কালিন্দী – ২৯

২৯

ইন্দ্র রায় বউভাত উপলক্ষ করিয়া আবার সাঁওতালদের নিমন্ত্রণ করিলেন।

কিন্তু সে নিমন্ত্রণও সাঁওতালরা গ্রহণ করিতে সাহস করিল না। শুভার্থী সকলেই নিষেধ করিয়াছিল, হেমাঙ্গিনী বার বার বলিয়াছিলেন, দেখ আমি বারণ করছি, ও তুমি করো না। বিয়ের রাত্রে যখন আসতে দেয় নি ওদের, তখন আবার নেমন্তন্ন করে বেচারাদের বিপদে ফেলা কেন? ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।’

সুনীতি সকরুণ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিয়াছিলেন, ঝগড়া বিবাদ করে কাজ নেই দাদা।

ইন্দ্র রায় কাহারও কথায় কর্নপাত করিলেন না, চোখ বুঝিয়া গভীর চিন্তায় কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া ধীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া অনুরোধ অস্বীকার করিলেন, বলিলেন, উলুখাগড়ার প্রাণ যায় বলে দুঃখ করছ, কিন্তু ও মিথ্যে দুঃখ। এমনি ভাবে মরবার জন্যেই উলুখাগড়ার সৃষ্টি। তিনি হাসিলেন।

হেমাঙ্গিনী, সুনীতি দুজনেই ইন্দ্র রায়ের হাসির ভঙ্গি দেখিয়া নীরব হইয়া রহিলেন; ক্ষুরের মতই ক্ষুদ্রপরিসর এবং মর্মান্তিক তীক্ষ্ণধার সে হাসি। ধীরে ধীরে সে হাসিটুকু রায়ের মুখ হইতে মিলাইয়া গেল। গম্ভীরভাবে আবার বলিলেন, এ-সংসারে যার ইজ্জত নেই, তার জাত নেই। এ হল চক্রবর্তী-বাড়ি রায় -বাড়ির ইজ্জত নিয়ে কথা, এ ব্যাপারে তোমরা কথা বলো না।

তিনি ও-পারের চরে নিমন্ত্রণ পাঠাইলেন, শুধু সাঁওতালদের নিকটই নয়, চরের সকলের নিকট- এমন কি বিমলবাবুর নিকট পর্যন্ত। নিমন্ত্রণ লইয়া গেল একজন গোমস্তা ও একজন পাইক। বিমলবাবু ব্যাতীত সকলের নিকট মৌখিক নিমন্ত্রণই পাঠানো হইল, কেবল বিমলবাবুর নিকট পাঠানো হইল একখানি পত্র।

চূড়া মাঝি বিব্রত হইয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; অন্যান্য সাঁওতালরা নীরব চিন্তান্বিত মুখে চূড়ার দিকে চাহিয়া রহিল, মুখরা মেয়েগুলি শুধু মৃদুস্বরে আপনাদের মধ্যে দুই-চারিটা কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিল।

গোমস্তাটি বলিল, যাস যেন সব, বুঝলি?

এতক্ষণে চূড়া বলিল, কি করে যাব গো বাবু? দু বেলা খাটতে হচ্ছে যি সাহেবের কলে।

গোমস্তা একটু হাসিয়া বলিল, ভাল। যাস নে তা হলে। আর কোন কথা না বলিয়া সে চলিয়া আসিল। কিছুদূর সে আসিয়াছে এমন সময় পিছন হইতে চূড়া তাহাকে ডাকিল, বাবু মশায়! গোমস্তাবাবু!

কি?

বাবু মশায়, সায়েব যি রাগ করেছে গো, বুলছে-তুদের বাড়ি গেলে পরে ইখান থেকে তাঁড়িয়ে দেবে।

আচ্ছা, তাই বলব আমি কর্তাবাবুকে।

চূড়ার বুক ভয়ে কাঁপিয়া উঠিল, সে বলিল, না গো বাবু মশায়; তা বুলিস না গো; সায়েব রাগ করবে গো।

গোমস্তা কোন উত্তর দিল না, অতি অবজ্ঞা ও ঘৃণার হাসি হাসিয়া সে চলিয়া গেল। চূড়া হতভম্বের মত দাঁড়াইয়া রহিল, ভয়ে তাঁহার পা দুইটি ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছে ; আঃ, কেন এ কথাটা সে উহাকে বলিল?

সাঁওতালরা আসিল না।

শুধু আসিল না নয়, সন্ধ্যা হইতেই চরের বুকে মাদল, করতাল ও বাঁশীর সমবেত ধ্বনিতে একটি উৎসবের বার্তা ঘোষণা করিয়া দিল। বিমলবাবু পাকা ব্যবসায়ী লোক; এই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিতে সাঁওতালদের মনঃক্ষুণ্ণতার কথা তিনি বেশ বুঝিয়াছিলেন। তিনি অপরাহ্নে তাহাদের ডাকিয়া প্রচুর পরিমানে মদের এবং দুইটা শূকরের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন, বলিলেন খুব নাচগান করতে হবে তোদের।

হাঁড়িয়ার কথা শুনিয়া প্রথমটা কেহ উৎসাহ প্রকাশ করিল না, চুপ করিয়া এ উহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

বিমলবাবু ব্যাপার বুঝিয়াও কোন কথা বলিলেন না, একেবারে অ্যাকাউণ্ট্যান্ট অচিন্ত্যবাবুকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, একখানা দশ টাকার ভাউচার করুন তো। সাঁওতালদের বকশিশ। আর মদের দোকানের ভেণ্ডারকে একখানা স্লিপ লিখে দিন, সাঁওতালদের যে যত মদ খেতে পারে মদ দেয় যেন-আপ-টু-টেন রুপীজ।

টাকাটা হাতে পাইয়া সাঁওতালদের মন ঈষৎ চাঙ্গা হইয়া উঠিল। তারপর মদের দোকানে আসিয়া তাহারা পরস্পরের মধ্যে খানিকটা জোর তর্ক আরম্ভ করিয়া দিল; কেহ কাহারও কথার প্রতিবাদ করিতেছিল না, অথচ উত্তেজিত কলরবে তুমুল তর্ক। সকলেই বলিতেছিল।

রাঙাবাবু কি বুলবে?

উয়ার শ্বশুরটি? বাবা রে বাঘের মতন তাকানি উয়ার। উ কি বুলবে?

রাগ করবে, ধরে লিয়ে যাবে। তখুন কি হবে?

ইধরে সায়েব রাগ করছে। বাবা রে, উ তো কম লয়। উয়ার আবার বন্দুক আছে, মেরে ফেলাবে গুলি দিয়ে।

এই তর্কের মধ্যেই মদ আসিয়া পৌঁছিল। কিছুক্ষণ পর তাহাদের তর্ক ভীষণাকার ধারণ করিল, উচ্চকণ্ঠে আস্ফালন করিয়া সকলেই বলিতেছিল, কি করবে রাঙাবাবুর শ্বশুর আমাদের? আমরা উয়াকে মানি না।

আমাদের সায়েব রইছে, উয়াকেই আমরা মানব, হেঁ।

অতঃপর মেয়েদের জন্য প্রকাণ্ড জালাতে করিয়া মদ লইয়া তাহারা পাড়ায় ফিরিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাদল-করতাল-বাঁশী বাজাইয়া প্রচণ্ড উৎসাহে নাচগান জুড়িয়া দিল।

* * *

ও-দিকে বউভাতের খাওয়ান-দাওয়ানের জের তখনও মেটে নাই, তবে প্রধান অংশ শেষ হইয়া আসিয়াছিল। ইন্দ্র রায় এখন কেবল পরিবেশন-কারীর দল ও ঠাকুর-চাকরদের খাওয়ানোর তদারক করিতেছেন। মাদল-করতাল-বাঁশীর উচ্ছ্বসিত ধ্বনি আসিয়া কানে প্রবেশ করিতেই তিনি গম্ভীর হইয়া উঠিলেন। মনে মনে ব্যাপারটা তিনি অনুমান করিয়া লইলেন

অমল কর্মান্তরে ব্যস্ত ছিল, তাহাকে ডাকিয়া খাওয়ান-দাওয়ানের ভার দিয়া তিনি রামেশ্বরের ঘরের গিয়া প্রবেশ করিলেন। রামেশ্বর খোলা জানলায় দাঁড়াইয়া কৃষ্ণা-দ্বিতীয়ার প্রায়-পূর্ণচন্দ্রের পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় আলোকিত উন্মত্ত সঙ্গীত-মুখর ওই চরটার দিকেই চাহিয়া ছিলেন।

রায় ডাকিলেন, রামেশ্বর!

রামেশ্বর চমকিয়া উঠিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, কে?

আমি ইন্দ্র।

ইন্দ্র! এস, এস ভাই। খাওয়ান-দাওয়ান সব হয়ে গেল?

হ্যাঁ। আমি নিজে দাঁড়িয়ে সব শেষ করে তোমার কাছে আসছি। যারা কাজকর্ম করেছে, তারাই খাচ্ছে এখন; অমল দাঁড়িয়ে দেখছে সেখানে।

রামেশ্বর অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া ডাকিলেন, বউমা! বউমা!

রায় হাসিলেন, উমার শ্বশুর উমাকে ডাকিতেছেন! বধূবেশিনী উমা আসিয়া ঘরে ঢুকিয়া বাবাকে দেখিয়া একটু হাসিল, হাসিয়া শ্বশুরের কাছে দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে বলিল, আমাকে ডাকছিলেন?

রামেশ্বর বলিলেন, হ্যাঁ রে বেটী, হ্যাঁ। আমার মা হয়ে তোর কোন বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই! দেখছিস না, কে এসেছেন! সমস্ত দিন তোর বাড়িতে খাটলেন, এখনও মুখে জল দেন নি। দে, হাত-পা-মুখ ধোবার জল দে। খাবার জায়গা করে দে। এ ঘরে নয়, অন্য ঘরে-অন্য ঘরে। চকিত তাঁহার দৃষ্টি একবার আপনার হাত দুইখানির দিকে নিবদ্ধ হইয়া আবার ফিরিয়া আসিল।

রায় হাসিয়া বলিলেন, হাত-মুখ আমি ধুয়েছি; খাবার জায়গা করতে নেই, ও থাক!

চকিত হইয়া রামেশ্বর প্রশ্ন করিলেন, কেন, ইন্দ্র খাবার জায়গা করতে নেই কেন?

তুমি একটা মূর্খ। রায় হাসিয়া বলিলেন, কাকে কোলে করে খেতে বসব? দাঁড়াও আমার দাদুভাইয়ের আগমন হোক, তবে তো!

বার বার ঘাড় নাড়িয়া রায়ের কথা স্বীকার করিয়া রামেশ্বর বলিলেন, বটে, বটে। তুমি যেদিন দাদুভাইকে কোলে নিয়ে খেতে বসবে ইন্দ্র, সেদিন যে আমার ঘরের কি শোভাই হবে হে, আমি কল্পনাই করতে পারছি না। কবি কালিদাসও এর উপমা দিয়ে যান নি। কুমার কার্তিকেয়কে গিরিরাজের কোলে দিয়ে তিনি দেখেন নি। সূর্যবংশের রাজারা তো পুত্র উপযুক্ত হলে আর গার্হস্থ্যাশ্রমে থাকতেন না। আমাকেই একটা শ্লোক রচনা করতে হবে দেখছি।

উমা একালের মেয়ে হইলেও বাঙালীর মেয়ে- সে লজ্জায় ঘামিয়া উঠিতেছিল। লজ্জার রক্তোচ্ছ্বাসে তাহার সুন্দর মুখের প্রসাধন-শুভ্রতাও রক্তাভ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার উপর সারাটা মুখ ভরিয়া বিন্দু বিন্দু ঘাম। ইন্দ্র রায় তাহাকে পরিত্রাণ দিলেন, তিনি বলিলেন, উমা, যা মা, তোর শাশুড়ির খাওয়া-দাওয়া হল কিনা দেখ্‌। তোর মাকেও বল্‌, একটু তাড়াতাড়ি সেরে নিতে।

উমা পলাইয়া আসিয়া যেন বাঁচিল, ঘর হইতে বাহির হইয়া দরদালানের নির্জনতায় আসিয়া পুলকিত সলজ্জ হাসিতে তাহার মুখ ভরিয়া উঠিল।

বাড়িতে বাহিরের দিকের টানা বারান্দায় রেলিঙের উপর মাথা রাখিয়া সুনীতি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ হইয়া গেলে তিনি অবসর পাইয়া কাঁদিতে আসিয়া ছিলেন মহীনের জন্য।

তাঁহার মহীন-দীর্ঘদেহ, সবলপেশী, উদ্ধতদৃষ্টি, উন্নতিশির মহীন্দ্র।

প্রথমে তো তাহারই বধূর কল্যাণঘট কাঁখে করিয়া এ-ঘরে প্রবেশ করিবার কথা। অহীন্দ্রের বিবাহে, তাহারই দৃপ্ত উচ্চ আদেশ-ধ্বনিতে এ-বাড়ির প্রতিটি কোণ মুখরিত হইয়া থাকিবার কথা।

এ সর্বনাশ না হইলে হতভাগ্য ননী পালও আজ এ বাড়িতে খাইয়া হাসিমুখে বলিত, আঃ খুব খেলুম বাপু।

বেচারা নবীন বাগদী আর তাহার সঙ্গী কয়েকজনকে তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। সেই অজানা মুসলমান লাঠিয়ালটি যে নবীনের লাঠির আঘাতে মরিয়াছে, সে থাকিলে সেও আজ আসিয়া বকশিশ হইয়া যাইত, লুচি মিষ্টি খাইয়া যাইত।

একটা সুগভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সুনীতি চন্দ্রালোকিত চরটার দিকে চাহিলেন। আজও সাঁওতালরা খাইতে আসে নাই; কলের মালিকও খাইতে আসেন নাই; ও-বাড়ির দাদার মুখ থমথমে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। তাহার উপর মাদল-করতাল-বাঁশী বাজাইয়া এ উহারা করিতেছে কি? না না না, এটা উহারা বিষম অন্যায় করিতেছে। স্তব্ধ হইয়া তিনি চরটার দিকে চাহিয়া রহিলেন। এত উচ্চ রূঢ় বাজনা কখনও বাজে না। বিরোধ বাধাইতে উহারা কি বদ্ধপরিকর হইয়া উঠিয়াছে? ডঙ্কা বাজাইয়া চরটা যেন যুদ্ধ ঘোষণা করিতেছে! আতঙ্কে তিনি শিহরিয়া উঠিলেন। পায়ের তলায় বাড়িটা যেন দুলিয়া উঠিল, চোখের সম্মুখে চরটা ঘুরিতেছে।

উমা আসিয়া তাহার কাছে দাঁড়াইল।

সুনীতি মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিলেন, উমা? বউমা?

অন্ধকারের মধ্যে মৃদু হাসিয়া উমা বলিল, আপনি খাবেন আসুন মা। পরক্ষণেই এই গিন্নীপনার জন্য লজ্জা অনুভব করিয়া সে বলিল, মা নীচে ডাকছেন আপনাকে। এই মা অর্থে তাহার মা হেমাঙ্গিনী

সুণিতি যেন উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। বিচলিত মস্তিষ্কের রক্তের চাপে স্নায়ু-শিরার চাঞ্চল্যে চরটাকে তিনি ঘুরিতে দেখিয়াছেন! এই মাদল ও করতালের উচ্চ ধ্বনির মধ্যে তিনি যুদ্ধোদ্যমের ঘোষণা শুনিয়াছেন, তাঁহার ধরিত্রীর মত সহিষ্ণু মনও আজ থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। এই মুহূর্তেই সম্মুখে বধূকে দেখিয়া সে কম্পন-চাঞ্চল্য যেন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। অহীন্দ্রের জন্য তিনি ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন, কোনমতেই তাহাকে সঙ্ঘর্ষের সম্মুখীন হইতে তিনি দিবেন না। যেমন করিয়া হউক তিনি নিবারণ করিবেন। ও-বাড়ির দাদার পায়ে তিনি উমাকে ফেলিয়া দিবেন। অহীন্দ্রের গৃহদ্বারে দুই বাজুতে হাত দিয়া পথরোধ করিয়া তিনি নিজে দাঁড়াইবেন।

উমা আবার ডাকিল, মা?

উত্তরে সুণিতি প্রশ্ন করিলেন, অহীন কোথায় বউমা?

উমা লজ্জিত হইয়া চুপ করিয়া রহিল। সুনীতি উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই বাহির হইয়া গেলেন।

অহীন্দ্র পড়ার ঘরে বসিয়া ছিল। একখানা মোটা বইয়ের মধ্যে আঙুল পুরিয়া মানদার মুখের দিকে চাহিয়া হাসিমুখে তাহার তিরস্কার শুনিতেছিল।

মানদা তাহাকে তিরস্কার করিতেছিল, না বাপু, এ কিন্তু আপনার ভাল কাজ নয় দাদাবাবু, সে আপনি যাই বলুন-হ্যাঁ। আজকে হল মানুষের জীবনের একটা দিন। আজ পাঁচজনা মেয়েছেলে এসেছে, ঠাট্টা-তামাসা করবে, গান করবে, ছড়া কাটবে, আপনার গান শুনবে সব। ফুলশয্যের দিন। আর আপনি ইয়া মোটা বইয়ের ভিতর মুখ গুঁজে বসে রয়েছেন।

অহীন্দ্র কোন উত্তর দিল না, মৃদু হাসিমুখেই তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। মানদা কোন উত্তর না পাইয়া আবার বলিল, বলি, উঠবেন কি না, বলুন? উঠে আসুন, কাপড় ছাড়বেন, মেয়েরা সব গজগজ করছে।

সুনীতি আসিয়া প্রবেশ করিলেন, মানদা অভিযোগ করিয়া বলিল, এই দেখুন, আজকের দিনে একখানা মোটা বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে বসে রয়েছেন। এলাম যদি, তা মানুষের খেয়াল নাই। কি রস যে ওই কালির হিজিবিজির মধ্যে আছে, কে জানে বাপু!

সুনীতি বলিলেন, চল্‌ তুই মানদা, আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে।

মানদা ঝঙ্কার দিয়া ঊঠিল, নাও হল। আপনি আবার ধর্মকথা আরম্ভ করুন এখন এক পহর! ও দিকে মেয়েরা সব চলে যাক।

না রে, না। চল্‌ তুই, আমি এলাম বলে ওকে নিয়ে। এই উদ্‌ভ্রান্ত মনেও সুনীতি মানদার স্নেহের শাসনে হাসিয়া আনুগত্য না জানাইয়া পারিলেন না।

অহীন্দ্রও মনে করিল সুনীতি তাহাকে ডাকিতেই আসিয়াছেন, সে বইখানার মধ্যে সুদৃশ্য কাগজের লম্বা টুকরা দিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিল, বলিল, যাচ্ছি মা আমি। তারপর মৃদু হাসিয়া বলিল, বইখানা বড় ভাল বই, পড়তে বসে আর ছাড়তে ইচ্ছে যায় না।

কি বই রে?

পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ট মনীষীর লেখা মা, জাতিতে তিনি জার্মান, তাঁর নাম কার্ল মার্ক্‌স। আমরা যাঁদের বলি ঋষি, তিনি তাই। পৃথিবীর এই যে ছোট-বড় ভেদাভেদ, কোটি কোটি লোকের দারিদ্র আর মুষ্টিমেয় ধণীর বিলাস, রাজ্যসম্পদ নিয়ে এই যে হিংস্র পশুর মত মানুষের কাড়াকাড়ি, তিনি তার কারণ নির্ধারণ করেছেন এবং নিবারণের উপায়-পথ নির্দেশ করে দিয়েছেন

সুনীতি মুগ্ধবিস্ময়ে ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। পৃথিবী জুড়িয়া সম্পদ লইয়া কাড়াকাড়ি, মানুষে মানুষে হিংসা দ্বেষ, কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র-নিবারণের উপায়। কয়েক মুহূর্ত পর তিনি অভিভূতের মত বলিলেন, সে-উপায় তবে কেন মানুষ নেয় না, অহী?

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, সে-পথে বাধার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে জমিদার আর ধনীর দল মা- আমরা, ওই বিমলবাবু। আমার এই প্রভুত্ব, এই পাকা বাড়ি, জমিদারী চাল, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তা হলে যে থাকবে না মা। সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি যা করি, আমরাই তো করি, নিরীহ গরীবের সম্পত্তি অর্থ কেড়ে নিয়ে আমরাই তো তাদের গরীব করে দিই। ওই চরটার কথা ভাল করে ভেবে দেখ, তা হলেই বুঝতে পারবে। চর উঠল নদীর বুকে, একেবারে নতুন এক টুকরা মাটি-

সুনীতি মধ্য পথেই বাধা দিয়া বলিলেন, আমি ওই চরের কথাই তোকে বলতে এসেছি অহি। চর নিয়ে যে আবার বিরোধ বেধে উঠল বাবা।

অহীন্দ্র হাসিল, স্বল্পায়তন তিক্ত হাসি। বলিল, বিরোধ তো বাধবেই মা। একদিকে জমিদার অন্যদিকে মহাজন। এ বিরোধ যে অবশ্যম্ভাবী।

সুনীতি আর্তভাবে বলিলেন, ওরে, ও-চরে আমাদের কাজ নেই, তুই বল্‌ তো শ্বশুরকে, ওটা বিক্রি করে দিন। ওই চর আমার সর্বনাশ করবে রে!

অহীন্দ্র বলিল, ও-কথাটা তোমার স্বীকার করতে পারলাম না। অপরাধ চরের নয়, অপরাধ আমাদের।

তুই জানিস নে অহীন, সে তোরা বুঝতে পারিস নে, সে তোরা দেখতে পাস নে। আমি বুঝতে পারি, দেখতে পাই-সুনীতি বিহ্বল দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন, যেন সে দৃষ্টির সম্মুখে চরটার রহস্যময় রূপ প্রত্যক্ষ হইয়া শূন্যলোকে ভাসিতেছে।

মায়ের সে ভয়কাতর বিবর্ণ মুখ দেখিয়া অহীন্দ্র স্নেহার্দ্র স্বরে বলিল, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন মা? কিসের ভয়?

ওরে তুই বল চরটা বিক্রি করে দেওয়া হোক। আর, তুই যেন এই দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্যে যাস নে বাবা। ওরে, তোদের বংশের রাগকে আমি বড় ভয় করি রে! রাগের বসে মহীন কি সর্বনাশ করলে, বল্‌ দেখি?

অহীন্দ্র চুপ করিয়া রহিল। তাহার চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল ননী পালের রক্তাক্ত দেহ। তারপরেই সে দেখিল, কাঠগড়ার মধ্যে তাহার দাদাকে, শীর্ণ কিন্তু দৃপ্ত মুখ, অনবনত ঋজু দেহ। একটা উন্মাদনা তাহাকে স্পর্শ করিল। ওই কুটিলচক্রী কলওয়ালা, যাহাকে সাঁওতাল -রমণীরা বলিয়াছে পাহাড়ে চিতি, নিষ্ঠুর অজগর, উহার দেহটা যদি সে এমনি ভাবে লুটাইয়া দিত।

সুনীতি কাতরস্বরে ডাকিলেন, অহীন!

অহীন্দ্র মায়ের মুখের দিকে চাহিল। সুনীতি বলিলেন, চল্‌, তুই একবার চল, তোর বাপ ও-বাড়ির দাদা বোধ হয় ওই চরের কথাই বলছেন। তুই চল্‌।

* * *

রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিয়া মাতা পুত্রে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। রামেশ্বরের সে মূর্তি অদ্ভুত! অহীন্দ্র জীবনে কখনও দেখে নাই, সুনীতি বহুপূর্বে দেখিয়াছিলেন, এ-কালে সে মূর্তি আর স্মরণেও আনিতে পারিতেন না। ন্যুব্জদেহ তিনি সোজা খাড়া করিয়া দাঁড়াইয়াছেন লোহার খুঁটির মত শীর্ণ হাতের আঙুলগুলি বাঁকাইয়া তীক্ষ্ণ দৃঢ় বাঘনখের মত ভংগি করিয়া রায়কে তিনি বলিতেছেন, মুণ্ডুটা তার ছিঁড়ে আনতে পারা যায় না ইন্দ্র, কিংবা আমাবস্যার রাত্রে মা-সর্বরক্ষার কাছে বলি-?

রায় বলিলেন, না। সে-কাল আর নেই রামেশ্বর; এখন আমাদের আইনের পথ ধরেই চলতে হবে। আইন বাঁচিয়ে দাঙ্গা করতে পেলে পেছুব না। আমাদের খাসের জমি, সেগুলো সাঁওতালদের ভাগে দেওয়া আছে, কালই সেগুলো দখল করতে হবে। সাঁওতালদেরও রীতিমত শিক্ষা দেব আমি। আর ওই যে বললাম, কালিন্দীর বুকে কলওয়ালা যে বাঁধ দিয়ে পাম্প বসিয়েছে, ওটাকে তুলে দিতে হবে। বাধবে, দাঙ্গা ওইখানেই বাধবে বলে বোধ হচ্ছে।

অহীন্দ্র বলিল, মা একটা কথা বলছেন। তিনি চান না যে, চর নিয়ে কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়। তাঁর একটা অদ্ভুত সংস্কার রয়েছে যে, চরটা থেকে কেবল আমাদের অমঙ্গলই হচ্ছে! সেইজন্য তিনি বলেছেন, চরটাকে বিক্রি করে দেওয়া হোক।

বজ্রগর্ভ স্বরে রামেশ্বর বলিলেন, না।

প্রচণ্ড উত্তেজনায় দৈহিক দুর্বলতা মানসিক বিহ্বলতা বিলুপ্ত হইয়া রামেশ্বর অকস্মাৎ যেন পূর্ব-রামেশ্বর হইয়া উঠিয়াছেন।

রায় বলিলেন সুনীতিকে লক্ষ্য করিয়া, তোমার কাছে আমি এই কথাটা শুনব প্রত্যাশা করি নি বোন। যাক, তুমি কোন ভয় করো না, যা করবার আমি করব।

ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিতেই অমলের সঙ্গে দেখা হইল, অমল হাত-পা ধুইয়া তাহার সন্ধানেই উপরে আসিয়াছিল। তাহার স্বাভাবিক মুখরতা আজ আবার উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছে। সে বলিল, বাপ রে বাপ রে, খুব খাটিয়ে নিলে যা হোক। আমার বিয়েতে আমি এর শোধ নেব, দাঁড়াও না।

অহীন্দ্র একটু হাসিল-অর্থহীন হাসি। অমলের কথাগুলি তাহার মনের মধ্যে প্রবেশ করিতে পায় নাই। সে বলিল, চর নিয়ে আবার দাঙ্গা বাধল- কাল সকালে।

অমল বলিল, দাঙ্গা-টাঙ্গা না করে ওই লোকটাকে- দ্যাট কলওয়ালাটাকে হুইপ করা উচিত।

অহীন্দ্র আবার একটু হাসিল। অমল বলিল, বিয়েটা না চুকতেই এখনই দাঙ্গাটাঙ্গাগুলো না করলেই হত। কিন্তু না করেই বা উপায় কি? লোকটা যেন দণ্ডমুণ্ডের মালিক হয়ে উঠেছে।

অহীন্দ্র হাসিয়া এবার বলিল-

বণিকের মানদণ্ড দেখা দিবে, পোহালে শর্বরী

রাজদণ্ডরূপে।

সুতরাং তার গতিরোধের চেষ্টা রাজকুলের স্বাভাবিক।

অমল হাসিয়া বলিল, তুমি যেন নিজেকে রাজকুল থেকে বাদ দিতে চাইছ মনে হচ্ছে। বুদ্ধদেব হয়ে উঠলে যে! ওরে উমা!

হাসিয়া বাধা দিয়া অহীন্দ্র বলিল, ভয় নেই, এ-যুগে গৌতমেরা সংসার ত্যাগ করে নির্বাণের জন্য বনে যান না। এ-যুগের নির্বাণ নিহিত আছে সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে। ঘরে বসেই সে তপস্যা করে। সুতরাং উমা নামধারিণী গোপাকে ডেকে সাবধান করার কোন প্রয়োজন নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *