১
বারাসাত থেকে বাসে উঠলাম। ফাঁকা বাস। ড্রাইভারের ঠিক পিছনের আড়াআড়ি সিটটায় বসলাম দিব্যি করে। একপাক ঘুরে চাঁপাডালির স্ট্যান্ডে এসে আবার দাঁড়িয়ে রয়েছে বাসটা; বেশ ভরে উঠেছে।
এমন সময় এক বুড়ি উঠে আমার সামনে দাঁড়াল। হতদরিদ্র, জরতিবেশ— ধারিণী অন্নপূর্ণার মত চেহারা। উঠে বসতে দিতে বেশ অবাক হয়ে তাকাল একবার। তবে বসল।
একটু পরে আমায় বলল— ‘আমার আঁচলের গিঁট থেকে পয়সাগুনো বার কর দিনি দাদা।’ ‘দেখি, বুড়ির আঁচলে গিঁট বাঁধা কতগুলো খুচরো। দশ-বার টাকা হবে। বার করলাম। এবার হুকুম হল— ‘ওর থে ছ-টাকা নে, হাতে রাখ।’ এ আবার কী কথা রে বাবা! তা রাখলাম। খানিক বাদে কন্ডাকটার আসল। বুড়ি বলল— ‘নাও, আমার টিকিটটা কর। আসলে চোখে মোটে দেখি নে আজকাল। তাই তোমারে বলতি হল দাদা।’
বোঝো কাণ্ড! এবার আমি বললাম— ‘ও ঠাকুমা, আমি যদি বেশি পয়সা বার করে নিতাম?’
বুড়ি দন্তহীন মুখে একগাল হেসে বলল— ‘তাই কেউ নেয় নাকি! আমি বলে গরীব মানুষ! আমার পয়সা নিলি তার পাপ হবে না? কী যে বল দাদা!’
মনে পড়ল, তপনবাবু এর’ম একটা ঘটনা লিখেছিলেন বটে। আজ দেখলাম।
এই আমার দেশ। আমার জন্মভূমি।
এই-ই আমার মা।
২
আবার সেই চাঁপাডালি বাসস্ট্যান্ড। পেছনের দিকে একটা সিটে বসে বই বার করব, এমন সময় হুড়মুড়িয়ে বাসে উঠল একটা লোক। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সামনের দুটো দাঁত নেই, ফ্যালফ্যালে চোখ। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ, লাউশাক আর ছেঁড়া গামছা উঁকি দিচ্ছে সেটা থেকে। ট্যাঁকে একটা বছর পাঁচেকের মেয়ে। শাকপাতা বিক্রি করে বাড়ি ফিরছে নির্ঘাৎ বাপ-বেটিতে। আমার পাশের সিটটায় বসল দু-জনে।
বাস চলল। বামুনগাছির পরে বোধ হয় একটা মসজিদ আছে। খুব ধ্বনি উঠছে— ‘আল্লা হু আকবর!’ কেন কে জানে। পরব আছে হয়তো।
বাচ্চাটা বাপকে জিগ্যেস করল— ‘ওরা কী বলছে বাবা?’
লোকটা একটু হাবাগোবা বোধ হয়। খানিক ভেবে টেবে বলল— ‘ও ঠাকুরের নাম কচ্ছে।’
বাচ্চাটা বলল— ‘আমিও করি?’ বাবা বলল— ‘তা কর না! সন্ধ্যেবেলা…।’ অমনি বাচ্চাটা কচি গলায় চিল্লিয়ে উঠল— ‘আল্লাআআ হু আকবর!’ বাবাও গলা মেলাল। খানিক চেল্লামেল্লি করে আমার দিকে ফিরে একগাল হেসে বলল— ‘কী বুদ্ধি, দেখেন! একবার শুনেই… হেঁ হেঁ…’
একটু পরে মেয়ে বলল— ‘জানো বাবা, মা-ও সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরের নাম করে। আমি সেটাও পারি।’ বাপ আরও বিগলিত। ‘কর দিনি। তোর মা কিন্তু মেলা জানে।’
টিয়াপাখির মতো চিকন বেসুরো গলায় বাচ্চাটা গেয়ে উঠল— ‘হরি হরায় নমো কিস্ন যাদবায় নমো…’
একটু পরে গলা মেলাল হাবাগোবা বাপটাও। ঠাকুরের নাম করছিল আধপাগল একটা গরীব বাবা আর তার কচি মেয়েটা। আর আমরা গভীর সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিলাম ওদের দিকে।
আমরা তো আর হাবাগোবা নই!
৩
আমার স্কুলটা যে খারাপ পাড়ায়, তা বুঝলাম জয়েন করতে গিয়ে। বন্ধুরা খুব খুশি; তারা আমায় ‘সোনাগাছির রাজা’ নাম দিল। কেউ কেউ জিগ্যেস করল আমার ওখানে ছাড় আছে কি না। স্বাভাবিক; তারা ভালো ছেলে। সচ্চরিত্র। রাগ করা অর্থহীন।
যাক। প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস। ভোরবেলা উঠে স্কুলে যাচ্ছি। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কাঁপছি রীতিমতো। পরণে ডাবল্ ভেস্টেড জ্যাকেট। অটো থেকে শোভাবাজারে নেমে হাঁটছি উলটো ফুট দিয়ে। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা মেয়ে একটা গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। পরনে অতি সংক্ষিপ্ত একটা টি-শার্ট, সবুজ। সাদা স্কার্ট। গলায় কমলা স্কার্ফ। ঠকঠক করে কাঁপছে মেয়েটা সকালের ঠাণ্ডায়। স্পষ্টতই সারারাত রোজগার হয়নি। খাওয়া হয়নি। নইলে এত সকালে… কাঁপছে মেয়েটা। খারাপ মেয়েটা। আমি হাত ঢোকালাম জ্যাকেটের পকেটে।
স্কুলে পৌঁছোলাম। পতাকা উঠছে। ঘনঘন স্লোগান— ‘বন্দে মাতরম।’
হঠাৎ মনে পড়ল, এই পতাকার রংটা এই মাত্র দেখেছি। কোথায় ? ও হ্যাঁ, ওই মেয়েটার পরনে। আমার ভারতমাতা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। আমি চিনতে পারিনি।
মনে পড়ল, ‘বন্দেমাতরম্’ মানে ‘মা-কে বন্দনা করো।’
কী ঠাণ্ডা! হাতটা বরং পকেটেই থাক।
গান শুরু হলো— ‘কেন চেয়ে আছো গো মা,মুখপানে …’
৪
গত লোকসভা ইলেকশন। সবচেয়ে ‘সফ্ট্ টার্গেট’, অর্থাৎ ভোটকর্মী হিসেবে যেতে হল হাওড়ার একটা ছোট্ট জনপদে। গিয়ে বুঝলাম, জায়গাটা আধা-মফস্বল, কিন্তু খুব পুরনো জায়গা। পুরোনো বাড়িগুলোতে এখনো আভিজাত্যের গন্ধ।
পরদিন ভোট চলল নির্বিঘ্নে; আশাতীত শান্তিতে। পোলিং এজেন্টরা সব বন্ধু-বান্ধব; সমস্যা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলছিলেন হাসিমুখে। তখন বেলা প্রায় একটা। দরজার কাছে একটু চড়া গলার শব্দে তাকিয়ে দেখি, পুলিশের উঁচোনো লাঠি মৃদু টোকায় সরিয়ে এক বৃদ্ধ ভিতরে এলেন। বয়স অন্তত পঁচাত্তর, টকটকে ফর্সা, দামি ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে একটা বাহারি ছড়ি। অপরিসীম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাদের ওপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন ‘কার কাছে যাব?’
হাতে অনেক কাজ। কাজেই চোখ ফিরিয়ে মন দিলাম। এমন সময় ফার্স্ট পোলিং অফিসার আমায় বললেন— ‘স্যার, ইনি কোনো আই-কার্ড আনেন নি। আনতেও চাইছেন না।’
আমি বিনীত গলায় বললাম, কোনো একটা না দেখালে আইনত ভোট দেওয়া যাবে না। এইবার কড়া গলায় ধমকের সুরে ভদ্রলোক বললেন ‘আপনি আমায় আইডেনটিফাই করার কে মশাই? আমাকে এখানে প্রতিটি লোক চেনে। আর আপনি কাল প্রথম এয়েচেন। আমারই তো আপনাকে চ্যালেঞ্জ করার কথা! কী? অ্যাঁ?’
হক কথা। কিন্তু আমি যে নাচার। আবার বলতে হলো— ‘কাউকে একটা পাঠিয়ে…।’ আবার ধমক ‘ফের মুখে মুখে কতা!’ কী বলি? এদিকে বাইরে যারা দাঁড়ানো, তারা যেন বেশ মজাই পাচ্ছেন। আমায় দেখেই নিশ্চই। এবার একজন এজেন্ট বলল ওই একই কথা। একটু থমকে গিয়ে, ভুরু কুঁচকে দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন— ‘ওরে, কেউ একটা গিয়ে আমার পাসপোর্টটা নিয়ে আয় দেখি!’
কেউ নড়ল না। কেউ না। ধীরে ধীরে দরজার দিকে ঘুরে তিনি বললেন— ‘কাজের সময় আর কাউকে পাওয়া যায় না। যত্তসব!’ বলে, ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। এবার যেন পা ভারী, ছড়িটাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে।
আমি দেখলাম, তিনি চলে যাচ্ছেন; আর গুঁড়ো হয়ে, ভেঙে ভেঙে খসে পড়ছে তাঁর আভিজাত্যের অহমিকা, তাঁর দৃপ্ত অহংকার। যেন বড্ড অপমানিত পায়ে চলে যাচ্ছেন একজন বুড়ো মানুষ, সময় যাঁর হাত ছাড়িয়ে জোর কদমে চলে গেছে কোন কালে। তিনি টের পান নি।
আমার দেশটার মতো।
৫
কার উপরে যে বিশ্বাস রাখা যায়, আর কার উপর যায় না— এইটে ঠিক করাই হল সবচেয়ে মুশকিলের কাজ। না?
তো হল কি, গত রোববার বাড়ি ফিরছি। এক হাতে আমার ব্যাগটা, অন্য হাতে মস্ত একটা প্যাকেটে পুজোর জামাকাপড় একগাদা। স্টেশনে নেমেছি সবে, বেজে উঠল ফোন। তা আমি তো আর ‘দু হাতে দুটো পিস্তল, অন্য হাতে টর্চ’ নিয়ে পাইপ বাইতে পারি না। কাজেই ব্যাগটা পাশের বেঞ্চটায় রেখে, পকেট থেকে ফোন বার করে কথা-টথা বলে আবার রওনা দিলাম।
প্রায় ফ্ল্যাটের কাছাকাছি পৌঁছে মনে পড়ল, ব্যাগটা ফেলে এসেছি। সর্বনাশ! গিন্নীর শাড়ি, ছেলের জামা-প্যান্ট, আমার… আর কী কী ছিল খোদায় মালুম! ফিরে দৌড়… দৌড়… সেই বেঞ্চ…
দেখি, বেঞ্চ থেকে প্যাকেটটা তুলছে একটা বুড়ো লোক। চিনি ওকে, দু-নম্বর প্ল্যাটফর্মে ভিক্ষে করে। খুব শান্ত পায়ে ওর কাছে এগিয়ে গেলাম আমি, যেন এদিকে মনই নেই। রওনা দিলেই ধরব ওকে। চোর ব্যাটা!
লাঠি ঠুকে ঠুকে পাশের চায়ের দোকান অবধি গেল বুড়ো। প্যাকেটটা দিল দোকানদারের হাতে। তারপর বলল— ‘এই বেঞ্চিটায় পড়ে ছিল, বুঝলি? কারোর পুজোর জামা হবে। চাইতে এলে কাউকে হুট করে দিস না যেন! বুঝে দিস। বাচ্চার জামা আছে। আহা রে, সে বুঝি কাঁদবে না পেলে! বুঝে-সুঝে দিস বাবা! আজকাল আর কাউকে…’
পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। গিয়ে বললাম, ওগুলো আমারই। চা-ওলা গভীর সন্দেহের চোখে কিছুক্ষণ আমায় দেখে বলল— ‘কী আছে বলুন তো প্যাকেটে? প্রমাণ কী, এটা আপনারই?’
ওর দোষ নেই। ওই যে বললাম, কাকে যে বিশ্বাস করা যায়, আর কাকে যে…
৬
মা কালীর দিব্যি, NJP— মানে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামলেই আমার মন ভাল হয়ে যায়। প্রত্যেক বচ্ছর যাচ্ছি, সকালে নেমে কোন কলে দাঁত মেজে মুখ ধোবো, তাও জানি…তবু…
যাক গে। গত বছরও নেমেছি। গাড়ি এসেছে নিতে। যাব সাংসের। নিতে এসেছে সঞ্চিত। পাহাড়ের সবচেয়ে সুদর্শন সারথি। এমন সময় গিন্নির মনে পড়ল, আমার প্রেশারের ওষুধটা আমি ফেলে এসেছি। কেলেংকারি। তখন সকাল আটটা; ওখানে কোনো দোকান অত সকালে খোলে না। বললাম সঞ্চিতকে। ও বলল, আমি যেন ওষুধগুলোর নাম ওকে SMS করে দিই। দেখবে। তা দিলাম। সব সম্ভাব্য জায়গায় থামতে থামতে চলল বেচারি। নেই।
নেই তো নেই! মারো গোলি। সাংসেরে পৌঁছে প্রেশার আপনিই নর্মাল হয়ে গেল। পরদিন ইচে থেকে হেঁটে পৌঁছোলাম সিলারি, আমার দ্বিতীয় গৃহে। দিলীপের সঙ্গে আড্ডা মারতে গিয়ে ভুলেই গেলাম ঔষধ-বৃত্তান্ত।
পরদিন বেরোচ্ছি, এমন সময় সঞ্চিতের ফোন। ‘স্যারজি, আপকা গাড়ি কৌন চলা রহা হ্যায়?’ কী জ্বালা! আমি কী করে জানব? বলল, ও জেনে নেবে।
নতুন ড্রাইভার পেদং-এ গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মহা সমস্যা! এমন সময় দেখি— সঞ্চিত! হাতে ওষুধের প্যাকেট। পরদিন কিনেছে শিলিগুড়ি থেকে। একশো তেতাল্লিশ টাকা বিল। দু-শো টাকা দিলাম ওকে। পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিয়ে বলল— ‘কী যে বলেন স্যারজি! ওষুধের জন্য… মনে করে খাবেন; সকালে এটা… বিকেলে….’
এই আমার দেশ। বসুধৈব কুটুম্বকম্। মা…
৭
পনেরো বছর আগে আমরা কিচ্ছুটি না-জেনেই বেড়াতে গিয়েছিলাম আসানবনি নামের একটা অদ্ভুত জায়গায়। বড়ো রাস্তার দু-পাশেই দলমা পাহাড়ের অনন্ত সবুজ ঢেউ, আর মাঝখানে বেখাপ্পা একটা জাঁদরেল রিসর্ট; যাকে ওই বনে-পাহাড়ে মোটেই মানাচ্ছিল না। ভোরবেলায় আমরা ওঠার চেষ্টা করেছিলাম রাস্তার ওপারের সেই মস্ত পাহাড়ে; আর ঘন জঙ্গলে হাতির বিষ্ঠা দেখে নেমে এসেছিলাম হুড়োহুড়ি করে।
বিকেলে আর কোনো অ্যাডভেঞ্চার না-করে আমরা হাঁটতে লাগলাম ঝকঝকে বড়ো রাস্তা ধরে। একটু এগিয়েই তা থেকে ডান দিকে বেরিয়েছে একটা ছোট্ট সরু রাস্তা। গিয়েছে পাহাড়ের দিকে। আমরা হাঁটা লাগালাম সেই পথ ধরে। পথটা গেছে একটা ছোট্ট বনবস্তিতে। বাঁ-পাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে ছোটো ছোটো নোংরা ঘর গুলো, শুয়োর-মুরগী চরছে। ডান দিকে, রাস্তা আর পাহাড়ের সরু ফাঁকটায় চাষের জমি। ফসল নেই তখন। মাঝামাঝি একটা বুনো ডুমুর গাছের নীচে বসে আছে একটা বুড়ো। রাস্তার দিকে না, পাহাড় আর জঙ্গলের দিকে মুখ করে। পাশে বসে আলাপ জমানোর জন্য বাড়িয়ে দেওয়া সিগারেটটা নিয়ে দিব্যি টানতে লাগল, কিন্তু ফিরে তাকাল না। বললাম— ‘চাচাজি, ইয়াঁহা পে হাথি নহি আতে ?’
মুখ না-ফিরিয়েই উদাস গলায় বুড়ো জবাব দিল— ‘কিঁউ নহি আয়েগা বাবু? হামেশা আতে হ্যায়। জগাহ্ তো উসিকি হ্যায়। হম হি বাহার সে আকে ব্যায়েঠ্ গ্যয়ে…!’ বলে আবার সিগারেটে টান দিল; আর সেই আসন্ন সন্ধ্যায় কালো হয়ে আসা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিল ভয়ে।
ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি রিসর্টের নিরাপত্তার দিকে হাঁটতে লাগলাম আমরা। দলমার ওপরে তখন ফুটে উঠছে সন্ধ্যাতারা। পিছনে, সেই গাছতলায় উদাস বসে থাকল লোকটা; যে বিশ্বাস করে— এই আরণ্যভূমি আসলে আরণ্যক প্রাণীদের। হাতির আর বাঘের, সজারু আর বনবরা’র। মানুষ সেখানে অনুপ্রবেশকারী-মাত্র। তবু, মিলেমিশে থাকা যায় বইকি। গাছ-পাহাড়-জানোয়ার-মানুষ…
যদি একে অপরকে একটু বোঝা যায়, তাহলেই থাকা যায় একসাথে।
আর আমরা, না-বোঝা শহুরেরা, ফিরে যাচ্ছিলাম আলো জ্বলা রিসর্টের দিকে… নতুন ভারতের দিকে…
৮
আগেই স্বীকার করে নেওয়া যাক, এটা শোনা গল্প। স্বাভাবিক, কেননা আমি তখনও জন্মাই নি। কিন্তু এতবার শুনেছি যে, মনে গেঁথে গেছে; যেন দেখেছি।
আমার মেজদা তখন কোলের ছেলে, এমনই দুরন্ত যে, জেঠিমা তাকে কোল থেকে নামানোর সাহস পেতেন না। একদিন বাড়িতে এল এক ভিখিরি; হাতে একতারা, গলায় কৃষ্ণকথা। শুনে জেঠিমা গেলেন ভিক্ষা দিতে, কোলে ছেলে— ধবধবে ফর্সা, একমাথা কোঁচকানো চুল একটি অপরূপ শিশু। হাতের কাঁসিতে খানিক চাল, একটা আলু— যেমন দিত সবাই সেকালে। ভিখিরি তার ঝোলা পাতল ভিক্ষা নিতে; আর অমনি ছেলের চোখে পড়ল— ঝোলার মধ্যে একটা পাকা মস্ত মর্তমান কলা; অন্য কারোর ভিক্ষার দান। ছেলে তক্ষুনি তার ছোট্ট হাত পেতে ভিখারিকে বলল—‘কলা দে! দে না!’
জেঠিমা লজ্জায় রাঙা ! ভাবছেন, কী বলে ছেলেকে সামলাবেন। এমন সময় তাকিয়ে দেখেন, ভিখিরির চোখ থেকে জলের ধারা নামছে ভাঙা গাল আর কাঁচা-পাকা দাড়ি বেয়ে। বাধো গলায় সে বলল— ‘মা, আমি সারা জীবন সবার কাছে হাত পেতেছি। আজ এই প্রথম ঠাকুর নিজে হাত পেতেছেন আমার কাছে। নাও ঠাকুর, খেও যখন ইচ্ছে হয়।’ এই বলে সে সেই শিশুর হাতে তুলে দিল তার ভিক্ষালব্ধ ধন।
এই আমার দেশ, যেখানে ভিখিরিকে ভিক্ষে দিয়ে নমস্কার করতে হয়, কেননা সে আমায় দান করার সুযোগ দিয়েছে। বসুধৈব কুটুম্বকম্। এ পৃথিবী আমার আত্মীয়।
৯
গ্যাংটকের নাগরিক অসভ্যতায় অধৈর্য হয়ে পালালাম ‘রিকিসুম’ নামের একটা পাহাড়ি গ্রামে। রংপো থেকে গাড়িতে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই গৃহিনীর ঝেঁপে জ্বর এল। হেমন্ত্ তামাং-এর বাড়িতে (মানে হোম স্টে-তে) যখন পৌঁছোলাম, তখন তার ধূম-জ্বর। ছোট্ট গ্রাম, কাজেই খবর চাউর হতে দেরি হল না। অচিরাৎ আট থেকে আশি আমার রুমে বিনা-অনুমতিতে ঢুকে আমারই গিন্নির কপালে হাত ছুঁইয়ে অযাচিত পরামর্শ দিতে লাগল— ‘আলগড়া ইয়া লাভা লে চলতে হ্যায়।’ আমি ক্যালপল খাইয়ে ছেলেকে নিয়ে পাইনের জঙ্গলে ধাঁ।
সন্ধ্যায় জ্বর ছেড়ে গেল। কাজেই আমি বারান্দার আড্ডায়, ন-বছরের ছেলে লেপ মুড়ি দিয়ে ফেলুদায়। এমন সময় ঘরে ঢুকল হেমন্তর অষ্টাদশী কন্যা, সুষমা; ছেলেকে লেপ থেকে বের করে এক ধমক দিল— ‘বই পড়তে এতদূর এসেছিস? চল্ আমার সাথে!’ বলে দু-জনে হাওয়া! নেই তো নেই! দু-ঘন্টা পরে খুঁজতে যেতেই হল; প্রচণ্ড চিন্তা হচ্ছে, চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, জঙ্গল, চিতা…
হঠাৎ সেই আরণ্যক অন্ধকারের মধ্যে ভেসে উঠল একটা বাড়ি। ঘরে মোমবাতির মায়াবি আলো। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে এক দঙ্গল বাচ্চাকে; আমার ছেলেটাও তাদেরই একজন, গিটার বাজাচ্ছে এক পাহাড়ি কিশোর, একসাথে গাইছে আমার (আর আমার ছেলেরও) খুউউব প্রিয় একটা গান… ছেলেও গাইছে…
Country roads, take me home…
কার যে কোথায় বাড়ি, এ দেশে বলা বেজায় মুশকিল, জানেন…