আত্মারা জেগে ওঠে
হাজারিবাগের আগেই ট্রেন থেকে নেমে পড়ল আনন্দ। হাজারিবাগই ছিল ওর গন্তব্যস্থল, ওখানে একটা হোটেলে আগাম কিছু টাকা পাঠিয়ে একটা ঘরও ঠিক করে রেখেছে, তবু এই ছোট্ট স্টেশনটা দেখে ওর এত ভালো লেগে গেল যে, সুটকেসটা হাতে নিয়ে চট করে নেমে পড়ল। ওর এক সহযাত্রী বলে উঠলেন, ‘এ কী করছেন মশাই, আপনি তো হাজারিবাগে যাবেন বলেছিলেন, এখানে নামছেন কেন?’
‘এখানে দু-দিন থেকে হাজারিবাগ যাব,’ নামতে নামতে আনন্দ জবাব দিল। আসলে ও খুব খেয়ালি মানুষ। হঠাৎ মাথায় কিছু চাপল তো আর কথা নেই, হুট করে সেটা করে বসবে। এ নিয়ে কম হাঙ্গামা পোহাতে হয়নি ওকে, কিন্তু তবু স্বভাব যায় না। বন্ধুরা বলে, মাথায় ছিট আছে।
দেশভ্রমণ আনন্দর একটা নেশা। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে। একটা সওদাগরি আপিসে ও চাকরি করে, ভালোই মাইনে পায়। তা ছাড়া ওর বাবা ওর জন্য যা বিষয়সম্পত্তি রেখে গেছেন তাও কম নয়। একা মানুষ, বয়স তিরিশের কোঠায়, বোহেমিয়ান জীবনযাপনেই ওর আনন্দ।
শাল মহুয়ায় ঘেরা লাল রঙের এই ছোট্ট স্টেশনটা ওকে যেন হাতছানি দিল অথচ এখানে নামার কোনো প্ল্যানই ছিল না, জায়গাটার নামই শোনেনি কখনো। টিকিট কালেক্টর ওর টিকিট দেখে অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালেন, বললেন, ‘এ তো হাজারিবাগের টিকিট।’
‘হ্যাঁ,’ আনন্দ ঘাড় দোলাল, ‘হঠাৎ এখানে নামার ইচ্ছে হল, নেমে পড়লাম। এখান থেকে নিশ্চয়ই হাজারিবাগ যাবার বাস আছে?’
‘তা আছে,’ টিকিট কালেক্টর স্বীকার করলেন।
‘এখানে দু-দিন কাটিয়ে চলে যাব,’ আনন্দ হাসল, ‘হোটেল-টোটেল আছে তো?’
‘রিকশাওলাকে বলুন, নিয়ে যাবে,’ টিকিট কালেক্টর আর কথা বাড়ালেন না।
বাইরে কয়েকটা সাইকেল রিকশা চোখে পড়ল আনন্দর। একটাতে উঠে রিকশাওলাকে ও বলল একটা হোটেলে নিয়ে যাবার জন্য। বাঙালি হোটেল হলেই ভালো হয়, একথাও বলল। তাই নিয়ে গেল রিকশাওলা।
হোটেলটা শহরের মাঝখানে। মোটামুটি পছন্দ হল আনন্দর। কিন্তু ও আশ্চর্য হল অন্য দুটি কারণে। প্রথমত হোটেলে সে ছাড়া আর কোনো বাসিন্দা নেই, দ্বিতীয়ত ওকে দেখে হোটেলের মালিক খুশি হয়েছেন বলে মোটেই মনে হল না বরং একটু যেন অপ্রসন্ন মুখে জানতে চাইলেন কতদিন ও থাকবে।
আরও একটা কথা, হোটেলটা দোতলা, তবে খুব বড়ো নয়, কিন্তু একজন ছোকরা ছাড়া কাজকর্মের আর কোনো লোক চোখে পড়ল না। হয়ত এখন অফ-সিজন তাই লোকজন ছুটি নিয়েছে, আনন্দ ভাবল।
ছোকরাটির নাম সূরয অর্থাৎ সূর্য। তার চোখে-মুখে কেমন যেন একটা ভীত সচকিত ভাব। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না আনন্দ। ওই ছেলেটিই দোতলার একটা ঘরে আনন্দর সুটকেসটা বয়ে নিয়ে গেল। ঘরের সব জানালা খুলে একটা ঝাড়ন দিয়ে ঘরের আসবাব ঝাড়-পুছ করতে লাগল।
‘হোটেলে আমি কি একাই?’ আনন্দ জিজ্ঞেস করল, অবিশ্যি হিন্দিতেই।
ছেলেটি ঘাড় দুলিয়ে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, এই সময় এখানে কেউ আসে না।’
‘কেন?’ আনন্দ জিজ্ঞেস না করে পারল না।
ছেলেটা ওর মুখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল, ওর চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠল, তারপর দু-পাশে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বলতে পারব না।’ একটু যেন তাড়াতাড়িই ছেলেটা ঘর থেকে চলে গেল।
আনন্দ ওখানে এসেছিল সকাল বেলা। চা পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞেস করার জন্য ও ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নামছিল, চোখে পড়ল রিসেপশন কাউন্টারের সামনে হোটেলর মালিক সূরযের সঙ্গে নীচু গলায় কী যেন কথা বলছেন আর ছেলেটা ঘাড় নাড়ছে। ওকে দেখে ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। ব্যাপার কী! আনন্দর মনে হল এই হোটেলে কিছু একটা রহস্য আছে। কোনো হোটেলেই অতিথি অবাঞ্ছিত নয় বরং তাদের নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। আর এটা ছোট্ট জায়গা, গমগমে শহর নয় যে দলে দলে বাইরের লোক এসে ভিড় করছে, হোটেল মালিকদের নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।
ওর প্রশ্নের জবাবে হোটেল মালিক বললেন তিনি সূরযকে দিয়ে ওপরে চা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। একটু পরেই ছেলেটা চা নিয়ে এল, সঙ্গে টোস্ট, ওমলেট আর একটা পাকা কলা। ওগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে সূরয একবার আড়চোখে তাকাল আনন্দর মুখের দিকে। আনন্দর সন্দেহটা আরও ঘনীভূত হল। কী ব্যাপার! হোটেল মালিক কি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত! যারা এখানে এসে ওঠে তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করা তার আসল উদ্দেশ্য নয় তো! এমন দু-একটা হোটেলের কথা ও শুনেছিল, যেগুলো আসলে শিকার ধরার ফাঁদ— শাঁসালো খদ্দের ধরে এনে তাদের সর্বস্বান্ত এমনকী গুম খুন পর্যন্ত করা হয়, হোটেলটা একটা আড়াল মাত্র, পুলিশের চোখে ধুলো দেবার একটা ফন্দি।
‘অ্যাই, এদিকে আয়,’ ও একটু ধমক দিয়েই সূরযকে ডাকল।
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
‘কী? ব্যাপার কী? আমাকে দেখে তখন হঠাৎ চুপ করে গেলি কেন তোরা? কী হয় এখানে?’
ছেলেটা যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল, বলল, ‘কুছ নেহি,’ তারপর হিন্দিতেই বলল, ‘বাবুজি ভুল করছেন, এটা খুব ভালো হোটেল, বাবুজি ইচ্ছে করলে বাইরে খোঁজ নিতে পারেন।’
‘তাই নেব,’ আনন্দ বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল।
চা-পর্ব শেষ করে ও স্নান সেরে নিল, তারপর ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় লোকজন কম, দোকানপাটও যা আছে প্রায় অর্ধেক বন্ধ। এখানে কি কোনো পরব চলছে নাকি! আনন্দ ভেবে পায় না। যাহোক একটা মনোহারি দোকানে ঢুকে ও একটা টুথপেস্ট আর এক প্যাকেট বেÏড কিনল, তারপর কথায় কথায় দোকানদারকে ওই হোটেলের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করল। ও যে ওখানেই উঠেছে তা বলল না।
দোকানদার বেহারি, বলল, খুব ভালো হোটেল, মালিক খুব সৎ, যাঁরা ওখানে ওঠেন তাঁদের খুব দেখভাল করেন।
রাস্তায় এত লোকজন কম কেন, এ প্রশ্নের জবাব দেবার সময় দোকানদারের মুখে যেন একটা ছায়া পড়ল। গলা নীচু করে সে বলল, ‘বাবুজি, আপনি বাইরের থেকে এসেছেন, নতুন মানুষ তাই বলছি, সাবধানে চলাফেরা করবেন, রাত্তিরে বাইরে বেরোবেন না, অন্তত কাল রাত্তিরে ভুলেও রাস্তায় পা দেবেন না।’
‘কী আছে কাল রাত্তিরে?’ আনন্দ কৌতূহলী হয়ে উঠল।
‘সে বাবুজি অনেক কথা। আপনি বেড়াতে এসেছেন, বেড়ান, খাওয়া-দাওয়া করুন, রাত্তিরে বেরুবেন না, ব্যস! কেউ আপনার ক্ষতি করবে না, এখানকার মানুষ ভালো।’
দোকান থেকে বেরোবার আগে আরও দুটি বিষয় জানতে পারল আনন্দ। ওর হোটেলের মালিকের নাম হ্যারিস মণ্ডল— একজন ক্রিশ্চান। বোধ হয় হরিশ থেকে নাম বদলে হয়েছে হ্যারিস। আর দ্বিতীয় ব্যাপারটি হল, এখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই ক্রিশ্চান। হাজারিবাগের খুব কাছে এ অঞ্চলে একসময় নিম্নবর্ণের ও আদিবাসী মানুষের বসতিই ছিল বেশি। তাদের ওপর বর্ণ-হিন্দুদের নানারকম অবিচারের সুযোগ নিয়ে মিশনারিরা এগিয়ে এসেছিলেন, খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে তৎপর হয়েছিলেন। মিশনারিরা দরাজ হাতে সাহায্যও দিচ্ছিলেন ফলে দলে দলে মানুষ ক্রিশ্চান হয়েছিল। একটা গির্জা আছে, প্রতি রবিবার সেখানে উপাসনা হয়, গির্জার পাদরি একজন দক্ষিণ ভারতীয় ক্রিশ্চান।
দুপুরে খাওয়াটা মন্দ হল না। তবে একটু মোটা চালের ভাত, মুসুরির ডাল, আলু ভাজা আর রুই মাছের ঝোল। মাছের খণ্ড বেশ বড়ো।
হোটেল মালিক ওকে বললেন, এখন সিজন নয়, হোটেলে লোকজন নেই, তাই শুধু একজনের জন্য ব্যবস্থায় ত্রুটি থেকে যাচ্ছে, ও যেন সেটা মাপ করে দেয়।
আনন্দর মনে হল ওর সন্দেহ বোধ হয় অমূলক, হোটেল মালিক সম্বন্ধে যা ভেবেছিল তা ঠিক নয়। তবে এখানে কিছু একটা গোলমাল আছে, কেউ তা মুখ ফুটে বলতে চাইছে না। একটা চাপা আতঙ্কে যেন ভুগছে এখানকার মানুষ।
দুপুরে একটু গড়িয়ে বিকেলে ও আবার বেরিয়ে পড়ল। জায়গাটা কিন্তু বেশ সুন্দর। চারদিকে সবুজ বনানী, অদূরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের রেখা। একটা নদীও চলে গেছে শহরের গা ঘেঁষে। আদিবাসী মানুষও বেশ কিছু চোখে পড়ল, অধিকাংশর গলায় ঝুলছে ক্রিশ্চান ধর্মের প্রতীক ‘ক্রুশ’।
গির্জা শহরের ঠিক মধ্যিখানে নয়, উত্তর-পশ্চিম কোণে। হাঁটতে হাঁটতে ও সেদিকে গেল। অনেকদিনের পুরোনো গির্জা, নুড়ি বিছানো অঙ্গন। গেট থেকে সার সার মন্দির-ঝাউ শোভা বাড়িয়েছে। ওটার লাগোয়া বেশ অনেকটা জমি নিয়ে কবরখানা। পাঁচিলে ঘেরা, যদিও পাঁচিলের অনেক জায়গাই এখন ভেঙে পড়েছে, এখানে ওখানে ফোকর চোখে পড়ে। আনন্দ ভেতরে ঢুকল। বেদির ওপর সারি সারি সব প্রস্তর ফলক। ফলকে মৃত ব্যক্তির নাম, সংক্ষিপ্ত পরিচয়, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ খোদাই করা। মনোহারি দোকানের সেই লোকটির কথাই ঠিক, যতগুলি নাম ও পড়ল সবার শেষেই ভারতীয় পদবি, স্যামুয়েল হোড়, নীল হেমব্রম ইত্যাদি।
ওখানে দাঁড়িয়ে ও যখন চারদিকে চোখ বুলোচ্ছিল তখন সূর্যের শেষ রশ্মি ম্লান আভা ছড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে। একটা হিমেল হাওয়ায় ওর শরীর কেঁপে উঠল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, চারদিকে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা। ওইসব বেদির তলায় কফিনের মধ্যে সমাহিত রয়েছে পাশাপাশি সব মৃতদেহ। একটা কেমন যেন অশরীরী পরিবেশ। আনন্দ রীতিমতো সাহসী, তবু ওর বুক কেঁপে উঠল, তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ল, জীবিত মানুষের সান্নিধ্যই ওর কাছে অনেক বেশি কাম্য।
ও হোটেলে ফেরার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই সূরয চা নিয়ে এল, আর একটা রেকাবিতে হালুয়া। হোটেল মালিক সূরযের পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকলেন, বললেন, ‘সকাল থেকে আপনার সঙ্গে ভালো করে কথাই হয়নি, তাই আলাপ করতে এলাম।’
কথায় কথায় আনন্দ জানতে পারল ভদ্রলোকের বাবা অল্প পুঁজি নিয়ে এখানে এসে ব্যাবসা শুরু করেছিলেন, তাঁদের আদিনিবাস হুগলি জেলার সিঙ্গুরে। জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা এখনও সেখানে আছেন, বাড়িঘর, জমিজমার অংশও আছে, তবে সেসব এখন প্রায় বে-দখল। দু-তিন বছর অন্তর ভদ্রলোক একবার সেখানে ঘুরে আসেন। স্ত্রী বাপের বাড়ি বর্ধমান, একমাত্র মেয়েরও বিয়ে দিয়েছেন বর্ধমানে। জামাইয়ের কাপড়ের ব্যাবসা। বাড়িঘর ছাড়াও ধানিজমি আছে, অবস্থা ভালো। গত দু-বছর ধরে ভদ্রলোকের স্ত্রী কঠিন অসুখে ভুগছেন।
আনন্দ এ সময় হঠাৎ এখানে বেড়াতে এল কেন এ প্রশ্নের জবাবে ও একটু হেসে কীভাবে হঠাৎ এখানে নেমে পড়েছিল তা বলল।
‘সবই ঈশ্বরের ইচ্ছে,’ একটু দার্শনিক ভাবে বললেন হোটেল মালিক, ‘নইলে কেন ঠিক এই সময়ে আপনি এখানে এলেন!’
‘কী ব্যাপার বলুন তো?’ আনন্দ এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না, ‘এখানে আসার পর থেকে লক্ষ করছি কী-একটা ব্যাপার যেন আমার কাছে চেপে যাওয়া হচ্ছে। শুধু হোটেলেই নয়, বাইরেও দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি এ ব্যাপারে সবাই যেন মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।’
হোটেল মালিক একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনি আরও দু-তিন দিন থাকুন সব জানতে পারবেন। তবে কাল রাতটা পার হতে দিন, তার আগে দয়া করে কিছু জানতে চাইবেন না। আপনি বাঙালি, এখানে এসে আপনি বিপদে না পড়েন সেটা দেখা আমার নৈতিক কর্তব্য।’
রাত্রে শুধু ভাত আর মাংস, বড়ো এক বাটি ভরতি পাঁঠার মাংস। এক ঘুমে রাত কাবার হয়ে গেল। আনন্দ আলস্যভরে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর উঠে মুখ ধুয়ে চায়ের প্রত্যাশায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সূরযকে ডাকতে যাবে এমন সময় হোটেল-মালিক নিজেই একটা ট্রে করে চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
‘কী ব্যাপার, আপনি?’ আনন্দ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।
‘সূরয কাল রাত্রেই ওর মা-বাবার কাছে গেছে, আজ আর আসবে না।’
‘তবে তো আপনার খুব মুশকিল হল,’ আনন্দ একটু অপ্রস্তুত বোধ করল।
‘না মুশকিল আর কীসের! আপনি তো একজন মাত্র বোর্ডার, তা আমার অভ্যেস আছে।’
চা-পান শেষ করে আনন্দ স্নান সেরে নিল, তারপর জলখাবার সেরে বেরুবে এমন সময় হোটেল মালিক পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘একটা কথা মজুমদার বাবু, আজ তাড়াতাড়ি ফিরবেন, আর এদিক-ওদিক বেশি যাবেন না।’
‘কেন বলুন তো?’
‘আপনাকে তো বলেইছি এখন কিছু জানতে চাইবেন না, আপনার ভালোর জন্যই বলছি।’
‘ঠিক আছে,’ আনন্দ বেরিয়ে পড়ল।
আশ্চর্য, আজ সকাল থেকেই পথঘাট যেন শুনশান, যে দু-চারজন পথে বেরিয়িছে তাদের যেন ভীষণ তাড়া, কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে তারা যেন ব্যস্ত। হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই গির্জার কাছে এসে পড়ল আনন্দ।
গির্জার যিনি যাজক তিনি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আনন্দ আগেই শুনেছিল ফাদার জোসেফ দক্ষিণ ভারতের মানুষ, এখানে অনেক বছর আছেন। গায়ের রং বেশ কালো, চুল-দাড়ি সব সাদা।
আনন্দ ভদ্রতার খাতিরে বলল, ‘গুড মর্নিং ফাদার।’
‘গুড মর্নিং মাই সন,’ তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘চিনতে পারলাম না তো।’
‘আমি এখানে থাকি না, বেড়াতে এসেছি।’
‘আচ্ছা! কবে এসেছ?’
‘গতকাল।’
‘কোথায় উঠেছ?’
আনন্দ হোটেলের নাম বলল।
‘আই সি,’ ফাদার বললেন, ‘হ্যারিসের হোটেলে…তা সে তোমাকে কিছু বলেনি?’
‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিলেন।’
‘ইয়েস, রাইট। তুমি হোটেলে ফিরে যাও, মাই সন। আজ দিনটা ভালো নয়, সন্ধের পর বাইরে বেরিয়ো না, নেভার।’
‘কিন্তু ব্যাপারটা কী ফাদার?’ আনন্দ অনেকটা অধৈর্য কণ্ঠে বলল, ‘কেউ আমাকে খুলে বলছে না, যেন আজ ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে চলেছে, কিন্তু সেটা কী কেউ বলছে না।’
‘ঠিক তাই,’ ফাদার গম্ভীর মুখে বললেন, ‘প্রতি বছর এই তারিখে রাত বারোটার পর ভীষণ এক কাণ্ড ঘটে। কেউ এদিন সন্ধের পর বাইরে থাকে না, দরজা-জানালা এঁটে প্রার্থনা করে। তুমি ফিরে যাও মাই সন, মে গড বেস্ট ইউ।’
তিনি আর কথা না বলে ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপর ধীরপদে ভেতরে চলে গেলেন।
আনন্দ কয়েক মুহূর্ত হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল তারপর ফিরে চলল। কবরখানার পাশ দিয়েই ওকে হাঁটতে হচ্ছিল। কবরখানার ভেতর আরেকবার ঢুঁ মারবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর, কিন্তু ইচ্ছেটাকে ও দমন করল। আসলে কবরখানা সম্বন্ধে ওর কৌতূহল বরাবরই একটু বেশি। কলকাতার সব কবরখানা ওর ঘোরা হয়ে গেছে। সমাধিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে বেদিতে বা ফলকে খোদাই করা মৃতের নাম, পরিচয় পড়তে পড়তে ওর বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। কবে, কখন, কোথাকার এক মানুষ এখানে এসে মাটির তলায় চিরশান্তির নিদ্রায় শুয়ে আছে, একথা ভাবতে রোমাঞ্চিত হয় ওর শরীর।
ও হোটেলে ফিরতেই মালিক যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। সূরয নেই, রান্নার ঠাকুরও অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছে, তিনি বেশ ফাঁপরেই পড়েছেন মনে হল। তবে হোটেলে ও ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই তাই একাই সামাল দিচ্ছেন। নিজেই রান্না করেছেন। ডাল, ভাত, বেগুন ভাজা আর পাবদা মাছের ঝোল। আনন্দ খেয়ে দেখল পাকা হাতের রান্না।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর একটা ঘুম দিল আনন্দ। ঘুম যখন ভাঙল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। চোখে-মুখে জল দিয়ে ও নীচে নেমে এল। হোটেল-মালিক যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, বললেন, ‘উঠেছেন, আপনার জন্যেই বসে আছি, এবার চা বানাব।’
চা-পান শেষ করে আনন্দ ভাবল বেলা থাকতে থাকতেই একটু ঘুরে আসবে। অন্ধকার হবার আগেই ফিরবে। ওকে বেরুতে দেখে হোটেল-মালিক বলে উঠলেন, ‘এ কী, আপনি বেরুচ্ছেন!’
‘একটু ঘুরে আসি,’ আনন্দ জবাব দিল, ‘বেড়াতে এসে ঘরে বন্দি থাকার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া এখন তো বেলা রয়েছে, সন্ধের আগেই ফিরে আসব।’ তারপরই মুচকি হেসে বলল, ‘আপনাদের সেই ভয়ংকর ঘটনা রাত বারোটার আগে তো শুরু হয় না।’
‘আপনাকে একথা কে বলেছে?’ হোটেল মালিক জিজ্ঞেস করলেন।
‘কেন, আপনাদের পাদরি সাহেব,’ আনন্দ জবাব দিল।
‘ও, ফাদার জোসেফের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, তিনিও আমাকে সন্ধের পর বাইরে থাকতে মানা করে দিয়েছেন। কী যে আপনাদের ব্যাপার-স্যাপার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। যা হোক, বেলা থাকতে থাকতে একটা চক্কর দিয়ে আসি।’
হোটেল-মালিক মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু তাঁর চোখ-মুখই বলে দিল যে তিনি আনন্দর এই ‘চক্কর’ দেওয়াটা মোটেই পছন্দ করছেন না।
নির্জন রাস্তা, দোকানপাট সব বন্ধ। যেন এক অলিখিত বনধের ডাকে সব কিছুর গতি স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু বাড়ির সদর দরজায় ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি চোখে পড়ল আনন্দর। কপাটে লটকানো রয়েছে, যেন দরজা দিয়ে অশুভ কিছু ভেতরে ঢুকতে না পারে।
ও হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে চলে গেল। ফেরার সময় একটু ঘুরে গির্জার পাশ দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ কী মনে হল কবরখানার মধ্যে ঢুকে পড়ল। একটা দুর্নিবার আকর্ষণই যেন ওকে নিয়ে গেল ওখানে। ঢুকেই অবাক। সমাধিস্তম্ভের প্রত্যেকটা বেদির ওপর ফুল ছড়ানো। তবে কি আজ এখানে ক্রিশ্চানদের কোনো পরব ছিল! নইলে সব বেদিতে ফুল দেওয়া হবে কেন! কিন্তু ক্রিশ্চানদের এমন কী পরব আছে যে একই দিনে সবার বেদিতে ফুল দিতে হয়! অন্তত ওর জানা নেই। নিশ্চয় সকাল বা ভোরের দিকে এখানকার মানুষ এসে এই ফুল দিয়ে গেছে। কারো মৃত্যুবার্ষিকীতে তার বেদিতে ফুলের স্তবক দিয়ে তাকে স্মরণ করা নয়, এ যেন সর্বজনীন স্মরণ তিথি।
কবরের মাঝখানে একটা মহুয়া গাছ। চারপাশটা গোল করে বাঁধানো। ঝরে পড়া মহুয়া ফুলে ভরে আছে ওই শানবাঁধানো গোল বেদিটা। আনন্দ সেই বেদির ওপর বসে পড়ল, তারপর দু-আঁজলা ভরে মহুয়া ফুল তুলে নাকের কাছে ধরল। একটা মদির আবেশ যেন আচ্ছন্ন করে ফেলল ওকে। ওর আর উঠতে ইচ্ছে করছে না, আলস্য নেমে এসেছে শরীরে, সেইসঙ্গে একটা অপ্রতিরোধ্য শক্তি যেন ওকে ওখানে আটকে রাখতে চাইছে। মহুয়া ফুলের মাদকতায় ওর দু-চোখ বুজে আসছে। দুপুরে ও খুব ঘুমিয়েছে তবু এখন দু-চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল আনন্দ, শুয়ে পড়ল শানবাঁধানো বেদির ওপর।
যখন ওর ঘুম ভাঙল, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে ঘোষণা করল রাত দশটা। তখুনি ওর খেয়াল হল কোথায় ও আছে। একটা হিম শিহরন বয়ে গেল ওর শরীরে। তারপরই ও শুনতে পেল চারদিকে ফিসফিসানি। ওকে ঘিরে কারা যেন ফিসফিস করছে, কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছে না ও।
‘কে? কে?’ ও প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
একটা চাপা হাসির শব্দ ভেসে এল। একসঙ্গে অনেকের চাপা হাসি। শব্দটা কিন্তু আসছে নীচ থেকে যেখানে সমাধিস্তম্ভের তলায় সমাহিত আছে সারি সারি মৃতদেহ।
ভীষণ আতঙ্কে কেঁপে উঠল ওর সর্বাঙ্গ। কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে ওখান থেকে বেরুবার জন্য ও ছুটল গেট লক্ষ করে। কিন্তু অন্ধকারে একটা বেদিতে হোঁচট খেয়ে ও পড়ে গেল। উঠল, আবার ছুটল, আবার পড়ে গেল। যতবারই ও উঠে ছুটতে যায়, ততবারই শানবাঁধানো চৌকো বেদি ওকে যেন আটকে দিচ্ছিল। হাঁটু, কনুই ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছে, ঠোঁট কেটে লোনা হয়ে উঠেছে মুখের স্বাদ। কিন্তু কোথায় গেট! সেটা যেন হারিয়ে গেছে। ও এখানে বন্দি, এখান থেকে আর কোনোদিন ও বেরুতে পারবে না, বাকি জীবনটা কাটাতে হবে এই মৃতদের সঙ্গে। পেছন থেকে ভেসে আসছে হি হি শব্দ— শরীরের রক্ত হিম করা হাসি।
একটা কাঁপুনি ওকে যেন দাঁড়াতে দিচ্ছে না। তারপরই প্রাণপণে ও চিৎকার করে উঠল, ‘ফাদার…ফাদার জোসেফ…আপনি কোথায়…আমাকে বাঁচান…আমাকে বাঁচান…’
হি হি শব্দটা যেন আরও বেড়ে গেল।
‘ফাদার…ফাদার!’
হঠাৎ গির্জার ভেতর দোতলার একটা ঘরের জানালার কাচে আলো দেখা গেল। ওর চিৎকার বোধ হয় শুনতে পেয়েছেন কেউ। ও আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘ফাদার…ফাদার…ফাদার জোসেফ…,’ একটা কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর গলা থেকে।
একটু পরেই একটা আলোর রেখা দেখা গেল, ওর দিকেই এগিয়ে আসছে, পেছনে সাদা আলখাল্লা পরা এক মূর্তি।
‘ফাদার আমি এখানে…আমাকে বাঁচান…আমি চলতে পারছি না।’
আলোটা আরও এগিয়ে এল। ফাদার জোসেফ ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর বাঁ-হাতে একটা লন্ঠন আর ডান হাতে ধরা রয়েছে ক্রুশ বিদ্ধ যিশুর এক মূর্তি। সেটা তিনি এমনভাবে বাড়িয়ে ধরেছেন যেন প্রতিরোধ করতে চাইছেন এক অদৃশ্য অশুভ শক্তিকে।
‘ফাদার…ফাদার আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন,’ কান্নার আবেগে থর থর করে কেঁপে উঠল ওর শরীর।
‘আমার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটো…কোনো ভয় নেই, গড ইজ ইউথ আস।’
তিনি বাইবেলের বাণী উচ্চারণ করতে লাগলেন আর যিশুর মূর্তিকে তুলে ধরলেন মাথার ওপর। হঠাৎ যেন মন্ত্রবলে কবরখানার সব কিছু শান্ত হয়ে গেল।
আনন্দকে ফাদার জোসেফ দোতলায় তাঁর নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে তিনি এক পেয়ালা দুধে খানিকটা ব্র্যান্ডি ঢেলে ওর সামনে ধরলেন, বললেন, ‘এটা খেয়ে নাও।’
আনন্দ এক চুমুকে পেয়ালাটা নিঃশেষ করল, অনেকটা চাঙ্গা মনে হল নিজেকে।
ফাদার জোসেফ ওকে কিছুক্ষণ সময় দিলেন, তারপর বললেন, ‘কেন এসেছিলে এখানে? তোমাকে আমি সকাল বেলা সাবধান করে দিয়েছিলাম।’
আনন্দ বলল বিকেলে একটু বেড়িয়ে সন্ধের আগেই হোটেলে ফিরবে মনে করেই বেরিয়েছিল, কিন্তু কীসের যেন একটা আকর্ষণে এই কবরখানায় ঢুকেছিল, তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না।
‘বুঝেছি,’ ফাদার জোসেফ বললেন, ‘অশুভ শক্তিই তোমাকে এখানে টেনে এনেছিল, খুব বেঁচে গেছ তুমি, রাত বারোটার পর হলে তোমাকে আর বাঁচাতে পারতাম না, রাত বারোটার পরেই ওরা জাগতে শুরু করে।’
‘কারা?’ আনন্দ জিজ্ঞেস করল।
ফাদার জোসেফ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, ‘প্রতি বছর এই তারিখে রাত বারোটার পর এই কবরখানায় মৃত ব্যক্তিদের আত্মারা কবর থেকে উঠে আসে, সারা শহর জুড়ে তাণ্ডব চালায় তাই সন্ধের পর থেকে দরজা জানালা এঁটে বসে থাকে সবাই, প্রার্থনা করে।’
‘তাই কি কবরখানায় অত ফুল?’
‘হ্যাঁ,’ ফাদার জোসেফ ক্লান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘এখানকার মানুষরা আজকের তারিখে কবরখানার সমাধিস্তম্ভে ভোরবেলা এসে ফুল দিয়ে যায়।’
‘কিন্তু কেন এমন হয়?’
ফাদার জোসেফ সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিলেন না, একটু সময় নিলেন, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘আজ থেকে অনেক বছর আগে, আমি তখন প্রথম এখানে এসেছি, বয়সে নবীন, কাজ করবার অদম্য উৎসাহ। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে আমি যিশুর বাণী প্রচার করি, অবহেলিত মানুষকে দীক্ষিত করি খ্রিস্ট ধর্মে। এই অঞ্চলের কিছু মানুষকে এভাবে আমি দীক্ষিত করেছিলাম। তখন জানতাম না তারা ছিল অসৎ, লোভী, নিষ্ঠুর, তাদের মধ্যে কয়েকজন খুনিও ছিল। আইনের হাত থেকে বাঁচবার জন্য তারা সাধু সেজেছিল, খ্রিস্টান হয়েছিল, আমি তাদের রক্ষা করেছিলাম। কিন্তু তাদের স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি, তাদের সবারই মৃত্যুর কারণ ছিল অস্বাভাবিক— ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ভায়োলেন্ট ডেথ। তারা যে অমন হিংস্র আর পাপী ছিল তা আমি বুঝতে পারিনি,’ ফাদার জোসেফের গলায় বেজে উঠল অনুশোচনার সুর, ‘আমি তাদের ভালো করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। তাদের মৃত্যুর পর ক্রিশ্চান ধর্মমতে এই কবরখানায় তাদের সমাহিত করা হয়েছিল। কয়েক বছর শান্তিতেই কেটেছিল তারপর একদিন,’ একটু থেমে ফাদার জোসেফ বললেন, ‘একদিন অমাবস্যার গভীর রাতে তাদের আত্মা কবর থেকে জেগে উঠল। আজকের রাতটাই তারা বেছে নিয়েছিল কারণ আজ খুব অশুভ দিন, রাত বারোটার পর ওরা পূর্ণ শক্তিতে জেগে ওঠে। প্রথম প্রথম ওই দুষ্টু আত্মারাই জাগছিল, পরে যারা ভালো তাদের আত্মাকেও তারা জাগিয়ে তাদের দুষ্কর্মের সঙ্গী করে নেয়। সারারাত তারা রাস্তায় রাস্তায় তাণ্ডব করে, সে এক নারকীয় কাণ্ড। আগে তারা আমাকে ভয় পেত, আমি তাদের সামনে দাঁড়ালে পালিয়ে যেত, কিন্তু এখন আর আমাকে গ্রাহ্য করে না। আমাকে শেষ করবার চেষ্টাও করেছিল। তাদের অশুভ শক্তির মোকাবিলার জন্য তাই আমাকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হয়। যত ভয়ংকরই তারা হোক না কেন, যিশুর মূর্তির সামনে তারা কুঁকড়ে যায়, অশুভ শক্তির সেখানেই পরাজয়। আজকের রাতে আমি ঘুমুই না, প্রার্থনা করি, তাই তোমার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম— যিশুই তোমাকে রক্ষা করেছেন।’
ফাদার জোসেফ চুপ করলেন। ঘরের মধ্যে নেমে এল এক অখণ্ড নিস্তব্ধতা। কতক্ষণ এভাবে ছিল আনন্দর হুঁশ নেই, হঠাৎ ও ভীষণ চমকে উঠল। বাইরে থেকে ভেসে আসছে হুল্লোড়, রক্ত হিম করা একটা শব্দ—
—হিংস্র উল্লাস।
‘ওরা জেগেছে,’ ফাদার জোসেফ মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘এসো, আমরা প্রার্থনা করি।’