অখণ্ড ভারতবর্ষ – ৫০

৫০

বছর দুই আগের কথা। এমনই ঘনঘোর বর্ষা নেমেছে। মেট্রো স্টেশন থেকে যখন বাইরে এলাম, আকাশ তখন থমথম করছে; কোলকাতার উপর জমেছে শ্রাবণের ছায়া। যে-কোনও মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে— এই ভেবে অভ্যেসমতো বাঁ দিকের ফুটপাথ ধরে জোরপায়ে হাঁটতে লাগলাম আমি। কিন্তু দু’টো গলি পার হতেই ঝমঝমিয়ে নামল তুমুল বৃষ্টি। এ বৃষ্টি ছাতায় মানার নয়। কোনোক্রমে এক ছুটে গিয়ে ‘ভারতীয় ধর্মশালা’ লেখা প্রকাণ্ড বাড়িটার গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়ালাম। যাক বাবা, স্বস্তি।

এইবার চারিদিকে একটু চোখ বোলাতেই অবিশ্যি সে স্বস্তি উবে গেল। আমি ছাড়াও একটি দল আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। তাদের দিকে তাকিয়ে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল। এই পাড়ার প্রায় সর্বত্র দেখা যায় এদের— খালি গা, প্যান্ট ছেঁড়া, এবং তাও বিপদসীমার নীচে ঝুলছে। সর্বাঙ্গে নোংরা, সারাক্ষণ নেশা করার ফলে রোগা টিঙটিঙে চেহারায় বুভুক্ষার ছাপ। আপাতত দলা পাকিয়ে বসে আছে এককোণে, আর কাঁচা খিস্তি করছে উচ্চস্বরে। ঘোষিত পাতাখোরের দল যাকে বলে।

অপ্রসন্ন মনে চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকালাম। বৃষ্টি একটু কমেছে; মনে হচ্ছে থেমে যাবে এবার। প্যান্টটা গোটাবো বলে নীচু হতে যাচ্ছি— এমন সময় চোখে পড়ল একটা অদ্ভুত ব্যাপার। উল্টো ফুটের চারতলা বাড়িটার ভিজে প্লাস্টারে যেন হঠাৎ ফুটে উঠছে একটা মানচিত্র। পরের মুহূর্তেই ভুল ভাঙল। না, ওটা মানচিত্র নয়। খসে পড়ছে পুরনো বাড়িটার তিনতলার প্লাস্টারের মস্ত একটা অংশ। বুঝে ফেলা মাত্র বুক হিম হয়ে গেল আমার। তৎক্ষণাৎ চোখ গেল নীচে— দেখলাম— ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়িটার নীচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি, মাথায় ছাতা। উন্মাদের মতো চিৎকার করতে গেলাম আমি— গলা থেকে স্বর বেরলো না! আর তারপর— যেন প্রথমে স্লো-মোশনে, তারপর আচমকা বিদ্যুতবেগে ভেঙে পড়ল প্রকাণ্ড চাঙরটা— সোজা সেই বৃদ্ধার মাথায়। একটা শব্দও না-করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। পাশের বৃদ্ধটি যেন পাথর দিয়ে গড়া, স্থানু।

আমি তখনও স্তম্ভিত, নড়ার সময় পাই নি। এই সময়, এক লাফে উঠে দাঁড়াল সেই ‘দলা-পাকান‘পাতাখোরের দল। তীব্র চিৎকারে ছুটন্ত ট্র্যাফিক থামিয়ে, রাস্তার মাঝের ডিভাইডার হিংস্র লাফে টপকে তারা নিমেষে পৌঁছে গেল ওপারে। একজন পাশের গ্যারাজের সামনে রাখা একটা ভ্যানের চাকার তালা ভেঙে ফেলল ইটের এক ঘায়ে, আর সেই পড়ে থাকা বৃদ্ধাকে তাতে তুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুট লাগাল ধর্মতলার দিকে। পিছনে পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন সেই বৃদ্ধ। গোটা ঘটনাটা ঘটল চোখের নিমেষে; আমি তখনও নড়ার অবকাশ পাই নি।

আরও মিনিট-দশেক পরে থেমে গেল বৃষ্টি। হাঁটা লাগালাম আমিও। লেট হয়ে যাবে এবার। রাস্তা পার হলাম। এইখানে একটা নার্সিংহোম হয়েছে সম্প্রতি। তার সামনে একটা ভ্যানে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন দামী শাড়ি আর চওড়া সিঁদুর পরা এক বৃদ্ধা। আর তার একটু দূরে একদল পাতাখোর ছেলে। এখন তাদের চোখে জল।

আর তাদেরই একজনের খোলা বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন এক ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, সৌম্য চেহারার বুড়ো মানুষ। ছেলেটার হাত তাঁর পিঠে, সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে।

কোলকাতার আকাশে মেঘ যেন উপুড় হয়ে পড়ে আছে সেই শোকের সাক্ষী হতে।

৫১

এটাও আমার শোনা ঘটনা। তাই, নিজের নয়— লিখে ফেলি তারই জবানিতে— যার কাছ থেকে শুনেছিলাম ঘটনাটা। প্রায় হুবহু।

—‘অনেক ঝঞ্ঝাট সামলে তো বিয়ে হল আমার। প্রণয় থেকে পরিণয়— কাজেই বিয়ের আগেই শ্বশুরবাড়িতে কেউ কেউ চিনতেন আমায়। ছোট বা সমবয়সীরা তো বটেই, গুরুজনদের মধ্যেও অনেকেই দেখেছেন আমায়। আমিও অনেককেই চিনি— এমন একটা ধারণা ছিল। কিন্তু বিয়ের পরদিন সন্ধ্যায় শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে মাথা ঘুরে গেল। আমিও যথেষ্ট বড়সড় পরিবারের মেয়ে— মেলা আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু এ একেবারে অন্য ব্যাপার। আমার শ্বশুরমশাই ছিলেন (বহুদিন আগেই গত হয়েছেন তিনি।) দশ ভাইয়ের মধ্যে নবম। সেই ভাইদের ছেলে-মেয়ে, সেই ছেলেদের গিন্নি আর মেয়েদের বর— এবং তাদের ছেলে-মেয়ে, মামাবাড়ির দিকের আত্মীয়রা — সব মিলিয়ে একটি সাগর-বিশেষ। তার উপর পাড়া-প্রতিবেশীরাও এসেছেন নববধূর দর্শনার্থে। কে যে কার কী হয়— সেটুকু উদ্ধার করতেই আমার নিদেনপক্ষে একটি মাস লাগবে— তদ্দণ্ডেই বুঝে ফেললাম আমি। কালরাত্রি কাটালাম দিদার পাশে শুয়ে রাত তিনটে অবধি গল্প করে— কেননা পাশের ঘরটির মেঝেতে ঢালাও বিছানায় যে জনা-কুড়ি মানুষ রাত কাটাচ্ছেন— তাঁরা কথা বা হাসি— কোনটাই গলা-চেপে করেন না। ঘুমনো অসম্ভব।

পরদিন সকালে বুঝলাম— ওটা ছিল ট্রেলার। আসল সিনেমা শুরু হয়েছে এইবার। সে একেবারে জনস্রোত। অধিকাংশই গুরুজন— প্রণাম করেই চলেছি যন্ত্রের মতো— মুখে বাঁধা হাসি। রাজ্যের বাচ্চাকাচ্চা খাট জুড়ে বসা— তাদেরও সবাইকে চিনি না; আর যাঁদের প্রণাম করছি— তাঁদের তো চেনার প্রশ্নই ওঠে না। বসছি না আর তখন— দাঁড়িয়েই আছি।

এমন সময় আমার শ্বাশুড়ি-মা ঢুকলেন ঘরে; সাথে চারজন নানাবয়সী মহিলা। ধোপদুরস্ত শাড়ি পরা, মুখে অপ্রতিভ হাসি, হাতে গিফটের বাক্স। মা বললেন— ‘এঁরা সব তোমায় দেখতে এসেছেন। রাত্তিরে ভীড়ের মধ্যে হয়তো ঠিক মতো আলাপ হবে না, তাই সকালেই…’

অভ্যেসমতো প্রণাম করতে গেলাম— অমনি তাঁরা এক-হাত জিভ কেটে শশব্যস্ত হয়ে পিছিয়ে গেলেন—‘আরে আরে কর কী, ও বউমা…দেখ কাণ্ড!’ —ইত্যাদি বলে। মা কিন্তু ভুরু কুঁচকে দাপুটে গলায় বললেন— ‘ওই দেখ, নতুন বউ, বাড়ির লোকেদের পেন্নাম করবে না প্রথম দিন?’ আমিও ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করলাম তাঁদের, তাঁরাও আমার হাতে উপহার তুলে দিয়ে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন।

এইবার শ্বাশুড়ি-মা বললেন—‘আলাপ করিয়ে দিই— এ হল ছায়া। তোমার বর বলতে গেলে এর হাতেই বড় হয়েছে— আমি তো স্কুলে চলে যেতাম, ছায়াই দেখত ওদের দুই ভাইকে। এ হল রূপালী— এখন বাড়ির ভার এর হাতে। এই যে— মাসি— কাচাকাচির সব দায়িত্বে আছে। আর এ হল সুভদ্রা— তোমার বিয়ের জন্য কাজ ছেড়ে দিয়েছে গত মাসে— পাগল আর বলে কাকে!’

এতক্ষণে বুঝলাম— এঁরা সকলেই মায়ের সহকারিণী— তাই এঁদের প্রণামে এত সংকোচ। তা নয় হল— কিন্তু আমার বিয়ের জন্য কাজ ছেড়ে দেওয়ার মানেটা কী? লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করে বসলাম। একটু অপ্রস্তুত হেসে সুভদ্রামাসি বললেন— ‘অনেকদিন তো কাজ কত্তিসি এ বাড়িতি। এরা যে কী ভালবাসে, তা কি বলপ তোমারে বৌমা। তোমার বর তো অফিস যাওয়ার আগে মা-রেও যের’ম বইলে যায়— আমারেও বইলে যায়— ‘‘আসছি মাসি…।’’ তাই ভাবলেম— নতুন বউ যদি আইসে এট্টাও খারাপ কতা বলে— ও আমি সহ্য কত্তি পারব না। তাই বোনেরে বললাম— তুইই কর এখন থে। আমি আর করপ না নে।’

আমি থ। বলতে বলতে গলা ধরে এল তাঁর— তারপর যোগ করলেন—‘তা কাল রাত্তিরি মেইয়ে গে’বলল— না মা, নতুন বউ কী ভাল! আমিও শুইনে নিশ্চিন্ত হলাম, যাক— ছেলেডা আমার ভাল থাকপে।’— এই বলে, চোখের ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলেন খাটে অন্য বাচ্চাদের মাঝে বসে থাকা একটি বছর দশেকের মেয়েকে। একগাল হেসে সে বলল—‘ভালই তো!’

গল্পটা আমায় বলেছিল আমার গিন্নি, বিয়ের অনেক বছর পর। আর আজ যখন স্বার্থের নিশ্চিত হাতছানি ছাড়া কাউকে শ্রদ্ধা করতে দেখি না কাউকেই— তখন মনে পড়ে পাশের ঘর থেকে দেখা সেই দৃশ্য। চারজন মানুষ সম্মানিত পদক্ষেপে বেরোচ্ছেন আমার ঘর থেকে, আর আমায় দেখে গদগদ গলায় বলছেন—‘অ রাজা, দিব্যি হয়েস বউ। খুব ভাল মেইয়ে। ভাল কইরে, মন দে’ সংসারডা ক’রো বাবা— আবার পড়তি বইসে বাজার কত্তি ভুইলে যেয়ো না যেন…’

আমাদের কাছে এই ‘আত্মীয়’ শব্দটা বড্ড গোলমেলে, না?

৫২

বি.এড. পড়তে গিয়ে প্রথম যে ক’জনের সঙ্গে আলাপ হল— তমিজ আহমেদ তাদের মধ্যে একজন। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। আমরা কয়েকজন আটকে গেছি— বুদ্ধিমন্ত ছেলে-মেয়েরা চলে গেছে কোন কালে। আমরা বাকিরা দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছি। খেয়াল করলাম— সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটি সবচেয়ে চুপচাপ। ফর্সা রঙ, পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, গালে হাল্কা দাড়ি। শুনছে সে সবার কথা, হাসছেও বটে; চোখ তার কথায় ভরা। কিন্তু মুখে কুলুপ। আমার যা স্বভাব— জিজ্ঞেস করলাম নাম-ধাম। জানা গেল, বাড়ি তার খুব ভিতরের দিকে এক গ্রামে। উচ্চারণে বড্ড গ্রাম্য ছাপ। এমনই বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলছিল— যেন আমি এক মস্ত আলেম মানুষ— ওর সহপাঠী নই আদৌ। বললাম— ‘তা তুই এর’ম চুপ করে আছিস যে?’ বলল— ‘আপনের মতো কতা ক’তি পাল্যে তো সারাদিন কতাই ক’তাম। কিন্তুক ওই…এ ভাষা শুনলি সব হাসপে নে’— তাই…!’ ‘আপনি’ সম্বোধনে এইসা ভড়কে গেলাম যে, ভাল করে প্রতিবাদও করতে পারলাম না। তবু, দিব্যি একধরণের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

তমিজ বসত সবার পিছনে, কথা বলত সবচেয়ে কম— তাও প্রধানত আমারই সাথে। ততদিনে গান-টান গেয়ে আমি অধ্যাপকদের সুনজরে পড়ে গেছি। মস্ত এক বন্ধুদল তৈরি হয়েছে— সবাই মিলে আজ নাটক তো কাল গানের অনুষ্ঠান করছি। তার উপর জানা আছে— অধ্যাপকদের সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করে আছে তিনশো নম্বর! তিন শো! কাজেই সকলেই মহাব্যস্ত তাদের গুডবুকে থাকতে। আম্মো। শুধু তমিজ যথারীতি নীরব।

এরই মধ্যে শুরু হল ‘মক টিচিং’। এবার আমরা হাতে-কলমে পড়াতে যাব বিভিন্ন ইশকুলে, তারই ট্রেনিং আর কি। পড়াতে হচ্ছে নিজেরই সহপাঠী আর বন্ধুদের, মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করছেন আমাদের এক শিক্ষিকা। কাজেই পড়াতে গিয়ে সকলেই ঢোক গিলছে দেদার, শেখা বুলি ভুলে গিয়ে আবোলতাবোল বলে ধমকও খাচ্ছে খুব। ভালোয় ভালোয় সে বিড়ম্বনা কাটিয়ে নিজের সিটে ফিরে এসে দম নিচ্ছি— এমন সময় ডাক পড়ল তমিজের। সকালেই আমাকে বসিয়ে শুনিয়ে দিয়েছে— কী কী বলবে আজ— সব মুখস্ত। কার্যকালে কিন্তু ওই কালান্তক ডায়াসে উঠতেই সব গুলিয়ে গেল ওর! মুখবন্ধ বাদ দিয়ে শুরু করে দিল পাঠ্য কবিতার আবৃত্তি—‘আজও এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে…!’ ওর সেই মিঠে গ্রাম্য উচ্চারণে জসিমুদ্দিনের কবিতা শুনে হাঁ করে শুনতে লাগলাম আমি— আর ভাবতে লাগলাম— আরে! এ কবিতা তো এমনি করেই বলতে হয়!

ইতিমধ্যে ম্যাডামের কিন্তু ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। কড়া গলায় তিনি বললেন—‘এইভাবে পড়াবে বুঝি স্কুলে গিয়ে! মাঠে মাঠে কান্দে কলমির লতা, কান্দে মটরের ফুল! অপদার্থ! রাজা, এদিকে এস তো!’

এমনই অপ্রত্যাশিত সে ডাক— আমি থতমত খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আর ম্যাডাম বললেন— ‘দেখিয়ে দাও তো— কেমন করে পড়াতে হবে এই পিসটা! ডায়াসে যাও।’

গেলাম। আমার পাশেই মাথা নীচু করে এক ঘর সহপাঠীর সামনে দাঁড়িয়ে রইল তমিজ। মাইকের সামনে গিয়ে,সেই অপমানিত মুখটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাথাটা গোলমাল হয়ে গেল আমার। ভুলে গেলাম— এর উপরেই নির্ভর করছে আমার নম্বর, আমার ভবিষ্যৎ। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, স্পষ্ট গলায় বললাম—‘এটা আমি পড়াব না— কেননা এত সুন্দর করে এই কবিতা পড়ার ক্ষমতাই নেই আমার! বরং পড়ে নিই কৃত্তিবাস ওঝার লেখা ‘‘রামের বিলাপ”।’ —এই বলে সেই বাঁধা গতে প্রশ্ন করা শুরু করলাম আমি— ‘আচ্ছা, কেউ বলো তো, রামায়ণ কে লিখেছেন? কোন্ ভাষায়?…’ ম্যাডামের লাল হয়ে-ওঠা মুখটা উপেক্ষা করে কথা বলে চললাম আমি।

নাঃ, এমন কি বি.এড. পরীক্ষাতেও ফার্স্ট ক্লাস পাই নি আমি— চিরকালের ব্যাকবেঞ্চার। কিন্তু আজও যখন পড়ানোর জন্য ডায়াসে উঠি, মনে পড়ে তমিজের সেই লাল হয়ে ওঠা মুখ, ছলছল করে ওঠা চোখ, আর অপমানিত বিড়ম্বিত চেহারা। আজও মনে রাখি— এই দেশেই একদিন লেখা হয়েছিল গুরু-শিষ্য পরম্পরার অমোঘ চূড়ান্ত অক্ষর—

সহ নাববতু

সহ নৌ ভুনক্তু

সহ বীর্যং করবাবহৈ

তেজস্বী নাবধী তমস্তু মা বিদ্বীষাবহৈ।

ওং শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ!!

আমাদের— আচার্য আর ছাত্রের— তো সবই সমান হওয়ার কথা ছিল একদিন! এত দূরে চলে গেলাম কবে— যে একজন আর একজনের চোখের জল দেখতে পাই না আমরা!

আজ যদি এক কণাও শিক্ষক হতে পেরে থাকি— তার অনেকটা কৃতিত্ব যে তমিজ আর ম্যাডামেরই — তা যেন ভুলে না যাই। এরাই তো শিখিয়ে দিয়েছিলেন— কেমন করে পড়াতে হয়, আর কেমন করে নয়!

৫৩

আমি ইশকুলে জয়েন করার কয়েক বছর পরেই একটা সরকারি নির্দেশে এক ঝটকায় ছুটি কমে গেল পনেরোটা। কাটা পড়ল অনেক ছুটি— তার মধ্যে বিশ্বকর্মা পুজোও একটা। ঠিক হল— ওই দিনটা হাফছুটি দেওয়া হবে— অর্থাৎ চার পিরিওড ক্লাসের পর ইশকুল বন্ধ হবে। তাও ভাল। ইশকুলের সঙ্গে বিশ্বকর্মার সম্পর্কও তেমন নেই— এইসব ব’লে ছুটি কমে যাওয়ার দুঃখে মলম লাগালাম আমরা— শিক্ষকেরা।

তো সেদিন ছিল বিশ্বকর্মা পুজো। হাফছুটি পেয়েই দিব্যি খুশি হয়ে বেরুলাম স্কুল থেকে— একটু দেরি হল টিফিন সেরে নিতে— কাজেই একাই। মাথার উপর সোনার গামলা উপুড় করে ধরেছে শরতের আকাশ; বুড়ি কলকাতা যেন সাজগোজের ঘটায় বয়েস লুকোচ্ছে। ও বাবা, দশ পা হেঁটেছি কি হাঁটি নি— আকাশ এল কালো হয়ে। দৌড়-পায়ে হাঁটা লাগালাম আমি— শরতের বৃষ্টি— বিশ্বাস নেই। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মেট্রো স্টেশনের বড়জোর তিনশো গজ দূরে যখন আমি— তখন নামল বৃষ্টি। আর সে কী বৃষ্টি! চশমার উপর দিয়ে যেন ধারাজল বইতে লাগল এক মিনিটের মধ্যে। ছাতাও আনি নি ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ মনে করে। কোনোক্রমে সবচেয়ে কাছের যে বাড়িটা চোখে পড়ল— তারই গাড়িবারান্দার নীচে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। চরাচর ঝাপসা করে তুমুল বৃষ্টি চলতেই থাকল।

রুমাল আমার পকেটে থাকে না। কাজেই আধো-ভিজে জামাটা দিয়েই কোনোমতে চশমাটা মুছে, ধাতস্থ হয়ে চারদিকে তাকাতেই কিন্তু আমার মুখ শুকিয়ে গেল। হঠাৎ-বৃষ্টি অনেককেই বাধ্য করেছে এই লম্বাটে গাড়িবারান্দার নীচে আশ্রয় নিতে। ফলে অপরিসর জায়গাটায় ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক মানুষ। কিন্তু এইবার যেটা চোখে পড়ল— তাতে আমি কাঠ হয়ে গেলাম। আমিই এখানে আশ্রয় নেওয়া একমাত্র পুরুষ। বাকিরা প্রত্যেকেই মেয়ে— যাদের আমরা যেতে-আসতে দেখে থাকি মুখে রং মেখে, বিচিত্র পোষাক প’রে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। ‘হে ভগবান! এ কোথায় এনে ফেললে আমায়!’— ভাবতে ভাবতে আমার শরীর যেন সংকুচিত হয়ে গেল। কেউ যদি এখন বাস থেকে আমায় দেখে ফেলে এই কুৎসিত ভীড়ের মধ্যে! কী ভাববে সে!

যতই এসব ভাবছিলাম, ততই সরে যাচ্ছিলাম আমি কোণের দিকে। ক্রমে এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম— যেখানে গায়ে লাগতে লাগল বৃষ্টির ছাট; আবার প্রায় ভিজতে লাগলাম আমি। অধৈর্য হয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে।

আর ঠিক তখনই কানে এল একটা কুণ্ঠিত ডাক—‘ও দাদা! শুনছেন? ও দাদা!’

আতঙ্কে ঘেমে উঠলাম আমি। ফিরে এল সেই দ্বিতীয় দিনে দালালের খপ্পরে পড়ার স্মৃতি। বুঝতেই পারছিলাম— এবার আসবে একটা জঘন্য প্রস্তাব— ঘন্টা-পিছু দরের কথা। আরও এক পা কোনার দিকে সরে গেলাম আমি। আর অন্য একটা গলায় ফের শুনলাম ডাক—‘ও কাকু, আপনাকে ডাকছে তো!‘ ভয়ে হিম হয়ে ভাবতে লাগলাম— এবার কি এরা গায়ে হাত দেবে?

ডাকাডাকি কিন্তু থেমে গেল এবার। বদলে শুরু হল একটা উত্তেজিত ফিসফাস। আলোচনাটা আমাকে নিয়েই— বুঝতে পারছিলাম আমি। কী ঠিক করছে এরা? কি করবে এরপর? ‘নাঃ, বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে ছুট লাগাই বরং’— ভাবলাম আমি।

আর ঠিক তখনই একটা ভাঙা ভাঙা নারীকণ্ঠ শোনা গেল—‘ও মাস্টারমশাই! একটু সরে আসুন না এদিকে! পুরো ছাটটাই তো গায়ে লাগচে। জামাটা তো ভিজে একশা। গলাটা ভাঙবে যে এবার! বলি গান-টান কি আর করবেন না, না কি!’

মহাবিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি— মেয়েগুলো এখন জট-পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরে— গাড়িবারান্দার অন্য প্রান্তে— যাতে আমার দাঁড়ানোর জায়গা হয়। ওরা চিনে ফেলেছে ওদের ‘খারাপ পাড়া’র মাস্টারমশাইকে। তাই সরে দাঁড়িয়েছে সসম্ভ্রমে। আমি তো আর ওদের চিনি না! আর অদ্ভুতভাবে শাড়ি-পরা যে মহিলা আমাকে এ-কথাটা বলেছেন— তিনি ঘাড় উঁচু ক’রে তাকিয়ে আছেন আমার দিকেই।

বৃষ্টি ধরে এসেছে তখন। ট্রেন ধরার জন্য তাড়াহুড়ো করে পথে নামলাম আমি— ভিজে জামায় তখন শীত শীত করছে। আর অপরিসর একটা গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে রইল কতগুলো নষ্ট মেয়ে। তাদের তখনও বাড়ি ফেরার সময় হয় নি।

বিশ্বকর্মা পুজো ব’লে কথা। এইদিন ব্যবসা হয় ভাল। পুজোর দিনে ক্ষুধার তো আর ছুটি থাকে না!

৫৪

খুব সঙ্গত কারণেই, ইশকুল থেকে ছাত্র-পেটানোর জঘন্য নিয়মটা উঠে গেছে অনেককাল আগে। যাওয়াই উচিত— বাড়িতে ঝগড়া করে এসে, বা শেয়ার ব্যবসায় লোকসান খেয়ে বাচ্চাদের উপর শোধ তোলাটাকে কোনো যুক্তিতেই সহ্য করা যায় না। আর আমার নিজের মারধোর করার অভ্যেস কোনোকালেই ছিল না। আমার তেরো বছরের ছেলে আজ অবধি একটা চড়ও খায় নি। তবে হ্যাঁ, মস্ত হাতের তেলোটা দেখিয়ে অনেক কেল্লাই ফতে হয়েছে— এ কথা সত্যি। ওই আকৃতি দেখেই দুষ্টু বাচ্চাও সোনা-হেন মুখ করে পড়ায় মন দেয়— থাপ্পড়টা পড়লে যে ব্যাপারটা সুখকর হবে না— তা তারা বিলক্ষণ বোঝে।

তবু এক-একটা বাচ্চা সত্যিই অধৈর্য করে দেয় বইকি। গণেশ দাস ছিল ঠিক এইরকম ছেলে। কালো, ভোঁতা চেহারা, চোখে একটা অদ্ভুত নির্বোধ চাউনি। একটি প্রশ্নেরও সে উত্তর দিত না, লিখতে দিলে গভীর মনোযোগ সহকারে পেনসিল চুষত, আর তেড়ে ধমকালে চুপ করে মুখের দিকে চেয়ে থাকত। হোমটাস্ক করে না-আনার অজুহাত দিত না কক্ষনো, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। এই নিরুত্তর নীরবতার সময়গুলোতেই আমার ইচ্ছে করত ওকে খুব একচোট ঠেঙিয়ে দেওয়ার।

ক্লাস এইট থেকে বিগড়ে যাওয়াটা আমাদের— অর্থাৎ মাস্টারমশাইদের— বেজায় চেনা একটা ব্যাপার। হঠাৎ-আসা বয়ঃসন্ধি উথালপাতাল করে দেয় শৈশব— ভাল ছেলে হঠাৎ বিচিত্র ছাঁদে চুল ছাঁটিয়ে স্কুলে আসতে আরম্ভ করে। গণেশ উল্টে এইটে উঠে স্কুলে আসাই বন্ধ করে দিল। প্রথম দু’মাস এল অনিয়মিতভাবে, তারপর থেকে শুরু হল হপ্তায় তিনদিন কামাই, ক্রমে অগাস্টের শুরু থেকে আর গণেশের দেখা নেই। একবারে এল সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে— পার্বিক পরীক্ষা দিতে। মাথা নীচু করে, পা টেনে টেনে ওর ওই ঢোকা দেখেই প্রচণ্ড রাগ হল আমার— ভয়ানক বকাবকি করলাম ওকে হলের মধ্যেই। যথারীতি অভ্রভেদী নীরবতার শেষ দেখে ছাড়ল ও। এক্কেবারে শেষ বেঞ্চিতে একা বসে রইল চুপটি করে; কিস্যু লিখল না। দু’তিন লাইন আঁকিবুকি কাটা খাতাগুলো যথাসময়ে জমা দিয়ে চলে যেতে লাগল রোজ।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিন খাতা নিয়ে বসলাম। সামনে অনন্ত লেখার আর গানের কাজ, এটা আগে শেষ করে ফেলা চাই। কিছু না-ভেবেই এইটের খাতা দিলেই উদ্বোধন করা গেল পুণ্যকর্ম। মন্দ লেখে নি বাচ্চারা, বলতে কি— মনটা বেশ খুশ হয়ে গেল।

ক্রমে এল শেষ খাতাটা। চারটে পাতার প্রথমটার উপরে বড় বড় করে সযত্নে নাম লেখা— গণেশ দাস। তার নীচে একটা মস্ত সাদা পাতা। মানে বিলকুল সাদা, ফাঁকা। কিচ্ছু লেখা নেই তাতে। খুললাম খাতাটা। এবার দু’পাশে দু’টো সাদা পাতা। মানেটা কি! একটা শব্দও লিখতে পারে নি! এমন হয় না কী! আচ্ছা করে ওকে পেটানোর ইচ্ছেটা যে বুকের মধ্যে ফের হাঁচোরপাচোর করছে— তা টের পেলাম খুব। লম্বা করে লাল দাগ কেটে বন্ধ করতে গেলাম খাতাটা ; আর তক্ষুনি দেখতে পেলাম— শেষ পাতাটায় কিছু লেখা আছে। হ্যাঁ, লিখেছে বটে— সেই একেবারে প্রথমদিকে যে লিখিয়ে দিয়েছিলাম ‘অনুপস্থিতির কারণ জানিয়ে প্রধান শিক্ষকের উদ্দেশ্যে পত্র’— সেটাই লিখেছে। যাক। তার মানে শূন্য পাচ্ছে না একেবারে।

দেখি, সুন্দর করে ‘মাননীয় প্রধান শিক্ষক মহাশয় সমীপেষু‘ইত্যাদি সেরে গণেশ লিখেছে ঠিক চারটে লাইন। সেই চার লাইনের স্মৃতি মগজ থেকে মুছে যাবে না কোনোদিন, কোনোমতেই। তাই, হুবহু টুকে দিই বরং—

‘মহাশয়,

আমার বিনিত নিবেদন এই জে, আমার বাবা তো পেন্ডেলের কাজ করে, আর খুব নেসা করে। এখুন পুজোর কাযের চাপ একা একা সামলাতে পারচে না। তাই আমাকে রোজ রোজ বাবার সংগে জেতে হছে। তাই আমি আড় ইস্কুলে আসতে পাচ্ছি না।

দয়া কোরে এই কয়দিনের ছুটি মনজুর করে আমায় বাধীত কোরবেন।

ইতি—

বিনিত—

গণেশ দাস,

(অস্টম শ্রেনী)’

মারধর বন্ধ হয়ে যাওয়ার এতদিন পর আবার….যেন ঠাস করে কেউ একটা চড় মারল আমায়। ভাগ্যিস স্টাফরুমে আর কেউ ছিল না তখন! ভাগ্যিস থাকলেও দেখতে পেত না! ভাগ্যিস সব চড়ের দাগ থাকে না! ভাগ্যিস এত কম দেখে, এত বেশি বুঝে ফেলি আমরা!

৫৫

আমি আলাভোলা কাছাখোলা মানুষ। দু’বার এ.টি.এম. কার্ড হারানোর পর থেকে গিন্নি আর ভরসা পান নি; কার্ড নিজের কাছে রাখেন। আমারও টাকা-পয়সার সাথে বিশেষ সম্পর্ক নেই— ফলে নিশ্চিন্ত হলাম।

তা আজ হঠাৎ কিছু টাকার প্রয়োজন হওয়ায় কার্ড নিয়ে বেরুতে হয়েছিল। সেকেন্ড পিরিয়ডে ক্লাস নেই; ভাবলাম এই মওকায় কাজ সেরে আসি। গিয়ে দেখি, কাউন্টারের সামনে মাঝারি গোছের একটা লাইন। কিন্তু লোকজন ঢুকেই বেরিয়ে পড়ছেন। লাইনে দাঁড়িয়েই জানা গেল— যন্তরটি দেহ রেখেছে। পাশের এ.টি.এম.টা বড়জোর একশো ফুট দূরে। ফিরে হাঁটা দেব— এ হেন সময়ে ঠিক সামনের ভদ্রলোক মাথায় হাত দিয়ে বললেন—‘হে ভগওয়ান! অব কেয়া হোগা!’

এ আবার কি নাটকীয় অভিব্যক্তি! তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল মুখে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। পরনে অবিশ্যি সাদামাটা প্যান্ট-শার্ট ; কিন্তু তাঁর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে— এ তাঁর অভ্যস্ত পোষাক নয়। হঠাৎ আমার হাতটা চেপে ধরে তিনি বললেন— ‘ভাইয়া, সবচেয়ে কাছের অন্য কাউন্টারটা কোথায় বলতে পারেন?’ আমিও আঙুল তুলে দেখালাম— একটু দূরেই সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। এবার প্রশ্ন—‘আপ ভি ওহি যা রহে হ্যায় না?’ ঘাড় নাড়তেই তিনি বললেন—‘চলিয়ে, হম ভি যায়েঙ্গে আপ কে সাথ।’

‘দেখাই তো যাচ্ছে বাপু, আবার সঙ্গে যাওয়ার কি আছে?’— ভেবে রওনা দিলাম আমি। তিনি চললেন সাথে। টাকা তুলে বেরিয়ে আসছি, তিনি প্রায় ঠেলে ফের ঢুকিয়ে দিলেন খুপরিটাতে। তারপর হাঁকপাক করে বললেন—‘একটু সাহায্য করুন ভাই। কোথায় ঢোকাতে হবে কার্ড?’

কি আপদ! এ দেখি আমার চেয়েও এক কাঠি সরেস ! দেখালাম। করলেন। স্ক্রিনে এল পরের নির্দেশ। ফের প্রশ্ন— এবার? দেখিয়ে দিলাম উপরের লেখাগুলো। মাথা নেড়ে বললেন—‘পড়না নেহি আতা। সুনাইয়ে।‘ পুজোর আগে এ কি পাল্লায় ফেললে মা! কালই না তোমায় টিভিতে বসে এত করে ডাকলাম! যাক, বললাম— ‘এই বোতামটা টিপুন। হল? এইবার আপনার পিন নম্বরটা টাইপ করুন।’— বলে বেরুতে গেলাম— হাঁ হাঁ করে উঠলেন তিনি— ‘আরে নেহি ভাইয়া, ও মুঝে ইয়াদ হ্যায়— এক পাঁচ…’

আমি এবার উল্টে হাঁ হাঁ করে উঠলাম—‘আরে ইয়ে নম্বর কিসিকো বাতানা নেহি। একমাত্র নিজে নিজে মনে রাখনা। এইখানে লিখনা!’— বলে দেখিয়ে দিলাম কি-প্যাড। তিনি সগর্বে বললেন— ‘উও তো বেটে-নে হি সিখা দিয়া।’ তারপর দিব্যি ‘ইয়ে হ্যায় এক..ইয়ে রহা পাঁচ…’— বলতে বলতে লিখে ফেললেন নম্বরটা। আমি শুধু আকুল নয়নে খুঁজতে লাগলাম— সিসিটিভিটা আছে কোথায়!

বাকি নির্দেশ শুনে শুনে দিব্যি ফলো করলেন ভদ্রলোক। টাকা বেরুতে গুনে অবাক! যা লিখেছেন তাই! ‘কি কল বানাইছ তুমি!’ টাকা গুছিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে বললেন— ‘আধ ঘণ্টা ধরে একে তাকে বলে যাচ্ছি বেটা, টাকাটা তোলা বড় দরকার। মেয়েটা ওই নার্সিংহোম-এ ভর্তি, ছেলে শুয়ে আছে রক্ত দেবে বলে। আমি জীবনে প্রথম এইসব কল দেখলাম— থাকি লাতেহারে। তা যাকে বলি, সে-ই দুদ্দার করে পালায়। কি করি বল দেখি, গাঁয়ের মানুষ।’

তারপর খানিক চুপ করে থেকে নিজের মনেই বললেন—‘বলুন দেখি, আমাদের নিজেদের মধ্যেই যদি এত অবিশ্বাস থাকে, পাকিস্তানের দরকারটা কোথায়! হম হি অগর এক দুসরে পে বিশওয়াস না কর সকেঁ….দোস্ত অগর এইসি হ্যায়, তো দুশমন কি ক্যায়া জরুরত!’

ও আমার দেশ! আর কবে বিশ্বাস করতে শেখাবে আমায়! আর কবে চিনিয়ে দেবে— কে বন্ধু, আর কে নয়!

৫৬

কেন জানি না, ক্লাস ফোরে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল পাড়ার প্রাইমারি ইশকুলটায়। অ্যাদ্দিন পড়েছি নার্সারি স্কুলে— সেখানকার আদবকায়দা ছিল অন্যরকম। এখানে মাটিতে আসন পেতে বসা, বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসা, সহপাঠীরাও অন্যরকম। অসুবিধে হত খুব প্রথমদিকে। ইশকুলে যেতে ইচ্ছে করত না।কিন্তু বর্ষাকালের মাঝামাঝি থেকে একটা আশ্চর্য ব্যাপার এসে আমাকে একেবারে দখল করে নিল।

কবে শুরু হল— সে আমি অত খেয়াল করি নি। একদিন হঠাৎ দেখি— ইশকুলে যাওয়ার পথেই যে টিনের বাড়িটা পড়ে, সেটার দরজা খোলা। এই বাড়িটাতে তো কেউ থাকে না, থাকে উঠোনের ওপাশের ছোট্ট পাকা বাড়িটাতে। তখন দেখি— একজন বুড়োমতো মানুষ খুব মন দিয়ে সেখানে কাঠামোর উপর মাটি লাগাচ্ছেন। কী কাণ্ড! ঠাকুর গড়ছেন না কি! একেবারে আমার চোখের সামনে! এটা তার মানে ঠাকুরবাড়ি। বেশ, তাহলে রোজ এই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমার দেখা হয়ে যাবে— ঠিক কীভাবে, কোন্ রহস্যে এক তাল মাটি ঈশ্বরীপ্রতিমা হয়ে ওঠে! সত্যি, কী কপাল আমার!

এরপর থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য আমাকে আর বলতে হত না। ঘড়ি ধ’রে দশটার সময় টিনের বাকসো হাতে আমি হাঁটা লাগাতাম ছায়াঢাকা ইশকুলের পথটা ধরে। আধঘন্টা হাঁ করে দেখতাম সেই বুড়োর কাজ। খুব মলিন একটা ধুতি আর সবুজ ফতুয়া পরে কাজ করতেন তিনি রোজই— বোধহয় ওইটে ছিল তাঁর কাজের পোষাক।তাতে লেগে থাকত মাটির দাগ, পরের দিকে রঙের ছিটে। আবার ফেরার পথে আধঘন্টা দাঁড়িয়ে, কাজ শেষ হতে— তবে রওনা দিতাম আমি। ফলে, প্রায় আমার চোখের সামনেই সেজে উঠলেন মা দুগ্গা; অভিজ্ঞ বন্ধুরা প্রাণপ্রতিষ্ঠা, চক্ষুদান— এ সব বোঝাতে চাইলেও আমার ঘনঘন পেন্নাম ঠোকা থামল না।‘মা যা ছিলেন’ আর ‘মা যা হইয়াছেন’— এর মাঝখানের বিপুল ব্যবধানটার কথা মনে রেখেই আমি সেই নাম-না-জানা মানুষটিকে ভারি শ্রদ্ধা করতে লাগলাম। কিন্তু ওই বয়েসে নাম জিজ্ঞেস করার সাহস ছিল না আমার।

পুজোর ছুটি পড়ল পঞ্চমীর দিন। কী সব্বনাশ! ঠাকুরের কাজ তো প্রায় শেষ, কিন্তু পুরো শেষ হওয়াটা তো আমি দেখতেই পাব না! ছুটি পড়ায় মন-খারাপ হয়ে গেল উল্টে।

সপ্তমীর সকালে আর থাকতে পারলাম না। কাউকে কিচ্ছু না বলে, চুপিসাড়ে ছুট লাগালাম স্কুলের দিকে। সেই পুজোবাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি— মাঝের একদিনে আগাগোড়া বদলে গেছে বাড়িটা। আটপৌরে টিনের ঠাকুরবাড়িটা সেজেগুজে পাউডার-মেখে ঝলমলে।ঢাক বাজছে, লাউডস্পিকারে আরতি মুখুজ্জে জলে নামতে মানা করছেন। অনেক লোক এসেছে, শহরের লোক সব— আমাদের মতো নয়; জেল্লা দেখলেই চেনা যায় তাদের। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে খানকয়েক। রান্নার আর ধূপের গন্ধ মিশে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে হইহই ব্যাপার। মস্ত কাঁঠালগাছের ছায়ায় ঢাকা নিকোনো উঠোন আর ঝুঁকে পড়া বাঁশবনের নিচের ঠাকুরবাড়িটাকে আর চেনা যায় না। ঠাকুরটাও যেন অচেনা ঠেকল কেমন।

বাড়ির পুজো। আত্মীয়স্বজনের ব্যাপার। একটা অচেনা ছেলেকে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাই অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল সবাই। আর না-দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম আমি। আর অমনি দেখতে পেলাম— ঠাকুরবাড়ির পিছনে, বাঁশবনের ছায়ায় বসে কলাপাতায় করে প্রসাদ খাচ্ছেন সেই বুড়োমানুষটি। আমাকে দেখে আজ এক মুখ হেসে তিনি বললেন— ‘কী খোকা, দেখলে? কেমন হয়েছে গো ঠাকুর? এই একটু পরেই চলে যাব তো, তা ভাবি— ছেলেটা রোজ আসে— কাজ শেষ হল— কই, এল না তো! ভাল লেগেছে, বাবা?’ আমি খুব ঘটা করে মাথা নাড়লাম— এর আগে তো আর কেউ কখনো এমন করে মত চায় নি আমার। তাই মুখেও বললাম— ‘খুব ভাল লেগেছে।’

তিনি খেতে খেতেই বললেন— ‘তাই বল দেখি— দু’মাসের চেষ্টা… তা এরা কেউ আর এই কথাটি বলে না… আরে ঠাকুরপ্রতিমা ঘিরেই তো পুজো, অ্যাঁ? তা সেটা কেমন হল… মায়ের মুখটা… তারপর চোখ… যাক, তোমার ভাল লেগেছে তা’লে, হুঁ…?’

আজ এত বছর পরে হঠাৎ মনে হল— প্যান্ডেল-লাইটিং-থিমের ঝলমলানির আড়ালে কী সপ্তমীর রাতে মা দুগ্গার মাঝেমধ্যে একা লাগে খুব?

৫৭

এই যে এখন— আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি খাটের উপর, ঘর অন্ধকার; আর জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নারকোল পাতার উপর উঠে এসেছে কোজাগরী পূর্ণিমার মস্ত চাঁদ— অমনি মনে পড়ল অনেক দিনের পুরনো একটা ঘটনা।

আমরা তখন ভাড়া থাকতাম যে বাড়িতে, সেটা একটা শুনশান পাড়ায়। গলির মুখেই ছিল ছোট্ট আর অনেক পুরনো একটা বাড়ি, সামনে ভারি সুন্দর বাগান। তাতে থাকত সেনগুপ্ত-দিদা। ওই নামেই ডাকা হত তাকে— যদিও সেনগুপ্ত-দাদুকে আমি চোখে দেখি নি। আমরা এ পাড়ায় আসার আগেই তিনি মারা যান। দিদা থাকতেন একাই। শুনেছিলাম, একটি ছেলে আছে তাঁর— নাকি কোন দূরদেশে থাকে, মায়ের খোঁজ নেয় না। আমাদের বাড়ি সারাদিন ভরে থাকত বাবার ছাত্রছাত্রীতে আর আত্মীয়স্বজনে। আর দিদার বাড়িতে কখনও কাউকে ঢুকতে দেখি নি আমি। তখন ফোরে পড়ি, দিদার বাড়িতে আমি অবিশ্যি যেতাম যখন-তখন; কেননা পুরনো পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলার মস্ত এক ভাণ্ডার ছিল তাঁর ট্রাংকে। গেলেই দিদা বের করে দিতেন তা; আর দিতেন নাড়ু— আমার প্রিয়তম খাবার। কাজেই কেবল পড়ার লোভেই যে যেতাম— এ কথা বললে নিছক মিথ্যাচার হবে।

আমাদের সেই ভাড়া বাড়িতে কিন্তু লক্ষ্মীপূজা হত না। পুজো হত আমাদের পুরনো বাড়িতে— তার চেয়ে অনেক বড় কথা— সেখানে থাকত বাজির অনন্ত সম্ভার। লক্ষ্মীপুজোর দিনটা— কাজেই আমি সকাল থেকেই লাফালাফি করতাম সেখানে যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যে হতেই সবাই মিলে সেখানে যাওয়া হত। তারপর সমস্ত ভাই-বোন-কাকা-জ্যাঠা মিলে বাজি ফাটানো চলত— যতক্ষণ না ঠাকুমা বাইরে এসে বারণ করত— ‘এইবার বাজি ফাডান বন্ধ কর্ তরা, পূজা কিন্তু শুরু হইয়া গেল গা!’ আমরাও শিষ্ট হয়ে বসতাম সব— যতক্ষণ পুজো চলে। তারপর খিচুরি-প্রসাদ খেয়ে ফেরার পথ ধরতাম আমরা। মাথার উপরে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটত পূর্ণিমা চাঁদ। রাস্তায় আলো ছিল না তখন; ফলে সেই সার্বভৌম চাঁদের আলোয় যেন ফিনিক দিত। পথ ভারি হয়ে থাকত বাজির ধোঁয়ায়— জ্যোৎস্নায় সে ধোঁয়া সরের মতো ভাসত আর কাঁপত। কেবলই বাজি ফাটার শব্দ আসত, আর আমি চেপে ধরতাম বাবার হাত।

মাঠ পেরিয়ে আমাদের গলিতে ঢুকলেই সাহস একটু বাড়ত আমার। তাই বাবার হাত ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেছি সেই লক্ষ্মীপুজোর রাতে। দিদার বাড়ির সামনে আসতে হঠাৎ শুনলাম দিদা ডাকছে—‘অ রাজা, এট্টু শোনবা না কি দাদুভাই?’

অমনি আমি অন্ধকার উঠোন আর বারান্দা পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম সেই বাড়িতে— আর চমকে থেমে গেলাম। ঘরের এককোণে ছোট্ট একটা সরা পেতে পুজো করেছে দিদা। ছোট ছোট বাটি আর থালাতে ক’টা কাটা ফল, চালমাখা, চিনির মঠ, আর নাড়ু। লম্বা একটা প্রদীপ জ্বলছে। দিদা হেসে বলল— ‘পূজা করসি নিজেই, বোঝলা দাদুভাই। হ্যার পর পাঁচালিডা পড়লাম। সইন্ধ্যা তামাইত (থেকে) বইয়া আছি— কেউ দেহি আয় না। এই এতক্ষণে আইসো তুমি। খাবা না কি কিসু, দাদা?’

আমার খিদে ছিল না একটুও। তাও, হঠাৎ কি মনে করে আমি বললাম— ‘নাড়ু দাও না দিদা। আর একটা আস্ত মঠ দেবে আমায়? কোনোদিন খাই নি!’— মনে হল— এই কথাগুলো বললে দিদা খুশি হবে। আর দিদা সত্যিই আমার কথা শুনে ভারি খুশি হয়ে দন্তহীন মুখে একগাল হেসে বলল— ‘আইস্তা মঠ কি তুমি খাইতে পারবা? নিয়া যাও বরং। আর লাড়ুগুলি তুমি এহেনে বইয়া খাও। আমি দেহি।‘ আর আমি, কেন কে জানে, ভরা পেটে বসে গেলাম নাড়ু খেতে।

খেয়ে-দেয়ে বাইরে এসে দেখি, মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে খামোখা কাঁদছে। আমি তো মা-কে নিয়ে বাড়ি চলে গেলাম। কিন্তু মা কেবলই আমায় জড়িয়ে ধরে কান্না-ভেজা গলায় বলতে লাগল— ‘তুই কোথাও যাবি না তো বাবা?‘ খানিক পরে আমাদের বারান্দা থেকে দেখি, দিদা একা বসে আছে বারান্দায়। কোজাগরী পূর্ণিমার মায়াবি আলো পড়ে তার সাদা শাড়ি আর পাকা চুল চকচক করছে।

আজ জানি, দিদা বসে ছিল এই আশায়— আর কেউ আসবে প্রসাদ খেতে….

৫৮

লখনৌ এসেছি আবার। এর আগে এসেছিলাম পনেরো বছর আগে। অনেক কিছু পাল্টে গেছে; যাওয়ারই কথা অবিশ্যি এত্তগুলো বছরে। রাস্তাঘাট তুলনায় অনেক পয়পরিস্কার, পার্ক হয়েছে অনেক নতুন নতুন। বেশ নতুন লাগছে প্রাচীন নবাবী আমলের শহরটাকে।

সকালে যাওয়া হল সেই পরিচিত বড়া ইমামবাড়াতে। মাঝখানে বিস্তর ঘষামাজা হয়েছে— বোঝা যায়। আগের মলিন ভাব একটু যেন কমেছে। মেনটেনেন্সের কাজ চলছে শাহি বওলি বা রাজকীয় স্নানাগারেও। আগেরবার এগুলো দেখেছিলাম নিজেরাই। এবার বড় কোম্পানির সাথে ঘোরা— কাজেই তারা সঙ্গে দিয়েছে গাইড। মাঝবয়েসি রোগা-পাতলা মানুষ, গালে কাঁচাপাকা দাড়ি। পুরোনো কোটের বুকে নেমপ্লেট আটকানো— ‘শাহজাদে’। মুখের ভাষা হিন্দিই বটে, কিন্তু সে হিন্দি একেবারে চপচপে করে উর্দু-মাখানো। কাজেই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে একটু, আর আমাদের সঙ্গীরা তো একেবারে দিশেহারা। মাঝে দু’একবার ঈষৎ ঝগড়াও হয়ে গেল। অধিকাংশ সেথোদের বয়েস অনেক, স্বভাবতই তাঁরা একটু অধৈর্য। সমস্যা হল— ইনি অন্য কোনও ভাষা বলতে পারেন না; তাদৃশ শিক্ষাও নেই স্পষ্টত। প্রায়শই এই পেশাটি বংশগত— বাপ-পিতেমোর কাছ থেকে শেখা বুলিই এঁরা আউড়ে চলেন— ফলে কথার গতিও টর্নেডো-তুল্য। এ সমস্যার তাই আশু সমাধানও নেই।

এদিকে ততক্ষণে প্রাচীন ইমারতের খিলান আর গম্বুজের বেদনাময় রেখা সবজান্তা বাঙালি পর্যটকের উপরেও অতি-সামান্য প্রভাব বিস্তার করেছে। অবশ্যই বৃদ্ধেরা কেউ জানাতে বাকি রাখেন নি— তাঁরা প্রত্যেকেই এই শহরে কখনো-না-কখনো পোস্টিং ছিলেন, নাড়িনক্ষত্র চেনা আছে তাঁদের লখনৌয়ের। তবু ভুলভুলাইয়াতে ঢুকে এবং ঘুরপাক খেয়ে— বোধকরি পথশ্রমেই— তাঁরা একটু চুপ করলেন। ক্রমে গোলোকধাঁধা পেরিয়ে আমরা উঠলাম রোদ-চনমনে ছাদে। বুড়ো মানুষেরাও এককোণে ছায়ার নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন।

এইবার আমাদের গাইডমশাই ঘুরে দাঁড়ালেন নাটকীয় ভঙ্গীতে। হাতদুটি আকাশে তুলে ঘোষণা করলেন— আমাদের বড়া ইমামবাড়া ভ্রমণ আইনতঃ এখানেই শেষ। তবে এইবার তিনি কিছু অতিরিক্ত দেবেন উপহার হিসেবে। লখনৌ নবাবদের শহর। এখানকার কৃষ্টির একটি বিশিষ্ট ‘অন্দাজ‘হল শেরশায়েরি। তাঁরও সে শওখ কিঞ্চিত আছে। এখন তিনি আমাদের দু’একটা কবিতা শোনাবেন।

থেমে গেল মুখস্থ বুলির ঝড়। তার বদলে শুরু হয়ে গেল বয়েতবাজি; মাথা নিচু করে ইজাজত চাইলেন তিনি— আর এই ছাপোষা মাস্টার বলে উঠল— ‘ইরশাদ! আহা… চারিদিকে প্রকাণ্ড জীর্ণ বা ঝলমলে প্রাচীন ইমারতের বাঁকা রেখা, মাথার উপর উড়ছে কবুতরের ঝাঁক, আর ছাত জুড়ে নাচছে শায়েরির টুকরোটাকরা— না জানে ইয়ে কিসকি তুরবৎ হ্যায়, কিসকি রাহ-গুজর হ্যায়/ উও যব গুজরে ইধর-সে— গির পড়েঁ দো ফুল দামন-সে!’ মুখ থেকে আপনিই উছলে উঠছে ‘কেয়া বাত’-এর তারিফ!

মিনিট পনের চলল সেই স্বর্গদর্শন— তারপর সভা ভঙ্গ হল। নিচে নেমে আসতে আমাদের ম্যানেজার বললেন—‘যে যা ইচ্ছে হয়, একটু বখশিশ দিতে পারেন। ওর পেমেন্ট হয়ে গেছে কিন্তু। না-দিলেও কিছু নয়।’ কত দেওয়া যায়— জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন—‘দিয়ে দিন খান-কুড়ি টাকা। বেশি দেবেন না, আবার খাই বেড়ে যাবে।’

কুড়ি টাকা! এ আবার আজকালকার দিনে কাউকে হাতে করে দেওয়া যায় না কি! তা যাক, বলেছে যখন— তাই দেওয়া গেল। ভারি খুশি হয়ে আদাব করলেন তিনি। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম— তাঁর হাতে ওই কুড়িটা টাকাই আছে। আর কেউ দেয় নি কি? জিজ্ঞেস করতে একগাল হেসে মাথা নাড়লেন তিনি; তারপর আমার বিরক্ত মুখ দেখে বললেন— ‘কেয়া বাবুজি! এটুকু কি আর পয়সার জন্য করলাম? এ আমার শওখ। হর শহর-কা, হর দেশ-কা অপনা এক অন্দাজ হোতা হ্যায়। অপনা কলচর। অনেক বছরে গড়ে ওঠে তা। আর আপনারা আসছেন কলকত্তা-সে— যেখানে অওধের আখরি নওয়াব মাটি পেয়েছেন। শেরশায়েরি-কি শওখ যিতনি হামারি, উতনি আপকো ভি হোগা! তো ইয়ে তো আপনি ফর্জ বনতি হ্যায় হুজুর— কি ইতনি-সি নজাকত বাকি রহেঁ লখনৌ কি!’

তারপর একটু কাছে এসে গাঢ় কণ্ঠে বললেন— ‘কুছ গুফতগু রহে যায়েগা, কুছ বাতেঁ রহে যায়েগা/ আপ চলে যায়েঙ্গে ম্যহফিল-সে— কোই অজনবি রহে যায়েগা..’ তারপর একটু হেসে বললেন— ‘বাদশাহ তো চলে গ্যয়ে জনাব; এক গরিব শাহজাদে কো ছোড় গয়ে…’

এই বলে, আর একবার আদাব করে, ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন এক দরিদ্র রাজপুত্র।

৫৯

তখন খুব গানের অনুষ্ঠান করতাম। শ্যামল মিত্রের গান গাইতাম পাড়া-বেপাড়ার স্টেজে। তা অমনই একটা অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখি— সারথিটি আমার অপরিচিত। সৌম্যদর্শন যুবক; সুন্দর জামা-কাপড়ে আমার চেয়ে ঢের সপ্রতিভ আর ধোপদুরস্ত। হাতে হাতে নামিয়ে ফেলছে হারমোনিয়াম-তবলা। আলাপ হল। নাম বলল ‘বিশ্ব’, আগে সুরাটে কী-সব কাজ করত; এখন গাড়ি চালাচ্ছে।

অতি দ্রুত খাসা বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমাদের। তার মূল কারণ অবিশ্যি গান— বিশ্বও আমার মতোই গানপাগল, অনুষ্ঠানে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কারণও প্রধানত ওটাই। ক্রমে আমাদের সম্পর্কটা পারিবারিক হয়ে উঠল। মাকে নিয়ে সারদা মিশনে যাওয়াই হোক, আর আমার বিয়ে করতে যাওয়া— সবকিছুর জন্যই বিশ্বকেই গাড়ি নিয়ে আসতে হত। সম্বোধনটাও নেমে এল তুই-তোকারিতে; সামান্য বড় বলে ও ‘রাজাদা, তুই‘বলে শুরু করত কথা।

তখন সদ্য মধ্যমগ্রামে উঠে এসেছি ফ্ল্যাট কিনে। ছেলের বয়েস সাড়ে তিন, পড়ার চাপ নেই। শনিবার ফিরে যাই বাড়িতে, রোববার রাত্তিরে ফিরে আসি ফ্ল্যাটে। তো তেমনই এক রবিবার। নিম্নচাপের দিন। সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি। সন্ধ্যে থেকে শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। আমি বাইরের ঘরে বসে পড়াচ্ছি— বাংলা অনার্সের নতুন ব্যাচের প্রথম ক্লাস। ছেলে খেলছিল খাটের উপর, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ, ঈশ্বর জানেন কী করে— সে ছিটকে পড়ল খাট থেকে মেঝেতে। ছুটে গিয়ে তুললাম। যা না লেগেছে, ভয় পেয়েছে তার দ্বিগুণ। ওর মা, আমার মা— দুজনে মিলে মাথায় জল দিয়ে শুইয়ে দিল ওকে।

এর মিনিট পনের পরে প্রথমবার বমি হল ওর। তার দশ মিনিটের মধ্যে আবার। এই লক্ষণ কারোর অচেনা নয়। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল আমার। বাড়িতে কান্নাকাটি। ফোন করলাম বারাসাতে, জন্মাবধি যে ভদ্রলোক ছেলের চিকিৎসা করছেন— সেই ডাক্তারকে। বন্ধু মানুষ তিনি। কম্পিত গলায় বললেন—‘এক্ষুনি নিয়ে এস। দেরী ক’র না।‘

নিয়ে যাব! কি ভাবে? তীব্র রিরংসায় বৃষ্টি হচ্ছে তখন বাইরে, ভিতরে ছেলে ক্রমশঃ নেতিয়ে পড়ছে। প্রায় স্বয়ংক্রিয় ভাবে মনে পড়ল বিশ্বর কথা। ফোন করলাম। ধরেই সেই হাসি-ভরা গলা— ‘দু’রাত জাগা কিন্তু, সমানে গাড়ি চালাচ্ছি। কোথাও যেতে বলবি না তো?’ বললাম অবস্থা। কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় বলল, দশ মিনিটের মধ্যে আসছে।

তাই-ই এল। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে রওনা দিলাম। সমস্ত যশোর রোড জ্যামে বন্ধ। কোন্ অলিগলি দিয়ে পৌঁছলাম বারাসাতে, জানি না। স্ক্যান হল। ছেলের মাথার পিছনে জমাট রক্তের চিহ্ন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ল— প্রায় ছ’বছর চাকরি করেও আমাদের মোট সঞ্চয়— চোদ্দ হাজার টাকা। ব্যাস। সব টাকা উড়িয়ে দিয়েছি বেড়িয়ে। আর হ্যাঁ, আমার এ.টি.এম. কার্ডটা নষ্ট। টাকা তুলতে পারছি না। মা কিছু দিল, শ্বশুরমশাই আলমারি ঝেড়ে বের করে দিলেন টাকা। সব মিলিয়ে বড়জোর দশ হাজার। স্ক্যান করতে চলে গেল অধিকাংশ। যখন এ.এম.আর.আই.-তে গিয়ে পৌঁছলাম— তখন পকেটে তিন-চার হাজার। ছেলেকে আর তার মা-কে নিয়ে গেল উপরে। আমি আর বিশ্ব গেলাম রিসেপশনে। সুন্দরী রিসেপশনিস্ট মিষ্টি হেসে জানালেন— ভর্তি করতে লাগবে দশ হাজার টাকা।

বের করে দেবে না কি আমার ছেলেকে! এই অবস্থায়! এই বৃষ্টির মধ্যে !!

এতক্ষণ একটাও কথা না-বলা বিশ্ব এইবার এগিয়ে এল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করল দু’দিন দু’রাত জেগে রোজগার করা প্রত্যেকটা পয়সা। না-গুনেই গুঁজে দিল আমার হাতে। ঠাণ্ডা গলায় বলল— ‘দ্যাখ তো রাজাদা, হয়ে যাওয়া উচিত।’ ভর্তি করলাম ছেলেকে। সারারাত আমার পাশে, সল্টলেকের ফুটপাথে, অবিশ্রাম বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল বিশ্ব। ভিতরের সোফাগুলোয় ঘুমোচ্ছেন রোগিদের আত্মীয়রা।

তিনদিন পর, দুপুরবেলায় জানা গেল— ছেলেকে ছেড়ে দেবে এবার। ফোন করে জানাতে বলল— ‘কাছেই আছি। আসছি, দাঁড়া।’ যে এনেছিল, সেই চলল হাসিমুখে ফিরিয়ে নিয়ে।

বাড়ির সামনে নামিয়ে, ছেলেকে বিস্তর বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে গাড়ি ঘোরালো বিশ্ব। আমি মানিব্যাগে হাত দিচ্ছি দেখে হাসল একগাল। তারপর ছেলেকে দেখিয়ে বলল—‘আরে ও-ই দেবে বড় হয়ে।’

কাঁপা গলায় বললাম— ‘থ্যাংকস বিশ্ব, তুই না থাকলে যে কী হত…’

বিশ্ব অবাক হয়ে বলল— ‘তুই তো পুরো সাহেব হয়ে গেছিস রে রাজাদা! এরপর তো জেঠিমাকেও বলবি থ্যাংক ইউ; আর বউদিকে ‘‘আই লাভ ইউ হানি’’!!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *