অখণ্ড ভারতবর্ষ – ৬০

৬০

আমার কাছে দার্জিলিং বড় স্মৃতিমেদুর শহর। বাবা ছিল খাঁটি বাঙালি— যে চারটে জায়গায় আমাদের নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো সেই বিখ্যাত ‘দীপুদা’ (দীঘা-পুরী-দার্জিলিং ট্রায়ো) আর মধুপুর। কাজেই এই দার্জিলিং-এই আমি প্রথম মুখোমুখি হলাম পাহাড়ের, পাইন বনের, সত্যিকারের ঠাণ্ডার, আর কাঞ্চনজঙ্ঘার। জানলাম— রাস্তা শুধু সামনে বা পিছনেই নয়— উপরে বা নীচেও যেতে পারে। সে যাত্রায় পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যেয়— দেখি নি কিচ্ছু। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখি— হোটেলের কাচের জানলা জুড়ে ঝলমল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা; ক্ষণে ক্ষণে তার রঙ বদলে যাচ্ছে— আর বিছানায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বাবা, চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। বাবাও যে সেই ঐশ্বরিক দৃশ্য প্রথমবার দেখছে— সেটা বোঝার বয়েস আমার তখন হয়েছে— ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কাজেই নিঃশেষ শুষে নিয়েছিলাম দুটোই। কাঞ্চনজঙ্ঘা, আর বাবা।

পরদিন আমরা দেখতে গিয়েছিলাম চিড়িয়াখানা। রেড প্যান্ডা আর সাইবেরিয়ান টাইগার দেখে হাঁ হয়ে বেরোলাম। এক ধাপ নীচেই কয়েকটা চা আর ভাজাভুজির দোকান। বাবা-মা দাঁড়াল চা খেতে; আমি এগিয়ে গেলাম দু-তিন পা। সেখানে আর একটা চায়ের দোকানের সামনে বসে আছে একটি মেয়ে। তার সামনে একটা ছোট্ট পাত্রে ছোট ছোট কাঠের টুকরো। আগুনের মৃদু আঁচে বসে সে সোয়েটার বুনছে। বয়েস বড়জোর পনেরো-ষোল। অমন সুন্দরী কালেভদ্রে দেখা যায়— অন্তত সেই আঠারো বছর বয়েসে আমার তাই মনে হয়েছিল। নরম রোদ্দুর পড়েছে সেই মুখে, যেন স্বয়ং সূর্যদেবও একবার ছুঁতে চাইছেন সেই কিশোরীর রক্তিম গাল আর স্বপ্নময় চোখ। পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, যেন শীতের হাত থেকে বাঁচতে ওই আগুনটুকুই আমারও শেষ আশ্রয়। ভারি মিষ্টি হেসে সে বসতে বলল আমায়। ধন্য হয়ে হাত বাড়ালাম আমি আগুনের দিকে। আলাপ হল। ক্লাস নাইন। এখন ছুটি। কলকাতা কখনও দেখেনি— ‘সুনা হ্যায় বহোত ভারি শহর হ্যায়!’ ভাবলাম— কলকাতা দেখানোর সৌভাগ্য তো একান্ত আমারই জন্য অপেক্ষারত। তারমধ্যেই বেরসিকের মতো এসে পড়ল বাবা,মা আর ভাই। বসে থাকার উপযুক্ত অজুহাত ছিল না আর। হাঁটা দিতেই হল; কিন্তু সেই ছোট্ট আগুনের পাশে-বসা কিশোরী মেয়েটি স্মৃতিতে দুরপনেয় ছাপ রেখে গেল। সেদিন বুঝি নি অবিশ্যি।

তারপর কতবার এলাম দার্জিলিং-এ! ওই জায়গাটায় বসে চা খেলাম কতবার! মনে পড়ে নি কিছু। এবার এলাম ইশকুলের বাচ্চাদের নিয়ে। ওরা গেল চিড়িয়াখানা হয়ে মিউজিয়ামে। আমি গেলাম সেই চায়ের দোকানে। কাপ হাতে নিয়ে সেই আদ্যিকালের কাঠের বেঞ্চিতে বসতেই যেন আমার মাথায় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল সাতাশ বছর আগের স্মৃতির পাহাড়।

দু’টো তিনটে দোকান পরে একটা দোকানের সামনে জ্বলছে মৃদু আগুন। একটি পরমাসুন্দরী পাহাড়ি মেয়ে মন দিয়ে সোয়েটার বুনছে তার পাশে বসে। বয়েস তার বড়জোর পনেরো! এই মেয়েটিকে আমি চিনি। দেখেছি আগেও। দেখেছি সাতাশ বছর আগে।

‘হতেই পারে না!’- ভেবেও অবিশ্বাসী পায়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম মেয়েটির দিকে। সে মিষ্টি হেসে আমায় বসতে বলল আগুনের পাশে। আর বসতেই আমার চোখে পড়ল— সেই চায়ের দোকানে বসে সোয়েটার বুনছেন প্রায় আমারই বয়সী এক ভদ্রমহিলা; বয়েস যাঁর মুখ থেকে এখনও মুছে দিতে পারে নি অলোকসামান্য রূপ।

নিশ্চিতভাবে— এঁকেই আমি দেখেছিলাম সাতাশ বছর আগে। বাইরে বসা মেয়েটি এর কন্যা। বয়েস গিয়াছে চলি আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার…

মনে পড়ল— সেই কোন্ কালে লিখে গিয়েছেন অগ্রজ সাহিত্যিক— ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে!’

৬১

আমার স্কুলটা এমন পাড়ায় যে, একবার স্কুলে ঢুকে গেলে আর বেরোতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু অন্তত একবার— আর কেউ না-বেরোলেও— আমায় বেরোতেই হয়। চা খেতে যাই বিডন স্ট্রিটের একটা চায়ের দোকানে। যেদিনই সেই যাওয়াটা হয় সাড়ে বারোটা নাগাদ— দেখতে পাই এক ভদ্রলোককে। ধীর গতিতে সাইকেল চালিয়ে আসেন তিনি; স্পষ্টতই বয়েসের ভার তাঁকে গ্রাস করেছে। পরনে রোজই থাকে একটা আধময়লা লুঙ্গি আর ফতুয়া। সাইকেলের সামনের ক্যারিয়ারে থাকে একটা গণশক্তি আর একটা আঠার কৌটো। চায়ের দোকানের ঠিক উলটো দিকেই একটা বোর্ডে তিনি সেঁটে দেন নতুন কাগজটা— বড়ো যত্নে, বড় শ্রদ্ধায়। তারপর এক কাপ চা খেয়ে আবার ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে চলে যান মিনার্ভার দিকে। আমি চা খেতে খেতে ভাবি— এখন আর কে-ই বা পড়ে এই কাগজটা! তিনি নিশ্চই ভাবেন না; কেননা তাঁর নিষ্ঠায় আমি কখনো ভাঁটা পড়তে দেখি নি।

আজও গেছি চা খেতে। একটু দেরিই হয়েছে আজ— কাজ ছিল স্কুলে। গিয়ে অভ্যেসবশতঃ চোখ গেল বোর্ডটার দিকে। দেখি, কালকের কাগজটাই তখনো টাঙানো। কী ব্যাপার? ভাবতে ভাবতেই দেখি— আসছেন তিনি, দেরি হয়ে গেছে বলে আজ গতি কিঞ্চিত বেশি। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে লেগে পড়লেন দৈনন্দিন কাজে। লাগানো হল নতুন কাগজ। কাজ সেরে রোজকার মতোই এসে বসলেন পুরনো কাঠের বেঞ্চে, আমার ঠিক পাশটিতে। আর তক্ষুনি বেজে উঠল তাঁর ফোন। পকেট থেকে বেরলো আদ্যিকালের একটা নোকিয়া এগারশো আট। আর পাশে বসে একদিকের প্রতিক্রিয়া শুনেই আমি বুঝে গেলাম— মস্ত একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তাঁর বাড়িতে— ‘কী বলছিস!… কে বলল তোকে?… ঠিক শুনেছিস তুই?’ ইত্যাদি কথার ওই একটাই মানে হয়। কথা সেরে, ফোন পকেটে রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন তিনি— মুখে তাঁর সদ্য আত্মীয়হারা হওয়ার বেদনার গাঢ় রেখা।

পাশে বসা প্রায়-সমবয়সী ভদ্রলোক এঁর পরিচিত— দু’জনের কথাবার্তা ঠাট্টাতামাসা এর আগেও শুনেছি আমি। আজ তিনিই প্রথম শুধোলেন— ‘কী হয়েছে, রমেনদা? বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?’

গভীর বিষাদের সঙ্গে তিনি বললেন—‘না রে। ফিদেল কাস্ত্রো একটু আগে মারা গেছেন।’

সামনে এসে দাঁড়ানো অল্পবয়সী ছেলেটি এবার উৎকণ্ঠা ভেঙে হেসে উঠল হো হো করে। বলল সে হাসি-ভরা গলায়— ‘বেঁচে ছিলেন না কি! উরিব্বাস— কতদিন পর নামটাই শুনলাম! মাইরি, আপনি না…এমনভাবে কথা বলছিলেন— আমি তো ভেবেছি বাড়িতেই…পারেনও বটে…’ —বলে হাসতে হাসতে গিয়ে বসল আবার বেঞ্চে, নিজের ছেড়ে-আসা জায়গাটায়।

কোনও প্রতিবাদ করলেন না তিনি। শুধু শোকস্তব্ধ অভিমানী চোখে একবার তাকালেন ছেলেটির দিকে। তারপর মাথা নীচু করে বসে রইলেন চুপ করে। বেশ খানিক পরে অস্ফুটে বললেন —‘বাড়িতেই তো…’

আর অমনি আমার চোখে ভেসে উঠল একটা পড়ো পড়ো আদ্যিকালের ঘর। বড়মার— মানে আমার বড়োজেঠিমার ঘর সেটা। তার কুলুঙ্গিতে দু’টো ছবি। গাভাসকার আর কাস্ত্রোর। জীর্ণ জানলায় আমরা ছোটরা লিখে রাখতাম আগুন-ঝরানো স্লোগান— দেওয়াল থেকে মুখস্থ করে আনতাম সেগুলো ; যদিও মানে বুঝতাম না আদৌ। মনে পড়ল আমার জেল-খাটা বাবা, গুলি-খাওয়া ন’জ্যাঠামণি আর বিনা-দোষে ফাঁসি যেতে বসা ছোটকাকুর কথা। মনে পড়ল বাড়ির উলটোদিকের কারখানাটার দেওয়ালের অপটু হাতের লিখন— ‘শহীদ দীপু লাল সেলাম। সত্তরের দশক মুক্তির দশক।’ আমার জ্ঞান হতে হতে সে লেখা প্রায় মুছে এসেছে— তবু পড়া যায় বইকি!

কাস্ত্রো ভাল ছিলেন, না মন্দ; মুক্তিযুদ্ধের নায়ক ছিলেন, না ভয়াল একনায়ক— আমি জানি না। রাজনীতি আমি বুঝি না। তবে এটুকু বুঝি— একটা গোটা প্রজন্মকে তিনি— আর তাঁর মতো আরও কয়েকজন— স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মুক্তির স্বপ্ন। সাম্যের স্বপ্ন। সে পথে হাঁটতে গিয়ে কোথায় যে ভুল হয়ে গিয়েছিল— অত বোঝার বুদ্ধি নেই আমার। কারা সেই স্বপ্ন ভাঙিয়ে আখের গুছিয়ে নিল— তাও ভাল বুঝি না। কিন্তু আজও সে স্বপ্ন যে কয়েকজন মলিন লুঙ্গি-পরা মানুষের বুকের মধ্যে ডানা ঝাপটায়— দেখাই যাচ্ছে। পতনেও বড় কষ্ট পায় তারা, আবার মৃত্যুতেও।

সাইকেলটা টানতে টানতে আস্তে আস্তে ফিরে যাচ্ছিলেন একজন আধবুড়ো মানুষ। আর আমি ভাবছিলাম— ইতিহাস শুধু সফল স্বপ্নই মনে রাখে কেন!

৬২

রঞ্জিত মান্না আমার সহকর্মী। খাঁটি কেমিস্ট্রি-টিচার। মুখে মোটে কথা নেই, বললেও সব ‘অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর’। এ হেন সাবজেক্টের নাম যে কে বাংলায় ‘রসায়ন’ রেখেছিল— খোদায় মালুম। তা আপনারা তো জানেনই, সম্প্রতি ইস্কুল থেকে গিয়েছিলাম দার্জিলিং। ছোট্ট ট্যুর, দু’দিন পরেই নেমে আসতে হল। ফেরার পথে— পাহাড় শেষ হয়ে পথের দু’পাশে যখন শুধু দিগন্তবিথারি চা-বাগান— স্বল্পবাক ছেলেটা হঠাৎ আমায় ডেকে বলল —‘মন ভরল না। জানো রাজাদা, বাড়ির জন্য মন-কেমন না-করলে কক্ষনো ফেরা উচিত না।’ বাহ্যত নীরস ছেলেটার মুখে এমন কথা শুনে মৃদু বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। আর অমনি, সেই পাহাড়-পর্বত-চায়ের বাগান ছাপিয়ে আমার মনে পড়ল অনেককাল আগের একটা ঘটনা। আর-এক বন্ধুর কথা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন। অধিকাংশ সময়টাই কাটে কফিহাউসে। সেখানেই আলাপ হয়েছিল সুদীপ্তর সঙ্গে। মুখচোরা ছেলে, এম.কম. করছে; একদম আমার সমবয়সী। আমরা যখন হইহই করে সদ্য-লেখা কবিতা পড়তাম, নতুন গান গাইতাম টেবিল চাপড়ে— ও বসে থাকত হাসিভরা চোখে। এটুকু জানতাম— ওর বাবা-মা দু’জনেই ডাক্তার। তাঁদের ইচ্ছে ছিল ও নিজেও যেন ডাক্তার হয়। অথচ ইচ্ছে করে জয়েন্টে ফেল করে কমার্স নিয়েছিল ও —শুধু ডাক্তারি পেশাটা ওর পছন্দ নয় বলে। এই অদ্ভুত খবরটা জানার পর কেমন একটা সমীহের ভাব এসেছিল মনে।

পার্ট ওয়ান পরীক্ষার পর হঠাৎ আরও অদ্ভুত একটা খবর পেলাম সুদীপ্তর সম্পর্কে।পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেছে আন্দামান— সেটা জানতাম। কিন্তু জানা গেল, সেই বন্ধুদের সঙ্গে ও আর ফেরে নি। মানে! এই বয়সের ছেলে কখনো হারিয়ে যায় না কি! না, হারিয়ে যায় নি ও। ট্যুরের শেষ দিন সকালে এসে বন্ধুদের বলেছে— ও আর যাবে না। এখানেই থাকবে— এই আন্দামানে। ভাল লেগে গেছে ওর জায়গাটা— এই বিরহিনীর চোখের মতো সবুজাভ নীল জল, দূর থেকে দেখা অন্য কোনও রহস্যময় দ্বীপ, বাতিঘরের একচক্ষু হাতছানি আর নারকোল গাছের দুলে ওঠা মাথা। তাই ও ঠিক করেছে— ‘আপাতত’ ফিরবে না। থাকবে। বন্ধুরা বুঝিয়েছে প্রাণপণে, উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছে এই পাগলাটে প্রস্তাব। কিন্তু ও নীরবে নিজের জেদে অটল ছিল। তখন ল্যান্ডলাইন-এর জমানা। বাড়িতে ফোন করে— না, অনুমতি চায় নি— সংক্ষেপে জানিয়ে দিয়েছে ওর মনোভাব। বাবা-মা হতবাক।

খবরটা মাস-খানেকের বাসি। কাজেই নতুন কিছু জানার আশায় ছুটলাম সবাই মিলে ওর বাড়িতে। সল্টলেকের আলিশান বাড়িটা দেখে ঢোকার সাহস হচ্ছিল না। কিন্তু ওর বাবা এবং মা— দুজনেই অত্যন্ত সজ্জন মানুষ; যদিও আপাতত উদ্ভ্রান্ত। বললেন— খবর পেয়েই ওঁরা ছুটেছিলেন আন্দামানে। একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া করে আছে সুদীপ্ত; ক্যাশিয়ারের চাকরি নিয়েছে একটা কাঠগোলায়। একা থাকে, যা-পারে রেঁধে খায়— আর ঘুরে বেড়ায়। এই সৈকত থেকে ওই সৈকত, এ দ্বীপ থেকে ও দ্বীপ।বলেছে— যখন আর ভাল লাগবে না, যখন বাড়ির জন্য মন-খারাপ হবে— তখন নিজেই ফিরে আসবে। চিন্তার কিছু নেই। এ কথায় বাপ-মায়ের চিন্তা কমতে পারে না। কাজেই তাঁরা এখন মাথার চুল ছিঁড়ছেন উদ্বেগে। মামুলি কয়েকটা সান্ত্বনার বুলি আউড়ে আমরাও কেমন ভোম্বল হয়ে উঠে এলাম। মাথাতেই ঢুকল না— এই বৈভবের মধ্যে মানুষ হওয়া ছেলেটা ওইভাবে আছে কি করে!

তারপর অদর্শনে ভুলেই গেলাম ওর কথা। পড়াশুনো চাকরি-বাকরি নিয়ে নাজেহাল অবস্থা তখন। একদিন উল্টোডাঙার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি বাস ধরব বলে— হঠাৎ কাঁধে টোকা পড়ল। সুদীপ্ত। দাড়ি রেখেছে, ফর্সা রঙটা পুড়ে গেছে খুব। কিন্তু টেপা ঠোঁটে সেই পরিচিত হাসি। চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম দু’জনে। আর এই প্রথম নিজে থেকেই মুখ খুলল ও।

চার বছর ছিল ও আন্দামানে। টানা চাকরি করত, ছুটি জমিয়ে বেরিয়ে পড়ত যেদিকে খুশি। জাহাজঘাটায় গিয়ে খোঁজ নিত, পরিচিতজনের কাছেও। তারপর পিঠে ব্যাগ নিয়ে ধাঁ। একা মানুষ, ফলে পিছুটান ছিল না কোনও। খুব ঘুরে নিয়েছে ও; গেছে সেই সব দ্বীপেও— সাধারণ ট্যুরিস্টদের যেখানে যাওয়া মানা। পরিচিত বা আধা-পরিচিত কারুর বাড়িতে রাত কাটিয়ে আবার রওনা দিত পরদিন। ঘুরে-টুরে এসে আবার মন দিয়ে কাজকম্ম করত; টাকা আর ছুটি জমাতো। অফিসের সময়টুকু বাদ দিলে পোর্ট ব্লেয়ারেরই নতুন নতুন বিচে ঘুরে বেড়াত। নীল আইল্যান্ডে ছিল ছ’মাস— ওদেরই অফিসের শাখা ছিল সেখানে। ‘সীতাপুরের মতো বিচ আর নেই রে রাজা…’ —বলতে বলতে মেদুর হয়ে এল ওর চোখ —যেন গাড়ি-হাঁসফাঁস উল্টোডাঙার মোড়ে দাঁড়িয়েই ও দেখতে পাচ্ছে সোনালি সৈকতের স্বপ্ন।

‘তাই বলে চার বছর! জীবনের, প্রথম-যৌবনের চার-চারটে বছর এই ভাবে কাটিয়ে দিলি বিদেশ বিভুঁইতে!’ —স্বভাবতই শুধোলাম আমি অবাক হয়ে।

‘কোথায় বিদেশ!’ —আরও অবাক হয়ে বলল সুদীপ্ত —‘দেশই তো! আমারই দেশ। তবু…কি আশ্চর্য আলাদা! দেখতে হবে বইকি— ভাল করে দেখে নেওয়া চাই গোটা দেশটা— এত বড়ো একটা দেশে জন্মেই ফেলেছি যখন কপালজোরে!’ তারপর খানিক চুপ করে থেকে বলল— ‘তারপর যখন খুব মন-কেমন করতে লাগল মায়ের আর বাবার জন্য, আর…আর এই কলকাতার জন্য… তখন বুঝলাম— বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে। চলে এলাম।’ বলে সেই অদ্ভুত হাসিটা হাসল আবার।

ও হ্যাঁ, তাই তো! হঠাৎ— যেন এই প্রথমবার আমার মনে হল— বটেই তো! একটা মস্ত আর বিবিধতায় ভরা দেশে দৈবক্রমে জন্ম হয়েছে আমার— তুষারমণ্ডিত হিমালয় আর সীতাপুরের স্বর্ণবেলা একই দেশে বটে! বেরিয়ে পড়া চাই! দেশটা মস্ত, জীবনটা ছোট্ট। দেখতে হবে না!

স্মিত মুখে সুদীপ্ত তখন বলছিল —‘ভাবছি এবার একটু হিমালয়টা ভাল করে ঘুরে দেখব। তা বাড়িতে বললেই বাবা-মা আঁতকে উঠছে…’ —এই বলে স্বভাববিরুদ্ধ ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠল এক ঘর-পালানো ভবঘুরে ছেলে, দেশ যার বুকের একেবারে ভিতরে গিয়ে টান মেরেছে।

৬৩

সব বেড়ালের ভাগ্যেই একদিন না একদিন শিকে ছেঁড়ে। এই মাস্টারেরও প্লেনে ওঠা হল আন্দামান যাওয়ার চক্করে। আকাশ থেকে দেখা হল সুন্দরবনের রিলিফ ম্যাপ, অনন্ত সমুদ্দুরের নীল, তারপর ‘সিন্ধুর টিপ‘আন্দামান। নেমেই শুরু হল দৌড়— এই বিচ থেকে ওই বিচ ; রস আইল্যান্ড থেকে হ্যাভলক; কোরাল রিফ থেকে বাতিঘর। ছুট আর ছুট। চারদিনের দিন সন্ধ্যেয় নীল আইল্যান্ড-এ পৌঁছে তাই আমার এক্সপ্রেশন ‘বাপ রে!‘থেকে ‘আহা!’-তে পৌছে গেল মুহূর্তে।

পথের দু’পাশে ঘন আম-জাম-কাঁঠালের বন। ঘাসজমি। ধানক্ষেত। বনের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে মাটি আর খড় দিয়ে তোলা কুঁড়েঘর— যেমন ছেলে আঁকে তার খাতায়। গরু আর লাঙল নিয়ে চাষের কাজ সেরে ঘরে ফিরছে চাষী, উচ্চকণ্ঠে বাংলায় গালি দিচ্ছে সে ধানের গোলায় মুখ-দিতে-যাওয়া গরু দু’টোকে। হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে গেল কোনো এক গাঁয়ের বধূ। সন্ধ্যা হয়…আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে….

বাংলা থেকে এত দূরে আর-এক টুকরো বাংলা! শুধু, ভেসে-আসা সমুদ্রগর্জন-টুকু মনে করিয়ে দিচ্ছে— এটা বাংলা নয়!

রাস্তাতেই চা নিয়ে এল কেয়ারটেকার রাজু। আবেগের বশে বলে ফেললাম— ‘বুঝলে ভাই, পারলে থেকেই যেতাম এখানে, একটা বাড়ি করে।’

অকাতরে সে বলল— ‘কিনে ফেলুন স্যার জমি। এক কোটি কুড়ি লাখ টাকা করে বিঘে যাচ্ছে তো! বিঘের কম তো বিক্রি হয় না স্যার!’

হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। তারপর তুমুল জিজ্ঞাসাবাদ— এবং জানা গেল— এটাই এখন এখানকার রেট যাচ্ছে। হ্যাভলক আইল্যান্ডের জমি শেষ। রিসর্ট-ব্যবসায়ীদের নতুন টার্গেট এখন নীল আইল্যান্ড। জমি তাই সোনা হয়ে গেছে হঠাৎ। সেই সাতচল্লিশ সালে, উদ্বাস্তু বাঙালিদের ঠাঁই হয়েছিল এখানে। তাঁরা পেয়েছিলেন পাঁচ বিঘে করে জমি। তার মানে— এখন সেই সর্বহারা মানুষগুলো ছ’কোটি টাকার উপর বসে আছেন! ছ য় কো টি টা কা !! বলে কি !!! তাহলে সব্বাই— প্রত্যেকে— টপাটপ জমি বিক্রি করে বড়লোক হয়ে যাচ্ছে না কেন? আমার স্বাভাবিক এবং নাগরিক প্রশ্নের উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল রাজু।

পরদিন ভোরে সীতাপুর বিচ থেকে অলৌকিক সূর্যোদয় দেখে হেঁটে ফিরছি। হোটেলের ঠিক আগের বাড়িটায় একটা দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। ইংরিজি L আকারের মাটির বাড়ি একটা। নিকোনো উঠোন তকতক করছে। একটা বকফুল গাছের নিচে মাটিতে মাদুর পেতে বসে চা খাচ্ছেন এক বৃদ্ধ। চারপাশে তাঁর হামাগুড়ি দিচ্ছে রোদ্দুরের ছানা। পাশেই গোলা। পিছনে উঁকি দিচ্ছে সোনালি ধানক্ষেতের লাবণ্য। এসব ব্যাপারে আমি দ্বিধাহীন। ঢুকে পড়লাম পায়ে পায়ে। বসলাম বুড়োর সামনে, মাটিতে। আলাপ হল। নিত্যানন্দ দাস। বয়েস আশি ছাড়িয়েছে। এখনও নিজে হাতে চাষ করেন। এক ছেলে গাড়ি চালায়; অন্যজন হোটেলে কাজ করে। শুধোলাম—‘এই জমিটুকুর দাম যে ছ’কোটি টাকা— জানেন?’ এক গাল হেসে মাথা নাড়লেন—‘জানি বাবা। খুব জানি। দু’বেলা আইস্যা জানাইয়া যাইতেয়াসে লোকজন।’ তাহলে যে বড় চাষ করছেন? লোভ হয় না?

এইবার তাঁর চোখ চলে গেল সুদূরে। বললেন—‘দ্যাশে থাকতেও চাষই করতাম। আমাগো পিতৃপুরুষের কামই এইয়া— জমি-চষা। তারপর পার্টিশন হইল। এহেনে আইয়া ফের জমি পাইলাম। বুনা, বেতালা জমি। ফসল হয় না। কেরমে কেরমে হেই জমি বশে আইল। ধান হইল। আম-কাঁঠাল হইল। আইজ দ্যাহো— সোনা ফলতেয়াসে জানি।’

ভারি মায়াময় চোখে খানিক সেই জমির দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন— ‘পোলারা কয়— বেইচ্যা দাও। বড়লোক হইয়া যামু। আমি কই— দ্যাখলাম তো একবার, জমি হারাইলে লাগে ক্যামন। এক জীবনে কয়বার উদ্বাস্তু হয় মাইনষে? কও দেহি বাবা! অহন যেই কয়ডা দিন আছি, বাঁইচ্যা আছি— এহেনেই থাকুম। এই যে বকফুল গাছ— দিদি লাগাইসিল নিজে হাতে। যতদিন বাঁইচ্যা আছিল— আইতো ফুল কুড়াইতে। অহন সেই গাছ— সেই ফুল কি বেইচ্যা খামু— কও দেহি!’

স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম আমি। সব প্রশ্নের উত্তর কি আমি জানি— মূর্খ মানুষ! হ্যাঁ, আজ ঠাকুমা থাকলে ঠিক বলে উঠত সাদা ছাঁটা চুল আর সাদা থান নাড়িয়ে— ‘হক কথা কইসেন, কত্তা!’

ঠিক তখন লাল পাড় শাড়ি পরে, দোক্তার গন্ধ মাখা হাসি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন অনেকটা ঠাকুমার মতোই দেখতে এক বৃদ্ধা। হাতে তাঁর কলাই-করা ডিশ। সামনে রেখে বললেন— ‘বকফুল ভাজা খাও তো বাবা? চা দিয়া জানি অমর্ত। খাও।’

দন্তহীন মুখে একগাল হেসে নিত্যানন্দ দাস বললেন— ‘খাও বাবা। বাড়ির ফসল। নিজের জমির ফসল…’

৬৪

তখন আমাদের সবচেয়ে টলমলে সময়টা চলছে। বাবা সদ্য গতায়ু, সেই শোকে মায়ের হয়েছে হাজারো রোগ। মেডিকেল কলেজ হসপিটাল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি বহু কষ্টে। একজন সর্বক্ষণের পরিচারিকা বড় দরকার। সময়মতো খাওয়া জুটছে না— এমন অবস্থা। এদিকে যাঁর হাতে বড় হলাম, সেই ছায়াদি নিজেই ভয়ানক অসুস্থ।

এ হেন সময়ে, এক প্রতিবেশীর যোগাযোগে বাড়িতে কাজ চাইতে এলেন এক ভদ্রমহিলা। পরনে মলিন শাড়ি, হাতে একটা পুঁটুলি। নাকি আজীবনের সম্বল ওই পুঁটুলিতেই ধরে যায়। নাম বললেন আশালতা দাস। তদ্দণ্ডেই কাজে বহাল হয়ে গেলেন তিনি, সসংকোচে ঢুকে পড়লেন রান্নাঘরে।

ক্রমে বোঝা গেল, তাঁর সংকোচ সর্বক্ষেত্রেই। পুজোর বাসন তিনি মাজবেন না, মায়ের পুজো করার শাড়িটা কাচবেন না, ইস্তক শাঁখ ধুয়ে রাখবেন না তিনি। কিন্তু অন্যান্য কাজ— মানে রান্নাবান্না ইত্যাদি— এত ভাল করতেন তিনি যে, ওই অসুবিধেটুকু সয়ে গেল আমাদের।

তখন আমি সকাল থেকে রাত অবধি ট্যুশন করি, পড়িয়ে বেড়াই এ-বাড়ি ও-বাড়ি। একদিন অমনই রাত করে বাড়ি ফিরে দেখি— হুলুস্থুলু কাণ্ড চলছে বাড়িতে। ঢুকেই ডানদিকের ঘরটায় থাকতে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে; সেই ঘরে থ‘হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মা। আর তিনি আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছেন মায়ের পা ধরে। আমি ঢুকতে সেই মায়ের বয়সী মহিলা জড়িয়ে ধরলেন আমার পা; তার সাথে হাহাকার —‘আমি কি কইরে এ পাপ কল্লাম বাবা! তোমরা নাহয় জানতি পারো নি, কিন্তু আমি তো বলতি পারতাম! এখন এ পাপ থেকে আমারে কে উদ্ধার করপে বাবা!’ আর আমি মহা-উদ্বেগ নিয়ে ভাবতে লাগলাম— এ কোন পাপের কথা বলছেন ইনি!

ক্রমে শান্ত হলেন তিনি, থেমে এল কান্নার বেগ। তখন তিনি যা বললেন— তা আমি এ জীবনে ভুলব না। তাঁর আসল নাম মানোয়ারা বেগম,বাড়ি চাঁদপাড়া স্টেশন থেকে খুব ভেতরবাগে ঢোকানো এক গ্রামে। যথাকালে— অর্থাৎ পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর— কিন্তু সন্তানাদি হয় নি। বিরক্ত হয়ে স্বামী আবার একটি বিবাহ করেন; এবং এ যাত্রায় সফলকাম হন— অর্থাৎ তাঁর চারটি সন্তান হয়। তিনি থেকে যান সন্তানবতী সপত্নীর পরিচারিকার মতো। এমন সময় তাঁর মাথার রোগ ধরা পড়ে। চিকিৎসার প্রশ্নই ওঠে নি, স্বামী তাকে তালাক দেন। এই নিতান্ত অসহায় অবস্থায় তাঁর এক প্রতিবেশিনী তাঁকে বুদ্ধি দেন এই কাজ করার। শর্ত ছিল— মুসলিম পরিচয় গোপন করতে হবে— কেননা হিন্দুরাই প্রধানত পরিচারিকা নিয়োগ করেন। কাজেই তাঁর নতুন নাম হয় ‘আশালতা’। কিন্তু এই ক’দিন কাজ করার পর তাঁর মনে হয়েছে— এ কোন্ নরকে তিনি নিক্ষেপ করছেন এই ব্রাহ্মণ পরিবারটিকে! না-জেনে মুসলিমের অন্নজল গ্রহণ ক’রে এরা তো মহাপাপ করছেই— সঙ্গে করছেন তিনি নিজেও!

সারারাত তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি আর মা— এতে আমাদের কিছুই এসে যায় না। গ্রাম্য প্রৌঢ়া মানুষটি বুঝতে চাইলেন না। বোঝার অবস্থাতেও ছিলেন না অবশ্য। পরদিন সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মুছতে মুছতে ফের পথে নামলেন তিনি। অজানা ভবিতব্যের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক নিরক্ষর গ্রাম্য মহিলা— হাতে একটা মলিন পুঁটুলি, পরনে মলিন শাড়ি।

তালাকের ফলের শতকরা হিসেব তিনিও জানতেন না, আমিও জানতাম না।

৬৫

আমাদের মফস্বল শহরে নববর্ষ জমে উঠত পয়লা বৈশাখে, ডিসেম্বরের একত্রিশে নয়। এ দোকান ও দোকান ঘুরে একটা ক’রে মিষ্টির প্যাকেট আর খানকতক বাংলা ক্যালেন্ডার যোগাড় হত সেদিন। একটু বড় হতে পাড়াতে ছোট্ট প্যান্ডেল খাটিয়ে ফিস্ট হত বটে ; কিন্তু তাতে কোনও ‘নিষিদ্ধ রস‘ছিল না।

সত্যিকারের থার্টিফার্স্ট নাইট আমি প্রথম দেখলাম গোয়াতে। সেটা বছর পাঁচেক আগের কথা। ওরেব্বাস, সে কী প্রস্তুতি! আমরা উঠেছিলাম একটা সমুদ্দুর-পাড়ের হোটেলে, তার সীমানা পেরোলেই হলুদ সৈকত, তারপর ফিরোজা-রঙা আরব সাগরের জল। জাগতিক চাহিদার এমন কোনও দিক নেই— যা এর পাঁচশো গজের মধ্যে পাওয়া যায় না —তা সে পিজা হোক, মদ্যপানের আখড়া হোক, বা হোক দু’হাজার টাকা দামের কাঁকড়া কিংবা ‘গোয়া‘লেখা টিশার্ট। আশপাশের অতুলনীয় সাগর-সৈকতগুলো দেখতে দেখতে কেটে গেল চারটে স্বপ্নবৎ দিন। এসে গেল সেই বিখ্যাত ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’।

সকালেই এসে হোটেলের লোকেরা বলে গেল জল স্টক ক’রে রাখতে— নাকি ওই একটি বস্তু পরে পাওয়া মুশকিল হবে। মদ অবিশ্যি মিলবে। বোঝো কথা! যাক, রাত্তির হল, সন্ধ্যেটা কেটে গেল দলবদ্ধ আড্ডা আর পান-ভোজনে। ক্রমে সাড়ে এগারোটা বাজল। ঘর ছেড়ে বিচ-এ এলাম আমরা। যতদূর দেখা যায়— শুধু মানুষ আর মানুষ। উৎসুক করমর্দন আর শুভেচ্ছা— চেনা অচেনা নির্বিশেষে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সব্বাই। চলছে নাচ, গান। যেমনি বারোটা বাজল— কলরব আকাশ ছুঁল, আর হাজার হাজার আতশবাজিও মাথা তুলল আকাশপানে। উফ্, অত্ত বাজি আমি জীবনেও একসঙ্গে দেখি নি।রাতের আকাশ ভরে গেল আলোর ঝলকানিতে। আমার গিন্নি, ছেলে, অন্য বন্ধুরা— সব্বাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন সেইদিকে। আমিও।

সমস্যা হল— এই একটি বস্তু আমায় কাৎ ক’রে ফেলে— এই বাজির ধোঁয়া। দমবন্ধ হয়ে গেল একটু পরেই। ফলে, আমাকে পায়ে পায়ে সরে পড়তে হল সেই উৎসব ছেড়ে। হেঁটে এসে বিচ পার হেয় উঠে পড়লাম রাস্তায়, তারপর এগিয়ে চললাম সুনসান পথ ধ’রে। অনেকক্ষণ জনারণ্যে থাকার পর এই একক হেঁটে চলার একটা অদ্ভুত নেশা আছে। সেই নেশার ঘোর অমন ক’রে টের পাই নি কখনও।

একটু হাঁটতেই পথের পাশে পড়ল একটা চার্চ— যেমন আশ্চর্য স্থাপত্য ছড়িয়ে আছে গোয়ার সর্বত্র। তার থমথমে সৌন্দর্যের সামনে এসে আপনিই চলার গতি কমে এল আমার। আজ অবিশ্যি গির্জার চত্বর জনশূন্য; আজকের রাত্তিরটা মানুষের— ঈশ্বরের নয়।

না, সম্পূর্ণ জনশূন্য নয়— কেননা সেই মধ্যরাত্রে গির্জা থেকে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। ভদ্রলোকের পরনে নিখুঁত স্যুট, কিন্তু ভদ্রমহিলা পরে আছেন শাড়ি— যদিও অন্যরকমভাবে। গেটের বাইরে এসে তাঁরা অস্ফুট প্রার্থনার শেষে বেশ জোরেই বললেন—‘আমেন!’ এবং আবাল্যের অভ্যাসবশত আমিও।

এইবার তাঁরা দেখলেন আমাকে, এবং বৃদ্ধ চোস্ত ইংরিজিতে যা বললেন— তার নিকটতম অনুবাদটি অতিশয় প্রাচীন— ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’

ঝট করে আলাপ হয়ে গেল এবার। কাছেই এঁদের বাড়ি, কত্তাগিন্নিতে থাকেন।পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একটু পরেই আমি বেহায়ার মতো জিজ্ঞেস করলাম— ‘কি চাইলেন আজ বর্ষশেষের প্রার্থনায়?’

ভদ্রমহিলা অতিশয় নীরব স্বভাব। ভদ্রলোক উত্তর দিলেন নৈর্ব্যক্তিক কণ্ঠে— ‘চাইলাম, যেন আমার আগে ওঁর মৃত্যু হয়— নইলে ওঁকে দেখার কেউ থাকবে না।’ তারপর স্ত্রীর ধমক উপেক্ষা করে বলে চললেন— ‘আর চাইলাম— আমাদের ছেলেটি যেন ভাল থাকে। গত সাত বছর ধরে সে নিউইয়ার সেলিব্রেট করে সিডনিতে— বলে— আসার জন্য ছুটি পায় না।’ —বললেন এমন ক’রে, যেন এতে তাঁর কিচ্ছুই আসে-যায় না। শুধু গলাটা তাঁর ধরে এল সামান্য।

পাছে আমি টের পাই, তাই দ্রুত গলা সাফ করে নিয়ে তিনি বললেন— ‘আমার বাড়ি কাছেই ইয়ংম্যান। লেটস হ্যাভ আ ড্রিংক টুগেদার। টুগেদার…আফটার আ লং টাইম….’

আমাকে মৃদু গলায় বলতেই হল— এ যাত্রায় সেটা অসম্ভব— গিন্নি এতক্ষণে চিন্তায় সারা হচ্ছেন। তারপর বললাম— ‘আর কিচ্ছু চাওয়ার কথা মনে এল না আপনার?’

একগাল হেসে বৃদ্ধ বললেন— ‘ইয়েস, অফকোর্স! আই প্রেইড ফর মাই কান্ট্রি! দ্য গ্রেট কান্ট্রি— ইন্ডিয়া— যাকে আমার ছেলে নিউইয়ার কাটাবার যোগ্য ব’লে মনে করে না… আর যাকে নিয়ে আমার অহংকারের শেষ নেই। মে গড ব্লেস মাই কান্ট্রি… অ্যান্ড অল হার চিল্ড্রেন…’

আমি বুঝতে পারছিলাম— সব পথভোলা ভারতীয় শিশুর মধ্যে একটি মুখ যেন জ্বলজ্বল করছে বৃদ্ধের নিষ্প্রভ চোখে। তাই তো হওয়ার কথা। সাত সাতটা বছর, সাত সাতটা নববর্ষ….

কোনোমতে গুডনাইট আর ‘হ্যাপি নিউইয়ার’ জানিয়ে দ্রুত পায়ে আমি ফিরে চললাম সাগর-সৈকতের জনারণ্যের দিকে। সেখানে আমার আট বছরের ছেলে নির্ঘাত মায়ের হাত আঁকড়ে আকুল হয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে— বাবাকে অনেকক্ষণ দেখতে পায় নি সে….

৬৬

আমাদের ইশকুলটা উত্তর কলকাতায়। তাই প্রতি বছর বাইশে শ্রাবণ আমরা শিক্ষকেরা ছাত্রদের নিয়ে যাই নিমতলায়; রবীন্দ্রনাথের সমাধিতে দেওয়া হয় সাদা ফুলের মালা, কোনও একজন মাস্টারমশাই বলেন রবি ঠাকুরকে নিয়ে দু’এক কথা। ফাঁকা থাকলে মৃদু কণ্ঠে একটা গান শোনাই প্রাণের মানুষটিকে। তারপর আবার হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসি ইশকুলে।

সেবার স্কুলেরই কী-একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। যাওয়া হল না। অন্য মাস্টারমশাইরা ছেলেদের নিয়ে চলে গেলেন। কাজ ফুরিয়ে যাওয়ার পর কিন্তু বেজায় মন-কেমন করতে লাগল আমার ; অনেক বছরের অভ্যেস, না আর-কিছু— তা জানি না। খানিক ইতস্তত করে একাই রওনা দিলাম— ওরা যাবে হেঁটে, আমি নাহয় অটোতে গিয়ে ওদের ধরে ফেলব।

বিডন স্ট্রীটের মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি; শুনি— কে যেন ডাকছে— ‘ও স্যার! ও রাজাবাবু-স্যার!’ ইতিউতি চেয়ে দেখি— দাঁড়িয়ে থাকা একটা অটো থেকে চালক হাঁক পাড়ছেন। বয়স্ক মানুষ, চোখে পুরু চশমা, গালে কাঁচাপাকা দাড়ি। পাড়ার ইশকুলের মাস্টারমশাই— চেনেন হয়তো— এই ভেবে কাছে যেতে তিনি বললেন— ‘রবীন্দ্রনাথের ইয়েতে যাবেন তো? চলুন, দিয়ে আসি আপনাকে।’ তা ভাল। চড়ে বসলাম। একাকী যাত্রী হয়েই। তিনি বললেন—‘কুমারজিতের বাবা আমি, বুঝলেন স্যার। আপনার স্কুলেরই গার্জিয়ান। আপনি বোধহয় চিনতে পারেন নি…।’

একটু এগোতেই জ্যাম— নিত্যি যেমন থাকে। অভ্যস্ত হাতে তিনি গান চালিয়ে দিলেন। এই ‘অটোর গান‘আমার চিরন্তন ভয়ের বিষয়— এক্ষুনি গুমগুম করে বেজে উঠবে হিন্দি ফিল্মের গান, বুক ধড়ফড়িয়ে উঠবে আমার— ভেবে শঙ্কিত মুখে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি। আর অমনি, আমায় একেবারে স্তম্ভিত ক’রে দিয়ে বেজে উঠল বড়ে গুলাম আলি সাহাবের ঐশ্বরিক গলায় সেই গান— ‘ইয়াদ পিয়া কে আয়ে, ইয়ে দুখ সহা না যায়ে… হায় রাম…’

চারপাশের লোহালক্কর আর সস্তার জামা-কাপড়ের দোকান ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আমার চোখে ভেসে উঠল মস্ত গোঁফওয়ালা সেই লোকটার মূর্তি, আর এক অমৃতলোকের ইশারা। গান শেষ হতে ধরা গলায় শুধোলাম— ‘আপনি এই গান কোথায় পেলেন!’

প্রসন্ন গলায় তিনি বললেন— ‘কী যে বলেন, স্যার। এই গান শুনেই তো বড় হলাম। উস্তাদজি নিজে এসেছেন আমাদের বাড়িতে। বাবা উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের হাত-ধোয়া জল খেয়েছেন। গাইতে এসেছিলেন। জল চাইলেন— হাত ধোবেন। বাবা সেই জল… পাঁচ মিনিট সময় হবে স্যার?’ আমার সম্মতির অপেক্ষা না-ক’রেই তিনি আমাকে নিয়ে চললেন এক ছোট্ট গলির মধ্যে দিয়ে। একটু পরেই সামনে পথ আগলে দাঁড়াল এক প্রকাণ্ড অট্টালিকা; সেটা যে দাঁড়িয়ে আছে আজও— এই আশ্চর্য। অটোর হ্যান্ডেলে হাত রেখেই তিনি বললেন—‘আমাদের বাড়ি, স্যার। ওইটা রংমহল। কত ওস্তাদ যে গান গেয়ে গেছেন এই ঘরটায়… ফৈয়াজ খাঁ সাহাব, বড়ে গুলাম আলি সাহাব, মল্লিকার্জুন মনসুর… জানেন, ভাস্কর বুয়ার আসার কথা ছিল…আসতে পারেন নি… শরীর খারাপ হল… বাবা বলেছিল… আপনি খেয়াল করেছেন স্যার, ফৈয়াজ খাঁ আর আব্দুল করিম খাঁ— দুজনেই ভৈরবীতে শুদ্ধ ধৈবত লাগিয়েছেন… মনে করুন… ‘‘যমুনা কে তীর’’, আর ‘‘বাজুবন্দ খুলু খুলু’’… আবার বড়ে গুলাম… ‘‘কা করুঁ সজনী’’… কিন্তু অন্দাজই আলাদা.. খেয়াল করেছেন? হবে না? ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছিল ওঁদের উপর…’

প’ড়ো প’ড়ো ইটের পাঁজার মতো এক জরাজীর্ণ অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে প্রলাপ বকছিলেন এক অটোচালক প্রৌঢ়। আর আমি ভাবছিলাম সম্পূর্ণ অন্য একটা কথা। এই মাটিতেই একদিন এক মুসলিম গায়ক রামের কাছে কী নালিশটাই না করে গেছেন— তাঁর কেবলই পিয়ার কথাই মনে পড়ে… সে দুঃখ সহ্য হয় না গো… ‘ইয়ে দুখ সহা না যায়ে, হায় রাম’… সলিল চৌধুরী আগে নিয়েছিলেন আল্লার নাম— ‘হে আল্লা হে রামা’… আর গেয়েছিলেন আর দুই ব্রাহ্মণ-সন্তান— হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর লতা মঙ্গেশকর!

রামধনু আর রংধনু— এই ছোট্ট জিনিসটা যে কত মানুষকে হিন্দু আর মুসলমান বানিয়ে দিল…

ও দেশ, ও আমার দেশ! আর কবে বড় হব আমরা— যাতে সবাই… সব্বাই আমাদের ‘উস্তাদজি’ বলে ডাকে….!

৬৭

আমার মামাবাড়ির পরিবারটিও আমাদের নিজেদের পরিবারের মতোই মস্ত। তো এঁদেরই একটি শাখা বাস করতেন রাজপুর নামে একটি গ্রামে; সে গ্রাম বনগাঁ লাইনের একটা স্টেশন থেকে প্রায় আধা ঘন্টার ভ্যান-রিক্সার দূরত্বে। কাছেই বাংলাদেশ বর্ডার। হামেশাই সেখানে ছুটতাম আমি বাবাকে রাজি করিয়ে। বাবার স্বার্থ ছিল মাছ-ধরা আর শালাদের সঙ্গে অনন্ত আড্ডা; আর আমার স্বার্থ— সোনাদিদার হাতে তৈরি খাবার— বিশেষত নাড়ু। সোনাদিদা মায়ের অতি দূর সম্পর্কের মায়িমা হন— এটুকুই জানতাম। আহা… সে স্বাদ মনে পড়লে আজও এই আধবুড়ো বয়েসে জিভ আর চোখ— দু’টোই জলে ভ’রে যায় গো…!

এই পুরনো গ্রাম্য শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবারটির সক্কলে ছিলেন ধবধবে ফর্সা। ব্যতিক্রম সোনাদিদা। বেশ কালো ছিলেন তিনি, চুল সমস্ত পাকা, দন্তহীন মুখে সবসময় হাসি লেগেই আছে। বাড়ির একপাল ছেলেমেয়ে তাঁর মস্ত এজমালি বিছানাটায় ঘুমোতো, তাদের খাওয়া-পরার তাবৎ দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর; যদিও নিজে ছিলেন নিঃসন্তান। আমিও, কিছুটা তাঁর অমৃতময় রান্নার টানে, আর কিছুটা অহৈতুকি স্নেহের টানে— ও বাড়িতে গেলেই তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরতাম। বেশ বড় বয়েসেও সে অভ্যেস যায় নি। এই পরিবারের বড়দি— আমি ডাকতাম মিষ্টিদিদি ব’লে— একদিন আমবাগানে ব’সে ঝিনুক দিয়ে কাঁচা আমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আমাকে কথাচ্ছলে বলল—‘সোনাদাদুর অকারণ অবুঝপনাই দিদার জীবনটা নষ্ট ক’রে দিল, জানিস?’

আমি সত্যিই হাঁ হয়ে গেলাম। নষ্ট! হাসি-ভরা মুখটা তো কোনদিন ম্লান হতেও দেখি নি! আমার মুখের ভাব থেকে অব্যক্ত প্রশ্নটা প’ড়ে ফেলে মিষ্টিদিদি যা বলল— তার প্রত্যেকটা শব্দ আমার কানে গরম তরল লোহার মতো ঢুকে গেল।

ষাট বছর আগে, মানে ন‘বছর বয়েসে সোনাদিদার বিয়ে হয়েছিল দাদুর সঙ্গে। দাদুর অঙ্গবর্ণ ছিল সত্যিই কাঁচা সোনার মতো— তাই ওই নাম। পাত্রীপক্ষ একটি গৌরবর্ণা ফুটফুটে বালিকাকে দেখিয়ে, বিয়ে দেয় এই সোনাদিদার সাথে। বিয়ের পরদিনই সেই মিথ্যাচার ধরা পড়ে। স্বাভাবিক। অত্যন্ত ভদ্র এই পরিবারটি এ নিয়ে একটি কথাও বলে নি। শুধু বৌভাতের দিন তারা গোটা বাড়ি নিষ্প্রদীপ রেখে দেয়। সোনাদাদু সব শুনেছিলেন। তিনিও নীরব রইলেন। ক্রমে বোঝা গেল— কালো মেয়েটি ভারি ভাল। বিশাল সংসারের দায় সে সেই নিতান্ত বালিকা বয়সেই নিজের কাঁধে তুলে নিল। তার বাপের বাড়ি থেকে আর কখনও কেউ তার খোঁজ নেয় নি। কিন্তু স্বভাবগুণে শ্বশুরবাড়িতে তিনি ক্রমে হয়ে উঠলেন সবচেয়ে লক্ষ্মী বউমা; শ্বাশুড়ি আর ননদদের চোখের মণি। শ্বশুরমশাই তাঁর হাতের রান্না ছাড়া খেতে পারতেন না, শ্বাশুড়ির পানের বাটায় একমাত্র তিনিই হাত দিতে পারতেন।

শুধু তাঁর স্বামীর নিষ্কম্প নীরবতা আর কখনো ভাঙল না। জীবনে কখনো তিনি কথা বললেন না স্ত্রীর সঙ্গে। বারবাড়িতে খেতেন, ঘুমোতেনও সেখানেই। আজীবন মুখদর্শন করলেন না স্ত্রীর। ঠকে যাওয়ার তীব্র অভিমান চিরদিন অটল হয়ে রইল তাঁর বুকে। সোনাদিদার যখন বাহান্ন বছর বয়েস, তখন তাঁর মৃত্যু হল। সদ্যবিধবা সোনাদিদাকে সবাই নিয়ে এল তাঁর মৃতদেহের কাছে, স্বামীর ধবধবে ফর্সা পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন তিনি, তাঁর কালোকোলো হাতে। এই প্রথম এবং শেষবার স্বামীর শীতল দেহ স্পর্শ করলেন তিনি।

কৈশোরের উত্তেজনায় ছুটে গিয়ে সোনাদিদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— ‘তুমি কখনও কিছু বললে না কেন দিদা? তোমার তো কোনও দোষ ছিল না!’

ফোকলা মুখে ম্লান হেসে তিনি বললেন— ‘ছিল না! কী যে বলো দাদা! আমি তো জানতাম সব! বলি নি তো কিছু! অবশ্য তখন…সেকালে…কে-ই বা শুনত…তাও…বলি নি যে— সেটা তো ঠিক— না? পাপ তো আমারও…’

এই লেখা প’ড়ে যাঁরা ভাবছেন— ‘এ সব আর একালে হয় না’— তাঁরা বোধহয় ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’র বার্ষিক টার্ন-ওভারটা জানেন না।

মহাভারতের মহানায়িকা দ্রৌপদীর আসল নাম যে কৃষ্ণা— তা আমরা আজ ভুলে গেছি। ভোলে নি শুধু রাত জেগে মুখে ক্রিম-মাখা আইবুড়ি মেয়েটা। হে মোর দুর্ভাগা দেশ! মনে রেখো— অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!

৬৮

শুনতে পাই— ছেঁড়া জুতো সেলাই-করে পরা নাকি ভারি লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা আমার এমনিই লজ্জাঘেন্না কম; তায় স্মার্ট হওয়ার বাসনাও নেই, সাধ্যিও নেই। কাজেই গত পরশু স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেই না বুঝলাম চটিটা জবাব দিয়েছে— প্রথমেই মনে পড়ল— মুচি! এখন আমি এটাকে সারাই কোথায়! তারপর মনে পড়ল— মেট্রো স্টেশন থেকে ইশকুলে যাওয়ার হাঁটাপথটুকুর মধ্যে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ফুটপাথে বসেন বটে! আগে প্রত্যেকদিনই বসতেন; ইদানিং সামান্য অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন— বোধহয় বয়েসের কারণে। ওই অবধি ঘষটে ঘষটে চলে যাই— কী আর করা!

অকুস্থলে পৌঁছে দেখি— বসেছেন তিনি; দোকান খোলা। গামছা আর গেঞ্জি পরা মানুষটি বসে আছেন বাঁধানো ফুটপাথে, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি আর চামড়ার হরেক আকারের টুকরো। গিয়ে দেখালাম। খুঁটিয়ে দেখে জানালেন— এক্ষুনি হয়ে যাবে, লাগবে দশ টাকা। একটা অন্য জুতো এগিয়ে দিয়ে বললেন দাঁড়াতে।

দাঁড়িয়ে আছি একপাশে; সামনের রাজপথ দিয়ে ছুটে চলেছে অফিসযাত্রী গাড়ির স্রোত— উদাস নয়নে একবার সেদিকে আর একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। হেনকালে একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল ওই দোকানের সামনে। রূপ বটে! বয়েস বোধহয় কুড়ির কোঠায় পৌঁছয়নি এখনো, ধবধবে রঙ আর কাটাকাটা মুখচোখ থেকে ঠিকরে আসছে রূপের দ্যুতি। এই বয়েসেও হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমি অবাক হয়ে। এক মুহূর্তের জন্য মেয়েটি তাকাল আমার দিকে, পরিচিত রূপমুগ্ধ দৃষ্টি দেখতে পেয়ে বিরক্ত চোখ সরিয়ে নিল তৎক্ষণাৎ। তারপর বৃদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের প্যাকেট থেকে বের করল একজোড়া দামি মেয়েলি জুতো। ঝুঁকে পড়ে বলল— ‘এই যে— এদিকে তাকাও। এই জায়গাটার পেস্টিং খুলে গেছে। এক্ষুনি ঠিক করে রাখবে। কলেজ যাব কিন্তু।’

আমার মোহদীপ দপ করে নিভে গেল। বয়স-নির্বিশেষে তুলনায় হীনবৃত্তির মানুষকে ‘তুমি‘বা ‘তুই‘বলাটা আমার সহ্য হয় না। ট্রেনে-বাসে পথেঘাটে অসংখ্য ঝগড়া করেছি এ নিয়ে। অজান্তেই ভুরু কুঁচকে গেল আমার।

বৃদ্ধ কিন্তু আদৌ পাত্তা দিলেন না মেয়েটিকে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমার জুতোটা সেলাই করতে করতে একবার চাইলেন আড়চোখে নামিয়ে-রাখা জুতোজোড়ার দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন— ‘তিস রুপয়ে লাগেগা।‘

মেয়েটি কঠিন গলায় বলল— ‘দশ টাকা দেব। এক পয়সাও বেশি না। পনের মিনিটের মধ্যে করে রাখবে। এসে যেন আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। লেট খেলে ভাল হবে না কিন্তু!’ —এই বলে, রূপের একটা হিল্লোল তুলে সে পাশের গলিটায় ঢুকে গেল গটগট করে।

ততক্ষণে আমার বিরক্তি সপ্তমে চড়ে গেছে। বোধহয় কিছু একটা বলে বসতাম— হঠাৎ বৃদ্ধের দিকে চোখ পড়তে আমার কেমন সন্দেহ হল। বুড়োর মুখে টেপা হাসির আভা, বোধহয় মুখ লুকিয়ে হাসি গোপন করছেন। সহসা কেমন একটা অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করলাম। পাড়াটা ভাল না; কার সাথে কার কেমনতর সম্পর্ক— তা বোঝা ভারি মুশকিল। থাক গে, আমি বহিরাগত শিক্ষক; সবক্ষেত্রে কথা না-ই বা বললাম। কিন্তু মাস্টারের মরণ— বিরক্তি ঠিক উপচে এল। কড়া গলায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলেই বসলাম— ‘ওইটুকু মেয়ে আপনাকে এমন বিচ্ছিরি করে ধমকে গেল— কিছু বলতে পারেন না?’

বেজায় চমকে গিয়ে তিনি বললেন— ‘লেড়কি! কওনসি? কব?’

যাচ্চলে! দিনেমানে গাঁজা খেয়েছেন নাকি ভদ্রলোক! মেয়েটি গিয়েছে বোধহয় এক মিনিটও হয়নি— ‘কোন্ মেয়ে!’

এবার সত্যিই রাগ হল। বললাম— ‘আপনারা লাই দেন বলেই এদের এমনভাবে কথা বলার সাহস হয়। যত্ত অসভ্যতা! ছিঃ!’

এইবার আধপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ঢাকা মুখটায় ফুটে উঠল বিপুল বিস্ময়— ‘আপ ক্যা উও হামরি মুন্নিকে বারেমেঁ… আরে সাহাব— বেটি হ্যায় মেরি!’

অ্যাঁ! বলেন কী ইনি! খাঁটি বাঙালি মেয়েটি এই বৃদ্ধ বিহারি মুচির মেয়ে হতে পারে নাকি! কী আশ্চর্য দাবি!

আমার মুখেচোখে ফুটে ওঠা তীব্র বিস্ময়ের রেখা পড়তে পেরে তিনি বললেন— ‘তিন সাল কি থি— যব উসকি মা চল্ বসি। এই পাশের বাড়িটাতেই থাকে ওরা। সৌতেলি মা-টি সুবিধের ছিলেন না; অনাদরে বেড়ে-ওঠা শিশুটি বাবা বেরিয়ে গেলে ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়ে থাকত নোংরা ফ্রক পরে। আমি ভয়ে থাকতাম— কবে রাস্তায় নেমে যাবে, আর গাড়ি এসে…তাই ডেকে এনে বসিয়ে রাখতাম আমার পাশে। ওই দোকান থেকে কেক কিনে দিতাম, খেত বসে বসে। খিদে থাকবে না ওইটুকু বাচ্চা মেয়ের! সেই থেকেই আমার কাছে…ওর বাবাও নিশ্চিন্ত থাকত— জানত— আমি আছি। এখন তো বড়ই হয়ে গেছে। কালেজ-মে পড়তি হ্যায়, পাতা হ্যায়?‘ বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর ভাঙাচোরা মুখ, অসীম গর্বে মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে বসলেন তিনি।

খানিক সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে, ফের আলগোছে আমার চটির সেলাইটা শেষ করলেন বৃদ্ধ মুচি। এগিয়ে দিলেন আমার পায়ের সামনে। তারপর মৃদু গলায় বললেন—‘বেটি হ্যায়, সাহাব! বুঢ়ে বাপ-সে এয়সাহি করতি হ্যায় উও। বচপন্-সে হি।’

মাথা নীচু করে চটি পায়ে গলিয়ে, টাকা মিটিয়ে হাঁটা দিলাম আমি। মাথা উঁচু করে মেয়ের ছেঁড়া চটি হাতে টেনে নিলেন এক গর্বিত পিতা।

বলছিলাম না— এ দেশে কে যে কার কী হয়…

৬৯

রাজা সিংহের সাথে আমার পরিচয় হয় অভীকের মাধ্যমে। ওর পাঁচটা লেখা শেয়ার করেছিল অভীক; ভয়ংকর শক্তিশালী লেখাগুলো শক্তিশেলের মতো গেঁথে গিয়েছিল মগজে। ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে, আর দুর্দান্ত গদ্য লেখে— এটা জেনে অবশ্য খুব একটা অবাক হইনি; ততদিনে জানা হয়ে গেছে— নিউইয়র্ক বা লন্ডনে থেকেও সাঙ্ঘাতিক বাংলা লেখা যায়।

বইমেলায় একটুখানি আলাপ বাদ দিলে ঠিকঠাক এই মানুষটিকে চিনলাম এক আড্ডায়। ঠিক তার আগেই মস্ত চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সে তখন শুরু করেছে এক বিচিত্র কাজ। অনুপ্রাণিত করে বেড়াচ্ছে হাজারো মানুষকে— শুধু কথা ব’লে। আমি শিক্ষক মানুষ; এমন কাজ যে পেশা হতে পারে— তাই-ই বুঝি না! আমার বিস্ময় দেখে মৃদু হেসে রাজা বলল—‘তোমায় একটা ঘটনা বলি, শোনো। নিয্যস সত্যি এমন সব ঘটনাই তো আমার অনুপ্রেরণা!’ কথা বলাই যার পেশা— সে যখন যেচে গল্প শোনাতে চায়— তখন একটু এগিয়ে বসা ছাড়া আর কীই বা করার থাকে আমার মতো চিরকালের শ্রোতার! শুনতে লাগলাম এক ব্যস্ত লেখকের নিজের মুখে বলা গল্প; এই ভারতবর্ষের মধ্যে লুকিয়ে-থাকা আর এক দেশের গল্প। এই রইল সেই আশ্চর্য কথকতা, তার নিজেরই জবানিতে :

আমাদের বাড়িতে যে ভদ্রমহিলা কাজ করত— মনে কর, তার নাম নাফিসা। অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের মুসলিম গৃহিনী; দুটি শিশুসন্তানের মা নাফিসা আমাদের বাড়িতে আসত বুরখা পরে, বুরখা ছেড়ে কাজকম্ম সেরে ফের সেটা চাপিয়ে ছুট লাগাত। স্বামী হঠাৎ তালাক দিয়েছেন— ফলে এতদিন যেটুকু যা চলে যাচ্ছিল— এখন একেবারে অকূল পাথারে পড়েছে। একদিন সে আমার গিন্নির কাছে সরাসরি সাহায্য প্রার্থনা করল : স্যারের তো অনেক জানাশোনা আছে, যদি একটা কাজ জুটিয়ে দেন কোনো গার্মেন্টস-এর ফ্যাক্টরিতে— সংসারে একটু সুসার হয়। গিন্নি এসে আমায় ধরলেন— ‘মেয়েটি বড় কষ্টে আছে— দ্যাখ না— যদি কিছু…’

আদেশ শিরোধার্য করে তিনদিন খুব খানিক খোঁজাখুঁজি করা গেল। আমার কাজ একেবারেই আলাদা গোত্রের; এই লাইনে কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তৃতীয় দিন গিন্নিকে ডেকে বললাম— মেয়েটিকে যেন আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমি জানতাম— আমি ঠিক কী বলতে চলেছি তাকে।

এল মেয়েটি। সংকুচিত অথচ আশান্বিত মুখে চেয়ে রইল মাটির দিকে। বললাম— ‘তুমি যেখানে থাকো, সেখানকার মেয়েবউরা কী করে?’

অমনি করে মেঝেতে চোখ রেখেই পরিষ্কার গলায় বলল— ‘অনেক কিছুই করে, স্যার। বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে, লেবারের কাজ করে…’

‘আর ছেলেরা?‘ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

—‘ছেলেরা কেউ অটো চালায়, রাজমিস্ত্রি… ফ্যাক্টরিতে কাজ করে কেউ কেউ…‘ বলতে বলতে জিজ্ঞাসু হয়ে উঠল ওর চোখ

—‘বেশ!’ —এই বলে পকেট থেকে চার হাজার টাকা বের করে দিলাম ওর হাতে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল এবার। বললাম— ‘তুমি যেমন চাইছিলে— তেমন কিছু পেলাম না। একটা অন্য কাজ কর। এই টাকাটা নিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু কর। মেয়েদের জন্য আন্ডার-গারমেন্টের ব্যবসা। মুসলিম মেয়েদের মধ্যে অনেকেই দোকানে গিয়ে কোনো পুরুষের— এমনকি মেয়ের হাত থেকেও এটা কিনতে অস্বস্তি বোধ করেন। তুমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দাও এগুলো, এগিয়ে দাও হাতের কাছে। দেখবে— সে তোমাকে পরে নিজেই খুঁজে নেবে।’

বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে আমার কথাগুলো যেন শুষে নিচ্ছিল মেয়েটা। তারপর হঠাৎ কিচ্ছু না-বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। শুধু যাওয়ার সময় আমার গিন্নিকে বলে গেল— কাল থেকে সে আর কাজে আসবে না; স্যার তাকে অন্য এক কাজে পাঠাচ্ছেন। গিন্নি আমার উপর বেজায় খাপ্পা হলেন অবিশ্যি, ফের তাঁকে সাহায্যকারিণী খুঁজতে হবে।

ঠিক দু’মাস পরে একদিন বাড়ি ফিরে দেখি— গেটের পাশে দাঁড় করানো আছে একটা পুরনো স্কুটি, আর সিঁড়িতে বসে আছে নাফিসা, পাশে মস্ত এক ব্যাগ। আমাকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল ; উজ্জ্বল মুখে বলল—‘দু’ঘন্টা এইখানে বসে আছি, স্যার। ম্যাডাম বললেন— আপনার ফিরতে দেরি হবে, যেন পরে আসি। আমি বলে দিলাম— এসেছি যখন, দেখা করেই যাব।’

ওর আলোময় মুখ দেখে ভাল লাগল। বললাম—‘বাইরে বসে আছ কেন? ভিতরে বসবে চলো!’

খেয়াল করলাম— ওর সেই জড়তা আর নেই। হেসে বলল—‘না স্যার, এখুনি ফের ছুটতে হবে। দেখছেন না— সেকেন্ড হ্যান্ড স্কুটি কিনতে হয়েছে একটা!’

এইবার বিস্ময়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। নাফিসা গড়গড়িয়ে বলে গেল এই দু’মাসের বৃত্তান্ত। আমার ধারণা ভুল ছিল না। বাইরে কাজ করতে হলে মেয়েদের অন্তর্বাস লাগবে বইকি! বাড়িতে বসে একটা মেয়ের কাছ থেকে সেটা কেনার সুযোগ পাওয়ায় ওর এলাকার মেয়েরা খুশি হয়েছিল খুব। ব্যবসা বাড়ছিল হু হু করে। কিন্তু খুব দ্রুত ও বুঝতে পারল— যে ক্রেতা একবার ওর কাছ থেকে অন্তর্বাস কিনছে— সে আর ছ’মাসের মধ্যে কিচ্ছুটি কিনবে না! তাহলে? নিত্য নতুন ক্রেতা ও পাবে কোথায়? কিন্তু এই সমস্যার সমাধান ও করেছে নিজেই। পাশে রাখা মস্ত ব্যাগটা খুলে ও দেখাল— তাতে থরেথরে সাজান আছে লিপস্টিক, স্যানিটারি ন্যাপকিন আর গর্ভনিরোধক! বলল নিজেই—‘এগুলো কিন্তু স্যার নিত্যি নিত্যি লাগে। এদিকে মরদেরা তো যাবে না কিনতে। মেয়েরা বাড়িতেই পেয়ে যাচ্ছে, দিব্যি কিনে নিচ্ছে। একজন ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছে আর একজনের! বলে দিচ্ছে আমার কথা! ব্যবসা বাড়ছে, স্যার। দিব্যি বাড়ছে।’

এই বলে, সেই ব্যাগেরই এক কোণ থেকে সে বের করল এক প্যাকেট মিষ্টি। আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল—‘এটা আপনারা খাবেন, স্যার। আর…এই টাকাটা…আপনিই দিয়েছিলেন হাতে করে…তাই আপনারই হাতে তুলে দেব বলে এতক্ষণ বসে ছিলাম।‘

মাথা নত করে নমস্কার করল নাফিসা। তারপর ভারি ব্যাগটা অক্লেশে কাঁধে তুলে নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল। চলে গেল এক দৃপ্ত নারী— সামান্যতম সাহায্য পাওয়া-মাত্রই আত্মবিশ্বাসী মাথা তুলে যে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর বুকে। নিজের যোগ্যতায়। নিজের বুদ্ধিতে। আর এই বুদ্ধির জন্য তাকে কোনো বিজনেস স্কুলে ভর্তি হতে হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *