॥ পাঁচ ॥
ফুলের তোড়টি অজয়ার সম্মুখে নিক্ষেপ করিয়া আসা অবধি সিদ্ধার্থর মন ভাল নাই। কাজটি করিয়া ফেলিয়াই তার মনে টিস্ টিস্ করিতে লাগিল, কোনই প্ৰয়োজন ছিল না, ঘটনা তাহাতে কিছুমাত্র অনুকূল বা অগ্রসর হয় নাই। কেন যে ঐ বুদ্ধিটা হঠাৎ ঘটে আসিল ছুটিতে ছুটিতে বাহির হইয়া আসিবার কিছুক্ষণ পরেই উত্তেজনার নিবৃত্তি হইয়া সেইটাই তাহার কাছে পরম বিস্ময়ের বিষয় হইয়া উঠিল।
যাই হোক, সিদ্ধার্থ সিদ্ধিদাতা গণেশের পাঁচসিকে ভোগ মানত করিয়াছে।
উল্টাইয়া না পড়া পর্যন্ত গণেশ ঠাকুরকে কেহ বড় স্মরণ করে না; সিদ্ধিপ্রদানের প্রার্থনাসহ কিঞ্চিৎ ভোগের আশা গণেশ বোধ করি এই প্রথম পাইলেন।
ডাকাতরা কালী পূজা করিয়া লুঠতরাজে বাহির হয়―কিন্তু তাহাতে খরচ বেশী, শব্দও বেশী। সিদ্ধার্থ তাই নিঃশব্দে নিরীহ গণেশের শরণাপন্ন হইয়াছে।
সঙ্কল্প তাহার সাধু সন্দেহ নাই।
রজতের সে পিছু লইয়াছে। রজত পাহাড়ে পাহাড়ে বেড়ায়; যদি দৈবাৎ সে পা পিছলাইয়া পড়ে পা একখানা মক্কাইয়া―
রজত নিজে না পড়ুক পাথরই একখানা গড়াইয়া পড়ুক না তার পায়ের উপর―কাঁধে করিয়া রজতকে সে বাড়ী পৌঁছাইয়া দিবে। তখন―
ভাবিতে ভাবিতে সিদ্ধার্থর মনে হইল, সে যেন রজতকে কাঁদে করিয়াই চলিয়াছে।
প্রথমেই একটি চমকিতার চঞ্চল ব্যাকুলতা। তারপর ধন্যবাদ; দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টির প্রথম মিলন। তারপর দু’চারিটি কথা, পরিচয়ের সূত্রপাত। তারপর হয়তো নিমন্ত্রণ। তারপর―
কিন্তু নিশ্চিন্ত গণেশের উপর অবিশ্বাস আর বিরক্তিতেই তারপর যে কি ঘটিবে তাহা সিদ্ধার্থর চিন্তা করা ঘটিয়া উঠিল না।
সিদ্ধার্থ মনে মনে একটু হাসিল।
যে কাজের সূচনাই হয় নাই, তাহাকে বাষ্পীয় কল্পনার বলে ঠেলিয়া ঠেলিয়া অতদূর লইয়া যাওয়া অনর্থক! তবু ছবিটা ভাল―মনে মনে সাজাইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে।
স্থান কাল উভয়ই মনোরম।
বায়ুমণ্ডল একেবারে নিঃশব্দ―মনে হয়, কোথাও একটু শব্দ হইলেই সে শব্দের আর শেষ হইবে না―ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবলি আসিবে আর যাইবে।
অন্ধকার কোথায় যেন কুণ্ডলী পাকাইয়া গহ্বরে নিদ্রিত ছিল; বাহিরে আসিয়া ক্রমাগত সে দেহ বিস্তৃত করিতেছে। গাছের মাথায় মাথায় আলোর স্পর্শ দিল―তাহাও সর্বোচ্চ বিন্দুতে মুহূর্তেক দাঁড়াইয়াই সরিয়া গেল।
কাঠুরিয়ারা জঙ্গলে কাঠ কাটিতে আসে। তাহারা ঘরে গেছে।
সিদ্ধার্থ ভাবিতে লগিল, রজত এই দিকে উঠিয়া গেছে; এখনো তার নামিবার তাড়া নাই কেন!
কিন্তু তাড়া তার ছিল; এবং তখনি তার প্রমাণ আসিল-একটি আর্ত চীৎকার।
সিদ্ধার্থ কান পাতিয়া রহিল। পর্বতমালার গায়ে গায়ে আছাড় খাইয়া খাইয়া সুগম্ভীর শব্দটার মৃত্যু ঘটিতে বহু বিলম্ব হইল।
শব্দটা শেষ হইলে সিদ্ধার্থ অত্যন্ত উৎফুল্ল হইয়া উঠিল―গণেশের কৃপা হইয়াছে। সিদ্ধার্থর অন্তরটাই যেন আবর্তিত হইয়া অতীব ক্রুর একটি হাসির আকারে দেখা দিল।
চমৎকার। ঘেমে উঠেছে; ভয়ার্ত ব্যাকুল চক্ষু দিগ্বিদিকে দৃষ্টি হেনে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কের আতপে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে; পশ্চিম আকাশের দিকে চেয়ে চক্ষু দু’টি এক একবার নিষ্পলক হয়ে বুকের স্পন্দন থর্ থর্ করছে। পৃথিবীময় সে মনে মনে হাতড়ে বেড়াচ্ছে মানুষের একখানি মুখ; বাঘের থাবার নীচে মৃগীর মত তার কাঁপুনি―চমৎকার ছবি!
বিপন্ন রজতের এই চমৎকার ছবিখানি কল্পনা করিতে করিতে সিদ্ধার্থ উচ্চকণ্ঠে সাড়া দিয়া শব্দের দিকে উঠিয়া গেল।
.
রজত উপরে। সিদ্ধার্থ নীচে; উঠিয়া আসিতেছে।
সিদ্ধার্থকে দেখিয়াই রজতের মনে হইল, সে যেন মানুষের আতরক্ষার সহজ আগ্রহ। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, ঠ্যাঙাড়ে নয় ত’!
সিদ্ধার্থর হাতে ছিল অতিকায় এক লাঠি, আর কাঁধে ছিল ব্যাগ।
ঠ্যাঙাড়ে সন্দেহ করিয়া ভয় পাইবার অবস্থা রজতের তখন নয়―সিদ্ধার্থ যে মানুষ তখনকার মত সেই তার যথেষ্ট। নির্নিমেষ চক্ষ সে নীচের দিকে চাহিয়া রহিল।
সিদ্ধার্থ উঠিয়া আসিয়া পাশে দাঁড়াতেই রজত তাহাকে মহা ব্যগ্রভাবে দুইহাতে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল,―বাঁচালেন।
সিদ্ধার্থ বলিল,―ছাড়ুন আর বসুন। আমি শ্রান্ত।
রজত বলিল,―বাঁচালেন যে সে ত’ মিথ্যে নয়। কি ক’রে যথোচিত কৃতজ্ঞতা জানাব তা ভেবে পাচ্ছিনে।
―ভেবে যখন পাচ্ছেন না তখন ত’ নিরুপায়। আর কৃতজ্ঞতা একটা কুসংস্কার।
―সে তর্কের সময় এখন নেই। তবে আমি যে মরতাম সে বিষয়ে বোধ হয় আপনারও সন্দেহ নেই।
সিদ্ধার্থ হাসিয়া বলিল,―শুনেছি, এই পাহাড়ে বালখিল্য মুনিগণের প্রেতাত্মারা সব বাস করেন; মানুষকে একা আর দুর্বল পেলেই তাঁরা তার পথ ভুলিয়ে দিয়ে অনিষ্ট ক’রে থাকেন।
–বালখিল্য মুনিরাই ত অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ; তাঁদের প্রেতাত্মারা আর কত ভয়ঙ্করই হবেন! ভয়ের কারণ ঠিক ওদিক দিয়ে নয়-বাঘ, ভালুক চ’রে বেড়ায় না কি?
―বেড়ায় ব’লেই জনরব। কিন্তু হিংস্র জন্তু যাকে মারে সে না কি মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে না―মৃত্যু আসছে দেখেই তার চেতনা যেমন নিশ্চেষ্ট তেমনি আসাড় হয়ে যায়। সে বড় সুখের মৃত্যু। সে কথা যাক―আপনি বোধ হয় ক্ষুধার্ত। আমার সঙ্গে খাবার আছে।―বলিয়া ব্যাগ্ খুলিয়া গরম দুধের বোতল, পাউরুটি, জেলি প্রভৃতি বাহির করিতে লাগিল।
রজত বলিল,―ক্ষিদেটা এতক্ষণ অনুভব করবার অবসরই পাইনি―তৃষ্ণাটাই মারাত্মক হয়ে উঠেছিল। এখন বুঝতে পারছি আমি মনঃসংযোগ না করলেও ক্ষিদেটা আপন মনেই বেড়ে উঠেছে!
―আজন, তবে খাবারগুলোকে কাজে লাগান যাক। ক্ষিদেটাকে স্থায়ী হ’তে দিলেই শেষ পর্যন্ত পীড়ন করে কম, কিন্তু ক্ষয় ক’রে দুর্বল করে বেশী। দুর্বল হ’লে আপনার চলবে না; পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামা কঠিন।
―সে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে, আমার এগুলি দরকার হবে তা আপনি যেন জানতেন।
সিদ্ধার্থ একটু হাসিল মাত্ৰ।
রজত বলিল,―আপনি এসে না পড়লে আমাকে বাঘে খেত; তাকে ফাঁকি দিয়ে আমি নির্বিবাদে দুধ-রুটি খাচ্ছি। ―বলিয়া রজত হাসিয়া অস্থির হইয়া গেল।
চাকা কেবলি ঘুরিতেছে।
.
বলসঞ্চয় করিয়া লইয়া রজত বলিল,–এইবার বেশ মজবুত বোধ করছি। আপনাকে দেকবার পরও ত্রাসভোগের যে গ্লানিটুকু ছিল তা দুধ-রুটি খেয়েই গেছে। কিন্তু কথায় কথায় ভুলে যাচ্ছি যে, অন্ধকার যত ঘনাচ্ছে, আমার বোনটি তত উতলা হচ্ছে।
―উঠুন―বলিয়া সিদ্ধার্থ হাতে লাঠি আর কাঁধে ব্যাগ লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
রজত বলিল,―উঠেছিলাম অনেক হাঙ্গামা পুইয়ে, শিকড় আর গাছগাছড়া ধ’রে ধ’রে, নামব কি ধ’রে?
―আমার কাঁধ ধ’রে। পা যেন টলে না; সমস্ত শরীরের ভাব আমার ওপর এলিয়ে দিন। দু’জনের ভার রাখবে এই লাঠি। তাড়াতাড়ি করবেন না, পা ফেলবেন খুব সাবধানে―আলগা পাথর এড়িয়ে। আসুন!
রজত ভাবিল, এই রকম বলিষ্ঠ দেহ তাহার হইলে তবু কিছু নিশ্চিন্ত থাকা যাইত, বিশেষ করিয়া এই আসুরিক শক্তি প্রতিযোগিতার যুগে।
সিদ্ধার্থ ভাবিল―লুকাইয়া নয়, চোখের সম্মুখে তাহাকে দেখিব।