অখণ্ড ভারতবর্ষ – ৭০

৭০

বছর পাঁচেক আগে সহসা গিন্নির মাথায় ঢুকল— সে সাইকেল শিখবে। বাই উঠলে কটকে যাওয়ার একটা নিয়ম আছে। কিন্তু অত দূরে যাওয়া আমার সাধ্যির বাইরে, আমি হাবড়া থেকে একটা লেডিস সাইকেল কিনে আনলাম। গিন্নির সাইকেল চালাতে শেখার উৎসাহ অচিরাৎ তিরোহিত হল; আমি কিন্তু বেহায়ার মতো মধ্যমগ্রামের ফ্ল্যাট থেকে হাবড়ার বাড়িতে ফিরলেই দিব্যি সেই লেডিস সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

কিছুদিন পর আবার এক খেয়াল উঠল তার— সাইকেলটা মধ্যমগ্রামে নিয়ে এলেই নাকি চালানোটা শিখে ফেলা যেত। একদিন দুপুরের দিকের ফাঁকা ট্রেনে যদি ওটাকে তুলে নিয়ে আমি চলে আসতে পারি— তাহলেই কার্যসিদ্ধি হয়। আমি ঠিক সেই জাতের মহাবীর— যে খালি হাতে বাঘের সঙ্গে লড়াই দিতে পারে— যদি অবিশ্যি গিন্নি আদেশ করে। কাজেই প্রস্তাবটা আমারও পছন্দ হল— নিতান্ত জন্মে-ইস্তক কখনও ফাঁকা বনগাঁ লোকাল না-দেখার ফলে সাহসে কুললো না। তার বদলে একটা খাসা প্ল্যান মাথায় এল— সাইকেলটা চালিয়েই যদি হাবড়া থেকে মধ্যমগ্রাম চলে যাই? মনে হল— দূরত্ব কমবেশি তেইশ-চব্বিশ কিলোমিটার হবে। যাওয়াই যায়। ভোরবেলা বেরুব— সকাল সকাল পৌঁছে যাব! দিব্যি একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যাবে।

কাজেই ঠিক দু’বছর আগে, পয়লা বৈশাখের পুণ্যপ্রভাতে, ভোর ভোর স্নান সেরে আক্ষরিক অর্থেই ‘সাতসকালে‘রওনা দেওয়া গেল। মফস্বলের রাস্তা পেরিয়ে উঠলাম যশোর রোডে— আমাদের ভাষায় ‘বড় রাস্তায়’। আজন্মের চেনা রাস্তা এটা, সকল কামনার মোক্ষধাম কলকাতায় যাওয়ার রাজপথ। কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গদাইলস্করি মস্ত লরি, বিদ্যুৎগতি টাটা সুমো আর তড়িঘড়ি বাস। আমি চলেছি ধীরেসুস্থে ; তাড়া নেই আজ। চেনা গণ্ডি পেরুতেই দু’পাশে খুলে গেল দিগন্তবিথারি ধানের ক্ষেত, কলাবাগান, আমের বন। পথের দু’পাশে প্রবীণ সব গাছেরা দাঁড়িয়ে আছে ;কালো পিচের রাস্তায় তাদের ছায়া যেন আলপনা এঁকে রেখেছে। শরীর জুড়িয়ে গেল আমার, গলা বেয়ে আপনিই উঠে এল গান—’সুহানা সফর অওর ইয়ে মৌসম হাসিঁ’।

মৌসম অবিশ্যি ততটা হাসিন ছিল না তখন আর। সেই সকালবেলাতেই পিঠ পোড়াচ্ছে রোদ। চা খাব বলে দাঁড়িয়ে গেলাম তাই বিড়া আর দত্তপুকুরের মাঝামাঝি একটা চায়ের দোকানে। একটা অমনই বুড়ো গাছে পিঠ দিয়ে ছায়ার নীচে বসে আছে দোকানটা; ছোট্ট তার সম্বল— চা, বেকারির বিস্কুট, বিড়ি। দোকানি প্রায় আমারই বয়সী, গাছে ঝুলছে তার ঘামে-ভেজা জামা। চা নিয়ে গাছটার ওপাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল মস্ত মাঠ, ধানের গোলা, শুকনো নয়ানজুলি। আর অমনি আমার মনে পড়ল— এই দোকানটার সামনে আমি এর আগেও এসেছি। কবে যেন… কেন…

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। অনেক বছর আগে, হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার মিউজিক প্র্যাকটিকালের তিনদিন আগে থেকে আমার ছিল ধূম জ্বর। বাবা তাই সাধ্যের বাইরে গিয়ে ভাড়া করেছিল একটা গাড়ি, অ্যাম্বাসেডার। বাপ-ব্যাটায় যখন বেরলাম— তখনও জ্বর চারের উপর। বারবার আমার মাথা-মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল বাবা। ফলে জল ফুরিয়ে গেল একটু পরেই। এই দোকানেই আমরা থেমেছিলাম। আমার মাথা ধুইয়ে দিয়েছিল বাবা। নিজে বাঁশের বেঞ্চিতে ব’সে চা খেয়েছিল, আর খোলা গলায় বলছিল চেনা চেনা কয়েকটা লাইন—

 ‘মিলিয়নস অফ বেবিস ওয়াচিং দ্য স্কাই

 বেলিস স্বোলেন, উইথ বিগ রাউন্ড আইজ

 অন যশোর রোড— লং ব্যাম্বু হাটস্

 নো প্লেস টু শিট বাট স্যান্ড চ্যানেল রাটস্…’

আমি জানতাম— এগুলো গিনসবার্গের লেখা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার প্রথম ক’টা লাইন; কেননা বাবা প্রায়ই আবৃত্তি করত এই পংক্তিগুলো। কিন্তু আজ, অন্তত আঠাশ বছর পর আমার হঠাৎ মনে পড়ল— এই গাছটার তলাতেই— নিতান্ত অজান্তে— দাঁড়িয়ে গেছি আমি। শুধু সেই সমবয়সী কিশোর চা-ওয়ালা আজ মধ্যবয়সী— আমারই মতো। আমার প্রশ্নের উত্তরে হাসিমুখেই বলছিল— একাত্তরে ওর বাপ পালিয়ে এসেছিল, ‘এই অবধি আসতেই পিসি মরে গেল। রাস্তার পাশেই দাহ করা হল তাকে। তাই বাবা আর এগোলো না, এখানেই থেকে গেল। হুউউউই দেখা যায় আমাদের গ্রাম। চুয়াল্লিশ বচ্ছর ধরে এখানেই…আগে বাবা, তারপর আমি…’ —বলে দিগন্তরেখায় কিছু একটা দেখিয়ে দিল সে। আর আমার মনে পড়ল আরও অনেক, অনেক পুরনো কিছু কথা। আচ্ছা, আমার ঠাকুর্দা— বলরাম কাইব্যব্যাকরণতীর্থ (এমনই তো বলত রাঙাজ্যাঠামণি) কী এই গাছগুলোর ছায়া দিয়েই হেঁটে এসেছিলেন সাতচল্লিশে? আড়াই বছরের বাবা কী ঠাকুমার কোলে ছিল? হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল বুঝি ঠাকুমার! নাকি বড়জ্যাঠামণি বা সুন্দরজ্যাঠামণি কোলে নিয়েছিল বাবাকে? পথে কে জল দিয়েছিল ওদের? দিয়েছিল আদৌ?

কিছু কিছু গাছ ইতিহাস জানে। দেশভাগ, দাঙ্গা, রেশন, পি.এল.ক্যাম্প, দণ্ডকারণ্য, কত কী জানে! তাদের পায়ের কাছে গিয়ে বসতে হয়। জিজ্ঞেস করতে হয়— ‘তুমি আমার ঠাকুর্দাকে দেখেছ? ঠাকুমাকে? তাঁদের অন্তহীন হেঁটে যাওয়া দেখেছ? দেখেছ তাঁদের পুঁটুলি-পেটে উবু হয়ে ব’সে থাকা? জানো— ‘দ্যাশে‘থাকতে পণ্ডিত হিসেবে ঠাকুর্দার খ্যাতি ছিল খুব? জানো— একজন সেদিন বলেছে— বাঙালে আর শুয়োরে কচু খায়— তাই সে খায় না? তুমি— হে প্রাচীন বৃক্ষ— সেই শুয়োরের অধম আমার পূর্বপুরুষদের দেখেছ গো? দেখেছ তাঁদের অনন্ত পরিব্রাজন?’

যে ইতিহাস জানে— তাকে মেরে ফেলতে নেই। উন্নয়ন চাই বইকি! খাট থেকে প’ড়ে মাথায় রক্ত জমে গিয়েছিল আমার ছেলের। ছোট আর সরু বলেই তো সেদিন পথ আগলেছিল এই যশোর রোড। কত্ত গলিঘুঁজি ঘুরে সেদিন ডাক্তার খুঁজে পেয়েছিল বিশ্ব— আমার ড্রাইভার বন্ধু! তার চওড়া হওয়া চাই বইকি! কিন্তু এই ইতিহাস-বৃক্ষগুলির বিনিময়ে চাই কী?

পথের বাধাই যখন ওরা— কোনভাবে সরিয়ে দেওয়া যায় না? এই যে শুনি— বিজ্ঞানীরা পারেন না— হেন কাজ নেই? গাড়ি তাড়াতাড়ি চলুক— কিন্তু প্রাণটুকু থাক না!

অতীত মুছে দিলে কিন্তু ভবিষ্যৎ আমাদের ক্ষমা করবে না।

৭১

বছর পাঁচেক আগে, এক ভয়ানক গ্রীষ্মের মরশুমে আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম দক্ষিণ ভারতে। গোটা একটা দিন আর দু’টো রাত অসহ্য গরমে ভাজাভাজা হয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছলাম উটিতে। খানিক সময় লাগল গরম মরতে— আর রাত আটটায় ছুটতে হল জ্যাকেট কিনতে। সে কী ঠাণ্ডা! ই কী রে বাবা— আমরা কী হিমালয়ে এয়েচি! এ দেশের মহিমা বোঝা ভার।

যাক। উটি, কোদাইকানাল আর মুন্নারের ছবির মতো সুন্দর নীলগিরি, পাইনের বন আর চা-বাগান পেরিয়ে শেষে আমরা নেমে এলাম আলেপ্পিতে। নাকি এখানকার ব্যাক-ওয়াটারের জগৎবিখ্যাত রূপ না-দেখলে জীবন বৃথা। সন্ধ্যেবেলা পৌঁছেছিলাম সেখানে। নারকোল তেলে ভাজা কলার চিপস্ খেতে খেতে সাগরসৈকত দেখে আসা গেল— বিশেষ কিছু বুঝলাম না। রাস্তার এপাশে ওপাশে বিস্তর ছোট ছোট খাল— এই-ই নাকি ব্যাক ওয়াটার! ধুর! সব শুধু প্রচার। মন খারাপ হয়ে গেল। এর চেয়ে আমাগো গুমার খালও ভাল— এমন একটা মনোভাব নিয়ে শুতে গেলাম।

পরদিন সক্কাল থেকে সাজোসাজো রব— এইবার যাওয়া হবে ব্যাকওয়াটার দেখতে। কেমন একটা নিরুৎসাহিত মন নিয়ে গাড়িতে উঠে পৌঁছলাম অমনই একটা খালের ঘাটে। সেখানে যে জলযানটি দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের অপেক্ষায়— তাকে দেখে অবিশ্যি আমি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। একটি রাজসিক নৌকো— বা বলা ভাল বজরা— তার সর্বাঙ্গে যথোচিত আভরণ— যেমন দেখেছিলাম ছবিতে। একতলায় দস্তুরমতো এক বেডরুম, তাতে খাট আছে, ড্রেসিংটেবিল আছে, জামাকাপড়ের আলমারি আছে। দোতলায় একটা খাসা খোলামেলা বসার জায়গা, দিব্যি চেয়ার পাতা। এই তবে সেই ‘হাউসবোট’! গুছিয়ে বসা গেল। নৌকো একটু এগিয়েই এসে পড়ল একটা প্রশস্ত জায়গায়; চারিদিকে টলটল করছে নীল জলরাশি, বহুদূরে দেখা যাচ্ছে অপূর্ব সব রঙবেরঙের বাড়ি। এখান থেকে চারপাশে চলে গেছে জলপথ। নৌকো গদাইলস্করি চালে সেই খালের জালে ঢুকে পড়ল। দুপাশে সারি সারি নারকোল গাছ, নীলে আর সবুজে মাখামাখি। উড়াল দিচ্ছে অজস্র জলচর পাখি, মাছের খোঁজে ঝাঁপ দিচ্ছে আসমানি মাছরাঙা আর সোনালি ডানার গাঙচিল। ছোট্ট ছোট্ট নৌকোয় হেথায় হোথায় পাড়ি দিচ্ছে স্থানীয় মানুষেরা, এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যেতেও ভরসা সেই নৌকো। মুগ্ধতার সীমা রইল না আর। সেথোদের হাতে চঞ্চল হয়ে উঠেছে দামী ডি.এস.এল.আর. ক্যামেরা। আমার সস্তা ক্যামেরায় পাখির ছবি উঠবে না, মগজের হার্ডডিস্কে শুষে নিতে লাগলাম সব।

এমন সময় চোখে পড়ল এক বিচিত্র দৃশ্য। তিনদিকের দিগন্তব্যাপী জলধারার মধ্যে জেগে আছে একটি অতিক্ষুদ্র চতুষ্কোণ ভূখণ্ড, প্রায় জল-ছুঁইছুঁই উচ্চতায়। দেখলে সন্দেহ হয়— ইচ্ছে করলে সমুদ্র তার জিহ্বা দিয়ে এক লহমায় চেটে নিতে পারে সেটুকু মগ্নমৃত্তিকা। সেখানে একটা ছোট্ট বাড়ি। তার বারান্দায় বসে আছেন এক প্রৌঢ়া। একা। একাকীত্বের এমন চেহারা আমি এর আগে কখনো দেখিনি। সেই ডাঙাটুকু থেকে একটা সরু— অতি সরু পথ বেরিয়েছে; দু’পাশের জলের মধ্যে দিয়ে টাল সামলাতে সামলাতে সে পথ এসে উঠেছে একটা তুলনায় চওড়া লম্বাটে ভূখণ্ডে। সেখানে দেখা যাচ্ছে বাড়িঘর। একেবারে জল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা চপ আর চায়ের দোকান। সেখানে এসে দাঁড়াল নৌকো।

আর সবাই যখন চা খেতে ব্যস্ত, আমি তখন পায়ে পায়ে হাঁটা দিলাম সেই ভয়ানক সরু পথটা দিয়ে। দেখে আসি তো— একজন মানুষ একা কীভাবে থাকেন সেখানে!

কাজটা সহজ নয়, কেননা সে পথ দিয়ে বড়জোর একজন মানুষ সতর্ক পায়ে হেঁটে যেতে পারে। তায় আমি সাঁতার জানিনে, যেতে হল পা টিপে টিপে, ভয়ে ভয়ে। পৌঁছে দেখি— সামনে বারান্দাওলা একটা ভারি ছিমছাম বাড়ি, তার তিনদিকে আদিগন্ত জল। গেটের উপর অচেনা হরফে কীসব লেখা। বারান্দায় ব’সে আছেন এক ভদ্রমহিলা, পাকা চুল, চোখে চশমা। আমায় দেখে ভুরু তুলে চাইলেন। সসংকোচে বললাম— আমি ট্যুরিস্ট— কৌতূহলবশত ঢুকে পড়েছি। তিনি এবার সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন— ‘আজকাল স্কুল দেখতেও ট্যুরিস্ট আসছে! আশ্চর্য!’

স্কুল! এই বাড়িটা! এই অনন্ত জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে, এক সূক্ষ্মতম সূত্রে ডাঙাকে কোনোমতে ছুঁয়ে থাকা বাড়িটা!! শিক্ষিকা আমার তুমুল বিস্ময় বুঝতে পেরে একটু হেসে বললেন—‘এখনো সময় হয়নি ইশকুলের, তাই ফাঁকা দেখছেন। আধ ঘন্টা পরে এখানে দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না।’ —এই ব’লে এক মুহূর্ত সুদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তিনি বললেন—‘অ্যান্ড দেয়ার কামস্ টুডে’জ ফার্স্ট স্টুডেন্ট।’

তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি— সেই অন্তহীন জলরাশি বিভক্ত করে ভেসে আসছে একটা অতি ছোট নৌকো। তাতে একজন মাত্র আরোহিণী। এক স্কুল-ড্রেস পরা বালিকা ; বয়েস তার বড়জোর দশ। নিজেই নৌকো চালিয়ে এল সে। ঘাটের নির্দিষ্ট জায়গায় তাকে বেঁধে সে দৃঢ় পায়ে উঠে এল শক্ত মাটিতে। একবার মাত্র সপ্রশ্ন আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সে ঢুকে গেল স্কুলে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে। ফের জলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমি। দেখি— ঝাঁকে ঝাঁকে নৌকো— যেন ভাগ্যান্বেষী এক নৌবহর— স্থির জল আলোড়িত ক’রে ছুটে আসছে এইদিকে। স্কুলের দিকে। শিক্ষার দিকে। বিদ্যার দিকে।

অবিদ্যার আর অশিক্ষার অনন্ত জলের দুরতিক্রম্য দূরত্ব পার হয়ে আমার ছোট্ট ছোট্ট সহনাগরিকেরা, আমার দীর্ণ স্বদেশ— ভেসে আসছে আলোর টানে। আলোর পথে। মুক্তির পথে। শিক্ষার পথে।

অনেক দূর থেকে আসা এক ছোট্ট ইশকুলের শিক্ষক এবার নত হয়ে প্রণাম করল সেই অপরিচিতা বর্ষীয়সী শিক্ষিকাকে। এখন সে জানে— তুলনায় অনেক সহজে শিক্ষার সুযোগ পেয়েও তা সে কাজে লাগাতে পারেনি।

৭২

কথায় বলে— মনের অগোচর পাপ নেই। তা বাপু— মনের অগোচর পাগলামিও নেই। কাজেই ভিতরে ভিতরে আমি নিজেই বিলক্ষণ জানি— আমি কিঞ্চিৎ খ্যাপা-গোছের আছি। মাঝেসাঝে বিচিত্র সব খেয়াল জাগে মগজে; তারপর সেই খেয়ালের পিছনে খামোখা ছুটে মরি।

তো এমনই এক উদ্ভট খেয়াল জাগল মাঝে একবার। তখন সল্টলেকের একটা অতি ছোট আপিসে আরও ছোট্ট একটা চাকরি করি। বাড়ি থেকে বেরোই সকাল ছ’টায়, ফিরি রাত দশটায়। সারাদিন কেটে যায় অকারণ সব অপমান মুখ বুজে হজম করতে করতে; আর ভাবি— এই তাহলে কপালে ছিল! শনিবার ছুটি; কিন্তু সেই ক্ষুদ্র ব্যবসার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মালিকটি হামেশা তুচ্ছ কারণে ‘এক ঘন্টার জন্য একটু’ ঘুরে যেতে বলেন; ভাবেন না— আসতে-যেতে আমার লাগে চার ঘন্টা। চেনা ছেলে কোনক্রমে অনার্স পাশ হলেও সরকারি চাকরি পেয়ে যায় পার্টির দৌলতে, আমি তাকে হেঁ হেঁ করে রক্তিম অভিনন্দন জানাই। মুখ তেতো হয়ে যায় আরও।

সেদিনও ছিল শনিবার, আজকের মতোই। যেতে হয়েছে অফিসে। দু’টো পর্যন্ত সম্পূর্ণ অকারণে বসিয়ে রেখে ছুটি দেওয়া হল আমাকে। উল্টোডাঙা থেকে ট্রেন ধরে ফিরছি বাড়ির পথে। বারাসাত পার হতেই দু’পাশের শহুরে ঘরদোরের আঁচল সরিয়ে মুখ মেলে ধরল আকাশ। মস্ত আকাশ। খোলা মাঠ। ধানক্ষেত। আমবাগান। বাঁশবন। দত্তপুকুর ছাড়তেই হঠাৎ সেই খ্যাপামি জেগে উঠল। কী মনে হল— নেমে গেলাম বিড়া স্টেশনে। তারপর সিধে হাঁটা দিলাম লাইনের পাশ ধরে। একটু এগোতেই বাড়িটাড়ি শেষ। সব জায়গায় লাইনের পাশে জায়গা নেই, লাইনের উপর দিয়েই হাঁটছি। ট্রেন এলে নেমে দাঁড়াব পাশের নয়ানজুলিতে। মাথার উপর বিশাল একটা আকাশ ছড়িয়ে আছে মস্ত সান্ত্বনার মতো। গায়ে লাগছে বিকেলের পড়ে-আসা হলুদ রোদ আর ঠাণ্ডা হাওয়া। চশমাচোখো বাবুনাই পাখি দেখলাম জীবনে প্রথমবার। ধূলিস্নান সারছে ক্লান্ত চড়ুই। সরসরিয়ে জল ঢুকছে ক্ষেতের আল-ছোঁয়া নালায়।

এমন সময় চোখে পড়ল সেই মস্ত পুকুরটা— যার পাশ দিয়ে রোজ দু’বেলা যাই ট্রেনে চড়ে। তখন তো ভীড়ের ঠেলায় দেখার জো থাকে না, এখন দেখে মনে হল— বাস রে! কী বিশাল! এ তো প্রায় দিঘি! একদিকে তার রেলের লাইন, দু’পাশে অনন্ত ক্ষেতখামার, আর একদিকে একটা বাড়ি। পুকুরের পরেই চোখ টেনে নিল পুকুরপাড়ের বাড়িটা। অনেকটা জায়গা নিয়ে বাড়িটা, মস্ত উঠোনটা বুড়ো সব আম-কাঁঠালের ছায়ায় ঢাকা, সে গাছ থেকে দোলনা ঝুলছে। বাড়িটা মাটির, টালির চাল। উঁচু দাওয়ায় এক বুড়ি বসে চাল বাছছে। চারটে বাচ্চা খেলছে টালির টুকরো নিয়ে— বোধহয় কিতকিত। নিয়ম ভুলে গেছি কোনকালে। আর এক্কেবারে পুকুরের পাড়ে একটা বাঁশের বেঞ্চি, তাতে বসে আছে এক বুড়ো। বয়েস অনেক হয়েছে তার, কিন্তু বেঁটেখাটো চেহারাটি বলিষ্ঠ; রোদে-পোড়া শরীরে স্বাস্থ্যের আভা। জল আর মাঠের উপর দিয়ে উড়ে-আসা হাওয়ায় উড়ছে তার পাকা দাড়ি।

কী ভেবে পায়ে পায়ে ঢুকে পড়লাম উঠোনটাতে। বুড়োর কাছে গিয়ে বললাম— ‘এক গ্লাস জল পাওয়া যাবে?’

একটু চমকে বুড়ো চাইল আমার দিকে। প্রথমে তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে হাঁক দিল—‘অ আসরাফ, এক গেলাস পানি নিয়ে আয় দি’নি!’ তারপর আমায় ভুরু কুঁচকে খানিক পরখ করে বলল— ‘তোমারে তো চেনলাম না বাবা ! কোয়ানে বাড়ি তোমার?’

কী বলব— মাথায় এল না, অগোছালো ভাবে বললাম— ‘না… এই যাচ্ছিলাম এইদিক দিয়ে… বেজায় রোদ তো… জলতেষ্টা পেয়ে গেল… একটু বসি এখানে?’

বুড়ো ব্যস্ত হয়ে সরে বসল— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বসো দি’নি আগে। ঘেমে গিয়েছ খুব।’ ততক্ষণে কাঁসার গেলাসে জল এসে গেছে, কাজেই কথা চাপা পড়ল। জল খেয়ে সামনে তাকাতে বুঝলাম— এইখানে বেঞ্চ কেন। এখান থেকে সামনে তাকালে যদ্দূর দেখা যায়— শুধু জলের ওপারে ধান আর ধান… আদিগন্ত খামার। হু হু হাওয়া বইছে। মাথার উপর ছাতা ধরেছে বৃদ্ধ বনস্পতি। ক্রমে আলাপ হল। বৃষ্টির গতিক, চাষের হালচাল। বললাম সেধে— ‘কী যে সুন্দর বাড়িটা আপনার!’ এইবার বুড়ো হাসল একটু। তারপর বলল— ‘তুমি থাকো শহরে, তোমার ভাল লাগপে। একদিনের অল্প দেখা তো। আমার ছেলে তো থাকতিই পারল না। বারাসাতে বাড়ি কইরে চইলে গেল। নাতিডা…’

এ রকম কথা আমি হাজারবার শুনেছি গ্রামের মানুষের কাছে। চিরন্তন সংকট। কাজেই বিশেষ বিচলিত না-হয়ে বললাম— ‘সে তো আপনিও গিয়ে থাকতে পারেন মাঝেসাঝে ছেলের কাছে গিয়ে।’

বুড়ো হঠাৎ তেরিয়া হয়ে ধমকে উঠল— ‘যাই নে নাকি। গিয়েলাম দু’বার কইরে। থাকতি পারি কই? সে বাড়ির চারপাশে অ্যাত্ত উঁচু পাঁচিল। আমি ছোট মানুষ, নাগালই পাইনে! আসমান দেখতি হলি ছাদে যাতি হয়। দুদ্দুর! ওখেনে মানুষ থাকে!’

এও এক পরিচিত কথা। চুপ করে রইলাম। বুড়ো তাকিয়ে রইল দূরে, কপালের ভাঁজে ঘোর অসন্তোষ। খানিক চুপ থেকে আনমনা গলায় বলল— ‘বলো দিনি— খোদাতালার আসমানে এট্টা বাধা নাই, পাঁচিল নাই। জমিনেও তো ছেল না। আমরা খালি বেড়া দিই, পাঁচিল তুলি, আর বলি— এডা আমার। সেডা আমার! চোখের সামনে পাঁচিল তুইলে তারপর হুতাশ করি— দেখতি পাচ্ছি নে। আরে! পাঁচিল তো তুললি নিজেই! দেখ দি’নি— এখেনে তো বেড়াটুকু পর্যন্ত নাই। তাতে কী ক্ষেতিডা হল! কও দেহি!’

তাই তো! এতক্ষণে খেয়াল হল— এ বাড়িতে পাঁচিল তো দূরস্থান— একটা বেড়া অবধি নেই! একসারি সজনে গাছ আছে বটে; ওটুকুই বোধহয় সীমানাজ্ঞাপক নিশান। আর বুড়ো দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিল এই অসীমের মধ্যে!

আমি শহুরে ‘শিক্ষিত’ মানুষ। কত যত্নে পাঁচিল তুলেছি বাড়ির চারপাশে। আজ প্রথমবার মনে হল— ধর্ম হোক, জাত হোক, এমনকি দেশ হোক— সব মানুষের তৈরি। কিন্তু পৃথিবী তো তার তৈরি নয়! সে বস্তুটি যিনি রচেছিলেন— তিনি একটাই দুনিয়া তৈরি করেছিলেন, একটাই মানবজাতি। আমরা যখন তাতে ধর্মের নামে, জাতির নামে, দেশপ্রেমের নামে পাঁচিল তুলি, বেড়া দিই— তখন কী তা খোদার উপর খোদকারি হয়ে দাঁড়ায় না? এক দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে অন্য দেশে গিয়ে থাকা যায়; অনেকেই থেকেছেন আজীবন। কিন্তু পৃথিবী থেকে নির্বাসন দিলে? আর তো যাওয়ার জায়গা নেই! ঘর তো শেষ অবধি একটাই! আমার কী অধিকার আছে— ঈশ্বরের সৃষ্ট পৃথিবীকে খণ্ড খণ্ড করে কাটার, সেই খণ্ডাংশকে আপন ভূমি ব’লে দাবী করার!

‘পরের জায়গা পরের জমিন— ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই!’

৭৩

জানি না আপনাদের কারুর মনে আছে কিনা— আমরা একবার সপরিবারে গ্যাংটক থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম রিকিসুম নামের ছোট্ট একটা গ্রামে। সেই যে— যেখানে শুনেছিলাম একদল কচি বাচ্চার গলায় গান— ‘কান্ট্রি রোডস্!’ আমাদের ছোট্ট ছেলেটাও সামিল হয়েছিল সেই গানে! মনে আছে?

গ্যাংটকে আমাদের শেষ রাতটা কেটেছিল একটা বিচ্ছিরি আর নোংরা হোটেলে। সন্ধ্যায় সেই হোটেল দেখেই ফোন করলাম এক বন্ধুকে— যে ক’রে হোক আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো— আমার হোম-স্টে-ই ভাল। অনেককালের পাহাড়ি বন্ধুটি তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা করে দিলেন। ভোরবেলায় একটা গাড়ি আমাদের পৌঁছে দেবে সিকিম-পশ্চিমবঙ্গের সীমানা অবধি; সেখান থেকে আরেকটা গাড়ি আমাদের নিয়ে যাবে রিকিসুমে। বেশ কথা। ভোরবেলায় রওনা দিয়ে রংপো এসে পৌঁছলাম সক্কালবেলা। তার আগেই অন্য গাড়ির ড্রাইভারের ফোন এল— তিনি অপেক্ষা করছেন সঙ্কেতস্থলে। যথাস্থানে পৌঁছে তাঁর সাথে দেখা হল; সুদর্শন এক পাহাড়ি যুবা। আমাকে চেনে; একগাল হেসে বলল— ‘আপ ওহি মাস্টারজি হ্যায় না?’ স্বীকার করতে হল। নাম বলল সুমন। মালপত্তর ছুঁতে দিল না, একাই তুলল ডিকিতে।

গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই গিন্নির ঝেঁপে জ্বর এল। আলগড়ার আগে কিচ্ছুটি মিলবে না, জানি। পথ সম্পূর্ণ নির্জন। সুমন একটু পরে পরেই গাড়ি থামাচ্ছে, জল দিতে বলছে ভাবির মুখেচোখে। সামান্য সুস্থ বোধ করলেই গিন্নি উঠে বসছে, আর উচ্চকণ্ঠে তারিফ করছে বন-পাহাড়ের। আমিও গলা মেলাচ্ছি। খানিক পরে সুমন বলল—‘মাস্টারজি, হর-সাল আপলোগ আতে রহেতে হো। ফির আপলোগ যাতে হি কিঁউ হো? আপকো তো ইয়েহি পাহাড়পে রহনা চাহিয়ে।’

একেই বলে অ্যাকিলিসের গোড়ালিতে তীর মারা। দুঃখিত গলায় বললাম— যাই কী আর সাধে! চাকরিটিই তো কান ধরে টেনে নিয়ে যায়! সুমন কিন্তু অপ্রতিরোধ্য। এবার বলল— ‘তো এক কাম কিজিয়ে না! একটা জমি কিনে, বাড়ি করে রেখে দিন! আপাতত ছুটিছাটায় আসবেন; রিটায়ারমেন্টের পর পাকাপাকি-ভাবে চলে আসবেন। সিম্পল!’

জ্বরের ঘোরেই হবে, গিন্নি উচ্চস্বরে বললেন— ‘এটা কিন্তু খাসা বলেছে সুমন, বলো!’

আমি ক্ষুধাতুর চোখে জানলার বাইরের নীল পাহাড় আর সবুজ অরণ্য দেখতে দেখতে বললাম— ‘তাতে আর সন্দেহ কী!’

যাক। রিকিসুমে পৌঁছে তো গিন্নি ক্যালপল খেয়ে কম্বল মুড়ি দিলেন, গ্রামশুদ্ধু লোকের পরামর্শ শুনে আমারও জ্বর আসার উপক্রম হল। সুমন খেয়েদেয়ে দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরে গেল, নাকি এটা ওর দিদির বাড়ি। আমার গান শুনল, এক বাঙালি পর্যটক ‘সফর’ পত্রিকায় বেরনো আমার লেখার উচ্চ প্রশংসা করলেন— ও মন দিয়ে শুনল। বিকেলে বাইরে বসে চা খেতে খেতে অন্য পর্যটকদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি— দেখি— সুমন ফের এসে উপস্থিত। কী ব্যাপার? জানা গেল— তার আমার সঙ্গে কিছু প্রাইভেট কথা আছে। গাড়ির দরজা খুলে ধরল, আমি উঠতেই ধাঁ। মিনিট পাঁচেক গাড়ি চালিয়ে এসে দাঁড়াল একটা নির্জন জায়গায়। কেউ কোত্থাও নেই। হঠাৎ কেমন একটা অস্বস্তি হল আমার। এমন কী কথা থাকতে পারে আমাদের— যার জন্য এমন নিশ্ছিদ্র নির্জনতার দরকার হয়! কোনও খারাপ মতলব নেই তো! আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

সুমন ততক্ষণে তীরবেগে উঠে গেছে পথের পাশের একটা উঁচু ঘাসজমিতে। রাস্তা থেকে প্রায় তিরিশ ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে হেঁকে বলল—‘আরে মাস্টারজি, উপর তো আইয়ে!’

কষ্টেসৃষ্টে উঠলাম। পাহাড়ের খাঁজ একটা; বেশ বড় একটা সমতল জায়গা, ঘাসে ঢাকা। রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে পিছনে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়, দু’পাশে পাইনের বন, সামনে বিপজ্জনক উৎরাই নেমেছে পাকা রাস্তা পর্যন্ত। তার ওপাশে অসীম শূন্যতা, তারপর পাহাড়ের নিস্তব্ধ তরঙ্গ। হমিনস্ত!

আমি যতক্ষণ হাঁ করে দেখছিলাম, ততক্ষণে সুমন কিন্তু হন্তদন্ত হয়ে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে ওইটুকু সমতলে; যেন কী সব মাপঝোক করছে। আমার চটকা ভাঙতেই সুমন বলল— ‘তাহলে মাস্টারজি, এই জমিটা যদি আপনি কিনে নেন, তাহলে দেখুন— এই হল আপনার বারান্দা। পাশ দিয়ে সিঁড়ি। নীচের রাস্তা থেকে বারান্দা অবধি। বেশ, এবার এই হল আপনার বসার ঘর। তার দু’পাশে দু’টো বেডরুম, একটা আপনাদের, একটা বাবু’র— ও তো মাঝেসাঝে আসবে— না কি! এইদিকে হবে কিচেন… নাঃ, ভাবির প্রবলেম হবে…কিচেনটা যদি ওদিকে হয়…পিছনে একটা বারান্দা চাইই চাই। বর্ষাকালে এদিক দিয়ে একটা ঝর্ণা নামে তো…সেটা কিন্তু দেখার মতো, বুঝলেন স্যারজি— ওইখানটায় বসে আপনি লিখবেন…’

এতক্ষণে বুঝলাম— পাগলটা আমায় জমি দেখাচ্ছে। সকালের কথাটা ওর ভারি মনে ধরেছে। ভেবে নিয়েছে— থেকেই যাব আমরা। আর থাকতে গেলে বাড়ি একটা চাই বইকি! মাস্টারজি এত গুণী মানুষ, ভাল একটা জায়গায় হওয়া চাই সে বাড়ি।

আমি— শহুরে এক অর্ধশিক্ষিত শিক্ষক— এইসব ভেবে মনে মনে হাসছিলাম। আর সুমন আমায় তখন চিনিয়ে দিচ্ছিল সেই পাকদণ্ডীটা— যেটা দিয়ে সোজা চূড়ায় উঠে গেলে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা!

একটা স্বপ্নের বাড়ি বানাতে সময় লাগে আধঘণ্টা। একটা স্বপ্নের দেশ বানাতে কত যুগ লেগে যায়!

এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়লে চলে?

৭৪

ইশকুলে যাতায়াতের পথটা এমনি মুখস্থ হয়ে গেছে যে, চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিলেও বোধহয় হাতড়ে হাতড়ে চলে যেতে পারি। কোথায় কোন দোকান, কোথায় ভাড়ার বিয়েবাড়ি, আর কোথায় এখনো কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছে আদ্যিকালের পোড়ো অট্টালিকা— সব একেবারে মগজে গেঁথে গেছে। ফলে, চলাচলের পথে একটু আনমনা হয়ে যাই। পা দুটো প্রায় অভ্যেসবশত যেন হাঁটিয়ে নিয়ে যায় এই শেষ পথটুকু— মেট্রো স্টেশন থেকে ইশকুল। চোখে পড়ে শুধু সেইটুকুই— যা ঠিক নিত্যি নিত্যি দেখা যায় না।

একদিন অমনি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছিলাম স্কুল থেকে। সারাদিনের ঝক্কির পর শরীর-মন— দুইই ক্লান্ত হয়ে পড়ে; আপনিই কমে যায় গতি। প্রায় এসেই গেছি— এমন সময় চোখে পড়ল একটা আজব দৃশ্য। এতই আজগুবি আর অবিশ্বাস্য সেই দৃশ্য— ক্ষণকালের জন্য যেন ভুলেই গেলাম— আমি দাঁড়িয়ে আছি কলকাতা শহরের একেবারে মাঝখানে, আর এটা একুশ শতক।

রাস্তার পাশে একটা ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কেনাবেচার দোকান। রোজই এর সামনে দিয়ে যাই আমি; কখনো চোখ পড়েনি তেমন করে। পুরনো খবরের কাগজ, শিশিবোতল— এইসব ডাঁই করা থাকে ফুটপাথের উপর। বিরক্তি উৎপাদন করে বলে ওইটুকুই খেয়াল করি শুধু। ভিতরে কে আছে, কী আছে— তা কখনো চোখ ফিরিয়ে দেখিনি। আজ দেখি— ফুটপাথের উপর পাতা হয়েছে একটা চেয়ার। তাতে বসে আছেন একেবারে থুত্থুরে বুড়ো এক ভদ্রলোক। পরনে তাঁর ঘরোয়া পোষাক— লুঙ্গি আর ফতুয়া। পা দুটো সামনে দিয়ে বসে আছেন তিনি; আর তাঁর পায়ের সামনে বসে এক ঘটি জল দিয়ে সযত্নে সেই পা ধুইয়ে দিচ্ছে আমারই বয়েসী এক যুবক। হাত দিয়ে ডলে ডলে ভাল করে পা ধুইয়ে, কাঁধ থেকে গামছা নামিয়ে খুব যত্নে তা মুছে দিল সে। ততক্ষণ সেই বৃদ্ধ বসে রইলেন একটু ঝুঁকে। হাতটা কেমন একটা অস্বস্তিকর ভঙ্গীতে ঝুলে আছে চেয়ারের দু’পাশে, কাঁপছে অল্প অল্প।

আমি ততক্ষণে বিস্ময়ের অভিঘাতে থমকে গিয়েছি। দেখছি চুপ করে, ফুটপাথের একপাশে দাঁড়িয়ে। পা ধোয়া-মোছার পর্ব শেষ হতে বিনা-বাক্যব্যয়ে যুবকটি ফিরে গেল দোকানে। আরও একটি অল্পবয়সী ছেলে বসে ছিল ভিতরে; তার কাছ থেকে কতগুলো কাগজ নিয়ে কীসব যেন হিসেব-কিতেব করতে লাগল। বৃদ্ধ অমনি ঈষৎ ঝুঁকে বসে রইলেন চেয়ারে।

আমার পক্ষে আর কৌতূহল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হল না। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম দোকানটার সামনে। যুবকটি মগ্ন হয়ে রইল হিসেবের খাতায়, কিন্তু অল্পবয়সী ছেলেটি— দেখে মনে হল দুই ভাই তারা— মুখ তুলে বলল—‘কিছু বলবেন?’

পাশেই বসে-থাকা বৃদ্ধের সামনে প্রশ্নটা করতে কেমন একটা দ্বিধা হল আমার। নরম গলায় বললাম— ‘একটু বাইরে আসবেন ভাই? কথা ছিল…’

কথাটা আমার কানেই কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকল। বড় ভাইটি এবার চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে। তারপর কড়া গলায় বলল— ‘বাইরে আবার কথা কীসের, দাদা? যা বলার— এখানেই বলুন! আমায় বলুন। কী নেবেন?’

কিছু বলার নেই। অনুরোধটাই করেছি বেয়াড়া ধরণের। কাজেই মৃদু গলায় বলতেই হল— ‘আপনি যা ভাবছেন— তা নয়। আপনিই একটু… আচ্ছা, আমিই বরং…’— ব’লে ঢুকে পড়লাম ছোট্ট আর হরেক রকম জিনিসপত্রে ঠাসা দোকানটায় একটু ঝুঁকে চাপা গলায় বললাম— ‘আমি ওই ইশকুলের স্যার। কী হয়েছে ওঁর?’— ব’লে চেয়ারে-বসা বৃদ্ধের দিকে ইশারা করলাম।

পরিচয় পেয়ে তাড়াতাড়ি চৌকি এগিয়ে দিল ছোটজন। অবাক হয়ে চোখ মেলাল দুই ভাই। তারপর শুধলো— ‘বাবার? কী আবার হবে! এখন তো আগের চেয়ে বরং ভালই আছে! কেন বলুন তো?’

বললাম— ‘না… মানে… ওভাবে পা ধুইয়ে দিচ্ছিলেন… আমি ভাবলাম…’

‘ওহো! আপনিও এটাই জিজ্ঞেস করতে এসেছেন!’ —বলে দুজন হেসে ফেলল সমস্বরে। তারপর বড়ভাই বলল— ‘কিচ্ছু হয়নি মাস্টারমশাই! বাবা-ই তো বরাবর দোকানে বসে এসেছে। সেই আঠেরো বছর বয়েস থেকে চালাচ্ছে। বড় হয়ে আমিও বসতে আরম্ভ করলাম; কিন্তু বাবা ঠিক এসে বসে থাকত, বুদ্ধি-পরামর্শ দিত। আমি শুধু হাতে হাতে কাজটা করতাম। এই করতে করতে গত বছর হল স্ট্রোক। প্রথমদিকে তো পুরো বাম অঙ্গ পড়ে গেল। হাঁটতে চলতে পারে না। তা ডাক্তার দেখাতে দেখাতে… তারপর আপনার ওই ফিজিওথেরাপি করাতে করাতে ফের হাঁটাচলা শুরু করল। এই তিন-চার দিন আগে হঠাৎ জেদ ধরল— দোকানে আসবে; নাকি বাবা না-এলে আমি আর ভাই মিলে সব লাটে তুলে দেব। তা ভাবলাম— সারাজীবন তো এই ময়লা ঘেঁটেই কাটাল, এই রদ্দি বেচেই আমাদের খাওয়ালো-পরাল, স্কুলে পড়াল, বড় করল। আর শেষবেলায় সেটুকু কেড়ে নিই কেন? এই কাছেই আমাদের বাড়ি, বুঝলেন মাস্টারমশাই, এই গুলু ওস্তাগর লেনে। ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করতে বললেন— নিয়ে যাও! তা আজ এই তিনদিন নিয়ে আসছি। এদিকে শুয়ে শুয়ে ভয়ানক শুচিবাই হয়েছে! এসেই দেখি পা তুলে তুলে দেখানোর চেষ্টা করছে— পায়ে ময়লা লেগেছে। এদিকে কথাও তো পষ্ট হয়নি আর! তা ধুইয়ে দিলাম ভাল করে। বুঝুন অবস্থা! আমরা হলাম যাকে বলে কাবাড়িওলা। আমাদের কি ঘেন্নাপিত্তি থাকলে চলে? বাবারও কস্মিনকালে ছিল না। আজ অবস্থা দেখুন!’ —বলে সস্নেহে একটু হাসল, যেন অবাধ্য ছেলের কাণ্ড দেখে হাসছে বাপ।

ভারি বুঝদারের মতো ‘বেশ বেশ, বাঃ, সাবধানে রাখবেন ভাই। আর হ্যাঁ, ওই ফিজিওথেরাপিটা যেন বন্ধ না হয়, বুঝলেন…’ —ইত্যাদি বলে উঠে পড়লাম আমি। দুই ভাই মিলে বিস্তর মাথা-টাথা নেড়ে ‘সে আর বলতে হবে না মাস্টারমশাই!’ —ব’লে আমায় চিন্তামুক্ত করে দিল। বেরিয়ে ছুট দিলাম স্টেশনের দিকে। এরপর বারাসাত লোকালটা মিস হয়ে যাবে।

এরা আমায় বলে মাস্টারমশাই! জীবনের আসল পাঠ একেবারে গুলে খেয়ে বসে আছে, আমায় শেখাতে পারে— কাকে বলে ‘মানুষ’— আর আমায় বলে কিনা মাস্টারমশাই….

পালা… রাজা, পালা…!

৭৫

এক্কেবারে প্রথম শৈশবেই আমার মাথাটা খেয়েছিল আমার বাবা। একদিকে মাছ-ধরার নেশা, আর অন্যদিকে গণসংগীতের দল নিয়ে গান গেয়ে বেড়ানো— এই দুইয়ের পাল্লায় পড়ে আমার ছুটির দিন কাটত কেবলই পাড়াগাঁয়ে। ওদিকে বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই লোকালয় ছাড়িয়ে ঢুকে পড়া যায় কলেজের পিছনের মস্ত নির্জন মাঠটায়; সেখানে শুধুই খেতখামার, কলাবাগান, নয়ানজুলি। মফস্বলে বাস করেও কেমন একটা গাঢ় গাঁইয়া ভাব লেগে গেল আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে— সে আর ইহজন্মে উঠবে না মনে হয়। ফলে, ছেলের ইশকুলের সূত্রে যখন শহরে এসে থানা গাড়তে বাধ্য হলাম— তখনও জন্মদাগের মতো গোপনে বয়ে বেড়াতে লাগলাম নিহিত নিভৃত খেতখামার, ধানের গোলা, খড়ের আর শর্ষেফুলের গন্ধ। ‘নাগরিক’ হওয়া আর হল না কোনোমতেই।

আমাদের ফ্ল্যাটটা বড়রাস্তা থেকে মিনিট দুয়েকের পথ, কিন্তু কেন জানি না— কেমন একটা নির্জনতা আছে গলিটাতে। ফ্ল্যাটের ঠিক আগেই একটা মস্ত ব্যস্ত গার্লস্ স্কুল; অনেক মেয়ে পড়ে তাতে, স্কুল শুরু আর ছুটির সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পাড়াটা। তারপরেই কিন্তু নেমে আসে নৈঃশব্দ্য, ক্কচিৎ পথচারী আর ফেরিওলার ডাকে নিবিড় হয়ে আসে সন্ধ্যা। আমি যখন ইশকুল সেরে ফিরি— তখন সব শুনশান।

এক শীতের সন্ধ্যায় ফিরছি অমনি সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, একটা নতুন দৃশ্য দেখে থমকে গেলাম। হঠাৎ বুকের মধ্যে ঘাই মারল গ্রামের স্মৃতি। রাস্তার ডানপাশে একটা দোতলা বাড়ির বাহারি গেটের সামনে সদ্য গজিয়েছে বেজায় ছোট একটা বিচিত্র দোকান, দোকান বললেও বাড়িয়ে বলা হয় তাকে। টেবিলের উপর একটা বেতের ঝুড়ি, তাতে ক’টা অতিক্ষুদ্র শিঙাড়া কাগজ-চাপা দিয়ে রাখা। টেবিলের পিছনে ছোট্ট একটা উনুন, তাতে বসান তেমনই ছোট্ট একটা কড়াইতে ভাজা হচ্ছে আলুর চপ। ভাজছেন এক ভদ্রমহিলা। বয়স আন্দাজ মধ্যচল্লিশ। শাড়ি বা মুখ দেখে ঠিক রাস্তায় চপের দোকান করার মতো অবস্থা বলে মনে হল না। পাশে একটা স্টুলে পা ঝুলিয়ে বসে আছে একটি প্রিয়দর্শন গৌরবর্ণ বালক— এগারো-বারো বছরের হবে বড়জোর। ঝুঁঝকো আঁধারে সে ঝুঁকে আছে একটা বইয়ের উপর। স্ট্রিটলাইটের যৎসামান্য আলোয় সে পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ভদ্রমহিলাকে আমি দেখিনি কখনো, বাচ্চাটিকেও না। দৃশ্যটাও বড্ড অসংলগ্ন। মস্ত বাড়ির গেটে চপের দোকান মানায় না মোটেই; যেমন মানাচ্ছে না চপবিক্রেতাকে। তবে শিঙাড়াগুলো বেশ অন্যরকম দেখতে। নিছক কৌতুহলবশত কিনে আনলাম তাই। দিব্যি ঘরোয়া স্বাদ। বেশ লাগল। কাজেই স্কুল থেকে ফেরার পথে টুকটাক তেলেভাজা কেনা চলতে লাগল। বাচ্চাটাই চোখ টেনে নেয় বেশি; কখনো দেখি পড়ছে মন দিয়ে, কখনো ঠোঙায় ভরছে তেলেভাজা— মায়ের কাজে সাহায্য করছে বোধহয়।

একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ খেয়াল করলাম— দোকানটা নেই, জায়গাটা খালি। এমন কত দোকান বসে, আবার উঠে যায়। তবু একটু খটকা লেগেই রইল— হল কী!

দু’দিন পরে ফের দেখলাম— দোকান বসেছে। তবে এবার রাস্তার বাঁদিকে; স্কুলের পাঁচিলের গায়ে একটা গাছের তলায়। বাকি দৃশ্য হুবহু এক। সেই টেবিল, সেই টুল, সেই পাঠরত বালক। গিয়ে দাঁড়ালাম দোকানের সামনে, চপের কথা বলে জিজ্ঞেস করলাম—‘কী ব্যাপার, এদিকে আনলেন?’

ভদ্রমহিলা এতদিনে হঠাৎ তাকালেন আমার দিকে; যেন আবছা আলোয় যাচাই করে নিচ্ছেন প্রায়-অপরিচিত প্রশ্নকর্তাকে। তারপর ম্লান কণ্ঠে বললেন— ‘ওই… ওরা বলল গেটের সামনে দোকান দিলে বাড়ির অপমান হয়… লোকে ভাববে কী… এইসব। তাই… এদিকে বসালাম। আমার তো চালাতে হবে, বলুন! ঘরের মানুষ পড়ে আছে বিছানায়…ছেলেটাকে তো পড়াতে হবে, বড় করতে হবে!’

এমন আত্মগত গলায় ছাড়াছাড়া ভাবে বললেন তিনি কথাগুলো যে, কিছুই প্রায় মাথায় ঢুকল না। ‘ওরা’ মানে কারা, কাদের গেটের সামনে দোকান, কারাই বা আপত্তি জানাল?! কাজেই চোখের ইশারায় গেটটা দেখিয়ে বলতেই হল— ‘ওটা আপনাদেরই বাড়ি না?’

মাথা হেলিয়ে তিনি বললেন—‘হ্যাঁ তো!’ —শুনে আরওই গুলিয়ে গেল সব। নিজের গেটের সামনে দোকান করেছেন— এতে কে আপত্তি করল! করলেই বা তিনি শুনবেন কেন!

এইবার ব্যাসন গুলতে গুলতে তিনি যা বললেন— তা যেমন অতি সাধারণ, তেমনই অত্যাশ্চর্য। এঁর স্বামী উলটোদিকের বাড়িটার বড় ভাই। বেশ বড়োসড়ো চাকরি করতেন একটা বেসরকারি অফিসে। দু’বছর আগে এঁর স্বামীর হার্ট অ্যাটাক হয়। সিভিয়ার অ্যাটাক। প্রাণ বেঁচে গেল কোনোক্রমে, কিন্তু শরীরের বাঁ পাশটা পড়ে গেল। শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন চিরকালের মতো। কিছুদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল ভাইয়েদের সহানুভূতি; চিকিৎসা যেটুকু হয়েছিল— বন্ধ হয়ে গেল। হাঁড়ি আলাদা করে দিল তারা। যতদিন পেরেছেন— গায়ের গয়না বেচে চালিয়েছেন খাওয়াপরা, ফিজিওথেরাপি, ছেলের পড়াশুনো। তারপর তাও শেষ হল। ক্রমে অচল হল সংসার— হাঁড়ি চড়া মুশকিল হল। শাশুড়ি নিজেও ঘোর অসুস্থ, নিয়ন্ত্রণ অন্য দুই ছেলের হাতেই। তিনি এবং অপরাপর আত্মীয়রা পরামর্শ দিয়েছিলেন দেওরদের কাছে হাত পাততে। তিনি রাজি হননি। হাত পাতেননি বাপের বাড়িতেও। অবশিষ্ট আত্মসম্মানটুকু বিসর্জন দিতে আর মন চায়নি। নিছক গৃহবধূ ছিলেন ইনি, বিশেষ শিক্ষাদীক্ষাও নেই। শেষে মিথ্যে আভিজাত্য মাথায় তুলে এই শেষ উপায় নিতে হল তাকে। তেলেভাজার দোকান। স্কুল ছুটির পর বাচ্চারা বের হয়, বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরে তেলেভাজা খাওয়ার। গলি দিয়ে যাতায়াতের পথেও কেনেন কেউ কেউ। বিক্রি মন্দ হয় না। সংসার চলে যাচ্ছে এদিক ওদিক করে। ছেলেকে মানা করেছিলেন এভাবে তার পাশে বসে থাকতে। বন্ধুরা দেখতে পায়। হাসে। স্কুলে পেছনে লাগে। নতুন নামকরণ হয়েছে— ‘আলুচ্চপ!’ মেলামেশা বন্ধ করেছে দু’একজন। কিন্তু সে গায়ে মাখে না; বলে— ‘তুমি একা একা রাস্তায় বসে থাকো— আমার ভাল লাগে না।’ মেনে নিয়েছেন এখন। দোকান এখানে সরিয়ে এনেছেন তাদেরই আপত্তিতে— যারা তাঁকে বিপদকালে বিনাদ্বিধায় ত্যাগ করেছিল অকাতরে। কিন্তু এই প্রথম মুখচোরা গৃহবধূটি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন— সরাতে পারেন, কিন্তু দোকান তিনি বন্ধ করবেন না। এটা এখন আর শুধু ভরণপোষণের প্রশ্ন নয়। আত্মসম্মানের প্রশ্ন। অনেক নত হয়েছেন তিনি, গত দু’বছরে। এবার উঠে দাঁড়ানোর পালা।

আলুর চপ ততক্ষণে ভাজা হয়ে গিয়েছে। বই মুড়ে রেখে উঠে পড়ল ছেলে, ঠোঙায় মুড়ে এগিয়ে দিল তা আমার দিকে। হিসেব করে পয়সা রাখল। ওর নরম চুলে হাত বুলিয়ে বললাম— ‘ভাল করে পড়িস, বাবা।’ মাথায় এল না, আর কীই বা বলা যায় এছাড়া।

বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে বলল— ‘পড়ি তো!’

খুব ছাতিম ফুটেছে মাথার উপরের গাছটায়, গন্ধ ম‘ম‘করছে গলিটায়। রওনা দিলাম আমি। পিছনে তখন বেগুনি ভাজার তোড়জোড় করছেন এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মা। আর রাস্তার হ্যালোজেন আলোয় ফের বইয়ের পাতায় চোখ ডুবিয়ে দিল এক বালক।

কে যে কীভাবে লড়ে যায় প্রাণপণে— তার কতটুকু খবর রাখ— হে আমার স্বদেশ!

৭৬

আমি যখন স্কুলে জয়েন করি— তখন টিফিন চলছে। বাচ্চারা সব হুটোপুটি করছে খইফুল গাছের নীচে ছোট্ট উঠোনটায়। হেডমাস্টারমশাই আমাকে বললেন স্টাফ রুমে গিয়ে বসতে। চিনি না কাউকে; দ্বিধাজড়িত পায়ে সেদিকে যাচ্ছি— সিঁড়ির পাশের ছোট্ট ঘরটা থেকে ভেসে এল উদাত্ত গম্ভীর আবাহন— ‘আসুন মাস্টারমশাই, এখানে একটু ব’সে যান।’

দেখি— সরু লম্বাটে ঘরটায় বেঞ্চে ব’সে আছেন এক ভদ্রলোক; পাকা চুল উল্টে আঁচড়ানো, সরু শৌখিন গোঁফ। কিন্তু পরণের জামা-কাপড় অত্যন্ত মলিন, সামান্য ছেঁড়া। পরিচয় আন্দাজ করতে পারলাম না, তবে শিক্ষক নন যে— তা স্পষ্ট। পাশে গিয়ে বসতে বললেন— ‘বাড়ি কোথায় আপনার?’ শহরের নাম বলতে মুরুব্বিয়ানা-ভরা কণ্ঠে বললেন— ‘সে তো এক্কেবারে গ্রাম জায়গা। এদ্দূর যাতায়াত করবেন কী করে!’ সবে বলতে যাচ্ছি, ‘আমি তো সেই এম.এ. করার সময় থেকেই নিত্যযাত্রী’; এমনসময় দারোয়ান বীরেনদা এসে ডেকে নিয়ে গেল— নাকি কি-সব সইসাবুদ করতে হবে।

ক্রমে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। নাম মন্টুদা। পুরনো শিক্ষকদের কাছ থেকে জানলাম— ইনি এই স্কুলের কেউ নন। চুয়ান্ন সালের মাধ্যমিক ব্যাচের ছাত্র। ত্রিভুবনে কেউ নেই, থাকার জায়গা নেই জেনে সেই সময়কার প্রধান শিক্ষক —এখনকার সেক্রেটারি তাঁকে স্কুলেই থাকতে দেন। সেই থেকে এই স্কুলই তাঁর বাসস্থান। উল্টো ফুটেই তাঁর পুরনো বইয়ের দোকান। বিক্রিবাটা হয় না। আমাকে দেখলেই পাশে বসিয়ে উদ্ভট সব থিয়োরি আওড়াতেন— পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, যুদ্ধ থেমে যাওয়ার ফলেই এত জনসংখ্যা-বৃদ্ধি— ইত্যাদি। ধৈর্যবান শ্রোতা হওয়ায় তিনি আমায় পছন্দ করতেন— কিন্তু আমার বেজায় হাসি পেত।

কয়েক বছর পরের কথা। ছেলে তখন কয়েক মাসের। গিন্নি তাকে নিয়ে হয়রান। প্রায়ই না-খেয়ে আসি, আর টিফিনে খেতে যাই বিডন স্ট্রীটের একটা পাঞ্জাবি হোটেলে। খাসা ডাল-ভাত মাছের-ঝোল পাওয়া যায় সেখানে। একদিন টিফিন পিরিয়ডের বদলে গেছি একটা নাগাদ; দেখি মন্টুদা ব’সে খাচ্ছে। হুবহু সেই মেনু। ডাল-ভাত মাছের ঝোল। অনেক দাম তো! কী করে খাচ্ছে রে বাবা! এই যে শুনলাম বেজায় গরীব….!

আমার সন্ধানী চোখের সামনেই খেয়ে-দেয়ে… এবং টাকা না-দিয়েই দিব্যি চলে গেল মন্টুদা। হাইলি সাসপিশাস! আমার মধ্যবিত্ত মন চঞ্চল হয়ে উঠল। খাওয়া শেষ ক’রে টাকা দেওয়ার সময় মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম পাঞ্জাবি ছোকরা-গোছের মালিককে— কী ব্যাপার?!

আমার পরিচয় যাচাই করে নিয়ে সে জবাবে যা বলল— তা শুনে আমি হাঁ হয়ে গেলাম। চল্লিশ বছর আগে এই ছেলেটির বাবা এখানে একটা ঘর খুঁজছিলেন— যেখানে একটা হোটেল করা যায়। ভাতের হোটেল— যেখানে খেতে আসবে মূলতঃ পাশের যাত্রাপাড়ার লোকেরা। মন্টুদা জানতে পেরে এই ঘরটা যোগাড় ক’রে দেন। এর বাবা দালালি দিতে চাইলে হদ্দ-গরিব মন্টুদা সগর্বে তা প্রত্যাখ্যান করেন— বলেন— হাওড়ার বোস-বাড়ির ছেলে হয়ে তিনি এ টাকা স্পর্শ করতে পারবেন না। চিন্তিত শিখ ভদ্রলোক তখন দ্বিতীয় প্রস্তাব দেন— মন্টুদা যদ্দিন বেঁচে থাকবেন— তদ্দিব এখানেই খাবেন— বিনামূল্যে। মন্টুদা এবার রাজি হন। সেই ভদ্রলোক বহুকাল গত হয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি এ কথা বলে যান তাঁর ছেলেকে— অর্থাৎ এই ছোকরাটিকে। আজও সে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করে চলেছে বিনা-প্রশ্নেই।

হাঁ ক’রে খানিক তাকিয়ে থেকে আমি ব’লেই বসলাম— ‘মানে…যাঁর প্রতিশ্রতি— তিনি নেই, আর তুমি… নাম জানো ওই ভদ্রলোকের?’

একগাল হেসে পাগড়ি-পরা দাড়িওয়ালা ছেলেটি বলল— ‘ক্যা স্যার! পাপাজি নেহি রহে, লেকিন উসকা দিয়া-হুয়া বচন তো রহেনা চাহিয়ে না! বরনা ও তো বিলকুল-হি মর যায়েঙ্গে!’

ঝট করে মনে পড়ে গেল— পিতৃসত্য পালনের জন্য ছেলের সিংহাসন ছেড়ে বনগমনের ঘটনাটা এই দেশেই লেখা হয়েছিল— না?

ধর্ম যাই হোক— শিখ বা হিন্দু— শেষ অব্দি তো এই দেশেরই ছেলে…!

৭৭

ভবতোষবাবু ছিলেন আমার এক সহকর্মীর বন্ধু। তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সেই সূত্রেই, মাঝেসাঝে স্কুলে আসতেন বন্ধুর সঙ্গে গল্পসল্প করতে। টাক-মাথা বয়স্ক মানুষ; কথা বলতেন মৃদু কণ্ঠে— বলতে গেলে ফিসফিস ক’রে। প্রায় কিছুই শুনতে পেতাম না মস্ত টেবিলের অন্য প্রান্তে বসা আমরা— ছোকরা শিক্ষকেরা; শুধু শুনতাম— মাঝেমধ্যেই হাসির হররা উঠছে টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে। ভাবতাম— এত বয়েসে আবার অত্ত গোপন কথা কি হে!

একদিন সন্ধ্যেবেলা। হেঁটে যাচ্ছি দমদম স্টেশনে নেমে বেদিয়াপাড়ায় বোনের বাড়ির দিকে; ভাগ্নির শরীরটা ভাল না, দেখে আসি একবার। দেখি, ভবতোষবাবু হেঁটে আসছেন স্টেশনের দিকে। ওঁর যে এদিকপানে বাড়ি— তা জানা ছিল না। আমার যা স্বভাব— হাঁক পাড়লাম উচ্চকিত কণ্ঠে। আমায় দেখে একগাল হাসলেন। দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল— চিনেছেন; কেননা এতদিনের মধ্যে একবারও আমার সাথে সরাসরি কথা হয় নি তাঁর। স্বভাবসুলভ মৃদু কণ্ঠে বললেন— ‘তারপর, এদিকে কোথায়?’ বললাম ভাগ্নির কথা। বিশেষ পাত্তা দিলেন না— ‘ও সিজন-চেঞ্জের সময় অমন জ্বর হয়, বুঝলেন তো…’ —বলে পাশ কাটিয়ে গেলেন। বিরক্ত হলাম স্বভাবতই; আপনজনের অসুখে অন্যের ঔদাসীন্যে যেমন হই আমরা। তিনি কিন্তু নির্বিকার; বললেন— ‘চা খাই আসুন।’ বয়স্ক মানুষ, দাঁড়াতে হল বাধ্য হয়েই। দমদম স্টেশন তখন লোকে-লোকারণ্য, হাঁকডাকে আকাশ ফেটে যাচ্ছে। ভবতোষবাবু কী বলছেন— তা বোঝাই দুষ্কর।

এমন সময় একটা চিৎকৃত কান্না শোনা গেল; শিশুকণ্ঠের আর্তনাদ বলাই ভাল। শোনা-মাত্রই যেন শিউরে উঠলেন প্রৌঢ় মানুষটি। আমার আগেই ভবতোষবাবু ছুটলেন সেই কান্নার উৎস-সন্ধানে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পিছু নিলাম তার, আর গিয়ে পৌঁছলাম একটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর দৃশ্যের মাঝখানে।

মানুষের একটা বৃত্তের মাঝে এক ভদ্রলোক উত্তমমধ্যম ঠ্যাঙাচ্ছেন একটি শিশুকে। বয়েস তার বড়জোর দশ। সে এই মুহূর্তে মাটিতে পড়ে আছে, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে একটা অবোধ্য গোঙানি। ‘ভদ্রলোক’ উন্মাদের মতো গর্জন করে চলেছেন— ‘বল, আর কখনো কারোর হাত থেকে খাবার নিবি? দিলেই নিতে হবে? তুই কি ভিখিরির বংশে জন্মেছিস? বল?’ বাচ্চাটার দামী জামা-কাপড়ে এখন লেগে আছে ধুলো, আর সে কান্নার হেঁচকি থামিয়ে কী-যেন বলতে চাইছে… কিন্তু ঈশ্বর! পরম করুণাময় ঈশ্বর তাঁকে ভাষা দিয়ে পাঠান নি। মাথাটা মস্ত, মোটাসোটা শরীর, আর চোখ দেখলেই বোঝা যায়— তার বয়েস তাকে ছাড়িয়ে গেছে। বাচ্চাটি মানসিক ভাবে সুস্থ নয়— মানে আমি বা আপনি যাকে ‘স্বাভাবিক শিশু’ ব’লে জানি— সে তা নয়। অটিস্টিক! আর আপাতত সে যার হাতে চোরের মার খাচ্ছে— সে তার বাবা; কেননা তার জড়ানো উচ্চারণ থেকে ওই একটি শব্দই বোঝা যাচ্ছে— ‘বাবা…বাবা গো!’

আমি যেন স্থানু হয়ে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য, পা দু’টো যেন জমে গিয়েছে সিমেন্টের মেঝেতে। হঠাৎ আমায় চমকে দিয়ে, সেই মজা-দেখা লোকজনের বৃত্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক টাক-মাথা প্রৌঢ়। ভবতোষবাবু। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন সেই ‘ভদ্রলোক’ পিতার সামনে, তারপর, ফিসফিস ক’রে নয়, সগর্জনে বললেন— ‘বাপ হতে পয়সা লাগে না, শিক্ষাও লাগে না। কিন্তু ন্যূনতম মনুষ্যত্বও কি লাগে না দাদা? ও আপনার মতো সুস্থ হলে যে দেশটা গোল্লায় যাবে! লজ্জা করে না আপনার! অসুস্থ বাচ্চাটাকে মারছেন জানোয়ারের মতো— কে যে সুস্থ— বোঝাই তো যাচ্ছে না!’

আরও কত কী বলে যাচ্ছিলেন ভবতোষবাবু, আমার কানে সব ঢুকছিল না। এবার অবশ্য দায়িত্ব নিয়েছে ‘জনগন’— বাপটাকেই পেটানোর বন্দোবস্ত করছে তারা। আর ভবতোষবাবু এখন লড়ছেন তাদের বিরুদ্ধেও….

খানিক বাদে হাঁফাতে হাঁফাতে ভীড় থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা, কাঁপছেন তখনও থরথর ক’রে। যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বললাম— ‘হল কি হঠাৎ আপনার! খেপে গেলেন যে একেবারে!’

কাঁপা গলায় তিনি বললেন— ‘আরে ভাই, এই শাসনের ঠেলায় আমার ভাইঝিটা…বুঝলে… ও এইরকমই ছিল… সকালে উঠে দেখি— ঝিলের জলে উপুড় হয়ে ভাসছে… শালা ভাইটা…আগের দিন নাকি খুব পিটিয়েছিল… কার কাছ থেকে নেলপালিশ চেয়েছিল… আরে চাইতেই পারে… বুদ্ধিশুদ্ধি নেই… অসুস্থ বাচ্চা… তাই বলে তুই মারবি! শালা… মরেই গেল তো… অমন মিষ্টি মেয়েটা…! সেই থেকে ঠিক করে নিয়েছি— বুঝলে রাজা— এদের ছাড়া নেই..এইসব বাপ… শালা…! ডাক্তার দেখাবে না, স্কুলে পাঠাবে না…আরে এদের জন্য তো আলাদা স্কুল আছে! তা না… খালি মারবে… শুয়োরগুলো…!!’

আজই কেন যেন মনে পড়ল ঘটনাটা। কথা রাখার দিন ছিল বলেই বোধহয়… ‘প্রমিস ডে’ না কি যেন…

৭৮

এম.এ. করতে গিয়ে প্রথম যার সাথে আমার আলাপ হল— সে হল মকবুল ইসলাম। তা তার কথা আরেকদিন হবে। দ্বিতীয়জনের নাম নাজনীন। ছোটখাট চেহারার সাদামাটা মেয়ে— দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো রূপ ছিল না তার; সত্যি বলতে চেষ্টাও ছিল না। রূপটানের চিহ্নমাত্র নেই, কথা বলে দিনের মধ্যে বড়জোর তিনটে। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয় যখন, মা তখন মেডিকেল কলেজে শুয়ে আছে। ফলে আমি ক্লাস শুরু করলাম প্রায় মাস-খানেক পরে। ইতিমধ্যে বাকিদের মধ্যে আলাপ-পর্ব সাঙ্গ হয়েছে; আমি কেমন একটা বহিরাগতর মতো উপস্থিত হলাম। স্বভাবসুলভ অপ্রতিভতা লুকোনোর জন্য আমি যেতাম ‘দ্য স্টোরি অ্যাবাউট আ রিয়েল ম্যান’ বইটা নিয়ে; এক কোণে ব’সে গম্ভীর হয়ে পড়তাম— যাতে মহা-আঁতেল বিবেচনায় সবাই আমায় এড়িয়ে চলে। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম— এ বাবদে আমি একা নই। একটি মেয়ে অন্য কোনায় ব’সে ওই একই সাধনায় রত; তফাত বলতে— তার সামনে আমার সবচেয়ে প্রিয় বইটা— ‘রূপসী বাংলা’। লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন অফ পিরিয়ডে যেচে পাশে গিয়ে বসলাম, সিধে বললাম— ‘জানিস, এটা আমার সবচেয়ে বেশিবার পড়া বই।’ মেয়েটি একগাল হেসে বলল—‘আমারও!’ তদ্দণ্ডেই আলাপ হয়ে গেল। নাম নাজনীন, বাড়ি বর্ধমানের খুব ভেতরবাগে ঢোকানো এক গ্রামে, আলিপুরে পিসির বাড়িতে থেকে পড়ছে। সম্ভ্রান্ত উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কবিতা খায়, কবিতা ঘুমোয়, কবিতা স্বপ্ন দেখে— কিন্তু শুধু… শুধুমাত্র পাঠক। লেখে না এক লাইনও। ভাবেও না লেখার কথা। পড়েই সন্তুষ্ট, বা হয়তো বলা উচিত ‘পরিপূর্ণ’। হপ্তা-খানেকের মধ্যে আমরা হরিহর-আত্মা হয়ে উঠলাম। দু’জন আনস্মার্ট মানুষের মধ্যে সেতু হয়ে দাঁড়াল কবিতা।

ক্রমে ছোটখাট একটা দল গড়ে উঠল আমাদের। স্বভাবতই, দলের অন্যেরাও সাহিত্যের রসিক। কফিহাউসে যাতায়াত শুরু হল। ক্লাসের সময়ের দখল নিল আড্ডা। দ্বারভাঙা বিল্ডিং-এর সামনের লন কাঁপিয়ে দিল আমাদের সমবেত সঙ্গীত। চোখ-ভর্তি কথা নিয়ে নাজনীন সর্বদাই আছে সে আড্ডায়, অবিশ্যি নীরবে। ওকে কথা বলানোর সাধ্যি হল না কারোরই।

একদিন, সবাই মিলে শ্যামবাজার যাব— বেরিয়েই পেয়ে গেলাম ফাঁকা একখানা ট্রাম। লাফ দিয়ে উঠেই দেখি— নাজনীন নেই। খাইসে! পড়ে গেল নাকি! আবার নামলাম লম্ফ দিয়ে, বন্ধুরা চলে গেল। দেখি— রাস্তার পাশে একা দাঁড়িয়ে আছে নাজনীন। কাছে গিয়ে শুধোলাম— ‘কী হল রে, উঠতে পারলি না?’ অন্য দিকে তাকিয়ে, ধরা গলায় কেটে কেটে উত্তর দিল— ‘আমি ট্রামে উঠি না।’

ঠিক এই উত্তরটার জন্য তৈরি ছিলাম না আমি। গ্রামের মেয়ে, ওঠে নি কখনও ট্রামে— সে আলাদা কথা। ‘উঠি না!’ এ আবার কী কথা! যথারীতি জিজ্ঞেস ক’রে লাভ হল না। নীরবতা।

ক্রমে জানলাম— নাজনীন সত্যিই ‘অন প্রিন্সিপাল‘ট্রামে ওঠে না। অনেকেই জানে ব্যাপারটা। বিদিশা একদিন খুব চেপে ধরায় ও বলেছিল— ওর এক আত্মীয় ট্রাম অ্যাকসিডেন্ট-এ মারা গেছেন, সেইজন্যই ওর ট্রামে অ্যালার্জি। তা হবে। আমারও তো অমন কত ব্যাপারে আছে। মাথা ঘামাই নি আর।

সেদিন বেজায় বৃষ্টি হয়েছে দিনভর। বিকেলের দিকে ফের মেঘ-ভাঙা রোদ উঠেছে। অমনই কোথায় একটা যাব আমি আর নাজনীন— সামনে ট্রাম দেখে এক লাফে উঠতে গিয়ে কী ক’রে যেন পা পিছলে গেল— আমি পড়ে গেলাম ট্রামলাইনের উপর। পথচারীদের ভীত চিৎকার ছাপিয়ে শুনলাম নাজনীনের তীব্র আর্তনাদ। তখন ক্রিকেট খেলি রোজ, চটপট সামলে উঠে পড়লাম; গা-ঘেঁসে চলে গেল সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। তখন তাকিয়ে দেখি, ল্যাম্পপোস্ট আঁকড়ে থরথর ক’রে কাঁপছে নাজনীন। চারদিকে জমে-ওঠা ভিড় উপেক্ষা ক’রে ছুটলাম ওর কাছে। কথা বলার অবস্থাই নেই, চেপে ধরল হাতটা। কোনোমতে হেসে বললাম—‘সবটায় ভয় পাস তুই! এই দেখ— কিস্যু হয় নি।’ জবাব দিতে পারল না। চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে শান্ত করতে আধ ঘন্টা লাগল। তারপর চেপে ধরতেই হল— এই ভয়ানক আতঙ্কের কারণটা জানা চাই।

জিজ্ঞেস করতে সেই ধরাবাঁধা জবাব— এক নিকট-আত্মীয় ট্রাম-দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার ফলেই এই অবস্থা। বুঝলাম— সদ্য আঘাতের ফল। কোমল কণ্ঠে শুধোলাম— ‘রিসেন্টলি হয়েছে অ্যাকসিডেন্ট— না রে?’ ম্লান গলায় বলল— ‘না রে। অনেকদিন…২২’শে অক্টোবর।’

—‘এ বছরের?’

—‘নাঃ। ১৯৫৪…অনেকদিন হল…না?’

তারিখটা বিদ্যুতবেগে সেঁধিয়ে গেল মগজে। কী যেন…কে যেন…

আর নাজনীন মৃদুকণ্ঠে বলে চলল—

‘একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা

নির্জন ডিপোর কোণে মুড়ে রাখছে রৌদ্র-রঙা খাম;

সারাদিন শহরের পথে পথে পায়চারি ক’রে

একা একা কেঁদে নিচ্ছে অনুতপ্ত হত্যাকারী ট্রাম….’

এইবার ঝাঁ ক’রে মনে পড়ে গেল। ওইদিন চলে গিয়েছিলেন সবচেয়ে নাগরিক… সবচেয়ে গ্রাম্য কবিটি…

জীবনানন্দ দাশ।

ফিসফিস ক’রে বললাম—‘তবে যে বললি— আত্মীয়…!’

আনমনা গলায় নাজনীন বলল— ‘তুই ‘আত্মীয়’ শব্দটার মানে জানিস না রে…’

আর কোনও দেশের আমজনতার আরাধ্য মানুষ একজন কবি— শুনি নি কখনও। রবীন্দ্রনাথ।

আর কোনও দেশে ‘আত্মীয়’ বলতে ‘আত্মার প্রিয়’ বোঝায়— শুনি নি তো! আর সেই মানুষটি চলে গেছেন বহুকাল আগে, কোনও এক অজানা ট্রামে চড়ে, অচেনা গন্তব্যের দিকে…

তা হোক, যতই চলে যান জীবনানন্দ, যতই দেওয়ালের মতো মৃত্যু এসে দাঁড়াক সামনে— মানুষের মৃত্য হলে তবুও মানব বেঁচে থাকে যে এই দেশে….!

৭৯

প্রায় বছর দশেক আগের কথা। ততদিনে আমি শিক্ষক হিসেবে পোক্ত হয়ে উঠেছি ; অর্থাৎ এ কলকাতার মধ্যে আছে যে আরেকটা কলকাতা— তাকে চেনার মতো বুদ্ধিশুদ্ধি কিঞ্চিৎ হয়েছে আমার— এমন একটা বোধ জন্মেছে। একদিন থার্ড পিরিয়ড নেবো ব’লে ক্লাস এইটে ঢুকছি— সহসা এক অত্যাশ্চর্য অনৈসর্গিক দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। জয়ন্ত পড়ছে! বই পড়ছে! কী কাণ্ড!!

জয়ন্ত পালিত ক্লাস এইটে উঠেছে নিতান্ত শিক্ষকদের অনুগ্রহে। শ্যামলা রং, রোগার মধ্যে ভারি মিষ্টি দেখতে, অত্যন্ত নিরীহ ছেলে। দোষের মধ্যে— পড়ে না। আদৌ না। ইদানিং ধ’রে ধ’রে রিডিং পড়তে পারে, লিখতে গেলে এখনও কলম ভেঙে যায়। সেই ছেলে নিজে থেকে পড়ছে! দু’টো ক্লাসের মধ্যবর্তী ফাঁকা সময়টা বাচ্চারা ক্লাসের মধ্যেই বেদম ফুটবল খেলে, জয়ন্ত বরাবর সে-খেলার রেফারি। আজও অন্যেরা খেলছিল, শুধু জয়ন্ত পাঠে মগ্ন। কী ব্যাপার?

নিঃশব্দে ক্লাসে ঢুকে বইটা দেখে আরও চমকে গেলাম। বাইবেল, ওল্ড টেস্টামেন্ট। সেই কালো মলাট, ও আমি বিলক্ষণ চিনি। ক্লাস এইটের এক রাম-ফাঁকিবাজ ছোঁড়া খেলা ফেলে বাইবেলে মত্ত! আমি ঢুকতে অন্য ছেলেরা এক ছুটে বেঞ্চে ফিরল; আর জয়ন্ত তড়িঘড়ি চেষ্টা করল বইটা লুকোতে। চেয়ারে বসে গম্ভীর হয়ে বললাম—‘কী বই রে ওটা?’ উত্তর না-দিয়ে অপরাধীর মতো এগিয়ে দিল বইটা। দেখলাম— তার একটা বিশেষ পাতায় কাগজ দিয়ে পেজমার্ক দেওয়া। খুললাম। সেই ‘আমরা পাপী, সদাপ্রভু তা জ্ঞাত আছেন’ ইত্যাদি। বললাম— ‘কী ব্যাপার রে? সটান বাইবেল?’

এইবার জয়ন্ত ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল— ‘মুখস্থ করছিলাম, স্যার।’

আমার মুখচোখ নিশ্চই জীবন্ত প্রশ্নচিহ্নের রূপ নিয়েছিল। জয়ন্ত বলল— ‘আসলে স্যার, আমরা তো চার্চে যাই। রোজ। জন-স্যার খুব ভালবাসেন আমাদের। কত কি দিয়েছেন— চাবির রিং, খেলনা— মানে বড় সফট-টয় স্যার…এত্তবড়… তারপর ধরুন বই …বাইবেলটাও…এবার ক্রিসমাসে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেলেন। গতবছর গেছিলাম নিক্কো পার্ক…এই ড্রেসটাও তো চার্চ থেকেই দিয়েছে স্যার…।’ অসংলগ্ন ভাবে এই অবধি ব’লে যোগ করল— ‘জানেন স্যার, রাহুল না স্যার, বলেছে কি— ও ক্রিশ্চান হয়ে যাবে। উইলিয়াম রাহুল দাস।’ ব’লে অপ্রস্তুত ভাবে হি হি করে হাসল; আর রাহুল তাড়াতাড়ি বলল— ‘না স্যার, আমি না, জয়ন্তই বলেছে! আপনি ওদের জিজ্ঞেস করুন!’ — ব’লে বাকিদের দেখিয়ে দিল। বাকীরাও একবাক্যে সায় দিল।

জানি, ক্লাসের সবক’টা বাচ্চাই খুব… খুব গরীব। এও জানি— ওরা সত্যিই ভালবাসা পায় না কোত্থাও। ভালই তো! কিন্তু মুশকিল হল— যে পরোপকারের পিছনে কোনও প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য আছে— এমনকি তা যদি ধর্মপ্রচারও হয়— কেন যেন আমি তাকে সেবা ব’লে মেনে নিতে পারি না। এদিকে এ অবস্থায় কী যে বলা যায়— তাও মাথায় এল না। দু-একবার বিড়বিড় ক’রে ‘তা ভাল…ভালই তো…’— ব’লে চুপ ক’রে গেলাম। জয়ন্ত ততক্ষণে উৎসাহ পেয়ে জন-স্যারের ছবি দেখাতে ব্যস্ত। এক শ্বেতাঙ্গ যুবক ও তার অপরূপ শিশুসন্তানের ছবি।

তারপর বহুকাল কেটে গেছে। ক্লাস নাইনে ফেল ক’রে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে জয়ন্ত। ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা। কাল হঠাৎ দেখা লিবার্টির সামনে। বারমুডা আর একটা রং-চটা টিশার্ট পরে বাঁশ দিয়ে কিসের যেন মস্ত একটা কাঠামো বানাচ্ছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে হাঁটুতে হাত দিয়ে প্রণাম করল। কথায় কথায় জানলাম— এটাই এখন পেশা ওর, প্যান্ডেলের কাঠামো বানায়। সারাবছরই কাজ থাকে। বোঝাও যাচ্ছে তা, কেননা ওর পকেট থেকে উঁকি মারছে একটা দামী মোবাইল।

একটু কথা সেরে— ‘যাই রে বাবা, ভাল থাকিস’— ব’লে এগোলাম আবার। এগিয়ে দেবে ব’লে সঙ্গে এল জয়ন্ত। দু‘পা হেঁটে মৃদু গলায় বলল— ‘জানেন স্যার, আগে ওরা আমাকে ধর্ম বেচতে বলেছিল। বাবার জন্য পারি নি। আজ দেখুন— সেই ধর্ম বেচেই খাচ্ছি, না?’

আমার সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। একদিন ধর্মই ছিল এই প্রকান্ড দেশটার মূল সাধনা। সরতে সরতে কতদূর এসে পড়েছি আমরা! এত দূর! এতটাই— যে সেই ভুলে যাওয়া পথটা আর চোখেও পড়ে না! আর এমনই আত্মবিস্মৃত হয়েছি যে, এ কথা মনেও আসে না— আজ ধর্ম শুধু কতিপয় ‘বুদ্ধিমান’ মানুষের বিক্রয়যোগ্য একটা পণ্যসামগ্রী-মাত্র! গোপন দাঙ্গায় দীর্ণ এই দেশ শুধু অজুহাত দেয়, আর অঙ্ক কষে— যারা মরল— তারা হিন্দু না মুসলিম! লুকিয়ে খবর নেয়— প্রথম গোলমালটা কে পাকিয়েছিল— হিন্দু না মুসলিম! দোষটা আসলে কার— হিন্দুর না মুসলিমের !!

আর এইসব বিক্রি ক’রে যারা খায়— একবারও কেউ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস তাদের জিজ্ঞেস করে না— ‘এই দেশের মানুষ— তাও এই কাজ করলি রে !’

আর কবে সোজা এই প্রশ্নটা করব আমরা— হিন্দু আর মুসলিম— সবাই মিলে? সব ভারতীয়রা মিলে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *