কালিন্দী – ১২

১২

সেই দিনই অপরাহ্নে সাঁওতালেরা খাজনার টাকা পাই পাই পয়সা হিসাব করিয়া মিটাইয়া দিল। কিন্তু গোল বাধাইল রংলাল-নবীনের দল। তাহারাও ধরিয়া বসিল, খাজনা ছাড়া সেলামি তাহারা দিতে পারিবে না। সাঁওতালদের চেয়েও কি তাহারা চক্রবর্তী-বাড়ির পর? অহীন্দ্র চুপ করিয়া রহিল, কোন উত্তর দিতে পারিল না। রংলাল-নবীনের যুক্তি খণ্ডন করিবার মত বিপরীত যুক্তি খুঁজিয়া সে সারা হইয়া গেল। অনেকক্ষণ নীরবে উত্তরের অপেক্ষা করিয়া রংলাল বলিল, দাদাবাবু, তাহলে হুকুমটা করে দিন আজ্ঞে।

অহীন্দ্র কিন্তু সে হুকুমও দিতে পারিল না। বিঘা পিছু পাঁচ টাকা সেলামি আদায় হইলেও পঞ্চাশ বিঘার আড়াই শত টাকা আদায় হইবে। তাহাদের সংসারের বর্তমান অবস্থা সে শুধু চোখেই দেখিতেছে না, মর্মে মর্মে অনুভব করিতেছে। তাহার মা যখন রান্নাশালে বসিয়া আগুনের উত্তাপ ভোগ করেন, তখন সেও গিয়া উনানের কাছে বসিয়া উনানে কাঠ ঠেলিয়া দেয়। সে যে কি উত্তাপ, সে তো তাহার অজানা নয়। উত্তাপ ও কষ্টের কথা ছাড়িয়া দিয়াও তাহার মাকে নিজে-হাতে রান্না করিতে হয়-ইহারই মধ্যে কোথাও আছে অসহনীয় অপরিসীম লজ্জা, যাহার ভয়ে তাহার মাথা হেট হইয়া পড়ে, তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসে। তাহার মা অবশ্য বলেন, যখন যেমন তখন তেমন। না পারলে হবে কেন? অম্লান হাসিমুখেই তিনি বলেন। কিন্তু তাহার মনে পড়ে কালিন্দী নদীর বানের জল আটক দিবার জন্য ঘাসের চাপড়া-বাঁধা বাঁধটার কথা; বাঁধটার ও-পারে থাকে অথই জল, আর এ-পারে বাঁধের গায়ে সবুজ ঘাস তেমনই তাহার মায়ের মুখে সুশ্যাম হাসির ও-পারে আছে অথই দুঃখের বন্যা; কালিন্দীর বন্যায় ভাটা পড়ে; বর্ষার শেষে সে শুকাইয়া যায়, কিন্তু মায়ের বুকের দুঃখের বন্যা শুকায় না, ও যেন শুকাইবার নয়! এ ক্ষেত্রে কেমন করিয়া সে এতগুলি টাকা ছাড়িয়ে দিবে?

নবীন বলিল, তা পাঁচ টাকা করে জনাহি লজর কিন্তুক দিতে হবে মোড়ল। তা লইলে সেটা ধর আমাদেরও অপমান। সাঁওতালরা না হয় দেয় নাই, ওরা ছোট জাত। আমাদিগে তো রাজার সম্মান একটা করতে হয়।

রংলাল বার বার ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইয়া বলিল, এ তুমি একটা কথার মত কথা বলেছ লবীন। লেন, লেন তাই হল দাদাবাবু, পঞ্চাশ বিঘের খাজনা আপনার এক শ টাকা, আর পাঁচ টাকা করে পাঁচজনের লজর পঁচিশ টাকা, এক শ পঁচিশই আমরা দিচ্ছি। সেও আপনার এক খাবল টাকা গো।

অহীন্দ্রের মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল, ইহাদের কথার ভঙ্গীতে সে যেন একটি ধারাবাহিক গোপন ষড়যন্ত্রের সূত্র দেখিতে পাইল, ইহারা তাহাকে ঠকাইবার জন্যই আসিয়াছে। তাহার উপর শেষের কয়টি কথা-‘একখাবল টাকা’ অর্থাৎ দুই হাতের মুঠিভরা টাকা-এই কথা কয়টির মধ্যে তাহাকে প্রলোভন দেখানোর সুর সুস্পষ্ট। তার ক্রোধ ও বিরক্তির আর সীমা রহিল না। সে দৃঢ় কঠোর স্বরে বলিল, জমি বন্দোবস্ত এখন হবে না, আমি বাবাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করতে পারব না।

রংলাল কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, বেশ তা হলে আমরা এখন ভেঙেচুরে জমি তৈরি করি, তারপর লেবেন খাজনা আপনারা।

তার মানে?

কথাটার মানে অত্যন্ত স্পষ্ট, বন্দোবস্ত করা হউক বা না হউক, জমি তাহারা দখল করিবেই। অকারণে খানিকটা মাথা চুলকাইয়া লইয়া রংলাল বলিল, ওই যে বললাম গো, আমরা জমি-জেরাত হাসিল করি তারপর লেবন খাজনা। আর এখন যদি লেবেন, তো তাও লেন, আমরা তো দিতেই রাজী রয়েছি।

অত্যন্ত ক্রোধে অহীন্দ্রের মাথাটা কেমন করিয়া উঠিল, কিন্তু প্রাণপণে সে-ক্রোধ মনের মধ্যে অবরুদ্ধ করিয়া সে বসিয়া রহিল।

রংলাল একটি প্রণাম করিয়া বলিল, তা হলে আমরা চল্‌লাম দাদাবাবু। যখুনি ডাকবেন তখুনি আমরা খাজনার টাকা এনে হাজির করে দেব। চল হে, চল সব। সন্ধ্যে হয়ে এল, চল।

অহীন্দ্র কথা বলিল না, হাত নাড়িয়া ইঙ্গিতেই জানাইয়া দিল, যাও, তোমরা চলিয়া যাও। ইহাদের উপস্থিতিও সে যেন আর সহ্য করিতে পারিতেছিল না। রংলাল ও নবীনের দল একে একে প্রণাম সারিয়া চলিয়া গেল, অহীন্দ্র একাই নির্জন স্তব্ধ কাছারি-বাড়ির দাওয়ায় তক্তপোশের উপর দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া রহিল। কার্নিশের মাথায় কড়িকাঠের উপরে বসিয়া সারি সারি পায়রার দল গুঞ্জন করিতেছে। সামনের খোলা মাঠটার সারিবদ্ধ নারিকেলের গাছ, তাহারই কোন একটার মাথায় আত্মগোপন করিয়া একটা পেঁচা আসন্ন সন্ধ্যার আনন্দে কুক কুক করিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। ঘরের ভিতর হইতে অন্ধকার নিঃশব্দে বাহির হইয়া আসিতেছে শোকাচ্ছন্ন বিধবার মত। এত বড় বাড়িটার কোথাও এক কণা আলোকের চিহ্ন নাই, কথাও একটা মানুষের সাড়া নাই, শুধু সিঁড়ির পাশে দুই দিকে দুইটা সুদীর্ঘ-শীর্ষ ঝাউগাছ অবিরাম শন শন শব্দ করিতেছে। সে শব্দ শুনিয়া মনে হয়, যেন এই অনাথা বাড়িটাই বুকফাটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিতেছে। অথচ একদিন নাকি হাসিতে কোলাহলে আলোকে গাম্ভীর্যে বাড়িখানা অহরহ গমগম করিত। মাথা হেঁট করিয়া প্রজারা সভয়ে অপেক্ষা করিয়া থাকিত এ বাড়ির মালিকের মুখের একটি কথার জন্য। আর আজ একজন চাষী প্রজা বলিয়া গেল, সম্মতি দেওয়া হউক বা না হউক, জোর করিয়া তাহারা জমি দখল করিবেই। অহীন্দ্র একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল, তারপর তক্তপোশটার উপরে নিতান্ত অবসন্নের মত শুইয়া পড়িল। তাহার মাথা ধরিয়া উঠিয়াছে।

কিছুক্ষণ পর মানদা এক হাতে ধূপদানি ও প্রদীপ, অন্য হাতে একটি জলের ঘটি লইয়া কাছারি-বাড়িতে প্রবেশ করিল। দুয়ারে চৌকাঠে চৌকাঠে জল ছিটাইয়া দিয়া ধূপ ও প্রদীপের আলো দেখাইতে দেখাইতে সে দেখিল, অহীন্দ্র ছেড়া শতরঞ্চি ঢাকা তক্তপোশটার উপর চোখ বুজিয়া নিস্তব্ধ হইয়া আছে। দেখিয়া তাহার বিস্ময়ের সীমা রহিল না। এমন নির্জন কাছারির বারান্দায়, ওই ময়লা ছেঁড়া শতরঞ্চির উপর, এই অসময়ে ছোটদাদাবাবু ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন! সঙ্গে সঙ্গে তাহার চিন্তাও হইল, কোন অসুখ-বিসুখ করে নাই তো? গায়ে হাত দিয়া দেখিতে সাহস হইল না। কি জানি, যদি ঘুম ভাঙিয়া যায় অনর্থ হইবে, হয়ত চীৎকার করিয়া উঠিবেন। ভাবিয়া-চিন্তিয়া সে ত্রস্ত গতিতে বাড়িতে গিয়ে ডাকিল, মা!

সুণীতি কাপড় কাচিয়া রামেশ্বরের ঘরে আলো জ্বালিয়া দিবার জন্য উপরে যাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। মানদার ডাকে বাধা পাইয়া বিরক্তির সহিতই বলিলেন, যখন-তখন কেন পেছনে ডাকিস মানদা? জানিস, আমি এবার ওপরে আলো জ্বালতে যাব।

মানদা বলিল, ডাকি কি আর সাধ করে মা? ছোটদাদাবাবু এই ভরসন্ধ্যেবেলায় কাছারির বারান্দায় সেই ছেঁড়া শতরঞ্চির ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে, অসুখ করেছে।

অসুখ করেছে?

করবে না? ওই দুধের ছেলে। এই জষ্টি মাসের আগুনের হল্কা রোদ, এই রোদে চর মাপতে গেল। তার ওপর এই সাঁওতালরা আসছে, এই তোমার সদগোপরা আসছে, কিচির-মিচির চেঁচামেচি। যান বাপু, আপনি গিয়ে উঠিয়ে নিয়ে আসুন। আমি বাপু ডাকতে পারলাম না ভয়ে।

সুনীতি বলিলেন, তুই আমার সঙ্গে আয়। আমি একলা কেমন করে কাছারি-বাড়িতে যাব?

তুলসীর মন্দিরের উপর প্রদীপ ও ধূপদানি রাখিয়া দিয়া মানদা বলিল, ঘরের ভিতর দিয়ে চলুন, বাইরের রাস্তায় কি জানি যদি কেউ থাকে!

অহীন্দ্রের কপালে হাত দিয়া আশ্বস্ত হইয়া সুনীতি বলিলেন, কই না, জ্বর তো হয় নি।

অহীন্দ্র স্পর্শেই বুঝিয়াছিল, এ তাহার মায়ের হাত। সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া বলিল, মা! কি মা?

কিছু নয় অহি। এ সময়ে এখানে শুয়ে কেন বাবা?

এমনি মাথা একটু ধরেছে, কেমন মনটাও একটু খারাপ হয়ে গেল। তাই একটু শুয়ে ছিলাম।

সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইয়া উৎকণ্ঠিত স্বরে সুনীতি বলিলেন, কেন মাথা ধরল রে, মনই বা খারাপ কেন হল?

সত্য গোপন করিয়া অহীন্দ্র বলিল, কি জানি! তারপর সে আবার বলিল, এই সন্ধ্যের অন্ধকার, কেউ কোথাও নেই, এত বড় বাড়ি-মনটা খারাপ হয়ে গেল মা। অথচ, গল্প শুনেছি, রাত্রি বারোটা পর্যন্ত এখানে লোক গিসগিস করত।

সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, নীরবে তিনিও একবার অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িখানার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। মানদা তাড়াতাড়ি বলিল, আমি আলো আনছি দাদাবাবু, আপনি আলো নিয়ে কাছারিতে বসুন কেনে। দু চারজনা বন্ধু-টন্ধু নিয়ে দিব্যি গল্প-গুজব করুন। তাস-টাস খেলুন।

অহীন্দ্র হাসিল, কিন্তু কথার কোন উত্তর দিল না। সুনীতি বলিলেন, এই বাড়ির মানমর্যাদা এখন সবই তোর উপর নির্ভর করছে

বাবা। ভাল করে লেখাপড়া শিখে তুই মানুষ হলে তবে এই দুঃখ ঘুচবে অহি।

মানদা সেই ভোরবেলা হইতেই আজ রংলাল-নবীনের দলের উপর বিরক্ত হইয়া ছিল। সে বলিল, হ্যাঁ বাপু। তখন এই ভোর বেলাতে কই সব চাষার দল এসে ডাকুক দেখি, দেখব। গরম কত সব! ডাকছ কেনে গো, না, সে তুমি বুঝবে না। আমি আজ বলে বিশ বছর জমিদারের ঘরে চাকরি করছি, আমি বুঝব না? ওই ভোরে উঠেই আপনার মাথা ধরেছে, তার উপর এই রোদ আর ঝলা।

সুনীতি বলিলেন, একটুখানি নদীর বাতাসে বেড়িয়ে আয় বরং। আকাশে চাঁদ উঠেছে মনটাও ভাল হবে, খোলা বাতাসে মাথাও অনেক হালকা হবে। আমি যাই, বাবুর ঘরে আলো দেওয়া হয় নি। মানদা, উনোনে আগুন দিয়ে দে মা।

অহীন্দ্রের মনের ভার অনেকটা হাল্‌কা হইয়াছিল, মায়ের ওই কথা কয়টিতে সে মনের মধ্যে একটা উৎসাহ অনুভব করিল, সে মানুষ হইলে তবে এই দুঃখ ঘুচিবে। সেই কথা ভাবিতে ভাবিতেই সে পথে বাহির হইয়া পড়িল। তাহার দাদার কথা মনে পড়িল, তাহাকে এম.এ. পর্যন্ত যেন পড়ানো হয়। যেমন-তেমন ভাবে এম.এ. পাস করিলে তো হইবে না, খুব ভালভাবে পাস করিতে হইবে। ফার্স্ট হইতে পারিলে কেমন হয়-ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট!

নদীর ধারে আসিয়া মাদলের শব্দে ও সাঁওতাল-মেয়েদের গানের সুরে তাহার চিন্তার একটানা ধারাটা ভাঙিয়া গেল। ও-পারের চরে আজ প্রবল সমারোহে উৎসব চলিয়াছে। আজ তাহারা জমিদারকে খাজনা দিয়া রসিদ পাইয়াছে, জমি তাহাদের নিজের হইয়াছে, আজিকার দিন তাহাদের একটি পরমকাম্য শুভদিন, তাহাদের দেবতাকে তাহারা পূজা দিয়াছে। পাঁচটি লাল রঙের মুরগী, একটি লাল রঙের ছাগল বলি দিয়া নাকি পূজা হইয়াছে, তাহার পর আকণ্ঠ পচুই মদ খাইয়া গান-বাজনা আরম্ভ করিয়াছে। অদ্ভুত জাত!

আকাশে শুক্লাসপ্তমীর আধখানা চাঁদ কালিন্দীর ক্ষীণ স্রোতের মধ্যে এক অপরূপ খেলা খেলিতেছে। দূরে কালিন্দীর ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় চাঁদ যেন জলে গলিয়া গিয়াছে, ঝিকমিক করিয়া নাচিতেছে চাঁদ-গলানো জলের ঢেউ। দূরে এ-পাশে কালিন্দীর জল, যেন একখানা অখণ্ড রূপার পাত। সম্মুখেই পায়ের কাছে চাঁদ কালিন্দীর স্রোতের তলে ছেঁড়া একগাছি চাঁদমালার মত আঁকিয়া-বাঁকিয়া লম্বা হইয়া ভাসিয়া চলিয়াছে। সাদা সাদা টিট্টিভ পাখীগুলি জলস্রোতের ও-পারে বালির উপর ছুটিয়া ছুটিয়া বেড়াইতেছে, কখনও কখনও একটা অন্যের তাড়ায় খানিকটা উড়িয়া আবার দূরে গিয়া বসিতেছে। দূর আকাশে একটা উড়িয়া চলিয়াছে আর ডাকিতেছে, হট্টি-টি–হট্টি-টি। নদীর বালুগর্ভের উপর অবাধ শূন্যতল স্বচ্ছ কুয়াশার ন্যায় জ্যোৎস্নায় মোহগ্রস্থের মত স্থির নিস্পন্দ। অহীন্দ্র নদীস্রোতের কিনারায় চুপ করিয়া

বসিল। সহসা তাহার মনে হইল, কোথায় কাহারা যেন কথা কহিতেছে! স্বর ভাসিয়া আসিতেছে, ভাষার শব্দ ঠিক ধরা যায় না। সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া বেশ সাড়া দিয়াই প্রশ্ন করিল, কে? উত্তর কেহ দিল না, উপরন্তু কথার শব্দও নিস্তব্ধ হইয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই তাহার নজরে পড়িল স্রোতের ও-পারে বালির উপর দুইটি মূর্তি। কিছুক্ষণ পরেই আবার কথার শব্দ আরম্ভ হইল।

অহীন্দ্র কৌতূহল সম্বরণ করিতে পারিল না, অগভীর জলস্রোত পার হইয়া এ-পারে বালির উপর উঠিয়া আসিয়া উঠিল। বলিতে বলিতে খানিকটা আগাইয়া আসিয়া সে কথার ভাষা বুঝিতে পারিল, সাঁওতালদের ভাষা; এবং গলার স্বরে বুঝিল, তাহারা দুজনেই স্ত্রীলোক; সুরে মনে হইল, কোন একটা বচসা চলিয়াছে। সে ডাকিল, কে?

যাহারা কথা কহিতেছিল, তাহারা দুজনেই ইষৎ চকিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। একজন সবিস্ময়ে আপনাদের ভাষায় কি বলিয়া উঠিল, তাহার মধ্যে একটি কথা অহীন্দ্র বুঝিতে পারিল, রাঙাবাবু! তাহাকে চিনিতেও অহীন্দ্রের বিলম্ব হইল না, তাহার দীর্ঘ দেহখানিই তাহাকে চিনাইয়া দিল। সে কমল মাঝির নাতনী। অপর জন তাহার দিকে আগাইয়া আসিতেই তাহাকেও অহীন্দ্র চিনিল, সে বৃদ্ধ সর্দার কমল মাঝির স্ত্রী। বৃদ্ধা অহীন্দ্রকে দেখিয়া যেন কতক আশ্বস্ত হইয়া ভাঙা বাংলায় একটানা সুরে বলিল, দেখ্‌ রাঙাবাবু দেখ্‌। মেয়েটা আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া পালাইয়া আসিয়াছে। আবার বলিতেছে, এ-ঠাঁই ছাড়িয়া ও চলিয়া যাইবে।

তরুণী নাতনী ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, কেনে ঝগড়া করবে না কেনে? চলে যাবে না কেনে? তু বাবু বিচার করে দে। বুড়া-বুড়ীর করণ দেখ্‌।

হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, কি, হল কি তোদের? ছি, মাঝিন, বুড়ী দিদিমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আছে?

বুড়ী খুব খুশি হইয়া উঠিল, দেখ বাবু, আপুনি দেখ্‌।

অহীন্দ্র বলিল, যা মাঝিন, বাড়ি যা; নাচ হচ্ছে, গান হচ্ছে পাড়াতে, যা, নাচ-গান করগে।

কেনে গান করবে? কেনে নাচ করবে? উয়ারা বুড়া-বুড়ীতে নাচ-গান করবে। উয়ারা জমি পেলে, উয়ারা নাচবে। আমাদিগে দিলে না কেনে?

অহীন্দ্র বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করিল, কি হল কি মাঝিন, তুই বল তো শুনি?

বৃদ্ধা যাহা বলিল, তাহা এই। -এই মেয়েটির শীঘ্রই বিবাহ হইবে। সর্দার বলিতেছে, তোমরা আমাদের কাছে থাক, খাট, খাও, আমি তোমাদের ভরণপোষণ করিব। কিন্তু মেয়েটি সে-কথা কোনমতেই শুনিবে না। সে স্বতন্ত্র ঘর বাঁধিতে চায়, নিজস্ব জমি চায়। সেই জমিই না পাইয়া সে এমন করিয়া রাগ করিয়াছে। ঝগড়া করিতেছে।

তরুণী নাতনীটি এইবার হাত নাড়িয়া অঙ্গভঙ্গি করিয়া বলিয়া উঠিল, তুরা জমি লিবি, তুদের ধান হবে, কোলাই হবে,ভুট্টা হবে, তুরা সব ঘরে ভরবি। আমরা কি করব তবে? আমাদের ঘর হবে না, বেটা-বেটি হবে না? উয়ারা কি খাবে তবে? কেনে আমরা তুদের জমিতে খাটব?

অহীন্দ্রের হাসি পাইল, আবার বেশ ভালও লাগিল; এই তরুণী কিশোরী মেয়ে, এখনও বিবাহ হয় নাই, হইবে এই প্রত্যাশায় ঘর-দুয়ার সন্তান-সন্ততি সম্পত্তির আয়োজনে মত্ত হইয়া উঠিয়াছে! মৃদু হাসিয়া সে বলিল, ওঃ, মাঝিন আমাদের পাকা গিন্নী হবে দেখছি! এখন থেকেই ঘরকন্নার ভাবনায় পাগল হয়ে উঠেছিস্‌।

বৃদ্ধা অহীন্দ্রের সুরে সুর মিলাইয়া বলিল, হ্যাঁ, তাই দেখ্‌ কেনে আপুনি। উয়ার একেবারে শরম নাই।

তরুণী এবার আরও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল, তড়বড় করিয়া এক রাশ কথা বলিয়া গেল। অহীন্দ্র অনেক কষ্টে তাহার মর্মার্থ বুঝিল; সে বলিতেছিল, শরম তোদের নাই বুড়া-বুড়ী, তোরা সকলকে জমি না দিয়া নিজেরা অধিক অংশ আত্মসাৎ করিয়া লইয়াছিস! অহীন্দ্র একটু বিস্ময় অনুভব করিল, কমল মাঝির নিজের নামে জমি লওয়ার মধ্যে এমন মতলবের কথা সে কল্পনাও করিতে পারে নাই। সে বৃদ্ধার স্ত্রীকে বলিল, না, না। ছি ছি, এমন কেন করলি তোরা মাঝিন?

বৃদ্ধা সবিনয়ে বলিল, জমি সকল বয়স্ক মাঝিকেই দেওয়া হইয়াছে, শুধু এই কজন তরুণ-বয়স্কদের দেওয়া হয় নাই। উহারা এখন জমি লইয়া কি করিবে? উহাদের জোয়ান বয়স-এখন খাটিয়া পয়সা উপার্জনের সময়। পরে উহারা সেই পয়সায় জমি কিনিবে, বুড়োরা মরিয়া গেলে পাইবে, এই তো নিয়ম। তাহারা বুড়া-বুড়ী কিছু জমি বেশি লইয়াছে, ইহাও সত্য। কিন্তু রাঙাবাবু, তাহারা যে মোড়ল-সর্দার, সকলের অপেক্ষা বেশি না পাইলে চলিবে কেন তাহাদের? সম্মান থাকিবে কেন? আর রাঙাবাবু যে অনেকটা জমি নিজের জন্য রাখিয়া দিলেন, নহিলে সকলকেই তাহারা দিত। এই সামান্য জমির ভাগ কেমন করিয়া এতগুলি লোককে দেওয়া যায়?

তবু মেয়েটির এই গিণ্ণীপনার আগ্রহ অহীন্দ্রের বড় ভাল লাগিয়াছিল, সে একটু চিন্তা করিয়া বলিল, এক কাজ কর্‌ মাঝিন। তোর হবু বরকে পাঠিয়ে দিস, আমি যে-জমিটা নিজের জন্যে রেখেছি, তারই খানিকটা তাকে ভাগে বিলি করে দেব। আরও যে যে চায়, দেব। তারপর হাসিয়া বলিল, কেমন, এইবার তোদের ঝগড়া মিটল তো?

বৃদ্ধা বলিল, হুঁ বাবু, মিটল। সব মাঝি ভারি খুশি হবে। কাল সব যাবে আপনার কাছে। উয়াদিগে আপুনি জমি ভাগে দিবি, নাম লিখে লিবি।

তরুণীটি বলিল, আমাদিগে ভাগীদারের সদ্দার করে দিবি বাবু। উ মরদটা তুর সব দেখে দিবে, আমি তুদের ঘরে পাট-কাম করে দিব। হোক!

মেয়েটির আনন্দের আগ্রহে অহীন্দ্র খুশি হইয়া উঠিল, বলিল, তাই করে দেব।

আনন্দে কলরব করিয়া মেয়েটি এবার হাসিয়া উঠিল। অহীন্দ্র বলিল, যা, এইবার ঘরে যা, নাচ-গান কর্‌ গিয়ে।

আপুনি যাবিন না বাবু?

না অনেকটা রাত্রি হয়ে গেল, আমি বাড়ি চললাম।

অহীন্দ্র জলের স্রোতটা পার হইয়া এ-পারে উঠিয়াছে, এমন সময় আবার পিছন থেকে কে ডাকিল, বাবু! রাঙাবাবু! অহীন্দ্র ফিরিয়া দাঁড়াইল, দেখিল একটি মূর্তি ছুটিয়া তাহার দিকেই আসিতেছে। সে মেয়েটিই ছুটিয়া আসিতেছে।

ফুল লিয়ে যা বাবু, তুর লেগে ফুল আনলম। এক আঁচল কুরচির ফুল লইয়া মেয়েটি তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল।

সরল অশিক্ষিত জাতির তরুনীটির কৃতজ্ঞতায় অহীন্দ্রের মন আনন্দে ভরিয়া উঠিল, সে দুই হাত পাতিয়া বলিল, দে। মেয়েটি আঁচল উজাড় করিয়া ফুল ঢালিয়া দিল, অহীন্দ্রের হাতের অঞ্জলিতে এত ফুল ধরিবার স্থান ছিল না, অঞ্জলি উপচিয়া ফুল বালির উপর পড়িয়া গেল।

মেয়েটি বলিল, ইগুলা পড়ে গেল যি?

অহীন্দ্র বলিল, ওগুলা তুই নিয়ে যা। খোঁপায় পরবি!

মেয়েটি নিঃসঙ্কোচে মাথায় কয়েকটা গুচ্ছ গুঁজিয়া নাচিতে নাচিতে জোৎস্নাস্নাত বালুচরের উপর দিয়া চলিয়া গেল। টিট্টিভ পাখীর দল মেয়েটির দিকেই চাহিয়া রহিল। এতক্ষণে তাহার মনের সকল গ্লানি কাটিয়া গিয়াছে। অপরাহ্নে ক্ষোভের বিমর্ষতায় তাহার অন্তর-বাহির ভাঁটা-পড়া নদীর মত শীর্ণ নিস্তরঙ্গ হইয়া উঠিয়াছিল, অকস্মাৎ যেন সেই শীর্ণতা ও নিস্তরঙ্গতাকে প্লাবণে আবৃত করিয়া একটা আনন্দের ভাল-লাগার জোয়ার আসিয়া গেল।

মেয়েটা অদ্ভুত! সাঁওতালদেরই তাঁতে বোনা মোটা দুধের মত সাদা কাপড়ে কি চমৎকারই না মানাইয়াছে! লাল কস্তায় রেলিঙের মত নকশাটা পাড়াটিও সুন্দরভাবে কাখড়খানাতে খাপ খাইয়াছে,বেণী রচনা না করিয়া সাদাসাপটা এলো খোঁপাতেই উহাদের ভাল মানায়। সরল বর্বর জাতি, স্বার্থকে গোপন করিতে জানে না, স্বার্থহানিতে পরম আপন জনের সঙ্গেও কলহ করিতে দ্বিধা করে না। কুমারী মেয়েটির স্বামী-সন্তান-সম্পদের কামনা দ্বন্দ করিয়া উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করিতে একটুকু কুণ্ঠা নাই। অদ্ভুত!

বালুচরের উপরে দূরে, মেয়েটিকে ওই এখনও দেখা যাইতেছে; মানুষ বলিয়া চেনা যায় না, উহার দুধে-ধোয়া কাপড়খানা জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশিয়া এক হইয়া গিয়েছে। শুধু অনাবৃত হাত, পিঠের খানিকটা, মাথার কালো চুল, পাতলা সাদা চাদরের মত জ্যোৎস্নার মধ্য দিয়া খানিকটা কালো রঙের মত,- না, খানিকটা কালো রূপের মত ছুটিয়া চলিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *