॥ তের ॥
স্বীয় কর্তব্য বিষয়ে দিশা না পাইয়া রজত তাহার পিসিমাকে ডাকিয়া আনিয়াছে।
আলোচনা-বৈঠকে বসিয়া রজত প্রথমেই বলিল,-পাহাড়ে বাঘ-ভালুক আছে―সুখে থাক তারা, মানুষের সামনে এসে পড়লে তারাও বিপদ গণে, তাদের ওপর গুলি চালানো যায়। আর একটা মস্ত সুবিধে, তারা এসে জাঁকিয়ে বসে আত্মকাহিনী মুখস্থ বলে না। যারা তা বলে, তাদের ওপর গুলি চালানো যায় না, এ হিসাবে বাঘ-ভালুকই বেশী নিরাপদ দেখছি। কি করা যায়, পিসীমা?
বিমলের মা বলিলেন,―যা-ই করো, গুলি চালালে গোল মিটবে না।
আমায় বড় ভাবিয়ে তুলেছে। অজয়ার সুখের দিক দিয়ে দেখতে গেলে ব্যাপার বড় জটিল হয়েই উঠেছে―যে আকর্ষণের প্রভাবের মধ্যে গিয়ে সে পড়েছে, সেখান থেকে টেনে আনলে সে ছিঁড়ে আসবে।
―এতদূর এগিয়ে গেছে?
―সম্ভবত এক নিমেষেই, প্রথম দর্শনেই।
ঐ ‘প্রথম দর্শন’ কথাটা পিসিমার বড় বিস্বাদ লাগিল। তাঁহার বিবাহের প্রাক্কালে বরপক্ষীয় প্রবীণ ব্যক্তি তাঁহাকে দেখিয়া শুনিয়া পছন্দ করিয়া গিয়াছিলেন, এবং তাঁহার পক্ষের এক গুরুজন যাইয়া পাত্রকে একেবারেই আশীর্বাদ করিয়া কথা পাকা করিয়া আসিয়াছিলেন। তাঁহাদের ‘প্রথম দর্শন’ ঘটিয়াছিল শুভদৃষ্টির সময়―কিন্তু তখন যে কি ঘটিয়াছিল তাহা তখনই তিনি অনুভব করিতে পারেন নাই। শুভদৃষ্টির অনুষ্ঠানটি বিবাহের অপরিহার্য অঙ্গ বলিয়া হইয়াছিল নিশ্চয়―এইরূপ একটা অ-স্বচ্ছ ধারণা তাঁর আছে।
কাজেই প্রথম দর্শনেই মূল হইতে ডগা পর্যন্ত প্রেমে পড়িবার দৃষ্টান্ত চোখের সম্মুখে দেখিয়া তিনি মনে মনে চটিয়া গেলেন। ভাবিলেন, সবই বাড়াবাড়ি। শিক্ষাপ্রাপ্তা বলিয়া আধুনিক সুন্দরীরা যত আড়ম্বরই করুক, হৃদয় সম্পর্কে সেই আদি নারীর চাইতে তিলমাত্র উন্নতি তাদের হয় নাই। একবার টলিলেই গড়াইতে সুরু করিয়া দিবে। বিচার-বুদ্ধি লোপ পাইয়া এমন হুঁশটুকু রহিবে না যে, গড়াইয়া সে রসাতলেও পড়িতে পারে।
প্রকাশ্যে বলিলেন,―অজয়াকে বুঝিয়ে বলেছ?
কে? আমি? তর্কে আমি তার সঙ্গে কোনোদিন পারিনে। আর, বোঝাবই বা কি! তারপর দেখো দৈবের সূক্ষ্মগতি–ক্রমশ দেখা গেল, দু’জনার আশ্চর্য রকম মতের মিল, দেশোদ্ধারের পতিতপাবনী নেশা! তারপর চূড়ান্ত হয়ে গেল মূৰ্ছায়।
―কি রকম?
―চা খেয়ে তিনজনে চ’লে আসছি―আগে আমি, তারপরে অজয়া, সকলের পিছনে সিদ্ধার্থ বাবু। দু’এক পা এসেই সিদ্ধার্থ বাবু ছিন্নমূল কদলী-কাণ্ডের মত হুড়মুড় ক’রে প’ড়ে গেলেন। যখন তাঁর জ্ঞান হ’ল তখন তিনি চোখ মেলেই বললেন,―আমি কোথায়? অজয়া–ব’লেই তিনি এমনভাবে চোখ বুজে ফেললেন যেন তাঁর বুকের বোঝা নেমে গেছে।
শুনিয়া পিসিমার মনে, রজতের কথার বকসুরের সূত্র ধরিয়া, আশ্চর্য একটা অন্তর্দৃষ্টির উদয় হইয়া গেল। বলিলেন,―ঐ মূর্ছার ব্যাপারটা আমার সন্দেহজনক মনে হচ্ছে, রজত। তার পরই মনের আর অন্তরাল রইল না। যদি মূর্ছা ভান হয় তবে সে ধূর্ত বটে।
–ভান না হয়ে যায় না―কোথাও কিছু নেই, পরিষ্কার সুস্থ মানুষ, বারাণসীর ষাঁড়ের মত ষণ্ডা বপুখানা; তার মূর্ছা কি খামকাই হয়। মানে এই যে, জ্ঞান হয়েই ধোঁয়াটে মাথায় তোমার নামটি সর্বাগ্রে এসেছে, অতএব, জানো যে, আমি তোমার প্রতি অনুরক্ত। তোমার দাদাও অকুস্থলে উপস্থিত―তাঁকেও সে খবরটা এই সঙ্গেই দিয়ে গেলাম। আপত্তি থাকে ত’, সেটাও স্পষ্ট করে জানাবারও এই-ই সুযোগ।
পিসিমা খানিক ভাবিয়া বলিলেন,―প্রথমত অর্থ ঐ। দ্বিতীয় অর্থ, সে যথার্থ ভালবাসে না। বাসলেও, যে কারণেই হোক, নিজেকে সে অযোগ্য মনে করে; অথবা দুনিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় ডুবে ডুবে। কাজেই মুখোমুখি নিজেকে স্পষ্ট ক’রে তোলবার সাহস তার নেই। কিন্তু একথাও বলতে হবে, তার মূর্ছা ভান ব’লে আমরা অনুমান ক’রে নিয়েছি। যদি লোক ভাল হ’ত―
অজয়া আসিয়া দাঁড়াইল।
কথোপকথনের কতটা তার কানে গিয়াছে তাহা অনিশ্চিত, কিন্তু তার মুখখানা যেন থম্ থম্ করিতেছিল। সেইদিকে চাহিয়া মন্ত্রণাসভার উভয় সদস্যই থম্কিয়া গেলেন। মুখে বলা না হইলেও, পিসিমা ও রজত দু’জনেই মনে মনে জানিতেন যে, তাঁহাদের এই কথাবার্তা গোপন কথাই। অজয়াকে লুকাইয়া একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়া পরে তাহাকে অনুরোধ করিয়া নিরস্ত করিতে হইবে, অথবা সম্মতি দিয়া উৎসবে ব্যাপৃত হইতে হইবে। কিন্তু একটা অনুমানকে ভিত্তি করিয়া এত বড় সত্যকার গুরুতর সমস্যার মীমাংসা করিতে যাওয়া যে শুধু অশোভন নয় অসঙ্গতও, সেই কথাটাই অজয়াকে দেখিয়া তাঁহাদের মনে পড়িয়া গেল।
অজয়া বলিল,–পিসিমা, রায় ত’ দিয়ে বসলে; কিন্তু তার আগে অপর পক্ষের বক্তব্যটা তোমার শোনা উচিত ছিল। বিচারে পক্ষপাতিত্ব দোষ ঘটছে যে!
কিন্তু পিসিমা মেয়ে মানুষ।
কথার মোড় ঘুরাইয়া লইয়া মেয়েলি ছন্দেই তিনি বলিলেন,―শোনো মেয়ের কথা! আমরা কি তোমার শত্রু? তোমারই সুখ আমাদের দেখবার জিনিষ―তা ছাড়া আমরা আর কিছুই ভাবছিনে। কিন্তু তাই ব’লে সামাজিক সম্মানের দিকটাও না ভাবলে ত’ চলবে না।–বলিয়া পিসিমা যেন ভাবনার উত্তাপেই হাল্কা হইয়া মিষ্টি মিষ্টি হাসিতে লাগিলেন।
–কিন্তু এত ভাবনা তোমাদের আমায় লুকিয়ে কেন?
লুকানোটা ঠিক এই ক্ষেত্রে হীনতা না হোক দুর্বলতা নিশ্চয়ই―তাহা রজত বেশ জানে।–বলিয়া উঠিল―তুমি এ কথার মধ্যে এসো না। বিষয়টি বড় জটিল―
―বিপদসঙ্কুল নয়?
–বিপদসঙ্কুল বৈ কি! এ যে জীবন-মরণ সমস্যা! একদিকে তোমার চিরসুখ, সার্থকতা; অন্যদিকে
―থামলে যে?
―কি আর বলি বলো!
কিন্তু পিসিমার বলিবার কিছু ছিল। বলিলেন,―আমাদের আগেকার অনুমানগুলি যদি নির্ভুল হয় তবে, অজয়া, রাগ করো না, সে লোক ভাল নয়।
অনুমান! ক্রোধে অজয়ার মন দপ্দপ্ করিতে লাগিল; বলিল,―পিসিমা, তুমি জানো যে তোমরা যে অপরাধ করছো এখন, তা আমি সইতে পরিনে। তোমাদের অনুমানগুলি কি তা আমি জানিনে, কি যাঁকে তোমরা অনুমানে বিচার করতে বসেছ তিনি এখানে উপস্থিত নেই; শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর ক’রে অনুপস্থিত একটি লোককে অমানুষ সাব্যস্ত করা ঠিক সামাজিক ব্যবহার নয়।
কিন্তু অনুমান ছাড়া উপায় কি? চক্ষুলজ্জা আছে যে―তারপর, অনুমানকে একেবারে অকেজো মনে করিলে মানুষের বার আনা কাজের যে সূত্রপাতই হয় না। কিন্তু রজত এই কথাগুলি প্রকাশ্যে না বলিয়া বলিল,―এমন কতকগুলি অনুমান আছে যা প্রত্যক্ষবৎ সত্য হ’তে বাধ্য। নাড়ী দেখে জ্বর আছে কি নেই বলাটাও বৈদ্যের অনুমান। কিন্তু―
তর্ক করতে আমি চাইনে; কিন্তু এটাও তোমাদের সামনেই আমি বলে যাচ্ছি যে, আমিও তোমাদের চেয়ে অনুমানে কম পটু নই।―বলিয়া যাইতে যাইতে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–মানুষ দেবতা নয়, তাই তার দোষের ভাগটাও ব্যাখ্যার পাণ্ডিত্যে গুণ হয়ে দাঁড়ায় না। আর খাঁটি মানুষ কেবল অনুমানের টানে নেমে অবাঞ্ছনীয় হয়ে ওঠে না। বৈদ্য অনুমান করেন জ্বর থাকা না থাকা―মানব চরিত্র নয়।
অজয়া চলিয়া গেলে সদস্যদ্বয় পরস্পরের দিকে খানিক অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন।
উভয়েরই কর্তৃত্ববোধ ধাক্কা খাইয়া মুখ মলিন করিলেও ন্যায়বোধটা চোখ মেলিয়া চারিদিকে একবার চাহিয়া দেখিল।
কিন্তু অতি অল্প সময়ের জন্য। অজয়া যদি তাহাদের পন্থাকে অন্যায় এবং ব্যক্তি বিশেষের প্রতি অবিচার মনে করিয়া থাকে তা করুক।
রজত গা ঝাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল,―থামলে চলবে না, পিসিমা। দায়িত্ব যে সর্বথা আমাদের! আমি একবার ঘুরে আসি সেই হেমন্তপুর আর লাহোর।
পিসিমা বলিলেন,–আমিও ইত্যবসরে একবার দেখে নিই সেই অদ্বিতীয় লোকটিকে।