পল্লিভবনের ভূত
ক্যাপ্টেন রবার্ট স্টুয়ার্ট ছিলেন ইংল্যান্ডের এক অভিজাত জমিদারের দ্বিতীয় পুত্র। যখনকার কথা বলা হচ্ছে, তখন তিনি এক সেনাবাহিনীর সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে ছিলেন। তিনি ভালো শিকারিও ছিলেন, ওটা ছিল তাঁর অন্যতম নেশা। একদিন শিকারে বেরিয়ে তিনি অনেকদূর চলে গিয়েছিলেন। এদিকে আবহাওয়া হঠাৎ খারাপ হওয়ায় তিনি আর শিবিরে ফিরতে পারলেন না। রাতটা তিনি কোনো পল্লিভবনে আশ্রয় নেবেন ঠিক করলেন।
প্রথম যে বাড়িটা চোখে পড়ল সেখানে গিয়ে তিনি তাঁর নামের কার্ড পাঠিয়ে রাতটা ওখানে কাটাবার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। আইরিশদের আতিথেয়তার ব্যাপারে সুনাম আছে। গৃহস্বামী তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, সেইসঙ্গে একথাও বললেন যে, সেই রাতে আরও কিছু অতিথি থাকায় ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের হয়তো অসুবিধে হবে।
স্টুয়ার্ট তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন প্রচণ্ড শীতে সামান্য উষ্ণতা আর হাত-পা ছড়াবার মতো একটা বিছানাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট।
‘একটা বাড়তি বিছানা নিশ্চয়ই হবে,’ গৃহস্বামী বললেন, তারপর খানসামাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে তিনি ক্যাপ্টেনের রাত্রিবাসের জন্য যতটা সম্ভব ভালো একটা ব্যবস্থার নির্দেশ দিলেন।
ওই পল্লিভবনে সত্যিই সেদিন অতিথির ভিড় ছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের মতোই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য রাতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। খাবার টেবিলে কথায় কথায় গৃহস্বামী স্টুয়ার্টকে জিজ্ঞেস করলেন পরদিনই তাঁকে তাঁর শিবিরে ফিরে যেতে হবে কি না। ক্যাপ্টেন জবাব দিলেন তাঁর হাতে তখনও দু-দিন সময় আছে। গৃহস্বামী তাঁকে ওই দু-দিনের জন্য তাঁর অতিথি হবার আমন্ত্রণ জানালেন, বললেন ওখানে ভালো শিকার পাওয়া যায়, তিনি ক্যাপ্টেনকে শিকারে নিয়ে যাবেন। ক্যাপ্টেন সানন্দে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।
গল্পগুজবে সন্ধেটা বেশ ভালোভাবেই কেটে গেল। তারপর শোবার পালা। খানসামা স্টুয়ার্টকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা খুব বড়ো কিন্তু মাত্র দু-তিনখানা চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। তবে বেশ চওড়া আগুনচুল্লিতে জ্বলছিল গনগনে আগুন, আর তার কাছেই একটা কার্পেটের ওপর নানানরকম কাপড়ের ঢাকনা দিয়ে একটা বিছানা করা হয়েছিল। খুব আরামদায়ক শয্যা না হলেও ক্লান্ত ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছে ওটাই তখন লোভনীয় মনে হচ্ছিল। আগুন বড্ড বেশি গনগনে মনে করে তিনি কিছু জ্বালানি সরিয়ে রাখলেন তারপর গা এলিয়ে দিলেন ওই কার্পেটের বিছানায়। সঙ্গেসঙ্গে ঘুম। ঘণ্টা দুই পরে আচমকা তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চমকে উঠলেন। ঘর যেন আলোময়। প্রথমে তিনি মনে করেছিলেন বোধ হয় আগুনচুল্লি থেকেই অত আলো আসছে। কিন্তু তাকিয়ে দেখলেন ওটা নিভু নিভু হয়ে এসেছে।
আলো ক্রমেই বাড়ছে দেখে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন, আলোর সূত্রটা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর চোখের সামনেই আলোটা একটা আকার নিতে লাগল, ফুটে উঠল এক সুন্দর বালকের চেহারা, তাকে ঘিরে রয়েছে এক উজ্জ্বল আলোর বন্যা। বালকটি তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তিনিও ওর দিক থেকে চোখ ফেরাননি। আস্তে আস্তে মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
স্টুয়ার্ট ভাবলেন গৃহস্বামী আর অন্যান্য অতিথিরা তাঁর সঙ্গে তামাশা করেছে, তাঁকে ভয় দেখিয়ে মজা করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁকে নিয়ে এমন বাজে রসিকতায় তিনি মনে মনে খুব চটলেন। পরদিন সকালে প্রাতরাশের টেবিলে তাঁর অসন্তোষের ভাবটা গোপন রইল না।
গৃহস্বামী তাঁর হাবভাবে অবাক হলেন। গতকাল সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট অন্যান্যদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছিলেন, হঠাৎ তিনি এত গম্ভীর কেন! স্টুয়ার্ট যখন জানালেন প্রাতরাশ সেরেই তিনি বিদায় নেবেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
‘কিন্তু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট,’ তিনি হতবুদ্ধির মতো বললেন, ‘আপনি যে কথা দিয়েছিলেন শিকারের দলে যোগ দেবেন!’
‘আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলেছি।’ স্টুয়ার্ট ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন। গৃহস্বামী তাঁকে একপাশে নিয়ে গিয়ে তাঁর অভিমত পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। স্টুয়ার্ট গম্ভীর গলায় বললেন তাঁর সঙ্গে বদ রসিকতা করা হয়েছে, একজন অপরিচিত অতিথির সঙ্গে এমন ব্যবহার অত্যন্ত অশোভন। তিনি রাতের ঘটনা বললেন।
‘কী সাংঘাতিক!’ গৃহস্বামী বলে উঠলেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি একমত। অতিথিদের মধ্যে কয়েকজন ছোকরার বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। ওই ছোকরাদের যদি আপনার সামনে এনে ক্ষমা চাওয়াই তবে কি আপনি আমাদের সঙ্গে শিকারে যাবেন? আপনাকে আমি অনুরোধ করছি, আপনার সঙ্গ আমাকে আনন্দ দেবে ক্যাপ্টেন, আর আপনি যে চমৎকার শিকার পাবেন তার প্রতিশ্রুতিও আমি দিচ্ছি।’
শেষের কথাটাই স্টুয়ার্টকে আকৃষ্ট করল, তিনি সম্মতি দিলেন।
ঘরের মাঝখানে ফিরে এসে গৃহস্বামী বেশ কঠিন গলায় জানতে চাইলেন কে বা কারা গত রাতে তাঁর মান্য অতিথির সঙ্গে অমন বাজে রসিকতা করেছিল। সবাই এর ওর মুখের দিকে তাকাল, তারপর জোর গলায় প্রতিবাদ করে বলল ওই ঘটনার কিছুই তারা জানে না। হঠাৎ একটা সম্ভাবনা উঁকি মারল গৃহস্বামীর মনে। তিনি কপাল চাপড়ালেন, তারপরই ডেকে পাঠালেন খানসামাকে।
‘হ্যামিল্টন,’ তিনি খানসামাকে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট কাল রাত্তিরে কোন ঘরে শুয়েছিলেন?’
‘আজ্ঞে হুজুর,’ খানসামা একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, ‘আপনি তো জানেন, কাল বাড়িতে অনেক অতিথি ছিলেন। এক একটা ঘরে তিন চারজনের শোবার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল, কেউ কেউ আবার মেঝেতেই শুয়েছিলেন। তাই আমি ওঁকে ”ছেলের ঘরে” থাকতে দিয়েছিলাম। ‘তবে’, অনেকটা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সে বলল, ‘আমি আগুনচুল্লিটা খুব ভালোভাবে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম যাতে সে আসতে না পারে।’
‘কিন্তু তুমি জান,’ গৃহস্বামী রাগত কণ্ঠে বললেন, ‘ওই ঘরে কাউকে জায়গা দিতে আমি তোমাকে মানা করে দিয়েছি। ওই ঘর থেকে সব আসবাবপত্র আমি কি এমনিই সরিয়েছি? আবার যদি তুমি অমন কাজ কর তোমার চাকরি থাকবে না।’ তারপরই তিনি স্টুয়ার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি অনুগ্রহ করে আমার স্টাডিতে আসুন।’
সেখানে গিয়ে তিনি বললেন, ‘ক্যাপ্টেন, আমি আপনার কাছে একবার দু-বার নয়, অসংখ্যবার ক্ষমা চাচ্ছি। আপনাকে ও ঘর দেওয়া উচিত হয়নি।’
‘ব্যাপারটা কী? ছেলে আবার কে?’ স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমাকে ক্ষমা করবেন, সব কিছু আমি বলতে পারব না। শুধু জেনে রাখুন, আপনি আমাদের পারিবারিক ভূতকে দেখেছেন।’
স্টুয়ার্ট হাসিতে ফেটে পড়লেন। ‘আমাকে এড়াতে পারবেন না।’ তিনি বললেন, ‘কে ওই ছেলেটি?’
‘আমাদের এক পূর্বপুরুষের ছেলে,’ গৃহস্বামী জবাব দিলেন। ‘ছেলেটির মায়ের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এক উত্তেজক মুহূর্তে ছেলেটির গলা টিপে তাকে মেরে ফেলেছিল। ছেলেটি কিন্তু মায়ের সবচেয়ে আদরের সন্তান ছিল, সবার ছোটো। আপনি কাল যে ঘরে রাত কাটিয়েছেন, সেখানেই ওই ঘটনা ঘটেছিল। তখন ওর বয়স নয় কি দশ বছর।’
‘আর এখন ওই ঘরে তার প্রেতাত্মাকে দেখা যায়। খুব ঝামেলা করে বুঝি?’ ক্যাপ্টেন হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলেন।
‘কেউ তাকে দেখলেই একটা ঝঞ্ঝটের সৃষ্টি হয়,’ গৃহস্বামী জবাব দিলেন।
‘কেন? শুধু তখন কেন?’
গৃহস্বামী জবাবটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু স্টুয়ার্টের পীড়াপীড়িতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ খুললেন।
‘আমি কিন্তু বলতে চাইনি, আপনি আমাকে বাধ্য করছেন।’ তিনি বললেন। ‘ছেলেটি ভালো-মন্দ দুটোরই খবর বয়ে আনে। যাকেই ছেলেটি দেখা দেয় সে ক্ষমতা আর সৌভাগ্যের চূড়ায় ওঠে, কিন্তু সেই সৌভাগ্যের শীর্ষেই তার ভয়ংকর মৃত্যু হয়।’
গৃহস্বামীর কথা স্টুয়ার্টকে যেন নাড়া দিল। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘আমাদের সবাইকে একদিন-না-একদিন মরতে হবে, আর কীভাবে মৃত্যু আসবে তার জন্য আমার মাথাব্যথা নেই। যদি সৌভাগ্য আমার জীবনকে মধুর করে তোলে, শেষের ভয়ংকর দিনটা মূল্য হিসাবে দিতে আমার আপত্তি নেই।’ একটু থেমে তিনি বললেন, ‘আপনাকে আগেই বলেছি, আমি আমার পিতার দ্বিতীয় পুত্র। আমার ভবিষ্যৎ যেকোনো দ্বিতীয় পুত্রের চাইতে উজ্জ্বল নয় কেননা প্রথম পুত্র পৈতৃক সম্পত্তির ভাবী উত্তরাধিকারী। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমার জীবন একজন সৈনিক হিসেবেই কেটে যাবে। খুব একটা উঁচু পদও আমি আশা করি না, বড়োজোর কর্নেল, তার বেশি কিছু নয়।’
ওই ছেলেটিকে দেখার কয়েক বছরের মধ্যেই কিন্তু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। তাঁর বড়োভাই, যিনি ছিলেন মার্কুইস খেতাবের এবং বিশাল জমিদারির ন্যায্য উত্তরাধিকারী, এক নৌ-দুর্ঘটনায় হঠাৎ তিনি জলে ডুবে মারা গেলেন। স্টুয়ার্ট রাতারাতি বিশাল জমিদারি কাসলরিগের ভাইকাউন্ট বনে গেলেন।
পদমর্যাদার এই পরিবর্তন তাঁর দায়দায়িত্বের অনেক পরিবর্তন নিয়ে এল। আয়ারল্যান্ড সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে দেখা গেল। ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের মধ্যে বিরোধ লেগেই ছিল। ইং ১৮০০ সালে তাঁরই রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় ইংলন্ড আর আয়ারল্যান্ডের মধ্যে শান্তির চুক্তি সম্পাদিত হল আর সেটা খুলে দিল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সোপান।
স্টুয়ার্ট তাঁর নিজের প্রতিভায় নিজেই চমৎকৃত হলেন। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার যথাযোগ্য মর্যাদা পেতে দেরি হল না, গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যের দায়িত্ব পেতে লাগলেন তিনি। ১৮০৫ সালে আবার ১৮০৭ সালে তিনি ‘সেক্রেটারি অফ ওয়ার’-এর পদে আসীন হলেন, ১৮১২ সাল থেকে অলংকৃত করলেন ফরেন সেক্রেটারি বা বিদেশ সচিবের পদ। দক্ষতার সঙ্গে তিনি পালন করেছিলেন তাঁর গুরু দায়িত্ব।
দুর্ভাগ্যক্রমে ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনোভাবেরও পরিবর্তন ঘটতে লাগল। তাঁর শীতল ব্যবহার, অসহিষু; আর আক্রমণাত্মক কথাবার্তা তাঁর নিজের দলের কাছেই তাঁকে শুধু অপ্রিয় করে তুলল না, অনেকের ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠলেন তিনি। তা সত্ত্বেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে তিনি শুধু শক্ত মানুষই ছিলেন না, দেশের উন্নয়ন মন্ত্রী হিসেবে তাঁর সব পরিকল্পনা সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করেছিলেন।
১৮২১ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনিই মার্কুইস খেতাবে অভিষিক্ত হলেন। শেষের দিকে কঠিন বাতের অসুখ আর দীর্ঘকাল গুরুত্বপূর্ণ রাজপদে থাকায় যে মানসিক চাপ, তার ধকল তিনি সইতে পারছিলেন না— শরীর ও মন দুই-ই ভেঙে পড়েছিল। তাঁর আচরণেও অসংগতি দেখা দিতে লাগল। ডিউক অফ ওয়েলিংটনের পরামর্শে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন কিন্তু তাঁর অবস্থার উন্নতি হল না।
ক্রমে তাঁর বিচারবুদ্ধি লোপ পেতে লাগল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, তাঁকে তাঁর পল্লিভবনে গৃহবন্দি করে রাখা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। সাবধানতার কারণে দাড়ি কামাবার ক্ষুর পর্যন্ত তাঁর নাগালের বাইরে রাখা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ১৮২২ সালের ১২ অগাস্ট একটা পেনসিল কাটার ছুরি দিয়ে তিনি তাঁর কণ্ঠনালী ছেদ করেন। যাকে ‘ছেলে’টি দেখা দেয় তাঁর জীবনের পরিণতি ভয়ংকর মৃত্যুতে, এই প্রবাদবাক্য নিষ্ঠুরভাবেই ফলে গেল স্টুয়ার্টের জীবনে— লর্ড কাসলরিগ নামেই যিনি ছিলেন পরিচিত।