আলমারি

আলমারি

প্রথম থেকেই কেন জানি না, কাঠের আলমারিটাকে আমি সুনজরে দেখিনি। কুচকুচে কালো রঙের প্রকাণ্ড আলমারিটাকে আমার মনে কেমন যেন একটা অস্বস্তি সৃষ্টি করেছিল। প্রমীলাকে অবশ্য এ নিয়ে কিছু বলা বৃথা। পুরোনো আসবাবপত্রের ওপর দারুণ ওর ঝোঁক, বিশেষ করে যদি কোনো বনেদি ঘরের হয়, তবে তো কথাই নেই। খবরের কাগজে নিলামের পাতাটা ও আগাগোড়া পড়বে, তারপরই মনের মতো জিনিসের উল্লেখ থাকলে, সেখানে ছুটে গিয়ে সেটা না কেনা পর্যন্ত ওর যেন স্বস্তি নেই।

মেহগনি কাঠের দু-পাল্লার আলমারি, প্রায় সাত ফুট উঁচু, কাঠের গায়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য। আমার দৃষ্টি হঠাৎ ডান দিকের পাল্লার ওপর স্থির হয়ে গেল, একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে আমার সর্বাঙ্গে যেন শিহরন বয়ে গেল।

পাঁচজন কুলি অনেক কায়দা কসরত করে আলমারিটাকে দোতলায় তুলছিল। আমার মনে হচ্ছিল, ফাঁদে পড়া একটা জন্তু যেন সর্বশক্তি দিয়ে ওদের সঙ্গে যুঝছে। সিঁড়ির মাঝপথে ডান পাল্লার সামনে যে কুলিটা ছিল, সে যেন চমকে গিয়ে পা হড়কাল। আলমারিটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে কুলিরা সামলে নিল। ওঠাকে দোতলার বাম প্রান্তের শেষ ঘরটায় রাখার পর সেই কুলিটা আলমারির ডান পাল্লাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি মেরে কী যেন দেখবার চেষ্টা করল। আমি তাকে লক্ষ করছি দেখে সে একটু থতোমতো খেল। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সে আমতা আমতা করে বলল, ‘ভেতর থেকে যেন একটা শব্দ শুনতে পেলাম।’

সে তাড়াতাড়ি পাল্লাটা বন্ধ করে দিল। আমার কেমন যেন খটকা লাগল। ওকে চেপে ধরলাম। লোকটি সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘বাবু, অর্ধেক সিঁড়ি ভেঙে ওঠার পর, আমার মনে হল, যেন একটা শব্দ— বাচ্চার গলার শব্দ বলেই মনে হল— আলমারির ভেতরে থেকে আসছে। আমারই ভুল, শব্দটা হয়তো অন্য কোথাও থেকে এসেছে।’

ওরা যেন তাড়াতাড়ি পালাতে পারলে বাঁচে। টাকাপয়সা মিটিয়ে দেবার পর দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে চলে গেল।

প্রমীলা যথারীতি বেরিয়েছিল। নানান মহিলা সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় দিনের অধিকাংশ সময় ওকে বাইরে কাটাতে হয়। আমি নীচে বসবার ঘরে বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, এমন সময় আমাদের দশ বছরের মেয়ে খুকু স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল। ঘরে ঢুকেই ও নাক কুঁচকে বলে উঠল, ‘কীসের গন্ধ, বাবা?’

আমি দেখলাম, ওর দৃষ্টিটা সিঁড়ি দিয়ে ওপরদিকে উঠে যাচ্ছে। আমি কিন্তু কোনো গন্ধই পাচ্ছিলাম না, তবু ওর মনের ভাবটা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। যে অস্বস্তিটা আমার মন থেকে দূর হয়ে গিয়েছিল, তা আবার ফিরে এল। আমার মনে হল, খুকুকে ওই কোনার ঘরে যেতে দেওয়া উচিত হবে না। কিন্তু কী যুক্তিতে আমি ওকে সেকথা বলব! ব্যাপারটাকে লঘু করার জন্য আমি বললাম, ‘হয়তো যে কাঠের আলমারিটা এসেছে, সেটা থেকেই গন্ধ আসছে।’

আজ না হোক, কাল তো আলমারিটা ও দেখবেই, সুতরাং লুকোচুরি করে লাভ নেই। খুকু কিন্তু আলমারির কথা শুনেই কৌতূহলী হয়ে উঠল, লাফিয়ে দু-তিনটে সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠতে লাগল। আমিও তাড়াতাড়ি ওর পেছনে ছুটলাম। আমার মন বলছিল, ওকে একা আলমারির কাছে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার ভেতরের বারান্দার বাঁ-দিকে মোড় নিতেই আমার চোখে পড়ল, খুকু ওই ঘরের দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়িয়েছে। আলমারিটার দিকে ও যেন সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে। আমি পা টিপে টিপে ওর পেছনে দাঁড়ালাম। আলমারিটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হতে লাগল, যেন ওটা হিংসুটে দৃষ্টি নিয়ে খুকুর দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। আর এই প্রথম, একটা ক্ষীণ গন্ধ আমার নাকে এসে লাগল। গন্ধটা কটু নয়, ঠিক ভাষায় প্রকাশ করাও সম্ভব নয়, তবু আমার মনে হতে লাগল গন্ধটা যেন পার্থিব নয়।

খুকুও ওই গন্ধটা টের পেয়েছিল, দু-পা পিছিয়ে ও বলল, ‘কী বিচ্ছিরি গন্ধ, না?’

আমি সহজ হবার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘পুরোনো আলমারি, বোধ হয় অনেকদিন গুদোমে পড়ে ছিল, তাই একটা গন্ধ হয়েছে।’

গন্ধটা ক্রমেই যেন তীব্র হয়ে উঠছে। পরমুহূর্তে একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, গন্ধটা কাঠের আলমারি থেকে আসছে ঠিকই, তবে যেন ডান দিকের পাল্লার ভেতর থেকে। বন্ধ পাল্লার ভেতর থেকে যেন দমকে দমকে গন্ধটা আসছে। আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না, একটা নিষ্ঠুর আক্রোশে এক হ্যাঁচকা টানে ডান দিকের পাল্লাটা খুলে ফেললাম। পরমুহূর্তে আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে পাল্লাটাকে ঠেলে বন্ধ করার চেষ্টা করলাম খুকুকে কিছুতেই ভেতরটা দেখতে দেওয়া হবে না। কিন্তু পাল্লাটা কোথায় যেন আটকে গেছে, কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, খুকু আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ওর পায়ের শব্দে পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম, তারপরেই আবার মুখ ফেরালাম। পাল্লার ফাঁক দিয়ে ডান দিকের একটা ফাঁকা গহ্বরের মতো দেখা যাচ্ছে। আগেই বলেছি, আলমারিটা প্রকাণ্ড, চওড়া অনেকটাই। ভেতরে দুটো ভাগ, বাঁ-দিকে কাপড়চোপড় রাখার জন্য তাক (সেলফ), আর ডান দিকে তাক কম, দুটো তাকের মধ্যে অনেকটা ব্যবধান, জামাকাপড় টাঙিয়ে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাকগুলিও বেশ চওড়া। আমি হলফ করে বলতে পারি, পাল্লাটা খুলেই বন্ধ করার জন্য আমি যে সজোরে চাপ দিয়েছিলাম, সেই সামান্য সময়টুকুর মধ্যেই ডান দিকে একটি বাচ্চা মেয়ের জড়োসড়ো অস্পষ্ট মূর্তি আমার চোখে পড়েছিল। দ্বিতীয়বার কিন্তু আমি আর কিছু দেখিনি— ফাঁকা আলমারি। আমি কি তবে ভুল দেখলাম! সবটাই কি আমার চোখের ভুল!

পাল্লাটা বন্ধ করে আমি খুকুর দিকে ফিরে দাঁড়ালাম। আমার চোখে চোখ পড়তেই ও মুখ ফিরিয়ে নিল। খুকুও কি তবে ওঠা দেখেছে! ওর ব্যবহারে আমি চিন্তিত হয়ে উঠলাম। ও যদি ভয় পেয়ে ঘর থেকে দৌড়ে পালাত, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেটাই হত স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু ও আমার কাছ থেকে যেন কিছু লুকোতে চাইছে, অথচ আমার ওপরই ওর টানটা বেশি। মাকে যা না বলে, আমার কাছে ওর তা বলা চাই-ই, এই নিয়ে আমরা বাপ-বেটিতে নিজেদের মধ্যে কত সময় কৌতুক করেছি।

আমি প্রমীলার কাছে কিছু খুলে বললাম না, কীই-বা বলব। ও আলমারিটা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করতে লেগে গেল। কোনোরকম অস্বাভাবিক কিছু ওর চোখে পড়ল না, খুকুও যেন একটু বেশি উৎসাহ নিয়েই মা-র কাজে সাহায্য করতে লাগল। আলমারিটার ওপর ওর একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে আমি খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।

প্রথম দিন যে বিচিত্র গন্ধটা আমি আর খুকু অনুভব করেছিলাম, পরে কিন্তু তা আর পাইনি। প্রমীলাও আলমারিটা পরিষ্কার করার পর আর ওটাতে হাত দেয়নি। ওই ওর স্বভাব, একটা জিনিস নিয়ে দু-দিন মেতে উঠবে, তারপর আবার অন্য কিছু একটা নিয়ে মাতবে। কয়েকটা দিন কেটে যাবার পর, আমার মনে হতে লাগল, সমস্ত ব্যাপারাটাই আমার কল্পনা। কিন্তু তবু খুকু একা একা ওই ঘরে থাকুক, এটা আমার মনঃপূত হল না।

সপ্তাহখানেক পর আমি একদিন অফিস থেকে ফিরে টেবিলের ওপর একটা চিরকুট পেলাম। প্রমীলা লিখেছে, নারী কল্যাণ সমিতির একটা জরুরি মিটিং-এ ওকে যেতে হয়েছে, ফিরতে রাত হবে। খুকু পাশের বাড়ি তার বন্ধু মণির সঙ্গে খেলা করতে গেছে, ওর কাছে বাইরের দরজার একটা চাবি আছে।

খুকু পাশের বাড়ি আছে মনে করে, আমি জামাকাপড় ছেড়ে ড্রয়িং রুমে একটা বিলিতি জার্নাল নিয়ে বসলাম। ও যে একা একা বাড়ি নেই, একথাটা ভেবে আমি বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছিলাম। হঠাৎ ওপর থেকে টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসতেই, আমি কান খাড়া করলাম। দু-জন ছোটো মেয়ের কণ্ঠস্বর, এতটুকু ভুল নেই। খুকু তার বন্ধুকে নিয়ে ওপরে খেলা করছে। কিন্তু ওর খেলার ঘর তো নীচে, আগে কখনো ওকে আমি বন্ধুদের নিয়ে ওপরে যেতে বা খেলা করতে দেখিনি। ওরা কী করছে দেখবার জন্য আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছোতেই ওদের তীক্ষ্ন কণ্ঠস্বর আমি শুনতে পেলাম, দু-জনে যেন ঝগড়া করছে। পরমুহূর্তে খুকু ককিয়ে কেঁদে উঠল। আমি আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দৌড়োলাম। কান্নার শব্দটা আসছে সেই কোনার ঘর থেকে। এক ধাক্কায় ভেজানো দরজা খুলে ফেলতেই, আমার চোখে পড়ল, খুকু আলমারিটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। ওর দু-চোখে জল, ব্যথায় মুখ নীল হয়ে গেছে।

আমি ওকে তুলে ধরে বললাম, ‘কী হয়েছে, খুকু?’

আলমারিটা আসার পর থেকে আমাদের দু-জনের মধ্যে যে একটা সংকোচ ও বাধার প্রাচীর সৃষ্টি হয়েছিল, ক্ষণিকের জন্য তা যেন দূর হয়ে গেল। ও আমার দুই হাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ও পাল্লা দিয়ে আমার আঙুল চেপে দিয়েছে।’

খুকুর ডান হাতের আঙুলগুলির ওপর একটা লাল দাগ আমার চোখে পড়ল। আমি আস্তে আস্তে ব্যথা পাওয়া জায়গায় আঙুল বুলোতে বুলোতে বললাম, ‘কে চেপে দিয়েছে?’

‘রাণু।’

কথাটা বলেই ও থেমে গেল, যেন মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে। অনিশ্চিতভাবে ও আমার মুখের দিকে তাকাল, তারপর অনেকটা ভয়ে ভয়ে আলমারির ডান পাল্লার দিকে— যেন গোপন কথা ফাঁস করে মহা অপরাধ করে ফেলেছে।

আমি এক ঝটকায় পাল্লাটা খুলে ফেললাম। ভেতরে ফাঁকা।

‘রাণু কে?’ আমি হালকাভাবে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, প্রাচীরটা আবার খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খুকু উত্তর দিল, ‘না, না, কেউ নয়।’

প্রমীলাকে আমি কথায় কথায় বললাম, ও যখন বেরোয় খুকুকেও যেন সঙ্গে নিয়ে যায়— একা একা ওর বাড়িতে থাকা উচিত নয়।

প্রমীলা আমার কথা উড়িয়েই দিল। ও বলল, ওইসব সভা-সমিতি খুকুর মোটেই ভালো লাগবে না, বরং বাড়িতে ও বেশি নিরিবিলি খেলবে।

আমি একবার ভাবলাম, প্রমীলাকে সব খুলে বলি। কিন্তু ভেবে দেখলাম, ফল হবে উলটো। ও মনে করবে, আমার মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটেছে, তাই নিরস্ত হলাম।

আলমারিটা বিক্রি করে দেবার কথা তুলতেই প্রমীলা এমন খেপে গেল যে, আমাকে চুপ করে যেতে হল। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, বাদানুবাদ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করি। বিশেষ করে প্রমীলার তিরিক্ষি মেজাজকে— সত্যি কথা বলতে কী, আমি একটু ভয়ই করি।

খুকুর বড়ো শখ ছিল একটা বেড়াল পুষবে। সেদিন অফিসে কথায় কথায় আমার এক সহকর্মী জানালেন, তাঁর পার্শিয়ান বেড়ালটার বাচ্চা হয়েছে, তিনি বিলিয়ে দেবেন। আমি রাত্রে খাবার টেবিলে কথাটা পাড়লাম।

প্রমীলা কিন্তু বেড়াল কিংবা কুকুর দু-চোখে দেখতে পারত না। ও বলল, বিছানা নোংরা করবে, কী দরকার বেড়ালের বাচ্চা এনে?

আমি বললাম, প্রথম থেকে ওটাকে ভালো শিক্ষা দিলে ঘরদোর নোংরা করবে না।

পার্শিয়ান বেড়াল বলেই প্রমীলা বোধ হয় আর বেশি উচ্চবাচ্য করল না।

খুকু এতক্ষণ আমাদের কথা মন দিয়ে শুনছিল। ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘না, না, বেড়ালের বাচ্চা আনতে হবে না।’

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘কিন্তু তুমিই তো বেড়ালের বাচ্চার জন্য বায়না ধরেছিলে।’

ওর চোখে যেন জল এসে গেল। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলল, ‘তা সত্যি, কিন্তু রাণু যে বেড়াল ভালোবাসে না।’ কথাটা বলেই ও যেন চুপসে গেল। ওর গাল দুটো লাল হয়ে উঠল।

প্রমীলা একটু মুচকি হাসল। ছোটো ছেলেমেয়েদের যে কাল্পনিক বন্ধু থাকে, সেটাই ও যেন ওর দৃষ্টি দিয়ে আমাকে বোঝাতে চাইল।

খুকু কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে দোতলায় ওর শোবার ঘরের দিকে ছুটে গেল।

আমি মনস্থির করে ফেললাম। আলমারিটা যে ভদ্রলোক বিক্রি করেছিলেন, তাঁর নাম সঞ্জীব চৌধুরী। আমি একদিন ছুটির দিন বিকেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আলমারির রহস্য আমাকে জানতেই হবে। ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন। আমি আমার পরিচয় দিয়ে তাঁকে বললাম আমার স্ত্রী সম্প্রতি নিলামে তাঁর কিছু আসবাবপত্রের মধ্যে একটা আলমারি কিনেছেন।

ভদ্রলোক আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তারপর পরিহাসতরল কণ্ঠে বললেন, ‘আশা করি, আলমারিতে ঘুণ ধরেনি।’

আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম যে, ওটা খুব ভালো অবস্থাতেই আছে।

ভদ্রলোকের ভুরু দুটো যেন একটু ওপরদিকে উঠল; তরপর তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘সচরাচর আমরা যা চোখে দেখি, তার চাইতেও কি বেশি কিছু?’ তারপর নিজে থেকেই তিনি বলতে লাগলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমিও ওটা পছন্দ করতাম না। আমার স্ত্রী তো ওটাকে আমাদের শোবার ঘরে রাখতেই দেননি। পরিবারের স্মৃতি হিসেবে ওটা এতদিন বাড়িতে রেখেছিলাম, স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর ওটা রাখার ইচ্ছে ছিল না বলেই অকশনে দিয়েছিলাম।’

‘আলমারিটা কি আপনাদের পরিবারে অনেকদিন ধরে আছে?’ প্রশ্ন করলাম।

‘আমি ঠিক বলতে পারব না, ওটা আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের সম্পত্তি ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর কিছু আসবাবের সঙ্গে ওটা আমার দখলে আসে।’

আমি সুযোগ পেয়ে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, আলমারিটার সঙ্গে কি কোনো কাহিনি জড়িত আছে?’

ভদ্রলোক সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দিলেন না, চুপ করে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘দেখুন লুকোচুরি করে লাভ নেই, আই শ্যাল রাদার বি অনেস্ট উইথ ইউ। শুনেছি, বছর পঞ্চাশ কী, কি ওর কাছাকাছি কোনো সময়, ওই আলমারির মধ্যে দশ-বারো বছরের একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল।’

‘দশ-বারো বছরের মেয়ে!’ আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম, ‘আপনি কি মেয়েটির নাম জানেন?’

ভদ্রলোক আমার প্রশ্ন শুনে যেন একটু থতোমতো খেলেন। তারপর বললেন, ‘শুনেছি, মেয়েটির নাম ছিল রাণু।’

আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, ওই নামটাই শুনব। তবু ভদ্রলোকের কথা শুনে, আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিম শিহরন বয়ে গেল।

ভদ্রলোক বলতে থাকেন, ‘আমাদের পরিবারের ইতিহাস যতটুকু জানি— শুনেছি, মেয়েটি নাকি তার বাবার বড়ো আদরের ছিল। একে বেশি বয়সের সন্তান, তার ওপর মেয়েটি যখন খুব ছোটো, তখনই ওর মা মারা যান। তাই বাবা তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন।’

‘আপনি বলছেন, ওই মেয়েটির মৃতদেহই আলমারিতে পাওয়া গিয়েছিল?’

‘কাহিনিটা তাই।’ ভদ্রলোক চুপ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বলে উঠলেন, ‘আশা করি, আপনাদের কোনো…ইয়ে…অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়নি!’

আমি লক্ষ করছিলাম, ভদ্রলোক কথা বলার সময় যেন হোঁচট খাচ্ছিলেন, কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

একটি বাচ্চা মেয়ের উদ্ভট কল্পনায় আমি প্রভাবান্বিত হয়েছি, এটা তাঁকে বলতে আমার কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকল। তাই আমি বললাম, ‘আমার স্ত্রী বলছিলেন, আলমারির ভেতর থেকে তিনি একটি বাচ্চা মেয়ের গলা শুনতে পান।’

‘সর্বনাশ!’ ভদ্রলোক যেন আঁতকে উঠলেন, ‘আলমারিটা পুড়িয়ে ফেলা উচিত। আমার স্ত্রীও ওই কথা বলতেন।’

‘কিন্তু আসল ঘটনা কী ঘটেছিল?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

ভদ্রলোক শুরু করলেন, ‘সুধাকান্ত, অর্থাৎ সেই বাবা ও মেয়ে রাণুর মধুর সম্পর্কের মধ্যে প্রথম চিড় ধরল, যখন সুধাকান্ত মেয়ের দেখাশোনা করার জন্য যে মহিলাকে রেখেছিলেন— তার মোহে পড়ে গেলেন। ভদ্রমহিলার নাম ছিল সৌদামিনী।

‘সুধাকান্ত মারা যাবার অনেক বছর পর, সৌদামিনীর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি থেকে ঘটনাটি জানা গিয়েছিল। সুধাকান্তর এক দূরসম্পর্কের ভাই ওই বাড়িতেই থাকত, তার নাম ছিল প্রাণতোষ। সে মদ্যপ ও উচ্ছৃঙ্খল। সুধাকান্ত তাকে দু-চোখে দেখতে পারতেন না, আবার ফেলতেও পারতেন না। সৌদামিনীর সঙ্গে প্রাণতোষের প্রথম থেকেই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রাণতোষই সৌদামিনীকে প্ররোচিত করে সুধাকান্তকে বিয়ে করার জন্য। তার উদ্দেশ্য ছিল, বর্ষীয়ান সুধাকান্তর মৃত্যুর পর, সে সৌদামিনীকে বিয়ে করে সুধাকান্তর সম্পত্তি ভোগ করবে। যতদিন তা সম্ভব না হয়, তারা গোপন প্রণয়লীলা চালিয়ে যাবে।

‘রাণু কিন্তু প্রথম থেকেই তার বাবা যে সৌদামিনীর দিকে ঝুঁকছেন, এটা সুনজরে দেখেনি; সৌদামিনীকে সে হিংসে করতে শুরু করেছিল।

‘এক রাত্রে সুধাকান্ত যখন ব্যাবসার সূত্রে বাইরে গিয়েছিলেন— রাণু ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে সৌদামিনীর ঘরে চলে আসে। প্রাণতোষ আর সৌদামিনীকে সে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে ফেলে। কী ভয়ানক অস্বস্তিকর পরিবেশ বুঝে দেখুন। রাণুর মুখ থেকে এটা জানার অর্থ হল, ওদের পরিকল্পনা, ওদের ভবিষ্যৎ চুরমার হয়ে যাওয়া। প্রাণতোষ মুহূর্ত দ্বিধা করেনি। রাণুকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে একটা বালিশ দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরেছিল।

‘সৌদামিনীর জবানিতে জানা যায়, সে নাকি প্রাণতোষকে অনেক অনুনয় করেছিল, কিন্তু প্রাণতোষ তার কথায় কান দেয়নি। অবশ্য সৌদামিনীর একথাটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা যাচাই করার সুযোগ ছিল না। রাণুর দেহটা ওরা সুধাকান্তর স্ত্রীর ঘরে যে বড়ো কাঠের আলমারিটা ছিল, তার মধ্যে ঢুকিয়ে পাল্লা বন্ধ করে দেয়। ওই ঘরটা প্রকাণ্ড বাড়ির একপ্রান্তে ছিল, রাণুর মা-র মৃত্যুর পর থেকে কেউ আর ওটা ব্যবহার করত না।

‘সুধাকান্ত ফেরার পর তাঁকে দুর্ঘটনার কথা জানানো হয়। রাণু নিশ্চয়ই তার মা-র ঘরে গিয়ে কোনো কারণে আলমারিটার মধ্যে ঢুকেছিল; তারপর পাল্লাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। পাল্লাটা জোরে আটকে যাওয়ায় ও আর বেরোতে পারেনি। ওদের এই কথা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ ছিল না।

‘এই ঘটনায় সুধাকান্ত ভয়ানক ভেঙে পড়েন, তারপর আর এক বছর মাত্র বেঁচেছিলেন। এরই মধ্যে সৌদামিনীর সঙ্গে সুধাকান্তর কোনোমতে বিয়েটা হয়ে যায় এবং সৌদামিনী বিধবাও হয়।

‘প্রচুর সম্পত্তির অধিকারিণী সৌদামিনী অল্প দিনের মধ্যেই যখন আবার প্রাণতোষকে বিয়ে করে, তা নিয়ে সমাজে খুব হইচই পড়েছিল।’

আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা রাণুর মৃতদেহ আলমারির কোন দিকে ছিল?’

‘কেন, ডান দিকে।’ সঞ্জীব চৌধুরী যেন একটু বিস্মিত হয়েই বললেন, ‘আপনি খেয়াল করে দেখবেন, ডান দিকের পাল্লাটা বেশ জোর দিয়ে খুলতে হয়।’

আমার কাছে অবশ্য এ ব্যাপারটা অজানা ছিল না।

ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন, ‘পাপের ধন ভূতে খায়। সৌদামিনীর জীবনেও সুখ ছিল না। প্রাণতোষ জুয়া খেলে দু-হাতে টাকা ওড়াতে লাগল। তা ছাড়া তার আরও বদ স্বভাব ছিল। এসব কথা সৌদামিনী আগে জানত না। বিয়ের পর প্রাণতোষের আসল মূর্তি দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রাণতোষ তার ওপর অত্যাচারও শুরু করে। ক্রমে তাকে কালরোগে ধরে। তখনকার দিনে যক্ষ্মার ভালো চিকিৎসা ছিল। মরবার আগে সৌদামিনী সমস্ত কাহিনি বলে যায়।’

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘রাণুর কোনো ছবি আছে?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘ফ্যামিলির বহু পুরোনো ছবির মধ্যে তারও একটা ছবি আছে, তবে তা দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, বিকৃত হয়ে গেছে।’

আমার অনুরোধে তিনি পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে একটা ছবি নিয়ে এলেন। ছবিটা অস্পষ্ট। তবু আমার মনে হল, ফ্রক পরা দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে, আর অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ছবির চোখ দুটো যেন অস্বাভাবিক উজ্জ্বল।

ভদ্রলোক আবার বলতে লাগলেন, ‘রাণু দেখতে খুব ফুটফুটে ছিল, কিন্তু তার স্বভাব নাকি মোটেই ভালো ছিল না। সৌদামিনীর টুকরো টুকরো কথা থেকে জানা যায় যে, বাপের উপস্থিতিতে সে খুব ভালোমানুষ সেজে থাকত, অন্য সময় তার মূর্তি ছিল একেবারে অন্যরকম। সৌদামিনীকে আঁচড়ে কামড়ে নাজেহাল করে ছাড়ত। তার প্রকৃতিও ছিল খুব নিষ্ঠুর। একবার নাকি একটা বেড়ালের বাচ্চাকে দোতলা থেকে ছুড়ে ফেলেছিল। বেড়াল ও একেবারেই দেখতে পারত না। বাবার কাছে মিথ্যে নালিশ করে লোকজনকে শাস্তি পাওয়ানো ওর একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। সৌদামিনী ওর ভয়ে সবসময় জুজু হয়ে থাকত। বাবা ওকে ছাড়া আর কাউকে সুনজরে দেখবেন, এটা যেন ও সহ্য করতে পারত না।’

ভদ্রলোকের কথায় রাণুর চরিত্রের নিষ্ঠুর ও হিংসুটে দিকটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লাম।

বাড়ি ফেরার পথে আমি দৃঢ় সংকল্প করলাম প্রমীলা যাই বলুক, আলমারিটাকে বাড়ি থেকে দূর করতেই হবে। ওটার প্রতি খুকুর তীব্র আকর্ষণ আর মাঝে মাঝে রাণুর নাম উচ্চারণ করার মধ্যে আমি অশুভ ইঙ্গিত অনুভব না করে পারলাম না।

আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। প্রমীলা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দরজা খোলার সঙ্গেসঙ্গেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘খুকু কোথায়?’

প্রমীলা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘ঘুমোচ্ছে। রাত ক-টা হল, খেয়াল আছে?’

আমি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, রাত সাড়ে এগারোটা।

প্রমীলাকে যেন একটু চিন্তাগ্রস্ত মনে হল। ও বলল, ‘খুকুর কী হয়েছে বলো তো? আজ সন্ধে থেকে ওর হাবভাব কেন জানি, আমার ভালো লাগেনি। আবার রাণুর কথা বলছিল।’

আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা অজানা আশঙ্কা আমাকে যেন গ্রাস করে ফেলতে চাইছে।

প্রমীলা একটু থেমে আবার বলল, ‘মনে হল, ও যেন খুব ভয় পেয়েছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ও আমাকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরল— সেই ছোট্টবেলায় যেমনটি করত। বলল, রাণু নাকি ফিরে আসতে চায়।’

আমি আর অপেক্ষা করলাম না। আমার বুকের মধ্যে যেন হাপর পড়ছে। টপাটপ সিঁড়ি টপকে আমি ছুটলাম খুকুর শোবার ঘরের দিকে। প্রমীলাও যেন ভয় পেয়ে আমার পেছন পেছন ছুটল।

খুকুর শোবার ঘরের দরজা খোলা। বিছানা খালি। অন্যপ্রান্তে সেই ঘরটার দরজা কিন্তু ভেজানো। আমি ছুটে গিয়ে এক লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললাম। তারপরই আলমারির ডান পাল্লা ধরে টান মারলাম। পাল্লাটা শক্তভাবে এঁটে গেছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে দ্বিতীয়বার টান মারতেই ওটা খুলে গেল।

এবার আর আমার চোখের ভুল হয়নি। ডান দিকের দুই তাকের মাঝখানের ফাঁকে, আলমারির গায়ে একটা দেহ হাঁটু মোড়া অবস্থায় যেন ঠেস দেওয়া রয়েছে।

আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম।

প্রমীলা তাড়াতাড়ি ঘরের সব জানলা খুলে দিল। ঠান্ডা, নির্মল হাওয়া ঘরে ঢুকতেই, ছোটো মেয়েটি চোখ খুলল।

প্রমীলা ওকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষতে ঘষতে কান্না ভেজা গলায় বলতে লাগল, ‘সোনা আমার, মানিক আমার— ভগবান তোমাকে রক্ষা করেছেন।’

সেই ছোটো মেয়েটির উজ্জ্বল দুই চোখ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, যেন আমাকে যাচাই করার চেষ্টা করছে।

আমি ভীষণ চমকে দু-পা পিছিয়ে এলাম। আমার বুঝতে এতটুকু দেরি হল না যে, খুকুর চোখের দৃষ্টিটা খুকুর নয়। সঞ্জীব চৌধুরীর বাড়িতে রাণুর যে ছবি আমি দেখেছিলাম, সেই উজ্জ্বল চোখ দুটি খুকুর চোখে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

খুকুকে ভুলিয়ে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাণুর অনেক দিনের বন্দি আত্মা ওর শরীরে ঢুকে পড়েছে, আর আমাদের প্রিয় খুকুর আত্মা এখন বোধ হয় রাণুর বিদেহীর মধ্যে গুমরে মরছে। কী ভয়ানক! খুকুর দেহটাই আছে, কিন্তু আত্মা, মন, সব রাণুর। ও আর আমাদের মেয়ে নয়।

খুকু তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে লাগল। প্রমীলার আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু আসল ঘটনা শুধু আমিই জানি। অনেক সময় লক্ষ করেছি, ধূর্ত চোখ দুটো আমাকেই দেখছে— যেন বিদ্রূপ করছে। আমিই যে ওর একমাত্র শত্রু, তা যেন ও বুঝে নিয়েছে।

প্রমীলাই এবার আলমারিটা বিদেয় করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আর বাদ সাধলাম আমি। আলমারিটার মধ্য দিয়েই রাণু খুকুকে ঠকিয়ে ওর শরীরে ভর করেছে, হয়তো এটার মধ্য দিয়েই আবার খুকুকে আমি ফিরে পাব, এই ক্ষীণ আশা আমার ছিল।

প্রমীলা বেরিয়ে গেলেই, আমি চুপি চুপি ওপরে ওই ঘরে ঢুকতাম। তারপর আলমারির ডান দিকে পাল্লাটা খুলে খুকুর নাম ধরে বার বার ডাকতাম। একদিন আমার স্পষ্ট মনে হল, যেন আমি খুকুর গলা শুনলাম, ‘বাবা, বাবা, আমি এখানে।’

আর ঠিক সেই মুহূর্তে পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করে আমি ফিরে তাকালাম।

খুকুর দেহটা আমার ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে। ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। মুখ থেকে সব ছদ্ম আবরণ খসে পড়েছে— সেখানে ফুটে উঠেছে একটা হিংস্র উল্লাস।

‘ও আর ফিরে আসবে না।’ যে মুখ একসময় আমাদের বড়ো আদরের খুকুর ছিল, সেই মুখে এক টুকরো উদ্ধত, বেপরোয়া হাসি ফুটে উঠল।

‘সেটা তোমার ভুল, ও এসে গেছে।’ আমি যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করে বললাম।

ওর মুখে একটা অনিশ্চয়তার ভাব ফুটে উঠল। তারপর ও এগিয়ে এসে পাল্লার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করল।

ওকে যে আমি ফাঁদে ফেলেছি, তা ও বোঝবার আগেই আমি দু-হাতে ওর গলা টিপে ধরলাম।

ও আমার হাত তেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু আমি আর ওকে সুযোগ দিলাম না— জোর করে আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে পাল্লাটা চেপে ধরলাম।

আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। যখন পাল্লাটা খুলব, তখন খুকুকে আমি ফিরে পাব।

কিন্তু আমার হিসেবে সামান্য ভুল হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়িতে আমি ওর গলাটা এত জোরে চেপে ধরেছিলাম যে, ঘাড় মটকে দেহটা শেষ হয়ে গিয়েছিল, খুকু আর ওর মধ্যে ফিরে আসার সুযোগ পায়নি।

মানসিক রোগীদের এই হাসপাতালে প্রমীলা কোনোদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। ওকে আমি দোষ দিই না, ওর বিশ্বাস, আমি খুকুকে মেরে ফেলেছি। কিন্তু সঞ্জীব চৌধুরী প্রায়ই আসেন। আমি বুঝতে পারি, ভদ্রলোক সমস্ত ঘটনার জন্য মনে মনে নিজেকে দায়ী করেন, তাই আমার প্রতি একটা দায়িত্ববোধও যেন অনুভব না করে পারেন না।

তাঁর মুখেই আমি শুনেছিলাম যে, প্রমীলা আলমারিটাকে বিক্রি করে দিয়েছে। ওটাকে পুড়িয়ে ফেলাই উচিত ছিল। খুকু আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, কিন্তু রাণুর আত্মা যে ওটার মধ্যে আবার আশ্রয় নিয়েছে, সে-বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত। সুযোগ পেলেই ও আবার ওর বয়সি কোনো মেয়েকে ছলনায় ভুলিয়ে বেরিয়ে আসবে।

পুরোনো আলমারি কেনার আগে, আপনারা ভালো করে দেখে নেবেন। মনে রাখবেন, সাত ফুট উঁচু, মেহগিনি কাঠের, কালো বার্নিশ, সারা গায়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য— আর ডান দিকের পাল্লাটা আটকে যায়। আপনাদের যদি দশ-বারো বছরের মেয়ে থাকে, তবে এই পুরোনো আলমারির ধার-পাশ দিয়েও হাঁটবেন না, এই আমার একান্ত অনুরোধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *