পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট

ড. বি. আর. আম্বেদকর : জীবন ও কর্ম

এমএ, পিএইচডি, ডিএসসি, এলএলডি
ডি.লিট, বার-অ্যাট-ল
(১৪ এপ্রিল ১৮৯১-৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬)

ভিমরাও রামজি আম্বেদকার (১৪ এপ্রিল ১৮৯১–৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬) ছিলেন এক ভারতীয় আইন বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক ও রাজনৈতিক নেতা যিনি ভারতের ‘সংবিধান রচনা কমিটি’র প্রধান ছিলেন, জওয়াহেরলাল নেহরুর প্রথম মন্ত্রীসভায় আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ‘দলিত বৌদ্ধ আন্দোলন’ গড়ে তোলার কাজ করেন।

ইউনিভার্সিটি অফ বম্বের এলফিনস্টোন কলেজ থেকে সম্মান সহ পড়াশোনা শেষ করে তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে অর্থনীতিতে অধ্যয়ণ করেন। ১৯২৩ ও ১৯২৭ সাল নাগাদ উপরোক্ত দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি দু’টো পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও ‘গ্রেজ ইন’-এ তিনি আইনে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তী জীবনে তিনি রাজনৈতিক নানা কাজ-কর্মে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে নানা প্রচারাভিযানে অংশ নেয়া ছাড়াও পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করা, ভারতের দলিত শ্রেণির জন্য রাজনৈতিক অধিকার ও সামাজিক স্বাধীনতার কথা বলা এবং ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা তাঁর জীবনের সেরা যত কাজ। ১৯৫৬ সালে তিনি সাড়ে তিন লাখের মতো দলিত অনুসারী সাথে নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন।

১৯৯০ সালে আম্বেদকার ভারতের বৃহত্তম বেসামরিক পদক ‘ভারতরত্ন অর্জন করেন। তাঁর অনুসারীরা আজও তাঁর নামে ‘জয় ভীম’ জয়ধ্বনি করে।

শুরুর জীবন

১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল আম্বেদকার মধ্যপ্রদেশের মহৌ নামে একটি শহর তথা সামরিক ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তদানীন্তন ব্রিটিশ- ভারতীয় সেনাবাহিনীর সুবেদার রামজি মালোজি সাকপালের চোদ্দতম ও শেষ সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর পরিবার ভাষিক ও জাতিগত পরিচয়ে ছিল মারাঠী ও বর্তমানের মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলার আম্বাদাওয়ি শহর ছিল তাঁদের পরিবারের আদি শহর। ‘মাহার’ নামের এক দলিত গোত্রে জন্ম হওয়ায় তাঁদের ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং তাঁরা প্রায়ই নানা সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হতেন। আম্বেদকারকে স্কুলে ভর্তি করা হলেও তিনি ও তাঁর মতো অপর দলিত শিশুদের শ্রেণিকক্ষের ভেতরে বসতে দেওয়া হতো না এবং শিক্ষকরা তাঁদের পাঠের প্রতি খুবই কম মনোযোগ দিতেন। পড়ার ফাঁকে পিপাসা পেলে উচ্চবর্ণের কাউকে এই ‘দলিত’ শিশুদের মুঠো করা হাতের আঁজলায় অনেক উপর থেকে পানি ঢেলে দিতে হতো যাতে ‘পানি’ বা ‘পানি রাখার পাত্র’ কোনটাই দূষিত না হয়! সাধারণত স্কুলের পিওনের সহায়তায় আম্বেদকারই সবার (দলিত শিশুদের) জন্য পানি ঢালার কাজটি করতেন। যেদিন পিওন অনুপস্থিত থাকতো, সেদিন তাঁকে পানি ছাড়াই থাকতে হতো যা পরবর্তী জীবনে ‘পিওন নেই, পানি নেই’ বা ‘নো পিওন, নো ওয়াটার’ শিরোনামে একটি লেখায় তিনি জানান। শ্রেণিকক্ষের বাইরে বাসা থেকে বয়ে আনা এক চটের বস্তার উপর বসে তাঁকে ক্লাস করতে হতো।

আম্বেদকারের পিতা রামজি সাকপাল ১৮৯৪ সালে অবসর গ্রহণের দু’বছর পর সপরিবারে সাতারা শহরে চলে যান। এর পরপরই আম্বেদকারের মা মারা যান। আম্বেদকার ও তাঁর ভাই-বোনদের তখন তাঁর বাবার বোন দেখা-শোনা শুরু করেন এবং মাতৃহীন চোদ্দটি শিশুর ভেতর শুধুমাত্র বলরাম, আনন্দরাও ও ভিমরাও এবং দুই বোন মঞ্জুলা ও তুলসা বেঁচে থাকেন। ভাই- বোনদের ভেতর, একমাত্র আম্বেদকার প্রাথমিক বিদ্যালয় সমাপ্ত করে হাই স্কুল বা উচ্চ বিদ্যালয়ে যান। হাই স্কুলে ভর্তির সময় তাঁর বাবা তাঁর পদবি ‘সাকপাল’ বদলে দিয়ে ‘আম্বাদাওয়েকার’ করে দেন যাতে তিনি ঠিক কোন্ গ্রাম থেকে এসেছেন সেটা বোঝা যায়। তবে তাঁর মারাঠি ব্রাহ্মণ শিক্ষক কেশব আম্বেদকার তাঁর নিজের পদবিতে ‘আম্বাদাওয়েকার’ পদবিটি ‘আম্বেদকার’ করে দেন।

উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা

১৮৯৭ সালে, আম্বেদকারের পরিবার মুম্বাই চলে যান যেখানে এলফিনস্টোন হাই স্কুলে একমাত্র অস্পৃশ্য ছাত্র হিসেবে তিনি ভর্তি হন। ১৯০৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে রামা বাঈ নামে এক নয় বছর বয়সী বালিকার সাথে তাঁর বিয়ে হয়।

ইউনিভার্সিটি অফ বম্বে-তে অধ্যয়ন

১৯০৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করার পর তিনি এলফিনস্টোন কলেজে ভর্তি হন এবং এই কলেজ ‘ইউনিভার্সিটি অফ বম্বে’-র সাথে সংযুক্ত ছিল। মাহার সম্প্রদায় থেকে তিনিই প্রথম এই কৃতিত্বের দাবিদার। ইংরেজিতে চতুর্থ শ্রেণি পাশের পরই তাঁর সম্প্রদায় তাঁর জন্য এক সম্বৰ্ধনা আয়োজন করেছিল যা ‘অন্য সম্প্রদায়গুলোতে শিক্ষার হারের তুলনায় বলতে গেলে কিছুই ছিল না’ বলে পরে তিনি কোন এক রচনায় স্মরণ করেন। তবে এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানেই তাঁকে দাদা কেলুষ্কার নামে এক লেখক স্ব-রচিত গ্রন্থ ‘বুদ্ধ’ উপহার দেন।

১৯১২ সালে ‘বম্বে ইউনিভার্সিটি’ থেকে আম্বেদকার অর্থনীতি ও রাজনীতি বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং বরোদা রাজ্য সরকারে চাকরি পান।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন

১৯১৩ সালে, মাত্র ২২ বছর বয়সে, আম্বেদকার পরবর্তী তিন বছরের জন্য মাসে ১১.৫০ স্টার্লিং সমমূল্যের ‘বরোদা স্টেট স্কলারশিপ’ পান। এই বৃত্তি প্রকল্পটি তৃতীয় সায়াজিরাও গায়কোওয়াড় (বরোদার গায়কোওয়াড়) নামে এক ধনাঢ্য শিক্ষাব্রতী চালু করেছিলেন যাতে করে তাঁর এলাকার মেধাবী ছাত্ররা নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-গ্রাজ্যুয়েশন স্তরে শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়।

আমেরিকা পৌঁছে নাভাল ভাথেনা নামে এক পার্সি যুবকের সাথে লিভিংস্টোন হলের একটি কক্ষে একসাথে থাকা শুরু করেন। এই পার্সি যুবক পরে তাঁর বাকি জীবনের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। ১৯১৫ সালের জুন মাসে অর্থনীতিতে মেজরসহ এমএ. পাস করেন এবং তাঁকে সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন এবং নৃ-তত্ত্বও পড়তে হয়েছিল। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল ‘প্রাচীন ভারতের বাণিজ্য।’ জন ডিউয়ি এবং তাঁর গণতন্ত্র বিষয়ক কাজ দ্বারাও এসময় তিনি প্রভাবিত হন।

১৯১৬ সালে তিনি ‘ভারতের জাতীয় লভ্যাংশ- একটি ঐতিহাসিক ও বিশ্লেষণী গবেষণা’ বা দ্বিতীয় মাস্টার্স থিসিস উপস্থাপনার পর দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছরের ৯ই মে তিনি বিখ্যাত নৃ-তাত্ত্বিক আলেক্সান্ডার গোল্ডেনওয়েইসারের উপস্থিতিতে একটি সেমিনারে ‘কাস্টস ইন ইন্ডিয়া: দেয়ার মেকানিজম, জেনেসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি গবেষণা পত্র উপস্থাপন করেন। ১৯২৭ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএই-ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে অধ্যয়ন

১৯১৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি গ্রেজ ইন-এ একটি বার অধ্যয়ন কোর্সে ভর্তি হন এবং একইসাথে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স-এ তাঁর ডক্টরাল থিসিস রচনায় ব্রতী হন। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল ‘দ্য প্রব্লেম অফ দ্য রুপি: ইটস অরিজিন অ্যান্ড ইটস সল্যুশন। ১৯১৭ সালের জুন মাসে বরোদা সরকার প্রদত্ত বৃত্তি শেষ হয়ে আসায় তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৯২৩ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে অর্থনীতিতে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

অস্পৃশ্যতার সাথে লড়াই

যেহেতু ‘প্রিন্সলি স্টেট অফ বরোদা’-র সূত্রে আম্বেদকার বিদেশে বৃত্তি পেয়েছিলেন, কাজেই ফিরে এসে কিছুদিন তাঁকে এখানে কাজ করতে হয়। গায়কোওয়াড়ের সামরিক সচিব নিযুক্ত হলেও নানা কারণে তাঁকে দ্রুতই এই কাজ ছেড়ে দিতে হয়। এরপর প্রথমা স্ত্রী ও তাঁর সন্তানদের জন্য কখনো প্রাইভেট টিউটর, হিসাবরক্ষক সহ নানা কাজের মাধ্যমে তিনি সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। একটি ‘ইনভেস্টমেন্ট কনসাল্টিং বিজনেস’ প্রতিষ্ঠার পরও এই ব্যবসা চালাতে ব্যর্থ হন। কারণ তাঁর গ্রাহকেরা জেনে গেছিলেন যে তিনি একজন ‘অস্পৃশ্য। ১৯১৮ সালে তিনি মুম্বাইয়ের ‘সিডেনহ্যাম কলেজ অফ কমার্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স’-এ অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হলেও, তাঁর সতীর্থ অধ্যাপকেরা তাঁর সাথে একই পানির জগ থেকে পানি পানে অস্বীকৃতি জানান।

১৯১৯ সালের ‘দ্য গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ প্রস্তুত করার সময় তাঁকে সাউথবরো কমিটির সামনে স্বাক্ষ্য দিতে ডাকা হয় এবং এখানে তিনি অস্পৃশ্য ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনি ব্যবস্থা ও সংরক্ষণের দাবি তোলেন। ১৯২০ সালে তিনি ‘মূকনায়ক (লিডার অব দ্য সাইলেন্ট)’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন।

১৯২৬ সালে আম্বেদকার একজন আইনজীবী হিসেবে তিনজন অ-ব্রাহ্মণ নেতার পক্ষ নিয়ে লড়াই করেন যারা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে ‘ভারত ধ্বংসে’র জন্য অভিযুক্ত করেন এবং এই লড়াইয়ে আম্বেদকার জয়ী হন।

বম্বে হাইকোর্টে আইন প্র্যাক্টিস করার সময় তিনি অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ে শিক্ষা বিস্তারে মনোযোগী হন। অস্পৃশ্যদের মাঝে শিক্ষা ও সামাজিক- অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তিনি ‘বহিষ্কৃত হিতাকাঙ্ক্ষী সভা’ গঠন করেন। দলিত অধিকারের সুরক্ষায় ‘মূকনায়কে’র পাশাপাশি তিনি ‘বহিষ্কৃত ভারত’ বা ‘ইক্যুয়ালিটি জানতা’ নামে পত্রিকাও চালু করেন।

১৯২৫ সালে বম্বে প্রেসিডেন্সি কমিটি কর্তৃক ‘অল-ইউরোপিয়ান সাইমন কমিশনে’র সাথে কাজের জন্য তিনি নিযুক্ত হন। ১৯২৭ সালে আম্বেদকার অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন সূচনা করেন। জনপরিসরে সবার জন্য পানি পানের সমতা চেয়ে তিনি বিশালায়তন আন্দোলন গড়ে তোলেন। হিন্দু মন্দিরগুলোয় প্রবেশের জন্যও আন্দোলন শুরু করেন। মাহাদ শহরে অস্পৃশ্যরা যেন শহরের মূল পানির ট্যাঙ্ক থেকে পানি তুলতে পারে, সেই লক্ষ্যে সত্যাগ্রহ সূচনা করেন। ১৯২৭ সালে আম্বেদকার প্রকাশ্যে ধ্রুপদী হিন্দু আইন গ্রন্থ ‘মনুস্মৃতি’র নিন্দা করেন যেহেতু এই গ্রন্থে জাতিভেদ ও ‘অস্পৃশ্যতা’কে আইনগত মান্যতা দেওয়া হয় এবং তিনি প্রকাশ্যে গ্রন্থটি পোড়ান। ১৯২৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর আম্বেদকার হাজার হাজার অনুসারী সহ মনুস্মৃতি দাহ করেন এবং সেই থেকে এই দিনটিকে ‘মনুস্মৃতি দহন দিন’ বলে আজও উদ্‌যাপন করা হয়।

১৯৩০ সালে আম্বেদকার ‘কলারাম মন্দির আন্দোলন’ সূচনা করেন। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার তিন মাসের মাথায় ১৫,০০০ স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে প্রথম দেবতার মুখ দেখার আশায় মন্দির অভিমুখে পদযাত্রা করে। অসংখ্য নর- নারী খুবই সুশৃঙ্খলভাবে পদযাত্রা করে মন্দিরের সামনে পৌঁছানোর পর ব্রাহ্মণ কর্তৃপক্ষ মন্দিরের দ্বার বন্ধ করে দেয়।

পুনা প্যাক্ট

১৯৩২ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ‘বঞ্চিত জাতিসমূহের’ জন্য একটি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করার কথা ঘোষণা করেন। মহাত্মা গান্ধী অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের প্রতিবাদ করেন এবং বলেন যে, এতে করে হিন্দু সম্প্রদায়ে বিভেদ ও অনৈক্যর সৃষ্টি হবে। প্রতিবাদের সূচক হিসেবে গান্ধি পুনার কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনও করেন। অনশনের প্রেক্ষিতে মদন মোহন মালব্য এবং পালওয়াঙ্কর বালু আম্বেদকার ও তাঁর সমর্থকদের সাথে বৈঠক করেন। ১৯৩২ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর আম্বেদকার ও মদন মোহন মালব্য ভেতর ‘পুনা প্যাক্ট’ স্বাক্ষরিত হয় যেখানে আম্বেদকার ‘নিষ্পেষিত’ জাতিসমূহের পক্ষে এবং মদনমোহন মালব্য উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রাদেশিক আইন পরিষদে সর্বজনীন নির্বাচনের আওতাতেই ‘নিষ্পেষিত’ জাতিসমূহের পক্ষে সংরক্ষিত আসন ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই ‘নিষ্পেষিত শ্রেণি’সমূহকেই ‘শিডিউলড কাস্টস অ্যান্ড শিডিউলড ট্রাইবস’ হিসেবে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট ১৯৩৫’-এর আওতায় এবং ১৯৫০ সালের ভারতীয় সংবিধানে ঘোষণা করা হয়।

রাজনৈতিক জীবন

১৯৩৫ সালে আম্বেদকার বম্বের সরকারি আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এসময় আম্বেদকার নিজের বাড়ি নির্মাণ করেন এবং ৫০,০০০ বইয়ের এক ব্যক্তিগত পাঠাগার গড়ে তোলেন। এই বছরই তাঁর প্রথমা স্ত্রী রমাবাঈ দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রয়াত হন। অসুস্থ স্ত্রী মৃত্যুর আগে হিন্দু তীর্থক্ষেত্র পন্দাহারপুরে যাবার অভিলাষ জানালে তিনি বলেন যে, স্ত্রীর জন্য তিনি এক নতুন পন্দাহারপুর গড়ে দেবেন যেখানে কেউ তাঁদের অস্পৃশ্য বলে মন্দ আচরণ করবে না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ১৩ই অক্টোবর তারিখে নাসিকে এক জনভায় তিনি অন্য কোন ধর্মে দীক্ষিত হবার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন এবং তাঁর অনুসারীদেরও ধর্ম বদলের জন্য উদ্দীপ্ত করেন। এরপর বেশকিছু জনসভায় তিনি একই বক্তব্য প্রদান করেন।

১৯৩৬ সালে তিনি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ গঠন করেন এবং কেন্দ্রীয় আইন সংসদে ১৩টি সংরক্ষিত ও চারটি সাধারণ আসনের লড়াইয়ে তাঁর দল ১১টি সংরক্ষিত ও তিনটি সাধারণ আসনে জয়ী হয়।

১৫ই মে ১৯৩৬-এ আম্বেদকার তাঁর বই ‘অ্যানিহিলেশন অফ কাস্টস’ বা ‘জাতিভেদ প্রথার নির্মূল’ রচনা করেন। ইংরেজি সংবাদপত্রে জাতিভেদের বিপক্ষে এবং গুজরাতি পত্র-পত্রিকায় জাতিভেদের পক্ষে লেখার জন্য গান্ধিকে তিনি তিরস্কারও করেন।

ভারতের সংবিধান রচনা

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু আম্বেদকারকে ভারতের আইন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান এবং পনেরো দিনের ভেতর তিনি ভারতের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারপার্সন হিসেবে নির্বাচিত হন।

ভারতীয় সংবিধান ধর্মের স্বাধীনতা, অস্পৃশ্যতা নির্মূলসহ সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে নানা ধারা অন্তর্ভুক্ত করেছে। মেয়েদের জন্য সম অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার কথাও তিনি বলেন।

দ্বিতীয় বিয়ে

প্রথমা স্ত্রী রমাবাঈ দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৩৫ সালে মারা গেলে ভারতীয় সংবিধান রচনার কষ্টসাধ্য সময়ে রাতে অনিদ্রা, পায়ে স্নায়ুজনিত ব্যথাসহ নানা সমস্যায় ভুগলে তাঁকে বম্বেতে এক নারী ডাক্তার শারদা কবিরের কাছে যেতে হয়। এই শারদাই তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী যাকে তিনি ১৯৪৮ সালের ১৫ই এপ্রিল বিয়ে করেন।

বৌদ্ধ ধৰ্ম গ্ৰহণ

ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্ম ভারতের মাটিতে উদ্ভুত নয় বলে আম্বেদকার চাইছিলেন ভারতীয় মৃত্তিকায় উদ্ভুত তবে বর্ণাশ্রম মুক্ত কোন ধর্মে আশ্রয় নিতে। সেই লক্ষ্যে শিখ গুরুদের সাথে কথা বলে তাঁর মনে হয় এই ধর্মেও তাঁকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির শিখ’ হয়ে থাকতে হবে। ১৯৫০ সালে তিনি শ্রীলঙ্কা গিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে পড়াশোনা ও ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন। পুনের কাছে একটি নতুন বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করার পর তিনি জানান যে, বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে তিনি একটি বই লিখছেন এবং বই শেষ করার পর বৌদ্ধ ধর্মে আশ্রয় নেবেন। ১৯৫৬ সালে ‘দ্য বুদ্ধ অ্যান্ড হিজ ধম্ম’ নামে বইটি লেখা শেষ করেন।

১৪ই অক্টোবর তিনি ও তাঁর পাঁচ লক্ষ সমর্থক মিলে নাগপুরে ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। ‘বুদ্ধ অর কার্ল মার্কস’ বা ‘রেভল্যুশন অ্যান্ড কাউন্টার রেভল্যুশন ইন অ্যানশিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ নামের বই দুটো অবশ্য তিনি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি।

মৃত্যু

‘দ্য বুদ্ধ অ্যান্ড হিজ ধম্ম’ রচনা শেষ করার তিন দিন পর ঘুমের ভেতরেই ১৯৫৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর আম্বেদকার প্রয়াত হন।

৭ই ডিসেম্বর দাদারের চৌপাট্টিতে অর্ধ কোটি জনতার সমাবেশে তাঁকে বৌদ্ধমতে দাহ করা হয়।

সূত্র : উইকিপিডিয়া

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *