অসাধু সিদ্ধার্থ – ২

॥ দুই ॥

ঋণ কিছু কিছু পরিশোধ করিয়া সিদ্ধার্থ পূর্বের বাসস্থান ত্যাগ করিয়াছে। পলায়ন ছাড়া তার আর উপায় ছিল না।

অধুনা সে এইখানে, একটা পার্বত্য জলপ্রপাতের খাদের ধারে।

পাওনাদার পর পর ক্ষুধিত নেকড়ের খড়গের মত অসহিষ্ণু শাণিত দৃষ্টি লইয়া অবিশ্রান্ত তাড়িয়া আসিতেছে না।

তবু সিদ্ধার্থর মরিতে ইচ্ছা করিতেছে। সে পলাতক।

সংসারের যে ধর্ম পালন করিলে মানুষের টিকিয়া থাকিবার বনিয়াদ প্রস্তুত হয়, মানুষে মানুষ বলিয়া মানে, সেই ধর্ম সে পালন করিতে না পারিয়া লোকালয় ত্যাগ করিয়াছে।

সিদ্ধার্থের মনে হইতে লাগিল, সে যেন গলিত কর্দমকুন্ডের কৃমি, মানুষের পাদ―স্পর্শের যোগ্য সে নয়। কোথায় একটু দুর্বলতার ফাঁক ছিল, তাহারই সুযোগ লইয়া দুনিয়া তাহাকে ভুলাইয়া ফুলাইয়া প্রবঞ্চক ইতর সাজাইয়াছে―তারপর তাহাকে গায়ের জোরে ভদ্রসীমার বাহিরে ঠেলিয়া দিয়াছে।

সিদ্ধার্থ খাদের জলের টগ্ বগ্ আলোড়নের দিকে আয়ত লুব্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

শেষ-উপার্জনের টাকা ক’টি সত্য সত্যই করতলের উপর জ্বালিয়া ওঠে নাই; কিন্তু তার স্পর্শ যেন একটা দুরারোগ্য ব্রণ-ব্যধির জ্বালার মত এখনো তার ভিতরে বাহিরে দপ্ দপ্ করিতেছে।

অস্থির জলের নীচে ক্ষুধা তৃষ্ণা আর বিবেক-দংশনের পরম-শান্তি যেন মিলনাকুলা প্রেয়সীর মত তাহাকে গ্রহণ করিতে বাহু মেলিয়া বুক পাতিয়া বসিয়া আছে।

প্রপাতের খরস্রোত খাদের গর্ভে লাফাইয়া নামিতেছে।

একটা ক্রুদ্ধ আহ্বান-গর্জনের মত অবিরাম অনন্ত তার শব্দ; উৎক্ষিপ্ত চূর্ণ জলের প্রতি কণায় ইন্দ্রধনুর সবগুলি রং ফুটিয়া উঠিয়াই ভাঙিয়া পড়িতেছে।

মরিতে হয় ত এইখানে। পিছন হইতে কে যেন দু’হাতে তাহাকে গহ্বরের দিকে ঠেলিতে লাগিল―নিষ্পলক চক্ষু তার ঠিক্রাইয়া উঠিয়া জলের দিকে চাহিয়া রহিল।

সে জলে আকাশের প্রতিবিম্ব নাই।

কিন্তু যেন আকাশ ছাপাইয়া পরলোকের প্রতিবিম্ব তাহার অন্তরে সজীব হইয়া উঠিয়া আকর্ষণ করিতেছে; কেবলি বলিতেছে, আয়! আয়!

হয়তো সিদ্ধার্থ মরিত। কিন্তু অনিশ্চিত সুনিশ্চিত হইবার পূর্বেই ঘটনাচক্র আর এক পাক ঘুরিয়া গেল।

জলের ডাকে মৃত্যুর আহ্বান শুনিতে শুনিতে কি মনে করিয়া হঠাৎ পিছন ফিরিয়াই সিদধার্থ যেন থম্‌কিয়া আকাশ বাতাসের মাঝে দিক্ ভ্রান্ত হইয়া গেল―তার শীতল রক্ত দেখিতে দেখিতে জরাক্রান্তের নাড়ীর মত উদ্দাম হইয়া উঠিল।

অতলে গর্জন করিতেছে মৃত্যু।

কিন্তু সম্মুখ দিয়া ভাসিয়া গেল অশেষ জীবনের নিগূঢ় ইঙ্গিত―অসীম আঁধার―সাগরের উপর জোতির্ময় শতদল ফুটিয়া উঠিয়া তাহারই অঙ্গপ্রভায় দিগন্ত পর্যন্ত স্বর্ণপ্রভাতের মত উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সম্মুখে কত রঙের মেঘ স্তরে স্তরে সাজান, রঙের আর শেষ নেই―স্তরের প্রান্তরেখায় তরল সোনার ঢেউ; পীত মেঘের গর্ভান্তরাল হইতে অসংখ্য সূক্ষ্ম রশ্মির সূত্রগুলি ছুটিয়া বাহির হইয়া আকাশের মধ্যস্থল অম্‌নি একটু স্পর্শ করিয়াই মিলাইয়া গেছে রুগ্ন সন্তানের মুখের উপর জননীর নিঃশ্বাসের মত বায়ু অতি সতর্ক; পুষ্পস্তর হিল্লোলে হিল্লোলে আকাশের গা বাহিয়া ক্রমে ঊর্ধ্বে উঠিয়া দিক্―সীমানায় লীন হইয়া গেছে। এই ছবিটা সিদ্ধার্থের আগে চোখে পড়ে নাই।

যাহাকে দেখিয়া সিদ্ধার্থ এই রূপবর্ণাঢ্য প্রকৃতির প্রাণের মধ্যে জাগিয়া উঠিয়াছে, অস্তোন্মুখ সূর্যের হিঙ্গলাভা তার মুখে পড়িয়াছিল।

চক্ষু দু’টি কৌতুকোজ্জ্বল―

সর্বাঙ্গে গতির লীলা-তরঙ্গ―

পা দু’খানির সাড়া পাইয়া মাটি যেন আগাইয়া আসিয়া বুক পাতিয়া দিতেছে। একটুখানি হাসি তার অধরে ছিল―যেন স্বর্গচ্যুত অমৃতের কণাটি, প্রাণের সব মধু যেন অধরপ্রান্তে উথলিয়া লীলা উঠিয়াছে।

সিদ্ধার্থর মনে হইল জীবনের অন্তহীন ধারা একটি মাত্র স্তবকে সীমাবদ্ধ হইয়া একটি রেখার সম্মুখে গতিহীন হইয়া পড়িয়াছে। ঐ রেখাটি উত্তীর্ণ হইতে সিদ্ধার্থর মন কিছুতেই চাহিল না।

সিদ্ধার্থর মরা হইল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *