নেপালি ড্রাইভার
আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের ঘটনা। ঘটনা বলছি এইজন্যে যে, এই কাহিনি যার মুখে আমি শুনেছি তাঁর নিজের জীবনেই এটা ঘটেছিল।
ভদ্রলোক আমার প্রতিবেশী। নাম গোপাল মুখার্জি। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হলেও স্বাস্থ্যবান চেহারা, সহজেই নজর কাড়ে। যখনকার কথা বলছি তখন তাঁর বয়স ছিল তেইশ-চব্বিশ। নিয়মিত ব্যায়াম করতেন, শুধু বলিষ্ঠ চেহারাই ছিল না, মনেও ছিল অফুরন্ত সাহস। বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে এতটুকু বুক কাঁপত না।
গোপালবাবু তখন সবে এক নামি ওষুধ কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের পদে যোগ দিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গে ওই কোম্পানির কয়েকজন প্রতিনিধি তখন কাজ করছিলেন, তাঁদের সাহায্য করার জন্য তাঁকে ওখানে যাবার নির্দেশ দেওয়া হল। দার্জিলিং-এর কাছে ওই কোম্পানির একটা গেস্ট হাউস বা অতিথি নিবাস ছিল। সেখানেই গিয়ে উঠবেন, ওখানে থেকেই শুরু হবে তাঁর কাজ। দার্জিলিংকে কেন্দ্র করে আশপাশ এলাকার সব ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে দেখা করে কোম্পানির তৈরি ওষুধের গুণপনা এবং উপকারিতা সম্বন্ধে তাঁদের মনে বিশ্বাস জন্মাবার দায়িত্ব হচ্ছে এইসব প্রতিনিধিদের, যাতে ডাক্তারবাবুরা অসুখবিসুখে ওই কোম্পানির ওষুধ ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। এটা অবশ্য খুব সহজ কাজ নয়, এর জন্য চাই বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে ওষুধের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা যাতে ডাক্তারবাবুদের মনে প্রত্যয় জন্মায়। তা ছাড়া অন্যান্য কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ব্যাপার তো আছেই।
গোপালবাবুকে এ ব্যাপারে কিছুদিন শিক্ষানবিশ থাকতে হয়েছিল। তবে তাঁর চমৎকার স্বাস্থ্য আর সপ্রতিভ চালচলন এই কাজের পক্ষে তাঁকে একটা অতিরিক্ত সুবিধে এনে দিয়েছিল। তা ছাড়া ভরসার কথা তিনি একা নন, ওই গেস্ট হাউসে সেই সময় কোম্পানির আরও কয়েকজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলেন, তাঁরাই সব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দেবেন।
প্রথম চাকরি তাও কলকাতার বাইরে, তাও আবার বর্ধমান বীরভূম নয় একেবারে দার্জিলিং। গোপালবাবুর অবশ্য নিজের ওপর আস্থার অভাব ছিল না, তবু বুকের ভেতরটা যে একেবারে গুড়গুড় করছিল না একথা বললে মিথ্যে বলা হবে।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যখন তিনি পৌঁছুলেন তখন সন্ধে। ওখান থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে কোম্পানির গেস্ট হাউসে যাবেন এটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু খালি ট্যাক্সি দূরের কথা, একটা ট্যাক্সিও তাঁর চোখে পড়ল না। এখন উপায়! রাতটা কি ওখানেই কাটাতে হবে! মনটা তাঁর দমে গেল। গেস্ট হাউসে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে অন্যান্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে কাজকর্মের ব্যাপারে পরামর্শ করে আগামীকাল সকাল থেকেই কাজ শুরু করবেন এটাই তিনি ভেবেছিলেন।
কী করবেন ভাবছেন এমন সময় যেন অন্ধকার ফুঁড়ে একজন নেপালি তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। মাঝারি বয়স, কপালে একটা বিচ্ছিরি ক্ষতের চিহ্ন। সে কোনো ভণিতা না করেই হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘সাহেব আপনি কি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ?’
গোপালবাবু একটু অবাক হয়েই জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’
‘কলকাতা থেকে আসছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোম্পানির গেস্ট হাউসে যাবেন তো?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি সেকথা জানলে কী করে?’ গোপালবাবুর বিস্ময় যেন বেড়েই চলে।
সেকথার জবাব না দিয়ে লোকটি বলল, ‘আমার ট্যাক্সিতে নিয়ে যাব, চলুন।’
গোপালবাবু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কিন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনো ট্যাক্সি তাঁর চোখে পড়ল না। নেপালি ড্রাইভার বোধ হয় তাঁর মনের কথা বুঝেই বলল, ‘ট্যাক্সি একটু দূরে আছে, চলুন।’
সে গোপালবাবুর সুটকেস, আর হোল্ডলটা দু-হাতে তুলে নিল।
‘কত ভাড়া দিতে হবে?’ গোপালবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
‘ওখানে গিয়েই ভাড়ার কথা জেনে নেবেন।’ লোকটি বলল।
গোপালবাবু ওর পিছু নিলেন। একটু দূরে অন্ধকারে সত্যিই একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথম নজরে ওটাকে দেখে ভরসা পেলেন না গোপালবাবু, এখানে-ওখানে দুমড়ানো, যেন অনেক ঝড় বয়ে গেছে ওটার ওপর দিয়ে। যা হোক, তিনি দরজা খুলে ভেতরে বসলেন। নেপালি ড্রাইভার সুটকেস আর বিছানাটা তাঁর পাশেই রেখে দিল।
গাড়ি ছাড়ল। গোপালবাবু অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। ওই ট্যাক্সিটা না পেলে আজ আর তাঁর গন্তব্যস্থলে যাওয়া হত না।
গাড়ি বেশ চলছিল কিন্তু গোপালবাবুর মনে হল ড্রাইভার ক্রমেই যেন গতি বাড়াচ্ছে। একে দুর্গম পথ, একপাশে গভীর খাদ, তার ওপর রাস্তায় তেমন আলো নেই। গাড়ি একবার যদি গতি হারিয়ে ওই খাদে পড়ে তবে শরীরের একটা হাড়ও আস্ত থাকবে না, ভয়ানক মৃত্যু।
তিনি ড্রাইভারকে একটু আস্তে গাড়ি চালাতে বললেন। কিন্তু সে যেন তাঁর কথা কানেই দিল না বরং গাড়ির গাতি আরও বাড়িয়ে দিল। গোপালবাবু মনে মনে ভাবলেন লোকটা উন্মাদ নাকি! কিংবা হয়তো তাঁর সাবধানবাণী লোকটি শুনতে পায়নি। তিনি একটু ঝুঁকে ড্রাইভারের পিঠে আলতোভাবে হাত রেখে গাড়ি আস্তে চালাতে বলতে গেলেন। আশ্চর্য, তাঁর হাতটা ড্রাইভারের পিঠ স্পর্শ করল না, ঝুলে পড়ল।
ব্যাপারটা কী হল তিনি বুঝতে পারলেন না। ঠিক তখুনি তাঁর চোখে পড়ল দূরে দুটো আলো, একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে তাঁদের দিকেই আসছে, বেশ জোরেই আসছে। গোপালবাবুর বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। রাস্তা তেমন চওড়া নয়, তার ওপর দুটো গাড়িই যে গতিতে চলছে তাতে মুখোমুখি সংঘর্ষ হতেই পারে।
আতঙ্কে তাঁর হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেছে, দু-চোখ প্রায় বুজে এসেছে, আর ঠিক তখুনি ঘটল সেই বিচিত্র ঘটনা। গোপালবাবুর মনে হল লেপালি ড্রাইভার সংঘর্ষ এড়াবার জন্য পথ ছেড়ে শূন্যে খাদের ওপর দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে দিল, আগুনয়ান গাড়ির পাশ কাটিয়ে আবার রাস্তায় পড়ে চলতে লাগল গাড়ি।
গোপালবাবু গাড়ির মধ্যেই মূর্ছা গেলেন।
যখন তাঁর জ্ঞান হল, তিনি দেখলেন একটা বাংলোয় তিনি শুয়ে আছেন। তাঁকে ঘিরে আছেন দু-চারজন লোক।
তাঁর জ্ঞান হয়েছে দেখে স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠল তাঁদের মুখে। তাঁদের কাছেই তিনি শুনলেন ওটাই হচ্ছে কোম্পানির গেস্ট হাউস। তিনি বাইরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। তাঁর বাক্স বিছানা পাশেই ছিল। তিনি কেমন করে ওখানে এলেন, কেই-বা তাঁকে রেখে গেল, সেটাই তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না।
গোপালবাবু তখন সব ঘটনা খুলে বললেন। একজন প্রবীণ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই নেপালি ড্রাইভারের কপালে কি একটা কাটা দাগ ছিল?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ গোপালবাবু জবাব দিলেন, ‘একটা বিচ্ছিরি ক্ষত…’
‘বুঝেছি’, সেই ভদ্রলোক বললেন, ‘ওর নাম বাহাদুর থাপা। এখানে যত মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ আসেন সবাইকে ও-ই নিয়ে আসত। কয়েক বছর আগে এমন এক অন্ধকার রাতে একজনকে এখানে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় এক দুর্ঘটনায় পড়েছিল তার গাড়ি। অন্য একটা গাড়িকে পাশ দিতে গিয়ে খাদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিল থাপা। গাড়িটাও চুরমার হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই কোনো মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে আটকা পড়লে ও ভূতুড়ে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়। যারা পুরোনো লোক, ঘটনা জানেন, তাঁরা কখনো ওর গাড়িতে চাপেন না। তবে যাঁরা নতুন, স্টেশনে এসে গাড়ি না পেয়ে অসুবিধেয় পড়েন, তাঁদেরই ও দেখা দেয়, ভূতুড়ে গাড়িতে পৌঁছে দেয় গন্তব্যস্থলে। কিন্তু কখনো কারো ক্ষতি ও করেছে বলে শোনা যায়নি। ওর কপালে কাটা দাগটাই সেই দুর্ঘটনার চিহ্ন।’
একটা ভূতুড়ে গাড়িতে তিনি উঠেছিলেন একথা ভাবতেই অতি বড়ো সাহসী গোপালবাবুরও সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল।