অসাধু সিদ্ধার্থ – ১৬

।। ষোল ।।

অজয়ার পালিত সন্তানদের উপনিবেশে আজ উৎসব–কর্ত্রী তাহাদের দেখিতে আসিয়াছেন, সঙ্গে সিদ্ধার্থ। ছেলেমেয়েগুলি মিলিত কন্ঠে একটি গান গাহিয়া শুনাইল-লক্ষ্মী বৈকুণ্ঠ ছাড়িয়া মর্ত্য রাজ্যে কমলচরণ অর্পণ করিয়াছেন―তাঁহার চক্ষে জগদ্ধাত্রীর করুণা, হস্তে অন্নপূর্ণার অন্নপাত্র-অন্ন বণ্টন করিয়া জননীর ক্লান্তি নাই―জননীর কৃপাশীর্বাদে পৃথিবীতে অক্ষয় হেমন্ত ধান্যশীর্ষে দুলিয়া দুলিয়া উঠিতেছে―তাঁহাকে প্রণাম।

গান শেষ করিয়া সকলে উভয়ের চরণে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণত হইল। সিদ্ধার্থ বলিল,―গান তোমাদের কে শিখিয়েছেন?

একজন বলিল,–গুরু-মা।

―গুরু-মা তোমাদের খুব ভালবাসেন?

―খুব।

একটি বালিকা হঠাৎ সিদ্ধার্থকে দেখাইয়া অজয়াকে প্রশ্ন করিয়া বসিল,–ইনি আমাদের কে, মা?

শুনিয়া সিদ্ধার্থ মুখ টিপিয়া হাসিল।

কিন্তু অজয়া লজ্জা পাইল; বলিল,―ইনিও তোমাদের অভিভাবক। তোমাদের ভালবাসেন, তোমাদের যাতে ভাল হয় তাই ইনি চান। তোমারও এঁর কুশল প্রার্থনা করবে।

―তোমার বর?

বালিকার মুখনিঃসৃত প্রশ্নটি এতগুলি লোকের সম্মুখে উচ্চারিত হইল বলিয়াই যেন প্রাঞ্জল সত্যের মত শুনাইল।

এবং তাহার কৌতুকের দিক্‌টা হঠাৎ চোখে পড়িয়া সিদ্ধার্থ আত্মসংবরণ করিতে না পরিয়া হাসিয়া উঠিল।

অজয়া বালিকার গাল টিপিয়া দিলো; বলিল, –যাও, আজ তোমাদের দিনভোর ছুটি।

সিদ্ধার্থ যেন সেই সঙ্গে ছুটি পাইয়া গেল।

তাহার মনে হইল আর ভয় নাই। মনে মনের প্রায়শ্চিত্তেই তার পাপ সমূলে ক্ষয় হইয়া গেছে―ছোটরা ভবিষ্যতের ছায়া দেখিতে পায়; সহজজ্ঞানেই ভালমন্দ টের পায়।

বালিকার প্রশ্নে অজয়ার মুখে বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা যায় নাই―যেন স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপারের সম্পর্কেই কেহ অপ্রাসঙ্গিক নহে, প্রাসঙ্গিকই কিন্তু অতিরিক্ত একটা উক্তি করিয়াছে।

সিদ্ধার্থ মনে মনে ডানা মেলিয়া যেন বসন্তের পুষ্পশাখে যাইয়া বসিল।

অজয়া সিদ্ধার্থর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল,―একেবারে মগ্ন হয়ে কি চিন্তা হচ্ছে?

সিদ্ধার্থ বলিল,–ভাবছি, প্রবাদ আছে, ভগবান মন বুঝে ধন দেন―কথটা সর্বদাই ঠিক কি মাঝে মাঝে বেঠিক হয়েও থাকে।

অজয়া টেরও পাইল না যে সিদ্ধার্থ নিজের কথাই বলিতেছে।

বালিকার মুখখানি সিদ্ধার্থ মনে মনে পুষ্প-চন্দনে অর্চিত করিয়াছিল। তারপর একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়া ভগবানের দানে মন-বিচারের কথাটা তার মনে পড়িয়া গেছে।

অজয়া বলিল,―দানেই যদি ধনের সার্থকতা ধ’রে নেয়া যায় তবে আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেঠিক। কথাটা জন্মগ্রহণ করেছে সেকালের অভিজ্ঞতা থেকে। তখন ধনী মনে করতো সে কেবল হিসাবনবিশ তহবিলদার―চাহিদা মত দিয়ে দেবার ভার তার ওপর। কাজে লাগবে, তার যা দরকার। এমন সব উল্টে গেছে।

–কারণ কি অনুমান করেন?

―আত্মপর বোধটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। যে নিতে চায় তাকে নিতান্তই আপনার জন না ভাবতে পারলে দেওয়া পাওয়ার আনন্দ কোনো তরফেই পূর্ণ হয় না―ভেতরে ফাঁক থেকে যায়। আপনার জন এখন কেউ কারো নয়; সঙ্কীর্ণতার সঙ্কোচের ফলেই এখন যথার্থ দাতা প্রার্থী দুই-ই কম।

কিন্তু সিদ্ধার্থর কানে অজয়ার কথাগুলি গেল কিনা সন্দেহ!

সে পরবর্তী কথাটাই প্রাণপণে ভাবিতেছিল।

অজয়ার গলার আওয়াজটা থামিতেই সে যেন আপন মনেই বলিতে লাগিল,―আমার দান বৃথা হয়নি। এই দেহ তার সঙ্গে সামান্য জ্ঞান উর্বর ভূমিকেই দান করছি। ফসল যখন ফলবে, তখন সেই সীমান্তবিস্তৃত হরিৎ সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে দেখবো দানের উদার সার্থকতা। দানে গর্ব নেই―গর্ভ তার ফলে। বলিতে বলিতে সহসা সে অজয়ার দিকে ফিরিল―অজয়া তাহার চোখের দিকে চাহিল না। চাহিলে সে বিস্মিত হইত―দেখিতে পাইত, সিদ্ধার্থর দৃষ্টি যেন সেই মুহূর্তেই মরিয়া হইয়া সাগর-গর্ভে ঝাঁপাইয়া পড়িতে উদ্যত হইয়াছে―সে দৃষ্টি যুগপৎ এমনি শঙ্কিত এবং স্থির।

সিদ্ধার্থর গায়ে তখন একবার কাঁটা দিয়া গেছে। একটি কথা তার জিহ্বাগ্রে কাঁপিতেছে―আকর্ষিত জ্যা-লগ্ন তীরের মত লক্ষ্যে পৌছিবার তার স্পন্দহীন অব্যক্ত অধীরতা।

সিদ্ধার্থর কণ্ঠস্বর কাঁপিতে লাগিল। বলিল,―আপনি দান করেছেন আপনার করুণায় ছলছল বিপুল স্নেহ-তার ফল দেখে গর্বে ভ’রে উঠছে আমার বুক। কেন? ―বলিয়াই সিদ্ধার্থ শুনিতে পাইল গুরুগুরু শব্দে কোথায় যেন মেঘ ঢাকিতেছে। কিন্তু সেটা তারই বুকের শব্দ।

অজয়া ধীরে ধীরে বলিল,–তা ত’ জানিনে।

―সহানুভূতি। দুটি প্রাণ করুণায় বিগলিত হয়ে ঢেলে পড়ছে একই পাত্রে। তারা একত্র হ’লে স্রোতের বেগ দুর্জয় হবে। অজয়া―

বলিয়াই সে অজয়ার হাত ধরিয়া ফেলিল।

এবং তারপর কথা বলিবার পূর্বে যে একটি মুহূর্ত অতিবাহিত হইল তাহারই মধ্যে জীবনের অনন্ত সুখ তার অনুভূতির প্রত্যেকটি পরমাণুর ভিতর দিয়া প্রবাহিত হইয়া গেল। অজয়ার হাত ছাড়িয়া দিয়া, হস্তবন্ধনের স্পর্শটুকু উপলব্ধি করিতে করিতে সিদ্ধার্থ গদগদম্বরে বলিল,―আমার জীবনের একান্ত আকাঙ্ক্ষা তোমাতেই মূর্তি গ্রহণ ক’রে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে―বলো, এসেই সে ফিরে যাবে না?

―না।

―চলো যাই।

―চলুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *