কালিন্দী – ২২

২২

এ দিকে গ্রামের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড জটলা পাকাইয়া উঠিল। সকাল হইতে না হইতে গ্রামের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত রটিয়া গেল, ও-পারের চরের উপর চিনির কল বসিতেছে। খাস কলিকাতা হইতে এক ধনী মহাজন আসিয়াছেন, তিনি সঙ্গে আনিয়াছেন প্রচুর টাকা-ছোট একটি ছালায় পরিপূর্ণ এক ছালা টাকা। সঙ্গে সঙ্গে রায়বংশের অন্য সমস্ত শরিকেরা একেবারে লোলুপ রসনায় গ্রাস বিস্তার করিয়া জাগিয়া উঠিল। অপরদিকে উর্বর-জমি-লোলুপ চাষীর দল বাঘের গোপন পার্শ্বচর শৃগালের মত জিভ চাটিতে চাটিতে চঞ্চল হইয়া উঠিল। সর্বপ্রথম নবীন বাগদীর স্ত্রী মতি বাগদিনী শিশু পৌত্রকে কোলে করিয়া চক্রবর্তী-বাড়ির অন্দরের উঠানে আসিয়া দাঁড়াইয়া চোখ মুছিতে আরম্ভ করিল।

সংবাদটা শুনিয়া রংলাল বাড়ি ফিরিয়া অকারণ স্ত্রীর সহিত কলহ করিয়া প্রচণ্ড ক্রোধে লাঠির আঘাতে রান্নার হাঁড়ি ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দিল। তারপর স্তব্ধ হইয়া মাটির মূর্তির মত বসিয়া রহিল।

মনের আক্ষেপে অচিন্ত্যবাবুর সমস্ত রাত্রি ভাল করিয়া ঘুম হয় নাই। ফলে-অতিপুষ্টিকর শশক-মাংস বদহজম হেতু নানা গোলমালের সৃষ্টি করিয়াছিল। ভদ্রলোক অন্ধকার থাকিতে থাকিতে বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া ঢক ঢক করিয়া এক গ্লাস জল ও খানিকটা সোডা খাইয়া মর্নিং ওয়াকের জন্য বাহির হইয়া পড়িলেন। খুব জোরে খানিকটা হাঁটিয়া তিনি সম্মুখে ভরা কালিন্দীর বাধা পাইয়া দাঁড়াইয়া গেলেন। ও-পারের চরটা অন্ধকারের ভিতর হইতে বর্ণে বৈচিত্রে সম্পদে অপরূপ হইয়া প্রকাশ পাইতে আরম্ভ করিয়াছে; গভীর তমিস্রাময়ী কালী যেন কমলা রূপে রূপান্তরিতা হইতেছেন।

অচিন্ত্যবাবু লক্ষ্য করিতেছিলেন, বেনাঘাসের গাঢ় সবুজ ঘন জঙ্গল চরের এ-প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্ত পর্য্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। উঃ, রাশি রাশি খসখস ওই ঘন সবুজ আস্তরনের নীচে লুকাইয়া আছে। খেয়াঘাটের ঠিকাদার ঠিক এই সময়েই ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল। অচিন্ত্যবাবুকে দেখিয়া সে একটি প্রণাম করিয়া বলিল, আজ আজ্ঞে, ভাগ্যি আমার ভাল। পেভাতেই ব্রাহ্মণদর্শন হল। এই ঘাট নিয়ে বুঝলেন কিনা, কত যে জাত-অজাতের মুখ সকালে দেখতে হয়! এ কাজ আপনার অতি পাজী কাজ মশায়। তবে দুটো পয়সা আসে, তাই বলি-

অসমাপ্ত কথা সে আকর্ণ-বিস্তার হাসিয়া সমাপ্ত করিল-

অচিন্ত্যবাবু আবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন লাভ এবার তোমার ভালই হবে, বুঝলে কিনা। ও-পাররের চরে কল বসছে, চিনির কল। লোকজনের আনাগোনা দেখতে দেখতে বেড়ে যাবে তোমার।

ঠিকাদার সবিস্ময়ে অচিন্ত্যবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কল? চিনির কল?

হ্যাঁ, চিনির কল। কাল কলকাতা থেকে মস্ত এক মহাজন এসেছে, সঙ্গে একটি ছালা টাকা। আমি নিজের চোখে দেখেছি। কাল আমার ছোট রায়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল কিনা।

ঠিকাদার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, ই টাকা কে পাবে? চরটা তো চক্কবর্তী-বাড়িরই সবাই বলছে; তা ছোট রায় মশায়ের বাড়িতে-

ছোট রায় মশায়ই আজকাল ওদের কর্তা। উনি সব দেখাশোনা করছেন যে।

বার বার ঘাড় নাড়িয়া ঠিকাদার বলিল, বটে, আজ্ঞে বটে। তা দেখলাম কাল, এইখানেই চক্কবর্তী-বাড়ির ছোট্‌কা আর রায় মশায়ের ছেলে বসে ছিল অ্যানেকক্ষণ; খুব ভাব দেখলাম দুজনায়। অ্যানেক কথা হল দুজনায়।

হুঁ। অচিন্ত্যবাবু খুব গম্ভীর হইয়া বলিলেন, হুঁ। আচ্ছা, কি কথা দুজনায় হচ্ছিল বল তো? কথা? স্বদেশীর কথা? মানে, সায়েবদের তাড়াতে হবে, বন্দেমাতরম্‌, মহাত্মা গান্ধীকি জয়, এই সব কথা হচ্ছিল?

আজ্ঞে না। আমি তো দূরে বসে ছিলাম। খুব খানিক কান বাজিয়ে শুনলাম; কাল কথা হচ্ছিল আজ্ঞে, আমি আঁচে বুঝলাম, কথা হচ্ছিল আপনার, আচ্ছা উমা কার নাম বলেন তো? এই ছোট রায়ের ঝিউড়ী মেয়ে লয়?

হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি তাকে পড়াতাম যে! বলিতে বলিতেই অচিন্ত্যবাবুর ভ্রু কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, বলিলেন, মেয়েটাকে কলকাতায় পাঠিয়ে ধিঙ্গী করে তুললে। ছোট রায় বাইরে বাঘ, আর ভেতরে একেবারে শেয়াল-বুঝলে কিনা, গিন্নীর কাছে একেবারে কেঁচো। মেয়েকে যে ভয় করে, তাকে আমি ঘেন্না করি, বুঝলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। তা, কাল আপনার ছোট রায়ের ছেলে চক্কবর্তী-বাড়ির ছোটকাকে ধরেছিল, বলে, তোমাকে তাকে বিয়ে করতে হবে।

বল কি?-অচিন্ত্যবাবু একেবারে তীরের মতো সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন। উপলব্ধি করার ভঙ্গিতে বার বার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ঠিক কথা। ইন্দ্র রায়ের মতলব এতদিন ঠাওর করতে পারছিলাম না। হুঁ। অহীন্দ্র ছেলেটি যে হীরের টুকরো ছেলে। এবারেও তোমার ফোর্থ হয়েছে ইউনিভার্সিটিতে। বটে! ঠিক শুনেছ তুমি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বয়সও হে অ্যানেকটা হল। মানুষ হাঁ করলেই বুঝতে পারি, কি বলবে। তা ছাড়া আপনার, রায় মশায়ের বুন। কুলের খুঁত ধরতে তো লোকে রায় মশায়েরই ধরবে।

ওরে বাপ রে বাপ রে! এই দেখ, কথাটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। তুমি তো ভয়ানক বুদ্ধিমান লোক। দেখ, তুমি ব্যবসা কর, তোমার নিশ্চয় উন্নতি হবে! আমার কাছে যাবে তুমি, তোমাকে আমি সঙ্গে নেব। বলো না যেন কাউকে, এই খসখসের ব্যবসা। খসখস বোঝ তো? খসখস হল বেনার মূল।

বেনার মূল?

হ্যাঁ। চুপ কর, সেজ রায়-বাড়ির হরিশ আসছে।

হরিশ রায় সেজ-রায়-বাড়ির একজন অংশীদার। সমস্ত রায় বংশের সিকি অংশের অধিকারী হইল সেজ তরফ, সেজ তরফের এক আনা অংশের অর্থাৎ ষোল আনা সম্পত্তির এক পয়সা রকমের মালিক হইলেন হরিশ রায়, এই এক পয়সা পরিমাণ জমিদারির অংশ লইয়া ভদ্রলোক অহরহই ব্যস্ত এবং কাজ লইয়া তাহার মাথা তুলিবারও অবসর থাকে না। কাগজের পর কাগজ তিনি তৈয়ারি করিয়া চলিয়াছেন। জমিদারির এককণা জমি যদি কেহ আত্মসাতের চেষ্টা করে, তবে তাহার আয়নার মত কাগজে তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতিবিম্ব পড়িবেই।

কানে পৈতে জড়াইয়া গাড়ু হাতে হরিশ রায় একটা দাঁতন-কাঠি চিবাইতে চিবাইতে নদীর ঘাটে আসিয়া নামিলেন। অচিন্ত্যবাবুকে দেখিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন, কি রকম, আজ যে এদিকে?

উদাসভাবে অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, এলাম,

না, মানে এদিকে তো দেখি না বড়।

হ্যাঁ। বলিয়াই হঠাৎ যেন তিনি আসিবার কারণটা আবিস্কার করিয়া ফেলিলেন; বলিলেন, চরের উপর কল বসছে কিনা, চিনির কল-সুগার মিল। তাই ভাবলাম, দেখে আসি ব্যাপারটা কি রকম হবে।

কল? চিনির কল?-হরিশ রায়ের বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। চিনির কল করবে কে মশায়? এত টাকা কার আছে?

কাল রাত্রে কলকাতা থেকে এক মস্ত মহাজন এসেছে, সঙ্গে আপনার একটি বস্তা টাকা। আমি নিজে চোখে দেখেছি-ওন্‌ আইজ। ইন্দ্র রায় মহাশয়ের ওখানে কাল আমার নেমন্তন্ন ছিল কিনা।

ইন্দ্র? তা, ইন্দ্র চর বন্দোবস্ত করছে নাকি?

হ্যাঁ। উনিই তো এখন চক্রবর্তী বাড়ির সব দেখাশুনা করছেন। তিনি ভুরু নাচাইয়া মুচকি হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, হুঁ, কোন খোঁজই রাখেন না আপনারা?

হরিশ রায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়া ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, এই দেখুন, এমন খোঁজ নাই যা হরিশ রায়ের কাগজে নাই। বুঝলেন, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমল থেকে ‘থাক’, নক্সা, জমাবন্দী, জরিপী, খতিয়ান, জমাওয়াশীল-বাকি সব আমার কাছে। কি বলব, পয়সা তেমন নাই হাতে, তা নইলে ‘চাকচান্দী’ লাগিয়ে দিতাম আমি। আর অন্যায় অধর্মও করতে চাই না আমি! যদি একটা কলম আমি খুঁচি, সব ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়বে। দেখি না, হোক না বন্দোবস্ত। আমরা এতদিন চুপ করেই ছিলাম,- বলি চক্কবর্তীরা আমাদেরই দৌহিত্র, তা খাচ্ছে খাক। কিন্তু এ তো হবে না মশায়। উঁহু!

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, সে আপনারা যা করবেন করুন গে মশাই। চর তো আজই বন্দোবস্ত হচ্ছে।

হাসিয়া হরিশ বলিলেন, দেখুন না, বেবাক কাগজ আজ বার করছি। একেবারে কড়া ক্রান্তি, মায় ধুল পর্যন্ত মিলিয়ে দেখিয়ে দেব চর কার।

অচিন্ত্যবাবু এত সব শুনিতে ভাল লাগিতেছিল না। তাঁহার মন তখন ভীষণ উত্তেজনায় ভরিয়া উঠিয়াছে। উঃ, ভিতরে ভিতরে ইন্দ্র রায় কন্যাদায়ের ব্যবস্থা করিয়া বসিয়া আছে! হরিশ রায়কে এড়াইয়া চলিয়া যাইবার জন্য হঠাৎ কথা বন্ধ করিয়া ঠিকাদারকে বলিলেন, তা হলে, তুমি কখন যাবে বল তো-সন্ধ্যেবেলা কেমন?

হরিশ জলের কুলকুচা ফেলিতে ফেলিতে আপন মনেই বলিলেন, কি আর বলব ইন্দ্রকে। লজ্জার ঘাটে আর মুখ ধোয় নাই। ছি ছি ছি! এতবড় কাণ্ডটার পরেও আবার রামেশ্বর চক্রবর্তীর সম্পত্তির দেখাশোনা করছে! ছি!

অচিন্ত্যবাবু যাইতে যাইতে ফিরিলেন, মৃদু হাসিয়া বলিলেন, সেই তো বলছিলাম মশায়, কি খবর রাখেন, আপনি? মাটির খবর নিয়েই মেতে আছেন আপনি, মানুষের মনের খবর কিছু রাখেন? ইন্দ্র রায় পাকা ছেলে। লজ্জার ঘাটে মুখ ধুয়ে বসে থাকলে ইন্দ্র রায়ের কন্যাদায় উদ্ধার হবে? বলতে পারেন? রায় ওই রামেশ্বর চক্রবর্তীর ছোট ছেলের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেবে।

বলেন কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই আমি বলি। চক্রবর্তী-বাড়িকে ইন্দ্র রায় বাঁধছে। রূপে গুণে এমন পাত্র পাবে কোথায় মশায়?

আরে মশায় ওদের আর আছে কি?

নাই, তাই মেয়ে-জামাইয়ের জন্যে রায় নগর বসাচ্ছেন চরে।

হুঁ। কিন্তু রামেশ্বরের যে কুষ্ট হয়েছে শোনা যায়।

আজ্ঞে না। সে সব ওরা রক্ত পরীক্ষা করিয়ে দেখেছেন। ওটা হল রামেশ্বরবাবুর পাগলামি। আচ্ছা, চলি আমি। অচিন্ত্যবাবু কথা কয়টা বলিয়া খুশি হইয়া উঠিলেন।

দাঁড়ান দাঁড়ান, আমিও যাব। দন্ত-মার্জনা অর্ধসমাপ্তভাবেই শেষ করিয়া হরিশ রায় উঠিয়া পড়িলেন। অচিন্ত্যবাবুর সঙ্গ ধরিয়া চলিতে চলিতে বলিলেন, দেখুন না, আমি কি করি! তামাম কাগজ আমি এক্ষুনি গিয়ে বের করে ফেলব। সব শরিককে ডাকব। সকলে মিলে বলব, ইন্দ্রকেও বলব, মহাজনকে বলব। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব। শোনে ভাল, না শোনে কালই সদরে গিয়ে দেব এক নম্বর ঠুকে, আর সঙ্গে সঙ্গে ইন্‌জাংশান। করুক না, কি করে কল করবে। কল বসাবে, নগর বসাবে!

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, কল বসলে সর্বনাশ হবে মশায়। রাজ্যের লোক এসে জুটবে-কুলী-কামিন-গুণ্ডা-বদমায়েশ, চুরি-ডাকাতি-রোগ, সে এক বিশ্রী ব্যাপার হবে মশায়। তা ছাড়া সমস্ত জিনিস হয়ে যাবে অগ্নিমূল্য, গেরস্ত লোকেরই হবে বিপদ। তার চেয়ে অন্য উপায়ে উন্নতি কর না নিজের! কত ব্যবসা রয়েছে। এই ধরুন গাছগাছড়া চালান দাও, খসখস-। অচিন্ত্যবাবু সহসা চুপ করিয়া গেলেন।

হরিশ রায় তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন, আসুন আপনি, আপনাকেই দেখাব আমি কাগজ। আপনি ইন্দ্রের বন্ধুলোক, কই, আপনিই বলুন তো ন্যায্য কথা। আয়নার মত কাগজ, এক নজরে বুঝতে পারবেন। ইন্দ্র না হয় বড়লোক, আমাদের না হয় পয়সা নাই। তাই বলে এই অধর্ম করতে হবে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই হরিশ রায়ের বাড়িতে রায়-বংশের প্রায় সকল শরিকই আসিয়া জুটিয়া গেল। আস্ফালন ও কটুক্তিতে প্রসন্ন প্রভাত কদর্য তিক্ত হইয়া উঠিল। সঙ্গতিহীন এক নাবালক-পক্ষের অভিভাবিকা নাগিনীর মতই বিষোদ্‌গার করিয়া কেবলই অভিসম্পাত বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল, ধ্বংস হবে। ভোগ করতে পাবে না। অনাথা ছেলেকে আমার যে ফাঁকি দেবে, তার মেয়ে বাসরে বিধবা হবে। নিব্বংশ হবে। এই আমি বলে রাখলাম। রাঙা বর! রাঙা বর! রাঙা বর বাসরে মরবে।

* * *

ইন্দ্র রায় ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। রায়-গোষ্ঠী দল বাঁধিয়া আসিয়া অধঃপতিত আভিজাত্যের স্বভাব-ধর্ম অনুযায়ী যে কদর্য দম্ভ ও কুটিল মনোবৃত্তির পরিচয় দিল, তাহাতে তিনি স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। বিশেষ করিয়া রায়বংশের এক শরিক-শূলপাণি যখন ক্রোধে আত্মহারা হইয়া কদর্য ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়িয়া বলিল, অ্যাঁ:, বাবু আমার ‘লগর’ বসাবেন মেয়ে -জামায়ের লেগে! আর আমরা সব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখবো না কি?

ইন্দ্র রায় বলিলেন, শূলপাণি শূলপাণি, কি বলছ তুমি?

রায়ের মুখের কাছে দুই হাত নাড়িয়া শূলপাণি বলিল, আহা-হা, ন্যাকা আমার রে, ন্যাকা! বলি আমরা কিছু বুঝি না, না কি? রামেশ্বরের বেটার সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দেবার কথা আমরা বুঝি না বুঝি?

ইন্দ্র রায় স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাঁহার মনে হইল, পায়ের তলায় পৃথিবী বুঝি থরথর করিয়া কাঁপিতেছে! সভয়ে তিনি চোখ বুজিলেন, তাঁহার চোখের সম্মুখে ফুটিয়া উঠিল-গত সন্ধ্যায় উপাসনার সময়ে মনশ্চক্ষে দেখা দৃশ্য। -চক্রবর্তী-বাড়ি ও রায়-বাড়ির জীবন-পথের সংযোগ-স্থলে ভাঙনের অতল অন্ধকূপ।

শূলপাণি কদর্য ভাষায় আপন মনে বকিতেছিল; অন্যান্য রায়েরা আপনাদের মধ্যে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করিতেছিল। হরিশ রায় বেশ বুঝাইয়া বলিবার ভঙ্গিতে বলিলেন, বেশ তো পাঁচজনে একসঙ্গে মজলিস করে বসো; আমি ফেলে দিই তামাম কাগজপত্র একটি একটি করে, একেবারে রুদ্রাক্ষের মালার মত গাঁথা! দেখ, বিচার করে দেখ, যদি সকলের হয় সকলে নেবে। চক্রবর্তীদের একার হয়, একাই নেবে চক্রবর্তীরা। একা তোমার হয় তুমি নাও, তারপর তুমি দান কর মেয়ে-জামাইকে, নিজে রাখ, যা হয় কর। তখন বলতে আসি কান দুটো ধরে মলে দিও।

ইন্দ্র রায়ের কানে ইহার একটা কথাও প্রবেশ করিল না। ধীরে ধীরে তিনি আত্মসম্বরণ করিয়া এতক্ষণে একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তারা তারা মা! তারপর তিনি ডাকিলেন, গোবিন্দ! ওরে গোবিন্দ!

গোবিন্দ-রায়ের চাকর। চাকরের সাড়া না পাইয়া তিনি ডাকিলেন, ঘরের মধ্যে কে রয়েছে?

ঘরের মধ্যে ছিল অমল ও অহীন্দ্র। অহীন্দ্র বিস্ফারিত দৃষ্টিতে স্তম্ভিতের মত বসিয়া ছিল। আর অমল হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতে ছিল, বলিতেছিল, কুরুকুল চীৎকার করছে পাণ্ডব-যাদবদের মিতালি দেখে। মাই গড্‌।

পিতার স্বর শুনিয়া সে হাসি থামাইয়া বাহিরে আসিতেই রায় বলিলেন, গোবিন্দ কোথায়? এদের তামাক দিতে বল তো।

শূলপাণি বলিল, তামাক আমরা ঢের খেয়েছি, তামাক খেতে আমরা আসি নাই। আগে আমাদের কথার জবাব চাই।

কথার জবাব? সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধে রায়ের মাথা উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। বিপুল ধৈর্যের সহিত আত্মসম্বরণ করিয়া কিছুক্ষণ পর বলিলেন, জবাব আমি এখনই দিতে পারলাম না। ও-বেলায় দু-একজন আসবেন, তখন জবাব দেব আমি!

শূলপাণি আবার লাফ দিয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু হরিশ তাহাকে থামাইয়া দিয়া বলিলেন, থাম শূলপাণি। ইন্দ্র হল আমাদের রায়গুষ্টির প্রধান লোক, তার সঙ্গে এমন করে কথা কইতে নাই। আমি বলছি।

শূলপাণি সঙ্গে সঙ্গে হরিশের উপরেই ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। বলিল, যা যা যাঃ, তোষামুদে কোথাকার। তোষামুদি করতে হয়, তুই করগে যা। আমি করব না। আচ্ছা আচ্ছা, কে যায় চরের ওপর দেখা যাবে। -বলিয়া সে হনহন করিয়া কাছারির বারান্দা হইতে নামিয়া চলিয়া গেল।

হরিশ বলিলেন, তা হলে মামলা-মকদ্দমাই স্থির ইন্দ্র?

ইন্দ্র রায় বলিলেন, আপনারা আগে আগে গেলে আমাকে রামেশ্বরের হয়ে পেছনে পেছনে যেতে হবে বৈকি।

হরিশ বলিলেন, তুমি ঠকবে ইন্দ্র,আমার কাছে এমন কাগজ আছে-একেবারে ব্রহ্মাস্ত্র।

ইন্দ্র রায় হাসিলেন, কোন উত্তর দিলেন না। আবার একবার আস্ফালন করিয়া রায়েরা চলিয়া গেল। শূলপাণি কিন্তু তখনও চলিয়া যায় নাই; সে ইন্দ্র রায়ের দারোয়ানের নিকট হইতে খইনি লইয়া খাইতেছিল।

রায় আজ অসময়ে অন্দরে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, হেম, আমার আহ্নিকের জায়গা কর তো।

অন্দর হইতে হেমাঙ্গিনী সমস্ত শুনিতেছিলেন, তিনিও আজ দিগ্‌ভ্রান্তের মত বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছেন। উমা-তাঁহার বড় আদরের উমা। অহীন্দ্রও সোনার অহীন্দ্র। কিন্তু এ তো তিনি কোনদিন কল্পনা করেন নাই।

স্নান-আহ্নিক শেষে রায় আহারে বসিলেন, হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ওদের কথায় তুমি কান দিও না। কুৎসা করা ওদের স্বভাব।

রায় মৃদু হাসিলেন, বলিলেন আমি বিচলিত হই নি হেম।

* * *.

সন্ধ্যায় তিনি বিমলবাবুকে লইয়া বসিলেন। বাধা-বিঘ্নের সম্ভাবনার কথা সমস্ত বলিয়া রায় বলিলেন, বাধা-বিঘ্ন হবে- এ আমি বিশ্বাস করি না। ওদের আমি জানি। তবে সমস্ত কথা আপনাকে আমার বলা দরকার, তাই বললাম। আপনি কাগজপত্র দেখুন, দেখলে সত্যিকারের আইনের দিকটাও দেখতে পাবেন।

বিমলবাবু কাগজগুলি গভীর মনঃসংযোগ করিয়া দেখিলেন, তারপর বলিলেন, আমার দিক থেকে কোন আপত্তি নাই, আজই দলিল হয়ে যাক।

টাকাকড়ির কথাবার্তা শেষ করিয়া তিনি অমলকে পাঠাইলেন সুনীতির নিকট। সুনীতির অনুমোদন লওয়া আবশ্যক। কিছুক্ষণ পর অমল ও অহীন্দ্র ফিরিয়া আসিল। অহীন্দ্র বলিল, মা বললেন, আপনি যা করবেন, তাই তাঁর শিরোধার্য। তবে একটা কথা তিনি বলছেন-

রায় বলিলেন, কি, বল?

নবীন বাগদীর স্ত্রী তার কাছে এসেছিল। অন্য বাগদীরাও এসেছিল সঙ্গে। তারা আমাদের পুরানো চাকর। তারা কিছু জমি চায়।

রায় একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, ভাল, তাদের জন্য পঁচিশ বিঘে জমি রেখেই বন্দোবস্ত হবে। কিন্তু চরটা তাহলে মাপ করা দরকার। আজ দলিলের খসড়া হয়ে থাক, কাল মাপ করে দলিলে লেখা হবে, কি বলেন, বিমলবাবু?

বিমলবাবু বলিলেন, তাই হবে।

তা হলে আমি সন্ধ্যা সেরে আসি।

রায় উঠিলেন, কিন্তু যাওয়া হইল না। বারান্দার বাহির হইতে দেখিলেন, যোগেশ মজুমদার বাগানের রাস্তা দিয়া কাছারির দিকে আসিতেছে। আজ মজুমদারের সঙ্গে একজন চাপরাসী। মজুমদার এখন চক্রবর্তী-বাড়ির বিক্রীত সম্পত্তির মালিক, রায়েদের শরিক জমিদার। ইন্দ্র রায় ঈষৎ হাসিলেন, হাসিয়া সম্ভাষণ করিলেন, এস এস, মজুমদার এস। কি ব্যাপার? হঠাৎ?

স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের হাসি হাসিয়া মজুমদার বলিল, এলাম আপনার শ্রীচরণ দর্শন করতে।

রায় বলিলেন, শ্রী এখন বিগত হয়েছে মজুমদার, এখন শুধু চরণই অবশিষ্ট। সুতরাং কথাটা তোমার বিনয় বলেই ধরে নিলাম। এখন আসল কথাটা কি , বলো তো? সংক্ষিপ্ত হলে এখনই বলতে পার; সময়ের দরকার হলে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমার সন্ধ্যার সময় চলে যাচ্ছে।

মজুমদার বলিল, কথা অল্পই। মানে আপনি তো জানেন, চক্রবর্তী-বাড়ির সেই ঋণটা-সেটা বেনামীতে আমারই দেওয়া। নিলামে সম্পত্তি ডাকলাম, এখনও বাকি অনেক। আজ শুনছি চরটাও বন্দোবস্ত হয়ে যাচ্ছে। তা আমার কি ব্যবস্থা হবে?

রায় অদ্ভুত হাসি হাসিয়া মজুমদারের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, কথাটার উত্তর কি আমারই কাছে শুনবে মজুমদার? চক্রবর্তী বাড়ি তো তোমার অচেনা নয়।

কথাটার সুরের মধ্যে সূচের মত তীক্ষ্ণতা ছিল, মজুমদার সে তীক্ষ্ণতার আঘাতে একেবারে হিংস্র হইয়া উঠিল, বলিল, আপনিই যে এখন ও বাড়ির মালিক রায় মশায়। চক্রবর্তীর সম্বন্ধী, আবার হবু বেয়াই-

রায় গম্ভীরভাবে নিঃশ্বাস টানিয়া অজগরের মত ফুলিয়া উঠিলেন, বলিলেন, হ্যাঁ, রামেশ্বরের সম্বন্ধী আমি বটে, আর বেয়াই হবার কথাটাও ভাবছি। এখন উত্তরটাও আমার শোন, চাকরের কাছে ধার, সে আমার টাকা চুরি করেই আমাকে ধার বলে দিয়েছে, কিন্তু সে যখন ধার বলেই নিয়েছি-তখন আমার ভগ্নীপতি, কি আমার হবু বেয়াই, কখনও ‘দেবে না’ বলবেন না।

মজুমদার মুহূর্তে এতটুকু হইয়া গেল। রায় বলিলেন, কাল সকালে এস তোমার হ্যাণ্ডনোট নিয়ে। তারপর কণ্ঠস্বর মৃদু ও মিষ্ট করিয়া বলিলেন, বস, তামাক খাও। গোবিন্দ! মজুমদার মশায়কে তামাক দাও।

তিনি অন্দরে চলিয়া গেলেন; চলিতে চলিতেই গম্ভীরস্বরে তিনি ডাকিলেন, তারা, তারা, মা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *