লেডি আরাবেলার প্রেতাত্মা
ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির মৃত্যুর পর তাঁর তৃতীয় রানি জেন সেমুরের সন্তান এবং হেনরির একমাত্র পুত্র এডোয়ার্ড ষষ্ঠ এডোয়ার্ড নামে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ষোলো বছর বয়সে তাঁর অকালমৃত্যুর পর হেনরির প্রথম রানি ক্যাথরিন অফ অ্যারাগনের কন্যা মেরি ইংল্যান্ডের রানি হলেন।
মেরিও বেশিদিন রাজত্ব করেননি। ১৫৫৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসলেন প্রথম এলিজাবেথ। তিনি ছিলেন হেনরির আদরের রানি অ্যান বোলেনের কন্যা, যে অ্যানের শিরশ্ছেদের হুকুম দিয়েছিলেন হেনরি।
রানি প্রথম এলিজাবেথের দীর্ঘ রাজত্বকালকে বলা হয় ইংল্যান্ডের স্বর্ণযুগ। পরাক্রমে, ব্যাবসায়, বাণিজ্যে, সাহিত্যে ও চারুকলায় ইংল্যান্ডের তখন জয়জয়কার।
এলিজাবেথ ছিলেন চিরকুমারী (ভার্জিন কুইন)। তাঁর মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের রাজা হলেন স্কটল্যান্ডের ষষ্ঠ জেমস, তিনি প্রথম জেমস নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন। অষ্টম হেনরির পিতা সপ্তম হেনরির জ্যেষ্ঠা কন্যা ছিলেন মার্গারেট স্টুয়ার্ট, অর্থাৎ এলিজাবেথের পিসি। সেই পিসির মেয়ে হলেন লেডি আরাবেলা স্টুয়ার্ট। জেমসও কিন্তু ছিলেন সপ্তম হেনরির অপর এক কন্যা মার্গারেট টিউডরের বংশধর।
এই কারণে রাজদরবারে আরাবেলাকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের অন্ত ছিল না। ইংল্যান্ডের বেশ কিছু রাজপুরুষ জেমসকে রাজা বলে মেনে নিতে পারেননি। আরাবেলাকে কেন্দ্র করে তাঁরাই জেমসের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিলেন। জেমস যে এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলেন তা নয়, তাই আরাবেলাকে তিনি চোখে চোখে রাখতেন, তাঁকে নিয়ে তাঁর কম আশঙ্কা ছিল না।
আরাবেলার বয়স যখন মাত্র দশ, এলিজাবেথ তাঁকে ইংল্যান্ডের ভাবী রানি বলে পরিচয় করিয়েছিলেন। জেমসকে প্ররোচিত করার জন্যই অমন কাজ করেছিলেন এলিজাবেথ, জেমসকে তিনি নিজেও পছন্দ করতেন না।
লেডি আরাবেলা ছিলেন সুন্দরী, বিদুষী, সাহিত্য এবং শিল্পকলায় তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। তাঁর পাণিপ্রার্থীর সংখ্যা কম ছিল না, তার মধ্যে যেমন ছিলেন অভিজাত বংশের পুরুষ তেমন ছিলেন নানান দেশের রাজকুমার। কিন্তু এলিজাবেথ এবং জেমস দু-জনেই এসব প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল আরাবেলা চিরকুমারী থাকবেন কেননা এমন পরিণয়ের ফলে যে সন্তান আসবে সে হবে ইংল্যান্ডের সিংহাসনের দাবিদার, ফলে ইংল্যান্ডের রাজবংশের উত্তরাধিকারের ব্যাপার জটিল হয়ে উঠবে।
বুদ্ধিমতী আরাবেলা সব বুঝতেন তাই এমন ভান করতেন যেন বিয়ের ব্যাপারে তিনি উৎসাহী নন নতুবা তিনি যে ঘোর সংকটে পড়বেন এটা না বোঝার মতো নির্বোধ ছিলেন না তিনি। তাই সাহিত্য এবং কাব্যরচনায় তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন, এমনকী ঈশ্বরতত্ত্ব বা ব্রহ্মবিদ্যায় তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। সেই সময় ওই বিষয়ের চর্চা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
জেমস ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসার পর আরাবেলার প্রতি সদয় মনোভাবই দেখিয়েছিলেন। রাজপ্রাসাদের এক সুরম্য প্রকোষ্ঠে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা ছাড়াও তাঁর জন্য উপযুক্ত ভাতার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। জেমসের রানি (ডেনমার্কের রাজকুমারী অ্যান) আরাবেলাকে খুব পছন্দ করতেন। বুদ্ধিমতী এবং বিদুষী আরাবেলার সাহচর্য তাঁর কাছে কাম্য হয়ে উঠেছিল। নাট্যাভিনয়ে খুব পটীয়সী ছিলেন আরাবেলা, আর রানি ছিলেন ওই ব্যাপারে একজন উৎসাহী পৃষ্ঠপোষিকা। রাজদরবারেও আরাবেলা সবার প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। ওখানেই তাঁর দেখা হল শৈশবের সঙ্গী সুপুরুষ স্যার উইলিয়াম সেমুরের সঙ্গে। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন।
ব্যাপারটা দু-জনেই গোপন রাখবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু জেমসের কানে খবরটা এল। তিনি আশঙ্কিত হলেন কারণ তাঁদের বিয়ে ভবিষ্যতে তাঁর সিংহাসনের পক্ষে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সিংহাসনে আরাবেলা ও সেমুরের সন্তানের প্রবল দাবি উপেক্ষা করার নয়।
জেমস দু-জনকে ডেকে পাঠালেন, পরিষদবর্গের সামনে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন রাজার অনুমতি ছাড়া তাঁদের বিয়ে বৈধ বলে স্বীকৃত হবে না। সন্দেহমুক্ত হবার জন্য প্রণয়ীযুগল সম্পর্ক ছেদ করার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
ওঁরা দু-জন বুঝতে পেরেছিলেন জেমস কখনো তাঁদের বিয়েতে সম্মতি দেবেন না, তাই গোপনে তাঁরা বিয়ে করলেন। জেমসের কাছে কিন্তু খবরটা গোপন রইল না। তিনি তাঁদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে ত্রু«দ্ধ হলেন, তাঁর আদেশে বন্দি করা হল তাঁদের দু-জনকে। সেমুরকে পাঠানো হল সেন্ট টমাস দুর্গে আর আরাবেলাকে রাখা হল ল্যামবেথ প্রাসাদে। এই ঘটনার সময় হল ইং ১৬১০ সালের গ্রীষ্মকাল।
রাজসভায় কিন্তু এই দুই তরুণ-তরুণীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন পারিষদের অভাব ছিল না। ফলে তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ গোপনে আগের মতোই চলতে লাগল। দুর্গের রক্ষীকে উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করে ল্যামবেথ প্রাসাদে গিয়ে আরাবেলার সঙ্গে মিলিত হচ্ছিলেন সেমুর।
ল্যামবেথের তরুশোভিত উদ্যানে একান্তে মিলিত হচ্ছিলেন দু-জনে, কখনো কখনো টেমস নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করতেন। কবে তাঁরা সুখী এবং স্বাভাবিক জীবনের মুখ দেখতে পাবেন এই চিন্তাই তাঁদের প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁরা মনস্থির করে ফেললেন ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে যাবেন।
এদিকে রাজসভায় তাঁদের হিতৈষীরা এমনকী স্বয়ং রানি পর্যন্ত তাঁদের ব্যাপারে নরম হবার জন্য জেমসকে পীড়াপীড়ি করছিলেন, কিন্তু জেমস নিজের সিংহাসনের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁদের কথায় কর্ণপাত করলেন না। বরং প্রণয়ীযুগলের গোপন মিলনের খবরটাও তিনি জানতে পারলেন। সেমুরের ওপর আরও কড়া পাহারার নির্দেশ দিলেন তিনি, আর আরাবেলাকে ডারহামে সরিয়ে দেবার আদেশ করলেন।
আরাবেলার চারিত্রিক দৃঢ়তাও কম ছিল না। তিনি ডারহামে যেতে অস্বীকার করলেন কারণ সেখানে গেলে সেমুরের সঙ্গে দেখা হবার সুযোগ আর থাকবে না। তাঁকে শয্যাসমেত একটা বজরায় তোলা হল তারপর নদীপথে যাত্রা করল সেই বজরা ডারহামের উদ্দেশে।
এই দুর্ব্যবহারে আরাবেলা অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং বার্নেট-এ পৌঁছুবার পর প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলেন তিনি। ডাক্তার তাঁকে পরীক্ষা করে সম্পূর্ণ বিশ্রামের উপদেশ দিলেন, তাঁর পক্ষে নড়াচড়া করা উচিত নয় একথাও বললেন। জেমস তখন আর্ল অফ এসেক্স-এর ভবনে আরাবেলার বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু বললেন এই ব্যবস্থা মাত্র একমাসের জন্য, সুস্থ হয়ে উঠলেই তাঁকে ডারহামে যেতে হবে।
আরাবেলা দ্রুত আরোগ্য লাভ করলেন, তারপরই বন্ধুদের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেন তাঁর স্বামীর সঙ্গে। ইংল্যান্ডে তাঁদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। তার প্রধান কারণ হল রাজা হিসাবে জেমস সুনাম অর্জন করতে পারেননি। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি নিষ্কলুষ ছিলেন না। রাজা হবার সময় তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পালন না করায় রাজসভায় এবং বাইরে তাঁর প্রতি বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছিল।
উইলিয়াম সেমুর বুঝতে পারলেন আর দেরি করা উচিত নয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে যেতে হবে। বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যে তাঁরা রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে একই সময় ব্ল্যাকওয়ালে মিলিত হবার ফন্দি আঁটলেন। ওখান থেকে এক জাহাজে চেপে তাঁরা পাড়ি দেবেন ফরাসি দেশে।
দিন ঠিক হয়ে গেল।
আরাবেলা পুরুষের ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। মাথায় দিলেন একটা বড়ো কালো টুপি আর গায়ে জড়ালেন একটা আলখাল্লা। টুপির তলায় তিনি পরচুলা পরেছিলেন আর আলখাল্লার তলায় গায়ে ছিল পুরুষদের আঁটো জামা, পায়ে ছিল পুরো মোজা আর কোমরে তরোয়াল। তখনকার দিনের এক তরুণ যোদ্ধার বেশ।
একজন পথপ্রদর্শকের সঙ্গে তিনি পৌঁছুলেন ক্রম্পটনের এক সরাইখানায়। সেখানে তাঁদের জন্য ঘোড়া অপেক্ষা করছিল। ঘোড়ায় চেপে আরাবেলা আর তাঁর সঙ্গী ব্ল্যাকওয়ালে উপস্থিত হলেন কিন্তু সেমুরের দেখা নেই। সরাইখানায় তাঁর অনুসন্ধান করে আরাবেলা গিয়ে উঠলেন ফরাসি জাহাজে, ওটা ওখানে তাঁদের জন্যই অপেক্ষা করিছল। স্বামীর জন্য উৎকণ্ঠিত চিত্তে অপেক্ষা করছিলেন আরাবেলা, এদিকে মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, জোয়ার চলে গিয়ে ভাটা এসেছে নদীতে।
ফরাসি জাহাজের কাপ্তেনের উদবেগের শেষ ছিল না। তিনি যে কাজের ঝুঁকি নিয়েছিলেন তার গুরুত্ব সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। যতই দেরি হচ্ছিল ততই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন তিনি। আরাবেলার অনুনয় সত্ত্বেও তিনি জাহাজকে টেমস নদীর মুখে সরিয়ে নিলেন।
সেন্ট টমাস দুর্গ থেকে সেমুরের পালাবার ব্যবস্থা হয়েছিল অন্যরকম। সেখানে দুর্গরক্ষীদের কড়া নজর এড়িয়ে তাঁকে বেরোতে হবে। একজন ঠেলাওলা ওই দুর্গে জ্বালানি কাঠ আর খড় জোগান দিত। তাকে উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করা হল। ঠিক হল ঠেলাওয়ালা তার ঢিলে আংরাখা আর প্রকাণ্ড টুপিটা খুলে; খড়ের গাদার তলায় লুকিয়ে পড়বে। সেমুর ওই লোকটির পোশাক পরবেন আর মুখে কালো দাড়ি লাগিয়ে দুর্গ থেকে খালি ঠেলাগাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু এই বদলাবদলি অনেক সময় নিয়ে নিল কারণ দুর্গের প্রহরীদের সতর্ক দৃষ্টির নজর এড়িয়ে কাজটা করতে হয়েছিল।
সেমুর যখন ব্ল্যাকওয়ালে পৌঁছুলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফরাসি জাহাজ তাঁকে ছাড়াই আরাবেলাকে নিয়ে ফরাসি উপকূলের দিকে যাত্রা করেছে। সেমুর এক কয়লাবাহী জাহাজের কাপ্তেনকে প্রচুর উৎকোচ দিয়ে তাঁকে অসটেন্ড নিয়ে যেতে রাজি করলেন। শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে তিনি ফরাসি দেশের ক্যালেতে গিয়ে পৌঁছুলেন, তিনি ভেবেছিলেন আরাবেলা সেখানেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
কিন্তু আরাবেলার ভাগ্য তাঁর প্রতি প্রসন্ন ছিল না। ব্ল্যাকওয়ালে তিনি যে সরাইখানায় সেমুরের খোঁজ করেছিলেন তা নৌ-সেনাপতি মনসন জানতে পেরেছিলেন। লেডি আরাবেলা আর উইলিয়াম সেমুরের পলায়নের সংবাদ আর গোপন ছিল না। জেমস নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত আরও গভীর হয়েছে, প্রভাবশালী মানুষের সাহায্য ছাড়া তাঁরা দু-জন রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে অমন করে পালাতে পারেন না। তিনি উদবিগ্ন হলেন, চারদিকে বার্তা পাঠালেন পলাতক দু-জন যেন ইংল্যান্ড ছাড়তে না পারেন সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য। মনসনের কাছেও সেই সতর্ক বার্তা এসে পৌঁছেছিল।
নৌ-সেনাপতি যুদ্ধজাহাজ ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এ চেপে সেই ফরাসি জাহাজকে তাড়া করলেন এবং মাঝদরিয়ায় তাকে ধরে ফেললেন। সামান্য প্রতিরোধের পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন ফরাসি জাহাজের কাপ্তেন। লেডি আরাবেলাকে লন্ডনে নিয়ে আসা হল এবং বেল দুর্গে বন্দি করে রাখা হল কড়া পাহারায়।
জেমসের আশঙ্কা কিন্তু একেবারে মিথ্যে ছিল না। জেমসকে সরিয়ে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে এক রোমান ক্যাথলিককে বসাবার জন্য তখন একটা ষড়যন্ত্র চলছিল, স্পেন সমেত ক্যাথলিক দেশগুলিরও এ ব্যাপারে সায় ছিল। ইংল্যান্ডের অনেক রাজপুরুষও স্কটল্যান্ডের রাজাকে নিজেদের রাজা বলে মেনে নিতে পারেননি কারণ স্কটল্যান্ডের সঙ্গে ইংল্যান্ডের ছিল দীর্ঘকালের শত্রুতা। তাঁদের অনেকেই এই ষড়যন্ত্রে শামিল হয়েছিলেন এবং সিংহাসনে আরাবেলার দাবি মনেপ্রাণে সমর্থন করছিলেন। আরাবেলা নিজে এ ব্যাপারে যে খুব উৎসাহী ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি কিন্তু তিনি এবং সেমুর এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একথা জেমস বিশ্বাস করতেন। তাই আরাবেলাকে মুক্তি দেবার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। রানির অনেক অনুরোধেও তিনি কর্ণপাত করলেন না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আরাবেলাকে সিংহাসনে বসাবার চক্রান্তের একজন হোতা এই অভিযোগে স্যার ওয়াল্টার র্যালের বিচার হয়েছিল।
ক্রমে আরাবেলা হতাশ হয়ে পড়তে লাগলেন। সেমুরের কোনো খবর নেই, কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কি না কিছুই তিনি জানতেন না। এদিকে জেমসের ভয়ে সেমুর বিদেশে আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, আরাবেলার জন্য কিছুই করতে পারেননি। মানসিক অবসাদ আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল আরাবেলাকে। সিংহাসনের চাইতে প্রিয়তম সেমুর তাঁর কাছে ছিল অনেক বেশি কাম্য। দুশ্চিন্তা আর মানসিক অবসাদে শেষ পর্যন্ত তিনি উন্মাদিনী হয়ে গেলেন। সুন্দরী, বিদুষী, রাজবংশের এক দুহিতার কী মর্মান্তিক পরিণতি! চার বছর ওই দুর্গে বন্দিনী থাকার পর ১৬১৫ সালের সাতাশে সেপ্টেম্বর চিরশান্তির কোলে ঢলে পড়লেন আরাবেলা।
কিন্তু মৃত্যুর পরও কি তিনি শান্তি পেয়েছিলেন! আরাবেলা স্টুয়ার্টের প্রেতাত্মাকে নাকি বেশ কয়েকবারই দেখা গিয়েছিল। ধূসর পোশাক পরা এক মহিলাকে বেল দুর্গের এক নির্দিষ্ট জানালায় দেখা যেত। তাকে সবসময় দেখা না গেলেও ওই দুর্গের দরজা জানালা অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় খুলে যেত, গলি বারান্দায় শোনা যেত খট খট জুতোর শব্দ।
ল্যামবেথ প্রাসাদেই বেশি দেখা যেত তাঁর প্রেতাত্মাকে। সেখানকার করিডোর এবং সোপান শ্রেণিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত ধূসর পোশাক পরা এক রমণী মূর্তিকে। ল্যামবেথের যে উদ্যানে দু-জনে মিলিত হতেন সেখানেও দেখা গেছে তাকে, যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে তার মনের মানুষটিকে।