বুদ্ধের ধর্ম
বুদ্ধকে সাধারণত অহিংসার নীতির সাথে মিলিয়ে দেখা হয়। অহিংসাই যেন তাঁর শিক্ষার ‘সবকিছু’ এবং ‘সবশেষ’ বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন বুদ্ধর শিক্ষার পরিধি কতটা বিস্তীর্ণ: ‘অহিংসা’ নীতিকে ছাপিয়েও এই শিক্ষার দিগন্ত আরো বহু দূর প্রসারিত। এজন্যই তাঁর নীতিগুলো বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ত্রিপিটক পাঠ থেকে যতটা বুঝেছি, সেই অনুধাবন থেকেই নিচে আমি বুদ্ধর শিক্ষার প্রধান ভাবনাগুলো তুলে ধরছি:
১. একটি মুক্ত সমাজের জন্য ধর্ম প্রয়োজনীয়।
২. প্রতিটি ধর্মই থাকার বা গ্রহণের যোগ্য নয়।
৩. ধর্মকে ঈশ্বর অথবা আত্মা বা স্বর্গ ও পৃথিবী নিয়ে নানা অনুমান ও তত্ত্বের সাথে নয় বরং অবশ্যই জীবনের ঘটনাবলীর সাথে সম্পর্কিত হতে হবে।
৪. ঈশ্বরকে ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু করাটা ভুল হবে।
৫. আত্মার মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ করাটাকে ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলা ভুল।
৬. পশুবলিকে ধর্মের কেন্দ্র করে তোলা ভুল।
৭. সত্যিকারের ধর্ম শাস্ত্রে নয়, মানুষের হৃদয়ে থাকে।
৮. মানুষ এবং নৈতিকতাকে ধর্মের কেন্দ্র হতে হবে। যদি তা’ না হয়, তবে ধর্ম একটি নিষ্ঠুর কুসংস্কার।
৯. নীতিবোধ বা নৈতিকতাকে শুধু জীবনের আদর্শ করাটাই যথেষ্ট নয়। যেহেতু ঈশ্বর বলে কেউ নেই, কাজেই নীতিবোধ বা নৈতিকতাকেই জীবনের আইন বা জীবনবিধি করে তুলতে হবে।
১০. ধর্মের কাজ হলো পৃথিবীকে পুনর্গঠন করা এবং পৃথিবীকে সুখী করা- পৃথিবীর উদ্ভব বা বিনাশ কীভাবে সেটা ব্যখ্যা করা নয়।
১১. পৃথিবীর সব অসুখের জন্ম হয় স্বার্থের সংঘাত থেকে এবং এই অসুখ থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় হলো ‘আর্য অষ্টাঙ্গ মাৰ্গ’কে অনুসরণ করা।
১২. সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা সমাজে একটি শ্রেণিকে ক্ষমতা দান করে এবং অন্য শ্রেণিকে দেয় দুঃখ।
১৩. সমাজের মঙ্গল বা হিতের জন্যই এই দুঃখকে মুছে ফেলতে হলে তার কারণ বা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকেও উচ্ছেদ করতে হবে।
১৪. সকল মানুষই সমান।
১৫. মানুষের যোগ্যতাই তাঁর পরিমাপ- তাঁর জন্ম বা বংশ পরিচয় নয়।
১৬. যা গুরুত্বপূর্ণ তা’ হলো জীবনের উচ্চ আদর্শ এবং অভিজাত জন্ম-ঠিকুজি নয়।
১৭. মৈত্রী’ বা বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতা কখনোই পরিত্যাগ করা উচিত নয়। এমনকি কারো শত্রুর প্রতিও ‘মৈত্রী’ নীতি পরিত্যাগ করা উচিত নয়।
১৮. সবারই শেখার অধিকার আছে। বেঁচে থাকতে যেমন খাবার প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন শেখা।
১৯. চরিত্র ছাড়া শিক্ষা বিপজ্জনক।
২০. কিছুই অমূলক নয়। কিছুই চিরতরের বাধ্যবাধকতা নয়। প্রতিটি জিনিসই অনুসন্ধান এবং পরীক্ষার মাধ্যমে বিবেচিত হওয়া উচিত।
২১. কোনোকিছুই চূড়ান্ত নয়।
২২. পৃথিবীর সবকিছুই কার্যকারণ নীতির আওতাধীন।
২৩. কিছুই চিরস্থায়ী বা সনাতন নয়। প্রতিটি জিনিসই পরিবর্তনের আওতাধীন। যা হচ্ছে তা সবসময়ই হয়ে উঠছে।
২৪. সত্য এবং ন্যায় ব্যতীত অন্য কিছুর জন্য যুদ্ধ করাটা অন্যায়।
২৫. পরাজিত বা বিজিতের প্রতি বিজয়ীর কর্তব্য রয়েছে।
সংক্ষেপে এটাই বুদ্ধর শিক্ষা। কত প্রাচীন ও কত সজীব! কত প্রসারিত এবং গভীর তাঁর শিক্ষা!