কার পন্থা বেশি কার্যকরী?

কার পন্থা বেশি কার্যকরী?

এখন আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব যে কার পন্থা বেশি কার্যকরী। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গঠিত সরকার আর নৈতিক চারিত্র্যের মাধ্যমে গঠিত সরকারের ভেতর একটি বেছে নিতে হবে।

বার্ক যেমন বলেন যে, শক্তি বা বলপ্রয়োগ কখনোই কোনো চিরস্থায়ী পন্থা হতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাঁর সমঝোতার বিষয়ক বক্তৃতায় তিনি এই স্মরণীয় সতর্কবার্তা দান করেন :

‘প্রথমত, স্যার, আমাকে বলতে দিন যে বলপ্রয়োগ বিষয়টি নিঃসঙ্গ ও ক্ষণস্থায়ী। এটা এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নতুন করে আবার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন তাতে দূর হয় না। এবং একটি জাতি কখনোই পরিচালিত হয় না যতক্ষণ না এটা চিরদিনের মতো বিজিত হয়।

‘আমার পরবর্তী আপত্তি হলো এর অনিশ্চয়তায়। সন্ত্রাস বা সহিংসতা সর্বদাই শক্তির প্রতিক্রিয়া নয়; এবং একটি অস্ত্র অর্থই বিজয় নয়। আপনি যদি সফল না হন, তবে তার অর্থ হলো আপনার কাছে কোনো সম্পদ নেই, কারণ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে শক্তি বা বলপ্রয়োগের পন্থা শুধু বাকি থাকে। কিন্তু বলপ্রয়োগও যদি ব্যর্থ হয়, তবে নতুন করে কোনো নিষ্পত্তি হবার আশা রহিত হয়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মাঝে মাঝে সদয়তা দ্বারাও ক্রীত হয়; কিন্তু ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কখনোই এক দুর্বল ও পরাজিত সন্ত্রাস কর্তৃক ভিক্ষা হিসেবে চাওয়া যেতে পারে না।’

শক্তি বা বলপ্রয়োগের প্রতি আর একটি মাত্র আপত্তি হলো তুমি যা রক্ষা করতে চাইছো, তা’ আসলে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তুমি ধ্বংস করে ফেল। যে জিনিসের জন্য তুমি লড়াই করেছো তা’ তুমি পাও বটে তবে পাও একটি অবমূল্যায়িত, নিমজ্জিত বা ডুবে যাওয়া, বিনষ্ট এবং ক্ষয়প্রাপ্ত বা অপচয়িত অবস্থায়।’

ভিক্ষুদের দেওয়া এক উপদেশে বুদ্ধ ন্যায়পরতার শাসন ও আইন বা বলপ্রয়োগের শাসনের ভেতরের পার্থক্য তুলে ধরেন। ভ্রাতৃসঙ্ঘকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন :

২. বহু আগে, প্রিয় ভ্রাতাবৃন্দ, এক দেশে ছিলেন এক সার্বভৌম অধিপতি এবং তাঁর নাম ছিল বজ্রচক্র। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়বান নৃপতি, গোটা পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশের রাজা, বিজয়ী এবং তাঁর জনগণের রক্ষক। তিনি ছিলেন স্বর্গীয়, মহাজাগতিক চাকা বা ধর্মচক্রের অধিকারী। এই সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি তিনি হয়েছিলেন তাঁর ন্যায়পরতা দিয়ে- সাহস বা তলোয়ারের গুণে নয়।

৩. এখন, প্রিয় ভ্রাতাবৃন্দ, বহু বছর পরে, বহু শত ও সহস্র বছর পরে, নৃপতি বজ্রচক্র একজনকে ডেকে বললেন : ‘তোমার দেখা উচিত, প্রিয় দূত, যে ধর্মচক্র এতটুকু ডুবে গেছে কিনা, এটা কি একটুও চ্যুত হয়েছে তার অবস্থান থেকে, তারপর আমাকে এসে জানাও।’

এখন এত শত সহস্র বছরে সত্যিই ধর্মচক্র তার অতীত স্থান থেকে সামান্য বিচ্যুত হয়েছে। এটা দেখে সেই বার্তাবাহক রাজা বজ্রচক্রের কাছে গিয়ে বললেন, ‘মহামান্য সম্রাট, সত্য হিসেবে এটা জেনে নিন যে ধর্মচক্র খানিকটা ডুবেছে এবং তার অতীত স্থান থেকে খানিকটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে।’

‘নৃপতি বজ্রচক্র, প্রিয় ভ্রাতাবৃন্দ, তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন :

দেখো, প্রিয় পুত্র, আমার ধর্মচক্র খানিকটা ডুবেছে এবং তার অতীতের স্থান থেকে খানিকটা বিচ্যুত হয়েছে। এখন আমাকে বলা হয়েছে: যদি কোনো রাজ্যের ধর্মচক্র ডুবে যায় বা তার অতীতের স্থান থেকে খানিকটা হলেও বিচ্যূত হয়, তখন সেই নৃপতির খুব একটা বাঁচার আশা থাকে না। আমি আমার জীবনের সব মানবীয় আনন্দ যা পাবার তা’ পেয়েছি; এখন আমার স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগের সময় এসেছে, এসো- প্রিয় পুত্র, এখন তুমিই এই সসাগরা পৃথিবীর দায়িত্ব গ্রহণ করো। কিন্তু, আমি, চুল এবং দাড়ি কর্তন করে এবং পীত বস্ত্র পরিধান করে, গৃহ ছেড়ে গৃহহীন, অনিকেত হব।

৪. সুতরাং, ভ্রাতৃবৃন্দ, নৃপতি বজ্রচক্র, জ্যেষ্ঠপুত্রকে নিয়মানুগভাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠান করিয়ে তাঁর চুল ও দাড়ি কর্তন করে, গৃহত্যাগ করলেন। কিন্তু রাজর্ষি বজ্রচক্রের গৃহত্যাগের সাত দিনের মাথায় রাজ্য থেকে ধর্মচক্র হারিয়ে গেল।

তখন একজন নতুন রাজার কাছে গিয়ে বললেন, ‘মহারাজা, সত্যের খাতিরে জেনে নিন যে ধর্মচক্র হারিয়ে গেছে!’

তখন সেই রাজা, ভ্রাতৃবৃন্দ, শোকে ও দুঃখে কাতর হয়ে পড়লেন। এবং তিনি তখন রাজর্ষির কাছে গিয়ে বললেন, ‘মহাত্মন, সত্যের খাতিরে জেনে নিন যে ধর্মচক্র রাজ্য থেকে হারিয়ে গেছে। এবং নব অভিষিক্ত রাজা যেই না এটা বললেন, অমনি রাজর্ষি বললেন, “প্রিয় পুত্র, ধর্মচক্র হারিয়ে গেছে বলে শোক করো না! কারণ ধর্মচক্র কোনো পিতৃসূত্রে প্রাপ্তব্য সম্পত্তি নয়। কিন্তু, প্রিয় পুত্র, তুমি যদি নিজেকে আর্য অষ্টাঙ্গ মার্গের পথে পরিচালিত করো (পৃথিবীর সত্যকারের সার্বভৌমদের দ্বারা নির্ধারিত আদর্শ কর্তব্যের মহান পথে নিজেকে চালিত করো), তবে তুমি এই ধর্মচক্র চালনাকারী নৃপতির আর্য দায়িত্ব পালন করতে পারবে এবং চরাচর আপ্লুত করা চন্দ্রালোকের রাতে, স্নাত মস্তকে তুমি চাইবে চক্রের উপরিভাগের সোপানে দাঁড়িয়ে সেই পূর্ণিমাকে উদযাপন করতে আর মহান এই ধর্মচক্র তখন তার চাকার হাজারটি নাট- বল্টু, নাভি বা কেন্দ্রবিন্দু এবং যাবতীয় অংশ সহ সুসমন্বিত রূপে দেখা দিবে।’

৫. ‘মহাত্মন, তাহলে ধর্মচক্র টানা নৃপতির আর্য দায়িত্ব কি?’

‘প্রিয় পুত্র, সেই দায়িত্ব হলো সত্য এবং ন্যায়পরতার প্রথার বশবর্তী হয়ে চক্রকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা এবং উপাসনা করা, তাকে নৈবেদ্য অর্পণ করা, সবকিছু পবিত্র করা, রাজা হিসেবে নিজেই ধর্ম বা আদর্শের শিরোনাম হয়ে ওঠা, আদর্শের চিহ্নায়ক হয়ে ওঠা, আদর্শকে প্রভু হিসেবে মেনে চলা, নিজ প্রজামণ্ডলী, সেনাবাহিনী, অভিজাতবর্গ, সামন্তশ্রেণি, ব্রাহ্মণ এবং গৃহপতি, নগর ও গ্রামবাসী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ, পশু ও পাখির জন্য সম্যক দৃষ্টি, অভিভাবকত্ব এবং নিরাপত্তা প্রদান করা। তোমার রাজত্ব জুড়ে কোনো অন্যায় কর্মকে অধিষ্ঠান হতে দেবে না। এবং তোমার রাজত্বে যে দরিদ্র, তাকে সম্পদ দিও।’

‘এবং প্রিয় পুত্র, তোমার রাজত্বে ধর্মীয় জীবন পালনকারী মানুষেরা, ইন্দ্রিয়সমূহের আসবমত্ততা থেকে উদ্ভুত সব অসতর্কতা বা প্রমাদ পরিত্যাগ করে, সহনশীলতা এবং সহানুভূতির প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে, প্রত্যেকে তার নিজ আত্মসত্তার উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে, প্রত্যেকেই তাঁর আত্মসত্তার দাবি করে, আত্মসত্তার নিরাপত্তা বিধান করে, তোমার কাছে সময় থেকে সময়ে আসবে এবং কি ভাল আর কি মন্দ সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করবে, প্রশ্ন করবে কোন কাজ অপরাধমূলক এবং অপরাধমূলক নয় সে বিষয়ে, কী করা উচিত এবং কী না করেই রেখে দেওয়া উচিত, কাজের কোন ধারা বা পদ্ধতি অবলম্বন করলে সেটা দীর্ঘমেয়াদে শুভ বা অশুভ বয়ে আনবে, তোমার শোনা উচিত যে তাদের কী বলার আছে এবং তোমার উচিত হবে তাদের সব মন্দ বা অশুভ থেকে রক্ষা করা এবং তাদের শুভর পথ গ্রহণ করতে বলা।

প্রিয় পুত্র, এটাই সসাগরা পৃথিবীর সার্বভৌম নৃপতির আর্য দায়িত্ব হওয়া উচিত।

‘অবশ্যই, মহাত্মন,’ নব অভিষিক্ত রাজা উত্তর করলেন এবং পিতৃবাক্য শিরোধার্য করে সার্বভৌম নৃপতির আর্য দায়িত্ব পালন করলেন।

এভাবেই, ধর্ম ও শীলের পথে থেকে, পূর্ণ চাঁদের আলোয় নব্যাভিষিক্ত রাজা স্নাত মস্তকে প্রাসাদের সোপান শ্রেণিতে দাঁড়িয়ে দেখেন যে ধর্মচক্র ঝকঝক করছে, তার হাজারটি নাট-বল্টু, চাকা, নাভি বা কেন্দ্রবিন্দু সহ পুরো চক্রটিই সম্পূর্ণ। এবং চক্রটি দেখার পর রাজার মনে হলো: ‘আমাকে বলা হয়েছে যে যিনি এমন ধর্মচক্র দেখতে পান, তিনি নিজেই চক্র-সঞ্চালক নৃপতি হয়ে ওঠেন। আমিও কি তবে পৃথিবীর সার্বভৌম শাসক হতে পারব।’

৬. হে ভিক্ষু ভ্রাতৃবৃন্দ, তখন নৃপতি সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁর এক কাঁধ থেকে গেরুয়া উত্তরীয় খুলে নিয়ে বাঁ হাতে একটি কলস থেকে ডানহাতে জল নিয়ে সেই মহাজাগতিক চক্রের উপর ছিটালেন এবং বললেন : ‘সম্মুখে ঘূর্ণন করো, হে মহাচক্র! সম্মুখে যাও এবং জয় করো, হে মহাচক্র!” তখন, প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, সেই মহাজাগতিক চক্র সোজা সম্মুখ বরাবর পূর্বদিকে চলতে শুরু করলো এবং তারপর চক্র চললো চক্র-সঞ্চালক নৃপতির দিকে এবং নৃপতির সাথে সাথে তাঁর সেনাবাহিনী, অশ্বদল, রথসমূহ, হস্তীবাহিনী এবং পুরুষদের দিকে। এবং যে যে এলাকায়, প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, এই চক্র থামলো, সেইসব জায়গায় এই চক্র নৃপতি, যুদ্ধজয়ী সেনাপতি ও তাঁদের চতুর্গুণ সেনাবাহিনীসহ সবাইকে নিয়ে চলতে শুরু করলেন। এভাবে পূর্বাঞ্চলের সব প্রতিদ্বন্দ্বী রাজারা সেই সসাগরা পৃথিবীর সার্বভৌম অধিপতির কাছে এলেন এবং বললেন, ‘আসুন, হে মহান শক্তিমান নৃপতি! স্বাগতম আপনাকে হে পরম প্রতাপধর! আমাদের সবকিছুই আপনার, আমাদের শিক্ষা দান করুন, হে মহান নৃপতি!’

তখন নৃপতি ও সার্বভৌম সেনাপতি উত্তরে বললেন, “তোমরা কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা করবে না। যা তোমাদের দেওয়া হয়নি তা কখনো গ্রহণ করবে না। দৈহিক বাসনা সংক্রান্ত কোনো ভুল বা অন্যায় কাজ তোমরা করবে না। তোমরা কোনো মিথ্যা কথা বলবে না। উন্মত্ত করে তোলে এমন কোনো পানীয় তোমরা পান করবে না। তোমাদের সব সম্পত্তি তোমরা পরিমিত ভাবে ভোগ করবে।’

৭. তখন, প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, সেই মহাজাগতিক চক্র পূর্বের মহাসাগরে ডুবে যেতে যেতে আবার ভেসে উঠলো এবং দক্ষিণাঞ্চলের দিকে গড়াতে শুরু করলো এবং একইভাবে সেই মহাজাগতিক চক্র দক্ষিণের মহাসাগরে ডুবে, আবার ভেসে উঠলো এবং পশ্চিমের দিকে গড়াতে শুরু করলো…এবং সেখান থেকে উত্তরে যেতে শুরু করলো: এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে যেমন যেমন ঘটেছে, তেমনটা উত্তরেও ঘটলো।

অতঃপর যখন মহাজাগতিক চক্র সমগ্র পৃথিবী জয় করে আরো সামনে অগ্রসর হয়ে সমুদ্র সীমার কাছে পৌঁছে সসাগরা পৃথিবীর অধিপতির রাজধানী নগরে প্রত্যাবর্তন করলো এবং দাঁড়ালো যেন সবাই চক্র স্থির হয়েছে বলে মনে করে; চক্র তখন রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে ঢোকার মুখে বিচার কক্ষের সামনে স্থাণু হয়ে থাকলো আর সাথে সাথে চক্রের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো রাজপ্রাসাদের অন্দর মহল এবং পৃথিবীর সার্বভৌম অধিপতি।

৮. এবং দ্বিতীয় নৃপতি, প্রিয় ভ্রাতাবৃন্দ, তিনি ও চক্র-ঘোরানো নৃপতি…এবং তৃতীয়…এবং চতুর্থ…এবং পঞ্চম…এবং ষষ্ঠ…এবং সপ্তম নৃপতি, এক রণবিজয়ী সেনাপতি, বহু বছর পরে, বহু শতাব্দী পরে, বহু সহস্র বছর পরে, একজন নির্দিষ্ট মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেন :

‘যদি তুমি দেখতে পাও যে মহাজাগতিক চক্র ডুবে গেছে বা তার স্থান থেকে এতটুকু বিচ্যূত হয়েছে, তবে আমাকে জানাবে।’

‘অবশ্যই মহাত্মন,’ তিনি উত্তর করলেন।

এরপর আরো অনেক বছর পর, বহু শতাব্দী পর, বহু সহস্র বছর পর, সেই দূত দেখতে পেল যে মহাজাগতিক চক্র ডুবে গেছে এবং তার স্থান থেকে খানিকটা চ্যূত হয়েছে। মহাজাগতিক চক্রের এই অবস্থা থেকে তিনি নৃপতি ও রণজয়ী সেনাপতির কাছে গিয়ে মহাজাগতিক কালচক্রের অবস্থা বললেন।

এরপর সেই নৃপতি (তাঁর পিতা বজ্রচক্রের মতই) রাজত্ব ত্যাগ করলেন।

রাজর্ষি রাজত্ব ত্যাগের সাত দিন পর সেই মহাজাগতিক চক্র নিরুদ্দেশ হলো।

তারপর এক দূত নৃপতির কাছে গেলেন। মহাজাগতিক চক্র হারিয়ে গেছে শুনে রাজা শোকে-দুঃখে কাতর হয়ে পড়লেন। কিন্তু তিনি রাজর্ষির কাছে গিয়ে এক সার্বভৌম, রণজয়ী নৃপতির আর্য-দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলেন না। উল্টো তিনি তাঁর নানা ভাবনা, ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বললেন এবং বললেন যে, এসব ভাবনা এবং ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েই তিনি তাঁর জনগণকে পরিচালনা করতেন; রাজর্ষি চলে যাবার পর রাজ্যে আর সমৃদ্ধি নেই যেটা প্রজারা রাজর্ষির শাসনে আর্য দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করতো।

অতঃপর, ভ্রাতৃবৃন্দ, মন্ত্রী এবং পারিষদবর্গ, কোষাগারের কার্যনির্বাহীরা, রক্ষী এবং দ্বাররক্ষীরা যারাই পবিত্র মন্ত্রের অনুসারী হয়ে জীবন কাটাতো, তারা নৃপতির কাছে এসে বললো:

‘আপনার জনতা, হে নৃপতি, আপনি যখন আপনার জনগণকে আপনার ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী শাসন করেন যা কিনা অতীতের শাসকদের আর্য দায়িত্ব অনুযায়ী পরিচালনা করার পন্থা থেকে ভিন্নতর, তখন দেশে সমৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এখন আপনার রাজ্যে রয়েছেন মন্ত্রী এবং অমাত্যবৃন্দ, রক্ষী এবং প্রহরীরা এবং যারাই পবিত্র মন্ত্রের নির্দেশে জীবন কাটায়— তারা এবং আমরা সবাই যাদের প্রত্যেকেই সার্বভৌম নৃপতির আর্য দায়িত্বের জ্ঞানধারণকারী। আপনি আমাদের আর্য দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন : আপনি আমাদের প্রশ্ন করলে আমরা উত্তর ঘোষণা করব।’

৯. তারপর, হে ভ্রাতৃবৃন্দ, নৃপতি তখন তাঁর সব মন্ত্রীকে পাশে বসালেন এবং তাদের বললেন সার্বভৌম রণপ্রভুর কর্তব্য কী। মন্ত্রীবর্গ তাঁকে সেটা জানালেন। এবং তিনি শুনতে পেলেন যে মন্ত্রীবর্গ তাঁকে জানাচ্ছেন যে যদিও তিনি রাজ্যে প্রহরার নিশ্চিত সুরক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু দরিদ্র ও নিঃসহায়দের তিনি কোনো সম্পদ দেননি এবং যেহেতু তিনি দরিদ্রদের সম্পদের ভাগ দেননি, সেহেতু দারিদ্র্য বিস্তার লাভ করেছে। এভাবে দারিদ্র্য যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো, তখন স্বভাবতই যে অসহায়কে কেউ কিছু দেয়নি, সে অন্যদের কাছ থেকে তার প্রাপ্য ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলো, আর একেই ‘চুরি’ বলা হলো। তখন সেই চোরকে ধরে (অতীতের) নৃপতির কাছে আনা হলো এবং বলা হলো, ‘হে নৃপতি! এই লোকটিকে যা দেওয়া হয়নি তা’ সে নিয়েছে এবং একেই বলা হয় চুরি।’

তখন নৃপতি সেই লোকটিকে বললেন, ‘এটা কি সত্য যে তোমাকে যা দেওয়া হয়নি, তা’ তুমি নিয়েছো এবং একেই সবাই ‘চুরি’ বলছে?!’

‘হ্যাঁ, একথা সত্য।’

‘কিন্তু কেন তুমি এমনটা করলে?’

‘হে নৃপতি, আমার নিজেকে বাঁচানোর মতো কিছুই নেই।’ তখন (অতীতের) নৃপতি সেই ব্যক্তিকে সম্পদ দান করলেন এবং বললেন, ‘এই অর্থ দিয়ে হে মহাত্মন, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করুন, আপনার পিতা- মাতা, সন্তান এবং স্ত্রীর জীবন অতিবাহিত করতে সাহায্য করুন, আপনার পেশার সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন।’

‘এই সম্পদ আমার জন্য পর্যাপ্ত,’ সেই ব্যক্তি উত্তর করলেন।

১০. এখন আর একজন ব্যক্তি, প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, চুরি করে একটি বস্তু নিল যা তাকে দেওয়া হয়নি। সেই চোরকে ধরা হলো এবং রাজার সামনে এনে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘হে নৃপতি, এই লোক চুরি করে এমন একটি জিনিস নিয়েছে যা তাকে দেওয়া হয়নি।’

এবং নৃপতি তখন তাকে সেসব কথা বললেন যা আগের মানুষটির সাথেও করেছেন এবং তাঁকে কিছু সম্পদ দিলেন।

১১. এরপর আরো একজন ব্যক্তি চুরি করলো। তাকে যখন ধরে রাজার সামনে আনা হলো, রাজা তাকেও জিজ্ঞাসা করল যে, কেন সে চুরি করেছে। ‘কারণ, হে নৃপতি! আমি নিজের ভরণ-পোষণে সক্ষম নই।’ তখন রাজা ভাবলেন : ‘আমি যদি তাকে সম্পদ দিই যা তাকে আগে কেউ দেয়নি, তবে এভাবে চুরির সংখ্যা বেড়েই চলবে। আমাকে এখন এই প্রক্রিয়ায় ইতি টানতে হবে এবং বরঞ্চ এই চোরকে শাস্তি দেয়া যাক, তার মাথা কাটা হোক!’

রাজা তখন তাঁর সৈন্য-কোতোয়ালদের বললেন, ‘শোন সবাই! এই লোকটির হাত দড়ি দিয়ে শক্ত করে পিছমোড়া বাঁধো, তার মাথা ন্যাড়া করে দাও এবং তাকে ঢোলের শব্দের সাথে সাথে পথে পথে ঘোরাও, ঘোরাও পথের বাঁক থেকে বাঁকে, তাকে দক্ষিণ দুয়ারে নিয়ে নগরীর দক্ষিণে নিয়ে যাও, তারপর এই প্রক্রিয়ার যতিচিহ্ন টানো, তাকে চূড়ান্ত শাস্তি দাও, তার মস্তক কর্তন করো।’

“তথাস্তু, হে নৃপতি!’ রাজার সৈন্য-সামন্ত নৃপতির আদেশ পালন করলেন।

১২. তখন, হে প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, মানুষ যখন শুনলো যে সম্পদ বঞ্চিত কেউ চুরির অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে, তখন তারা তীক্ষ্ণ তরবারি হাতে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করলো। তারা ভাবলো যে ‘আমাদের যা দেয়া হয়নি সেটা নেবার জন্য যদি আমাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়— তবে এই প্রক্রিয়ায় একটি যতি-চিহ্ন টানা দরকার- আমাদের অধিকার যারা অগ্রাহ্য করে, তাদের চূড়ান্ত শাস্তি দিতে হবে, তাদের মস্তক কর্তন করা দরকার।’

তখন সেই বিক্ষুব্ধ প্রজারা তীক্ষ তরবারী হাতে গ্রামকে গ্রাম এবং শহরকে শহর লুট করা শুরু করলো এবং বড় সড়কগুলোয় ডাকাতি করা শুরু করলো। এবং যাদের সম্পদ তারা ডাকাতি করে লুণ্ঠন করলো, তাদের মাথাও কেটে নিল।

১৩. এভাবেই, ভ্রাতৃবৃন্দ, দরিদ্রদের যে সম্পদ দেয়া হয়নি সেই সম্পদহীনতা তাদের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছড়ালো, দারিদ্র্য থেকে সমাজে প্রথমে চুরি ও পরে ডাকাতি সহ অন্য নানা সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লো এবং সহিংসতা থেকে জীবনহানি শুরু হলো, সমাজে খুনের হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের আয়ু কমে এলো, কমে এলো জীবনের সার্বিক শান্তি ও স্থৈর্য্য।

প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, এরপর থেকে কেউ চুরির দায়ে ধরা পড়তে শুরু করলেও তাকে রাজার সামনে নেয়া হলে সে চুরির কথা অতীতের মতো সততার সাথে স্বীকার করতো না।

‘না— হে রাজন, ওরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলছে।’

১৪. এভাবেই দরিদ্রকে সম্পদ না দেওয়ায় অভাব বাড়তে থাকলো…বাড়তে থাকে চুরি, সন্ত্রাস, খুন যতদিন না মিথ্যা কথা বলা সর্বসাধারণ্যে প্রচলিত হয়ে উঠল।

এরপর আবার এক লোক রাজার কাছে নালিশ করলেন যে, অমুক অমুক এক ব্যক্তি— হে নৃপতি! চুরি করে এমন দ্রব্যাদি নিয়েছে যা তাকে দেওয়া হয়নি’- আর এভাবে তার নামে মন্দ কথা বলতে থাকলেন।

১৫. এবং এভাবেই, প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, দরিদ্র ও নিঃসহায়কে সম্পদের ভাগ না দেওয়ায় দারিদ্র্য বিষম আকার ধারণ করতে থাকে…বাড়তে থাকে চুরি, সন্ত্রাস, খুন, মিথ্যে কথা বলা…মন্দ কথার পরিমাণও সমাজে বাড়তে থাকে।

১৬. মিথ্যা কথা থেকে বাড়লো ব্যভিচার বা পরকীয়া অনৈতিকতা।

১৭. এভাবেই দরিদ্র ও নিঃসহায়কে সম্পদের ভাগ না দেওয়ায় দারিদ্র্য বিষম আকার ধারণ করতে থাকে…বাড়তে থাকে চুরি, সন্ত্রাস, খুন, মিথ্যে কথা বলা…মন্দ কথা…অনৈতিকতা বিষম আকার ধারণ করে।

১৮. প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, এই যাবতীয় মন্দত্বের ভেতর তিনটি জিনিস প্রবল আকারে বাড়তে থাকে; আর সেই তিনটি মন্দ বিষয় হলো অজাচার, উচ্ছৃঙ্খল লোভ ও বিকৃত কামনা।

এরপর বাড়তে থাকে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের সন্তানোচিতো আনুগত্য, পবিত্র সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের প্রতি সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আনুগত্য বোধ এবং গোত্রপিতার প্রতি শ্রদ্ধার অভাব।

১৯. এরপর এমন এক সময় আসবে, ভ্রাতাবৃন্দ, যে আজকের মানুষের উত্তর পুরুষদের মাত্র দশ বছরের আয়ু হবে। তাদের ভেতর মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মেয়েরা বিবাহযোগ্যা হবে। এরা নিচের খাদ্যদ্রব্যগুলো সঠিকভাবে আস্বাদন করতে পারবে না: ঘি, মাখন, তিলের তেল, লবণ ও চিনি। এদের ভেতর কুদ্রসার দানাই সেরা শস্য হিসেবে বিবেচিত হবে। আজ যেমন ভাত ও তরকারিই আমাদের কাছে সেরা খাবার হিসেবে বিবেচিত, ভবিষ্যতের সেই মন্দ সময়ে কুদ্রসার দানাই হবে সেরা খাবার। এমন মানুষদের ভেতর দশ প্রকারের নৈতিক আচরণ পুরোপুরি ভাবে হারিয়ে যাবে; বদলে দশ ধরনের অনৈতিক আচরণ তাদের ভেতর প্রবলভাবে বেড়ে যাবে, এদের ভেতর নৈতিকতা বলে কিছু থাকবে না— নৈতিকতার দূত তাদের ভেতর একজনও রইবে না।

এমন মানুষদের ভেতর, ভ্রাতৃবৃন্দ, যারা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি আনুগত্য এবং ধর্মীয় আনুগত্য ধারণ করে না এবং গোত্রপতির প্রতি যার বা যাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই— তখন তাদের প্রতিই শ্রদ্ধা ও সম্মান বর্ষিত হবে যেমন বর্তমানে আমরা অনুগত, ধার্মিক ও গোত্রপতিকে সম্মান করা মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বর্ষণ করি।

২০. এমন মানুষদের ভেতর, হে প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, মা, মাসী, মায়ের বৌদি বা ননদ, শিক্ষকের স্ত্রী, বাবার শ্যালিকা বা বৌদি বা সোজা কথায় যেসব শ্রদ্ধার সম্পর্কের কারণে আন্তর্বিবাহ বিঘ্নিত হয়, তেমন শ্রদ্ধাবোধ বলতে কিছু থাকবে না। পৃথিবী ভরে উঠবে অশালীনতায়, ছাগল ও ভেড়ার মতো, শূকর ও পাখির মতো, শেয়াল ও কুকুরের মতো মানুষ যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো নিষিদ্ধ সম্পর্ক মানবে না। এমন মানুষদের ভেতর, প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, তীক্ষ্ণ পারস্পরিক বৈরীতাই হবে আইন, দেখা দেবে তীব্র মন্দ ইচ্ছা, প্রবল শত্রুতা, এমনকি সন্তানের প্রতি মায়ের, পিতার প্রতি সন্তানের, ভ্রাতার প্রতি ভ্রাতার, ভগ্নীর প্রতি ভ্রাতার, ভ্রাতার প্রতি ভগ্নীর খুন করার মতো ভয়ানক ইচ্ছাও দেখা দেবে।

যেভাবে একজন ক্রীড়াবিদ খেলা দেখার সময় খেলার প্রতি যেমন আবেগ বোধ করে, এই মানুষেরাও তেমন নানা মন্দ বস্তুর প্রতি আকর্ষিত হবে।

সমাজে নৈতিক শক্তির যখন পতন হয় এবং পাশব, নিষ্ঠুর শক্তি যখন প্রবল হয়ে ওঠে, সেই সমাজের এটাই নিখুঁততম চিত্র। বুদ্ধ যা চেয়েছিলেন তা’ হলো প্রতিটি ব্যক্তির নৈতিক ভাবে এতটাই প্রশিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন যেন সে নিজেই ন্যায়পরতার রাজ্যের প্রহরী হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *