শীতের এক রাতে
সে আজ অনেক বছর আগেকার ঘটনা। আমার এক ডাক্তার বন্ধু সদ্য মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়ে উত্তর বাংলার এক শহরে প্র্যাকটিস শুরু করেছে, তখনকার কথা। আমার ডাক্তার বন্ধুর মুখেই শুনেছিলাম সেই কাহিনি।
নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে জমিয়ে বসতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, সময় লাগে। আমার বন্ধুটির উৎসাহ বা ধৈর্যের অভাব ছিল না। নতুন ডাক্তারের কাছে চট করে কোনো রোগী আসে না, পুরোনো ডাক্তারদেরই সবার পছন্দ। তবে আমার বন্ধুটি শিশুচিকিৎসায় সসম্মানে পাশ করেছিল, সোনার মেডেল পেয়েছিল। সে বুদ্ধি করে তার নেমপ্লেটে নামের পাশে এম বি বি এস, ডি সি এইচ (গোল্ড মেডেলিস্ট) কথাটা জুড়ে দিয়েছিল, ফলে দু-চারজন করে রোগী আসতে শুরু করেছিল।
এভাবে কিছুদিন কাটবার পর এল শীত। উত্তরবঙ্গের হাড়-কাঁপানো শীত। সন্ধের পর রাস্তা ফাঁকা, দরজা-জানালা বন্ধ করে সবাই আশ্রয় নিয়েছে ঘরের ভেতর। নেহাত দায় না ঠেকলে কেউ আর পথে বেরোয় না।
সেদিন রাত তখন প্রায় দশটা। মফস্সল শহরে ওটা কম রাত নয়, তার ওপর ঠান্ডার জন্য শীতকালে সবাই তাড়াতাড়ি কাজকর্ম সেরে শুয়ে পড়ে। ডাক্তার ন-টার মধ্যে খাওয়া সেরে বিছানায় লেপের তলায় বেশ আয়েশ করে একটা মেডিক্যাল জার্নাল পড়ছিল। আমেরিকায় ফিলাডেলফিয়ায় একজন শল্যচিকিৎসক কেমন করে একটা দুরূহ অপারেশন করেছিলেন তার বিবরণ ছিল ওই জার্নালে, সেটা পড়তে পড়তে সে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বাইরের দরজায় ঘন ঘন কড়া নাড়ার শব্দে ডাক্তার চমকে উঠল। এই অসময়ে কে এল! নিশ্চয়ই জরুরি কেস।
আগেই বলেছি, আমার ডাক্তারবন্ধু ছিল খুব করিতকর্মা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য আলস্যকে সে কখনো প্রশ্রয় দিত না। তাড়াতাড়ি গায়ে একটা গরম চাদর জড়িয়ে সে সদর দরজা খুলল, তারপরই ভীষণ চমকে দু-পা পিছিয়ে এল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি সুন্দরী অল্পবয়সি বউ, মাথার সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। বউটির মুখ কিন্তু উৎকণ্ঠায় আর দুশ্চিন্তায় ভীষণ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
‘ডাক্তারবাবু, আমার মেয়ের খুব অসুখ,’ বউটি ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আপনি শিগগির চলুন।’
‘কোথায় আপনাদের বাড়ি?’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করল।
‘বেশি দূর নয়, আপনি আর দেরি করবেন না,’ বউটির গলা থেকে যেন কাকুতি ঝরে পড়ছে।
‘ঠিক আছে, আপনি ভেতরে এসে বসুন,’ ডাক্তার বলল, ‘আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’
‘আমি এখানেই ভালো আছি, আপনি তাড়াতাড়ি করুন।’
বউটি ভেতরে আসতে অনিচ্ছুক বলে মনে হল ডাক্তারের। ওই ঠান্ডায় তার গায়ে একটা সুতোর চাদর পর্যন্ত নেই, খালি পা, অথচ চেহারা দেখে মনে হয় ভালো ভদ্র পরিবারের বউ। ডাক্তার তবু ইতস্তত করছিল, ভাবছিল বউটিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা ঠিক হবে কি না, কিন্তু বউটিই বলে উঠল, ‘আমার জন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না, তাড়াতাড়ি চলুন।’
অগত্যা ডাক্তার ভেতরে গিয়ে গায়ে একটা গরম ওভারকোট চাপিয়ে বেরিয়ে এল, হাতে ব্যাগ, তাতে কিছু দরকারি ওষুধপত্তরও আছে।
‘আপনাকে একটা চাদর দেব?’ ডাক্তার আমতা আমতা করে বলল।
‘বললাম তো, আমার জন্য আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না,’ একটু অসহিষু; কণ্ঠেই জবাব দিল বউটি, ‘চলুন।’
দরজায় তালা লাগিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে পড়ল। বউটি আগে আগে যাচ্ছে আর তার পেছনে ডাক্তার। বউটি খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছে।
রাস্তা নির্জন, অন্ধকার, গা ছমছম করে। বউটি এই রাতে একা ডাক্তারের খোঁজে বেরিয়েছে, বাড়িতে কি পুরুষমানুষ নেই! এই ঠান্ডার রাতে এমন একা কেউ ছেড়ে দেয় ঘরের বউকে! ডাক্তারের খুব খারাপ লাগছিল।
যাহোক বেশ খানিকটা যাবার পর একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বউটি, তারপর ডাক্তারকে লক্ষ করে বলল, ‘সদর দরজা খোলা আছে, আপনি ভেতরে যান, আমি আসছি।’
সে গেটের পাশ দিয়ে অন্ধকারে কোথায় যেন গেল।
বউটির কথাই ঠিক। সদর দরজা ভেজানো ছিল, ঠেলতেই খুলে গেল। প্রথমেই একটা ঘর, প্রায় অন্ধকার, তার পরের ঘরে আলো জ্বলছে। ডাক্তার এগিয়ে গেল। একটা খাটে বছর দেড়েকের একটি মেয়ে নিঃঝুমের মতো শুয়ে আছে। ফর্সা গায়ে রং, কোঁকড়ানো চুল, ভারি মিষ্টি মুখ কিন্তু জ্বরে বেঁহুশ, মুখ আগুনের মতো লাল।
মেয়েটির মাথার সামনে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর একজন বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন, বোধ হয় ওর দাদু-দিদিমা। বৃদ্ধা মেয়েটির কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন আর ভদ্রলোক পাখার হাওয়া করছেন। দু-জনের মুখে ফুটে উঠেছে অসীম উৎকণ্ঠা। ডাক্তারের জুতোর শব্দে দু-জনেই মুখ তুলে তাকালেন।
‘ডাক্তারবাবু এসে গেছেন!’ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তাঁর মুখে ফুটে উঠল একটা নিশ্চিন্ততার ছাপ।
ডাক্তার ব্যাগ থেকে স্টেথিসকোপ বের করে মেয়েটির বুক-পিঠ পরীক্ষা করল, জ্বর দেখল এক-শো পাঁচ। নিমুনিয়া, তবে ভাগ্য ভালো তখনও মারাত্মক আকার নেয়নি। মেয়েটিকে সে তক্ষুনি একটা ইঞ্জেকশন দিল। একটা প্রেসক্রিপশন লিখে বুড়ো ভদ্রলোকের হাতে সেটা দিয়ে বলল, ‘সকালে এই ইঞ্জেকশন আর ট্যাবলেটগুলো আনিয়ে রাখবেন। আমি আজ রাতের মতো ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি, দু-ঘণ্টা অন্তর খাওয়াবেন। আমি সকালে আবার আসব।’
‘ও ভালো হয়ে যাবে তো?’ বুড়ো ভদ্রলোক ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন।
‘হ্যাঁ,’ ডাক্তার হাসিমুখে জবাব দিল, ‘ঠিক সময়ে ওষুধ পড়েছে, আর দেরি হলেই ভয় ছিল।’
ঠিক সেইসময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল একজন সুপুরুষ যুবক, উদ্ভ্রান্তের মতো তার চেহারা। ডাক্তারকে দেখে সে বলল, ‘ও আপনি এখানে, আমি আপনার ঘরে তালা দেখে ভাবলাম রোগী দেখতে গেছেন, আরও দু-জন ডাক্তারবাবুর কাছে ছুটে গেলাম, তাঁরা এই ঠান্ডায় আসতে রাজি হলেন না।’
‘তুই ওঁকে খবর দিসনি!’ বুড়ো ভদ্রলোক এবার অবাক হয়ে বললেন, ‘তবে কে ওঁকে ডেকে আনল?’
‘তাই তো!’ যুবক এবার বলল, ‘আপনাকে কে খবর দিল?’
‘কেন, মেয়েটির মা,’ ডাক্তার জবাব দিল, ‘তিনি গিয়ে বললেন মেয়ের খুব অসুখ এখুনি যেতে হবে। এত রাতে উনি একা ছুটে এসেছেন দেখে আমিও কম অবাক হইনি, গায়ে একটা চাদর পর্যন্ত ছিল না।’
‘ওর মা!’ অস্ফুট কণ্ঠে বললেন বুড়ো ভদ্রলোক।
তখুনি ডাক্তারের চোখে পড়ল দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে। হাসি হাসি মুখে সেই বউটি তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন খুব খুশি হয়েছে তার ওপর।
‘ওই তো,’ ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ডাক্তার বলে উঠল, ‘উনিই তো আমাকে নিয়ে এলেন, গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বললেন, দরজা খোলা আছে ভেতরে যান, আমি আসছি।’
ঘরে সবাই যেন স্তম্ভিত, যুবকটি হঠাৎ দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে। ব্যাপার কী বুঝতে না পেরে ডাক্তার এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
‘ওটা আমার পুত্রবধূর ছবি,’ বুড়ো ভদ্রলোক একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘গত বছর এই সময় আমাদের ছেড়ে স্বর্গে গেছে।’
ডাক্তার হতভম্ব!
মেয়ের কঠিন অসুখে মৃত মায়ের আত্মা স্থির থাকতে পারেনি, মানুষের দেহ ধরে এসেছিল সময়মতো চিকিৎসার জন্য ডাক্তারকে নিয়ে যেতে। সন্তানের প্রতি এমন ভালোবাসা মায়ের পক্ষেই সম্ভব।
মেয়েটি ভালো হয়ে উঠেছিল। আর ওই ঘটনার পর ডাক্তারের পসার এত বেড়ে গিয়েছিল যে তাকে আর কখনো রোগীর জন্য বসে থাকতে হয়নি। তার নামই হয়ে গিয়েছিল ধন্বন্তরী ডাক্তার। অথচ তার মূলে ছিল এক মৃত মায়ের স্নেহ আর উৎকণ্ঠা, অসুস্থ মেয়েকে বাঁচাবার জন্য অন্য জগৎ থেকে ছুটে আসতেও তার আটকায়নি।