কালিন্দী – ৩০

৩০

পরদিন প্রভাতেই জমিদার পক্ষ সাজিয়া চরের উপর হাজির হইল, সাঁওতালদের ভাগে বিলি করা জমি দখল করা হইবে।

জমিদার পক্ষকে মোটেই বেগ পাইতে হইল না। লোক জুটিয়া গেল বিস্তর। আদেশ অথবা অনুরোধ করিয়াও লোক ডাকিতে হইল না। আপনা হইতেই গ্রামের সমস্ত চাষী হাল-গরু লইয়া ছুটিয়া আসিল, দলের সর্বাগ্রে আসিল রংলাল। চরের উর্বর মাটির উপর লোভের নিবৃত্তি তাহাদের কোন দিনই হয় নাই। নিরুপায়ে সে কেবল নিরুদ্ধ হইয়া ছিল। সংবাদটা পাইবামাত্র তাহারা পুলকিত হইয়া সাঁওতালদের সযত্নে গড়ে তোলা জমিগুলি দখল করিতে উদ্যত হইল। বাগদীপাড়ার নবীনের দল এবং রায়েদের লাঠিয়ালের দল লাঠি হাতে চক্রবর্তী-বাড়ির ভাগে বিলি জমির সীমানার মাথায় খুঁটি পুঁতিয়া দাঁড়াইল। চাষীরা বিপুল উৎসাহে গরুগুলিকে প্রচণ্ড চীৎকারে তাড়না করিয়া জমিগুলির উপর লাঙ্গল চালাইয়া দিল-হেৎ-তা-তা-তা-তা- তা-হেৎ-হেৎ!

সাঁওতালদের পুরুষের দল আপনাদের পাড়ার প্রান্তভাগে বসিয়া উদাস বিষন্ন দৃষ্টিতে শক্তিমত্ত দখলকারী জনতার দিকে নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল। পিছনে মেয়েদের দল শুধু ব্যাকুল হইয়া কাঁদিল। কেহ কেহ গালি পাড়িতেছিল আপনাদের পুরুষদের, কেন মিছামিছি রাঙাবাবুদের সহিত বিবাদ করিলি তোরা? এ তোদের উপযুক্ত হইয়াছে, ঠিক হইয়াছে। সায়েব ওদিকে জমি কাড়িয়া লইয়াছে, এ-দিকে রাঙাবাবুরা জমি কাড়িয়া লইল, এইবার কি করবি কর্‌! মরিতে হইবে না, না খাইয়া শুকাইয়া মরিতে হইবে।

এক বৃদ্ধা আক্ষেপ করিয়া বলিল, আমি তখুনি বললম গো, তুরা চিবাস মোড়লের কাছে লিস না, ধান ধার তুরা লিস না। ‘কাই হড়’ (পাপী লোক) বেটে উ! হিঁদু সাউয়েরা পুরানো বাঘ বেটে। হাড্ডি তাকাত চিবায়ে খাবে উ। লে ইবার হল তো। আঃ, হায় হায় গো!

একজন বলিল উয়ার কি দোষ হল? উ কি করবে?

দোষটি কার হল? উ নোকটি যদি সায়েবকে খতগুলান বেচে না দিথো, তবে সায়েব কি করে জমিগুলান লিথো? কি করে জমিদার হথো উ?

একটি তরুণী বলিল, হেঁ! তা হলে রাঙাবাবুর বিয়েতে যেতে কি করে মানা করত?

চূড়া মাঝির স্ত্রী এবং আর কয়েকজন মাতব্বর মাঝির স্ত্রী অঝোরঝরে কাঁদিতেছিল, মৃদুস্বরে বিলাপ করিতেছিল, আঃ-আঃ, হায় হায় গো! সব জমিনজেরাত চলে গেল গো! এখুন যে পরের দুয়ারে চাকর খাটতে হবে গো! লইলে ভিখ মাগতে হবে গো! গুগা (বোবা) ভিখ্‌ করে গো! কাঁড়া (অন্ধ) ভিখ্‌ করে গো! লেঢ়া (খোঁড়া) ভিখ্‌ করে গো! উয়াদিগে যেমন লোকে থো (থুথু) দেয়, তেমনি করে থো খেতে হবে, হায় হায় গো! হায় হায় গো!

বাগদী লাঠিয়ালেরা প্রতিদ্বন্দীর অভাবে শূন্যের সহিত লড়াই জুড়িয়া দিল। অকারণে লাঠি ঘুরাইয়া, হাক মারিয়া, কুক দিয়া তাহারা যেন তাণ্ডবে মাতিয়া উঠিল। আসিয়াছিল তাহারা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীতার সম্ভাবনায় সতর্ক ধীরতার সহিত সংযত পদক্ষেপ; কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে উচ্ছৃঙ্খল উল্লাস আত্মপ্রকাশ করিল বাধ-ভাঙা জলের মত। জমির উপরে লাঙলগুলাও এলোমেলো গতিতে যেন ছুটিয়া বেড়াইতেছিল। চাষীরা সব উল্লাসে গরুগুলিকে ছুটাইয়া যেন গরু-দৌড়-প্রতিযোগীতা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সমগ্র ভূমিখণ্ডটাকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া তাহারা দখল সম্পূর্ণ করিল।

রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির দুই নায়েবও উপস্থিত ছিল। এই মাতনের ছোঁয়া তাহাদিগকেও স্পর্শ করিয়াছিল। তাহারা দৃপ্ত উল্লাসে এইবার হুকুম দিল, কাট এইবার কালিন্দীর বাঁধ। পাইপ-টাইপ সব উখার দেও। উত্তেজনায় খানিকটা হিন্দীও বাহির হইয়া গেল।

লাঠিয়ালের দল গিয়া পড়িল বাধের উপর; এইবার তাহারা একটু সতর্ক এবং সংযত হইল। কলের কুলির দল অদূরে জটলা বাঁধিয়া বসিয়া আছে।

আশ্চর্যের কথা তাহারা কেহ আগাইয়া আসিল না। ইহারা বাঁধ কাটিয়া পাইপ ছাড়াইয়া তছনছ করিয়া দিল, তাহারা দর্শকের মত দাঁড়াইয়া দেখিল মাত্র। জনতা হইতে দূরে একটি গাছতলায় একা দাঁড়াইয়া একটা দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়েও সমস্ত দেখিতেছিল। এ-সবের কোন কিছুই তাহাকে স্পর্শ করিল না, এ-সমস্তের কোন অর্থই তাহার কাছে নাই।

মুখার্জি সাহেব কাল হইতে সারীকে বাংলোর আউটহাউস হইতে তাড়াইয়া দিয়াছেন; তাঁহার শখ মিটিয়া গিয়াছে। কুলী-ব্যারাকের মধ্যে সে এবার বসতি পাতিয়াছে। সরকারবাবু শূলপাণি রায় বাছিয়া বেশ একখানি ভাল ঘরই তাহাকে দিয়াছে। খুব তেজি পাকা হাঁড়িয়াও তাহাকে খাওয়াইয়াছে। তাহার মাথাটা এখনও কেমন করিতেছে। সে শুধু দেখিতেছিল, অনেক লোক; অনেক লোক, বাবা রে! রাঙাবাবু কই? না, সে নাই। সায়েব কই? লম্বা চোঙার মত বন্দুকটা লইয়া সে তো কই তাক্‌ করিয়া এখনও দাঁড়ায় নাই। বাবা রে!

* * *

সত্য সত্যই বিমলবাবু এত বড় উত্তেজিত আহ্ববানের উত্তরেও একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। কোন উদ্যমই তিনি প্রকাশ করিলেন না। তিনি যে প্রস্তুত ছিলেন না, তাহাও নয়। সংবাদ তিনি বেশ সময় থাকিতেই পাইয়াছিলেন। পূর্বদিন রাত্রির প্রথম প্রহরেই সংবাদটা তাঁহার কানে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল।

সংবাদ প্রথম আনিয়াছিলেন অচিন্ত্যবাবু। কথাটা কানে উঠিবামাত্র ভদ্রলোক ভীষণ চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। রায় মহাশয় ও চক্রবর্তী-বাড়ির লাঠিয়ালরা তো সামান্য জীব নয়, উহারা প্রত্যেকেই ডাকাত। নবীন বাগদীর এক লাঠির ঘায়ে সেই মুসলমান লাঠিয়ালের মাথাটি ডিমের মত ফাটিয়া গিয়াছিল; ইহারা সব তাহারই সাকরেদ দোসর। ও-দিকে মিস্টার মুখার্জির হিন্দুস্থানী কুলীর দল সাক্ষাৎ যমদূতের দল। তাহার উপর সাহেবের বন্দুকগুলা একেবারে তৈয়ারী হইয়াই থাকে। কোন রকমে তাগ ফস্কাইয়া যদি একটা বিপথে ছোটে, তবে যে কাহাকে খতম করিবে, সে কি বলিতে পারে? হরেকে তাগ করিয়া শঙ্করাকে মারাই বাঙালীর অভ্যাস। আর বাগদী-লাঠিয়ালের দল যদি আপিস চড়াও করে, তবে তো ভীষণ বিপদ! তিনি তৎক্ষণাৎ পরদিন ছুটি লইবার সঙ্কল্প করিলেন এবং সেই রাত্রেই নগদ দুই আনা পয়সা দিয়া একজন ডোম রক্ষক লইয়া বিমলবাবুর বাংলোয় হাজির হইলেন।

বিমলবাবু তখন সারীকে বাংলো হইতে তাড়াইয়া দিয়া সবে পঞ্চম পেগ লইয়া বসিয়াছেন। ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া তিনি প্রশ্ন করিলেন, কি ব্যাপার? রাত্রে?

একখানা দরখাস্ত আগাইয়া দিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, আজ্ঞে ছুটি সার।

ছুটি? কেন?

আজ্ঞে আমার স্ত্রী-সার-

কদিনের জন্যে?

দুদিনের আজ্ঞে, দু দিন সার।

এর জন্যে এই রাত্রে আপনি জ্বালাতে এসেছেন? ননসেন্স! দরখাস্তখানা তিনি ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন, তারপর বলিলেন, আচ্ছা, আসবেন না দু দিন।

অচিন্ত্যবাবু সবিনয়ে বলিলেন, আজ্ঞে, আরও একটা খবর আছে, জমিদারেরা ফৌজদারী করবার জন্যে সাজছে সার।

ফৌজদারী? বিমলবাবু এবার সজাগ হইয়া বসিলেন

সবিস্তারে সমস্ত বলিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, সেই জন্যেই আমার আরও আসা সার।

বিমলবাবু গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। অচিন্ত্যবাবু সরিয়া আসিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন।

গভীর চিন্তা করিয়া বিমলবাবু কোন উদ্যম প্রকাশ করিলেন না। সকাল হতেই যোগেশ মজুমদার এবং জমিদারবিদ্যা-বিশারদ হরিশ রায়কে লইয়া চার-পাঁচটি ফৌজদারী এবং দেওয়ানী মকদ্দমার আরজির খসড়া প্রস্তুত করাইতে বসিলেন।

* * *

ও -দিকে দীর্ঘকাল পরে চক্রবর্তী-বাবুদের কাছারী-বাড়ি গমগম করিয়া জাঁকিয়া উঠিল, চাষী-প্রজার দল ও বাগদী লাঠিয়ালেরা কাছারির বারান্দা পরিপূর্ণ করিয়া বসিল। নায়েব-গোমস্তারা ডেমিতে ভাগচাষের কবুলতি লিখিতেছে; ওই সব দখল-করা জমি চাষীদের ভাগচাষে বিলি হইবে। রায় প্রসন্ন তৃপ্ত মুখে বসিয়া আছেন, তাঁহার মনের গ্লানি অনেকখানি কাটিয়া গিয়াছে। প্রসন্ন মনেই তিনি নূতন কোন দ্বন্দের পরিকল্পনা চিন্তা করিতেছেন। মধ্যে মধ্যে ঘাড় হেঁট করিয়া চিন্তানিবিষ্ট মনে বোধ করি আপনার অজ্ঞাতসারেই মৃদু মৃদু দুলিতেছেন। সহসা একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের উচ্চ ধ্বনি কানে আসিয়া পৌঁছিল, মৃদু হাসিয়া তিনি সজাগ হইয়া উঠিলেন। কণ্ঠস্বরটি অচিন্ত্যবাবুর; কোন ব্যক্তিকে ধরিয়া বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি পথ দিয়া চলিয়াছেন; স্লো অ্যাণ্ড স্টেডি উইন্‌স্‌ দি রেস। ঈসপ্‌স্‌ ফেব্‌ল্‌ পড়েছ? দি হেয়ার অ্যাণ্ড দি টর্‌টয়েজের গল্প? ইংরেজের আইনে, নো লাঠি অ্যাণ্ড নো ফাটি। ব্রেন অ্যাণ্ড মানি এভ্‌রিথিং। পাঁচ-পাঁচ-খানি ফৌজদারী মকদ্দমা। অল বেস্ট প্লীডার্স এন্‌গেজ্‌ড্‌। সিরিয়াস চার্জ- রায়টিং, ট্রেসপাস, অ্যাণ্ড অনেক কিছু। এই চলল লোক লরিতে চড়ে।

রায় হাসিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিলেন, ও অচিন্ত্যবাবু! ও মশায়!

তাঁহার কথাকে ঢাকিয়া দিয়াই অচিন্ত্যবাবুর ত্বরিত উত্তর ভাসিয়া আসিল, আই ডোণ্ট নো এনিথিং-আই ডোণ্ট নো।

আরও অনেক কিছু তিনি বলিলেন, কিন্তু ক্রমবর্ধমান দূরত্ব হেতু সেগুলি এত অস্পষ্ট যে, তাহার কিছুই বুঝা গেল না। ইন্দ্র রায় কিন্তু এইটুকুতেই অনেক বুঝিলেন এবং খাড়া হইয়া বসিয়া গোঁফে তা দিতে আরম্ভ করিলেন।

মুহূর্ত চিন্তা করিয়া তিনি পাশের ঘরে প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন, মিত্তির!

প্রবীণ মিত্তিরও কথাগুলির কিছু কিছু বুঝিয়াছিল, সে তাড়াতাড়ি কাজ ছাড়িয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। রায় বলিলেন, সদরে যাবার পথে গ্রাম পেরিয়ে যে সাঁকোটা আছে-

পাকা নায়েব মুহূর্তে উত্তর দিল, আজ্ঞে, হ্যাঁ। তা হলে আর লরি যেতে পারবে না। আদ্ধেক খানা খসিয়ে দিলেই হবে। সে ব্যবস্থা আমি করছি। আমাদের চাষ-বাড়িতে গাঁইতি আছে, আধ ঘন্টায় কাজ হাসিল হয়ে যাবে।

রায় বলিলেন, সকলের চেয়ে যে ‘পাউড়ে’, তাকে পাঠাও সদরে। মুখুজ্জে, সেন আর সিংহীকে ওকালতনামার বায়না পাঠিয়ে দাও। ওদের চেয়ে ফৌজদারী উকিল আর ভাল কেউ নেই। আমাদের তরফ থেকে মামলা প্রথম দায়ের হয়ে যাক।

নায়েব লঘু দ্রুত পদে বাহির হইয়া গেল।

রায় ফিরিয়া আসিয়া বসিলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার দুলিতে আরম্ভ করিলেন।

বাড়ির ভিতরে বিবাহের গোলযোগ তখনও প্রায় পূর্ণমাত্রায় বর্তমান। বউভাত মিটিয়া গিয়াছে, আজ বাসি-ভোজ; পরিবেশক, ঠাকুর-চাকর আত্মীয়-বন্ধু-স্বজনবর্গকে ভাল করিয়া খাওয়ানো হইবে। তাহার সঙ্গে এই দাঙ্গার সমস্ত লোকগুলিকেও খাওয়ানোর ব্যবস্থা হইয়াছে। বিবাহের ভাণ্ডারে গ্রামেরই কয়েকজন পাকা দোকানদার ভাণ্ডারীর কাজ করিতেছে। তাহারা লোক হিসাব করিয়া জলখাবার মাপিতে ব্যস্ত। মানদা চীৎকার করিয়া ফিরিতেছে, বাড়ির মধ্যে দাঙ্গার উত্তেজনাটাকে সে একাই বজায় করিয়া রাখিয়াছে। হেমাঙ্গিনী সমস্ত দিনের তদ্বির-তদারক করিতেছেন। সুনীতি সমস্ত সকালটা প্রাণহীণ প্রতিমার মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন। ওই চরটার কথাই তিনি ভাবিতেছিলেন। তিনি কল্পনা করিতেছিলেন, চরের মাটি রক্তমাখা; দাঙ্গায় নিহত মানুষের হাত-পা দেহ-মাথা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়া আছে। বার বার তাহার অন্তরাত্মা প্রশ্ন করিতেছে, এ পাপ কাহার? সঙ্গে সঙ্গে সভয়ে তাহার চোখ আপনি যেন বন্ধ হইয়া আসিতেছে।

মানদা আসিয়া দর্পিত কণ্ঠে সংবাদ দিল, দাঙ্গায় আমরা জিতেছি মা। ওরা কেউ আসে নাই ভয়ে, ল্যাজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকেছে সব। -বলিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া সে গড়াইয়া পড়িল।

পরম আশ্বাসের একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সুনীতি যেন দুঃস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিলেন, তা হলে খুন-জখম কিছু হয়নি, না রে মানদা?

হেমাঙ্গিণী মানদার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি হাসিয়া কহিলেন, না ভাই। তুমি এবার ওঠ দেখি, উঠে ঠাকুর-জামাইয়ের স্নান-টানের ব্যবস্থা কর। উমা হাজার হলেও ছেলেমানুষ, তার ওপর জানাশোনাও তো নেই কিছু।

সুনীতা হাসিমুখে উঠিলেন, বলিলেন, আহা দিদি, মানুষের জীবন গেলে তো আর ফেরে না। সারা সকালটা আমার বুকে কে যেন পাষাণ চাপিয়ে দিয়েছিল।

নীচে ইন্দ্র রায়ের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কই রে, উমা কোথায় গেলি? তোর শ্বশুর কি করছেন রে?

উমার অপেক্ষা না করিয়াই তিনি উপরে উঠিয়া আসিয়া রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চ হাসির সঙ্গে শোনা গেল, ফৌজদারী মামলা করে কলওলা আমাদের জব্দ করবে!–বলিয়া অবজ্ঞাপূর্ণ কৌতুকে উচ্ছ্বসিত হাসি-হা-হা-হা-হা।

সে হাসির শব্দ নীচে বাগদী লাঠিয়ালদের কলরব মিশিয়া সমস্ত মহলটা যেন গমগম করিয়া উঠিল। ভাণ্ডারের দুয়ারে তাহারা জলখাবার লইতে আসিয়া গোলমাল করিতেছিল। মানদা রেলিঙের উপর বুক দিয়া ঝুঁকিয়া বলিল, খুব তো চেঁচাচ্ছিস সব! সেই বিভীষণ মজুমদারের একটা ঠ্যাং ভেঙে দিয়ে আসতিস, তবে বুঝতাম। কিংবা একপাটি দাঁত-

বলিতে বলিতে সে সসম্ভ্রমে সঙ্কুচিত হইয়া চুপ হইয়া গেল।

ভারি গলায় কণ্ঠনালী পরিস্কার করিয়া লওয়ার উচ্চ গম্ভীর শব্দ জানাইয়া দিল রায় বাহির হইয়া আসিতেছেন। রায় ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ডাকিলেন, উমা!

মানদা ত্রস্তপদে গিয়া উমাকে ডাকিয়া দিল। উমা আসিয়া বাপের সম্মুখে দাঁড়াইতেই সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইয়া রায় বলিলেন, খুব যে বউ সেজে গেছিস মা! তোকে একেবারে দেখবারই জো নেই।-বলিয়া উমার মুখের দিকে চাহিয়া তিনি যুগপৎ বিস্মিত এবং শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। উমার মুখ নিশান্তের জ্যোৎস্নার মত সকরুণ পাণ্ডুর। পরমুহূর্তেই মনে পড়িল, কাল রাত্রে ফুলশয্যা গিয়াছে। হাসিয়া বলিলেন, তোর শাশুড়ীকে বল্‌ মা, রামেশ্বরের স্নান-আহ্নিকের ব্যবস্থা করে দিন। দুর্বল শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তোরাও স্নান-টান করে সব বিশ্রাম কর্‌।

উমাকে রামেশ্বরের পরিচর্যার জন্য বলিবেন সঙ্কল্প করিয়া ডাকিয়াছিলেন। কিন্তু উমার এমন ক্লান্ত ভঙ্গি দেখিয়া সুনীতিকে ডাকিবার জন্য বলিলেন। গত রাত্রির রামেশ্বর আজ আর নাই, রায়ের উচ্চ হাস্য, উল্লাস তাঁহাকে স্পর্শও করিতে পারে নাই। রোগ যেন আজ বাড়িয়া গিয়াছে।

রায় সত্য দেখিয়াও ভ্রম করিলেন। উমার মুখ সত্যই সকরুণ পাণ্ডুর, কিন্তু সে ফুলশয্যার রজনীর আনন্দে অবসাদে নয়। গোপন অন্তরে নিরুদ্ধ সুগভীর অভিমান ও দুঃখের দাহে তাহার মুখের লাবণ্যের সজীবতা এমন শুকাইয়া গিয়াছে। জীবনের প্রথম মিলন-বাসরে অহীন্দ্রের মধ্যে সে পরম বাঞ্ছিত জনকে খুঁজিয়া পায় নাই, এমন কি এতদিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু-অহীন্দ্রেরও দেখা পায় নাই। স্তব্ধ উদাসীন, এ যেন অস্বাভাবিক অপরিচিত এক অহীন্দ্র! দৃষ্টিপত অবরোধ করিয়া দাঁড়াইয়াও তাহার দৃষ্টিতে পড়া যায় না। সকাল হইতে এতটা বেলা পর্যন্ত বাহিরের বারান্দায় সে পায়চারি করিতেছে, কত বার তাহার দৃষ্টির সাথে তাহার দৃষ্টি মিলিয়াছে, উমার দৃষ্টি সুস্পষ্ট অভিমানের বার্তা জানিয়াছে, কিন্তু অহীন্দ্রের দৃষ্টি যেন বধির মূক হইয়া গিয়াছে; কোন বার্তা সে -দৃষ্টির গোচরে আসে নাই, কোনও উত্তরও দিতে পারে নাই।

মানদা অদূরে দাঁড়াইয় ছিল, রায় নীচে চলিয়া যাইতেই বলিল, চলুন বৌদিদি, চান করবেন চলুন। মুখ আপনার বড্ড শুকিয়ে গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *