॥ চার ॥
জলের চেয়ে রক্ত গাঢ় ইহা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই কথাটি যে, রোগের বীজের মত অভ্যাসও যেন রক্তের আশ্রয়েই চিরজীবী হইয়া থাকিতে চায়।
এই কথাটি সিদ্ধার্থ সময় সময় ভুলিয়া যায়; সে ভাবে, তার মস্তিষ্কের বিচ্যুতি, আত্মবিস্মৃতি। মনে করে, যা করিতেছে তা ছাড়া উপায়ান্তর নাই; কিন্তু অনতিবিলম্বেই চেতনার মূর্ছা কাটিয়া সহস্ৰ দিকে সহস্ৰ পথ দেখিতে পাইয়া তার মর্মদাহের অন্ত থাকে না। যে পথে সে হঠাৎ এ সময় চলিতে থাকে সে পথে তাহাকে লইয়া যায় তার বিভ্রান্ত আত্মবিস্মৃতি নহে, তার বিগত এবং বিস্মৃত অভ্যাস।
অতিশয় হীন সংস্রবে জীবনের দীর্ঘদিন সে কাটাইয়াছে। তাই তার আহরিত শিক্ষার ফলটিকে আবৃত করিয়া মাঝে মাঝে পাঁকের বুদ্ উঠিতে থাকে।
.
―মদনের আজ কি কান্না, দিদিমণি! –বলিয়া হাসিমুখে ননী আসিয়া দাঁড়াইল। ননীর পরিচয়টা দি―
কিন্তু ননী অজয়ার কে তাহা সংক্ষেপে ঠিক করিয়া বলা কঠিন; অন্য কোথাও হয় তো এরূপ অবস্থায় প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কই দাঁড়াইত!
কিন্তু অজয়া তাহাকে নিম্নস্তরের ভিতর কুড়াইয়া পাইয়াও সখীর আসন দিয়াছে। ননীকে খাটাইতে অজয়ার বাধে না। ননীও, যেন নিজেরই সব, এমনি করিয়া আলায়।
অজয়া সেলাই করিতেছিল। মদনের কান্নার সংবাদে মুখ তুলিয়া বলিল,―তোর ধারা পেয়েছে বুঝি! আমার গান শুনে নিশ্চয়ই।
―না গো না; তাহ’লে ত’ বুঝতাম, লোকটা কেবল রাঁধে না, কাঁদতেও জানে।
―তবে?
―শোনো মজা। আমি ব’সে কি একটা করছি, মদ্না কোথা থেকে ছুটে এসে আমার সামনে ব’সে পড়েই হু হু ক’রে চোখের জল ছেড়ে দিল। জল কি দু’এক ফোঁটা! ঘড়া ঘড়া গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি বলি, কাঁদিস কেন? কাঁদিস কেন? মদ্না কেবল বলে, আমি ম’রে যাব। জিজ্ঞাসা করলাম, বাড়ী থেকে খারাপ খবর এসেছে? বললে, না। তারপর কায়ক্লেশে কান্নার কারণ যা বললে তা তোমাকে বলতে বারণ ক’রে দিয়েছে। বলব কি না ভাবছি।
ননী বলিতেই আসিয়াছিল। “বলব কিনা ভাবছি” বলিয়া সে অনর্থক অপেক্ষা করিতে লাগিল।
অজয়া বলিল,–আমি শুনতে চাইনে। কিন্তু কান্না থেমেছে ত’?
―আপাতত মুলতুবী আছে, কিন্তু জল কখন আবার নাববে তার কিছু ঠিক নেই। তোমাদের খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ঘটনা এমনি সাংঘাতিক। সে বলতে বলেছে দাদাবাবুকে, কিন্তু তোমাকেই বলি; তুমিই না হয় তাঁকে ব’লো। ছেলেবেলা থেকেই নেশাটা আস্টা করে, কিন্তু গাঁজা খায়। এখন, কলকাতা থেকে সম্বল যা এনেছিল তা প্রায় শেষ ক’রে এনেছে। এ মুলুকে আবগারী দোকান বোধ হয় নেই; ফুরিয়ে গেলে কি হবে তাই ভেবে সে ক্ষেপে উঠেছে। তোমরা যদি পরিচিত কাউকে চিঠি লিখে ভরিটাক্ আনিয়ে দিতে পারো তবেই বাঁচবে, নতুবা সে লাফিয়ে বেড়াবে কি বিছানা নেবে তা সে জানে না।
অজয়া হাসিতে লাগিল; বলিল,―মিলেছে সব ভালই। বলিস তাকে, আনিয়ে দেওয়া যাবে।
―তুমি শুনেছ সে যেন জানতে না পারে। জানতে পেলে আমায় মাছের কাঁটা খাইয়ে মারবে।
মদন অজয়াদেব পাচক। অজয়া বলিল,–তুই ম’লে ত’ আমি বাঁচি, হাড় জুড়োয়।
―–তাই ব’লে কি আজই বিদায় করতে চাও? তা আমি যাচ্ছিনে। তোমার চেয়েও আমার যে আপনার তাকে তুমি এনে দেবে, তাকে দেখে তবে আমি মরব-অবিশ্যি যদি তখন মনে পড়িয়ে দাও।
―তবেই তুমি এ জন্মে মরেছ। তালগাছ―
দরজার বাহির হইতে হঠাৎ একটা ফুলের তোড়া আসিয়া ঘরের মধ্যে পড়িল –এবং দৃপ্দাপ্ পায়ের শব্দ মাত্র কয়ে মুহূর্ত শোনা গেল―
―কে রে?
ননী বলিল,―আর কে রে! সে পালিয়েছে।
―দেখত ননী, কে!
ননী বাহিরটা দেখিয়া আসিল―কিন্তু রাস্তা জনশূন্য। বলিল―কেউ কোথাও নেই ত’!
ইতিমধ্যে অজয়া তোড়াটি তুলিয়া লইয়াছে। সেটা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে দেখিতে বলিল,―সুন্দর তোড়াটি ত! সাজিয়েছেও বেশ―সাতভাই চম্পার মত সাতটি ফুল, মাঝখানে একটি স্থলপদ্ম। এ কি!
স্থলপদ্মের মৃণালের সঙ্গে ছোট একখানা কাগজ জড়ান রহিয়াছে।
অজয়া সেখানা টানিয়া বাহির করিল―পরিষ্কার হস্তাক্ষরে তাহারই নাম লেখা―আস্তে আস্তে ভাঁজ খুলিয়া সে নিঃশব্দে পড়িতে লাগিল―অল্প অল্প হাসিতে লাগিল―যেন গল্প লিখিতেছে।
কিন্তু হাসিতে হাসিতে অজয়ার মুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল; তোমরা যেন আকাশ থেকে পড়ে হাঁ ক’রে ব’সে আছ! ব্যাপারখানা কি? তোমার হাতে ও কাগজ কিসের? কোনো দুঃসংবাদ আসেনি ত?
―না। প’ড়ে দেখ।
―তবু ভাল।―বলিয়া কাগজখানা হাতে লইয়া চেয়ারে বসিয়া রজত পা ছড়াইয়া দিল। এবং আলোর সম্মুখে কাগজখানা ধরিয়া টিপ্পনী জুড়িয়া জুড়িয়া পড়িতে লাগিল―
নিরানন্দস্থানে একটি নিষ্পত্র বৃক্ষ; তারি একটি ডালে দড়ি বেঁধে এক ব্যক্তি তার ধিকৃত অসহ্য জীবন শেষ করতে এসেছিল। (সর্বনাশ!)―দড়ি বাঁধছে এমন সময় একটা পাখী এসে সেই গাছেরই ডালে ব’সে গান সুরু ক’রে দিলে। (হতভাগা পাখী।)―যে মরতে এসেছিল সে ভাবলে, যখন পৃথিবীতে এত নিরানন্দ স্থান কোথাও নেই যেখানে পাখী গান করে না তখন আমি বাঁচব। (উত্তম প্রস্তাব। )
“এই পাহাড়ে আমি এসেছিলাম জীবনে বীতস্পৃহ হয়ে মরতে। (ঠিক)―ইতিমধ্যে তোমায় দেখলাম―”
এইখানে রজত কাগজখানা উল্টাইয়া শিরোনামটি পড়িল। অজয়া তাহাতে অকারণেই লজ্জা পাইয়া মাথা নোয়াইল।
―তারপর মহাশয় লিখছেন,―বলিয়া আরম্ভ করিয়া রজত পড়িতে লাগিল―
“কে যেন আমায় বাঁচতে বললে। (পাখী-টাখী হবে।) ―আমি বাঁচব। (খাসা কথা! আমি বাঁচি কি মরি তোমার তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি কি! (কিছুই না।)―আমি আজই এ স্থান ত্যাগ ক’রে যাবো; তুমি জানতে পারবে না, কাকে তুমি বাঁচিয়েছ; কে তাই তোমায় এমন হঠাৎ জানিয়ে গেল।” কাগজের দিকে চাহিয়াই রজত বলিতে লাগিল,―সমাপ্তির ইতি নেই, স্বাক্ষর নেই, তথাপি ধন্যবাদ তোমায়, হে অজ্ঞাতনামা আত্মহত্যা মহাপাপ―তার উপর সন্ধ্যার অন্ধকারে সে দৃশ্যটাও উপযোগ হ’ত না। এত লোকের সঙ্গে পথে দেখা হয় পাগলের মত চেহারা ত’ কারো দেখিনি! ননী, চা। আমি তার স্বাস্থ্য পান করবো।―বলিয়া রজত তেমনি নিঃস্পৃহ আল্ল্গা সুরেই শেষ করিল।
কিন্তু ঐ কাগজ উল্টাইয়া ঠিকানাটা দেখিবার পর হইতেই যে তাহার হাল্কা কন্ঠের সরসতায় ঘৃণ্যক্ষরের মত একটা দ্বিধার দৌর্বল্য মিশিয়া গিয়াছিল তাহা বোধ হয় নিজেও সে অনুভব করিতে পারে নাই; পারিয়াছে কেবল নারী দু’টি।
ননী নিঃশব্দে চা আনিতে চলিয়া গেল। এবং অজয়া যখন দাদার দিকে চোখ ফিরাইল তখন তাহাতে তাহার হৃদয়ের সুকোমল প্রসন্নতার ছায়ামাত্রও নাই।
ব্যাপারটা যে বড় অস্বাভাবিক।
কিন্তু অজয়া স্বাভাবিক সুরেই বলিল,―পাগলের কর্ম এটা নয়। নানারকম খোঁজ নিয়েছে―আমাদের দেখেছে, বাড়ী চিনে গেছে। কাগজখানা দাও ত’ রেখে দি।
রজত বলিল,–এ পাহাড় ও-পাহাড় ক’রে বড্ড বেড়িয়েছি আজ। বেড়াতে বেড়াতে এমনি তন্ময় হয়ে পড়ি য ক্ষিদে ভুলে যাই।
―তুমিই একদিন বিপত্তি ঘটাবে দেখছি; গহ্বরে পড়ে তলিয়ে যাবে, কি গড়িয়ে প’ড়ে মাথা গুঁড়ো ক’রে আসবে।
পাগল! তন্ময় হয়ে পড়িয়া ব’লে কি চোখ বুজে চলি? হাত-পা-মাথাকে আমি যথেষ্ট ভালবাসি, তাদে মঙ্গল অমঙ্গল বিষয়ে আমি খুব সজাগ―দেহে জোর পেয়েছি কত! মনে হয় যেন পাহাড়ের মাথাটা দরতে পারলে তাকে নুইয়ে এনে ধনুকের মত গুণ পরাতে পারি।
―তা পার কি না জানিনে, কিন্তু একটা কথা রাখবে?
―কি কথা? খুব ভারি কি?
―কথা দাও, এই কথাটা আর কখনো তুলবে না।
―কোন্ কথাটা?
―এই চিঠির কথাটা।
―দায় পড়েছে। আমি ত’ ছেলেমানুষ নই যে ঐ খেলনা পেয়ে দিনরাত খেলা করব।
―তা জানি; কিন্তু এই ঘটনার সংস্রবে আমাদের কাজটা কোথায় তা তুমি বুঝেও হয় তো বুঝবে না; তোমার তাই সতর্কতার অন্ত থাকবে না, পদে পদে আমায় লজ্জা দেবে।
শুনিয়া রজত হা হা করিয়া হাসিতে লাগিল।
বলিল,―তা দেব না। তবে সাবধান থাকা দরকার বৈ কি! যদি পাগল না হয়ে চোর হ’ত?―মদন-মাণিক করছিল কি? ডাকো তাদের।
মদন হাত জুড়িয়া আসিয়া দাঁড়াইল।
মাণিক তাহার আড়ালে দাঁড়াইয়া কাঁধের উপর দিয়া উঁকি মারিতে লাগিল।
অজয়া বলিল,–মদনের আট আনা জরিমানা; মাণিকের এক টাকা। তোরা কি ঘুমুচ্ছিলি?
চোখ দেখিলেই বুঝা যাইবে যে সে ঘুমায় নাই―ইহাই মনে করিয়া মাণিক মদনকে একদিকে ঠেলিয়া দিয়া স্পষ্ট প্রকট হইল।
হাজার হোক সে বাঙালী। বলিল,-না, দিদিমণি, সন্ধ্যেবেলাই ঘুমুবো কেন!
―তবে কি কাজে তন্ময় ছিলে যে একটা বাজে লোক বাড়ীতে ঢুকে বেরিয়ে গেল; তোমরা কেউ তার আওয়াজ পেরে না―কেন?
অপরাধ সত্যই ঘটিয়াছে―তর্ক বৃথা, কান্নাকাটি, প্রতিবাদ, কৈফিয়ৎ সবই এখানে এবং এখন বৃথা, মাণিক তাহা জানে। শাস্তি মানিয়া লইয়া নিঃশব্দে একটা সেলাম বাজাইয়া মদনকে টানিয়া লইয়া সে চলিয়া গেল।
.
ননী চা দিয়া গেল।
লম্বা করিয়া একটা হাঁফ ছাড়িয়া রজত বলিল,―এদিক্কার ত’ সব একরকম মিটল। এখন আমার চায়ের কি হবে তা িহয়েছে ভাবনা।
অজয়া বলিল,―আমারও সেই ভাবনাই হয়েছে।
―আমি তোমার দাদা হই। আমি খালি ভাবি না, কাজও করি। আমার ইচ্ছে যে, আমার বোনটিও ঠিক তেমনি হয়।
―একটি দাদা থাকা মন্দ নয়, সব বিষয়েই ভাল; কেবল যদি―
―গান গাইতে না বলে তবেই ষোল-আনা ভাল হয়―এই না কথার শেষ কথা তোমার? কি করবো দিদি! ভগবান সব দিয়েছেন, শুধু কণ্ঠে বঞ্চিত করেছেন, কিন্তু সে―ক্ষতি পূরণ ক’রে দিয়েছেন তোমায় আমার বোন ক’রে―চা-টা মাটি করেই দিলে। ননী, দিদি আমার, আর এক পেয়ালা―যদি পারো, যদি অসুবিধে না হয়, যদি―
অজয়া জোগাইয়া দিল,–না ঘুমিয়ে থাকো।
ননী পাশের ঘর হইতে বলিল,–ঘুমুইনি, আনছি।
এতগুলি কথার খরচ হইল শুধু এই কারণে যে, রজত সন্ধ্যাবেলায় চায়ের সঙ্গে একটি করিয়া অজয়ার গান শোনে। তার নাকি মনে হয় চায়ের সঙ্গে ঐ গানটি না শুনিলে ব্যাপার সঙ্গীন হইয়া এমন কি তার ক্রোধের উৎপত্তিও ঘটিতে পারে।
কিন্তু আজকার মত রাগের কারণ ঘটিল না।