কালিন্দী – ৮

বজ্রের আঘাতের মত আকস্মিক নির্মম আঘাতে সুনীতির বুকখানা ভাঙিয়া গেলেও তাঁহার কাঁদিবার উপায় ছিল না। সন্তানের বেদনায় আত্মহারা হইয়া লুটাইয়া পড়িবার শ্রেষ্ঠ স্থান হইল স্বামীর আশ্রয়। কিন্তু সেইখানেই সুনীতিকে জীবনের এই কঠিনতম দুঃখকে কঠোর সংযমে নিরুচ্ছ্বাসিত স্তব্ধ করিয়া রাখিতে হইল। অপরাহ্নে কাণ্ডটা ঘটিয়া গেল, সুনীতি সমস্ত অপরাহ্নটাই মাটির উপর মুখ গুঁজিয়া মাটির প্রতিমার মত পড়িয়া রহিলেন, সন্ধ্যাতে তিনি গৃহলক্ষ্মীর সিংহাসনের সম্মুখে ধূপপ্রদীপ দিতে পর্যন্ত উঠিলেন না। সন্ধ্যার পরই কিন্তু তাঁহাকে উঠিয়া বসিতে হইল। মনে পড়িয়া গেল-তাঁহারই উপর একান্ত-নির্ভরশীল স্বামীর কথা। এখনও তিনি অন্ধকারে আছেন, দুপুরের পর হইতে এখনও পর্যন্ত তিনি অভুক্ত। যথাসম্ভব আপনাকে সংযত করিয়া সুনীতি রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিলেন। বন্ধ ঘরে গুমোট গরম উঠিতেছিল, প্রদীপ জ্বালিয়া সুনীতি ঘরের জানলা খুলিয়া দিলেন। এতক্ষণ পর্যন্ত তিনি স্বামীর দিকে ফিরিয়া চাহিতে পারেন নাই, স্বামীর মুখ কল্পনামাত্রেই তাঁহার হৃদয়াবেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছিল। এবার কঠিনভাবে মনকে বাঁধিয়া তিনি স্বামীর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন, -দেখিলেন গভীর আতঙ্কে রামেশ্বরের চোখ দুইটি বিস্ফারিত হইয়া উঠিয়াছে, নিস্পন্দ মাটির পুতুলের মত বসিয়া আছেন। সুনীতির চোখে চোখ পড়িতেই তিনি আতঙ্কিত চাপা কণ্ঠস্বরে বলিলেন, মহীনকে লুকিয়ে রেখেছ?

সুনীতি আর যেন আত্মসম্বরণ করিতে পারিলেন না। দাঁতের উপর দাঁতের পাটি সজোরে টিপিয়া ধরিয়া তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। রামেশ্বর আবার বলিলেন, খুব অন্ধকার ঘরে, কেউ যেন দেখতে না পায়!

আবেগের উচ্ছ্বাসটা কোনমতে সম্বরণ করিয়া এবার সুনীতি বলিলেন, কেন, মহী তো আমার অন্যায় কাজ কিছু করে নি, কেন সে লুকিয়ে থাকবে?

তুমি জান না, মহী খুন করেছে-খুন!

জানি।

তবে! পুলিসে ধরে নিয়ে যাবে যে!

সুনীতির বুকে ধীরে ধীরে বল ফিরিয়া আসিতেছিল, তিনি বলিলেন, মহী নিজেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। সে তো আমার কোন অন্যায় কজ করে নি, কেন সে চোরের মত আতমগোপন ক’রে ফিরবে? সে তার মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে, সন্তানের যোগ্য কাজ করেছে।

অনেকক্ষণ স্তব্ধভাবে সুনীতির মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া রামেশ্বর বলিলেন, তুমি ঠিক বলেছ। মণিপুর-রাজনন্দিনীর অপমানে তার পুত্র বভ্রুবাহন পিতৃবধেও কুণ্ঠিত হয় নি। ঠিক বলেছ তুমি!

গাঢ়স্বরে সুণীতি বলিলেন, এই বিপদের মধ্যে তুমি একটু খাড়া হয়ে ওঠ, তুমি না দাঁড়ালে আমি কাকে আশ্রয় ক’রে চলাফেরা করব? মহীর মকদ্দমায় কে লড়বে? ওগো, মনকে শক্ত কর, মনে করো কিছুই তো হয় নি তোমার।

রামেশ্বর ধীরে ধীরে খাট হইতে নামিয়া খোলা জানলার ধারে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সুনীতি বলিলেন, আমার কথা শুনবে?

সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে বার বার ঘাড় নাড়িয়া রামেশ্বর বলিলেন, হুঁ।

সুনীতি বলিলেন, হ্যাঁ, তুমি শক্ত হয়ে দাঁড়ালে মহীর কিছু হবে না। মজুমদার ঠাকুরপো আমায় বলেছেন, এরকম উত্তেজনায় খুন করলে ফাঁসি তো হয়ই না, অনেক সময় বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।

বলিতে বলিতে তাঁহার ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তাঁহার চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল-ননী পালের রক্তাক্ত নিস্পন্দ দেহ। উঃ, সে কি রক্ত! কাছারি-বাড়ির বারান্দায় রক্ত জমিয়া একটা স্তর পড়িয়া গিয়াছিল। সুনীতির মন হতভাগ্য ননী পালের জন্য হাহাকার করিয়া উঠিল। মহীন অন্যায় করিয়াছে, অপরাধ করিয়াছে। দণ্ড দিতে গিয়া মাত্রা অতিক্রম করিয়াছে। সেইটুকুর জন্য শাস্তি তাহার প্রাপ্য, এইটুকু শাস্তিই যেন সে পায়। আত্মহারা নির্বাক হইয়া তিনি দাঁড়াইয়া রহিলেন।

কিছুক্ষণ পর মানদা ঘরের বাহির হইতে তাঁহাকে ডাকিল, মা!

সুনীতির চমক ভাঙিল, একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া তিনি বলিলেন, যাই।

উনোনের আঁচ ব’য়ে যাচ্ছে মা।

আত্মসম্বরণ করিয়া সুনীতি স্বামীর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন।

রামেশ্বর একদৃষ্টে বাহিরে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাঁহার জন্য সন্ধ্যাকৃত্যের জায়গা করিয়া দিয়া সুনীতি বলিলেন, কাপড় ছেড়ে নাও, সন্ধ্যে ক’রে ফেল। আমি দুধ গরম করে নিয়ে আসি।

রামেশ্বর বলিলেন, একটা কথা বলে দিই তোমাকে। তুমি-

সুনীতি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া বলিলেন, বল, কি বলছ?

তুমি একমনে তোমার দিদিকে ডাক-মানে রাধারাণী, রাধারাণী। সে বেঁচে নাই, ওপার থেকে সে তোমার ডাক শুনতে পাবে। বল- তোমার মান রাখতেই মহীন আমার এই অবস্থা, তুমি তাকে আশীর্বাদ করো, বাঁচাও।

সুনীতি বলিলেন, ডাকব, তাঁকে ডাকব বইকি।

* * *

সুনীতি নীচে আসিয়া দেখিলেন, মজুমদার তাঁহারই অপেক্ষায় বসিয়া রহিয়াছে। সে মহীন্দ্রের খবর জানিবার জন্য থানায় গিয়াছিল। তাহাকে দেখিয়াই সুনীতির ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তাঁহার চোখের সম্মুখে শৃঙ্খলাবদ্ধ মহীর বিষণ্ণ মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। মুখে তিনি কোন প্রশ্ন করিতে পারিলেন না, কিন্তু মজুমদার দেখিল, উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন মূর্তিমতী হইয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে।

সে নিতান্ত মূর্খের মত খানিকটা হাসিয়া বলিল, দেখে এলাম মহীকে।

তবু সুনীতি নীরব প্রতিমার মত দাঁড়াইয়া রহিলেন। মজুমদার অকারণে কাশিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া আবার বলিল, এতটুকু ভেঙে পড়ে নি, দেখলাম। আবার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়াও সুনীতির নিকট হইতে সরব কোন প্রশ্ন আসিল না দেখিয়া বলিল, থানার দারোগাও তো কোন খারাপ ব্যবহার করে নি। আবার সে বলিল, আমি সব জেনে এলাম, থানায় কি এজাহার দিয়েছেন, তাও দেখলাম। একটাও মিথ্যে বলেন নি।

সুনীতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন, আর কোন জীবন-স্পন্দন স্ফুরিত হইল না।

মজুমদার বলিল, দারোগা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বরং, লোকটা কি বলেছিল বলুন তো? মহীবাবু সে কথা বলেন নি। দারোগা কথাটা জানতে চেয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছেন, সে কথা আমি যদি উচ্চারণই করব, তবে তাকে গুলি করে মেরেছি কেন? আমি বললাম সব।

সুনীতি এতক্ষণে কথা কহিলেন, ছি!

মাথা হেঁট করিয়া মজুমদার বলিল, না বলে যে উপায় নেই বউ-ঠাকরুণ, মহীকে বাঁচানো চাই তো!

দরদর করিয়া এবার সুনীতির চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল, মজুমদার প্রাণপণে তাঁহাকে উৎফুল্ল করিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ভাববেন না আপনি, ও-মামলায় কিছু হবে না মহীর। দারোগাও আমাকে সেই কথা বললেন।

অত্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে সুনীতি প্রশ্ন করিলেন, মহী কিছু বলে নি?

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মজুমদার বলিলেন, বললেন-মাকে বলবেন, তিনি যেন না কাঁদেন। আমি অন্যায় কিছু করি নি। বড়মাকে দেখি নি, মা বললেই মাকে মনে পড়ে। সে শয়তান যখন মায়ের নাম মুখে আনলে, তখন মাকেই আমার মনে প’ড়ে গেল, আমি তাকে গুলি করলাম। আমার তাতে একবিন্দু দুঃখ নেই, ভয়ও করি না আমি। তবে মা কাঁদলে আমি দুঃখ পাব।

সুনীতি বলিলেন, কাল যখন যাবে ঠাকুরপো, তখন তাকে ব’লো, যেন মনে মনে তার বড়মাকে ডাকে, প্রণাম করে। বলবে, তার বাপ এই কথা ব’লে দিয়েছেন, আমিও বলছি।

কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিয়া মজুমদার বলিল, অনেকগুলি কথা আছে আপনার সঙ্গে। স্থির হয়ে ধৈর্য ধরে আপনাকে শুনতে হবে।

সুনীতি বলিলেন, আমি কি ধৈর্য হারিয়েছি ঠাকুরপো?

অপ্রস্তুত হইয়া মজুমদার বলিল, না-মানে, মামলা-সংক্রান্ত পরামর্শ তো। মাথা ঠিক রেখে করতে হবে, এই আর কি!

আচ্ছা, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি ওঁকে দুধটা গরম ক’রে খাইয়ে আসি। যাইতে যাইতে সুনীতি দাঁড়াইলেন, ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে মানদাকে ডাকিলেন, মানদা, বামুন-ঠাকরুনকে বল্‌ তো মা, মজুমদার-ঠাকুরপোকে একটু জল খেতে দিক। আর তুই হাত-পা ধোবার জল দে।

মজুমদার বলিল, শুধু এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল।

তৃষ্ণায় তাহার ভিতরটা যেন শুকাইয়া গিয়াছে।

স্বামীকে খাওয়াইয়া সুনীতি নীচে আসিয়া মজুমদারের অল্প দূরে বসিলেন। যোগেশ মাথায় হাত দিয়া গম্ভীরভাবে চিন্তা করিতেছিল। সুনীতি বলিলেন, কি বলছিলে, বল ঠাকুরপো?

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মজুমদার বলিল, মামলার কথাই বলছিলাম। আমার খুব ভরসা বউঠাকরুন, মহির এতে কিছু হবে না। দারোগাও আমাকে ভরসা দিলেন।

সে তো তুমি বললে ঠাকুরপো।

হ্যাঁ। কিন্তু এখন দুটি ভাবনা কথা, সে কথাই বলছিলাম।

কি কথা বল?

মামলায় টাকা খরচ করতে হবে, ভাল উকিল দিতে হবে। আর ধরুন, দারোগা-টারোগাকেও কিছু দিলে ভাল হয়।

সুনীতি প্রশ্ন করিলেন, ঘুষ?

হ্যাঁ, ঘুষই বৈকি। কাল যে কলি বউঠাকরুন। তবে আমরা তো আর ঘুষ দিয়ে মিথ্যা করাতে চাই না।

কত টাকা চাই?

তা হাজার দুয়েক তো বটেই, মামলা-খরচ নিয়ে।

আমার গহনা আমি দেব ঠাকুরপো, তাই দিয়ে এখন তুমি খরচ চালাও।

ইতস্তত করিয়া মজুমদার বলিল, আমি বলছিলাম চরটা বিক্রি ক’রে দিতে। অপয়া জিনিস, আর খদ্দেরও রয়েছে। আজই থানার ওখানে একজন মারোয়াড়ী মহাজন আমাকে বলছিল কথাটা।

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া সুনীতি বলিলেন, ওটা এখন থাক ঠাকুরপো, এখন তুমি গহনা নিয়েই কাজ কর। পরে যা হয় হবে। আর কি বলছিলে, বল?

আর একটা কথা বউঠাকরুন, এইটেই হ’ল ভয়ের কথা! ছোট রায় মশায় যদি বেঁকে দাঁড়ান।

সুনীতি নীরবে মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন, এ কথার উত্তর দিতে পারিলেন না।

মজুমদার বলিল, আপনি একবার ওদের বাড়ি যান।

সুনীতি নীরব।

মজুমদার বলিল, মহীর বড়মা ধরুন মা-ই, কিন্তু তিনি তো রায় মহাশয়ের সহোদরা। ননী পাল তাঁর আশ্রিত, কিন্তু সে কি তাঁর সহোদরার চেয়েও বড়?

সুনীতি ধীরে ধীরে বলিলেন, কিন্তু মহী তো তাঁর সহোদরার অপমানের শোধ নিতে এ কাজ করে নি ঠাকুরপো!

কিন্তু কথা তো সেই একই!

ম্লান হাসি হাসিয়া সুনীতি বলিলেন, একই যদি হয় তবে কৈফিয়ৎ দেবার জন্য কি আমার যাবার প্রয়োজন আছে ঠাকুরপো? তার মত লোক এ কথা কি নিজেই বুঝতে পারবেন না?

মজুমদার চুপ করিয়া গেল, আর সে বলিবার কথা খুঁজিয়া পাইল না। সুনীতি আবার বলিলেন, যে কাজ মহী করলে ঠাকুরপো, বিনা কারণে সে কাজ করলে ভগবানও তাকে ক্ষমা করেন না। কিন্তু যে কারণে সে করেছে, সেই কারণটা আজ বড় হয়ে কর্মের পাপ হালকা ক’রে দিয়েছে। এ কারণ যে না বুঝবে, তাকে কি ব’লে বোঝাতে যাব আমি? আবার কিছুক্ষণ পর বলিলেন, আর মহীর কাছে মহীর মা বড়। রায় মশায়ের কাছে তাঁর ভগ্নী বড়। মহী মায়ের অপমানে যা করবার করেছে; এখন রায় মশায় তাঁর ভগ্নীর জন্যে যা করা ভাল মনে করেন, করবেন। এতে আর আমি গিয়ে কি করব। বল?

* * *

গভীর রাত্রি; গ্রামখানা সুষুপ্ত। রামেশ্বর বিছানায় শুইয়া জাগিয়াই ছিলেন, অদূরে স্বতন্ত্র বিছানায় সুনীতি অসাড় হইয়া আছেন, তিনিও জাগিয়া মহীন্দ্রের কথাই ভাবিতেছিলেন। মায়ের অপমানের শোধ লইতে মহী বীরের কাজ করিয়াছে, এ যুক্তিতে মনকে বাঁধিলেও প্রাণ সে বাঁধন ছিঁড়িয়া উন্মত্তের মত হাহাকার করিতে চাহিতেছে; বুকের মধ্যে অসহ্য বেদনার বিক্ষোভ চাপিয়া তিনি অসাড় হইয়া পড়িয়া ছিলেন। শয়নগৃহে স্বামীর বুকের কাছে থাকিয়াও প্রাণ খুলিয়া কাঁদিয়া সে বিক্ষোভ লঘু করার উপায় নাই। রামেশ্বর জাগিয়া উঠিলে বিপদ হইবে, তিনি অধীর হইয়া পড়িবেন, বিপদের উপর বিপদ ঘটিয়া যাইবে।

পূর্বাকাশে দিক্‌চক্রবালে কৃষপক্ষের চাঁদ উঠিতেছিল। খোলা জানলা দিয়া আলোর আভাস আসিয়া ঘরে ঢুকিতেছে। রামেশ্বর অতি সন্তর্পণে খাট হইতে নামিয়া জানলার ধারে গিয়া দাঁড়াইলেন, ঘুমন্ত সুনীতির বিশ্রামে ব্যাঘাত না ঘটাইবার জন্যই তাঁহার এ সতর্কতা। জানলা দিয়া নীচে মাটির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া তিনি কয়েক পা পিছাইয়া আসিলেন। মৃদুস্বরে বলিলেন, উঃ, ভয়ানক উঁচু!

সুনীতি শিহরিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া তাঁহাকে ধরিলেন, বলিলেন, কি করছ?

রামেশ্বর ভীষণ আতঙ্কে চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, কে?

সুনীতি তাড়াতাড়ি বলিলেন, আমি, আমি, ভয় নেই, আমি!

কে? রাধারাণী?

না, আমি সুনীতি?

আশ্বস্ত হইয়া রামেশ্বর একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ও, এখনও ঘুমোও নি তুমি? রাত্রি যে অনেক হ’ল সুনীতি!

সুনীতি বিচিত্র হাসি হাসিলেন। বলিলেন, তুমিও ঘুমোও নি যে? এস, শোবে এস।

আমার ঘুম আসছে না সুনীতি। শুয়ে হঠাৎ রামায়ণ মনে প’ড়ে গেল।

রামায়ণ আমি পড়ব, তুমি শুনবে?

না। মেঘনাদ যখন অধর্ম-যুদ্ধে লক্ষণ বধ করলে, তখন রাবণের কথা মনে আছে তোমার? শক্তিশেল, শক্তিশেল! আমার মনে হচ্ছে- তেমনি শেল যদি পেতাম, তবে রায়বংশ, রায়-হাট সব আজ ধ্বংস ক’রে দিতাম আমি। রামেশ্বর থরথর করিয়া কাঁপিতেছিলেন। সুনীতি বিব্রত হইয়া স্বামীকে মৃদু আকর্ষণ করিয়া বলিলেন, এস, বিছানায় বসবে এস, আমি বাতাস করি।

রামেশ্বর আপত্তি করিলেন না, আসিয়া বিছানায় বসিলেন। একদৃষ্টে জানলা দিয়া চন্দ্রালোকিত গ্রামখানির দিকে চাহিয়া রহিলেন। সুনীতি বলিলেন, তুমি ভেবো না, মহী আমার অন্যায় কিছু করে নি। ভগবান তাকে রক্ষা করবেন।

রামেশ্বর ও কথার কোন জবাব দিলেন না। নীরবে বাহিরের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে সহসা পরম ঘৃণায় মুখ বিকৃত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, অ্যাঃ, বিষে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

সুনীতি কাতর স্বরে মিনতি করিয়া বলিলেন, ওগো, কি বলছ তুমি? আমার ভয় করছে যে!

ভয় হবারই কথা। দেখ, চেয়ে দেখ-গ্রামখানা বিষে একাবেরে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। কতকাল ধ’রে মানুষের গায়ের বিষ জমা হয়ে আসছে, রোগ শোক, কত কি! মনের বিষ, হিংসা-দ্বেষ মারামারি কাটাকাটি খুন! আঃ

চন্দ্রালোকিত গ্রামখানার দিকে চাহিয়া সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশাস ফেলিলেন; সত্যি গ্রামখানাকে অদ্ভুত মনে হইতেছিল। জমাট অন্ধকারের মত বড় বড় গাছ, বহুকালের জীর্ণ বাড়ি ঘর-ভাঙা দালান, ভগ্নচূড়া দেউলের সারি, এদিকে গ্রামের কোল ঘেঁষিয়া কালীন্দির সুদীর্ঘ সু-উচ্চ ভাঙন, সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া, বিকৃতমস্তিষ্ক রামেশ্বরের মত বিষ-জর্জরিত মনে না হইলেও, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিতে ইচ্ছা হয়।

সহসা রামেশ্বর আবার বলিলেন, দেখ।

কি?

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া রামেশ্বর বলিলেন, আমার আঙুলগুলো বড় টাটাচ্ছে।

কেন? কোথাও আঘাত লাগল নাকি?

বিষণ্ণভাবে রামেশ্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, উহুঁ।

তবে? কই, দেখি!- বলিয়া অন্তরালে রক্ষিত প্রদীপটি উস্কাইয়া আনিয়া দেখিয়া বলিলেন, কই, কিছুই তো হয় নি।

তুমি বুঝতে পারছ না। হয়েছে-হয়েছে। দেখছ না, আঙ্গুলগুলো ফুলো-ফুলো আর লাল টকটক করছে?

হাত তো তোমাদের বংশের এমনই লাল।

না, তোমায় এতদিন বলি নি আমি। ভেবেছিলাম, কিছু না, মনের ভ্রম। কিন্তু-। তিনি আর বলিলেন না, চুপ করিয়া গেলেন।

সুনীতি বলিলেন, তুমি একটু শোও দেখি, মাথায় একটু জল দিয়ে তোমায় আমি বাতাস করি।

রামেশ্বর আপত্তি করিলেন না, সুনীতির নির্দেশমত চুপ করিয়া শুইয়া পড়িলেন। সুনীতি শিয়রে বসিয়া বাতাস দিতে আরম্ভ

করিলেন। চাঁদের আলোয় কালীর গর্ভের বালির রাশি দেখিয়া মনে কেমন একটা উদাস ভাব জাগিয়া উঠে। একপাশে কালীর ক্ষীণ কলস্রোত চাঁদের প্রতিবিম্ব, সুনীতির মনে ঐ উদাসীনতার মধ্যে একটু রূপের আনন্দ ফুটাইতে চেষ্টা করিয়াও পারিল না। তাহার ও-পারে সেই কাশে ও বেনাঘাসের ঢাকা চরটা, জোৎস্নার আলোয় কোমল কালো রঙের সুবিস্তীর্ণ একখানি গালিচার মত বিস্তীর্ণ হইয়া রহিয়াছে। সর্বনাশা চর! বাতাস করিতে করিতে সুনীতিও ধীরে ধীরে ঢলিয়া বিছানার উপর পড়িয়া গেলেন। পড়িয়াই আবার চেতনা আসিল, কিন্তু দারুণ শ্রান্তিতে উঠিতে আর মন চাহিল না, দেহ পারিল না।

ঘুম যখন ভাঙিল, তখন প্রভাত হইয়াছে। রামেশ্বর উঠিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন। সুনীতিকে উঠতে দেখিয়াই তিনি বলিলেন, কবরেজ মশায়কে একবার ডাকতে পাঠাও তো।

কেন? শরীর কি খারাপ করছে কিছু?

এই আঙুলগুলো একবার দেখাব।

ও কিছু হয় নি, তবে বল তো ডাকতে পাঠাচ্ছি।

না, অনেকদিন উপেক্ষা করেছি, ভেবেছি, ও কিছু নয়। কিন্তু এইবার বেশ বুঝতে পারছি, হয়েছে-হয়েছে।

রাত্রেও ঠিক এই কথা বলিয়াছিলেন। এ আর সুনীতি কত সহ্য করইবেন! বিরক্ত হইতে পারেন না, দুর্ভাগ্যের জন্য কাঁদিবার পর্যন্ত অবসর নাই, এ এক অদ্ভুত অবস্থা। তিনি বলিলেন, আঙুলে আবার কি হবে বল? আঙ্গুল তো-

কুষ্ঠ-কুষ্ঠ। -সুনীতির কথার উপরেই চাপা গলায় রামেশ্বর বলিয়া উঠিলেন, অনেক দিন আগে থেকে সূত্রপাত, তোমায় বিয়ে করার আগে থেকে। লুকিয়ে তোমায় বিয়ে করেছি।

সুনীতা ব্জ্রাহতার মত নিস্পন্দ নিথর হইয়া গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *