রাষ্ট্রের বিলুপ্ত হওয়া

রাষ্ট্রের বিলুপ্ত হওয়া

সাম্যবাদীরা নিজেরাই স্বীকার করেন যে রাষ্ট্রকে চিরস্থায়ী একনায়কত্ব হিসেবে ঘোষণা করা, তাদের তত্ত্ব আসলে রাজনৈতিক দর্শনের হিসেবে এক বড় দুর্বলতা। তারা মোটামুটি এমন যুক্তির আশ্রয় নেন যে, রাষ্ট্র একটা সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সাম্যবাদীদের দু’টো উত্তর দেবার আছে। রাষ্ট্র কবে বিলুপ্ত হবে? রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবার পর তার জায়গায় কে স্থান নেবে? প্রথম প্রশ্নের ক্ষেত্রে তারা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলতে পারে না। স্বল্প সময়ের জন্য একনায়কত্ব ভাল বিষয় এবং এমনকি গণতন্ত্রকেও নিরাপদ করার জন্য এটি স্বাগত জানানোর মতো একটি বিষয় হতে পারে। কিন্তু নিজের স্বল্প সময়ের জরুরি কাজটুকু সেরে এই একনায়কত্ব নিজেই কেন বিদায় নেবে না? গণতন্ত্রের পথের সব বিপত্তি ও পাথর সরিয়ে কেন সে বিদায় নেবে না? কেন গণতন্ত্রের পথকে সে আরো নিরাপদ করবে না? মহামতি অশোক কি এই পথে তেমনই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেননি? কলিঙ্গের যুদ্ধে তিনি সন্ত্রাস চর্চা করেছিলেন। কিন্তু তারপর তিনি সন্ত্রাসের পথ পুরোপুরি পরিহার করেন। আমাদের আজকের বিজয়ীরা যদি শুধু তাদের প্রতিপক্ষকে নিরস্ত্র না করে নিজেরাও নিরস্ত্র হন, তবে সারা পৃথিবীতেই শান্তি ছড়িয়ে পড়বে।

সাম্যবাদীরা অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট উত্তর দেননি। রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবার পর ঠিক কোন ধরনের সংগঠন রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হবে, এর কোনো সন্তোষজনক উত্তর সাম্যবাদীরা দিতে পারেননি। যদিও এই প্রশ্নটি রাষ্ট্র কখন বিলুপ্ত হবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র বিলুপ্ত হলে কি নৈরাজ্য দেখা দেবে? যদি তাই হয়, তবে সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠন হবে একটি অর্থহীন প্রচেষ্টা। যদি শক্তি বা বলপ্রয়োগ ব্যতীত সাম্যবাদী রাষ্ট্রও টিঁকিয়ে না রাখা যায় এবং যদি রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রত্যাহার করা মাত্র নৈরাজ্য দেখা দেয়, তবে আর সাম্যবাদী সমাজের ভালোর কী রইলো? রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রত্যাহার করার পরও যা থেকে যায় তা’ হলো ধর্ম। কিন্তু সাম্যবাদীদের কাছে ধর্ম হলো অভিশাপ। ধর্মের প্রতি তাদের ঘৃণা এতই গভীরে প্রোথিত যে তারা এমনকি সাম্যবাদের জন্য সহায়ক ধর্ম এবং সাম্যবাদের জন্য বৈরী ধর্মের ভেতরও কোনো পার্থক্য করে না। সাম্যবাদীরা ধর্ম প্রশ্নে খ্রিষ্ট ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের ভেতর কোনো পার্থক্য করবে না। খ্রিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে সাম্যবাদীদের অভিযোগের ছিল দু’টো স্তর বিশিষ্ট খ্রিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল যে তারা মানুষকে পরকালের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে এবং ইহজীবনে দারিদ্র্যকে নির্বিবাদে মেনে নিতে সাহায্য করেছে। বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে আমার এ রচনায় আগে আমি যে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছি, সেসব উদ্ধৃতি সাপেক্ষে বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা যায়।

তবে খ্রিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে সাম্যবাদীদের আনা দ্বিতীয় অভিযোগ বোধ করি বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে আনা যাবে না। এই দ্বিতীয় অভিযোগটি হলো যে ধর্ম আসলে সাধারণ মানুষের জন্য শাসক শ্রেণির দেয়া আফিম। বাইবেলে ‘পর্বতে প্রদত্ত উপদেশাবলি’র ভিত্তিতে এই অভিযোগ সাম্যবাদীরা এনে থাকে।

এই উপদেশাবলিতে দারিদ্র্য ও দুর্বলতাকে আনন্দময় করে তোলা হয়েছে। এই উপদেশাবলিতে দরিদ্র ও দুর্বলের জন্য স্বর্গের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধর শিক্ষায় কিন্তু এমন উপদেশ নেই। তিনি বরং সম্পদ অর্জনের কথা বলেছেন যেমনটা তিনি তাঁর শিষ্য অনাথপিন্ডককে বলেছেন।

একবার অনাথপিন্ডক মহিমান্বিত বুদ্ধ যেখানে অবস্থান করছিলেন, সেখানে এলেন। এসে তিনি সেই মহিমান্বিত অমিতাভকে প্রণাম জানিয়ে তার পার্শ্বে উপবেশন করলেন এবং বললেন, ‘মহাজ্ঞানী বুদ্ধ কি বলবেন যে, কোন্ বস্তুগুলো গৃহীর কাছে স্বাগত জানানোর মতো আনন্দময় ও সম্মত হবার মতো অমায়িক তবে অর্জন করা কঠিন?

মহিমান্বিত বুদ্ধ তখন বললেন যে, ‘প্রথমত: বৈধভাবে সম্পদ অর্জন করা।

‘দ্বিতীয়ত: এটা লক্ষ্য করা যে তোমার আত্মীয়রাও সবাই বৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছে।

‘তৃতীয়ত: দীর্ঘ জীবন যাপন করা এবং গৌরব যুগে প্রবেশ করা,’ তবে, সত্য বলতে, হে গৃহী, পৃথিবীতে সুখকর, স্বাগত জানানোর মত আনন্দময় ও সম্মত হবার মতো অমায়িক তবে অর্জন করা কঠিন এমন চারটি বিষয় পেতে হলে চারটি পূর্বশর্ত পূরণ করা প্রয়োজন। সেই শর্তগুলো হলো: বিশ্বাসের আশীর্ব্বাদ, ধার্মিক আচরণের আশীর্বাদ, উদারনৈতিকতার আশীর্বাদ ও প্রজ্ঞার আশীৰ্ব্বাদ।’

‘সৎ আচরণের আশীর্বাদ যে সব মন্দ কাজের কারণে বিনষ্ট হয় সেসবের ভেতর রয়েছে কারো জীবন কেড়ে নেয়া, চুরি করা, অসচ্চরিত্রতা, মিথ্যা কথা বলা ও গেঁজানো মদ গ্ৰহণ।’

‘স্বাধীনতার আশীর্বাদ, হে গৃহী, পাওয়া যায় লোভ মুক্ত হৃদয়ে, উদার চিত্ততা, উদার হস্ত, উপহার প্রদান এবং উপহার বিতরণের আনন্দ থেকে।

‘প্রজ্ঞার আনন্দ পাওয়া যায় কীসে? যিনি জানেন যে, কোনো গৃহীর হৃদয় লোভ, লালসা, মন্দ ইচ্ছা, আলস্য, নিদ্রাজড়িমা, বিক্ষিপ্ততা এবং উত্তেজনা আর অন্যায় কাজ করার ও কর্তব্যে অবহেলার মাধ্যমে সুখ ও সম্মান থেকে বঞ্চিত হতে হয়, তিনিই প্রজ্ঞাবান।’

লোভ, লালসা, মন্দ ইচ্ছা, আলস্য ও নিদ্রাজড়িমা, বিক্ষিপ্ততা এবং উত্তেজনা ও সংশয় মনের কুদাগ। যে গৃহী অন্তরের এসব মলিন দাগ মুছে ফেলে বিপুল প্রজ্ঞা, প্রচুর জ্ঞান, স্বচ্ছ দৃষ্টি ও নিখুঁত প্রজ্ঞা অর্জন করেন, তিনিই সত্যিকারের জ্ঞানী।

এভাবেই ন্যায়সম্মতভাবে এবং বৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করা, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ আয় করা, বাহুর সবলতায় সম্পদ জড়ো করা এবং দুই ভ্রু-তে জমে থাকা ঘাম ঝরিয়ে অর্থ আয় করা এক বিশাল আশীর্বাদ। গৃহী নিজেকে সুখী এবং আনন্দিত করতে পারেন এবং অন্তরের সুখপূর্ণ ভাব সবসময়ই ধরে রাখতে পারেনঃ এবং একইসাথে তাঁর পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি, ভৃত্যকুল, শ্রমিক, বন্ধু ও সঙ্গীদের সুখী করতে পারেন ও তাদের চিরস্থায়ী ভাবে সুখী রাখতে পারেন। রুশরা কিন্তু বলপ্রয়োগে রক্ষিত সাম্যবাদী সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শক্তি বা বলপ্রয়োগ সরিয়ে নেবার পর বৌদ্ধ মতবাদে আশ্রয় নিতে আদৌ মনোযোগী নন।

রুশরা তাদের সাম্যবাদ নিয়ে গর্বিত। তবে তারা ভুলে যায় যে বিস্ময়ের বিস্ময় হচ্ছে এটিই যে বুদ্ধ নিজেই সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করে গেছিলেন এবং ভিক্ষু সঙ্ঘ একনায়কত্বে বিশ্বাস করত না। হতে পারে এই সাম্যবাদ ছিল খুবই ক্ষুদ্র পরিসরের সাম্যবাদ। তবে এই সাম্যবাদ ছিল কোনো ধরনের একনায়কত্ব বিবর্জিত যা রূপকথার মতো শোনালেও সত্য। লেনিন কিন্তু এমন রূপকথা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

বুদ্ধর পদ্ধতি অবশ্য ছিল ভিন্ন। তার পদ্ধতি ছিল মানুষের হৃদয় পরিবর্তন করা- তার স্বভাব বদলে দেওয়া- সুতরাং যা কিছু একজন মানুষ করে, সে এটা কোনো বলপ্রয়োগ বা বাধ্যবাধকতা ব্যতীতই করে বা স্বেচ্ছায় করে। মানুষের হৃদয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বুদ্ধের মূল পন্থা ছিল তার ‘ধম্ম’ বদলানো এবং ক্রমাগত ভাবে ‘ধম্ম’-র প্রচার করা। বুদ্ধর পন্থা কিন্তু মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করানোর জন্য বলপ্রয়োগের পথ অবলম্বন করেনি; যদিও এমনকি সেটা তাদের ভালর জন্যও হয়ে থাকতো। তাঁর পন্থা ছিল মানুষের ভাবনা-চিন্তাকে বদলানো যার ফলে তারা স্বেচ্ছায় তেমন কাজ করবে যা তারা অন্য সময়ে হলে করতো না।

এমনটা দাবি করা হয়ে থাকে যে রাশিয়ার সাম্যবাদী একনায়কত্বর ঝুলিতে অসংখ্য অসাধারণ অর্জন রয়েছে। একথা অস্বীকার করাও যায় না। এজন্যই আমি বলি যে, রুশ একনায়কত্ব সমস্ত পিছিয়ে পড়া দেশের জন্যই ভালো হবে। কিন্তু এটা চিরস্থায়ী একনায়কত্বের জন্য ভাল নয়। মানবতা শুধুই অর্থনৈতিক মূল্য চায় না, তার কিছু আত্মিক মূল্যও প্রয়োজন। সর্বহারার একনায়কত্বের মতবাদ মানুষের জীবনে আত্মিক মূল্যের দিকে কোনো দৃষ্টি দেয়নি এবং দিতেও চায় না। রাজনৈতিক অর্থনীতিকে কার্লাইল বলেছেন, ‘শূকরের দর্শন।’ কার্লাইল অবশ্যই ভুল ছিলেন। মানুষের বস্তুগত সুখ- সুবিধারও প্রয়োজন আছে। তবে সাম্যবাদী দর্শনকেও সমানভাবে ভুল মনে হয় যেহেতু এই দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শূকরকে মোটা-তাজা করা; কারণ মানুষ শূকরের চেয়ে শ্রেয়তর কিছু নয়। মানুষকে অবশ্যই বস্তুগত এবং আত্মিকভাবেও বিকশিত হতে হবে। আধুনিক মানব সমাজ সমাজের জন্য যে নব দর্শনের ভিত্তিপ্রস্তর চেয়েছে, তা’ ফরাসি বিপ্লব তিনটি মাত্র শব্দে সার- সংক্ষেপ করেছে। শব্দ-ত্রয়ী হলো: ভ্রাতৃত্ব-মুক্তি-সমতা। ফরাসি বিপ্লব তার শ্লোগানের জন্যই সমাদৃত হয়েছিল। তবে এই বিপ্লব মানুষের সমতা রক্ষায় ব্যর্থ হয়। আমরা রুশ বিপ্লবকে স্বাগত জানাই। যেহেতু এই বিপ্লব সমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করে। তবে এই সমতা অর্জন করতে গিয়ে সমাজ যে ‘ভ্রাতৃত্ব’ বা ‘মুক্তি’কে বিসর্জন দেয়নি সেকথা জোর দিয়ে বলা যায় না। ‘ভ্রাতৃত্ব’ বা ‘মুক্তি’ ব্যতীত ‘সমতা’ অর্জন সম্ভব নয়। ‘ভ্রাতৃত্ব-মুক্তি-সমতা’ অর্জন শুধুমাত্র তখনি অর্জন সম্ভব যখন আমরা বুদ্ধের পথ অনুসরণ করব। সাম্যবাদ ‘সমতা’ দিতে পারলেও ‘ভ্রাতৃত্ব’ বা ‘মুক্তি’ দিতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *