বুদ্ধ এবং কার্ল মার্ক্সের ভেতর প্রতিতুলনা

বুদ্ধ এবং কার্ল মার্কসের ভেতর প্রতিতুলনা

মার্কসীয় বিশ্বাসের যে দিকগুলো আজও টিকে আছে, সেসবে একবার চোখ বুলিয়ে আমরা এখন বুদ্ধ এবং কার্ল মার্ক্সের ভেতর একটি প্রতি-তুলনায় আসতে পারি।

প্রথম বিষয়ে বুদ্ধ ও কার্ল মার্ক্সের ভেতরে পুরোপুরি ঐক্যমত্য আছে। কতটাই তাঁদের দু’জনের ভেতরে মিল সেটা দেখাতে আমি নিচে বুদ্ধ ও ব্রাহ্মণ পোত্থপদর ভেতরকার একটি কথোপকথন বা সংলাপ তুলে ধরছি:

‘তারপর, একই পদে, পোত্থপদ বুদ্ধকে নিচের প্রতিটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন :

১. পৃথিবী কি চিরন্তন নয়?

২. পৃথিবী কি সসীম?

৩. পৃথিবী কি অসীম?

৪. আত্মা কি দেহের মতো একই রূপ?

৫. আত্মা এক এবং দেহ কি অন্য রূপ?

৬. যিনি সত্যকে লাভ করেছেন, তিনি কি মৃত্যুর পর আবার বাঁচবেন?

৭. তিনি কি মৃত্যুর পর আর কখনো জীবিত হবেন?

এবং প্রতিটি প্রশ্নেই মহিমান্বিত বুদ্ধ একই উত্তর দিলেন : ‘পোখপদ, এই বিষয়ে আমি কোনো মতামত দিইনি।

২৮. ‘কিন্তু কেন মহিমান্বিত বুদ্ধ এ বিষয়ে কোনো মতামত দেননি? (কারণ) ‘এই প্রশ্নটি কোনো লাভের জন্য গণনা করা হয়নি, এটা ধম্মের সাথে সম্পর্কিত নয় এবং সঠিক আচরণের মৌল উপাদানগুলোয় এটি ফিরে আসে না, এটি বিচ্ছিন্নতা অথবা বাসনা থেকে মুক্তির সাথেও সম্পর্কিত নয়, নয় আত্মার প্রশান্তি লাভের সাথে, খাঁটি প্রজ্ঞার সাথে সম্পর্কিত নয়, নয় অন্তর্দৃষ্টি (অথবা মার্গের উচ্চতর সোপানের সাথে), নয় নির্বাণের সাথে। এজন্যই আমি এই বিষয়ে কোনো মতামত দিই না,’ বুদ্ধ বললেন।

দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রে বুদ্ধ এবং মার্ক্সের ভেতর মিল পাওয়া যায়, সে বিষয়ে বুদ্ধ ও কোশলের রাজা পাসেনাদির মধ্যবর্তী সংলাপটিই বুঝতে যথেষ্ট:

‘এছাড়া, সবসময়ই রাজায় রাজায়, অভিজাতদের ভেতরে, ব্রাহ্মণগণের মধ্যে, গৃহাধিপতিদের ভেতরে, মাতা ও পুত্রে, পিতা ও পুত্রে, ভ্রাতা ও ভগিনীর ভেতর, ভগিনী ও ভ্রাতার ভিতর, বন্ধু ও বন্ধুর ভেতর কলহ-বিবাদ- সঙ্ঘর্ষ চলতেই থাকে…’ যদিও এ কথাগুলো কোশল রাজ পাসেনাদি বলেছেন, বুদ্ধ তাঁর কথায় দ্বি-মত করেননি; যেহেতু পাসেনাদির এ বক্তব্য সমাজের একটি সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরে।

২৯. সমাজে বিদ্যমান শ্রেণি সংঘাত বিষয়ে বুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য তাঁর ‘আর্য অষ্টাঙ্গ নীতি—তেই প্রকাশিত। এই নীতিমালায় তিনি স্বীকার করেছেন যে ‘শ্রেণি সংঘাত’ সমাজে রয়েছে এবং শ্রেণি সংঘাতই মানুষের দুর্দশার কারণ। তৃতীয় প্রশ্নে আমি আবারও বুদ্ধের সাথে পোখপদের সংলাপ থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাই:

‘অতঃপর মহিমান্বিত বুদ্ধ তবে কী নির্ণয় করলেন?’ আমি ব্যখ্যা করলাম, ‘পোখপদ, দুঃখ ও দুর্দশা রয়েছে,’ আমি তাঁকে ব্যাখ্যা করলাম যে দুঃখের উদ্ভব কীসে হয়। আমি পোত্থপদকে আরো ব্যখ্যা করে বোঝালাম যে কীভাবে দুঃখের বিনাশ সাধন সম্ভব হতে পারে।

৩০. ‘এবং কেন মহিমান্বিত বুদ্ধ এবিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন?’

‘কারণ ঐ প্রশ্নগুলো, পোখপদ, আত্মার লাভের সাথে জড়িত, ধম্মের সাথে সম্পর্কিত, ঐ প্রশ্নগুলো সঠিক আচরণের পথে ফিরে আসে, ফিরে আসে বিচ্ছিন্নতা বা বাসনা থেকে শুদ্ধতা লাভের পথে, ফিরে আসে নৈঃশব্দ্য ও নির্জনতায়, হৃদয়ের প্রশান্তিতে, সত্যিকারের প্রজ্ঞায়, মুক্তিপথের উচ্চতর সোপানসমূহের অন্তর্দৃষ্টি এবং নির্বাণে। এজন্যই, পোখপদ, আমি এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছি। বুদ্ধ বলেন।

মার্কস ও বুদ্ধের ভাষা ভিন্ন হলেও অর্থ একইরকম। দুর্দশার জন্য সমাজের বঞ্চনাকে বুদ্ধ যখন দায়ী করেন, তখন সেটা মার্ক্সের বক্তব্য থেকে আদৌ পৃথক নয়।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিষয়েও বুদ্ধ ও আনন্দর মধ্যবর্তী এই সংলাপটির কিছু অংশ যে-কারো জন্যই খুব আগ্রহোদ্দীপক হতে পারে। আনন্দর করা একটি প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধ বলছেন :

‘আমি বলেছি যে সম্পদের অধিকার বোধ থেকেই মানুষের ভেতর বিষয় বাসনা বা অর্থলিপ্সা তৈরি হয়, আনন্দ, এভাবেই তোমাকে বিষয়টি বুঝতে হবে। যেখানে কোনো ধরনের বা কোনো প্রকৃতির অধিকার বোধ নেই, সেখানে সেই সম্পদের মালিকানা বা অধিকার হাতছাড়া হলে কোনো দুঃখ জন্মাবে কি?

‘না, প্ৰভু।’

‘কাজেই, আনন্দ, সব বেদনার মূলে এই অধিকার বোধ বা সম্পদের মালিকানা।’

৩১. ‘আমি আরো বলেছি যে বিষয়ের জন্য আকাঙ্ক্ষাই হলো সম্পদ অধিকারের মূল কারণ। এখন যা কিছুই ঘটুক না কেন, আনন্দ, বিষয়টি এভাবেই বুঝতে হবে। যদি কারোর ভেতর কোনো বিষয়ে বা কোনো কিছু নিয়েই কোনো আকাঙ্ক্ষা দেখা না যায়, তবে সেখানে আকাঙ্ক্ষার অভাবে সম্পদের মালিকানা কি দেখা দেবে?’

‘না, প্ৰভু।’

‘সুতরাং, আনন্দ, এটাই মূল কথা, সম্পদের মালিকানার ভিত্তি বলো, খুঁটি বলো, উদ্ভব বলো বা কারণ বলো- মূল কারণ হলো সম্পদ প্রাপ্তির জন্য জিদ বা আকাঙ্ক্ষা।’ চতুর্থ বিষয়ে কোনো স্বাক্ষ্যই প্রয়োজনীয় নয়। ভিক্ষু সংঘের নিয়মাবলি এবিষয়ে সেরা সাক্ষ্য দেবে।

ভিক্ষু সংঘের নিয়মাবলি অনুযায়ী, একজন ভিক্ষু শুধুমাত্র নিচের ছয়টি দ্রব্য তাঁর ব্যক্তিগত মালিকানায় পেতে পারেন। এই ছয়টি দ্রব্য হলো:

১. প্রতিদিনের পরার জন্য তিন টুকরো কাপড়,

২. একটি কোমরবন্ধনী,

৩. একটি ভিক্ষাপাত্র,

৪. একটি দাড়ি কামাবার ক্ষুর,

৫. একটি সুঁই,

৬. একটি পানি/জলের ছাঁকনি।

এছাড়াও একজন ভিক্ষুকে কেউ স্বর্ণ বা রৌপ্য হিসেবে উপহার দিলে তাঁর সেই উপহার গ্রহণও বৌদ্ধ ধর্মমতে সম্পূর্ণ অনুচিত। কারণ এই ভয় থেকেই যায় যে সোনা বা রূপা দিয়ে তিনি উপরোক্ত আটটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া অন্য কিছুও কিনে ফেলতে পারেন।

ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে এই নিয়মগুলো সাম্যবাদী রাশিয়ায় প্রচলিত নিয়ম-কানুনের চেয়েও কড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *