১০
ঠিক এই সময়— যখন আপনি স্থির করে উঠতে পারেন না সোয়েটার নামাবেন কি না, তখনই পরিযায়ী পাখির মতো আমাদের বাড়িতে আসতেন বেগ-চাচা। আসতেন কাশ্মীর থেকে শাল বিক্রি করতে। আমরা দুই ভাই তখন ছোটো। বেজায় খুশি হতাম তাঁর আগমনে; কেননা এসেই তিনি দিতেন চারটে আখরোট। দরজার কোণে চেপে ফাটিয়ে সেগুলো খেতাম আমরা, আর অসম্ভব সুপুরুষ বেগ-চাচা হাসিভরা চোখে তা দেখতেন। মা ছিলেন তাঁর দিদি। এই দুজনের কথোপকথন কান পেতে শুনতাম আমরা; কারণ চাচা বলতেন যাচ্ছেতাই বাংলা, আর মা তার চেয়েও খারাপ হিন্দিতে চাচার গেরস্থালির খবরাখবর নিতেন।
ছোটো ভাই থাকা সত্ত্বেও আমায় তিনি ডাকতেন ‘বাচ্চা’ বলে। আমার বিয়ে হয়েছিল শীতকালে। বিয়ের মাস-দুয়েক আগে এসে খবর পেয়ে চাচা ব্যস্ত হয়ে নতুন বউয়ের শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। তারপর আমায় বাগানে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, টাকার ব্যপারে যেন আমি সংকোচ না করি। বলে হাতে গুঁজে দিলেন এক বান্ডিল একশো টাকার নোট, কেন কে জানে। খুব হাসাহাসি হল তাঁর এই কীর্তি নিয়ে।
বিয়ের রাতে যা-তা কাণ্ড হল। নববধূর হাতে কী-একটা প্যাকেট ধরিয়ে চাচা তার হাতে তুলে দিলেন একটা মস্ত ঝুলি, তারপর সব্বাইকে শুনিয়েই বললেন— ‘আখরোট। বাচ্চা বালোবাসে।’ আবার সমবেত হাস্য, এবার অবশ্য আমায় নিয়ে।
পরদিন সকালে আবার এলেন বেগচাচা; এবং আমার তর্জন-গর্জনকে মোটেই পাত্তা না-দিয়ে নববধূকে ফর্মাল নেমন্তন্ন করলেন কাশ্মীরে। শুধু পৌঁছলেই হবে, বাকি দায়িত্ব তাঁর। ইতিকর্তব্য সব বুঝিয়ে দিয়ে শেষে একটা কাগজ বের করে কী একটা লাইন লিখে, সই করে এগিয়ে দিলেন। অক্ষরগুলো অচেনা। জিগ্যেস করলাম— ‘কী লিখলেন?’
অনেক মাথা চুলকে, ভেবে-চিন্তে বেগ-চাচা বললেন—‘লিকে দিলাম, এ লোক বালো আচে।’ আমার সমস্ত সাদামাটা, ব্যর্থতায়-ভরা জীবনকে নস্যাৎ করে এল চরম সার্টিফিকেট।
তাই বলছিলাম কী, এই দেশটাকে সিরিয়া বানানো ঠিক ততদিন অসম্ভব, যতদিন কোনো ‘বেগচাচা’ চোখ বন্ধ করে কোনো ‘রাজা ভটচাজ্’ সম্পর্কে লিখে দিচ্ছেন ‘লোকটা ভালো’।
‘খান’ আর ‘খুন’ যে সমার্থক নয়, তা জানার জন্য আমাদের কোনো শাহরুখ খান লাগে না মশাই!!
১১
অষ্টমীর রাত। কলকাতার রাস্তায় তখন মানুষের ঢেউ খেলছে। আর আমি মধ্যপ্রদেশ থেকে অনুষ্ঠান করে ফিরছি। একা। দুর্গ্ থেকে বম্বে মেলে উঠলাম মধ্যরাত্রে, গোটা কামরা তখন সুষুপ্ত। তিন রাত জাগা। কোনোক্রমে আপার-বার্থে উঠে খেয়েই ঘুম; সকালে রৌরকেল্লায় কচুরি খাব— এই প্রতিজ্ঞা-সহ।
ঘুম ভেঙে রোদ্দুরের রঙটা খুব সন্দেহজনক মনে হল। কোথায় যেন ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে জল দিতে দিতেই ছেড়ে দিল গাড়িটা; আর অমনি টের পেলাম— খুব…খুউউব খিদে পেয়েছে আমার। দেখি, ঘড়িতে বাজে এগারোটা! কিন্তু কোত্থাও না দাঁড়িয়ে চলতেই লাগল ট্রেনটা। আমার কাছে তো একটা বিস্কুটও নেই!
আগুন খিদে নিয়ে আপার বার্থে ব’সে রইলাম আমি। একটা বাজল। ক্রমে সব্বার ব্যাগ থেকে বেরুতে লাগল খাবার… খাবারের গন্ধে ভরে উঠল কামরাটা। মনটা অন্যদিকে ঘোরানোর একটাই উপায় আমি জানি। গান ধরলাম; প্রথমে মৃদুকণ্ঠে, তারপর স্বাভাবিক গলায়— ‘তেরো তন মেঁ রাম, মন মেঁ রাম/ রোম রোম মেঁ রাম রে…!’ ক্রমে থেমে এল কথাবার্তা, তারপর সবাই চুপ। খেয়াল করিনি প্রথমে। মন বসে গিয়েছিল।
হঠাৎ কে যেন বলল—‘বেটা, কচৌরি খাওগে?’ দেখি, নীচের বার্থের অবাঙালি ভদ্রলোক। হাতে শালপাতার দোনায় ক-টা কচুরি, একটু তরকারি। লজ্জা লজ্জা মুখ করে নিলাম। খাচ্ছি, উল্টো দিকের ছেলেটা একরাশ বাদাম ঢেলে দিল কোলে। আড়াআড়ি বার্থ থেকে এগিয়ে এল একটা দই-এর ভাঁড়। ‘আপ ফিরনি খাতে হো? আম্মি পুছ রহি হ্যায়।’— বলল সালোয়ার পরা, সুর্মা-চোখে একরত্তি মেয়েটা; তার বুরখা-ঢাকা মাকে দেখিয়ে।
সেদিন লজ্জা করছিল খুব, কিন্তু খিদে পেয়েছিল তার চেয়েও বেশি। আজ, লিখতে গিয়ে ততটা লজ্জা করছে না তো! বরং কৌতুহল হচ্ছে, আপনাদের মধ্যেই কেউ সেদিন আমায় নিজের খাবার এগিয়ে দেন নি তো? সেই অভুক্ত ছেলেটিকে?
আমাদের আবার ভিক্ষায় লজ্জা নেই। লজ্জা আছে দিতে না-পারায়।
১২
তখন সদ্য স্কুলে জয়েন করেছি। ট্রেনে যাতায়াত করি। এক সহযাত্রী রোজ যাওয়ার সময় আমায় বোঝাচ্ছেন, শিক্ষকরা পড়ায় না বলেই দেশের এই অবস্থা। রাজি হওয়ার ক্ষমতা আমার বিধিদত্ত, বাঁচোয়া। একদিন তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘আমরা বসে প্রস্রাব করি কেন, কলাপাতের উল্টোপাতে খাই কেন, জানেন?’ জানি না, বলায় তিনি কারণগুলো বললেন। অ্যাদ্দিনে বুঝলাম, তিনি মুসলমান। তারপর জানালেন, এ সবই কোরান-এ আছে। বিশ্বাস হল না। কাজেই পাড়ার লাইব্রেরি থেকে কোরান এল, আর তারপর যা হয়— মগ্ন হয়ে গেলাম এই মহাগ্রন্থে। বাহ্যজ্ঞান রইল না।
ক-দিন পর দুপুরে ট্রেনে ফিরছি। কোলে যথারীতি কোরানের গিরীশচন্দ্র-কৃত অনুবাদ। খেয়াল হল, সামনের সিটে বসা ভদ্রলোক উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন ক্রমাগত। জিগ্যেস করলাম— ‘দেখবেন?’ একটু অপ্রতিভ হেসে নিলেন। বেশ খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে ফেরত দিয়ে বললেন— ‘কী পার্থক্য আছে বলুন তো আমাদের আর আপনাদের ধর্মে ?’
বুঝলাম, তিনি আমায় মুসলিম ঠাউরেছেন। ভাসা ভাসা ভাবে বললাম, আসলে সব ধর্মই কিছু বেসিক ভালো কথা বলে, পরধর্মকে সম্মান, নারীর সম্মান…
উত্তেজিত ভাবে তিনি বললেন— ‘আমিও তো তাই বলি মশায়! এই যে ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ, এ তো আমাদেরই তৈরি…’ ইত্যাদি।
আমার স্টেশন এসে গেছে। উঠতে গিয়ে দেখি, পৈতেটা জামার সঙ্গে আটকে গেছে। গলার বোতামটা আলগা করে, ওটা পুরো বার করে আবার ঢোকাতে হল। ব্যাগটা নামিয়ে দেখি ভদ্রলোক বজ্রাহত চোখে চেয়ে আছেন। গম্ভীর গলায় বললেন— ‘আপনি হিন্দু ?’ মাথা নাড়তেই হল। ‘ব্রাহ্মণ?’ এবারেও হ্যাঁ।
এইবার তিনি রুদ্র কণ্ঠে বললেন— ‘হিন্দু হয়েও আপনি কোরান পড়ছেন! বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ-গীতা… এমনকী মহাভারত… আমাদের কী ধর্মগ্রন্থের অভাব? আর আপনি…ছি ছি…ব্রাহ্মণসন্তান…!’
সহিষ্ণুতা ভারী ঠুনকো জিনিস, জানেন ! একটু টোকা লেগেছি কি…
১৩
মধ্যমগ্রাম স্টেশনে নেমে এক ঠোঙা বাদাম কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফিরছি; কে যেন পিঠে একটা থাবড়া মারল। চমকে ফিরে দেখি— কালুদা। কী কাণ্ড! কালুদা এখানে?
অশোকনগরে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতাম, তার পাশেই একটা জুতোর দোকানে কাজ করত কালুদা। বিশেষ বিক্রি হত না, প্রায় সারাক্ষণই ফাঁকা দোকানে বসে বই পড়ত; নয় গুনগুন ক’রে গান গাইত। এক-একদিন হঠাৎ করে আমাদের কাছে এসে বলত—‘গান শুনবে?’ আমরা হই হই করে রাজি হতাম, কেননা মিষ্টি দরদি গলায় কালুদা শোনাত মুকেশের গান— ‘সুহানা সফর’ কিংবা ‘সাবন কা মাহিনা’। তারপর কোন্ কালে আমি চলে এসেছি এখানে, দেখাও হয়নি বহুদিন। ‘এখানে?’— জিগ্যেস করলাম আমি।
বলল, সে দোকান উঠে গেছে ছ-মাস আগে। চলত না। মালিক সাইবার কাফে করেছে। কালুদা ও সব বোঝে না। ফলে এখানে একটা জুতোর দোকানে কাজ নিয়েছে। ‘দিনে তিনশো টাকা করে দেয়, বুঝলে! কিন্তু কোনো ফিউচার নাই। ছাড়ব এবার। এক বন্ধু একটা গারমেন্টের কারখানা করেছে আমাদের বাড়ির কাছেই। ওখানেই জয়েন করতে বলছে। পনেরো হাজার দেবে। যথেষ্ট, কী বল রাজা? মেয়েটা তো ইলেভেনে উঠল স্টার পেয়ে। সন্ধ্যের মধ্যে বাড়ি ফিরে ওকে নিয়ে বসব, যেটুকু পারি। আর এবার একটু গান গাইব, বুঝলে! এমনি, নিজের মনে। তোমার বউদিও বলল, এবার একটু আমায় শোনাও দেখি! এখান থেকে তো ফিরতেই রাত এগারোটা। এইবার বোধ হয় ঠাকুর মুখ তুলে চাইলেন, শেষ বয়েসে। কী বল, জয়েন করেই যাই, হ্যাঁ?’
সাগ্রহে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল কালুদা, যেন এতদিন আমার মতামতের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আর আমি ভাবছিলাম, ন-হাজার থেকে পনেরো হাজারে পৌঁছে কী খুশি কালুদা! ভাবছিলাম, আজ সারাদিন আমরা হিসেব করেছি— টেন পার্সেন্ট ডি.এ. মানে কত টাকা। ভাবছিলাম সেই সরকারি কেরানি বন্ধুর কথা, চাকরি-করা মেয়ে ছাড়া যে বিয়ে করবে না বলেছে— কেননা একার আয়ে সংসার চলে না। সেই মেয়েটার কথা, যে শিক্ষিকা হয়েই ঘোষণা করেছিল, ডাক্তার ছাড়া বিয়ে করবে না। ভাবছিলাম সেই সহকর্মীর কথা, যে বলছিল, ফ্ল্যাট আর গাড়ির ই.এম.আই. দিতে হচ্ছে বলেই সে মা-এর অপারেশনটা করাতে পারেনি।
আর ভাবছিলাম, সেই কোনকালে বক-রূপী যক্ষকে বলেছিলেন যুধিষ্ঠির— ‘অঋণী অপ্রবাসী যে মানুষ স্বপাক শাক-ভাত খায় সন্ধ্যেবেলায়, সে-ই সুখী।’
আমরা তো শাকে-ভাতে সুখেই ছিলাম ! কে শেখাল আমাদের, সাফল্য, টাকা আর যশ— এসবের নামই সুখ?
ও কালুদা! আর কবে শেখাবে আমায়? আমাদের??
আর কালুদা আশা-ভরা চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে গুনগুন করছিল— ‘হম উস দেশ কে বাসী হ্যায়, যিস দেশমে গঙ্গা বহতি হ্যায়…’
১৪
মনে আছে, তখন আমি ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। এক ছুটির দিনে বসে আছি আমাদের ভাড়াবাড়ির বাইরের ঘরে, মাটিতে। অঙ্ক কষছি কাঁদো কাঁদো মুখে। বাবা ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে পেপার পড়ছে। এমন সময় ঘরে ঢুকল দুই কিশোর। মুখে-চোখে প্রগাঢ় গ্রাম্য ছাপ, শ্যামলা রং, সবুজ প্যান্টের হাঁটু অবধি ধুলো। বাবাকে প্রণাম করে পায়ের কাছে উবু হয়ে বসল তারা হাটুরে ভঙ্গিতে। তারপর বলল— ‘ছ্যার, আমরা খুব গেরাম থে এয়েছি। এলেবেনে (ইলেভেন আর কী) উটিছি এবার। দ্যাকলাম পাঁচখানা ছাবজেক্ট। তাও একবারে হপে না-নে। আপনে এবার তিনটে পাশ করায়ে দ্যান, তারপরের বার দুটো। তিন বছরে কিলিয়ার হইয়ে যাবে-নে।’ আমার সুগম্ভীর পিতার অমন উচ্চ হাস্য আমি এর আগে বা পরে কক্ষনো শুনি নি। বাবা অনার্স থেকেই পড়াত; কিন্তু এই আশ্চর্য ইন্ট্রুডাকশানের সুবাদে এই দুই গ্রাম্য কিশোর তার ছাত্র হয়ে গেল। আব্দুল হাই, আর মুশতাক আলি।
তিন বছর লাগে নি অবিশ্যি। দু-বছরে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে বাংলা অনার্সে ভরতি হল মুশতাকদা আর হাইদা— ততদিনে ওই ডাকদুটো রপ্ত হয়ে গেছে আমাদের। গরমের দিনে আম, কিংবা শীতের দিনে তারা নিয়ে আসত নতুন গুড়; বাবাকে এড়িয়ে সোজা নিয়ে যেত মা-র কাছে। মা বকত, তারপর খুব মায়া ভরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলত— ‘ভালো করে পড়ো বাবা।’ তারা দু-জন বিগলিত হয়ে যেত গুরুপত্নীর আদরে, আর প্রতিজ্ঞা করত— ‘সে আর বলতি হবে না মা!’ বাবা তাদের বাড়িতে ছুটত মাছ ধরতে।
ইতিমধ্যে আমাদের বাড়ি হল, কোনোক্রমে উঠল দু-খানা ঘর। সেই নতুন বাড়ি ভাড়াবাড়ি থেকে বড়জোর পাঁচশো গজ দূরে। জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাকা হল একটা ভ্যান— তেমন ভারি কিছু তো ছিলও না। খাট-বিছানা তাতেই উঠল। মুশতাকদা’রাই তুলল সব ধরাধরি করে, বাবার ‘ওরে তোরা পারবি না রে’ ইত্যাদি শুনে হাসলও খুব। গোল বাঁধল মা-র মস্ত ঠাকুরের আসনটা নিয়ে। সেটা নাকি কিছুতেই ও রকম ভাবে তোলা যাবে না ভ্যানে, কে জানে, হয়তো আমিষ কড়াইটাই আছে বাসনপত্রের মধ্যে ! খানিক বাকবিতণ্ডার পর মুশতাকদা হঠাৎ বলে উঠল—‘ধুত্তোর! মা, এ এক্কেরে হালকা জিনিস। মাথায় কইরে নিয়ে চইলে যাই? এটুনি তো পথ!’
মা তীক্ষ্ণ কোপকটাক্ষে আমার পণ্ডিত পিতাকে ভস্ম করে দিয়ে বললেন— ‘হ্যাঁ বাবা, তোমাদের স্যারের এত জ্ঞান, শুধু যদি সাধারণ বুদ্ধিটা থাকত। ঠাকুরের আসন তুলছেন আঁশবঁটির সঙ্গে। তোলো তো আসনটা। দেখো, ওটা কিন্তু গঙ্গাজলের শিশি! হাতে নাও, আবার ভ্যানে তুলো না এঁটোকাটার সঙ্গে।’
ছায়াঢাকা মফস্সলের পথ দিয়ে ঠাকুরের আসন মাথায় নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল মুশতাকদা। আর গঙ্গাজলের পাত্র বা কোশাকুশি— সব নিয়ে যাচ্ছিল হাইদা। খুব হাসছিল ওরা। এ বইতে নাকি আবার গাড়ি লাগে! হেঃ!!
১৫
এ আমার অতি দূর শৈশবের গল্প— সেই যখন চেনার চৌহদ্দি ছিল বাড়ির সামনের মাঠ আর মাঠের কোণের ইশকুল পর্যন্তই। বাড়িতে কার্তিক পুজো হত। তাতে দরকার পড়ত ধানের ছড়ার— যা দাদা আনত মাইল দু-এক দূরের ধানক্ষেত থেকে। সে ধানক্ষেত তখন ছিল পৃথিবীর দূরতম প্রান্ত। হঠাৎ একবার আমায় আর আমার পিঠোপিঠি জাঠতুতো ভাইটিকে সেই ধান আনার দায়িত্ব দেওয়া হল। ‘বড়োই হয়ে গেলাম তাহলে!’— এরকম একটা গর্বিত ভাব নিয়ে আমরা রওনা দিলাম দুজনে। আমি যেমন কালো, ভাইটি তেমন ধবধবে ফর্সা। লোকে এই বৈপরীত্য নিয়ে হাসত বটে, কিন্তু বালকের রাজত্বে বর্ণবৈষম্য থাকে না।
বাড়ির সামনের রাস্তাটাই সোজা গেছে ধানক্ষেতে। সমস্যা হল না। কিন্তু সেখানে পৌঁছে আমরা হাঁ হয়ে গেলাম। তখন বিকেল শেষ হচ্ছে। ধানের বিশাল ক্ষেতের উপর জমেছে কুয়াশার চাদর। মৃদু হাওয়ায় কাঁপছে সেই কুয়াশা, দুলে দুলে উঠছে মাঠভরা ধান; যেন লক্ষ্মীর পায়ে বেজে উঠছে মল। পায়ে পায়ে আমরা নেমে গেলাম মাঠে। আল ধরে হাঁটতে লাগলাম সম্মোহিতের মত। রূপের পাথারে ডুবে গেল দুই বালকের আঁখি। এবং স্বভাবতই, কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, আমরা হারিয়ে গেছি। যতদূর দেখা যায়— শুধু খেত খামার। রাস্তাটাও আর দেখা যাচ্ছে না। একটি মানুষ নেই কোত্থাও। খানিক ভ্যাবাচ্যাকা দাঁড়িয়ে থেকে আমরা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম।
ঠিক তখনই, সামনের ঝোপঝাড় ভেদ করে উঠে এল একটা লোক। দৈত্যাকার, কালো; হাত থেকে জল ঝরছে। সোজা আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ভাঙা খসখসে গলায় বলল— ‘তোরা হারায়ে গেছ?’ ছেলেধরা! আরও জোরে কাঁদার আগেই লোকটা আমাদের মাথাদুটো ধরে নিয়ে হাঁটা দিল। চোখ মুছতে মুছতে আমরাও।
খানিক পরেই ম্যাজিকের মতো ভেসে উঠল চেনা বাড়িটা। এ কী! সোজা ঠাকুমার ঘরের সামনে এসে ‘অ মা-ঠাইরেন!’ বলে হাঁক দিয়ে সিঁড়িতে বসল লোকটা; পিঁড়িতে বসা ঠাকুমাকে বলতে লাগল— ‘কান্না শুইন্যা দেহি দুইডা পোলা। ভটচাইয-বাড়ির কালাডা আর ধলাডা। অমনি ধরসি— হারাইয়া গ্যাসেগা। দ্যান মা, মুড়ি দ্যান। খাই নাই অহনতরি।’ শুনে বড়মা ব্যস্ত হয়ে ছুটল মুড়ি আনতে; আর ঠাকুমা শুধোল—‘অ হারাণ! তর পোলাডায় নি বিয়া করল ?’
কতবার পথ হারিয়েছি আমরা! ঠিক কেউ-না-কেউ এসে আমাদের বাড়িতে দিয়ে গেছে। কখনো সে এসেছে সেই নেপালের কুশীনগর থেকে, কখনো নবদ্বীপ থেকে। কখনো জন্মেছে মুসলিম জোলার ঘরে, কখনো বীরসিংহের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। কখনো তাকে দেখেছি নীল-পাড় সাদা শাড়িতে ‘নির্মল হৃদয়’; কখনো জোব্বা আর লম্বা দাড়িতে। পথ ঠিক মিলে গেছে আমাদের।
আর আজ, এই ধর্ম আর রাজনীতির কুয়াশায় পথ হারিয়ে যখন কেঁদে উঠছি, তখন কেউ উঠে আসবে না ধানক্ষেত থেকে? তাই হয়! কে যেন কথা দিয়েছিল—‘সম্ভবামি যুগে যুগে!’
১৬
আমাদের উত্তরাপথ-পরিক্রমা শুরু হয়েছিল হরিদ্বার থেকে। বীভৎস ট্রেন-জার্নিতে বিধ্বস্ত হয়ে সকালে পৌঁছে দুপুরে টেনে ঘুম লাগালাম। বিকেলে এক কাপ চায়ের আশায় বাইরে, গঙ্গার তীরে এসে দাঁড়ালাম। বেলা পড়ে এসেছে তখন; নদী থেকে বয়ে আসছে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস— শরীর আড়ষ্ট হয়ে আসছে। চা যে কী বস্তু… আহা… এমন সব সময়েই বোঝা যায় গো! গেলাসটা হাতে চেপে নেমে গেলাম ঘাটের শেষ ধাপটায়।
এমন সময় পাশে এসে দাঁড়াল একটি মেয়ে। শ্বেতাঙ্গিনী, অপূর্ব সুন্দরী তরুণী। কিন্তু তার নীল চোখে গাঢ় বিষাদ। একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে, ধীর নিশ্চিৎ পদক্ষেপে সে নেমে গেল সেই বরফ-ঠাণ্ডা জলে। গলা-জলে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে, একটা ডুব দিয়ে সে উঠে এল জল থেকে। তারপর আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সিঁড়ির শেষ ধাপে সে বাবু হয়ে বসল, হাত রাখল হাঁটুতে। তাকে দেখে আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল ঠাণ্ডায়। তারও ঠোঁট কাঁপছিল; কিন্তু শীতে নয়। সে কিছু একটা বলছিল। বিজাতীয় উচ্চারণ সত্ত্বেও সেই শব্দগুলো বুঝতে আমার ভুল হল না। সে বলছিল—‘গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী…!’ সন্তর্পণে আমি উঠে এলাম ঘাট থেকে, যেন আমার পদশব্দেই তার ধ্যানভঙ্গ হতে পারে।
রাস্তায় উঠতেই আমার সামনে এসে দাঁড়াল একটা স্কুটার। ঠিক আমার সামনে নয়, এক থুত্থুরে বুড়ো সাধুর সামনে। চালকটির পরনে একটা রঙচঙে জ্যাকেট; চুল লাল রং করা, এক কানে দুল, মুখে নির্ঘাৎ পানপরাগ। ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’— মনে হল আমার। ছোকরা সোজা সেই বুড়োর সামনে স্কুটার থামিয়ে একটা বিচ্ছিরি শিষ দিল। রাগে মাথা জ্বলছিল। ছেলেটা হাল্কা গলায় বলল— ‘কী বুড়ো, আজও কেউ জোটে নি?’
মাথা নাড়ল বুড়ো, পরনে তার একটা ছেঁড়া বস্তা। ছোঁড়া অমনি নামল স্কুটার থেকে; তারপর টুক করে বুড়োকে তুলে বসিয়ে নিল পেছনের সিটটায়। তারপর বলল কপাল চাপড়ে— ‘কোথায় খুবসুরত গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরব, তা না, হররোজ তুমহি মিল যাতে হো! নসিব! কপাল! চল, কী আর করা! নামিয়ে দিই। খেয়েছ কিছু ভিক্ষে জুটল?’ আরও কী সব ইয়ার্কি করতে করতে স্কুটারে স্টার্ট দিল ছোকরা। ‘সমকাল’এসে নিয়ে গেল ‘সনাতন’কে।
কে যে কীভাবে খোঁজে, কী খোঁজে, কী পায়… এ দেশে বলা ভারি মুশকিল মশাই, যাই বলুন! সব নদীর জল এমন মিশে আছে…!
১৭
বাবা শীতকালটাকে বেজায় ভালবাসত। রীতিমতো ‘সেলিব্রেট’ করত বলা যায়। আমাদের সংসারে শীত আসত বাবার নিয়ে আসা কফির গন্ধে, কখনো-সখনো আমরা তার ভাগ পেতাম। উঠোনে রোদ্দুরে বসে তেল মেখে স্নান করত; অস্বস্তিতে পড়ত সামনের পথ দিয়ে হেঁটে-যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা। বাবা নির্বিকার। একসাথে খেতে বসতাম সেই রোদ-নিকোনো উঠোনে।
একদিন সেই উঠোনে হঠাৎ ঢুকে পড়ল এক বুড়ো। গোঁফ নেই, পাকা দাড়ি, পরনে একটা খুব নোংরা লুঙ্গি আর ফতুয়া। চোখে কেমন একটা জলে-ডোবা দৃষ্টি; যেন এই পৃথিবীর মস্ত ব্যাপার-স্যাপার ঠিক ধরতে পারছে না। হাতে একটা বালতি আর একটা মস্ত কাঁচের বয়াম। বালতিতে দুধ, বয়ামে ঘি। বিনা ভূমিকায় বলল— ‘দুধ নেবেন গো? ঘি কিনবেন? বাড়িতে পেতিচি নিজে!’
এই অবেলায় এমন আবদার! বাবা কিন্তু একটুও না-ঘাবড়ে ধোঁয়া-ওঠা ভাতের থালাটা এগিয়ে দিয়ে বলল— ‘দ্যান দেখি ঘি! আগে খেইয়ে দেখি!’ আর লোকটাও তাড়াতাড়ি খানিক ঘি বাবার পাতে ঢেলে দিয়ে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল— যেন এই পরীক্ষার উপরেই ওর তাবৎ বিক্রিবাটা নির্ভর করে আছে। আর জায়গাটা ম ম করে উঠল ঘিয়ের সুবাসে। কেনাকাটাও হল।
তারপর থেকেই মাঝে মাঝে আসত বুড়ো। ছুটির দিনে। রোজ বিক্রি করত না; কিন্তু ওর ভাঙা সাইকেলে ঝুলত বালতি, ক্যারিয়ারে থাকত এঁচোর বা ঝুনো নারকোল, মোচা বা থোড়— এইসব। বাবা কোনোদিন কিনত, কোনোদিন কিনত না; দুজনে গল্প করত বসে। একজন এম.এ. পড়ায়, আর একজন লিখতে জানে না। সবাই বলত, লোকটা বাবাকে বোকা পেয়ে ঠকায়, ওর জিনিসগুলো বাজে। কোথাও বিক্রি হয় না বলে ও বাবাকে গছিয়ে দেয়। বাবা শুনে খুব হাসত; বলত— ‘যাক, এতদিনে একজন চিনেছে তাহলে!’
বাবার মৃত্যুর পরের দিন এলো বুড়ো। আমি ধড়া পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। দু-দিন পরে পার্ট ওয়ান পরীক্ষা। শোকের বাড়ির মূর্তি দেখলেই চেনা যায়। বালতিটা হাতে নিয়ে আমায় দেখে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল বুড়ো। বলল—‘কী হয়েছে?’ বলতে হল। ‘হায় আল্লা!’ বলে আঁতকে উঠে কপালে হাত দিল সে; হাত থেকে বালতিটা রাস্তায় আছড়ে পড়ল ঝনঝন করে, কালো রাস্তায় সাদা দুধের ঢেউ খেলে গেল। বললাম, ‘একটু দাঁড়ান।’ বলে ভেতরে গেলাম টাকা আনতে; ওর লোকসানটুকু পুষিয়ে দিতে ইচ্ছে করল সেদিন।
ফিরে দেখি, বুড়ো চলে গেছে। শুধু কালো রাস্তায় সাদা দুধের দাগ। আর কখনো, কোনোদিন দেখি নি তাকে।
আমরা এইরকমই। কেন ভালবাসি, কাকে যে বন্ধু বলে মানি— কে জানে!
১৮
ছেলেকে আমি যেদিন প্রথম ধানখেত দেখাতে নিয়ে যাই, সেদিনটা ছিল একেবারে রচনা বইয়ের ‘শীতের সকাল’-এর মতো। মাথার উপরে নীল একটা পেয়ালা কে যেন উপুড় করে দিয়েছে। ঝকঝক করছে সকালের রোদ্দুর আর রোদ পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে শিশিরে ভেজা ঘাস। একটু পরেই বাড়িঘর শেষ হয়ে গেল। নয়ানজুলির ওপারে তখন ধান কাটা হয়ে যাওয়া মাঠ; আরও দূরে সর্ষের আবাদ। আগে আগে তড়বড়িয়ে হাঁটছিল ছেলে, ছটফটে নদীর মতন; সর্ষেখেত তখন তার প্রায় মাথায় মাথায়। আর আমি তাকে শেখাচ্ছিলাম আলের উপর দিয়ে কেমন করে হাঁটতে হয়, কেমন করে পেরিয়ে যেতে হয় নুয়ে-পড়া গাঢ় হলুদ রঙা সর্ষেফুল। শীতের তাপহীন রোদ্দুরে ঝলসে উঠছিল খেত খামার।
অনেক হাঁটাহাঁটির পর ক্লান্ত বাপ-ব্যাটায় গিয়ে বসলাম আরও দূরের কলাবাগানের নীচের নিকোনো মাটিতে। আমি বসলাম মাটিতে বাবু হয়ে; ছেলে বসল কোলে, আড়াআড়ি ভাবে— আমার বুকে মাথা রেখে। মনে পড়ছিল বাবার সঙ্গে এই মাঠে আসার কথা, নয়ানজুলিতে মাছ ধরার কথা। আমিও কী এমনি করে কোলে বসতাম? মনে নেই তো! এক পিতৃহীন পিতা বসে থাকল পুত্রকে কোলে নিয়ে। ফসলের খেতের পাশে, কলাবাগানের ঠাণ্ডা ছায়ায়। পাখপাখালির ডাক, আর জলের পাম্প চলার আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ পৌঁছয় না— এমন এক দূরে।
হঠাৎ বেজায় উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল ছেলে। বলল— ‘ও বাবা, তোমার বুকের মধ্যে না… ডিগি ডিগি করে একটা শব্দ হচ্ছে। কেন বাবা?’
বললাম— ‘তা তো হবেই! ও হৃদপিণ্ডের চলার শব্দ যে!’
ছেলে আবার আমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে খানিক শুনে মাথা তুলল— ‘হ্যাঁ বাবা, এখনও হচ্ছে! আমার হয়? শোনো তো!’— বলে উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথাটা টেনে নিয়ে চেপে ধরল তার সোয়েটারে ঢাকা ছোট্ট বুকে। আমি বললাম— ‘হ্যাঁ বাবা, খুব হচ্ছে, আমার চেয়ে বেশিই হচ্ছে। এ তো সব প্রাণীরই হবে।’
‘ও!’— বলে খানিক চুপ ক’রে থেকে আরও উত্তেজিত গলায় বলল— ‘ওইরকম আর একটা শব্দ হচ্ছে বাবা, তুমি শুনতে পাচ্ছ ?’ কান পেতে শুনলাম, দূর থেকে ভেসে আসছে পাম্প চলার শব্দ। সেটা বলার আগেই ছেলে বলল— ‘এটা কী মাটির নিচ থেকে আসছে বাবা? পাতাল থেকে! ‘বলে কোল থেকে নেমে সে উপুড় হয়ে কান পাতল মাটিতে। একটু পরেই চোখে রাজ্যের বিস্ময় ভরে সে তাকাল আমার দিকে— ‘হ্যাঁ বাবা! শোনো, এটা পৃথিবীর হৃদপিণ্ডের শব্দ গো !’
এইমাত্র শিখেছে হৃদপিণ্ড শব্দটা, অমনি বলা চাই— ভেবে হাসি পেল আমার। কিন্তু ততক্ষণে ছোট্ট হাত দিয়ে জামা টেনে সে আমায় শুইয়ে দিয়েছে মাটিতে। তার পাশে শুয়ে জীবনে প্রথমবার মাটিতে কান পাতলাম আমি, আর শুনতে পেলাম— মাটির গভীর… অতি গভীর কোনো অতল থেকে ভেসে আসছে শব্দ— ধুক পুক ধুক পুক…
আর কতবার শেখাতে হবে আমায়— এই পৃথিবী এক প্রাণবান সত্ত্বা! সে বেঁচে আছে…খুশি হয়… কাঁদে… তার বাতাসে মধু আছে, নদীরা মধু ক্ষরণ করে আমাদেরই জন্য… মধু বাতা ঋতায়তে…
এই দেশ কী কোনো শিক্ষাই দেয় নি আমায় ?
ছেলের পাশে শুয়ে, মাটিতে কান পেতে আমি শুনতে লাগলাম জননী বসুমতীর হৃদস্পন্দন!
১৯
আমাদের মফস্সল শহরটা হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে অনেকটা জায়গা নিয়ে। আর যেখানে সেটা হঠাৎ ফুরিয়ে যায়, সেখান থেকে একটা মাটির রাস্তা নেমে গেছে প্রতীকের মতো। একটু এগোলেই আদিগন্ত খেত খামার, যতদূর দেখা যায় ধূ ধূ মাঠ। ধান, পাট, নানান সবজির চাষ।
এক হেমন্তের সকালে এই মাঠের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে প্রথম দেখেছিলাম নীলকণ্ঠ পাখি। নরম আলোয় ভরা মাঠ রঙের দ্যুতিতে ঝলসে দিয়ে সে উড়ে গিয়েছিল আমার মাথার উপর দিয়ে। যা হয়, বিকেলেই আবার গেলাম সেই একই জায়গায়— অবিশ্যি এবার গিন্নি আর ছেলেকে নিয়ে। একা একা সুন্দরকে দেখতে ভালো লাগে? আর সেই নীলকণ্ঠও বাধ্য ছেলের মতো দেখা দিয়ে গেল আমাদের। মুগ্ধ শিশুর মতো তারপর আমরা নেমে গেলাম মাঠে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটছিলাম আমরা; উঁচু রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা বাইকটা যেন দেখা যায়— এইটুকু খেয়াল রেখে।
এমন সময় একটা লোক আমাদের পথ আটকাল। রোদে পোড়া চেহারা, গালে কয়েকদিনের বাসি দাড়ি, লুঙ্গি আর শার্ট পরা। বলল— ‘আপনারে পেরায়দিন দেখি একেনে। জমি কেনপেন (কিনবেন) নাকি?’ মাথা নাড়তে বলল—‘তবে?’ খানিক ভেবেচিন্তে বললাম—‘দেখতে আসি।’
চোখ কপালে তুলে বলল— ‘একেনে দেখার আছেটা কী? সবজি দেকতি হয় খেইয়ে। আসেন।’ বলে এ কথা ও কথা বলতে বলতে আল ধরে চলতে লাগল লোকটা। নাম বলল খায়েশ। আমি ইশকুলে পড়াই শুনে সগর্বে জানাল— ও নিজেও মেয়ের স্কুলের কমিটি মেম্বার, সিক্সে পড়ে সে। বলে হঠাৎ দেখাল— একটা বরবটির খেতে ফসল তুলে গোছা করছে বাচ্চা একটা মেয়ে, পাশের রোগাপানা মহিলা নিশ্চই ওর মা। টপাটপ একগাদা বরবটি তুলে বিনা ভূমিকায় আমার গিন্নির আঁচলে তুলে দিল খায়েশ— একটা করে হাতে দিয়ে বলল— ‘কাঁচা খালিও এ যেন অমর্ত! দেকেন খেইয়ে!’ তারপর একে একে খান পাঁচেক বেগুন, এক মুঠো লংকা, গাদা খানিক সিম। বোঝাই হয়ে গেল গিন্নীর আঁচল, আমার পকেট। আপত্তি করার সুযোগই পেলাম না।
হঠাৎ ছেলে বলল— বাইকটা দেখা যাচ্ছে না। আমি ব্যস্ত হলাম ফেরার জন্য, খায়েশ অবিশ্যি নির্বিকার— ‘একেনে কে চুরি করপে? আর আপনের বাইক সবাই চেনে। লাল’ডা না?’ তা নয় হল। কিন্তু এই অ্যাত্ত সবজি ! গিন্নি চোখের ইশারায় বললেন কিছু দিতে। একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে দিতে গেলাম।
একটু হেসে খায়েশ বলল— ‘আপনের বাড়িতি বন্ধু গেলি বুঝি চা খাইয়ে টাকা নেন আপনে?’ বন্ধু! এই তো সদ্য আলাপ হল আমাদের! এইভাবে বন্ধুত্ব হয় বুঝি, এক মাস্টার আর এক চাষীর?
ফিরতে ফিরতে মনে হল— হলে এভাবেই হয়। জানতে হয়, কাকে বলে বন্ধুত্ব। জানতাম। ভুলে গেছি।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল বাইকটা। শহরে ফিরতে হবে। অবশ্য সেখানে কোনো বন্ধু অপেক্ষা করে নেই… তবু…
পিছনে ফিরে দেখলাম— সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে আসা মাঠে আলের উপর দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে একটা আবছা লোক। পাশে রোগাপানা বউ, আর ছোট্ট একটা মেয়ে।