বেগম সাহেবা
ডাকবাংলোটা একটা টিলার ওপর। নীচে চারপাশে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পাইন আর পাইনের বন। পাহাড়িদের বসতিও আছে, কিন্তু তা বেশ দূরে, বন ভেদ করে তা চোখে পড়ে না।
তৌফিক আর শাহিদ যখন ডাকবাংলোয় পৌঁছাল তখন পড়ন্ত বেলা, নেমে এসেছে এক আশ্চর্য স্তব্ধতা। পাহাড়ি এলাকায় সন্ধে যখন নামে, বনের চেহারা একেবারে বদলে যায়, শহরে গঞ্জে বসে তা কল্পনাও করা যায় না। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, বড়ো বড়ো গাছের কালো কালো ছায়া, মাঝে মাঝে বন্য প্রাণী আর রাতজাগা পাখির ডাক ভেসে আসে, নিঃসীম স্তব্ধতাকে ভয়াবহ করে তোলে।
ডাকবাংলোর দারোয়ান ওদের জন্য একটা ঘর খুলে দিল। বাইরে দারুণ ঠান্ডায় ওরা যেন জমে গিয়েছিল। ঘরের জানালাগুলো কাচের, ওগুলো বন্ধ থাকায় ভেতরটা বেশ আরামদায়ক। চৌকিদার ওদের অবস্থা দেখে একটা লোহার পাত্রে গনগনে আগুন দিয়ে গেল। হাত-পা সেঁকতে সেঁকতে ওদের মনে হল এত আরাম বোধ হয় দুনিয়ার কোথাও নেই।
চৌকিদার গরম চা বানিয়ে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল রাত্তিরে কী রান্না হবে। মুরগি হতে পারে একথাও জানাল।
‘এই জমাটি ঠান্ডায় খিচুড়ি দারুণ জমবে,’ তৌফিক বলল।
‘ঠিক বলেছিস,’ শাহিদ সায় দিল, ‘মুরগির মাংস তো হরদমই খাচ্ছি, কিন্তু এমন হিমাঙ্কর নীচে তাপাঙ্ক ওয়েদারে মুরগির চাইতে গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম ভাজা ভাবতেই জিভে জল এসে যাচ্ছে।’
‘তবে তাই হোক,’ তৌফিক চৌকিদারকে বলে দিল খিচুড়ির মধ্যে যেন বড়ো বড়ো আলু আর ফুলকপি ছেড়ে দেয়। চৌকিদারের কাছে মাখন আছে, পাতে খিচুড়ির সঙ্গে মাখন নিলে তোফা হবে।
সত্যিই খাওয়াটা দারুণ হল, একটু বেশিই হয়ে গেল। দু-জনেরই পেট আইঢাই করছে, তাড়াতাড়ি শুতে পারলে যেন বাঁচে।
চৌকিদার দুটো করে কম্বল দিয়ে গেল। তার আগে তার বউ এসে বিছানা পেতে দিয়ে গেছে। চৌকিদারের ঘর ডাকবাংলোর লাগোয়া। ওটাও সরকারি বাসা।
উত্তর প্রদেশের এমন পাহাড়ি অঞ্চলে ডাকবাংলোই হল ভ্রমণবিলাসীদের প্রধান ভরসা। যেখানে কোনো হোটেল, ধরমশালা বা চটি নেই, সেখানে ডাকবাংলো না থাকলে গাছের তলাই একমাত্র আশ্রয়।
তৌফিক আর শাহিদ দু-জনেই থাকে কলকাতায়। বেকবাগানের মোড় থেকে ডান দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেখানে। ওরা দু-জনেই বনেদি পরিবারের ছেলে। তৌফিকের মা হলেন খানদানি বংশের মেয়ে, তাঁর এক নিকট সম্পর্কের নানা (দাদামশায়) ভারতের রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন।
আর শাহিদের এক পূর্বপুরুষ উত্তর প্রদেশ থেকে বাংলা মুলুকে এসে ডেরা বেঁধেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে, লর্ড ডাফরিন তখন ভারতের বড়োলাট। অযোধ্যার নবাব বংশের রক্ত ছিল সেই পূর্বপুরুষের শরীরে। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর সম্পর্কের এক নানির (দিদিমা) তিনি বংশধর।
তৌফিক আর শাহিদ এবার পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার পরেই ওরা বেরিয়ে পড়েছে বেড়াতে। অযোধ্যায় শাহিদের পূর্বপুরুষের ভিটে দেখতেও গিয়েছিল ওরা। আগে নাকি ওখানে একটা হাভেলি ছিল, এখন তা ভেঙে সরকারি কলাভবন হয়েছে। ওখানে একটা চিত্রশালাও আছে। সেখানে মোগল আমলের চিত্রকলার সঙ্গে অযোধ্যার নবাব পরিবারের কিছু ছবিও চোখে পড়ে।
অযোধ্যা থেকে লখনৌ দু-দিন কাটিয়ে ওরা এসেছে এই জায়গায় বেড়াতে। এখানকার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের কথা ওদের বলেছিল লখনৌয়েরই এক হোটেলের মালিক। ওই হোটেলেই উঠেছিল ওরা। কথায় কথায় এটাও বেরিয়ে পড়েছিল অযোধ্যার নবাব পরিবারের সঙ্গে হোটেল মালিকের পূর্বপুরুষের একটা সম্পর্ক ছিল, অর্থাৎ শাহিদের সঙ্গে লতায়-পাতায় তাঁর একটা সম্পর্ক আছে।
হোটেল মালিকের নাম হাসান আলি। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন এক সময় তাঁর পূর্বপুরুষের পায়ের নাগরা পথের ধুলো স্পর্শ করত না, আর সেই বংশের মানুষ আজ তিনি হোটেল চালাচ্ছেন। তাও ছোটো হোটেল, কোনোমতে দিন গুজরান হয়। তবু তিনি শাহিদদের নিজের বাড়ি নিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন, যতটা সম্ভব যত্ন-আত্তি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওরা রাজি হয়নি। মানুষটার আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করেই রাজি হয়নি। হোটেলের পুরো খরচাই ওরা মিটিয়ে দিয়েছিল।
হাসান আলির ছোট্ট আপিস কামরায় এক অপূর্ব রূপসি মহিলার ছবি দেখে ওরা দুই বন্ধু চমকে উঠেছিল। ওই ছবিটা অযোধ্যার কলাভবনেও চোখে পড়েছিল ওদের। ছবির চোখ দুটো যেন জীবন্ত। ওরা জিজ্ঞেস করে জেনেছিল ছবিটা অযোধ্যার এক নবাবের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছোটি বেগমের। বোরখার ঢাকনাটা মাথার ওপর তোলা অবস্থায় ছবি আঁকা হয়েছিল। শিল্পী মন-প্রাণ ঢেলে এঁকেছিলেন ছবিটা। ঠিক যেন সদ্য প্ৰস্ফুটিত এক বসরাই গোলাপ।
শাহিদের প্রশ্নের জবাবে হাসান আলি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ওই বেগম সাহেবাই হলেন শাহিদ আর তাঁর মধ্যে সেতুবন্ধনের উৎস। শাহিদ ব্যাপারটা বুঝতে না পারায় তিনি খোলসা করে বলেছিলেন ওই বেগমের এক দৌহিত্রের বংশধর হলেন শাহিদ, আর সেই দৌহিত্রের মাতুল বংশের হলেন তিনি নিজে। মূল সম্পর্কটা যদিও ছিল খুব ঘনিষ্ঠ কিন্তু আজ দু-শোরও বেশি বছর পরে তা এক বিশাল বটগাছের অসংখ্য ডালপালার মতো ছড়িয়ে জট পাকিয়ে গেছে।
হাসান আলির মুখেই ওরা শুনেছিল ওই বেগম সাহেবা ছিলেন খুব তেজস্বিনী আর স্বাধীনচেতা। হারামের মধ্যে বিবি সেজে বসে থাকবার মহিলা ছিলেন না। ওয়ারেন হেস্টিংস যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাগার পূর্ণ করার জন্য অযোধ্যার বেগমদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন, তাঁদের সোনা জহরতের দিকেও লোলুপ হাত বাড়িয়েছিলেন তখন এই ফতিমা বেগমই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, হেস্টিংসের রক্তচক্ষুকে তিনি পরোয়া করেননি। শোনা যায় তিনি নাকি প্রচুর অর্থ আর অলংকার নিয়ে পুরুষের ছদ্মবেশে ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শেষ পরিণতি জানা যায়নি, তাঁকে আর দেখাও যায়নি। তবে দুষ্টু লোকে তাঁর নামে দুর্নাম রটাতে কার্পণ্য করেনি।
শাহিদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ছবিটার দিকে। ওর স্পষ্ট মনে হচ্ছিল চোখ দুটো যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে শিহরন বয়ে গিয়েছিল ওর সারা শরীরে।
শোবার আগে চৌকিদার ওদের বলল, ‘রাত্তিরে হুট করে দরজা খুলে বেরুবেন না কিন্তু, জায়গা ভালো নয়।’
সারাদিনের পথশ্রান্তিতে ঘুম আসতে দেরি হল না। মাঝরাতে দু-জনেরই কীসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ওরা কান পেতে শুনল, ঘোড়ার গাড়ির শব্দ। এদিকে ঘোড়ার গাড়ি আগে ওদের চোখে পড়েনি। ডাকবাংলোর সামনেই এসে থামল গাড়িটা। কারা যেন গাড়ি থেকে নেমে বারান্দা দিয়ে হেঁটে ওদের পাশের ঘরেই ঢুকল। ডাকবাংলোয় ওরা ছাড়াও যে অতিথি আছে চৌকিদার একথা ওদের বলেনি।
ওরা আবার ঘুমোবার চেষ্টা করল। ঘুমিয়েও পড়েছিল কিন্তু ঘোড়ার খুরের টগবগ শব্দে ওদের ঘুম গেল টুটে। একটা দুটো নয়, যেন বেশ কয়েকটা ঘোড়া ছুটতে ছুটতে এসে থামল ডাকবাংলোর সামনে। এত ঘোড়া কেন! ওরা অবাক না হয়ে পারল না। দু-জনেরই তরুণ বয়স, কৌতূহলটা ওদের মধ্যেও টগবগ শুরু করে দিয়েছে।
দু-জনেই জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকাল। অদ্ভুত এক দৃশ্য চোখে পড়ল ওদের। জনা কয়েক গোরা ঘোড়সওয়ার ঘিরে ধরেছে একটা ঘোড়ার গাড়িকে। সাধারণ ঘোড়ার গাড়ি নয়, ঝালরের পর্দায় ঘেরা, দুটো ঘোড়া— একটা কালো কুচকুচে অন্যটা ধবধবে সাদা। দুটোর চোখেই ঠুলি পরানো, গায়ে বহুমূল্য জাজিম, মাথায় রুপোর তাজ। কোচোয়ানের গায়েও ঝলমলে পোশাক। হঠাৎ গোরাদের একজন, তার কাঁধের স্টার দেখে বোঝা যায় একজন কর্নেল, পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করল সেই কোচোয়ানকে, আর সে বুকে হাত দিয়ে ধপ করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। তৌফিকের মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল। তারপরই সেই কর্নেল সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে গট গট করে এগিয়ে গেল ওদের পাশের ঘরের দিকে।
তৌফিক এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়েছিল, ওর হাত-পা কাঁপছিল, কিন্তু শাহিদের যেন কোনো চেতনা নেই। একটা দুর্নিবার আকর্ষণে ও এগিয়ে চলেছে দরজার দিকে। ওর ভাবভঙ্গি দেখে ভয় পেয়ে গেল তৌফিক, বন্ধুকে আটকাবার চেষ্টা করল, কিন্তু শাহিদের শরীরে যেন অসীম শক্তি এসে ভর করেছে, এক ঝটকায় তৌফিককে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। অগত্যা তৌফিককেও যেতে বলা হল তার পেছন পেছন।
পাশের ঘরের দরজার দুটো পাটই হাঁ করে খোলা। ঘরের ভেতর বিচিত্র এক দৃশ্য চোখে পড়ল ওদের। সেই গোরা কর্নেল পিস্তল উঁচিয়ে আছে আর তার কয়েক হাত দূরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন পুরুষের পোশাক পরা এক রমণী, অপূর্ব রূপসি। মণিমুক্তা খচিত মখমলের একটা মুসলমানি টুপি মাটিতে পড়ে আছে। ওটা মাথায় থাকলে রূপবান এক পুরুষ বলেই ভুল হত। এখন দীর্ঘ বেণিটা প্রায় জানুর কাছে নেমে এসেছে। ওদের কিন্তু মনে হল মুখটা যেন খুব চেনা চেনা।
সেই রমণীর পদ্মের মতো দু-চোখে ফুটে উঠেছে তীব্র বিদ্বেষ আর ঘৃণা। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক বাঁদি, বোধ হয় দেহরক্ষিণী, তার হাতে একটা বাঁকা তরোয়াল।
কর্নেল হা হা করে হাসল, তারপর ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বিদ্রূপের গলায় বলল, ‘বেগম সাহেবা ভেবেছিলেন আমাদের ফাঁকি দিয়ে ধনরত্ন নিয়ে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু আমরা আগেই সে-খবর পেয়েছিলাম। আপনার হারেমের এক বাঁদিই সেই খবরটা আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল। আমরা এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এখন ধনরত্নের পেটিকা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে কৃতার্থ করুন। আপনাকে আমি আমার বিবি করে রাখব।’
বেগম সাহেবার দু-চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ল, তিনি বললেন, ‘ওরে বিদেশি কুকুর, তুই কি ভেবেছিস নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য ওই পেটিকা তোর হাতে তুলে দেব! নিজের মানসম্মান বিসর্জন দেব! তুই তো কোম্পানির গোলাম আর আমি এক স্বাধীন রাজ্যের নবাব পরিবারের বেগম। বামন হয়ে আশমানের চাঁদের দিকে তুই হাত বাড়াতে চাস! তোর স্পর্ধা তো কম নয়! আগুনে পুড়ে মরবার আগে পতঙ্গের পাখা গজায়, তোরও তেমন পাখনা গজিয়েছে।’
কর্নেলের ফর্সা মুখ আরও রাঙা হয়ে উঠল, জ্বলে উঠল দু-চোখ।
‘তবে মরো তুমি’, পিস্তলটা সে বেগম সাহেবার বুক লক্ষ করে তাক করল। সঙ্গেসঙ্গে সেই বাঁদি তরোয়াল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বার চেষ্টা করল তার ওপর। পিস্তলের গুলিটা এসে লাগল তার বুকে। রক্তে লাল হয়ে গেল জামা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বেগমের সহচরী। শেষবারের মতো সে তাকাল বেগম সাহেবার দিকে।
কর্নেল আবার হা হা করে হেসে দু-পা এগিয়ে এল। কিন্তু সে কিছু করবার আগেই বেগম সাহেবা বিদ্যুদগতিতে কটিদেশ থেকে একটা ছোরা বার করে আমূল বসিয়ে দিলেন সেই কর্নেলের বুকে। মরণ আর্তনাদ করে উঠল কর্নেল, সেইসঙ্গে তার পিস্তলটাও গর্জে উঠল। দু-জনে প্রায় একইসঙ্গে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
স্তম্ভিত তৌফিক তাকাল শাহিদের দিকে, তারপরই চমকে উঠল। শাহিদের দু-চোখে ফুটে উঠেছে ক্রোধ আর জিঘাংসার চিহ্ন। ও বন্ধুকে কয়েকবার জোরে নাড়া দিতেই আস্তে আস্তে সহজ হয়ে এল শাহিদ।
এদিকে যে গোরা সেনারা ওই কর্নেলের সঙ্গে এসেছিল, দলপতির মৃত্যুতে তারা যেন দিশেহারা হয়ে পড়ল, কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে নীচু গলায় তারা কী সব পরামর্শ করল, তারপর কর্নেলের মৃতদেহ বাইরে নিয়ে এসে ওই ফিটনে চাপিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল জোরকদমে। আশ্চর্য, এত যে কাণ্ড ঘটে গেল, শাহিদদের দিকে একবারও কেউ ফিরেও তাকাল না, যেন ওদের উপস্থিতি টেরই পায়নি।
ওরা চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এলেন কালো আলখাল্লায় ঢাকা, গলায় পুতির মালা, দীর্ঘদেহী এক ফকির সাহেব, সঙ্গে খুব সম্ভব তাঁর দু-জন শিষ্য। তাঁরা ঘরে গিয়ে বেগম সাহেবা আর তাঁর সহচরীর মৃতদেহ যত্ন করে বাইরে বয়ে নিয়ে এলেন, তারপর একটা গাছের তলায় পাশাপাশি সমাধিস্থ করলেন মৃতদেহ দুটি। যেমন হঠাৎ এসেছিলেন তেমন হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেলেন তাঁরা।
এখন চারদিক নির্জন নিঃঝুম। এত যে কাণ্ড ঘটে গেছে বোঝবার উপায় নেই। শাহিদ যেন কেমন হয়ে গেছে, মুখে কথা নেই, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে মনে হয়। তৌফিক ওকে টানতে টানতে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল, এবার আর বাধা দিল না ও।। শাহিদকে শুইয়ে তৌফিকও শুয়ে পড়ল ওর পাশে।
কখন যে ওরা ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজেরাই জানে না, ঘুম ভাঙল ডাকবাংলোর চৌকিদারের হাঁকডাকে। দরজা খুলতেই সে বলল অনেক বেলা হয়েছে, ওদের উঠতে না দেখে তার দুশ্চিন্তা হয়েছিল।
সত্যিই অনেকক্ষণ রোদ উঠেছে, সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে পাহাড়ি উপত্যকা। গত রাতের ঘটনা মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন। কিন্তু সত্যিই কি তাই! ওরা দু-জন পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।
চৌকিদার ওদের মুখের হতভম্ব ভাব লক্ষ করে ব্যাপার কী জানতে চাইল। তৌফিকই খুলে বলল সব কথা।
চৌকিদারের তো দু-চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। সে বলল তার বাপ ঠাকুরদার মুখে এমন একটা ঘটনা শুনেছিল। তা সে তো অনেক বছর আগের ঘটনা, তখন আংরেজরা এক এক করে নবাব বাদশাদের রাজ্য কেড়ে নিচ্ছিল। তখন নাকি এখানে একটা বাগানবাড়ি ছিল, এক নবাবের বাগানবাড়ি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ এমন ঘটনা দেখেছে বলে শোনা যায়নি।
চৌকিদার ওদের সকালের জলখাবার আনতে চলে গেল। শাহিদ হঠাৎ বলে উঠল, ‘ব্যাপারটা এখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।’
‘কী সেটা?’ তৌফিক জিজ্ঞেস করল।
‘যে বেগম সাহেবাকে আমরা কাল রাতে দেখেছিলাম, তাঁকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, কাল বুঝতে পারিনি। হাসান আলির আপিস ঘরে আর কলাভবনে যে ছবিটা আমরা দেখেছিলাম, সেই ফতিমা বেগমই কাল দেখা দিয়েছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েদের বংশ শাখাপ্রশাখার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আমিও তার একটা শাখা। হয়তো খোদার মর্জিতেই কাল আমরা এখানে এসেছিলাম। বেগম সাহেবা সেই রাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে আমাকে জানিয়ে গেলেন আসলে কী ঘটেছিল, সেইসঙ্গে তাঁর নামে যে অপবাদ রটেছিল তা যে মিথ্যে তাও প্রমাণ করে গেলেন। হয়তো এটা না জানানো পর্যন্ত তাঁর আত্মা শান্তি পাচ্ছিল না।’
একটু থেমে তৌফিক আবার বলল, ‘আল্লার কাছে আমি তাঁর জন্য দোয়া মাঙব।’