হানাবাড়ি
ইংল্যান্ডের ফরফারশায়ারে (Forfarshire) আর্ল অফ স্ট্র্যাথমোরদের জমিদারি ভবন গ্ল্যামিস প্রাসাদ এক সময় হানাবাড়ি নামে খুব প্রচার লাভ করেছিল। ওই জমিদার বংশের কয়েকজনের অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল, তাদের আত্মাকেই নাকি দেখা যেত প্রাসাদের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াতে।
বাইরে থেকে ওই প্রাসাদকে সত্যিই ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হয়। একগুচ্ছ আদ্যিকালের গম্বুজ, কালের প্রবাহে ধূসর হয়ে যাওয়া পাথরের দেওয়াল, ভেতরে অসংখ্য স্বল্পালোকিত কক্ষ; দীর্ঘ আঁকাবাঁকা গলি বারান্দা এবং ঠান্ডা স্যাঁৎসেঁতে ভূগর্ভস্থ কুঠুরির পর কুঠুরি, যাদের দেওয়াল কোথাও কোথাও কয়েক ফুট চওড়া, সব মিলিয়ে এক প্রাচীন স্থাপত্যের সঙ্গে গা ছম ছম করা শিহরন বয়ে আনে।
শোনা যায় ওই প্রাসাদেই ১০৪০ সালে ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করেছিলেন (সেই কাহিনি নিয়েই শেক্সপিয়র রচনা করেছিলেন তাঁর ‘ম্যাকবেথ’ নাটক)। প্রাসাদের একটি প্রদর্শনী কক্ষে ম্যাকবেথের তরবারি আর একটি জামা রক্ষিত আছে।
চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে ওই প্রাসাদ নির্মিত হলেও সপ্তদশ শতাব্দীতে তার অনেক সংস্কার হয়েছিল, নতুন নতুন দালানকোঠা, গলি বারান্দা আর বড়ো বড়ো পাথরের চাঁইয়ের আগুনচুল্লি নির্মিত হয়েছিল।
ওই জায়গাটার ইতিহাসও খুব প্রাচীন। অনেক বছর আগে ওখানে ছিল স্কটল্যান্ড রাজাদের আধিপত্য। স্কটল্যান্ড তখন স্বাধীন রাজ্য। বিখ্যাত রবার্ট ব্রুসের নাতি দ্বিতীয় রবার্ট ওই অঞ্চলটা তাঁর জামাতা স্যার জন লিওনকে উপহার দিয়েছিলেন। ১৩৭২ সালে তিনি জামাতাকে রাজপরিবারের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। ওখানে তখন একটা প্রাসাদের ধ্বাংসাবশেষ শুধু ছিল, স্যার জন সেটা ভেঙে এক বিশাল ভবন নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা শেষ করে যেতে পারেননি। ইং ১৩৮৩ সালে এক দ্বন্দ্বযুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন।
তাঁর পুত্র, গ্ল্যামিসের প্রথম লর্ড ওই অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করেছিলেন। ইং ১৪৪৫ সালে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। ওই বংশের পুরুষদের মধ্যে যে কয়জন নিরুপদ্রবে পূর্ণ জীবন ভোগ করেছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম।
তাঁর বংশধর, গ্ল্যামিসের দ্বিতীয় লর্ড অল্প দিনেই দুর্জন হিসাবে কুখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মদ্যপ এবং জুয়াড়ি। ‘দুষ্ট জমিদার’ (The Wicked Laird) এই নামে তাঁকে অভিহিত করা হত।
প্রায় একশো বছর পরে গ্ল্যামিসের ষষ্ঠ লর্ড জন তাঁর অসামান্যা সুন্দরী তরুণী ভার্যা জেনেট ডগলাসের সঙ্গে ওই ভবনে বাস করেছিলেন। জেনেটের রূপের খ্যাতি সমস্ত স্কটল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু একদিন স্যার জনকে অন্দরমহলের একটি ঘরে পাথরের মেঝের ওপর মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। তাঁকে বিষ খাইয়ে মেরেছেন এই অভিযোগে জেনেটের বিচার হয়েছিল, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন।
ছয় বছর পরে আবার তাঁকে দাঁড়াতে হল কাঠগড়ায়। এবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও মারাত্মক, তিনি নাকি স্কটল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জেমসকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এবং তিনি নিজে একজন ডাইনি। তাঁর ভৃত্যদের উৎকোচ দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার জন্য বশীভূত করা হয়েছিল। তাঁর নাবালক পুত্রের ওপর এমন অত্যাচার করা হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত সে মায়ের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছিল।
১৫৩৭ সালে ডাইনি এই অভিযোগে এডিনবরায় পুড়িয়ে মারা হয়েছিল জেনেট ডগলাসকে। স্কটল্যান্ডের রাজদরবারে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির প্রতিনিধি রাজার কাছে ওই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই জেনেটকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
জেনেটের নাবালক পুত্র মায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষী দেওয়া সত্ত্বেও কিন্তু নিষ্কৃতি পেলেন না। তাঁর জমিদারি কেড়ে নেওয়া হল এবং তাঁকে নিক্ষেপ করা হল কারাগারে। তিন বছর পরে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। পঞ্চম জেমসের মৃত্যুর পর তাঁর জমিদারি এবং উপাধি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি হয়েছিলেন গ্ল্যামিসের সপ্তম ব্যারন। কুকর্মে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ উইকেড লেয়ার্ড-এর চাইতে কোনো অংশে কম ছিলেন না।
তাঁর ছেলের নামও ছিল জন। বংশের ধারা বজায় রেখে সেও মেতে উঠেছিল অসংযত জীবনে। জ্ঞাতি শত্রু লিন্ডসেদের সঙ্গে এক বিবাদে প্রকাশ্য রাস্তায় প্রাণনাশ হয়েছিল তার।
১৬৬০ সালে প্যাট্রিক লিওনের হাতে এল ওই জমিদারি। ততদিনে গ্ল্যামিসের সেই রমরমা আর নেই, লোকজন প্রায় সবাই চলে গেছে, অবহেলায় দৈন্যদশা জমিদারির, তার ওপর পারিবারিক আর্থিক অবস্থা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
প্যাট্রিক কিন্তু ছিলেন ওই বংশের ধারার একেবারে বিপরীত। সৎ এবং প্রকৃত অর্থে ভদ্র। তিরিশ বছর সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধন করে তিনি ফিরিয়ে এনেছিলেন তাঁর পারিবারিক সৌভাগ্য। মদ, জুয়া, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন কোনো কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। বংশের মানমর্যাদা পুনরুদ্ধারই ছিল তাঁর একমাত্র সংকল্প। তিনি কিন্তু স্ট্র্যাথমোরের প্রথম ‘আর্ল’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যও হয়েছিলেন তিনি।
বোধ হয় নিজের নিরাপত্তার জন্যই তিনি গ্ল্যামিস প্রাসাদের অনেক সংস্কার করেছিলেন এবং গোপন কুঠুরি বানিয়েছিলেন। ওই প্রাসাদে ঘরের সংখ্যাই হল একশো কুড়ি। ১৬৯৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর লিওন পরিবারে আবার ঘনিয়ে আসে দুর্যোগের মেঘ। প্যাট্রিকের প্রথম পুত্র জ্যাকোবাইট বিদ্রোহে যোগ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে হত হয়েছিলেন। তাঁর সহোদর চার্লস অভিষিক্ত হলেন স্ট্র্যাথমোরের আর্লের পদে। তিনি ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল, সুরাসক্ত এবং জুয়াড়ি। ১৭২৮ সালে এক জুয়ার আড্ডায় কলহে প্রবৃত্ত হয়ে তিনি খুন হয়েছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্ল্যামিস ভবনের হানাবাড়ি হিসাবে খুব দুর্নাম রটেছিল। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক স্যার ওয়াল্টার স্কট তাঁর এক ঐতিহাসিক কাহিনির মালমশলা সংগ্রহের জন্য এবং হানাবাড়ির অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে এই আশায় একটা রাত ওখানে কাটিয়েছিলেন।
‘ঘরের দরজা বন্ধ করার পর আমার মনে হয়েছিল যেন বাইরের জগৎ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। একটা গা শিরশির করা অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করেছিল।’ স্যার ওয়াল্টার স্কট পরে একথা বলেছিলেন। তিনি অবশ্য কোনো ভূতের দেখা পাননি।
পরবর্তীকালে অনেকেই কিন্তু বলেছেন প্রাসাদের গলি বারান্দায় তাঁরা দীর্ঘদেহী এক মানুষের দেখা পেয়েছেন, মুখে তার কুচকুচে কালো দাড়ি, লম্বা জুলফি, গ্ল্যামিসের অপঘাতে মৃত জমিদারদের অতৃপ্ত আত্মাই কি ওখানে ফিরে ফিরে আসে। মদ্যপ এবং জুয়া খেলায় অভ্যস্ত তাদের প্রেতাত্মা মৃত্যুর পরেও হয়তো প্রাসাদের প্রায়ান্ধকার কক্ষে এবং গলি বারান্দায় জুয়া খেলার সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। এ নিয়ে এক গল্প ইংরেজ কাহিনিকার একটা ভূতের গল্পও লিখেছিলেন। সেটা হল—
‘অনেক বছর আগে গ্ল্যামিস প্রাসাদে এক জমিদার ছিলেন। যতরকম পাপ কাজ আছে সবেতেই তিনি ছিলেন দক্ষ। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় নেশা ছিল তাসের বাজি। মদে চুর হয়ে তিনি বসতেন জুয়া খেলতে, তখন মেজাজটাও থাকত সপ্তমে চড়া।
‘খেলার সঙ্গী না পেলে তিনি বাড়ির পরিচারকদের সঙ্গে, এমনকী আস্তাবলের সহিসদের সঙ্গে পর্যন্ত বাজির খেলায় বসে যেতেন। নভেম্বর মাসের এক দুর্যোগপূর্ণ রবিবারের রাত্রে মত্ত অবস্থায় তিনি জেদ ধরলেন কাউকে তাঁর সঙ্গে তাসের বাজিতে বসতে হবে। কিন্তু কেউ খেলতে রাজি হল না, এমনকী পরিচারকরা পর্যন্ত নয়, কারণ সেটা ছিল রবিবার, শাস্ত্রমতে খ্রিস্টানদের কর্মবিরতির দিন— স্যাবাথ।
‘ক্ষিপ্ত জমিদার তখন তাঁর পরিবারের যাজককে ডেকে পাঠালেন, তাঁকে আহ্বান করলেন তাসের বাজিতে। যাজক শুধু অস্বীকারই করলেন না, সবাইকে সাবধান করে দিলেন স্যাবাথের পবিত্রতা তারা যেন জুয়া খেলে অপবিত্র না করে। একথাও তিনি বললেন যে, বাজির নেশা হল শয়তানের ছলাকলা, একবার তার খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার নেই। আরও খেপে গেলেন গ্ল্যামিস প্রাসাদের মালিক। তিনি নিদারুণ শপথবাক্য উচ্চারণ করতে করতে ওপরে নিজের ঘরে যেতে যেতে বললেন, ‘শয়তানের সঙ্গেই তবে আমি ধরব তাসের বাজি।’
‘বেশিক্ষণ হয়নি, হঠাৎ তাঁর ঘরের পুরু দরজায় ঘন ঘন করাঘাতের সঙ্গে এক গুরুগম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল, ‘তুমি কি জুয়া খেলার সঙ্গী খুঁজছ?’
‘হ্যাঁ,’ চেঁচিয়ে বললেন জমিদার, ‘তুমি যে-ই হওনা কেন ভেতরে এসো।’
‘দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল দীর্ঘদেহী, কৃষ্ণকায় এক মানুষ। আগন্তুকের গায়ে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা কালো কোট, মাথায় একটা কালো টুপি, প্রায় আধ হাত উঁচু। আগন্তুক ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর চেয়ার টেনে বসল জমিদারের মুখোমুখি।
‘জমিদার ভবনে নেমে এল আতঙ্কের ছায়া। একটা কী হয়, কী হয় ভাব। ভীত পরিচারকরা নিঃশব্দে ওপরে উঠে ওই ঘরের সামনের গলি বারান্দায় ভিড় করল। ভেতর থেকে তাদের কানে ভেসে আসছিল অশ্রাব্য গালিগালাজ, খেলুড়ে দু-জনের কেউ কম যায় না। যতই খেলা এগোচ্ছিল, কটূক্তি আর গালিবর্ষণ যেন তীব্রতর হচ্ছিল। জমিদার একটার পর একটা বাজিতে হারছিলেন, শেষ পর্যন্ত বাজি ধরার মতো কিছুই আর তাঁর ছিল না। তখন তিনি আগন্তুক যা নিয়ে খুশি হবে তাই দেবেন বলে অঙ্গীকারপত্রে সই করে দিলেন।
‘এদিকে তাঁর পরিচারকদের যে প্রধান (বাটলার) সে ভেতরে কী হচ্ছে দেখবার জন্য দরজায় চাবির গর্তে একটা চোখ রেখেছিল। সঙ্গেসঙ্গে একটা আগুনের ঝলকে সে যন্ত্রণায় মাটিতে লুটোপুটি খেতে লাগল, তার চোখের চারপাশে একটা পোড়া দাগ। দরজা খুলে গেল আর জমিদার বেরিয়ে এসে তাঁর ওপর নজরদারি করার জন্য যাচ্ছেতাই ধমকালেন তাদের।
‘কিন্তু ঘরে ফিরে সেই আগন্তুককে তিনি আর দেখতে পেলেন না, সেইসঙ্গে তাঁর স্বাক্ষরিত অঙ্গীকারপত্রটাও উধাও— হেরে গেলে তাঁর আত্মার মালিক হবে আগন্তুক এই মর্মে তিনি অঙ্গীকারপত্রে সই করেছিলেন।
‘জমিদারের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর সঙ্গে খেলতে এসেছিল স্বয়ং শয়তান! সে দরজার দিকে পিছন ফিরে বসেছিল, দরজার দিকে না তাকিয়েই সে বলে উঠেছিল, ‘ওই চোখটাকে যন্ত্রণা দাও’— আর তখুনি ঘরের মধ্যে বিদ্যুতের মতো আলো ঝলসে উঠে দরজার চাবির গর্তে ছিটকে পড়েছিল, তাতেই আহত হয়েছিল হতভাগ্য বাটলার। সেই শয়তানের কাছেই তিনি বন্ধক রেখেছেন তার আত্মা।
‘ওই জমিদার আরও পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর পর নভেম্বর মাসের প্রত্যেক স্যাবাথের রাত্রে তাঁর প্রেতাত্মা ওই ঘরে ফিরে এসে শয়তানের সঙ্গে তাসের বাজিতে বসত। শয়তানের হাত থেকে নিজের আত্মা ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে বসতে হত তাসের বাজিতে। সেই সময় ওই ঘর থেকে ভেসে আসত চিৎকার চেঁচামেচি আর অশ্রাব্য গালাগালি। শেষপর্যন্ত ওই ঘরে যাবার গলি বারান্দা ইট গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।’
এটা অবশ্য গল্পই।