছে দুটো মেয়ে। একরাশ বিরক্তি— ‘বাবা যে কোথায় রাখে খুচরো পয়সাগুলো!’ মহাত্মা গান্ধী মেট্রো স্টেশনের শেডের তলায় চাপ ধরা ভিড়। এক প্রৌঢ় অনেক খুঁজে একটা লোককে দূরে বিড়ি ধরাতে দেখে অপ্রসন্ন মুখে রুমাল চাপা দিলেন।

এগোচ্ছি। জল বাড়ছে। প্যান্ট ভিজছে এবার। এখানে অনেক বেশি জল। ফুটপাথের দোকানগুলো অর্ধেকটা জলের তলায়। নোংরা কালো জল। অসম্ভব ঘেন্না করছে। ওইরকমই একটা আধ-ডোবা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা নোংরা লোক। হাতে একটা লাঠি। পরনে লুঙ্গি। খালি গা। দোকানদার। ডোবা দোকানের দোকানদার। সমানে চিৎকার করছে ভাঙা গলায়— ‘গত্ত আছে…গত্ত আছে…গত্ত আছে…গত্ত…’

পাগল। আর কী। এগোচ্ছি। জল বাড়ছে। চিৎকারটাও বাড়ছে। পা বাড়ালাম। মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিলাম আর একটু হলেই। প্রকান্ড গর্ত একটা। ওর দোকানের সামনে। জলের তলায় অদৃশ্য। ওই লোকটা জানে। তাই চ্যাঁচাচ্ছিল। লাঠি তুলে ধমকাল আমায় চোখ পাকিয়ে—‘বলছি না— গত্ত আছে এখানে? কানে ঢুকছে না?‘ বলে আবার লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার শুরু করল— ‘গত্ত আছে…গত্ত আছে..’

ওর নিজের দোকানটা অর্ধেক জলের তলায়। ও দেখছে না। ও চিৎকার করেই চলেছে—‘গত্ত আছে…. গত্ত…!’

ও সত্যিই পাগল। আমি তো পাগল নই। আমি এগোচ্ছি। লেখা জমা দিতে হবে। লোকটা চিৎকার করেই চলেছে— ‘গত্ত আছে…গত্ত আছে…‘

কবে যে শিখতে শিখব…কে জানে…

৪৪

প্রথমবার যখন সিলারি গাঁও যাই, তখন সেখানে পর্যটন ব্যবসা সবে হাঁটতে শিখছে। পাহাড় আর পাইন-বার্চের জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গ্রামটায় আমরাই ছিলাম ‘তিনমাত্র’ বহিরাগত— অর্থাৎ আমি, গিন্নি আর আমাদের পাঁচ বছরের ছেলে। রাত্তিরে গ্রামের ভিতরে ঘুরতে আসত চিতা, কুকুরের ডাকে তা বোঝা যেত স্পষ্ট। কারেন্ট ছিল না, পূর্ণিমারাতে দিগন্ত আলোড়িত করে উঠে আসত অলৌকিক চাঁদ— সে আলোয় স্পষ্ট দেখা যেত কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমরা উঠেছিলাম দিলীপ তামাং-এর বাড়িতে; তখনও সেটা দস্তুরমত ‘হোম স্টে‘ হয়ে ওঠে নি। গৌতম চক্কোত্তির কাছে শুনেছিলাম— এই মানুষটি তাঁর প্রায় সর্বস্ব দিয়ে গড়ে তুলেছেন এই ঘর তিনটে। দুটো দিন মগ্ন হয়ে থেকে, পায়ে হেঁটে বিস্তর ঘুরে ফেরার সময় টাকা দিতে গেলাম। প্রায়-নিরক্ষর পাহাড়ি মানুষটি বারশো টাকা ফেরত দিয়ে বললেন—‘ইয়ে তো জ্যাদা হো গ্যয়া সারজি!’ আমি তো অবাক! তিনি হিসেব বোঝাতে লাগলেন—‘আপ দো হ্যায়, দো দিন ঠ্যাহরে…!’ আমি বললাম—দো কোথায়, তিনজন যে আমরা! দিলীপ আরও অবাক হয়ে আমার ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন—‘অব বাবু-কা ভি প্যায়সা লেনা পড়েগা কেয়া !‘ আমি ভাবলাম— একটা মানুষকে চেনা হল।

মাস ছয়েক পরেই আবার গেলাম সিলারিতে; এবার সঙ্গে দুই বন্ধু, তাদের স্ত্রী ও সন্তান। একগাল হেসে দিলীপ বরণ করল আমাদের। ঘর বেড়েছে, আর সেই ঘরে উঠেছেন এক যুগল। মাঝবয়েসী নারী-পুরুষ তাঁরা; আমাদের মতো নন মোটেই। এসেছেন নিজেদের প্রকাণ্ড গাড়িতে নিজেরাই চালিয়ে, নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন ইংরিজিতে। উঠোন-ময় ছুটোছুটি করে বেড়ানো শিশুদের দিকে তাঁদের মন নেই মোটেই। একজন যখন দামী ক্যামেরায় ফটো তুলছেন, অন্যজন তখন ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। খাওয়ার ঘরে আলাপ করতে গিয়ে বুঝলাম, এঁরা সামান্য সরকারি কর্মীদের বাক্যালাপের যোগ্য মনে করছেন না। নিরস্ত হতে হল। পরদিন সকালেই গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন তাঁরা, মেঘ ভেঙে তখন সদ্য দেখা দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমরা বারান্দায়, হাঁ হয়ে তাকিয়ে, স্থানু।

বেশ কিছুক্ষণ পরে চা দিতে ওপরে এল দিলীপ। সদাহাস্যময় মুখ গম্ভীর, কপালে ভাঁজ। আমার বিস্তর জিজ্ঞাসায় বলল— এইমাত্র যাঁরা বেরিয়ে গেলেন— তাঁরা টাকা না-দিয়েই চলে গেছেন। মোটে একটি রাতই ছিলেন তাঁরা, মানে— মাত্র বারশো টাকা মেরে দিয়ে পালিয়ে গেছেন নির্দ্বিধায়, বারো লাখ টাকার গাড়িতে চড়ে। দিলীপ ভেবেছিল— কোথাও যাচ্ছেন— একটু পরেই ফিরবেন। আর ফেরেন নি তাঁরা।

ফ্যালফ্যাল করে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল সেদিনের সেই গরিব মানুষটি। আর আমি ভাবছিলাম— আরও একবার ‘ইন্ডিয়া’ এসেছিল ‘ভারতের’ দরজায়।

আরও একবার এই গরিবগুর্বো ‘ভারত’কে ঠকিয়ে পালিয়ে গেছে ‘ইন্ডিয়া’!

৪৫

তখন ক্রিকেটের নেশা ছিল খুব। শচীন-সৌরভ-রাহুল নিয়ে গলা ফাটাতাম পাড়ায় আর ইশকুলে। সৌরভের সেঞ্চুরিতে গাঁটের পয়সা খরচ করে লজেন্স খাওয়াতাম ছাত্রদের। অনুমান করতে পারি, আমার চেয়ে ওরাই বেশি করে প্রার্থনা করত— সৌরভ যেন রোজ সেঞ্চুরি করে।

মোবাইল তখনও বড়লোকি ব্যাপার, হাতে থাকলে লোকজন তাকিয়ে থাকে। বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে পড়লে ভরসা শুধু সেইসব ভাগ্যবন্ত লোকেরা— যাঁরা কানে চেপে আছেন ছোট্ট রেডিও। ট্রেনে তাঁরা সেলেব-সুলভ আচরণ করতেন; মুড (এবং ভারতের অবস্থা) ভাল থাকলে জবাব দিতেন কৃপা করে, নইলে শুনতে পেতেন না।

সেই সময় আমার একমাত্র ভরসা ছিল জে.এম.এভিনিউর একটা দোকান। বিচিত্র দোকান সেটা— আমার বুক-সমান উচ্চতায় বসে থাকতেন দোকানি; পাওয়া যেত চা, পান, সিগারেট, চিপস; কিন্তু বিকিকিনির তাড়াহুড়ো ছিল না তাঁর। যাবতীয় আগ্রহ— আমার মতোই— ক্রিকেট। রেডিও চলত তারস্বরে, আকাশের দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতেন দোকানদার নিজেই। কাজেই ওখানে দাঁড়িয়ে স্কোর শুনে যাওয়াটা অবশ্য-কর্তব্য। আরও অনেককেই দেখতাম ওই একই উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে যেতে।

সেদিনও তাই ইশকুলে যাওয়ার পথে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সৌরভ সেঞ্চুরি থেকে আর বারো রান দূরে। এমন অসময়ে আমার পায়ে কি যেন একটা অস্বস্তি হল। তাকিয়ে দেখি— দোকানের নীচের গুহা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে একটি মেয়ে— বয়েস তার বড়জোর বারো-তেরো। রাস্তার ফুটপাথে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, বেজায় রোগা, শ্যামলা রঙ, পরনে খুব চেনা একটা স্কুল-ড্রেস। আমার দিকে তাকিয়ে, অপ্রতিভ হাসি হেসে সে বলল—‘সরি কাকু।’ এই প্রথম আমার চোখে পড়ল, সেই দোকানের আবার একটা ‘একতলা‘আছে। মানে, একটাই প্রমাণ-সাইজের ঘরকে দু’টো তলায় ভাগ করা হয়েছে মাঝে একটা ছাত বানিয়ে। উপরে দোকান। নীচে দস্তুরমতো সংসার— উনুন ধরিয়ে রান্না চলছে সেখানে, পাশেই তখনও ছড়িয়ে আছে বইখাতা। মেয়েটাকে বললাম— ‘কোন স্কুলে পড় তুমি?’

মেয়েটা উত্তর কলকাতার একটা বিখ্যাত মেয়েদের স্কুলের নাম বলল বাধো গলায়। চমকে গিয়ে শুধোলাম— ‘কোন ক্লাস হল?’ বলল— ‘সিক্স।’

‘বাঃ‘— বললাম আমি—‘তা রেজাল্ট কেমন হয়েছে এবার?‘

উপর থেকে শোনা গেল গর্বিত পিতার কণ্ঠ— ‘সেকেন হয়েছে এবার, স্যার। আমার তো পড়াশুনো হল না, ভাবি— মেয়েটাই পড়ুক ভাল করে। তা, বলতে নেই রেজাল্ট তো ভালই করছে।’

 এই স্কুলটার নাম প্রায় প্রতি বছর পেপারে বেরোয় মাধ্যমিক আর উচ্চ-মাধ্যমিকের পর। সেই স্কুলের সেকেন্ড গার্ল থাকে এখানে, এই আধতলা গুহায়! বলেই বসলাম চরম বিস্ময়ে—‘সব সাবজেক্ট নিজেই পড় নাকি তুমি?‘ সেও নির্বিকার ঔদাসীন্যে বলল—‘আহা, আমার কি কোচিনে পড়তে যাওয়ার পয়সা আছে ওদের মতো? নিজে নিজেই পড়ি তো !’

—‘আর তোমার বন্ধুরা?’ —বললাম আমি।

মেয়েটি বলল— ‘তাদের তো বাড়িরেই মাস্টার আসে। আমার বাড়িতে কে আসবে পড়াতে? টু’তে থাকতে এক বন্ধুকে দেখিয়েছিলাম আমার বাড়ি। বলে কি— তুই কি শেয়াল, যে গত্তে থাকিস? সেই থেকে আর কাউকে বলি না, কোথায় থাকি আমি।’ এই বলে, অসম্ভব আত্মপ্রত্যয় গলায় মাখিয়ে সে বলল— ‘পরের বার ফার্স্ট হবই আমি। মোটে তিনটে নম্বরের জন্য সেকেন্ড হয়ে গেলাম এবার…’

আর ঠিক সেই সময় রেডিওতে হুঙ্কার দিয়ে উঠল ভাষ্যকারের গলা—‘অওর ইয়ে চার রান কে সাথ সৌরভকা সও রান পুরা হুয়া…ইয়ে উনকি আটওয়া শতক হ্যায়….ব্যাট কো চুম রহেঁ হ্যায় ও…’

কে যে কখন কোন্ খেলায় জিতে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না মশাই….! দেশটাই গোলমেলে…..!!

৪৬

আমরা তখন যে বাড়িটায় ভাড়া থাকতাম, তার দু’পাশেই প্রকাণ্ড আমবাগান। এমনি ঘন, দিনেমানেও অন্ধকার হয়ে থাকত। পিছনের পাঁচিলের ওপাশে একটা কারখানা। সামনের কাঁচা রাস্তার উলটো দিকে একটা পোড়ো বাড়ি, তার পাশের পাঁচিল-ঘেরা বাড়িটাও মস্ত আমবাগানের মধ্যে। জঙ্গুলে জায়গা যাকে বলে। আমাদের বাড়িটার সামনে, উঠোনের বাঁ-পাশে একটা মস্ত ঘাসজমি, দিনে-দুপুরে সেইই ঘাসের উপর রেখা কেটে সড়সড় করে চলে যেত গোসাপ। শেয়াল ছুটে যেত সন্ধ্যায়— সামনে তার পলায়মান খরগোশ।

আমি তখন সাত বছরের, ভাইয়ের বয়েস আড়াই। দুপুর বেলা। বাবা কলেজে, মা ঘরের সামনের বারান্দায় বসে বই পড়ছে, আমি হোম-ওয়ার্ক নিয়ে নাজেহাল। ভাই খেলছিল উঠোনে একা একাই। নিঝুম স্তব্ধ মধ্যাহ্ন। এই সময় রোজ শোনা যেত একটা ঘণ্টাধ্বনি— এক টাক-মাথা ভদ্রলোকের পিছন পিছন মাথায় একটা ঝাঁকা নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যেতেন এক ধুতি-পরা প্রৌঢ়; ঝাঁকাতে থাকত কাঁসা আর পিতলের বাসন। মা মাঝেমধ্যে ডাকত তাঁদের, কেনাকাটাও হত।

সেদিন দেখি— সেই টাক-মাথা ভদ্রলোক মৃদু গলায় ডাকছেন মা-কে— প্রায় ফিসফিস করে—‘মা, ও মা, একবার শুনবেন?’ সেই বয়েসেও সেই ডাকের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় শুনতে পেলাম আমি। মা তাকাতেই তিনি বললেন— ‘ছোট ছেলে কই আপনের ?’ মা খালি উঠোনের দিকে তাকিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠতেই তিনি ঠোঁটে আঙুল রাখলেন, তারপর হাতের ইশারায় ডাকলেন কাছে। মা আর আমি— দুজনেই প্রায় ছুটে গেলাম গেটের কাছে। রাস্তায় বেরিয়ে যা দেখলাম, তা ভুলব না কখনও।

গেটের থেকে কুড়ি-পঁচিশ পা দূরে, মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে ভাই ; আদুল গা, পরনে একটা হলুদ প্যান্ট। ওর সামনে একটা বেড়ালছানা, তার সামনে একটা ছোট্ট সাপ— তার মাথার ইউ-এর মতো দাগটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুপুরের রোদ্দুরে। ঝাঁকা-মাথায় প্রৌঢ় ফিসফিস করে বললেন— ‘গোখরো!’ সাপটা বড়জোর হাত-খানেক লম্বা, স্পষ্টতই শিশু-মাত্র। মাঝে মাঝেই সে ফনা তুলছে, অমনি বেড়ালছানাটা মৃদু থাবা মারছে তার ফনায়, আর সে মাথা নামিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে একটু। খানিক অপেক্ষা করেই আবার তুলছে তার অবাধ্য ফনা। আর অমনি হাততালি দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠছে আর একটি শিশু। আমার ভাই।

আমরা দম বন্ধ করে এই দৃশ্য দেখছি— এমনসময় হঠাৎ সেই ঘন্টা বেজে উঠল ঢংঢং করে; সঙ্গে ধুপধাপ পায়ের শব্দ। সাপটা অমনি মাথা নামিয়ে ঢুকে গেল পথের পাশের ঝোপে, বেড়ালছানাটাও লেজ তুলে পালাল উল্টোদিকে। আর মা একটা অর্ধব্যক্ত চিৎকার করে ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিল ভাইকে, তারপর হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।

ভাই কিন্তু গম্ভীর হয়ে বলল— ‘খেলা কচ্চিলাম তো!’

আজ বিকেলে গিয়েছিলাম সেই পুরনো পাড়ায়। সেই জঙ্গল আর নেই, সার সার বাহারি বাড়ি উঠে গেছে। তিনটি শিশুর খেলা আর কখনও হবে না সেখানে। মনে পড়ল— এরচেয়ে অনেক— অনেক বড় একটা জঙ্গল কেটে ফেলার জন্য কুড়ুলে শান দিচ্ছে কারা যেন।

একবার ভেবে দেখলে হয় না, কোনটা বেশি জরুরি— সুন্দরবন, না খানিকটা বিদ্যুত?

৪৭

গুরুদাসকাকু থাকত আমাদের বাড়ির ঠিক চারটে বাড়ি পরে। প্রায়ই আসত আমাদের বাড়িতে, গান শুনতে। কট্টর কমিউনিস্ট বাড়ি আমাদের; গুলি-খাওয়া জেলে-যাওয়া কমিউনিস্ট। বাবা দিনরাত গণসঙ্গীত লিখত, গাইত, শেখাত। আর গুরুদাসকাকু ছিল কংগ্রেসের নেতা। কিন্তু গান তাকে টেনে আনত আমাদের বাড়িতে; বাবাকে ডাকত ‘গুরু’ বলে। আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, শুধু জানতাম— কাকু ‘বড়দের ইশকুলে’ পড়ায়। ব্যাস।

এমনই কপাল— ফোর পাশ করার পর আমাকে ভরতি করে দেওয়া হল সেই ইশকুলেই। তা নয় হল, আরও খারাপ যেটা ঘটল— বাবা গুরুদাসকাকুকেই নিযুক্ত করল আমায় ইশকুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভাবুন একবার— আমার বন্ধুরা যখন দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে, গল্প করতে করতে ইশকুলে যেত— আমি যেতাম স্যারের সাইকেলে চেপে, মাথা নীচু করে। কী লজ্জা! তায় আবার ক্লাস ফাইভের ক্লাস-টিচারও গুরুদাসকাকুই!

প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় দিনেই কী একটা কথায় আমি জিজ্ঞেস করলাম— ‘স্যার (স্কুলে ওই সম্বোধনটা করতেই হত), লেনিনের বাবার নাম কী?’ খানিক চুপ করে থেকে কাকু বলল—‘জানি না রে, কাল জেনে বলব।’ এই প্রথম কোনও শিক্ষকের মুখে এই কথাটা শুনলাম আমি। শিখলাম।

একদিন ক্লাসে কথা উঠল— জল খেতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে যাই, ঘরেই যদি একটা ব্যবস্থা করা যেত? কাকু শুনে বলল—‘এক কাজ কর, দশ পয়সা করে চাঁদা তুলে একটা কুঁজো কিনে ফেল। যা বাকি থাকবে আমি দেব।’ কী আশ্চর্য, দিল সবাই! আর কাকু দিল বাকি পয়সাটা। নিজেদের চেষ্টায় এই প্রথম কিছু করলাম আমরা। শিখলাম।

শীতকালে কাকু ক্লাস করত ইশকুলের মস্ত মাঠে। গোল হয়ে বসতাম আমরা, কাকু মাটিতে দাগ কেটে বোঝাত গ্রহ উপগ্রহের গতিপথ। বলত—‘ক্লাস কী আর শুধু ক্লাসেই হয় রে?’ শিখলাম।

তারপর কোন্ কালে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি— সব পাস করলাম। স্কুলে পড়াই নিজেও। একদিন সেই আমার পুরনো স্কুলেই হল একটা অনুষ্ঠান। বাইশে শ্রাবণ। আমি বলব ‘রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তা’ বিষয়ে। কত কি ভেবে গেছি। আজ প্রথমবার এই স্কুলে আমার মাথার পিছনে ব্ল্যাকবোর্ড। ওরে বাবা, স্টেজে উঠে সামনে তাকিয়ে দেখি, আমার অন্তত পাঁচজন শিক্ষক দর্শক-আসনে বসা। গুরুদাসকাকুও আছে তাঁদের মধ্যে। সব যেন মুহূর্তে গুলিয়ে গেল— কী বলব এঁদের সামনে আমি! কোনোক্রমে মাথা নীচু করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম— আমি যেটুকু জানি। অন্য শ্রোতারা খুব হাততালি দিল— আমি ভয়ে কাঠ হয়ে নেমে এলাম স্যারদের কাছে। প্রণামটা তো করতে হবে!

আর কেউ কিছু বলার আগেই গুরুদাসকাকু এগিয়ে এল আমার কাছে। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল—‘কিছু খেয়ে নিস।’ এ আবার কী! জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে হেসে বলল— ‘তোদের তো ভাল করে কিছু শেখাতে পারি নি। কিন্তু আজ অনেককিছু শিখলাম রে। মনে কর, এটা গুরুদক্ষিণা।’

গত বুধবার চলে গেল গুরুদাসকাকু। আমার প্রথম শিক্ষক। অসুস্থ ছিল খুব। ভাগ্নে খবরটা দিল যখন, প্রথমেই মনে হল— যাঃ। একটা জরুরি কথা বলার ছিল যে! কাকু বলেছিল, আমি বলার সুযোগ পাই নি।

তুমিই শিখিয়েছিলে— ‘জানি না রে, জেনে বলব’— এই কথাটা বলতে লজ্জা নেই এই গুরু-শিষ্য পরম্পরার দেশে…

৪৮

প্রচুর ধার-টার করে নতুন ফ্ল্যাট কেনার পর প্রথম যে মানুষটির সঙ্গে আলাপ হল— তিনি সদানন্দ দাস। সে আলাপও অদ্ভুত। তখনও গৃহপ্রবেশ হয় নি, রং-অ্যাকোয়াগার্ড-এ.সি. নিয়ে হিমসিম খাচ্ছি। সারাক্ষণ চলছে মিস্ত্রিদের সশব্দ কাজ। একদিন দুপুরে হঠাৎ দরজায় অধৈর্য করাঘাতে ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। দেখি, দাঁড়িয়ে আছেন খালি গা, ধুতি পরা এক কৃষ্ণবর্ণ প্রৌঢ়— তার চোখ রাগে লাল। ধরা গলায় বললেন চিৎকার করে— ‘আপনারা কি মানুষটাকে শান্তিতে মরতেও দেবেন না? সারাদিন দুমদাম চলতে থাকলে এই এখন-তখন রুগি থাকতে পারে কখনও? বলেন দেখি!’ বলতে বলতেই তার গলা কান্নায় বুজে গেল, চোখ থেকে জল ঝরতে লাগল। আমি অপ্রস্তুতের চূড়ান্ত। ছুটে গিয়ে মিস্ত্রিদের বললাম— যাতে যথাসম্ভব কম শব্দ করে কাজ সারা যায়। ফিরে এসে দেখি, তিনি চলে গিয়েছেন।

জল চাইতে গিয়ে পাশের ঘরের ভদ্রলোকের কাছ থেকে জানতে পারলাম— এঁর স্ত্রী ক্যান্সারে মৃতপ্রায়, ডাক্তার জবাব দিয়েছেন। এবার বুঝলাম ভদ্রলোকের ওই ব্যবহারের কারণ। লজ্জার সীমা রইল না আর। কাজ মুলতুবি করে দিলাম অনির্দিষ্ট কালের জন্য। ঠিক এর তিনদিন পর চলে গেলেন সেই অপিরিচিতা মৃত্যুপথযাত্রিণী।

ফ্ল্যাটের রাজত্ব। শেষকৃত্য হল ছোট্ট করে। আমরাও নিমন্ত্রিত। চারতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি— কম্পিউটার টেবিলের উপরে একটা শ্রীখোল। এ কি কাণ্ড! জানা গেল— ইনি নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব, নবদ্বীপধামে দীক্ষিত। এবার চোখে পড়ল— ভদ্রলোকের গলায় তুলসীর মালা। কথায় কথায় বললেন— ছেলে থাকে ব্যাঙ্গালুরুতে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। টেবিলের কম্পিউটারটা তারই। একটু পরে আলাপ হল সেই ছেলের সাথেও; ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত তরুণটি আমার ছেলেকে বলল— ‘সে কি রে! এখনও হিচকক দেখিস নি! আয়, তোকে ‘‘দ্য বার্ড’’ চালিয়ে দিই।’ মধ্যমগ্রামের সুসভ্য ড্রইংরুমে খোল দেখার অস্বস্তি কেটে গেল পলকে।

মাস-খানেক পর একদিন স্কুল থেকে ফিরছি, ভদ্রলোকের সঙ্গে আবার দেখা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, কাঁধে কাপড়ে বাঁধা খোল নিয়ে চলেছেন। কথা হল। বললেন— ছেলে এখানে না-থাকলে বেশির ভাগ দিন গুরুর আশ্রমেই কাটান। সেখানেই ‘সেবা হয়’— খাওয়া-দাওয়া আর কি। সন্ধ্যে থেকে কীর্তন। তিনি খোল বাজান। ‘ঠাকুরের নাম হয়, সময়টাও কেটে যায়— বুঝলেন তো। বাড়িতে তো আর মন টেঁকে না আজকাল, কেউ নাই, একা একা…গিন্নিও জগন্নাথদেবের শ্রীচরণ পেলেন। আমি রইলাম পড়ে…’— বলতে বলতেই তাঁর চোখ ভিজে এল।

একটু থেমে বললেন— ‘ভাল বৈষ্ণব ঘরের মেয়ে পেলে বলবেন তো মাস্টারমশাই। ওকে গৃহী দেখে যাব— এই শেষ ইচ্ছাটুকু নিয়েই তো সে চলে গেল। বলবেন— আমরা কিন্তু নিরামিষ খাই। বৈষ্ণব তো…! ছেলেও কিন্তু… তার শ্রীখোল-বাদন যদি শোনেন…’

এতক্ষণে কম্পিউটার টেবিলে খোল থাকার রহস্য ভেদ হল। বুঝলাম— সেদিন রঙিন টি-শার্টের নীচে লুকোনো তুলসীর মালাটা আমি দেখতে পাই নি।

আমরা এইরকমই। ‘আই লাভ নিউইয়র্ক’ লেখা টি-শার্টের নীচে একটা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো হৃদয় আছে। ওটা দেখতে ভুলবেন না যেন…

৪৯

সেই প্রথমবার কাউকে দেখে দিনেমানে ভয় খেয়ে আঁৎকে উঠেছিলাম আমি, আর…বলতে লজ্জা করছে আজ— মনে হয়েছিল— মানুষ এত কুচ্ছিৎ দেখতে হয় না কি!

তখন আমি ক্লাস ফোর-এ পড়ি। ভাড়া-বাড়ি ছেড়ে সদ্য উঠে এসেছি আমাদের নতুন বাড়িতে। দুটো মাত্র ঘর উঠেছে, বাকি ঘরের জানলা-দরজা-মেঝে— কিচ্ছু নেই। কিন্তু বাড়ির সামনে আছে মস্ত এক টুকরো আকাঁড়া জমি। এই ক’দিন আগেও এখানে ছিল আমার বুক-সমান বনতুলসীর ঝোপ। তার খানিক পরিষ্কার হয়ে গেছে মিস্ত্রিদের হাতে হাতে, রয়ে গেছে অনেকটাই। একদিন বাখারির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ‘কাজ আছে, কা-আ-আ-আ-জ!’— বলে হেঁকে উঠল একটা লোক। বাবা বসে কাগজ পড়ছিল— আমায় বলল—‘ডেকে আন দেখি লোকটাকে!’ আমি ছুটে গেলাম বাইরে, আর অমনি সেই লজ্জাকর কথাটা আমার মনে হল—‘মানুষ এত কুচ্ছিৎ দেখতে হয় না কি!’ বেঁটেখাটো, ধড়ের উপর মাথাটা বসিয়ে দেওয়া, ঘাড় নেই, কুচকুচে কালো, কোঁকড়ানো চুল লেপটে আছে খুলিতে, একখানা চোখ খারাপ। পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি, কাঁধে ঝুড়ি আর কোদাল। কিন্তু শুধু এই কারণে নয়। আমি লোকটাকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম; কেননা— লোকটার মুখে কোনও অভিব্যক্তি ছিল না। একটুও না। যেন মৃত কোনও মানুষকে আমি বললাম—‘আপনাকে বাবা ডাকছে…!’ আর অমনি লোকটা নির্বিকার মুখে ঢুকে পড়ল উঠোনে— যেন এমনই কথা ছিল।

বাবার কথায় কাজে লেগে পড়ল লোকটা। ঝোপঝাড় কেটে, মাটি সমান করে, কুপিয়ে দিতে হবে জমি। ‘একদিনে হবে না গো, বুঝলে। ধীরেসুস্থে করো, আর দুপুরে এখানেই খেয়ো।’ —বলল বাবা। লোকটাও তৎক্ষণাৎ লুঙ্গিটা ভাঁজ করে, গেঞ্জি খুলে কাজে নেমে পড়ল যন্ত্রের মতো। খানিক দাঁড়িয়ে, তার কাজ দেখতে দেখতে বাবা জিজ্ঞেস করল—‘তা তোমার নাম কী গো?’ পিছনে না-তাকিয়ে ভাঙা গলায় লোকটা জবাব দিল— ‘নীলকান্ত, বাবু।’ বাবা একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল— ‘বাবু আবার কি! তুমি আমায়…ইয়ে…স্যার বলে ডেকো।’

সেই ‘নীলকান্ত’ নাম অবিশ্যি বেশিদিন কাজে লাগল না। কেননা শিগগিরি ধরা পড়ল— তাকে যা করতে বলা হয়, তা সে কক্ষনো করে না। যে গাছটা দেখিয়ে বাবা বলে যায়—‘দেখো, এটা কেটো না যেন বাপু’ —সেটাই কাটা পড়ে সর্বাগ্রে। যেখানে লালশাকের বীজ ছড়িয়েছে মা, সেখানটাই ফের কুপিয়ে ফেলে সে। কাজেই, তার এই গুণরাশিকে সম্মান জানাতে বাবা তার নাম রাখল— গুণধর। ব্যাস, ওইটাই ক্রমে নাম হয়ে উঠল হদ্দ-গরীব মানুষটার। আমরা তাকে ডাকতে শুরু করলাম ‘গুণধরদা’ বলে— সেও নির্বিকার মুখে সাড়া দিতে লাগল। মা মাঝেমধ্যে রেগে যেত গুণধরদার কাজেকর্মে, কিন্তু বাবা ঠিক ডেকে নিত আবার। মাও জানত— খুব বেশি কাজ পায় না বোকাসোকা মানুষটা, আর গরীব ছিল খুব। থাকুক গে। কাজেই, আমাদের গলা-অব্দি ধারের মধ্যেও, বারান্দায় বসে মস্ত থালায় অনেকটা ভাত খেত গুণধরদা। আমাদেরও অভ্যেস হয়ে গেল নির্বিকার মুখটা। অভ্যেস হল তার ফরমায়েসও— ‘আমারে পঞ্চাশ পয়সার বিড়ি এনে দেবা!’

বাবার মৃত্যুর পরদিন সকালে ডাকতে ডাকতে যাচ্ছিল গুণধরদা। বাড়ি তখন লোক-থইথই। খবর শুনে গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল মানুষটা। অনেক অচেনা বাইরের লোক দেখে ঢোকার সাহস পাচ্ছিল না। দেখতে পেয়ে ডাকলাম আমি। মুখ যেন পাথরের, শুধু ভাল চোখটা টকটকে লাল। তারপর তিনদিন ধরে আমাদের শোকে-মুহ্যমান বাড়িটাকে বুকে করে আগলে লাগল গুণধরদা। কে আসছে, কে যাচ্ছে, কে না-খেয়ে চলে গেল, কে অন্যের চটিতে পা গলিয়েছে— সব খেয়াল রাখল। বাড়ি ফিরত অনেক রাতে।

চারদিনের দিন কাজ হয়ে গেল। অজস্র মানুষের শোকার্ত বিলাপে ভরে থাকল সারাদিন আমাদের বাড়িটা। শুধু গুণধরদা নিজের কাজ করে গেল নিঃশব্দে— তা প্যান্ডেলের জন্য বাঁশ টানাই হোক আর জেনারেটরটা ভ্যান থেকে নামান। তারপর অনেক রাতে, বাড়ি যখন ফাঁকা— আমি ডাকলাম তাকে। একটা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললাম— ‘এটা রাখ, গুণধরদা, আর দিদিভাই মিষ্টি দেবে ক’টা, নিয়ে যেও।’

এই প্রথমবার, সেই ভাবলেশহীন নির্বিকার মুখটা ভেঙে গেল রেখায় রেখায়। ভাল চোখটা বেয়ে গালে নেমে এল জলের রেখা। তারপর ভাঙা গলায় বলল— ‘সাবধানে থেকো, বাবা!’

এই বলে, টাকাটা না নিয়েই, কোদাল আর ঝুড়িটা কাঁধে তুলে, ধীর পদক্ষেপে গেট খুলে অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে গেল কুচ্ছিৎ লোকটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *