উপায়/পন্থা

উপায়/পন্থা

এখন আমাদের আসতে হবে উদ্দেশ্য সাধনের উপায় বা পন্থার প্রশ্নে। সাম্যবাদ আনার উপায় হিসেবে বুদ্ধ প্রস্তাবিত পন্থাগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট। উদ্দেশ্য সাধনের উপায় বা পন্থাগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ বা অধ্যায়ে রয়েছে ‘পঞ্চশীল পালন’। বোধি অর্জনের পর সিদ্ধার্থ সক্ষম হন একটি নতুন ধর্ম প্রচারে, যা ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংক্রান্ত নানা সমস্যা থেকে মানুষকে উত্তরণের পথ দেখায় আর এই পথই বুদ্ধত্ব অর্জনের আগ অবধি তিনি হাতড়ে ফিরছিলেন।

নতুন এই ধর্মের মৌল ভিত্তি হলো পৃথিবী নানা দুঃখ ও অসুখে পরিপূর্ণ। নির্বাণ সংক্রান্ত যে কোনো ভাবনারই এটাই মূল কথা। বুদ্ধর হিতোপদেশের সূচনা বিন্দুও এই ঘটনারই স্বীকৃতি। জীবনে কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে এই দুর্দশা ও দুঃখকে মুছে ফেলাই ছিল তাঁর নীতিশিক্ষার মূল লক্ষ্য। জীবনে দূর্দশার কারণ কী সে-বিষয়ে প্রশ্ন করলে বুদ্ধ উত্তর করেন যে মূলত দু’টো কারণ থাকতে পারে। মানুষের অনেক দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ অনেক সময় তার নিজেরই মন্দ আচরণ। আর তাই দুঃখ দুর্দশার মূল কারণ বা ব্যক্তির নিজস্ব মন্দ আচরণ মুছতে ‘পঞ্চ শীলে’র অনুশীলন প্রয়োজন।

পঞ্চশীলে বুদ্ধের প্রধান পর্যবেক্ষণসমূহ নিচে দেয়া হলো :

১. ধ্বংস অথবা কোনো জীবিত বা জ্যান্ত বস্তর ধ্বংস সাধন করা,

২. চুরি করা থেকে বিরত থাকা অথবা প্রতারণা বা সন্ত্রাসের মাধ্যমে অন্য কারো সম্পত্তি অর্জন করা বা মালিকানায় নেওয়া।

৩. অসত্য বা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকা।

৪. কামনা-বাসনা থেকে দূরে থাকা।

৫. নেশাজাতীয় পানীয়দ্রব্য থেকে দূরে থাকা।

বুদ্ধর মতে, পৃথিবীর দুর্দশা ও অসুখের আর একটি প্রধান কারণ হলো মানুষের প্রতি মানুষের আচরণের অসমতা। এই অসাম্য কীভাবে দূর করা যায়? মানুষের প্রতি মানুষের আচরণগত অসাম্য দূর করার জন্য বুদ্ধ আর্য- অষ্টাঙ্গ মার্গ প্রস্তাব করেছেন।

আর্য অষ্টাঙ্গ মার্গের অন্তর্গত আটটি পন্থা হলো:

১. সম্যক দৃষ্টি : নানা কুসংস্কার থেকে মুক্তি।

২. সম্যক লক্ষ্য : বুদ্ধিমান এবং আন্তরিক মানুষের জন্য এই পন্থা যথাযোগ্য।

৩. সম্যক বাক বা সদয় : মুক্ত ও সত্য বাচন।

৪. সম্যক আচরণ : শান্তিপূর্ণ, সততাপূর্ণ ও শুদ্ধ।

৫. সম্যক জীবিকা : কোনো জীবিত বস্তুর প্রতি কোনো আঘাত বা ক্ষতি না করে অর্জিত জীবিকা।

৬. সম্যক মনন : সদা জাগ্রত ও পর্যবেক্ষণশীল মন।

৭. সম্যক ধ্যান : জীবনের গভীর সব রহস্য নিয়ে ঐকান্তিক চিন্তা।

৮. সম্যক অনুশীলন : উপরোক্ত সাতটি নীতি সঠিকভাবে পালন।

মহান এই ‘আর্য অষ্টাঙ্গ মার্গে’র লক্ষ্য হলো পৃথিবীতে ন্যায়পরতার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা এবং এভাবেই পৃথিবী থেকে দুঃখ ও পীড়াকে দূর করা।

বুদ্ধর উপদেশাবলির তৃতীয় অংশ হলো ‘নির্ব্বাণা’ বা ‘নির্বাণে’র নীতি। ‘নির্বাণের নীতি’ মহান আর্য-অষ্টাঙ্গ মার্গেরই একটি অবিভাজ্য পথ। নির্বাণ ব্যতীত আর্য-অষ্টাঙ্গ মার্গ অর্জন সম্ভব নয়। ‘নির্ব্বাণা’র নীতি আমাদের বলে যে আর্য-অষ্টাঙ্গ নীতি অর্জনের পথে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা কী কী? আর্য-অষ্টাঙ্গ মার্গ অর্জনের পথে প্রধান দশটি বিপত্তি বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বুদ্ধ তাদের অভিহিত করেছেন ‘দশ আসব’ বলে— এই দশ আসবই মানবজীবনের নানা শৃঙ্খল বা প্রতিবন্ধকতা।

এই দশ আসবের প্রধান আসব হলো আত্ম-বিভ্রম, জীবনের প্রতিটি মোহ-বুদ্বুদের পিছনে ছুটে চলা যা সে ভুলবশত মনে করে যে তার হৃদয়ের আর্তি মেটাবে, যদিও নিজের জন্য ব্যক্তির আসলে কোনো মহান পথই আর খোলা থাকে না। শুধুমাত্র যখন তার চোখজোড়া খুলে ব্যক্তি দেখতে বা বুঝতে পারে যে সে মূলত এই অসীম, মহান ব্রহ্মাণ্ডের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ ব্যতীত কিছুই নয়, তখনি কেবল সে বোঝা শুরু করে যে তার ক্ষণস্থায়ী ব্যক্তিসত্তায় প্রতিটি জিনিসই কত অনিত্য যে সে তুচ্ছ মোহ-বিভ্রমের সঙ্কীর্ণ পথেও প্রবেশ করতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো সন্দেহ এবং সিদ্ধান্তহীনতা। মানুষের চোখ যখন অস্তিত্বের বিপুল ও মহান রহস্যের দিকে খুলে যায়, যখন তার চোখ খুলে যায় প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের অনিত্যতা বিষয়ে, তখন নিজের কাজ নিয়ে সে নানা দ্বিধা বা সংশয়ে আক্রান্ত হতেই পারে। ‘আমার জীবনই যখন অনিত্য, তখন কিছু করব কি করব না’ এজাতীয় নানা প্রশ্ন একজন মানুষকে সিদ্ধান্তহীনতায় আক্রান্ত ও নিষ্ক্রিয় করে তোলে। কিন্তু এমন নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে আবার জীবন চলে না। কাজেই একজন মানুষকে কিন্তু তাঁর শিক্ষককে মেনে চলার জন্য মনকে প্রস্তত করতে হয়, গ্রহণ করতে হয় সত্য এবং জীবন সংগ্রামে প্রবেশ করতে হয়— নয়তো সে কোথাও পৌঁছতে পারবে না।

মানুষের তৃতীয় আসব হলো নানা আচার-অনুষ্ঠানের কার্যকারিতার উপর নির্ভরশীল হওয়া। যতদিন না মানুষ এসব অর্থহীন আচার-অনুষ্ঠানের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে, ততদিন হাজারটা দৃঢ় ও ভাল সিদ্ধান্তও তাকে মুক্ত করতে পারবে না: কোনো বাহ্যিক কার্যাবলি বিষয়ে তার বিশ্বাস, কোনো পুরোহিতের ক্ষমতা, পবিত্র কোনো অনুষ্ঠানই তাঁকে কোনো ধরনের সাহায্য করতে পারবে না। শুধুমাত্র যখন সে এই সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পারবে, তখনি মানুষকে বলা যায় যে সে ‘স্রোতাপন্ন’ হয়েছে বা সত্যের মূল স্রোতে ঢুকেছে এবং আজ অথবা কাল সে জয়ী হবেই।

‘মানুষের চতুর্থ আসব বা প্রতিবন্ধকতা হলো দৈহিক নানা বাসনা থাকা…পঞ্চমটি হলো অন্যের জন্য মন্দ উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি। ষষ্ঠটি হলো ভবিষ্যত জীবনের জন্য বস্তুগত শরীরের আকাঙ্ক্ষা দমন করা এবং সপ্তম আসব হলো একটি অবাস্তব বা অশরীরী পৃথিবীতে ভবিষ্যত জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষা করা।

মানুষের অষ্টম প্রতিবন্ধকতা হলো গর্ব বা অহঙ্কার এবং নবম প্রতিবন্ধকতা হলো আত্ম-ন্যায়পরতা বা স্ব-ধার্মিকতা। এই ব্যর্থতাগুলো মানুষের জন্য অতিক্রম করা সবচেয়ে কঠিন এবং উন্নততর মনের অধিকারী মানুষেরা এজাতীয় ভাবনায় বেশি আচ্ছন্ন থাকে- নিজেদের চেয়ে তুলনামূলক কম দক্ষ বা কম পবিত্রদের প্রতি তাদের একধরনের প্রশংসামূলক অবজ্ঞা থাকে।

দশম প্রতিবন্ধকতা হলো অজ্ঞতা। অন্য সব প্রতিবন্ধকতা জয় হলেও এটি থেকেই যাবে, জ্ঞানী ও উত্তম মানুষের শরীরেও কাঁটার মতো থেকে যায় এই অজ্ঞতা যা কিনা মানুষের শেষ এবং তিক্ততম শত্ৰু।

‘নির্ব্বাণা’ হলো মহান আর্য-অষ্টাঙ্গ পথের অন্বেষণে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো অর্জনের উপায়। মহান আর্য-অষ্টাঙ্গ মার্গের নীতি আমাদের বলে যে কতটা যত্নের সাথেই না একজন মানুষের উচিত তার মনকে গড়ে তোলা। ‘নির্ব্বাণা’ একজন মানুষের চলার পথে যতরকম প্রলোভন বা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলো কতটা আন্তরিকতার সাথে জয় করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের জানায়- অন্তত; কেউ যদি সত্যিই ‘মহান আর্য অষ্টাঙ্গ মার্গ’-এর পথ জানতে চায়।

বুদ্ধ প্রচারিত নতুন সদোপদেশের চতুর্থ অংশ হলো— ‘পারমিতা সুত্ত (সূত্র)।’ পারমিতা সূত্র একজন মানুষের প্রতিদিনকার জীবনে দশটি নীতি বা গুণের চর্চার কথা বলে।

এই দশ নীতি হলো দশ গুণ বা ধর্ম-

১) পান্না, ২) শীল, ৩) নেক্ষমা, ৪) দান, ৫) বীর্য, ৬) ক্ষান্তি, ৭) সূক্ষ্ম, ৮) অধিষ্ঠানা, ৯) মেত্তা এবং ১০) উপেক্ষা।

পান্না অথবা প্রজ্ঞা হলো সেই আলো যা অবিদ্যা, মোহ বা অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে। পান্না বা প্রজ্ঞার দাবি হলো কোনো মানুষ যদি তার অন্তরের সব সংশয় দূর করতে চায়, তবে তাকে নিজের চেয়েও জ্ঞানী কাউকে প্রশ্ন করতে হবে, নিজেকে জ্ঞানীদের সাথে যুক্ত করতে হবে এবং নানা ধরনের কলা ও বিজ্ঞান অনুশীলন করতে হবে যা তাঁর হৃদয়কে বিকশিত করতে সাহায্য করে বা করবে।

শীল হলো নৈতিক প্রকৃতি বা স্বভাব, কারোর ক্ষতি না করা ও অপরের ভাল করার সঙ্কল্প, অন্যায় করার লজ্জায় লজ্জিত হওয়া। শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে অন্যায় কাজকে পরিত্যাগ করা হলো শীল। শীল হলো অন্যায় বা অপরাধ করার ভয়।

নেক্ষমা হলো পার্থিব নানা আনন্দ-প্রমোদ ত্যাগ করা।

দান হলো কোনো প্রত্যাশার বিনিময়েই অন্যের মঙ্গলের জন্য নিজের যাবতীয় সম্পদ, রক্ত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং এমনকি জীবনও দান করা।

বীর্য হলো সত্য প্রচেষ্টা। সমস্ত শক্তি দিয়ে এবং পিছন না ফিরে, যা করার সঙ্কল্প করেছি, সেটা করা।

ক্ষান্তি হলো সহনশীলতা। ঘৃণাকে ঘৃণা দিয়ে পূরণ না করাই এই সহনশীলতার মর্ম। যেহেতু ঘৃণা দিয়ে ঘৃণাকে প্রশমিত করা যায় না। এটা শুধুই নিবৃত্তি বা সহনশীলতা দ্বারা প্রশমিত করা যায়।

সূক্ষ্ম হলো সত্য। বোধি অর্জনে আকাঙ্ক্ষী এক ভিক্ষু কখনো মিথ্যা বলেন না। তাঁর বাক্যই সত্য এবং সত্য ভিন্ন আর কিছু নয়।

অধিষ্ঠান হলো লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প।

মেত্তা হলো বন্ধু ও শত্রু, পশু ও মানুষ- সবার জন্য মৈত্রী বা সহমর্মীতাবোধ।

উপেক্ষা হলো উদাসীনতা থেকে পৃথক তবে মনের এক বিচ্ছিন্ন অবস্থা। যখন মন কোনো কিছু পছন্দ বা অপছন্দ করার অবস্থায় থাকে না। ফলাফলে কিছু যায় আসে না তবে তখনো পর্যন্ত ফলের সন্ধানে থাকে।

এই গুণগুলো অর্জনের জন্য মানুষ তার সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে চেষ্টা করে যাবে। এজন্যই এই গুণগুলোকে ‘পারমিতা’ (শুদ্ধতার সর্বোচ্চ সীমা) বলা হয়।

এসব নীতি-উপদেশই বুদ্ধ প্রচার করেছেন যা তিনি পৃথিবীর নানা দুঃখ- দুর্দশার ভেতর, দুঃখ থেকে মুক্তি অর্জনের পন্থা হিসেবে পেয়েছেন।

একথা পরিষ্কার যে বুদ্ধ কর্তৃক উদ্ভাবিত পন্থাসমূহ ব্যক্তির নৈতিক অবস্থান বদলানোর জন্য স্বেচ্ছা পথ বেছে নেবার জন্য গৃহীত হয়েছিল।

সাম্যবাদীদের দ্বারা গৃহীত পন্থাসমূহও সমানভাবে স্বচ্ছ, সংক্ষিপ্ত ও দ্রুতগতি। সে পন্থাদ্বয় হলো : ১. সহিংসতা এবং ২. সর্বহারার একনায়কত্ব।

সাম্যবাদীরা বলেন যে, পৃথিবীতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার দু’টো মাত্র পন্থা বা উপায় রয়েছে। প্রথম পন্থাটি হলো সন্ত্রাস। এর চেয়ে কোনো কিছু কমে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে ভাঙা যাবে না। অন্য পন্থাটি হলো ‘সর্বহারার একনায়কত্ব। এর চেয়ে কম কিছু দিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালানো যাবে না।

এটা বর্তমানে স্পষ্ট যে বুদ্ধ এবং কার্ল মার্ক্সের ভেতর মিল ও অমিলগুলো কী? পার্থক্যগুলো মূলত পন্থা বিষয়ক। লক্ষ্য দুয়েরই এক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *