মার্কসীয় বিশ্বাসের যা টিকে থাকে
বুদ্ধ এবং কার্ল মার্ক্সের মতাদর্শসমূহের ভেতর তুলনা করার আগে শুরুতে যেটা করা দরকার সেটা হলো মার্কসীয় বিশ্বাসের কতটা টিকে আছে, কতটা ইতিহাস অনুমোদন করেনি এবং কতটা তার বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেটা লক্ষ্য করা।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি কোনো সময়ে মার্কসীয় মতবাদ প্রথম প্রস্তাবিত হয়েছিল। সেই থেকে এই মতবাদ প্রচণ্ড সমালোচনার শিকার হয়। এই সমালোচনার কারণেই কার্ল মার্কস কর্তৃক উত্থাপিত ভাবাদর্শগত কাঠামোর অনেকাংশই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সমাজতন্ত্র অনিবার্য বলে মার্ক্সের উত্থাপিত দাবি যে সম্পূর্ণ অপ্রমাণিত হয়েছে সেবিষয়ে সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। ‘ডাস ক্যাপিটাল’ বা মার্কস লিখিত সমাজতন্ত্রের সুসমাচার প্রকাশিত হবার ৭০ বছর পর ১৯১৭ সালে পৃথিবীর একটি দেশে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ নামে রাশিয়াতে ‘সাম্যবাদ’ যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন এটা কিন্তু ‘অনিবার্য’ বা ‘অপ্রতিরোধ্য’ কিছু হিসেবে আসেনি। বরঞ্চ এই একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে প্রচুর মানবীয় প্রচেষ্টা দরকার হয়েছে, দরকার হয়েছে রক্তপাত। সুচিন্তিত নানা পরিকল্পনার সাথে প্রচুর সন্ত্রাস এবং রক্তপাতের পর বিপ্লব সম্ভব হয়েছে— তার আগে এই বিপ্লব রাশিয়াতে পা রাখতে পারেনি। বাকি পৃথিবী ‘সর্বহারার একনায়কত্বে’র জন্য আজও অপেক্ষা করছে। ‘সমাজতন্ত্র অনিবার্য বা অপরিহার্য’ বলে মার্কসীয় তত্ত্বের এই ‘সাধারণীকৃত বিকৃতকরণ’ ব্যতীত ও মার্কসীয় মতবাদের অন্য প্রধান ভাবনাগুলোও যুক্তি ও অভিজ্ঞতা থেকে ইতোমধ্যে চূর্ণ করা হয়েছে। ইতিহাসকে আজ কেউই শুধু ‘অর্থনৈতিক ব্যখ্যা’ সাপেক্ষে গ্রহণ করে না। কেউই মেনে নেয় না যে ‘সর্বহারা’ ক্রমশ নিঃস্ব হয়েছে। এটা তাঁর অন্যান্য পূর্বানুমানগুলো সম্পর্কেও সত্য। কার্ল মার্ক্সের বিপুল তত্ত্বাবলীর যা আজও কার্যকরী ভাবে টিকে আছে তা’ যেন তাঁর প্রজ্জ্বলিত অগ্নির অতি সামান্য এক অংশ, ক্ষুদ্র তবে আজও গুরুত্বপূর্ণ। এই অবশিষ্ট অগ্নি, আমার মতে, নিচের চারটি উপাদানে পরিপূর্ণ :
১. দর্শনের মূল কাজ হলো পৃথিবীকে পুনর্গঠন করা এবং পৃথিবীর উদ্ভব কীভাবে হলো সেটা ব্যখ্যায় অযথা কালক্ষেপণ না করা।
২. এক শ্রেণির সাথে অপর শ্রেণির মধ্যকার স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকে।
৩. সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা এক শ্রেণিকে ক্ষমতা এনে দেয় এবং অন্য শ্রেণিকে বঞ্চনার মাধ্যমে দুঃখ-যন্ত্রণার মুখোমুখি করে।
৪. সমাজের মঙ্গলের জন্যই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদের মাধ্যমে দুঃখকে মুছে ফেলা প্রয়োজন।