হাতের পাঞ্জা

হাতের পাঞ্জা

উত্তরপ্রদেশের একটি বর্ধিষু গ্রাম। সবারই প্রায় সচ্ছল অবস্থা। গাঁয়ের লোকবসতি যেমন কম, অভাবও তেমনি নগণ্য। ওই সুখী গাঁয়ে একমাত্র অসুখী লোক ছিল রাজেশ। তার ঠাকুরদা একজন ভূস্বামী ছিলেন, কিন্তু রাজেশের বাবা ছিলেন বেহিসেবি এবং যাকে বলে উড়নচণ্ডী। ফলে বাবা মারা যাবার পর রাজেশের ভাগ্যে জমিজমা আর জুটল না, সব তার বাবা বেচে দিয়েছিলেন। রাজেশ ঠিক করল শহরে গিয়ে কাজকর্মের চেষ্টা করবে, কিন্তু বাড়িটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ওটা পুরোনো হলেও সাবেকি আমলের, ঘরও অনেক।

ঠিক এই সময় অশোক শর্মা ওই বাড়িটা দীর্ঘমেয়াদি লিজ নেবার জন্য এগিয়ে এলেন। মি শর্মা কেমন করে বাড়িটার কথা জানতে পারলেন সেটাই আশ্চর্য, কারণ তিনি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা নন। কোথা থেকে তিনি এসেছেন, কী করেন, কিছুই জানা গেল না। ভদ্রলোক সত্যিকার সুপুরুষ, কিন্তু কেমন যেন নির্বিকার ভাব। চেহারা দেখে তাঁকে মধ্যবয়সি অনুমান করা যায়। তিনি যে বেশ অবস্থাপন্ন, সে-বিষয়ে গাঁয়ের কারো মনে সন্দেহ ছিল না। ভদ্রলোক একা একজন চাকর নিয়ে অত বড়ো বাড়িতে বাস করতে শুরু করলেন। গাঁয়ের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা দূরের কথা, সামনাসামনি পড়লেও তিনি অনেকটা উপেক্ষা ভরেই তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন। এই কারণে গাঁয়ের মানুষরাও তাঁকে অনেকটা একঘরে করার মতো এড়িয়ে চলত।

গাঁয়ের ডাক্তার প্রকাশ খান্নাই একমাত্র তাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন। এক সন্ধ্যায় মি শর্মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাঁর চাকর ডা খান্নাকে ডেকে নিয়ে আসে। মি শর্মা বিছানায় চিত হয়ে শুয়েছিলেন, তাঁর সমস্ত শরীর ঠান্ডা ও শক্ত হয়ে গেছে, খোলা চোখ দুটি স্থির আছে, ঠিক যেন একটি মৃতদেহ।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তাঁর শরীরের কাঠিন্য দূর হল, চোখে স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে এল। উঠে বসে তিনি ডা খান্নার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তারপর যেন রাগত কণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন, ‘কে আপনি?’

‘আমি এ গাঁয়ের ডাক্তার। আপনার চাকরের মুখে আপনি অসুস্থ এই খবর পেয়ে এসেছি।’

ডা খান্না মানুষটি ছিলেন হাসিখুশি, মিশুকে— যাকে বলে ভালোমানুষ। তিনি বুঝলেন তাঁকে জবাব দেওয়া হল একটু রূঢ়ভাবেই, তবু তিনি রাগ করলেন না।

‘আচ্ছা, নমস্কার।’ মৃদুকণ্ঠে কথাটা বলে তিনি দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

‘এক মিনিট ডাক্তার সাব।’ মি শর্মা বলে উঠলেন, ‘আমার ব্যবহারে আপনি হয়তো অসন্তুষ্ট হলেন। আপনাকে খুলেই বলি, এই ধরনের রোগের আক্রমণ আমার মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে। ঠিক কখন যে আক্রান্ত হব, তা আগে আমি টের পাই না। আক্রান্ত হবার পর এক ঘণ্টা থেকে এক নাগাড়ে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত আমার শরীর অসাড় হয়ে যায়। সেসময় কোনো ডাক্তারের চিকিৎসাই আমার উপকারে আসে না। ওই ঘোরটা কেটে যাবার সঙ্গেসঙ্গেই আমার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে, তা আপনি নিজের চোখেই দেখলেন।’

‘আপনার মনও কি সেই সময় অচেতন থাকে?’ ডা খান্না প্রশ্ন করলেন।

‘বর্তমান সম্বন্ধে অচেতন, কিন্তু অতীত সম্বন্ধে সম্পূর্ণ চেতনা থাকে।’ একটা ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে মি শর্মা জবাব দিলেন।

‘আপনার কি সেসময় কোনো কষ্ট হয়?’

‘হ্যাঁ! আমার মনে হয়, যেন একটা বরফের মতো ঠান্ডা হাত হৃৎপিণ্ডের ওপর চেপে বসেছে; তারপর চাপটা বাড়তে থাকে, অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।’

‘হুম!’ ডা খান্না মন্তব্য করলেন, ‘কেসটা একটু অদ্ভুত ধরনের, তবে চিকিৎসায় সারবে না এমন নয়। আমার কথামতো ওষুধ খেতে আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তবে ওই যন্ত্রণার উপশম আমি করতে পারব বলে আশা রাখি।’

‘ভুল, মস্ত ভুল, ডাক্তার সাব। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনারা ফল সম্বন্ধে আশাবদী, ততক্ষণ আপনারা শুধু ওষুধের ব্যবস্থাই করে যান।’

‘আমাদের পেশা সম্বন্ধে আপনার ভালো ধারণা নেই দেখছি।’

‘পেশা সম্বন্ধে যতটা নয়, যারা ওই বৃত্তি গ্রহণ করেছে, তাদের সম্বন্ধে বলতে পারেন। পৃথিবী শঠ আর মূর্খে ভরা; মূর্খরা ওষুধ গ্রহণ করে, আর যারা শঠ তারা ওষুধের ব্যবস্থা করে।’

ডা খান্না এবার ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘তবে কি আমি ধরে নেব, পৃথিবীতে আপনিই একমাত্র উঁচুদরের মানুষ, যেহেতু আপনি ওষুধের ব্যবস্থা করার মতো শঠও নন, কিংবা ওষুধ গ্রহণ করার মতো মূর্খও নন!’

‘আপনাকে কিছুই ধরে নিতে হবে না। আমার মধ্যে আপনি এমন একজন মানুষের দেখা পাবেন, যে লোভে অন্ধ হয়ে একমাত্র বন্ধুর প্রতি শুধু অবিচারই করেনি, ঘোর অপরাধ করেছিল, আর যার ফলে আজ আমার এই পরিণতি। আপনি যদি আমার জীবনের ইতিহাস জানতেন তবে—’

‘তবে কী?’

‘এক হতভাগ্য মানুষের জন্য হয়তো আপনি অনুকম্পা বোধ করতেন। কৃতকর্মের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে আমাকে। আচ্ছা, নমস্কার।’

মি শর্মা এই প্রসঙ্গে আর কিছু আলোচনা করতে ইচ্ছুক নন, বুঝতে পেরে ডা খান্না বিদায় নিলেন। তাঁর মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি মারছিল, ভদ্রলোকের মাথায় কি গোলমাল আছে? অথবা ভদ্রলোক এমন একজন রহস্যময় মানুষ যাদের কথা গল্প বলেই মনে হয়।

বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। মি শর্মা এখনও আগের মতোই রহস্যময় রয়ে গেছেন। ডা খান্নার সঙ্গে বার দুই তাঁর পথে দেখা হয়েছে, সামান্য ভদ্রতাসূচক কথাবার্তাও হয়েছে, কিন্তু ওই পর্যন্ত। গাঁয়ের আর কারো সঙ্গে তিনি নিজে থেকে আলাপ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেননি, তাঁরাও নিজেদের সম্মান বাঁচিয়ে চলেছেন।

ঠিক এই সময় একটা ঘটনা ঘটল, রেল দফতর থেকে জানানো হল, একটা ব্রাঞ্চ লাইনের জন্য ওই গাঁয়ের অনেকটা জমি দরকার, কারণ লাইনটা গ্রামের মাঝবরাবর গিয়ে আর একটা লাইনের সঙ্গে মিশবে। ওই বিজ্ঞপ্তির পর গাঁয়ে খুব উত্তেজনা দেখা দিল। অনেকের জমি তো যাবেই, তা ছাড়া লাইন বসানো হলে গাঁয়ের যে শান্তি ভঙ্গ হবে, সে-বিষয়ে ওখানকার লোকের মনে কোনো দ্বিমত ছিল না।

গাঁয়ের মানুষরা সমস্বরে প্রতিবাদ করে উঠল। ঠিক হল, সরকারের কাছে গণস্বাক্ষর দিযে ওই প্রস্তাব কার্যকর না করার জন্য অনুরোধ জানানো হবে। ভূস্বামীদের মধ্যে ভার্মাজিই ছিলেন বয়সে ও সম্পদে সবার বড়ো। তাঁর বাড়িতে একটা মিটিং ডাকা হল, গাঁয়ের সম্মানিত সবাই সেখানে একটা নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়ে চিঠির খসড়া সম্বন্ধে আলোচনা করবেন। খাওয়া-দাওয়ারও ব্যবস্থা আছে।

মি শর্মা এই প্রসঙ্গে একটা চিঠি পেলেন, কিন্তু জবাব দেওয়া প্রয়োজন মনে করলেন না। দ্বিতীয় চিঠিতে তাঁকে জানানো হল, তিনি যে বাড়ি লিজ নিয়েছেন, সেটাও রেললাইনের পরিকল্পনার মধ্যে পড়ছে। এর উত্তরে তিনি লিখলেন যে, খবরটা শুনে তিনি দুঃখিত, কারণ রেললাইন তাঁর জমির ওপর দিয়ে গেলে, তাঁকে অবশ্যই ও জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে, কিন্তু প্রস্তাবিত অধিবেশনে যোগ দেবার কোনো ইচ্ছে তাঁর নেই।

গাঁয়ের লোকেরা তখন ডা খান্নাকে দিয়ে তাঁর ওপর চাপ দিল। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হলেন। কিন্তু বললেন, তাঁর উপস্থিতির ফলে যা-ই ঘটুক না কেন, তার জন্য তাঁকে যেন পরে দায়ী করা না হয়।

মি শর্মাকে ওই সভায় আমন্ত্রণ জানাবার কারণ ছিল। কেমন করে জানি রটে গেছিল তিনি খুব বিদ্বান এবং নানা দেশ ঘোরার ফলে তাঁর অভিজ্ঞতাও প্রচুর, ইংরেজিতে যাকে বলে ম্যান অভ দ্য ওয়ার্ল্ড। তাই তাঁকে দিয়ে প্রস্তাবিত প্রতিবাদ লিপির খসড়া তৈরি করাবার বুদ্ধিটা কয়েকজনের মাথায় এসেছিল। গাঁয়ের ভূস্বামীরা ধনী হলেও ঠিক যাকে বলে বিদ্বান, তা কেউ ছিলেন না। তা ছাড়া মি শর্মার লিজ নেওয়া বাড়ি ও জমির পুরোটাই রেল কর্তৃপক্ষের নকশার মধ্যে পড়েছিল, তাই প্রতিবাদী হিসেবে তাঁকেও দলভুক্ত করাটা গাঁয়ের অধিবাসীদের নিজেদের স্বার্থেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

নির্ধারিত দিনে মি শর্মা কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় (ওই সময়টাই চিঠিতে উল্লেখ ছিল) ভার্মাজির বাড়ি এলেন। ভার্মাজি এবং গাঁয়ের দু-চারজন মাতব্বর গোছের মানুষ এগিয়ে এসে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন, তিনি আসাতে সবাই যে খুশি হয়েছেন, তা জানাতেও কার্পণ্য করলেন না। মি শর্মা গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন, তিনি এসব সভায় আসা পছন্দ করেন না, কিন্তু ডা খান্না পীড়াপীড়ি করায় ভদ্রতার খাতিরেই এসেছেন।

তারপর সকলে যাতে শুনতে পায়, এমনভাবে গলা তুলে বললেন, ‘ভালো কথা, আমার এক বন্ধুও আসবেন, আমার পাশের আসনটা তাঁর জন্য খালি রাখলে আমি বাধিত হব।’

মি শর্মার কথা শুনে সবাই অবাক হল, কারণ তাঁর কেউ বন্ধু আছে বলে কারো জানা ছিল না। কাউকে তাঁর বাড়ি যেতেও কেউ কখনো দেখেনি।

‘আপনার বন্ধুও কি আমাদের এই ব্যাপারে আগ্রহী?’ ভার্মাজি জিজ্ঞেস করলেন।

‘একটুও না।’

‘তাঁর কি এখানে কোনো সম্পত্তি আছে?’

‘না।’

‘আমাদের এই সভায় শুধু তাঁদেরই আসতে বলা হয়েছে,’ ভার্মাজি একটু যেন অপ্রতিভের মতো বললেন, ‘যাঁরা আজকের আলোচনায় যোগ দেবেন কিংবা যাঁদের জমি রেল কর্তৃপক্ষ দখল করতে চাইছেন।’ ‘আপনাদের কোনো আপত্তি থাকলে, আমি চলে যাচ্ছি।’

‘না, না, আপনার বন্ধু আমাদেরও অতিথি।’

ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ একটা উৎকট নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে, তারপর আবার গুঞ্জন শুরু হয়। ইতিমধ্যে সবার খাবার ডাক এল, কথা ছিল মধ্যাহ্নভোজনের পর সবাই হৃষ্ট মনে গুরুতর বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় বসবেন। ভার্মাজি তাঁর বড়োলোকি চাল দেখাবার এই অপূর্ব সুযোগ খুশি মনেই গ্রহণ করেছিলেন, তাই খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও করেছিলেন প্রচুর।

‘আপনার বন্ধুকে দেখছি না তো?’ তিনি মি শর্মাকে বললেন, ‘অপরিচিত কাউকে চোখে পড়ছে না।’

‘উনি এখনও আসেননি, কিন্তু আসবেন। আপনি তার জন্য ব্যস্ত হবেন না, শুধু আমার পাশের আসন খালি রেখে দেবেন।’

সবাই খেতে বসলেন। ভার্মাজি চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করেছিলেন। সুস্বাদু রান্না, পদও অনেক। সবাই নিবিষ্ট চিত্তে খাচ্ছিলেন; হঠাৎ কেন জানি সবাই মুখ তুললেন আর ভীষণ চমকে উঠলেন। খালি চেয়ারটা আর খালি নেই। মি শর্মা কিন্তু এতটুকু আশ্চর্য হয়েছেন বলে মনে হল না। তাঁর পাশের চেয়ারটিতে যিনি বসে আছেন, তাঁর চেহারায় আভিজাত্যের চিহ্ন ফুটে উঠেছে, বয়স চল্লিশে থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। আগন্তুকের কাঁচা-পাকা কোঁকড়ানো চুল পরিপাটিভাবে আঁচড়ানো। সবচেয়ে আশ্চর্য হল তাঁর গায়ের রং— অনেকটা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে, কেমন যেন অস্বস্তির সৃষ্টি করে। পোশাকও এখানকার মানুষদের মতো নয়, কালো প্যান্ট, দুধের মতো সাদা শার্ট, কালো কোট, গলায় টাই আর পায়ে চকচকে কালো জুতো।

চেয়ারে চুপচাপ তিনি বসে ছিলেন। কেউ তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখেনি, কেউ তাঁকে চেয়ারে বসতে দেখেনি— যেন জাদুমন্ত্রবলে তিনি সকলের চোখে ধুলো দিয়ে ঘরে ঢুকে আসন গ্রহণ করেছেন। আগন্তুকের বাঁ-হাতের আঙুলগুলো টেবিলের ওপর খেলা করছিল। সবিস্ময় সবাই লক্ষ করলেন তাঁর তর্জনী ও অনামিকার আঙুল দুটো নেই।

আশ্চর্যের ব্যাপার, সবাই যখন খাওয়া বন্ধ করে অবাক হয়ে আগন্তুককে দেখছিলেন, মি শর্মা কিন্তু সম্পূর্ণ উদাসীন, তাঁর পাশে যিনি বসে আছেন তাঁর সম্বন্ধে যেন তিনি নিরাসক্ত অথচ আগন্তুকের উপস্থিতির জন্য তিনিই দায়ী। কারো সঙ্গে আগন্তুকের পরিচয় করিয়ে দেওয়াও তিনি প্রয়োজন মনে করলেন না। একটা দারুণ অস্বস্তিতে সবার মন ভরে উঠল।

ভার্মাজিই আবহাওয়া সহজ করে তোলার উদ্দেশ্যে একটা হাসির কথা বললেন। আস্তে আস্তে ঘরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এল।

পাতে বড়ো বড়ো মাছের টুকরো পড়তেই কে একজন বলে উঠলেন, ‘সেবার বর্ষায় বিলের জল উপচে ডাঙা ভাসিয়েছিল মনে আছে? বড়ো বড়ো রুই-কাতলা ধানের খেতে, পথে-ঘাটে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমাদের সবজি বাগানেই তো একটা ইয়া বড়ো কাতলা মাছ ধরেছিলাম। সেটা বোধ হয় ১৯৪৪।’

‘না,’ আগন্তুক বললেন, ‘১৯৪৫।’

‘আপনি…আপনি কি তখন এখানে ছিলেন?’ যিনি বলছিলেন তিনি যেন একটু তোতলা হয়ে গেলেন।

‘না।’

‘বছরটা আমার ঠিক মনে নেই, তবে সেবারই আলি হোসেন তার বউকে খুন করে জেলে গিয়েছিল। বিচারে ওর তিরিশ বছর জেল হয়েছিল, ছাড়া পাবার সময় হয়ে এল বোধ হয়।’ সে ভদ্রলোক আবার বললেন।

‘আলি হোসেন কোনোদিনই আর ছাড়া পাবে না।’ আগন্তুক বললেন।

‘আপনি কি তাকে চেনেন।’ ভার্মাজি কৌতূহল ভরে প্রশ্ন করলেন।

‘অল্প কিছুদিন আগে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।’

‘কোথায়? আগ্রা জেলে?’

‘না।’

‘এখন তবে ও কোথায় আছে?’

‘কবরে।’

ভর্মাজি অনাহূত অতিথির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন; তাঁর গা ছমছম করে উঠল।

খাওয়া-দাওয়ার পর আসল উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হল। সবাই একসঙ্গে কথা বলতে থাকায় এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হল, যাকে হট্টগোল ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। শেষ পর্যন্ত মি শর্মাকে ভার্মাজি কিছু বলতে অনুরোধ করলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে এমন জ্বালাময়ী বর্ক্তৃতা দিলেন, যা ওখানকার মানুষ কোনোদিন শোনেনি। শেষ পর্যন্ত ঠিক মি শর্মাই প্রতিবাদলিপির খসড়া বানাবেন।

এতক্ষণ পর্যন্ত আগন্তুক চুপচাপ কথা শুনছিলেন। প্রতিবাদপত্রের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আপনারা অনর্থক কষ্ট করবেন, আপনাদের আবেদনে কিছুই হবে না।’

‘আপনি কী করে জানলেন?’ ভার্মাজি তীক্ষ্ন কণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন।

‘আমি সত্যি কথাই বলছি।’

‘আপনি হয়তো রেল কোম্পানির একজন লোক।’ কে একজন ব্যঙ্গকণ্ঠে বলে উঠল।

‘আজ থেকে ঠিক উনিশ মাসের মাথায়,’ শান্তকণ্ঠে আগন্তুক বললেন, ‘এই গাঁয়ের মাঝ দিয়ে একটা ট্রেন যাবে—’

‘আশা করি আপনার ভবিষ্যদবাণী সফল হবে না।’ ভার্মাজি বললেন।

‘বিফল হবে না।’

যাই হোক, আবেদনপত্র পাঠানো হবে এবং সকলে সই দেবেন এই প্রস্তাবমতো সভা ভঙ্গ হল।

‘আপনার ভবিষ্যদবাণী আমাদের মনে এতটুকু রেখাপাত করেনি; দেখলেন তো!’ ভার্মাজি আগন্তুককে পরিহাস করে বললেন।

আগন্তুক সামান্য হেসে বললেন, ‘পাঁচ সপ্তাহ পরে আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে—’

‘আপনি দেখছি সময় সম্বন্ধেই বেশি ভবিষ্যদবাণী করেন।’ ভার্মাজি জবাব দিলেন।

আগন্তুক কোনো কথা না বলে মৃদু অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

ডা খান্না এই সুযোগে মি শর্মাকে পাকড়াও করলেন। বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার বন্ধুর চেহারাটি কেমন যেন অস্বাভাবিক।’

‘ঠিকই বলেছেন।’

‘উনি কি কোনো অসুখে ভুগছেন? আমি পেশাগত আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞেস করছি— অন্য কোনো কারণে নয়।’

‘না, কোনো অসুখে ভুগছেন না, আমি হলপ করে বলতে পারি।’ জবাব দেবার সময় মি শর্মার শরীর কেঁপে উঠল।

‘অদ্ভুত,’ ডা খান্না অনেকটা যেন আপনমনেই বললেন, ‘জীবিত মানুষের এমন গায়ের রং আগে কখনো চোখে পড়েনি।’

‘উনি হয়তো জীবিত মানুষ নন।’ কথাটা বলেই মি শর্মা বেরিয়ে গেলেন আর ডা খান্না হতবুদ্ধির মতো তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

পাঁচ সপ্তাহ পরে ভার্মাজি তাঁর ঘোড়ায় চেপে সান্ধ্য-ভ্রমণ করে ফিরছিলেন। অনেক দিনের পুরোনো ঘোড়া, খুব বাধ্য। হঠাৎ ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠে ভার্মাজিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ছুট মারল। নরম মাটির ওপর পড়ায় তাঁর তেমন কিছু চোট লাগল না, কিন্তু তিনি ঘোড়ার ব্যবহারে আশ্চর্য হলেন। উঠে দাঁড়িয়ে গা-হাত-পা ঝেড়ে তিনি ঘোড়াটা যেদিকে গেছে, সেদিকে এগিয়ে গেলেন। একটা পুকুরপাড়ে ঘোড়া স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার পাশেই একজন মানুষের মূর্তি তাঁর চোখে পড়ল। মূর্তিটি আর কেউ নয়, পাঁচ সপ্তাহ আগে তাঁর বাড়িতে দেখা সেই অনাহূত অতিথি, আর সেদিনও তাঁর গায়ে যে পোশাক ছিল, আজও তাই। তাঁর দিকে পেছন ফিরে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

ওই নির্জন খোলা জায়গায়, পড়ন্ত বেলায় অমনভাবে ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভার্মাজির একটু ভয়ই হল। সাহসী বলে তাঁর অহংকার ছিল, কিন্তু এই অপরাহ্নে তাঁর মনে হল এই লোকটির সঙ্গে এই অবস্থায় দেখা না হলেই বোধ হয় ভালো ছিল।

যাই হোক তিনি এগিয়ে গেলেন। তাঁর পায়ের শব্দে ওই ভদ্রলোক ফিরে তাকাবেন— এটাই ভার্মাজি আশা বা আশঙ্কা করেছিলেন, কিন্তু তেমন কিছু হল না। ভার্মাজি যখন আবার ঘোড়ার পিঠে চেপে ফেরার জন্য ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়েছেন, তখনই মূর্তিটি ঘুরে দাঁড়াল। ভার্মাজির মুখের দিকে তাকিয়ে যে হাতে দুটো আঙুল নেই, নিঃশব্দে সে-হাতটা বাড়িয়ে দিল পুকুরের জলের দিকে।

ভার্মাজি জোরকদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।

ওই ঘটনার পর মাস তিনেক কেটে গেছে। গাঁয়ের মানুষদের আর্জি আবেদন সব নিষ্ফল হয়েছে। কয়েকশো মজুর রেললাইন বসাবার কাজে উদয়াস্ত খাটছে, গাঁয়ের শান্ত নির্জনতা আর নেই। যে পুকুরপাড়ে ভার্মাজি অনাহূত অতিথিকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন, রেললাইনের বাঁধ তৈরির জন্য সেই পুকুরের জল ছেঁচে ফেলা দরকার হয়ে পড়ল। যখন পুকুরের জল প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে, তখন একটা ভয়ানক দৃশ্যে কুলি-মজুরের দল আঁতকে উঠে কাজ বন্ধ করল, ঊর্ধ্বতন কর্মচারীরা ছুটে এলেন। দৃশ্যটি আর কিছু নয়, মানুষের একটি কঙ্কাল— কাদায় বুক পর্যন্ত ডুবে আছে।

হাতের কাছেই ছিলেন ডা খান্না, তাই তাঁর ডাক পড়ল। তিনি কঙ্কালটাকে পরীক্ষা করে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আশ্চর্য, বাঁ-হাতের দুটো আঙুল নেই।’

কার কঙ্কাল? পুকুরেই-বা এল কী করে? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। কঙ্কালটাকে কবর দেওয়া হোক, এই সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত সবাই মেনে নিলেন। ফেরার পথে ডা খান্নার মনে হল, মি শর্মা হয়তো ওই কঙ্কাল সম্বন্ধে কিছু জানতে পারেন। তাঁর রহস্যময় বন্ধুরও বাঁ-হাতের দুটো আঙুল ছিল না।

তিনি মি শর্মার বাড়ির দরজার কড়া নাড়লেন, কিন্তু কোনো জবাব পেলেন না। বারকয়েক ব্যর্থ চেষ্টার পর তিনি খিড়কির দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। মি শর্মার চাকরটি কী কারণে কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাই বাড়িতে ভদ্রলোক একা। যদি ওই অবস্থায় ভদ্রলোক অদ্ভুত সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন— এই আশঙ্কায় ডা খান্না ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খিড়কির দরজা খোলাই ছিল। তিনি ভেতরে ঢুকলেন। বসবার ঘরে পা দিয়েই যে দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল, তাতে তিনি চমকে উঠলেন। মি শর্মা মাটিতে চিত হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে।

উনি কি মারা গেছেন, না সেই বিচিত্র পীড়ায় জ্ঞান হারিয়েছেন? ডা খান্না হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর একটা হাত তুলে নাড়ি পরীক্ষা করলেন। নাড়ির গতি নেই। নাকের কাছে হাতের তালু ধরলেন, না, নিশ্বাস পড়ছে না। ভদ্রলোক সত্যিই মারা গেছেন। ডা খান্না নিঃসন্দেহ হবার জন্য বুকের কাছে জামাটা সরালেন, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন অনুভব করার উদ্দেশ্যে একটু ঝুঁকে পড়তেই ভূত দেখার মতো তিনি চমকে উঠলেন। মি শর্মার বুকে হৃৎপিণ্ডের ঠিক ওপর, একটা হাতের ছাপ পরিষ্কার ফুটে উঠেছে, আঙুলগুলিও স্পষ্ট, শুধু দ্বিতীয় আর চতুর্থ আঙুলের চিহ্ন নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *