পন্থার মূল্যায়ন
এখন আমরা অবশ্যই পন্থার মূল্যায়নে চোখ ফেরাব। এ প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে যে কোন পন্থাগুলো শ্রেয়তর এবং শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে। তবে, উভয় দিকেই কিছু ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। এই ভুল বোঝাবুঝিগুলো দূর করা প্রয়োজন। সন্ত্রাসের কথাই ধরুন। বহু মানুষ আছে যারা সন্ত্রাসের কথা শুনলেই কাঁপে। কিন্ত এটা নিছকই একটি অনুভূতি মাত্র। সন্ত্রাসকে একদম পুরোপুরি বাতিল করা যায় না। এমনকি অ-সাম্যবাদী দেশগুলোতেও একজন খুনীর ফাঁসি হয়। ফাঁসিতে ঝোলানো কি সন্ত্রাস নয়? অ-সাম্যবাদী দেশগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। এটা কি কোনো সন্ত্রাস নয়? একজন খুনী যদি কোনো নাগরিককে হত্যার দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে পারে, যদি শত্রু দেশের বা জাতির মানুষ হবার সুবাদে যুদ্ধে একজন সৈনিক নিহত হতে পারে, তবে একজন সম্পত্তির মালিক কেন খুন হবে না যেহেতু তার মালিকানাধীন ব্যক্তিগত সম্পত্তি অনেকের দুর্দশার কারণ? সম্পত্তির মালিকের পক্ষে একটি ব্যতিক্রমী সুরক্ষা ঢাল তৈরি করার কোনো কারণই নেই, কেন ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে ‘পবিত্র’ মনে করা হবে?
বুদ্ধ নিজে ছিলেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তবে তিনি ন্যায়বিচারের পক্ষে ছিলেন এবং ন্যায়বিচার যেখানে বলপ্রয়োগ দাবি করে, সেখানে তিনি শক্তি ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বৈশালীর প্রধান সেনাপতি সিনহার সাথে তাঁর সংলাপ থেকেই এটা স্পষ্ট। বুদ্ধ অহিংসা প্রচার করছেন জেনে সিনহা তাঁর কাছে এলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন :
“ভগবান তো অহিংসা প্রচার করেন। ভগবান কি কোনো অপরাধীকে তার শাস্তি থেকে মুক্তি দেবার কথা প্রচার করেন? ভগবান কি এটা প্রচার করেন বা করতে চান যে স্ত্রী, সন্তান ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য আমাদের যুদ্ধে যাওয়া উচিত নয়? অহিংসার নামে আমাদের কি অপরাধীদের হাতে যন্ত্রণা সহ্য করা উচিত?’
‘তথাগত কি সব যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করেছেন এমনকি যদি সেই যুদ্ধ সত্য ও ন্যায়ের স্বার্থেও পরিচালিত হয়?’
বুদ্ধ উত্তর করলেন, ‘আমি এতদিন ধরে যা কিছু প্রচার করে চলেছি, আপনি সেসব ভুল বুঝেছেন। একজন অপরাধীকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে এবং নিষ্পাপ মানুষ অবশ্যই মুক্ত হবে। অপরাধীকে দণ্ড দেওয়া কোতোয়ালের অপরাধ নয়। অপরাধীর ভুলই তার শাস্তির কারণ। যে কোতোয়াল শাস্তি দেন, তিনি আইনের নির্দেশ বহন ও পালন করেন মাত্র। অহিংসার দাগে তিনি দাগী হয়ে থাকেন না। সত্য ও ন্যায়বিচারের জন্য লড়াইরত কোনো মানুষকে অহিংসার দায়ে দায়ি করা যায় না। শান্তি রক্ষার সব উপায় যদি ব্যর্থ হয়, তবে হিংসা সূচনা করার সব দায় যে যুদ্ধ শুরু করে তার স্কন্ধে চাপে। অশুভ ক্ষমতার কাছে কেউ অবশ্যই আত্ম-সমর্পণ করবে না। যুদ্ধ হলেও হতে পারে। তবে স্বার্থপর লক্ষ্যের কাছে কেউ আত্ম-সমর্পণ করবে না।
অধ্যাপক জন ডিউয়ি যেমন বলেন যে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবশ্যই আরো অনেক যুক্তি রয়েছে। যারা এই বলে তর্ক করে যে লক্ষ্যই উদ্দেশ্য সাধনের পন্থা— তেমন ক্ষেত্রে নীতিটি আসলে নীতিগতভাবে বিকৃত একটি মতবাদ; ডিউয়ি তাদের যথার্থই প্রশ্ন করেছেন যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ব্যতীত পন্থাকে বৈধতা দেবে কে? লক্ষ্যই পন্থাকে বৈধতা দান করে।
বুদ্ধ সম্ভবত মেনে নেবেন যে শুধুমাত্র লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই পন্থাকে বৈধতা দান করে। এছাড়া অন্য কী বা হতে পারে? এবং তিনি আরো বলতে পারতেন যে উদ্দেশ্য যদি সহিংসতাকে বৈধতা দান করতো, তবে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সহিংসতা বা সন্ত্রাসই উদ্দেশ্য অর্জনের একটি ন্যায়পর পন্থা হতে পারত। সেক্ষেত্রে বুদ্ধ সম্পত্তির মালিকদেরও বলপ্রয়োগ থেকে ছাড় দিতেন না যদি না বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি সম্পত্তি উচ্ছেদের লক্ষ্য অর্জিত হতো।
যেমন আমরা দেখতে পাব যে বুদ্ধর উদ্দেশ্য অর্জনের পন্থা কতটা ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। অধ্যাপক ডিউয়ি যেমন চিহ্নিত করেছেন যে সন্ত্রাস হলো শক্তির ব্যবহারের অন্য একটি নাম এবং শক্তি শুধুমাত্র সৃজনশীল উদ্দেশ্য থেকেই ব্যবহৃত হওয়া উচিত। এছাড়া শক্তি হিসেবে বলপ্রয়োগের ব্যবহার এবং সন্ত্রাস হিসেবে শক্তির ব্যবহারের ভেতরও পার্থক্যরেখা টানা উচিত। একটি উদ্দেশ্য অর্জন অন্য নানা উদ্দেশ্যর ধ্বংস ঘটায় যারা কিনা বিনাশ করতে চাওয়া উদ্দেশ্যর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শক্তির প্রয়োগকে অবশ্যই এতটা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে যা একসাথে যতগুলো সম্ভব উদ্দেশ্যকে রক্ষা করবে। যাতে করে মন্দকে ধ্বংস করা যায়। জৈন ধর্মের প্রবক্তা মহাবীর প্রচারিত ‘অহিংসা’ এবং বুদ্ধ প্রচারিত ‘অহিংসা’র ভেতর বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। বুদ্ধ বলপ্রয়োগকে শুধুমাত্র শক্তি হিসেবেই ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন। সাম্যবাদীরা ‘অহিংসা’কে এক পরম নীতি হিসেবে প্রচার করলেও বুদ্ধ কিন্তু এর বিরোধী ছিলেন।
বুদ্ধ ছিলেন একনায়কত্বের চরম বিরোধী। তিনি গণতন্ত্রী হিসেবেই জন্মেছিলেন এবং গণতন্ত্রী হিসেবেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর জীবদ্দশায় ভারতে ছিল ১৪টি রাজা পরিচালিত রাজ্য এবং ৪টি প্রজাতন্ত্র। তিনি নিজে ছিলেন শাক্য গোষ্ঠির মানুষ এবং শাক্য রাজ্য ছিল মূলত একটি প্রজাতন্ত্র। তাঁর দ্বিতীয় ভালবাসার শহর ছিল বৈশালী। যেহেতু এটিও ছিল একটি প্রজাতন্ত্র। ‘মহাপরিনির্ব্বাণ’-এর আগে তিনি বৈশালীতে তাঁর ‘বর্ষাবাস’ (বৃষ্টির সময় বা বর্ষাকালে যে তিন মাস ভিক্ষুরা এক জায়গায় থাকেন) কাটিয়েছেন। ‘বর্ষাবাস’ অতিক্রান্ত হবার পর তিনি বৈশালী ত্যাগ করে অন্য কোথাও যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘বৈশালী’ ছেড়ে চলে যাবার সময় তিনি কাকাতো অনুজ আনন্দকে বলেন, ‘এটাই বৈশালীর শেষ দৃশ্য যা তথাগত দেখছেন,’— এতটাই ভক্ত ছিলেন তিনি এই প্রজাতন্ত্রের।
বুদ্ধ ছিলেন পুরোটাই এক সাম্যবাদী। শুরুতে ভিক্ষুরা, বুদ্ধ নিজে সহ, ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোর চীরবাস পরতেন। ধনশালী শ্রেণিগুলো থেকে কেউ যেন সংঘে যোগ দিতে না পারে, সে লক্ষ্যেই আপাত : কঠোর এই নিয়ম চালু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জীবক নামের বিখ্যাত চিকিৎসক বুদ্ধকে অনুরোধ করেন একটি পুরো কাপড়ের আঙরাখা উপহার হিসেবে গ্রহণ করতে। বুদ্ধ তখনি তাঁর সংঘের নিয়ম পরিবর্তন করে জানালেন যে সব ভিক্ষুই পুরো কাপড়ের আঙরাখা পরবেন।
একবার বুদ্ধর পালিকা মা, বিমাতা ও আপন মাসী মহাপ্রজাপতি গোতমি ভিক্ষুণী সংঘে যোগ দেবার পর শুনতে পেলেন যে বুদ্ধর ঠান্ডা লেগেছে। সাথে সাথে তিনি তাঁর জন্য একটি মাফলার বুনতে শুরু করলেন। মাফলারটি বোনা শেষ করার পর বুদ্ধর কাছে গিয়ে তিনি বুদ্ধকে মাফলারটি পরতে বলেন। বুদ্ধ কিন্তু উপহারটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন যে তাঁকে উপহার দিতে হলে সংঘের প্রত্যেক ভিক্ষুকেই উপহার দিতে হবে। মহাপ্রজাপতির অনেক অনুরোধেও বুদ্ধ সম্মত হলেন না।
বুদ্ধ নির্মিত ভিক্ষু সংঘের সংবিধান ছিল সবচেয়ে গণতান্ত্রিক। তিনি ছিলেন ভিক্ষুদের একজন মাত্র। বড়জোর কোনো সরকারের মন্ত্রী পরিষদের প্রধানমন্ত্রীর মতো কেউ। তবে নিজের জন্য ‘একনায়কে’র ভূমিকা কখনো তিনি চাননি বা একনায়ক হয়ে ওঠেননি। তাঁর মৃত্যুর আগে দু’বার তাঁকে অনুরোধ করা হয় সংঘের প্রধান হিসেবে কাউকে নিযুক্ত করতে যাতে সংঘের কাজ-কর্ম পরিচালনা করা সহজতর হয়। কিন্তু প্রতিবারই এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন যে, ‘ধম্ম’-ই সংঘের সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা। নিজে যেমন একনায়ক হতে রাজি হননি, তেমনি কোনো একনায়ককে নিযুক্ত করতেও রাজি হননি।
এখন পন্থা বা উপায়ের মূল্য সম্পর্কে কী বলা যায়? কোন পন্থাসমূহ উন্নততর এবং কোন পন্থাগুলো দীর্ঘতর সময়ের জন্য টেঁকসই? সাম্যবাদীরা কি একথা জোর দিয়ে বলতে পারেন যে মূল্যবান লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে তাঁরা আসলে তাঁদের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকেই ধ্বংস করেননি? তাঁরা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে ধ্বংস করেছেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিনাশকে একটি মূল্যবান উদ্দেশ্য ধরে নিয়েও একথা কী বলা যায় যে এই মূল্যবান লক্ষ্যটি অর্জনের প্রক্রিয়ায় তাঁরা অন্যান্য মূল্যবান উদ্দেশ্যগুলোকে ধ্বংস করেননি? উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কত মানুষকে তাঁরা হত্যা করেছেন? মানব জীবনের কী কোনো মূল্য নেই? ব্যক্তি সম্পত্তির মালিকের জীবন না নিয়েই কি তাঁরা (সাম্যবাদীরা) সম্পত্তির মালিকদের হাত থেকে সম্পত্তি কেড়ে নিতে পারতেন না?
একনায়কত্বের কথাই ধরুন। একনায়কত্ব অবসানের মূল উদ্দেশ্য হলো একটি চিরস্থায়ী বিপ্লব করা। এটা একটি মূল্যবান উদ্দেশ্য। একনায়কত্বকে প্রায়ই ‘মুক্তি’ বা ‘স্বাধীনতার অভাব’ অথবা সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই দু’টো ব্যখ্যার কোনোটিই খুব পরিষ্কার নয়। সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকলেও ‘মুক্তি’ বা ‘স্বাধীনতা’ না-ও থাকতে পারে। কারণ আইন অর্থই হলো মুক্তি বা স্বাধীনতা চাওয়া। একনায়কত্ব ও সংসদীয় গণতন্ত্রের ভেতর এটাই অন্তর্নিহিত পার্থক্য। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের সরকার কর্তৃক আরোপিত নানা বিধি-নিষেধের সমালোচনা করার অধিকার আছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে আপনার কর্তব্য এবং অধিকার থাকে; থাকে আইন মান্য করা এবং আইনকে সমালোচনা করার কর্তব্য। একনায়কত্বের ক্ষেত্রে আপনার শুধু আদেশ পালন করার কর্তব্য রয়েছে কিন্তু একে সমালোচনা করার কোনো অধিকার নেই।